আমার কালি ও কলম, আমাদের কালি ও কলম

কালি ও কলম বাংলাদেশের শুদ্ধ সাহিত্য ধারায় এক অনন্য প্রগতিশীল সাহিত্যপত্রিকার নাম। ২০০৪ সালে প্রথম কালি ও কলম সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি বিষয়ক বাংলা মাসিক পত্রিকা হিসেবে যখন আমাদের হাতে এলো, যারপরনাই আনন্দে আমরা কবি-লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিকবৃন্দ তুমুলভাবে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম। আপ্লুত হয়েছিলাম একজন কবি হিসেবে, এই জন্যে যে, নতুন এক শুদ্ধতম পরিসর পেলাম, যেখানে নিজের সৃষ্টিশীল কাজ প্রকাশের অবারিত এক দিগন্ত খুলে গেল। সত্যিকার অর্থে নির্ভেজাল সাহিত্যপত্রিকার অভাব তো ছিলই। আজ অবধি মাসিক এই পত্রিকাটি সাহিত্যের আলাদা আভিজাত্যে, শিল্পসৌকর্যে এবং বিষয় ভাবনায় সমৃদ্ধ রচনা প্রকাশে তার স্বকীয়তা বজায় রেখে চলেছে।

মাসিক ভিত্তিতে প্রকাশিত বহুল সমাদৃত পত্রিকাটির প্রকাশক আবুল খায়ের এবং প্রতিষ্ঠাকালীন সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান জাতীয় অধ্যাপক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ড. আনিসুজ্জামান স্যার। তাঁর অবর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন অপর শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। একইভাবে প্রতিষ্ঠাকালীন সম্পাদক ও কবি আবুল হাসনাতের অবর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক সুব্রত বড়ুয়া। ভাষা ও সাহিত্যে তাঁর অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করেছে।

ড. আনিসুজ্জামান এবং কবি আবুল হাসনাত – এই দুই মহৎপ্রাণ ব্যক্তিত্বকে হারিয়েছি আমরা বড় ক্রান্তিকালে। দুজনেই আত্মঘাতী করোনার রোষানলে পড়ে আর ফিরতে পারেননি। আমাদের ছেড়ে অনন্তবাসে অবস্থান নিয়েছেন তাঁরা দুজনেই। তাঁদের অভাব ও অবদান বাংলা সাহিত্য অনুরাগী মাত্রই নিয়ত অনুভব করবে পলে পলে। এই দুই মহৎ আত্মার শান্তি কামনা করছি এই লেখার মাধ্যমে।

কালি ও কলমের আরো দুজন সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য যথাক্রমে কবি রুবী রহমান এবং লুভা নাহিদ চৌধুরী আমার প্রিয় ব্যক্তিদের অন্যতম। কবি রুবী রহমান ষাটের দশকে আমাদের অগ্রজ কবি, কবি রফিক আজাদের সতীর্থ বটে। পাশাপাশি আমাদেরও তিনি অগ্রজবন্ধু কবি হিসেবে তাঁর সস্নেহ আদর, ভালোবাসা, পরামর্শ যেমন পেয়েছি, তেমনি তাঁর পাশে থেকে অনুভব করেছি তাঁর সর্বস্ব হারানোর দুঃসহ দিনের একাকিত্বকে। স্বামী শ্রমিকনেতা নুরুল ইসলাম এবং পুত্র তমোহরকে হারিয়ে তাঁর যে বেদনার্ত একাকিত্ব এবং নিঃসঙ্গতা – তুলনাহীন তাঁর এই দহন ও কষ্টের কথা ভাষা পেয়েছে তমোহর শীর্ষক কাব্যগ্রন্থে। সংগীতশিল্পী, লেখক এবং বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদের কর্মক্ষেত্রের পরিসর অত্যন্ত ব্যাপক এবং নানা মাত্রায় বিস্তৃত। অসাধারণ তাঁর গায়কি, এক মৌন ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী তিনি। তাঁর সংগীতের ভক্ত আমি।

বহিরঙ্গে এবং অন্তরঙ্গে কালি ও কলম সর্বতোভাবে ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত সাহিত্যামোদীদের কাছে।

উল্লেখ্য যে, ২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশের নবীন কবি-লেখকদের সাহিত্যচর্চাকে অনুপ্রাণিত, গতিময় ও সৃজনধারাকে অধিকতর স্রোতস্বিনী করার লক্ষ্যে কালি ও কলম ‘তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার’ প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এই উদ্যোগটি তরুণ কবি ও লেখকদের মনে এক ধরনের আশার পিদিম জ্বেলে দিয়েছে এবং সৃজনশীল ধারার লেখকদের রচনায় অধিক সচেতন মনোনিবেশ ও গভীর মননশীল শিল্পবৈচিত্র্যের দিকে আকৃষ্ট করেছে বলে আমার বিশ্বাস।

কাকতালীয়ভাবে বেশ কবার পুরস্কার কমিটির প্রাথমিক বিচারক হিসেবে তরুণদের অনেক লেখা পাঠের সুযোগ হয়েছে আমার। উল্লেখ্য, পাঁচটি বিভাগ, যথা – কবিতা, কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক  সাহিত্য ও শিশু-কিশোর সাহিত্য – এই পাঁচটি বিভাগে পুরস্কার প্রদান করা হয়ে থাকে। আমি বিশ্বাস করি, এই উদ্যোগটি সৃজনশীল বাংলা সাহিত্যের ধারাকে এগিয়ে নিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।

সালটি ঠিক মনে নেই, যে-বছর বিচারক ছিলাম সে-বছর কবি ওবায়েদ আকাশ কবিতায় প্রথম তরুণ কবি হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছিল। আমিও তাকে সর্বোচ্চ নম্বর দিয়েছিলাম। সাইমন জাকারিয়ার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। লোকসংস্কৃতি গবেষক হিসেবে ২০০৮ সালে ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার’ পেয়েছে সে। তার ক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ নম্বর দিয়েছিলাম আমি। আত্মতৃপ্তি  সেখানেই।

বাংলা একাডেমিতে সাইমন জাকারিয়া নিজের যথার্থ এক ক্যারিয়ার সৃষ্টি করতে পেরেছে। পাশাপাশি হাজার বছরের বাংলা কবিতার নিদর্শন চর্যাপদ নিয়ে তার গবেষণা এবং ব্যতিক্রমী উদ্ভাবনা ইতোমধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বিশেষভাবে বৌদ্ধ সহজিয়াপন্থী ধর্মীয় সাধনসংগীত হিসেবে রচিত এই চর্যাপদ সাধিকাদের কণ্ঠে নতুনভাবে পৌঁছে দিচ্ছে সাধারণ মানুষের হৃদয়ে। ধারণা করি, হারিয়ে যাওয়া চর্যাপদ নতুনভাবে তার মূলমন্ত্র নিয়ে শ্রোতা-দর্শককে আবিষ্ট করে তুলতে পেরেছে ইতোমধ্যে।

ওবায়েদ আকাশ আজ বাংলা কবিতার ধারায় উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রমী প্রতিভা। দৈনিক সংবাদ পত্রিকার বিখ্যাত সাহিত্য সাময়িকীর মেধাবী সম্পাদক। ইতোমধ্যে বাংলা কবিতার ধারায় তার আলাদা কণ্ঠস্বরটি আমরা শনাক্ত করতে পেরেছি। তার সুলতানপুর শুধু তার নিজ জন্মভূমি নয় – পাঠকের হৃদয়ে হৃদয়ে বাস করে আজ সুলতানপুরের প্রাকৃত-পুরাণ। এছাড়া দীর্ঘ পঁচিশ বছর লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় শালুক একটি বিশেষ নাম। কবি ওবায়েদ আকাশ শুধু নিজে কবি হিসেবে থাকেনি, অনেককে কবি করেছে সাপ্তাহিক রোববার পত্রিকার সম্পাদক এবং কবি রফিক আজাদের মতোই। পাশাপাশি একটি বিশেষ পাঠকগোষ্ঠী সৃষ্টি করতে পেরেছে – সাহিত্যের বর্তমান ধারায়।

বিচারক আসনে বসে বেশ কিছু অনন্যসাধারণ বই পেয়েছিলাম, যা পুরস্কারযোগ্য। কিন্তু এত পুরস্কার দেওয়া তো সম্ভব হয় না কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে। কাজেই বিশ্বাস করি সেসব বই কোনো না কোনো সময়ে পাঠকের দৃষ্টি কাড়বে।

বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে ধারণা করি, আমাকে বিচারক হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন তৎকালীন বিখ্যাত সম্পাদক ও কবি আবুল হাসনাত। অথবা আরো কেউ থাকতে পারেন আমার সমর্থনে।

উল্লেখ না করলেই নয়, কিংবদন্তিতুল্য সম্পাদক কবি আবুল হাসনাত ভাইয়ের সঙ্গে আমার একটু কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা ও কবি রফিক আজাদের প্রয়াণের পরে ২০১৭ সাল থেকে আমরা বেশ কজন কবি এবং সংস্কৃতিকর্মী মিলে কবি রফিক আজাদ স্মৃতি পর্ষদ গঠন করেছিলাম।

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে হাসনাত ভাই এই পর্ষদের গবেষণা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে। তাঁর পরামর্শে কবি রফিক আজাদ স্মৃতি পর্ষদ ২০২১ সাল থেকে কবিতায় কিংবা মুক্তিযুদ্ধে কিংবা সাংবাদিকতায় একটি পুরস্কার প্রদান করে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়ার নিয়মাবলি সব নিজ হাতে হাসনাত ভাই লিখে দিয়ে গেছেন। এই ঋণ কবি রফিক আজাদ স্মৃতি পর্ষদের কেউ কখনো ভুলবে না। তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

বর্তমান সহযোগী সম্পাদক স্নেহভাজন কবি আশফাক খানের অনুরোধেও বেশ কিছু গদ্য লিখেছি। বিশেষভাবে কবি শামসুর রাহমান, কবি আবুল হাসনাত স্মরণে দুটো উল্লেখযোগ্য লেখার কথা মনে পড়ছে। পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে কবিতা তো লিখেই চলেছি।

রফিক আজাদের সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ যে আঁধার আলোর অধিক বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে। সেজন্যে ধন্যবাদ জানাই এই সংস্থার কর্ণধার আবুল খায়ের সাহেবকে, যিনি শিল্প-সংস্কৃতি এবং প্রকাশনা শিল্পের উন্নয়নে নানাভাবে অবদান রেখে চলেছেন।

এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীর প্রতি আমার শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও মঙ্গলকামনা সতত।