আধুনিকতা, উত্তর-আধুনিকতা এবং আমরা

সমকাল সব সময়ই আধুনিক। এই ধারণা কাল নির্ভর, সময়ের পরিপ্রেক্ষিতেই এমন ধারণা এবং বিশ্বাসের উৎপত্তি। সাধারণ আলোচনায় বর্তমানের সঙ্গে অতীতের ভেদরেখাসূচক এই অভিধায় পরিচিতিমূলক বিশেষ বৈশিষ্ট্যের ভূমিকা গৌণ, এমনকি  সেসব উহ্যই থাকে। সমকাল আধুনিক হবে, এটা স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেওয়াই নিয়ম। এই ‘বিবেচনায়’ ‘আধুনিক’ একবার নয়, যতদিন অতীতকে পিছনে রেখে বর্তমান এসেছে প্রতিটি সমকালকেই আধুনিক বলা হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও এভাবে বলা হবে। এই আধুনিক নির্গুণ, বৈশিষ্ট্যহীন, কেবল সময়ের পরিবর্তন নির্দেশক একটি বিশেষণ যার পুনরাবৃত্তি হয়ে চলেছে। শিল্পে এবং সাহিত্যে ‘আধুনিক’ ব্যবহার করা হয়েছে সময়ের পরিবর্তনের পরিচিতি হিসেবে নয়, বিশেষ গুণ, বৈশিষ্ট্য এবং প্রবণতার ধারক, এটা প্রণিধানের জন্য। এইসব বৈশিষ্ট্য, গুণ ইত্যাদি সময়ের পরিক্রমায় একবারই এসেছে, তাদের পুনরাবৃত্তি হয়নি, হলেও সর্বাংশে নয়, আংশিকভাবে। তবে এই ‘আধুনিক’ শিল্প, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান এবং জ্ঞানচর্চা ও অনুশীলনের সব শাখায় একই সময়ে আবির্ভূত হয়নি অর্থাৎ তাদের ইতিহাস শুরু হয়েছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে। আবার এও দেখা গিয়েছে যে, দেশ বা মহাদেশের শিল্প, সাহিত্য ইত্যাদির ইতিহাসে ‘আধুনিক’ পর্বের  সূচনা হয়েছে  ভিন্ন সময়ে। যেমন, ইউরোপ এবং ভারত উপমহাদেশে শিল্পে ও সাহিত্যে আধুনিক পর্ব শুরু হয়েছে বিভিন্ন সময়ে।

শিল্পে, সাহিত্যে ‘আধুনিক’ পর্ব সম্বন্ধে ওপরে যা বলা হয়েছে, ‘উত্তর-আধুনিক’ সম্বন্ধেও একই কথা প্রযোজ্য। ‘আধুনিক’-এর মতো ‘উত্তর-আধুনিক’ও গুণবাচক একটি শব্দ, এর কালিক পরিচয় ইতিহাসে নিরূপণের স্বার্থে, তা বৈশিষ্ট্যের দ্যোতক নয়।

আলোচনায় ‘আধুনিক’ এবং ‘উত্তর-আধুনিক’ শব্দ দুটির পাশাপাশি ‘আধুনিকতা’ এবং  ‘উত্তর-আধুনিকতা’ কথা দুটিও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ব্যাকরণের ভাষায় বলতে গেলে, প্রথম  দৃষ্টান্তে শব্দ দুটি বিশেষ্য এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে  তারা বিশেষণ। ‘আধুনিক’ এবং  ‘উত্তর-আধুনিক’ বলা হলে দুটি সাধারণ পরিচয় দেওয়া হয়। অপরদিকে  ‘আধুনিকতা’ এবং ‘উত্তর-আধুনিকতা’ গুণবাচক, এদের দ্বারা তাদের বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায় বা এরা সেইসব গুণ এবং বৈশিষ্ট্যের প্রতি ইঙ্গিত দেয়।

দুই

আধুনিক এবং উত্তর-আধুনিকের আলোচনায় তাদের গুণ এবং বৈশিষ্ট্যই আলোচনার কেন্দ্রে থাকে। কিন্তু কোনো সময়ে তাদের সূচনা এবং সমাপ্তি (যদি হয়ে থাকে) সে-বিষয়ে অবহিত হওয়াও গুরুত্বপূর্ণ, কেননা শিল্পে-সাহিত্যে এইসব পর্ব তাদের সময়ের রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি পরিবেশগত এবং যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন করে এবং তাদের দ্বারা কোনো না কোনোভাবে প্রভাবান্বিত হয়েছে। তবে এদের সূচনা নির্ধারিত বছরে একজনের লেখার মাধ্যমে হয়েছে, এ কথা বলা যৌক্তিক হবে না। শিল্পে-সাহিত্যে বাঁক বদল বা নতুন ধরনের সৃষ্টি কোনো এক বছরে, নির্দিষ্ট কোনো লেখকের লেখার ভিত্তিতে হয়েছে, এ-কথা বলার উপায় নেই। সেজন্য কয়েকটি বছরের সময় পর্বকে এই উদ্দেশ্যে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। যেহেতু শিল্পে-সাহিত্যে আধুনিকতা, উত্তর-আধুনিকতা ইত্যাদি ধারার আলোচনা পাশ্চাত্যের বিদ্বজ্জনের গবেষণার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়েছে এবং সেটিই আমরা গ্রহণ করেছি সেজন্য এই অনুচ্ছেদের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় তাঁদের নামই উল্লেখ করা হবে।

শিল্পসাহিত্যে আধুনিকতা সূচিত হয়েছে মধ্যযুগের পর যখন মানুষ পারলৌকিকতার সার্বভৌমত্ব থেকে বেরিয়ে এসে ইহজীবনকে প্রাধান্য দিয়ে মানবতাবাদের দর্শনে দীক্ষিত হয়। ইতালির দ্বাদশ শতকের রেনেসাঁ শেখালো পৃথিবীর কেন্দ্রে মানুষ এবং মানুষকে দিয়ে সবকিছুর মূল্যায়ন করতে হবে অর্থাৎ মানুষের মনের উৎকর্ষ এবং তার কল্যাণ দিয়েই বিচার করতে হবে সকল চিন্তা-ভাবনা এবং কর্মকাণ্ডকে। কারো মতে আধুনিকতার শুরু আঠারো শতকে আলোকায়ন বা এনলাইটেনমেন্টের যুগে যখন যুক্তিকে আলোকিত মানুষ গ্রহণ করেছে সব  চিন্তা-ভাবনা এবং কাজের চালিকাশক্তি হিসেবে। এই এনলাইটেনমেন্টের পিছনে ছিল বৈজ্ঞানিক আবিস্কার। তবে অধিকাংশ সাহিত্য সমালোচক এবং ঐতিহাসিকের মতে আধুনিকতা শুরু হয়েছে উনিশ শতকের শেষ ভাগ থেকে এবং শেষ হয়েছে বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। আধুনিকতার দেশভিত্তিক আবির্ভাবের হিসাবে বলা হয়েছে যে, ১৮৯০ থেকে ফ্রান্সে, ১৮৯০ থেকে ১৯২০-এর সময়কালে জার্মানিতে, ১৯০০ থেকে ১৯২০-এর মধ্যে রাশিয়ায়। প্রথম মহাযুদ্ধের কিছু আগে থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে আধুনিকতার বিকাশ ঘটেছিল।

আধুনিকতার ঠিক কখন শুরু আর সমাপ্তি, সেই বিষয়টি যে কালিক বিচারে নির্ধারণ করা যায় না তার প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করে রবীন্দ্রনাথ ‘আধুনিক কাব্য’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন : ‘পাঁজি মিলিয়ে মডার্নের সীমানা নির্ধারণ করবে কে? এটা কালের কথা ততটা নয় যতটা, ভাবের কথা।’ সুতরাং অন্তিম বিচারে শিল্পসাহিত্যের আধুনিকতা নির্ভর করে সেসব ক্ষেত্রে সৃষ্টি আধুনিকতার গুণাবলি এবং বৈশিষ্ট্য ধারণ করে কি না। এই মাপাকাঠি ব্যবহার করা হলে দেখা যাবে আধুনিকতার নির্ধারিত সময়কালের আগে এবং পরেও আধুনিকতার গুণসম্পন্ন  শিল্পসাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে। এই বিষয়টির ওপর অন্যদের মধ্যে স্টিফেন স্পেন্ডার তাঁর দি স্ট্রাগল অব দি মডার্ন (১৯৬৩) বইয়ে বেশ যুক্তিপূর্ণ আলোচনা করেছেন। সুতরাং আধুনিকতার (এবং অন্য পর্ব) বিচার করতে গিয়ে সৃষ্ট কাজের গুণাবলি এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই প্রাধান্য পায়।

উত্তর-আধুনিকতা, বলা বাহুল্য, সূচিত হয়েছে আধুনিকতা শেষ হওয়ার পর। যেহেতু আধুনিকতার সমাপ্তি নিয়ে মতভেদ আছে, সেজন্য কালিক নিরিখে উত্তর-আধুনিকতার সঠিক, বিশেষ করে সর্ববাদীসম্মত সময়-ব্যাপ্তি নিয়েও ভিন্ন ভিন্ন মত আছে। তবে অধিকাংশের ধারণা, উত্তর আধুনিকতার সূচনা হয়েছে সত্তরের দশকে এবং আধুনিকতার মতো এরও আবির্ভাব হয়েছে ইউরোপে। ব্যাপ্তি  ও গভীরতায় আধুনিকতার তুলনায় উত্তর-আধুনিকতা যে বহুবিস্তৃত, বিষয় এবং মিথস্ক্রিয়ায়, সে বিষয়েও মোটামুটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আধুনিকতা যেখানে শিল্প এবং সাহিত্যেই (গৌণভাবে স্থাপত্যে) সীমাবদ্ধ থেকেছে উত্তর-আধুনিকতা ধারণ করেছে এই দুটি জনপ্রিয় শাখা ছাড়াও স্থাপত্য, দর্শন, জ্ঞানতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, রাজনীতি, নৃতত্ত্ব ইত্যাদি শাখার  বিষয়। উত্তর-আধুনিকতাকে বলা যায় একাধিক বিষয়ভিত্তিক ডিসকোর্স বা আলোচনা। এর সূচনা ইউরোপে, বিশেষ করে ফ্রান্সে হয়েছে, এই মতের প্রবক্তার সংখ্যা বেশি হলেও আমেরিকাও এই কৃতিত্বের দাবিদার বলে কেউ কেউ মনে করেন এবং এর সপক্ষে ইহাব হাসানের লেখার (টুয়ার্ড এ পোস্ট মডার্ন লিটেরেচার, ১৯৮২) উল্লেখ করেন। ফ্রেডারিক জেমসন এবং রিচার্ড রোর্টি, দুই আমেরিকান বুদ্ধিজীবী, পরবর্তীকালে উত্তর-আধুনিকতার আলোচনায় অবদান রেখেছেন।

সবশেষে, অধিকাংশ ঐতিহাসিক এবং সমালোচক উত্তর আধুনিকতা এখনো সক্রিয় মনে করলেও কেউ কেউ উত্তর-উত্তর-আধুনিকতার উল্লেখ করেছেন, যে-প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে উত্তর আধুনিকতা ১৯৮০-র দশক থেকে দুর্বল হয়ে উত্তর-উত্তর আধুনিকতার পথ প্রশস্ত করেছে। এদের মধ্যে জেফ্রি নীলন  তাঁর  লেখা, পোস্ট পোস্ট-মডার্নিজম (২০১২) বইয়ে  ফ্রেডারিক জেমসনের উত্তর-আধুনিকতার বিরুদ্ধে লেখা,  কালচারাল লজিক অফ লেট ক্যাপিটালিজম (১৯৯১)-এর মূল প্রতিপাদ্য অস্বীকার করে বলেছেন পুঁজিবাদ তার সাময়িক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে শুধু অর্থনীতির ক্ষেত্রে মুনাফার জন্য উৎপাদন অব্যাহত রাখেনি, শিল্পসাহিত্যের স্বয়ংম্ভর ক্ষেত্রেও অনুপ্রবেশ করে উৎপাদন আরো বেশি মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ করছে। এই বেশি মাত্রায় (intensification) নিয়ন্ত্রণকেই জেফ্রি নীলন উত্তর-উত্তর আধুনিকতার লক্ষণ বলে চিহ্নিত করেছেন।

তিন

বলা বাহুল্য, বুদ্ধিবৃত্তির চর্চায়  এবং আলোচনায় ও  সমালোচনায় আধুনিকতা এবং উত্তর-আধুনিকতার গুণ, বৈশিষ্ট্য এবং প্রবণতার বিষয়ই প্রাধান্য পেয়েছে এবং আলোচনায় এসেছে। উত্তর উত্তর-আধুনিকতা তেমন উল্লিখিত হয়নি। নিচে সংক্ষেপে   শিল্পে, সাহিত্যে এবং চলচ্চিত্রে এই দুটি শব্দের, আধুনিকতা এবং উত্তর-আধুনিকতা, গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্যের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হলো। এই গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ আধুনিকতা এবং উত্তর-আধুনিকতার ওপর লেখা অসংখ্য বইপত্রে আছে যা অনুসন্ধানী পাঠকের জানা। এখানে সেসবের উল্লেখ করা হলো এই জন্য যে, এদের সূত্রেই পরবর্তী সেকশনে আমাদের শিল্পসাহিত্যে আধুনিকতা এবং উত্তর-আধুনিকতার আলোচনা করা হবে, যা এই লেখার প্রধান উদ্দেশ্য।

আধুনিক সাহিত্যে আধুনিকতার যুগ রোমান্টিসিজমের  পরে এসেছে কিন্তু পূর্ণ বিরোধিতা করে নয়, বিবর্তনের পথে। সেই জন্য আধুনিকতায় যে ‘নতুন’-এর আবাহন তার মধ্যে পুরাতন অর্থাৎ রোমান্টিক কল্পনা বিভিন্নভাবে উপস্থিতি আছে। কিন্তু এই উপস্থিতি আগের স্বরূপে নয়, আধুনিকতার মোড়কে। অর্থাৎ রোমান্টিক ভাবনা এক নতুন রসায়নে আধুনিকতার মূল স্রোতের সঙ্গে মিশেছে। এই পুনঃমিশ্রণ রোমান্টিকতাকে নতুন ভূমিকা দিয়েছে। স্টিফেন স্পেন্ডার আধুনিকতায় রোমান্টিকতার আত্তীকরণকে দেখেছেন ভাষার ব্যবহারে রূপান্তর হিসেবে, কল্পনার ভূমিকা নামবাচক থেকে ক্রিয়াবাচকের চালিকাশক্তির  পরিণতিতে। রোমান্টিক ভাবালুতা এবং কল্পনা কবি এবং শিল্পীকে নিজস্ব ভাবনার আলোকে বাইরের পৃথিবীকে পুনর্নির্মাণ করতে সাহায্য করে, যেখানে বাইরের পৃথিবীর রূপে-সৌন্দর্যের প্রলেপ পড়লেও তার মৌলিক পরিচয় হারায় না বা অস্পষ্ট হয় না। কিন্তু আধুনিক কবি যখন কল্পনাকে ক্রিয়াপদ হিসেবে ব্যবহার করে  যে পৃথিবী নির্মাণ করেন সেটি একান্তই তার নিজস্ব পৃথিবী, বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তার মিল নেই। আধুনিক কবি রূপান্তরিত কল্পনা দিয়ে নতুন পৃথিবী নির্মাণ করেন সাবজেক্টভিটি বিসর্জন দিয়ে, রূপক ও প্রতীকের সাহায্যে। এলিয়ট আরো স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘যে আমি আনন্দ-বেদনায় উদ্বেলিত হয়, তার সঙ্গে যে শিল্প সৃষ্টি করি তারা পৃথক।’ কবিতায় যেমন উপন্যাসেও আধুনিক লেখক বস্তুবাদী, নৈর্ব্যক্তিক এবং নির্মোহ। (ÔTradition and Individual Talent,Õ 1919)।

শিল্পসাহিত্যের ইতিহাসের পরিহাস হলো এলিয়ট থেকে শুরু করে অনেক আধুনিক কবির কবিতা রোমান্টিকতামুক্ত নয়। তাঁরা মূলত রোমান্টিক চেতনারই কবি। রোমান্টিকতা কবিতার আদিমতম প্রেরণা যেজন্য সম্পূর্ণ  পরিত্যাজ্য হতে পারে না। আধুনিকতায় রোমান্টিক পর্বের কল্পনা কিছুটা পরিশীলিত হলেই শর্ত পূরণ হয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে।

আধুনিকতা দৃশ্যমান পৃথিবী  এবং যাপিত জীবনকে দেখতে চেয়েছে শুধু কল্পনার রূপান্তর ঘটিয়ে নয়, প্রকাশভঙ্গিকে প্রত্যক্ষ থেকে পরোক্ষ করে যা মূর্ত এবং অভিব্যক্ত হয়েছে নতুন আঙ্গিক এবং ন্যারেটিভের উদ্ভাবনে। এরই অন্বেষণের ফলে এসেছে শিল্পসাহিত্যে নতুন ধারা যেসব আন্দোলন নামেও পরিচিত হয়েছে। যেমন, সাহিত্যে ন্যাচারালিজম, ইমেজিজম, নিউ ফিকশন, ইন্টেরিওর মনোলিগ, স্ট্রিম অব কনশাসনেস, চিত্রকলায় ইম্প্রেশনিজম, স্যুররিয়েলিজম, অ্যাবস্ট্র্যাক্ট  এক্সপ্রেশনিজম ইত্যাদি। শিল্পে আঙ্গিক এবং সাহিত্যে ন্যারেটিভ  নিয়ে, গতানুগতিকতা পরিহারের চেষ্টা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, আধুনিকতার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য।

তৃতীয় যে বৈশিষ্ট্য আধুনিকতাকে চিহ্নিত করেছে সেটি শিল্পে-সাহিত্যের বিষয়ে অসুন্দর, কুৎসিৎ, ভয়ংকর, অশুভ এবং অমঙ্গলের অন্তর্ভুক্তি। উনিশ শতকের রোমান্টিক পর্বের সঙ্গে এখানে আধুনিকতার বিশাল এবং গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য। এর দ্বারা শিল্প-সাহিত্যকে আরো জীবনঘনিষ্ট এবং বাস্তবমুখী করে তোলা হয়েছে। এই রিয়েলিজম মার্ক্সবাদের সোশ্যালিস্ট রিয়েলিজম থেকে ভিন্ন এজন্য যে, বিষয়ের এই বিস্তৃতি, ব্যাপকতা এবং গভীরতা, সমাজ পরিবর্তনের জন্য নয়, কেবল সৃষ্টির তাগিদে। আধুনিকতায় কলাকৈবল্যবাদ রয়েছে, সামান্যভাবে হলেও। আধুনিকতা রাজনীতিবিমুখ নয়, কিন্তু বিপ্লবের হাতিয়ার হতে   বেশ অনিচ্ছুক। সাহিত্যে অনেকেই বোদলেয়ারকে আধুনিকতার পথিকৃৎ মনে করেন; কিন্তু তাঁকে যারা এই কৃতিত্ব দিতে অস্বীকার বা ইতস্তত করেন তাঁদের মতে তিনি মানুষের জীবনের অশুভ এবং কদর্যতাকে বিষয় করেননি। এই কৃতিত্বের স্বীকৃতি তাঁরা দিতে চান আর্তুর র্যাঁবোকে, যাঁর এ সিজন ইন হেল কাব্যগ্রন্থে জীবন উঠে এসেছে তার সমগ্রতায়,
সুন্দর-অসুন্দরের সমাহারে।

আধুনিকতার আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য মানুষের কেবল বাইরের জীবন নয়, তার অন্তর্জীবনের প্রবেশ করে সাহিত্যে এবং শিল্প সেখানকার রহস্য, জটিলতা এবং বিচিত্র রূপ ও আচরণের বয়ান দেয়। ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্ব, বিশেষ করে মনোবিশ্লেষণ আধুনিকতার অনুশীলনে এবং প্রকাশে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

ম্যালকম ব্র্যাডবারি এবং জেমস ম্যাকফারলেন তাঁদের সম্পাদিত  মডার্নিজম (১৯৭৬) বইয়ের শেষে পরিশিষ্ট হিসেবে  ১৮৯০ থেকে ১৯৩০, আধুনিকতার এই সময়কালে শিল্পে-সাহিত্যে প্রধান ঘটনার (যেমন, গ্রন্থ প্রকাশ) পাশাপাশি  যেসব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ঘটনা ঘটেছে সেসব লিপিবদ্ধ করে  গবেষকদের আধুনিকতার পটভূমি বিশ্লেষণে সাহায্য করেছেন। সব বছরেই  দুই শ্রেণির ঘটনার পাশাপাশি প্রদর্শন যে কার্যকারণ প্রতিষ্ঠিত করেছে তা নয়, কিন্তু  উল্লিখিত সামাজিক, রাজনৈতিক ঘটনা একই সময়ে আধুনিক অভিধায় অভিষিক্ত বিষয়গুলির (গ্রন্থ, শিল্প, আর্ট মিউজিয়াম) পটভূমি জানতে সাহায্য করে যার ভিত্তিতে আধুনিকতার গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে অনুমান করা যায়।

উত্তর-আধুনিকতা

আধুনিকতা যেমন তার পূর্বসূরি রোমান্টিসিজমের অন্ধ অনুসরণ না করে তার বিপরীতে ভিন্ন পথে যাত্রা করেছে,
উত্তর-আধুনিকের সঙ্গে আধুনিকতার সেই একই সম্পর্ক। আবার আধুনিকতায় যেমন পূর্বসূরি রোমান্টিসিজমের চিহ্ন ও অভ্যাস রয়ে গিয়েছে, উত্তর আধুনিকতার ক্ষেত্রে একই পরিণতি হয়েছে উত্তরাধিকার প্রসঙ্গে। চিন্তা এবং সৃজনশীলতার জগতে ধারাবাহিকতা আছে, সেখানে বিভিন্ন পর্ব থাকলেও চরম বিচ্ছেদ নেই, এটি  এখন স্বতঃসিদ্ধ। এই উপলব্ধির ভিত্তিতে মোটা দাগে উত্তর-আধুনিকতার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি নতুন করে স্মরণ করা যেতে পারে।

ফ্রান্সে উত্তর-আধুনিকতার অন্যতম প্রধান প্রবক্তা ফ্রাসোঁয়া লিওতারের মতে মডার্নিজমে যেখানে মহা-আখ্যান বা মেটা ন্যারেটিভের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাখ্যায়, যেমন মার্ক্সিজম, উত্তর-আধুনিকতা তা বর্জন করে বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। তাঁর ঘোষণা : মহা-আখ্যানের দিন শেষ, তাদের প্রতিশ্রুতি লুপ্ত, কেননা তারা  কার্যকারিতা  হারিয়েছে।

(দি পোস্টমডার্ন কন্ডিশন, ১৯৭৯)। লিওতারের মতে মহা-আখ্যান পৃথিবীকে ভালো, মন্দে বিভক্ত করেছে; দর্শন, সমাজ, রাজনীতি এবং শিল্পসাহিত্যকে সংজ্ঞায়িত করে বৈধতা দিয়েছে যার ফলে তাদের অন্তর্গত ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং অসংগতি প্রচ্ছন্ন থেকে গিয়েছে। আধুনিকতার মহা-আখ্যান, মেটা-ন্যারেটিভ বৈধতা দিয়েছে বিশেষ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও ডিসকোর্স, আইনের শাসন এবং শিল্প-সাহিত্যের নান্দনিকতা। এর ফলে সাধারণের নিচে চাপা পড়ে গিয়েছে ডিটেইলস, দৈনন্দিনের অভিজ্ঞতাগুলো। লিওতারের মতো উত্তর-আধুনিকতাবাদীরা মনে করেন বিংশ শতাব্দীর বহু নতুন সমস্যা এবং ঘটনার ব্যাখ্যা করতে আধুনিকতা অপ্রতুল।

সমগ্রতার ধারণাটি বর্জন করে উত্তর-আধুনিকতাবাদীরা বলেন সামাজিক, রাজনৈতিক সম্পর্কগুলো পরস্পরবিচ্ছিন্ন, তাদের একত্রে গাঁথা যায় না। তা করা হলে বাস্তব সত্য শুধু  ঢাকা পড়ে না, সৃষ্টি হয় মহা-বাচন, মাস্টার ডিসকোর্স যেটি হয় গ্রামসি যাকে বলেছেন আধিপত্যবাদী, হেজিমনিক। গ্র্যান্ড ডিস্কোর্স বা হেজিমনি অন্য পৃথক বিষয়ের বাচনগুলিকে দমন করে বা তাদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে। যেমন মার্ক্সবাদে শ্রেণির ওপর গুরুত্ব দেওয়ায় মানুষের অন্য পরিচিতিগুলি গৌণ বা উপেক্ষিত হয়ে গিয়েছে, যেমন নারীবাদ।

অবিভক্ত সমগ্র নয়, ক্ষমতার বলয়ে খণ্ড খণ্ড অংশগুলিকে দেখার লাভ হলো ক্ষমতার বিকেন্দ্রিত অবস্থান দেখতে পারা, যা বিশেষ বাচন বা শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার জন্য আন্দোলন করার সুযোগ এনে দেয়। উত্তর-আধুনিকতাবাদীরা রাষ্ট্রকে ক্ষমতার সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী মনে না করে বিভিন্ন স্তরে প্রভাবশালীদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে বা তার পুনর্বণ্টনের জন্য এই সব স্তরে আন্দোলন সংগঠনের কথা বলেন।

উত্তর-আধুনিকতা শিল্পী বা সাহিত্যিকদের উদ্ভাবন নয়, কিন্তু সাহিত্যে উত্তর-আধুনিকতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এই প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, সাহিত্যে আধুনিকতার দৃষ্টান্ত যেমন বেশি দেখা গিয়েছিল কবিতায়, তার তুলনায়
উত্তর-আধুনিকতায় প্রাধান্য পেয়েছে উপন্যাস। আধুনিক কবিতায় সময়কে সংক্ষিপ্ত করে আনা হয়েছে, উত্তর-আধুনিক উপন্যাসে সময় নয় গুরুত্ব পেয়েছে ন্যারেটিভ কৌশল। এর অন্যতম উদ্ভাবন হলো আন্তঃবাচনিকতা (inter-textuality)। এই কৌশল অবশ্য আধুনিক উপন্যাসেও দেখা গিয়েছে যেমন, জেমস জয়েসের ইউলিসিস উপন্যাস যে-বইয়ে অন্য লেখকের লেখার প্রচুর উল্লেখ আছে। অপরদিকে অষ্টাদশ শতকের  লরেন্স ষ্টার্নের ট্রিস্টাম শ্যান্ডি উপন্যাসকে অনায়াসে বলা যায়
উত্তর-আধুনিক, কেননা এর ন্যারেটিভ গতানুগতিকভাবে সরলরৈখিক নয়।

আধুনিকতাবাদে যা দেখা যায়নি, উত্তর-আধুনিকতার  দ্রুত বিবর্তন  ঘটেছে তার  পুরো সময়কালে (১৯৫০ থেকে নিয়ে)। ষাটের দশকে উত্তর-আধুনিকের আলোচনা হয়েছে মূলত সামগ্রিক একটি ধারণা হিসেবে যা আধুনিকতাবাদের  প্রতীতি এবং চর্চাকে চ্যালেঞ্জ করেছে, যেমন আমেরিকায় ইহাব হাসানের লেখা। এই ধরনের লেখা ক্রিটিকাল থিওরির পর্যায়ে পড়ে। সত্তরের দশকে এসে উত্তর-আধুনিকতা তাৎপর্য লাভ করেছে সাহিত্যের আলোচনা-সমালোচনায়। আশির দশকে এসে স্থাপত্য উত্তর-আধুনিকতার আলোচনায় কেন্দ্রীয় আসন গ্রহণ করে এবং স্থাপত্য সংক্রান্ত নানা ইস্যু, শব্দপুঞ্জ এবং প্রতীক উত্তর আধুনিকের অন্য আলোচনার ওপর প্রভাব বিস্তার করে। নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মহা-আখ্যান, মেটা-ন্যারেটিভ আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে এবং উত্তর-আধুনিকতার প্রধান চিহ্ন বা বৈশিষ্ট্য হিসেবে পরিগণিত হয়। বিশ শতকের শেষ প্রান্ত থেকে পুরনো বিষয় আলোচনার পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে নতুন বিষয় আলোচনা ও অনুশীলনের ক্ষেত্র : দর্শন, নৈতিকতা, চলচ্চিত্র, আইন, ধর্ম, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইত্যাদি। একের পর এক নতুন বিষয় এবং ক্ষেত্র যুক্ত হওয়ার ফলে যেসব বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলি দিয়ে উত্তর-আধুনিক-এর বিশ্লেষণ করা যেত তাদের সম্প্রসারণ ঘটছে যার ফলে কেবল সাধারণ মানদণ্ড ব্যবহার করে

উত্তর-আধুনিকতার সকল বিষয় বা ক্ষেত্র চিহ্নিত করা সম্ভব  হচ্ছে না। ক্রমশ প্রতিটি বিষয় বা ক্ষেত্রে উত্তর-আধুনিকতার চিহ্ন বা গুণ শনাক্ত করার জন্য সেই ক্ষেত্রের নিজস্ব কোড বা ভাষার শরণাপন্ন হতে হচ্ছে।

বৃহৎ নয়, ক্ষুদ্র; সমগ্র নয়, অংশ; গোছানো, শৃঙ্খলাবদ্ধ নয়, এলোমেলো; উদ্ভট; প্রথাগত নয়, নিরীক্ষামূলক; বিভিন্ন ক্ষেত্রের মিশ্রণ এবং মিথস্ক্রিয়া;, ন্যারেটিভের অস্পষ্টতা; কোনো সাংস্কৃতিক প্রকল্পে একটি নয় বহু স্বরের সমাহার ইত্যাদিকে মনে করা যেতে পারে উত্তর-আধুনিকতার গুণ বা বৈশিষ্ট্য হিসেবে। ইহাব হাসান আধুনিকতা আর উত্তর-আধুনিকতার গুণ এবং বৈশিষ্ট্যের যে তুলনামূলক সারণি তৈরি করেছেন সেটি আরো বিশদ এবং জটিল (দি কালচার অব পোস্টমডার্নিজম, ১৯৮৫)।

উত্তর-আধুনিকতা কী, তার তাত্ত্বিক, দার্শনিক ব্যাখ্যার জন্য পড়া যেতে পারে ইউরোপ, বিশেষ করে ফ্রান্সের বুদ্ধিজীবী লিওতার, জ্যাক দেরিদা, মিশেল ফুকো প্রমুখের এবং আটলান্টিকের অপর তীরে ইহাব হাসান, ফ্রেডারিক জেমসন, রিচার্ড রোর্টির লেখা। বলা যায়, আধুনিকতার প্রবক্তাদের তুলনায় উত্তর-আধুনিকের প্রবক্তাদের সংখ্যা অনেক বেশি, যার পিছনে এর বিশাল ব্যাপ্তিই প্রধান কারণ। আর একটি কারণ উত্তর-আধুনিকের ধারণা মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি হওয়ার জন্য যে কোনো একটি ডিসিপ্লিনের বিশেষজ্ঞ নিজের বিষয়ের আলোকে উত্তর-আধুনিক সম্পর্কে বলার অধিকার রাখেন। যেমন লাকাঁ মনস্তত্ত্ব এবং সাইকোঅ্যানালিসিসের জ্ঞান দিয়েই উত্তর-আধুনিকের ব্যাখ্যা দিতে পারেন।

চার

আধুনিক এবং উত্তর-আধুনিক বিষয়ে বাংলাদেশের সমালোচক-বুদ্ধিজীবীদের জ্ঞান যে যথেষ্ট তা এইসব বিষয়ে অনেকের লেখা দেখে বেশ বোঝা যায়। তাঁদের জানাশুনা ব্যাপক এবং গভীর এবং তাঁরা এই দুটি বিষয়ে বেশ আস্থার সঙ্গেই কথা বলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ব্যাখ্যা করা ছাড়া নিজের মত বা ধারণা তৈরি করে উপস্থাপন করেছেন, এমন দৃষ্টান্ত চোখে পড়ে না। বাংলাদেশ কোনো গায়ত্রী স্পিভাক বা হোমি ভাবা তৈরি করতে পারেনি। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো এখানেও আমাদের ভূমিকা গ্রহিতার, দাতা বা কর্তৃপক্ষের (বিষয়ের ওপর) নয়।

এখন সংক্ষেপে সাহিত্য, শিল্প এবং চলচ্চিত্র, এই তিনটি ক্ষেত্রে আধুনিকতা এবং উত্তর-আধুনিকতা কতটুকু প্রভাব ফেলেছে এবং সচেতনভাবে এই দুটির অন্তর্গত কী প্রবণতা  শনাক্ত করা যায় সে সম্বন্ধে কিছু বলা হবে। এক্ষেত্রে বিশদভাবে বলার জন্য যে-গবেষণা ও জরিপ করা প্রয়োজন তা করা হয়নি বলে আপাতত মোটা দাগেই মন্তব্য করা হবে এবং উপসংহারে আসা হবে। বলা যায়, এটি এমন একটি গবেষণা ও বিশ্লেষণের ক্ষেত্র যে এখানে লেখার দারিদ্র্য বেশ আশ্চর্যজনক। সালাউদ্দিন আইয়ুব তাঁর  আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতা বইয়ে জীবনানন্দ দাশ এবং শওকত ওসমানের লেখায় আধুনিকতা এবং উত্তরাধুনিকতার সন্ধান করেছেন। এ ছাড়া তিনি বঙ্কিমচন্দ্র এবং তিরিশের লেখকদের সম্পর্কেও এই পরিপ্রেক্ষিতে লিখেছেন। রুশ কবি আন্না আখমাতোমার ওপরও তাঁর লেখা আছে বইটির  পরিশিষ্টে। সবই সাহিত্যের ক্ষেত্রের দৃষ্টান্ত এবং আধুনিকতার, কিন্তু বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য এই আলোচনা পূর্ণতা পায়নি। নিচে ক্ষেত্রভিত্তিক যে-আলোচনা তাকে কোনোক্রমেই এই ঘটতি পূরণের জন্য লেখা, তা বলা যাবে না। একে একান্তই ইমপ্রেসনিস্টিক (আলতো হাতে) বলতে হবে, যার একটা উদ্দেশ্য ভবিষ্যতের গবেষকদের উস্কে দেওয়া।

যে তিনটি ক্ষেত্রকে আধুনিকতা এবং উত্তর আধুনিকতার দৃষ্টান্ত  দেওয়ার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে সেগুলি হলো : (ক) সাহিত্য (খ) শিল্পকলা এবং (গ) চলচ্চিত্র। এইসব ক্ষেত্রে আধুনিকতার দৃষ্টান্ত যেমন বেশি পাওয়া যায়, সে-তুলনায় উত্তর আধুনিক পর্বের দৃষ্টান্ত বেশ কম। এর দুটি কারণ অনুমান করা যেতে পারে : এক, যে আর্থ-সামাজিক পরিবেশে উত্তর আধুনিক চিন্তা বা ধারণা সংখ্যাগরিষ্ঠের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার অংশ হয় হয়ত তা তেমনভাবে সৃষ্টি হয়নি; দুই হলেও অনেকের উপলব্ধিতে আসেনি বা আত্তীকৃত হয়নি।

(ক) সাহিত্যে আধুনিকতা

বাংলাদেশের সাহিত্যে আধুনিকতা এবং উত্তর-আধুনিকতার বিচারে যেসব লেখকের (লেখিকা সমার্থক) নাম উল্লেখ করা হবে তাঁরা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের আগে এবং পরে লেখালেখিতে সক্রিয়। বলা বাহুল্য, স্বাধীনতা অর্জনের আগে বর্তমানের বাংলাদেশে লেখকদের সংখ্যা বেশি ছিল না। এর পিছনের  কারণ ছিল জনসখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মধ্যে শিক্ষার কম হার এবং সাহিত্যচর্চার পরিবেশের অভাব (পত্রিকা না থাকা, বই ছাপা না হওয়া)। স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশে বেসরকারিভাবে মাসিক মোহাম্মদী, সওগাত, বেগম অনিয়মিতভাবেই বের হতো। অনেক পরে প্রকাশিত হয় সিকান্দার আবুজাফর এবং হাসান হাফিজুর রহমান-সম্পাদিত রুচিশীল সাহিত্য পত্রিকা ‘সমকাল’ যা বেশ নিয়মিত ছিল। শেষোক্ত এই সাহিত্য পত্রিকা ছিল সব দিক দিয়েই আধুনিক, অঙ্গসজ্জায়, লেখার চরিত্রগুণে এবং উঁচু মান সংরক্ষণের জন্য। এর বিপরীত প্রান্তে ছিল সরকারের নিয়ন্ত্রণে পাকিস্তানের রাষ্ট্র আদর্শ প্রচারণার মুখপাত্র মাসিক মাহে নও পত্রিকা, যেখানে শুধু প্রতিক্রিয়াশীল লেখকদের লেখা স্থান পেত না, লেখায় আধুনিকতা বলতে যা বোঝায়, তার  ছিল নিদারুণ অভাব। এ ছাড়া মাঝে মাঝে ব্যক্তি বা কতিপয় সাহিত্যপ্রেমীর উদ্যোগে বের হতো সাহিত্য পত্রিকা যাদের আয়ু ছিল সংক্ষিপ্ত এবং প্রকাশনা অনিয়মিত।

সাহিত্য পত্রিকার এই সমস্যার পাশাপাশি ছিল প্রকাশনা সংস্থার অভাব এবং তাদের সাহিত্যের বই ছাপার অনীহা। পত্রিকার অভাবে যেমন পাঠক তৈরি হয় নি, বই-এর সংখ্যাল্পতাও পাঠকের সংখ্যাবৃদ্ধির পথে অন্তরায় হিসেবে কাজ করেছে। বাংলাদেশ হওয়ার আগে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত প্রবীন এবং নবীন  যেসব লেখক গল্প, কবিতা উপন্যাস লিখেছেন তাদের মধ্যে মোটা দাগে অধিকাংশ প্রবীণের লেখা আধুনিকতার গুণ বা বৈশিষ্ট্য বহন করে নি। এই সময়কালে যেসব প্রবীণের লেখা কথাসাহিত্য আধুনিক অভিধায় অভিহিত হতে পারে তাদের মধ্যে শওকত ওসমান, আবু রুশদ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, রশীদ করিম, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সর্দার জয়নুদ্দিন উল্লেখযোগ্য। নবীনদের  মধ্যে আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য অর্জন করে গল্প লিখেছেন আলাউদ্দিন আল আজাদ, জহির রায়হান, আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক, শওকত আলী, আবু ইশহাক, শহীদ সাবের, রাবেয়া খাতুন, আনোয়ারা সৈয়দ হক, আবু বকর সিদ্দিক। একই সময়ে আধুনিক কবিদের মধ্যে ছিলেন জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, শামসুর রাহমান, সিকান্দার আবু জাফর, হাসান হাফিজুর রহমান, শহীদ কাদরী। নাটকে একই সঙ্গে আধুনিকতা এবং উত্তর-আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য ধারণ করে অ্যাবসার্ড এবং ফ্যান্টাসি ঘরানার নাটক লিখেছেন সাঈদ আহমেদ। নাটকে অন্য যারা আধুনিক ধারায় লিখেছেন তাদের মধ্যে জিয়া হায়দার, মমতাজুদ্দিন আহমদ উল্লেখযোগ্য।

আধুনিকতা, উত্তর-আধুনিকতা এবং আমরা

প্রাক-বাংলাদেশ পর্বে একমাত্র সাঈদ আহমদকেই বলা যায় উত্তর-আধুনিকের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে সাহিত্য চর্চা করতে। তিনিই বাংলা ভাষায় প্রথম অ্যাবসার্ড ঘরানার নাটক লেখেন এবং তাঁর হাত দিয়েই প্রথম রূপকথা নিয়ে ফ্যান্টাসি ঘরানার নাটক বের হয়, যা একই সঙ্গে ছিল এলেগরিকাল। অস্তিত্ববাদের ওপর ভিত্তি করে উপন্যাস লেখার জন্য সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকেও বলা যায় উত্তর-আধুনিকতার গুণসম্পন্ন লেখক। এঁদের দুজনই বিদেশি, বিশেষ করে ফরাসি সাহিত্য এবং দর্শনের সঙ্গে বেশ পরিচিত ছিলেন যার জন্য তাঁরা সহজেই আভা-গার্দ শিল্প-সাহিত্যের ধারার প্রতি আকর্ষণ বোধ করেছেন এবং তার বৈশিষ্ট্য তাঁদের লেখায় প্রতিফলিত করতে পেরেছেন। কাকতালীয় নয় যে, দুজনই বিদেশে প্রবাস জীবন কাটিয়েছেন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সবচেয়ে বেশি সময়ের জন্য।

প্রাক-বাংলাদেশ পর্বে কেন অধিকাংশ লেখক আধুনিক ধারায় লেখেননি তার প্রধান কারণ তাঁরা গ্রামীণ কৃষি-সংস্কৃতির প্রভাব বলয়ে বেড়ে উঠেছিলেন এবং নাগরিক জীবনের অভিজ্ঞতা তাঁদের ছিল কর্মজীবনের অনুষঙ্গে। আধুনিকতা নাগরিক জীবনের বৈশিষ্ট্য যার জন্য উচ্চশিক্ষিত হলেও এবং কর্মজীবনে নাগরিকতার অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও তাঁরা যে উঠে এসেছিলেন গ্রামীণ পটভূমি থেকে, এই বাস্তবতার জন্য সেই সময়ের অনেক লেখকের মানসিকতায় রোমান্টিক ভাবালুতা অক্ষুণ্ন ছিল।

১৯৪৭-এর দেশভাগের আগে কলকাতায় বসবাসকারী বেশ কয়েকজন পূর্ববঙ্গের লেখক থাকলেও এবং মাসিক সওগাত ও মাসিক মোহাম্মদী প্রকাশিত হলেও রমেশচন্দ্র মজুমদারের বাংলাদেশের ইতিহাস (১৯৮২, বাংলাদেশ সংস্করণ) বইয়ে একমাত্র নজরুল ইসলামের নাম এবং তাঁর সম্পাদিত ধুমকেতু পত্রিকার উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৯৪৭-এর আগে বাংলাদেশিদের (সেই সময় এই পরিচয় না থাকলেও তাঁরা বাঙালি ছিলেন)  সাহিত্যে ‘আধুনিক’ হওয়ার পথে যেসব অন্তরায় কাজ করেছে তার মধ্যে এই উপেক্ষা এবং এর সঙ্গে জড়িত অসহযোগিতা  একটি কারণ বলে মনে করা যেতে পারে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সাহিত্যে যে শাখায় প্রায় জোয়ার আসে তা হলো নাটিক লেখা এবং মঞ্চায়ন। এর পিছনে  ছিল সংস্কৃতিমনস্ক একদল তরুণ ও যুবক-যুবতীর কলকাতা অবস্থান, যখন তারা মুক্তিমুদ্ধের আনুষঙ্গিক কাজের অবসরে মঞ্চনাটক দেখেছে এবং সেই স্মৃতি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে স্বাধীনতার পর ঢাকায় ফিরে এসে মঞ্চনাটকের আয়োজন করে একটি  সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে। সেই সময় নতুন প্রজন্মের যারা, আধুনিক ধারার নাটক লিখেছে তাদের মধ্যে ছিল আবদুল্লা আল মামুন, জিয়া হায়দার, সেলিম আল দীন, আলী জাকের প্রমুখ। তাঁদের লেখা নাটকের মধ্যে বিদেশি, বিশেষ করে ইউরোপীয় নাট্যকারদের যেসব নাটক অনূদিত হয়ে মঞ্চস্থ হয়েছে তার মধ্যে আঁভা-গার্দ নাটকই ছিল বেশি। আবার মলিয়েঁরের রোমান্টিকধর্মী কমেডিও অনূদিত হয়েছে। বিনোদন এবং পরিশীলিত রুচির চর্চা, উভয়ই সেই সময়ের নাটক লেখা ও মঞ্চায়নের পিছনের উদ্দেশ্য ছিল, যা এখনো অব্যাহত বলা যায়, যদিও প্রথম পর্বের ফার্স্ট জেনারেশন নাট্যকাররা মঞ্চ থেকে বিদায় নিয়েছেন। স্বাধীনতার পর যে নাট্য আন্দোলন শুরু হয় সেখানে আধুনিকতার চর্চা প্রাধান্য পেয়েছে।

নাটকের পর সাহিত্যের যে শাখায় সৃষ্টি সুখের উল্লাস দেখা গিয়েছে তা হলো কবিতা। প্রবীণ (পঞ্চাশের দশকের) এবং নবীন  (সত্তরের দশক এবং পরবর্তী) কবিদের লেখা কবিতায় আধুনিকতার প্রায় সব বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়েছে। তাঁরা বাংলায় তিরিশের কবিদের অনুসরণ করেছেন, দৈনন্দিনের বর্ণহীন, একঘেয়ে জীবনের মধ্যে খুঁজেছেন বাঁচার মর্মার্থ এবং সার্থকতা। বোদলেয়ারের মতো কেবল নাগরিক জীবনের সাদা-কালো নয়, র‌্যাবোঁর নারকীয় অন্ধকারকেও তারা মনে করেছেন বন্ধুপ্রতিম। ম্যালার্মে, রিলকে থেকে এলিয়ট, অডেন, স্পেন্ডাদের কাব্য জগতের কারুকাজকে গ্রহণ করেছেন নিজেদের চারণভূমির নৈসর্গিক দৃশ্যাবলি নির্মাণে। বাকপ্রতিমা এবং ইমেজের ব্যবহারে মিথের জগৎ আর পরিচিত জীবনের মধ্যে তাঁরা গড়ে তুলেছেন যে সেতুবন্ধ তার উৎস কেবল দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে নয়, বিশ^জনীন, যাকে আঁদ্রে মালরো বলেছেন  ‘ইমাজিনারি মিউজয়াম’ – কল্পনার জাদুঘর। শুধু বিষয় নয়, আধুনিক কবিরা ভাষায় খুঁজেছেন আধুনিকতার মুক্তি, যে-ভাষা সাধারণ পাঠকের কাছে মনে হবে পরিচিতজনের  সুর – দূরাগত, অস্পষ্ট কিন্তু দুর্বোধ্য নয়। শামসুর রাহমানের  ‘রূপালী স্নান’ কবিতাকে যদি বলা যায় আধুনিকতায় সমর্পণ এবং তার প্রতি নিবেদনের অর্ঘ্য, রফিক আজাদের  ‘ভাত দে হারামজাদা’ এবং হেলাল হাফিজের ‘এখন যৌবন যার’ ঘোষণা করেছে কবিতার আধুনিকতার ইশতেহার। বিষয়ে এবং বর্ণনায় প্রবীণদের তুলনায় নবীন প্রজন্মের কবিরা হয়েছেন আরো জীবনঘনিষ্ঠ, তাঁদের কাছ থেকেই দীক্ষা নিয়ে তাঁরা তৈরি করেছেন সামনে যাওয়ার নতুন পথ। কবিতা হয়ে উঠেছে ক্রমান্বয়ে জীবনের দাবির কাছে দায়বদ্ধ। আধুনিকতার যে অন্যতম বৈশিষ্ট্য গুরুত্ব পেয়েছে স্যামুয়েল বেকেটের সংক্ষিপ্ততায়, বাংলাদেশে গদ্যের তুলনায় কবিতাতেই দেখা গিয়েছে তার বহুল ও স্বছন্দ ব্যবহার। কবিতার অবমূল্যায়নও হয়েছে কখনো কখনো, ক্ষমতার কাছে নতজানু হয়ে আশীর্বাদপুষ্ট হবার প্রলোভনে, যেখানে আধুনিকতা ঘাড় হেঁট করে থেকেছে তার প্রেম এবং দ্রোহের যুগলবন্দিকে পরাভূত হতে দেখে। সার্বভৌমত্বের এই আত্মসমর্পণ যখন ঘটে, শিল্পসাহিত্যের সব শাখাই উপদ্রুত হয়। কিন্তু কবিতা হয় সবচেয়ে বেশি, কেননা কবিতার রয়েছে গণসংগীতের মতো  সকল শ্রেণির মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার ক্ষমতা। সেজন্যই প্রাচীনকাল থেকে সৃষ্ট হয়েছে ‘রাজকবি’র পদ, অন্য কোনো শাখার জন্য রাখা হয় নি এই প্রিভিলেজ। বাংলাদেশের কবিতায় আধুনিকতার জয়-জয়কারের পাশে মাঝে মাঝে ঘটে যাওয়া এই পদস্খলন মনস্তাপের বিষয়।

(খ) শিল্পকলা

বাংলাদেশের শিল্পে আধুনিকতা এসেছে পঞ্চাশের দশকে প্রথম প্রজন্মের শিল্পী জয়নুল আবেদীন, সফিউদ্দীন আহমদ, কামরুল হাসান, আনোয়ারুল হক, সুলতান প্রমুখের তৈরি ছবিতে। বিষয়ে আধুনিকতার শর্ত – জীবনঘনিষ্ঠতা, মৃত্তিকাসংলগ্নতা,   এঁদের ছবিতে শুধু স্বীকৃতি নয়, প্রাধান্য পেয়েছে প্রথম থেকেই। বিষয়ে এবং শিল্পশৈলীতে তাঁরা মেলবন্ধন ঘটাতে চেয়েছেন লোকজ শিল্পের সঙ্গে আধুনিকতার। জয়নুলের দুর্ভিক্ষের ছবির রূঢ় বাস্তবতা একদিকে যেমন শিল্পে আধুনিকতার শর্ত পূরণ করেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে, পরবর্তীকালে আঁকা ছবিতে  ময়মনসিংহ এলাকার পুতুলের আদলে আঁকা ছবি প্রতিষ্ঠিত করেছে লোকজ ঐতিহ্যকে আত্তীকরণের মাধ্যমে। কামরুল হাসান প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পটুয়াদের চিত্র অঙ্কনরীতি অনুসরণ করেছেন ফর্ম এবং রঙের ব্যবহারে। সফিউদ্দীনের প্রিন্ট ছবি আঙ্গিকে পাশ্চাত্যের হলেও বিষয়ে তিনি লোকজ জীবনকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তাঁর অন্য মাধ্যমের কাজে  কিউবিজমের প্রভাব নিশ্চিতভাবে জানিয়ে দেয় পাশ্চাত্যের আধুনিকতার লক্ষণ। সুলতান প্রথম থেকেই ফিগারভিত্তিক ছবি এঁকেছেন, যে-ফিগার ক্রমে প্রচলিত ফর্ম থেকে উত্তরিত হয়েছে কল্পনার জগতে। বিষয়ে আধুনিক হয়েও সুলতান ধারণ করেছেন রোমান্টিকতার ঐতিহ্য। আধুনিকতার চর্চা দেশে-বিদেশে অনেক শিল্পীর কাজই এই ভাবে দুই ঐতিহ্যের ধারক এবং বাহক হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রথম প্রজন্মের পর বাংলাদেশে যে প্রজন্মের শিল্পীরা এসেছেন তাঁরা শিক্ষাজীবনে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন যেসব শিল্পধারার সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন তার মধ্যে  পিকাসো-ব্রাক-মাতিস পর্বের আধুনিকতাই প্রভাব বিস্তার করেছে বেশি। পাশাপাশি এবং পরবতীকালে আধুনিকতার অন্য ধারা, যেমন, প্রকাশবাদ, বিমূর্ত প্রকাশবাদ অনুসরণ করে ছবি তৈরি করেছেন কেউ কেউ। যেমন, কিবরিয়া, আমিনুল ইসলাম, দেবদাস চক্রবর্তী। কিউবিজমকে ভেঙে-চুরে ‘বিমূর্ত বাস্তবতা’ শিরোনামে সে-সিরিজের ছবি এঁকেছেন মুর্তজা বশীর ফ্লোরেন্সে ছাত্রজীবনে, সেটি আধুনিক শিল্পকলার অন্যতম উপশাখা হিসেবে বিবেচিত হতে পারতো যদি তিনি পাশ্চাত্যের কোনো দেশের শিল্পী হতেন। এদের সমসাময়িক রশীদ চৌধুরী যে টেপেস্ট্রির কাজ করে খ্যাত হয়েছেন সেই মাধ্যম পাশ্চাত্যের বহু প্রাচীন হলেও বিষয়ের নির্বাচনে তিনি আধুনিকতার পরিচয় দিয়েছেন। এদের পরের প্রজন্ম যারা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শিল্পচর্চা করেছেন তাঁদের মধ্যে শাহাবুদ্দিনের কাজে জার্মান এক্সপ্রেশনিস্টদের প্রভাব সুস্পষ্ট। বেশ কিছু নারী শিল্পী (শিল্পীদের এখন নারী-পুরুষ জেন্ডারে বিভক্ত করা হয় না) আধুনিকধারায়, বিশেষ করে ফেমিনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ছবি এঁকে শিল্পরসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এদের মধ্যে নাজলী লায়লা মনসুর, আতিয়া ইসলাম এনি, দিলারা বেগম জলির নাম উল্লেখ করা যায়। ফরিদা জামান এবং নাসরীন বেগম আধুনিক শিল্পের বিভিন্ন ধারার সমন্বয় করে যে ছবি তৈরি করেছেন সেখানে তাদের নিজস্বতা আছে। বাংলাদেশে আধুনিক ধারার সফল শিল্পী এখন অনেকেই, যেজন্য সবার নাম উল্লেখ করা সম্ভব নয়।

শিল্পকলার মধ্যে ভাস্কর্যে সংখ্যার দিক দিয়ে অগ্রগতি উল্লেখ্যোগ্য ভাবে  হয়নি। প্রথম প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে ভাস্কর ছিলেন মাত্র একজন, নভেরা আহমেদ। কিন্তু তিনিও ঢাকায় একটির বেশি প্রদর্শনী করতে পারেননি। তবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না পেলেও তিনি অর্ধবিমূর্ত কাজ করে আধুনিক ধারার শিল্পী হিসেবে পরিচিত হয়েছেন। সিনিয়রদের মধ্যে এরপর হামিদুজ্জামান খান আধুনিক ধারার বিমূর্ত, অর্ধবিমূর্ত ভাস্কর্য তৈরি  করে  এই শাখায়  প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। এর পরের প্রজন্মের মধ্যে যিনি ঢাকা শহরের খোলা জায়গায় বাস্তবধর্মী কাজ স্থাপনের মধ্যে নাম করেছেন তিনি রাশা। শামিম শিকদারের ভাস্কর্যেও আধুনিকতা আছে তাঁর স্টাইলাইজেশনের জন্য। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভাস্কর্যের প্রতি গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়, যার জন্য ক্রমে ক্রমে ভাস্করদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৩ সালে  শিল্পকলা একাডেমিতে যে জাতীয় প্রদর্শনী হয়, সেখানে ভাস্কর্যের কাজ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল শুধু সংখ্যার দিক দিয়ে নয়, গুণগত উৎকর্ষের জন্যও। এদের অধিকাংশই ছিল আধুনিক, বিমূর্ত এবং অর্ধবিমূর্ত  শৈলীর। বলা যায়, ভাস্কর্যে ভবিষ্যতে আধুনিকতাই প্রাধান্য পাবে, কেননা, ক্লাসিক্যাল ঘরানার ফিগারেটিভ বা মূর্ত কাজে ভাস্করদের জন্য তেমন চ্যালেঞ্জ নেই, দর্শকদের কল্পনার জন্যও কিছু অবশিষ্ট থাকে না।

(গ) চলচ্চিত্র

চলচ্চিত্রকে মোটামুটি দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায় : বিনোদনমূলক ছবি, যেখানে কল্পিত রোমান্স এবং তার সঙ্গে আনুষঙ্গিক

নাচ-গান থাকে। একই ঘরানার ছবি যার বিষয়বস্তু ভায়োলেন্স এবং সেক্স। বিনোদনমূলক ছবির তৃতীয় দৃষ্টান্ত ফ্যান্টাসি, যেখানে রূপকথা এবং লোককথা বিষয়। দ্বিতীয় শ্রেণির ছবি সমাজ-সচেতন বাস্তবধর্মী যার উদ্দেশ্য চিত্তের প্রসারণ এবং সুস্থ রুচির বিনোদন। এর মধ্যে রয়েছে ফিচার ফিল্ম, ইভেন্টভিত্তিক ফিল্ম (বাস্তব এবং কল্পনার মিশ্রণে তৈরি), আর্ট ফিল্ম, ডকুমেন্টারি, শর্ট ফিল্ম। আধুনিকতার সংজ্ঞায় দ্বিতীয় শ্রেণির  ছবি  অন্তর্ভুক্ত। প্রাক-বাংলাদেশে, পাকিস্তান আমলের প্রথমদিকে পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত পূর্ব বঙ্গে সিনেমার বাজার ছিল কলকাতার বাংলা, বোম্বাই-এর হিন্দি আর লাহোরের উর্দু ফিল্মের দখলে। ১৯৫৬ সালে আবদুল জব্বার খান যে মুখ ও মুখোশ সিনেমা নিয়ে বাংলা সিনেমার যাত্রা শুরু করেন,  সেটি কারিগরি গুণের দিক দিয়ে নিচুমানের হলেও বিষয়ের দিকে ছিল আধুনিক। এরপর বাঙালি পরিচালকরা অবাঙালি প্রযোজকদের সহায়তায় একের পর এক সিনেমা তৈরিতে এগিয়ে এলেন। বোম্বাই এবং লাহোরের নাচ-গানে ভরপুর সিনেমার সঙ্গে প্রতিযোগিতা থাকা সত্ত্বেও ঢাকায় তৈরি অধিকাংশ বাংলা সিনেমা রুচির সঙ্গে আপোষ করেনি। এদিক দিয়ে তাদের আদর্শ ছিল কলকাতার সিনেমা, যদিও সেই সিনেমার সঙ্গেও তাদের প্রতিযোগিতা করতে হয়েছে এবং তা  মধ্যবিত্ত দর্শকদের টেনে আনার ক্ষেত্রে বেশি করেই। পঞ্চাশের দশকের শেষে (১৯৫৯) যখন ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন স্থাপিত হয়, তারপর থেকে ঢাকায় বাংলা সিনেমা তৈরির মোটামুটি উপযুক্ত  পরিবেশ সৃষ্টি  হয়ে গেল, এ-কথা বলা যায়, যদিও অর্থায়ন বিরাট সমস্যা হয়েই থাকলো।

১৯৫৯ সালে আকাশ আর মাটি এবং ১৯৬০ সালে  আসিয়া নামে যে দুটি সিনেমা পরিচালনা করেন ফতেহ লোহানী  তাদের বলা যায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র, মুখ ও মুখোশ এর মতো ত্রুটিপূর্ণ নয়। দুটি সিনেমাই বিষয়ের দিক দিয়ে এবং উপস্থাপনায় আধুনিক ছিল, অকারণে নাচের অবতারণা করা হয়নি, গান এসেছিল কাহিনির প্রয়োজনে। পরের বছর (১৯৬১)জহির রায়হান সিনেমায় আত্মপ্রকাশ করলেন কখনো আসে নি নিয়ে যা দর্শকনন্দিত  হয় নি, কেননা বিষয় ছিল খুবই মন খারাপ করার মতো (সড়ৎনরফ)। কিন্তু মনোজগতের বিশ্লেষণ নিয়ে ছবিটি আধুনিকতার শর্ত পূরণ করেছিল। সালাউদ্দিন  পরিচালিত সূর্য্যস্নান (১৯৬২) এবং সুভাষ দত্তের ডেবু

(প্রথমবার) উপহার  সুতরাং  (১৯৬৪) দুটিই বাস্তববাদী এবং রুচিসম্মত সিনেমা হিসেবে জনপ্রিয় হয়েছিল, বিশেষ করে  সুতরাং। সুস্থ রুচি এবং সমাজমনস্কতার জন্য ছবিটি বাংলাদেশের সিনেমায় ক্ল্যাসিক হয়ে রয়েছে।

কথাসাহিত্যিক-প্রাবন্ধিক  হুমায়ুন কবীরের লেখা উপন্যাস নদী ও নারী  (১৯৬৫) পরিচালনা করে  নাম করেন প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী সাদেক খান। এই  সিনেমার চিত্রনাট্য লেখেন খ্যাতনামা শিল্পী মুর্তজা বশীর। আধুনিক ধারায় নদীভিত্তিক সিনেমার মধ্যে এটিই ছিল

পথিকৃৎ। ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে বক্স অফিসে সফল হওয়ার জন্য উপকথা (জহির রায়হানের বেহুলা এবং রূপকথা  (সাত ভাই চম্পা) নিয়ে সিনেমা তৈরির হিড়িক পড়ে যায়, যেসব আধুনিকতার সংজ্ঞায় পড়ে না বলে এখানে উল্লেখ করা হলো না। কিন্তু এইসব ছবি দর্শক টেনে এনে ব্যবসা সফল হয়ে বাংলা সিনেমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। শিল্পের দাবি এবং বিনোদনের চাহিদা, এই দুই-এর ভিতরের দ্বন্দ্ব সিনেমায় যেমন প্রকট, তেমন আর কোনো শাখায় নয়। সাতভাই চম্পা, কাঞ্চনমালা সিরিজের ছবি নির্মিত হলো ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে শেষ  পর্যন্ত। এইসব ছবির পরিচালনা করেছেন জহির রায়হান থেকে সুভাষ দত্ত নিয়ে সেই সময়ের সব খ্যাতনামা পরিচালক। কিন্তু ফ্যান্টাসির জগৎ বাজারে টিকে থাকার উপায় বাতলে দিলেও সেসব তাঁদের মননশীলতার জারকে পরিশীলিত সৃজনশীলতাকে তৃপ্তি দিতে পারেনি। সেই জন্য সুযোগ পেলেই তাঁরা দর্শকের কাছে উপস্থিত হয়েছেন বাস্তবধর্মী উন্নত রুচির সিনেমা নিয়ে। ১৯৭০ সালে নির্মিত জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়া আক্ষরিক অর্থেই ছিল সেই সময়ের আর্থ-রাজনীতির নিরিখে জীবনঘনিষ্ঠ সিনেমা। এই সিনেমার জনপ্রিয়তা প্রমাণ করেছিল চলচ্চিত্রে আধুনিকতা জনপ্রিয়  হয় সমকালের জীবনের সঙ্গে যখন তার মেলবন্ধন ঘটে। শিল্পকলা কিংবা সাহিত্য

পাঠক-দর্শকের রুচি এবং উপলব্ধির চেয়ে অগ্রগামী হয়েও  অপেক্ষা করতে পারে গ্রহণযোগ্যতা লাভের জন্য, কেননা সেসব ক্ষেত্রে প্রতিটি সৃষ্টির (একটি বই, একটি ছবি) ব্যয় একটি সিনেমার তুলনায় অনেক কম।

বাংলাদেশ স্বাধীন  হওয়ার পর  মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেশ কয়েকটি সিনেমা তৈরি হয়েছে যেগুলি  বাস্তবধর্মী হওয়ার কারণে আধুনিকের শর্ত পূরণ করে। খান আতাউর রহমানের আবার তোরা মানুষ হ কিংবা চাষী নজরুল ইসলামের  ওরা এগার জন  দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে বিনোদনের উপাদান ছিল বলে নয়, মুক্তিযুদ্ধকালের অভিজ্ঞতা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য। সমকালের যে দলিল সকল শ্রেণির মানুষের আপন মনে হয়, সেখানে আপ্যায়ন বা বিনোদনের তাগিদ থাকে না। সিনেমার বিষয় নির্বাচনে এই বাস্তবতা মনে করিয়ে দেয় সমকালের ঘটনাভিত্তিক অন্যান্য ছবি যেসব সম্প্রতি তৈরি হয়েছে যেমন, রায়হান রাফীর পরান (২০২২), যে প্রসঙ্গ পরে আসবে। নতুন সহস্রাব্দ শুরু হওয়ার আগে এবং পরে বাংলা সিনেমার জগৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল দুটি কারণে। প্রথমত সিনেমায় সহিংসতা এবং অশ্লীলতা বেড়ে যাওয়ায় রুচিসম্পন্ন দর্শক প্রেক্ষাগৃহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। দ্বিতীয়ত ইন্টারনেটে নিখরচায় সিনেমা দেখার সুযোগ দর্শকদের ঘরমুখো করে রেখেছিল। এই দুই সমস্যার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে সুস্থরুচির বাস্তবধর্মী সিনেমা তৈরির আদর্শ বিসর্জন না দিয়ে নতুন প্রজন্মের কয়েকজন চিত্রপরিচালক যেসব সিনেমা তৈরি করেছেন সেই সিনেমা রুচিশীল দর্শকদের প্রেক্ষাগৃহে ফিরিয়ে এনেছে বলা যায়। এদের কেউ কেউ একটা কি কয়েকটি সিনেমা তৈরি করেছেন, যেমন এনামুল করিম নির্ঝর (আহ! ২০০৫) আবার  বেশ কয়েকজন একের পর এক আধুনিক ধারার সিনেমা তৈরি করে যাচ্ছেন, যাঁদের মধ্যে আছেন তানভির মোকাম্মেল (লালসালু, ২০০১), মোস্তফা  সরয়ার ফারুকী (ডুব, ২০১৭), আবু সাঈদ (শংখনাদ, ২০০৪), গিয়াসুদ্দিন সেলিম (স্বপ্নজাল, ২০১৮), অমিতাভ রেজা (আয়নাবাজি, ২০১৬), রুবাইয়াত হোসেন (আন্ডার কনস্ট্রাকশন, ২০১৫)। অতিসম্প্রতি কুড়া পক্ষীর শূন্যে ওড়া (২০২২)  ছবিটি পরিচালক মোহাম্মদ কাইয়ুম পুরো একবছর ধরে লোকেশন শুটিং করেছেন বিভিন্ন ঋতুর পরিবর্তন ধারণ করার জন্য যা তাঁর বাস্তবধর্মিতার  পরিচয় দেয়। এই সময়ে তৈরি আরো কিছু ছবির উল্লেখ পরে করা হবে। দুঃসময়ের মুখোমুখি হয়েও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আপোষ না করে  সমাজমনস্কতা, বাস্তবতাসম্পন্ন এবং সুস্থ রুচির  সিনেমা নির্মাণ করে যাচ্ছে, এটা শ্লাঘার বিষয়।

উত্তর-আধুনিকতা

(ক) সাহিত্য

উত্তর-আধুনিকতার ধারণা সাহিত্য আলোচনা, সমালোচনায় না হলেও  সত্তর থেকে আশির দশকে, যে-সময়কালকে বলা হয়েছে এই মতবাদের গঠনকাল, সাহিত্যের অনুষঙ্গেই সেই ধারণাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে সাহিত্যে বিভিন্ন শাখার মধ্যে উপন্যাসেই উত্তর আধুনিকতাকে পাওয়া যায় বলে মনে করেছেন অনেকে। এই প্রবণতার অনুসরণে বা সমর্থনে কেউ কেউ বলেছেন আধুনিকতা থেকে উত্তর-আধুনিকতায় উত্তরণ কবিতা থেকে কথাসাহিত্যে যাত্রাকেই বোঝায়। উত্তর-আধুনিকতার অন্যতম প্রধান প্রবক্তা লিন্ডা হাচিওন তাঁর গুরুত্বপূর্ণ এ পোয়েটিক্স অফ পোস্ট মডার্নিজম (১৯৮৮) বইয়ে উত্তর-আধুনিকতার আলোচনা কথাসাহিত্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন, যেমন করেছেন ব্রায়ান ম্যাকহাল (পোস্ট মডার্নিস্ট ফিকশন, ১৯৮৭)। এঁরা কবিতার প্রয়োজন নেই, এ কথা বলেন নি। বলেছেন উপন্যাসকে হতে হবে শব্দের ব্যবহারে মিতব্যয়ী এবং সংক্ষিপ্ত। কবিতা এবং উপন্যাস, উভয় ক্ষেত্রেই ন্যারেটিভ আছে, কিন্তু ভিন্ন চরিত্রের। কবিতার ন্যারেটিভ সংক্ষিপ্ত হতে পেরেছে  প্রতীক এবং মেটাফোর ব্যবহার করে। একইভাবে উপন্যাসও ন্যারেটিভে স্থান এবং কালকে সংক্ষিপ্ত করতে পারে রেফারেন্স ব্যবহার করে।

বাংলাদেশের উপন্যাসে কনিতার চরিত্র অর্জনের জন্য ইমেজারি এবং মেটাফোর ব্যবহারের দৃষ্টান্ত খুব একটা দেখা যায় না। অনিসুল হক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা উপন্যাসে রূপকথার ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমীর ব্যবহার করে কিছুটা উত্তরাধুনিকতার এই শর্ত পূরণ করেছেন বলা যায়।  সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের কিছু গল্পে উত্তর-আধুনিকতার লক্ষণ দেখা যায়। মাসরুর আরেফিন তাঁর আগস্ট  আবছায়া, আলথুসার এবং আন্ডারগ্রাউন্ড উপন্যাসে বিদেশি লেখক, তাদের বই এবং ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ করে আন্তঃবাচনিকতার (inter-textuality) শর্ত পূরণ  করার জন্য উপন্যাসগুলি উত্তর আধুনিকের অভিধায় অভিহিত হবার দাবি  রেখেছে। ইচক দুয়েন্দে ছদ্মনামে একজন মধ্যবয়সের স্বল্পপরিচিত লেখক তাঁর একমাত্র উপন্যাসে যেসব বিশেষ্য এবং বিশেষণ ব্যবহার করেছেন তার ফলে কবিতার মতো স্থান এবং কাল হ্রস্ব না হলেও পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে, অন্তত পরিচিতিহীন  হয়েছে। কয়েক মাস আগে একটি লিটল ম্যাগাজিনে উত্তর-আধুনিক গল্পের সংকলন বের হয়েছে বলে ফেসবুকে দেখেছি; কিন্তু পড়া হয় নি যে জন্য বলতে পারছি না গল্পগুলিতে  উত্তর-আধুনিকতার স্বভাব-চরিত্র কতটা এসেছে। তবে সংকলনটি জানিয়েছে যে বাংলাদেশের কিছু কথাসাহিত্যিক উত্তর-আধুনিক ধারায় গল্প লেখায় আগ্রহী এবং সেই লক্ষ্যে চেষ্টা করেছেন।

কবিতায় উত্তর-আধুনিক হওয়া কঠিন, কেননা রেফারেন্স, প্রতীক, উৎপ্রেক্ষা ব্যবহার করে কবিতা অনেকদিন থেকেই এই স্বভাব পেয়ে গিয়েছে। উত্তর-আধুনিকতার এই প্রধান বৈশিষ্ট্য রপ্ত করার পর বাকি যা থাকে সেসব কবিকে তাঁর নিজস্ব  শৈলী উদ্ভাবনের মাধ্যমে খুঁজে নিতে হয়, যা দেখে বোদ্ধা পাঠক বলতে পারবে উত্তর আধুনিকতার নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে কি না। বাংলাদেশে কতিপয় কবি গত শতকের শেষ দশকে কবিতায় উত্তর-আধুনিকতার আন্দোলন শুরু করেছিলেন বলে জানা যায়। এজাজ ইউসুফী-সম্পাদিত লিটল ম্যাগ লিরিকের ডিসেম্বর, ২০২০ সালের পঞ্চদশ সংখ্যা উত্তর আধুনিক কবিতা সংখ্যার পঞ্চম অ্যাডিশন থেকে নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশে উত্তর-আধুনিক কবিতার হাল-হকিকত জানা গেল। এই সংখ্যায় কবি অসীম সাহার ‘আধুনিক ও উত্তর আধুনিক কবিতার দ্বৈরথ’ শিরোনামে  লিখেছেন : সারা পৃথিবীতে উত্তর আধুনিকতার তত্ত্ব নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা চলছে বটে, কিন্তু আলোচনা-সমালোচনা, এমনকি তত্ত্বের প্রতিষ্ঠা দিয়েও প্রমাণ হয় না, সেই ধারাটি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তার ভিত্তি দৃঢ়তা লাভ করেছে। বিশেষ করে কবিতায় এর কোনো লক্ষণ ক্ষীণ আকারে দেখা গেলেও  যতক্ষণ না সৃষ্টিশীল কবিদের হাতে তা একটি পূর্ণ অবয়ব পাচ্ছে, তাকে গ্রহণ করা কারো পক্ষেই সম্ভব হবে  না।’ এর পরের অনুচ্ছেদে তিনি লিখেছেন : ‘আজকে যারা বাংলাদেশে উত্তরাধুনিকতাকে প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিজেদের সক্রিয় বলে দেখাতে চাইছেন, তাদের হাতে সেই মজবুত কবিতা কোথায়, যা দিয়ে তারা প্রমাণ করবে তাদের কবিতায় তারা উত্তরাধুনিকতাক যথাযথভাবে প্রতিফলিত করতে পেরেছেন, (পৃ ৩৭৬)।

নাটকে উত্তর-আধুনিকতার দৃষ্টান্ত প্রায় নেই বললেই চলে। একমাত্র সাঈদ আহমদ বেকেট প্রমুখ অ্যাবসার্ড ধারার লেখকদের লেখা পড়ে উৎসাহিত হয়ে তিনটি নাটিকা লিখে সত্তরের দশকে মোটামুটি একটা আলোড়ন তুলেছিলেন এবং সেগুলি মঞ্চায়িত হয়েছিল, এই উদাহরণ ছাড়া উল্লেখ করার মতো আর কারো নাটকের খোঁজ পাওয়া যায়নি যা উত্তর-আধুনিকের শ্রেণিতে পড়ে।

(খ) শিল্পকলা

শিল্পকলা একমাত্র ক্ষেত্র যেখানে চিত্রকলা এবং ত্রিমাত্রিক  আর্ট, উভয় শাখাতেই উত্তর-আধুনিক ধারার প্রচুর কাজ হয়েছে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর। বিদেশে এই ধারার শিল্পকর্ম শুরু হওয়ার পরপর বাংলাদেশে এর চর্চা হয়েছে। দেশের বাইরে সুযোগ বেড়ে যাওয়ায় সমকালীন শিল্পকলার জনপ্রিয় এই ধারা সম্বন্ধে অবহিত হওয়া এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে চর্চার পরিবেশ তৈরি হওয়ার কারণে বাংলাদেশে উত্তর-আধুনিক শিল্পকলা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সেসব এখন আন্তর্জাতিক মানের  বলা যায়  বেশ আস্থা নিয়ে। মাল্টিমিডিয়া থেকে শুরু করে ডিজিটাল আর্ট এবং ইনস্টলেশন ও পারফরম্যান্স আর্ট, সকল বিভাগে বাংলাদেশি শিল্পীদের উৎকর্ষ প্রশ্নাতীত। বাংলাদেশের শিল্পীদের কাজের এই উৎকর্ষের জন্য তাঁরা ভেনিস বিয়েনাল, ডকুমেন্টা এইসব অন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে আমন্ত্রিত হচ্ছেন।

(গ) চলচ্চিত্র

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে উত্তর-আধুনিকতা এসেছে সীমিত আকারে। এর দৃষ্টান্ত দেখা যায় দুই ক্ষেত্রে : (১) বিষয় এবং (২) আঙ্গিক। বিষয় হিসেবে নারীবাদভিত্তিক ছবিকে এই ধারার বলে চিহ্নিত করা যায়, কেননা এই বিষয় একটি নিয়ন্ত্রিত জনগোষ্ঠীর কথা বলে যারা মূল স্রোতের সঙ্গে অলীক সম্পর্কে জড়িত হলেও প্রকৃতপক্ষে থাকে ক্ষমতাহীন। নারীবাদী সিনেমা তাদের  ক্ষমতহীনতার, শোষণের, অবমাননার ওপর আলোকপাত করে। যখন এই ধরনের সিনেমা নির্মিত হয় নারী পরিচালকের হাতে, সেক্ষেত্রে সমস্যা থেকে উদ্ভূত চিন্তা এবং প্রতিক্রিয়া হয় খাঁটি (morbid)। রুবাইয়াত হোসেন  মেহেরজান (২০১১) সিনেমা দিয়ে যাত্রা শুরু করে এ পর্যন্ত  তৈরি করেছেন তিনটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি যার সবগুলিতেই নারী চরিত্র প্রধান। মেয়ে গার্মেন্ট শ্রমিকদের নিয়ে তৈরি চলচ্চিত্র মেড ইন বাংলাদেশ (২০১৯) জাতীয় পুরস্কার লাভ করেছে। আন্ডার কনস্ট্রাকশন (২০১৫) ছবিতে দেখানো হয়েছে দাম্পত্য জীবনে অসুখী এক অভিনেত্রীর নাটক লেখার মাধ্যমে নিজের অস্তিত্ব এবং পরিচিতি অক্ষুণ্ন রাখার সংকল্প।

শবনম ফেরদৌসী নির্মিত জন্মসাথী (২০১৪) সিনেমায় প্রধান চরিত্র একই দিনে জন্মগ্রহণ করা কয়েকজন পরিচিত নারী চরিত্রের সন্ধানে গিয়ে দেখতে পায় তাদের জীবনের বঞ্চনা  ও শূন্যতা। এই কাহিনির মাধ্যমে পরিচালক মন্তব্য করেছেন স্বধীনতা যুদ্ধে লাঞ্ছিত নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ পদবির পিছনের পরিহাস।

২০১৯ সালে তানিম রহমান অংশুর ন ডরাই ছবিটি পুরুষশাসিত নারীর জীবনে আত্মমর্যাদা রক্ষার এবং নিজেকে প্রতিষ্ঠার লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সংকল্পে দৃঢ় এক নিম্নবিত্ত নারী চরিত্রের কাহিনি।

মেজবাহুর রহমান সুমনের তৈরি হাওয়া (২০২২)

উত্তর-আধুনিক শ্রেণির চলচ্চিত্র হওয়ার দাবি রাখে আঙ্গিকের কৌশলের জন্য। রূপকথা এবং  মিথের ব্যবহার কাহিনিকে করেছে কল্পনা ও বাস্তবের  সুখদ যুগলবন্দি। প্রচলিত কাহিনির ভিড়ে হাওয়া প্রকৃতই নিয়ে আসে তরতাজা নতুন বাতাস।

অনেক সৃজনশীল-মননশীল পরিচালকই মূলধারার বাণিজ্যিক সিনেমার পাশে বিকল্প ধারার ছবি তৈরিতে আগ্রহী কিন্তু পুঁজি এবং অর্থায়নের অভাবে তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সরকারি অনুদান দেওয়ার ক্ষেত্রে এই বিষয়টি মনে রাখা প্রয়োজন।

[বিভিন্ন পর্যায়ে শিল্পী-সাহিত্যিকদের নাম দেওয়া হয়েছে ব্যাখ্যার জন্য, এই তালিকা সম্পূর্ণ বলা যাবে না]