১৯৭১ সালে ২৫শে মার্চ মধ্যরাতের কিছু আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকায় ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু করার অব্যবহিত পরে চট্টগ্রামে বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছিল। নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ১৬ই ডিসেম্বরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে পূর্ণ বিজয় অর্জিত হয় এবং পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। বাঙালির ইতিহাসে এটি খুব বড় একটি ঘটনা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনাবসানের মধ্য দিয়ে যে স্বাধীনতা এসেছিল তা পরিপূর্ণতা পেয়েছে ১৯৭১-এ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাস নানা ঘটনার ঘনঘটায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এ-মাসে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সূচনা হয়,
যে-যুদ্ধ অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে। এ-মাসে পাকিস্তানের কারাগারে অন্তরীণ বাঙালি জাতির নেতা এবং পাকিস্তানের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এ-মাসে বিভিন্ন সময়ে মুক্তিবাহিনী সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। এ-মাসের ১৬ তারিখ বাংলাদেশের বিজয় দিবস। এদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করে। এ-মাসে কলকাতায় অবস্থিত প্রবাসী সরকার ঢাকায় আসে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে মন্ত্রী পরিষদের প্রথম সভা অনুষ্ঠানে সক্ষম হয়।
এ-মাসে পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। এ-মাসেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইয়াহিয়া খানের পতন হয় এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো খণ্ডিত পাকিস্তানের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। কয়েক দিন পর জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়ার ব্যাপারে এক জনসভায় জনগণের সমর্থন আদায় করেন।
কেবল একাত্তরের ডিসেম্বর মাসের ঘটনাবলি নিয়ে কোনো লেখালেখি নেই, যদিও উপর্যুক্ত বিষয়গুলি সমন্বিতভাবে পর্যালোচনা করলে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তি ও বিজয় এবং সংশ্লিষ্ট খেলোয়াড়দের বিবিধ কর্মকাণ্ড ও অবদান সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা যায়। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে দেশি ও বিদেশি পত্র-পত্রিকা থেকে অনেক কিছু জানার সুযোগ আছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের বিজয়, আমাদের স্বাধীনতা – এসব নিয়ে দলিলীকরণের যেমন প্রয়োজন রয়েছে, তেমনি জানারও আবশ্যকতা রয়েছে। আমরা জানি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান থেকে লন্ডন ও দিল্লি হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি নবপ্রতিষ্ঠ বাংলাদেশে এসেছিলেন। কিন্তু সম্ভবত এই তথ্যটি সর্বজনবিদিত নয় যে, তাঁকে ১৬ই ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর মিয়াঁওয়ালী জেলখানা থেকে বের করে আনা হয়েছিল, এবং ২২শে ডিসেম্বর তাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিয়ে ঢাকা প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ইয়াহিয়া-পরবর্তী সরকার। এটি বহুল প্রচারিত যে, শেখ মুজিবের ফাঁসির আদেশ হয়েছিল এবং এই আদেশ কার্যকর করার পর তাঁর মরদেহ দাফনের জন্য জেলখানার ভেতরই কবর খোদাই করা হয়েছিল। প্রকৃত ঘটনা এই যে, বিচার প্রক্রিয়ার অনেকাংশ সম্পন্ন হলেও ৩রা ডিসেম্বর তারিখে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় বিচারের রায়ই লেখা হয়নি। মিয়াঁওয়ালী জেলখানার চত্বরে কবর নয়, ইংরেজি ‘এল’ আকৃতির ট্রেঞ্চ খোদাই করা হয়েছিল, পাছে ভারতীয় বিমান বাহিনীর আক্রমণে জেলখানাটিও আক্রান্ত হয়ে পড়ে।
১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে প্রকাশ্যে আত্মসমর্পণ করেছিল। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত সমস্যা ও ঘটনাবলির প্রেক্ষাপট সম্বন্ধে অনবহিত থাকার কারণে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের অধিকাংশ এই আত্মসমর্পণকে প্রধানত পাকিস্তান বনাম ভারতের চৌদ্দ দিনব্যাপী যুদ্ধের সমাপ্তি ও ভারতের বিজয় হিসেবে বিবেচনা করেছিল। এতে যে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ নামে স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি নতুন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলো – এই বিষয়টি অনেকাংশে চাপা পড়ে গিয়েছিল। মনে হতে পারে এটি ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে শুরু হওয়া মুক্তিযুদ্ধ ছিল না, এটি ছিল ৩রা ডিসেম্বর শুরু হওয়া তৃতীয় পাক-ভারত যুদ্ধ।
ইতিহাসের তথ্যকণা নানা স্থানে নানা আকারে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। সেগুলি সংগ্রহ করা ও একত্র করা সময়সাপেক্ষ বিষয়। এ-ধরনের কাজে দ্রুততা সমূহ বিভ্রাটের কারণ হয়ে থাকে। অন্যদিকে যিনি কাজটি করছেন তাঁর নিরপেক্ষতা লিখিত ইতিহাসকে বস্তুনিষ্ঠ হতে সাহায্য করে। এই সব কথা মনে রেখে এই নিবন্ধটি মুসাবিদা করা হয়েছে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রতিটি দিন নিয়ে কম করে হলেও পাঁচ হাজার শব্দ লেখার রসদ রয়েছে। এই তুলনামূলকভাবে হ্রস্বাকৃতির রচনাটিকে তারই সরমর্ম হিসেবে বিবেচনা করা ন্যায্য হবে।
ডিসেম্বরের সংক্ষিপ্ত দিনপঞ্জি
১৯৭১-এর ডিসেম্বর মাসের ১ তারিখের পত্রপত্রিকা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল। প্রকৃতপক্ষে নভেম্বর মাসেই ভারতীয় সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে বিভিন্ন স্থানে পরিকল্পিতভাবে আক্রমণ শুরু করেছিল। এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, যশোরের চৌগাছা এলাকায় ২০ ও ২১শে নভেম্বর পাকিস্তানি ও ভারতীয় সেনাদলের মধ্যে একটি ট্যাংক-যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। সে-সময় ভারতীয় বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের সীমানার ভেতরে ঢুকে পড়লে পাকিস্তান সরকার এই বলে প্রতিবাদ জানিয়েছিল যে, কোনো আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা ব্যতিরেকেই ভারত পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করেছে। ২২শে নভেম্বর ভারত পাকিস্তানের তিনটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে। এই গুরুত্বপূর্ণ সংঘর্ষটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল।
এছাড়া নভেম্বরের ২৯ তারিখে জামালপুর অঞ্চলের কামালপুর সীমান্তে প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়েছিল ভারতীয় বাহিনী। নভেম্বরের শেষ দিনে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী সৈয়দপুরে একটি জনসভায় বক্তৃতা করেন এবং ভারতীয় সামরিক আগ্রাসন মোকাবিলার জন্য দেশবাসীকে আহ্বান জানান। তিনি সম্ভবত ভারতীয় সামরিক প্রস্তুতি সম্বন্ধে সংবাদ রাখতেন।
ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিনটিতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)। এতে সাংবাদিক সিডনি সানবার্গ অভিমত ব্যক্ত করেন, ভারত সরকার প্রথমবারের মতো স্বীকার করেছে যে, ভারতীয় বাহিনী সীমান্ত অতিক্রম করে পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ঢুকে আক্রমণ চালিয়েছে। তিনি জানান যে, তিনি দেখেছেন ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ভারতীয় সৈন্যরা যশোর শহর থেকে মাত্র ছয় মাইল দূরে বয়রাতে পৌঁছে গেছে। এর পূর্বাবধি নভেম্বর মাসেই ‘অপারেশন ক্যাকটাস লিলি’র পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারতীয় সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তের বিভিন্ন স্থানে অপারেশন শুরু করলেও তা অস্বীকার করে আসছিল।
ঢাকার মর্নিং নিউজ পত্রিকায় এই দিনে মুক্তিযোদ্ধা মেজর জলিলের হাস্যোজ্জ্বল ফটো ছাপা হয়। অন্যান্য পত্রিকা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) কর্তৃক সরবরাহকৃত ফটোটি মুদ্রণ করেছিল।
এদিন সন্ধ্যায় লন্ডনভিত্তিক রেডিও বিবিসির একটি উর্দু অনুষ্ঠানে বলা হয় যে, ভারতীয় বাহিনীকে পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত অতিক্রম করে ১৫ মাইল ভেতর পর্যন্ত প্রবেশ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ-বিষয়ে ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম ব্যাখ্যা করে বলেন যে, কেবল যশোর ও কুমিল্লার মতো দুটি গুরুত্বপূর্ণ শহর দখল করার পরিকল্পনা থেকে ওই নির্দেশ দেওয়া হয়।
এই দিন পশ্চিম পাকিস্তানের শিয়ালকোট এলাকায় চারটি ভারতীয় বিমান পশ্চিম পাকিস্তানের আকাশসীমা লংঘন করে।
ভারতীয় আক্রমণের মুখে দৃঢ়চিত্তে যুদ্ধ করার জন্য পাকিস্তানের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে জেনারেল নিয়াজী দেশব্যাপী জনসংযোগ কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। ডিসেম্বরের ১ তারিখে তিনি সিলেট সফর এবং জনসভায় বক্তৃতা করেন। বক্তৃতায় জেনারেল নিয়াজী বলেন, ‘কোনো অঞ্চল থেকে পশ্চাদপসরণ করার প্রশ্নই ওঠে না, কারণ যে-কোনো মূল্যে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’
২রা ডিসেম্বর : এদিন সংবাদমাধ্যমে জানানো হয় যে, শেখ মুজিবের বিচার এখনো শেষ হয়নি।
রাওয়ালপিন্ডিতে ইয়াহিয়া সরকারের একজন মুখপাত্র ঘোষণা করেন যে, পাক-ভারত উপমহাদেশে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ চালানোর বিকল্প পন্থা যতদিন পর্যন্ত পাওয়া যাবে, ততদিন পর্যন্ত পাকিস্তান সে-পন্থা অনুসরণ করে চলবে।
ভারতের সাবেক জেনারেল বি. এম. কাউল মন্তব্য করেন যে, যুদ্ধ বাধলে চীন পাকিস্তানের পক্ষে হস্তক্ষেপ করবে বলে তিনি মনে করেন। উল্লেখ্য, জেনারেল কাউল ১৯৬২ সালে চীনের সঙ্গে যুদ্ধে ভারতীয় সামরিক বাহিনী পরিচালনা করেছিলেন।
সে-সময় পাকিস্তান সফররত মার্কিন সিনেটর উইলিয়াম স্যাক্সবি বলেন যে, তিনি পশ্চিম পাকিস্তান সফরকালে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু করতে পারেননি। তবে তাকে বলা হয়েছে, শেখ মুজিব ভালো আছেন।
ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকা জানায় যে, ভারতীয় বাহিনী অতিরিক্ত তিন ডিভিশন সৈন্য নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে আখাউড়া, পঞ্চগড়, বনতারা, ভুরুঙ্গামারী, কামালপুর, শমসের নগর এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম – এই সাতটি এলাকায় আক্রমণ-অভিযান শুরু করেছে। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানানো হয় যে, নভেম্বর মাসে ভারতীয় সেনাবাহিনীর গোলায় পূর্ব পাকিস্তানের ৬১৯ জন নিহত হয়েছে।
লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ডেভিড লোশন কর্তৃক প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়, ভারতীয় হাইকমান্ডের পরিকল্পনা হলো, যদি একবার যশোরকে মুক্ত করা যায়, তাহলে ভারত পূর্ব পাকিস্তানের বুকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে।
৩ ডিসেম্বর : ভারত অভিযোগ করে যে, সীমান্ত অতিক্রম করে পাকিস্তান বিমান বাহিনী ভারতের ১২টি বিমান ঘাঁটিতে একযোগে আক্রমণ চালিয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী অভিযোগ করেন যে, পাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করেছে, তবে ভারত তাদের পরাজিত করে ছাড়বে।
পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. আব্দুল মোতালিব মালিক (এ. এম. মালিক) রাতে রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র থেকে জনগণের উদ্দেশে বেতার ভাষণ প্রদান করেন। এ-ভাষণে তিনি বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে আমার প্রাথমিক দায়িত্ব ছিল প্রদেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রার পরিবেশ ফিরিয়ে এনে জনসাধারণকে নিয়ে গঠিত একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করা।’ তিনি আরো বলেন, ‘বন্ধুগণ, আবারো আমি আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, আমরা এক ভয়াবহ যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছি এবং আমাদের সমগ্র অস্তিত্বই আজ বিপন্ন। এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে প্রয়োজন হলো যে-কোনো মূল্যে একতা, শৃঙ্খলা ও সম্প্রীতি বজায় রাখা। বর্তমান মুহূর্তে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের জন্য আমাদের সকলকে প্রস্তুত থাকতে হবে।’
চীনা সরকার বিবৃতি দিয়ে অভিযোগ করে যে, পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করার জন্য ভারত হামলা শুরু করেছে।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো ঘোষণা করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর অধীনে তিনি সহকারী প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণে রাজি আছেন; তবে তাঁকে পূর্ণ ক্ষমতা দিতে হবে।
ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত জনসমাবেশে জেনারেল নিয়াজী বলেন, ‘যে-কোনো মূল্যে মাতৃভূমি রক্ষার জন্য সশস্ত্র বাহিনী সংকল্পবদ্ধ।’
একই দিনে সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন বলেন, ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ সংঘর্ষ বন্ধের জন্য সব রকম চেষ্টা করে যাবে।’
৪ ডিসেম্বর : সংবাদ সংস্থার সূত্রে জানা যায়, পাকিস্তান বিমান বাহিনী ৪ঠা ডিসেম্বর সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ভারতীয় বিমান বাহিনীর ৩৪টি বিমান ধ্বংস করেছে এবং তিনজন ভারতীয় পাইলটকে জীবন্ত অবস্থায় আটক করতে সক্ষম হয়েছে। একই দিনে ঢাকার আকাশে বিমান-যুদ্ধ হয়; এই যুদ্ধে পাঁচটি ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করা হয়।
করাচিতে ভারতীয় নৌবাহিনী হামলা চালায়, যার নাম ছিল ‘অপারেশন ট্রাইডেন্ট’।
ঢাকার অদূরে অসামরিক এলাকা আদমজীনগরে ভারতীয় বিমান বাহিনীর হামলায় দেড়শো জন নিহত এবং শতাধিক ব্যক্তি আহত হন।
পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারতীয় সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তান দখলের জন্য স্থলপথে অভিযান শুরু করে। এর আগে মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী মিলে যৌথবাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। যৌথবাহিনীর সামরিক কৌশল ছিল,
যে-কোনোভাবে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করে বিভিন্ন দিক থেকে ঢাকাকে ঘিরে ফেলা। পরিকল্পনা অনুযায়ী পূর্বাঞ্চলের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে ৩ ডিভিশন সৈন্য নিয়ে গঠিত ৪র্থ কোর সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, নোয়াখালী অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। উত্তর অঞ্চল থেকে দুই ডিভিশন সৈন্য নিয়ে গঠিত ৩৩শ কোর রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া এলাকা দিয়ে অভিযান শুরু করে। পশ্চিমাঞ্চল থেকে দুই ডিভিশনের সমবায়ে গঠিত ২য় সামরিক কোর যশোর, খুলনা, কুষ্টিয়া, ফরিদপুরের পথে অগ্রাভিযান শুরু করে এবং মেঘালয় রাজ্যের তুরা থেকে একটি বাহিনী জামালপুর-ময়মনসিংহ অভিমুখে অগ্রসর হতে শুরু করে।
এই দিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের শত্রু আবার আমাদের বিরুদ্ধে লেগেছে; ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রান্তে সর্বশক্তি নিয়ে আক্রমণ শুরু করেছে। পাকিস্তানের প্রতি ভারতের শত্রুতা ও ঘৃণা সম্পর্কে পৃথিবীর সকলেই অবগত আছে। পাকিস্তানকে দুর্বল ও ধ্বংস করাই তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। আমাদের প্রতি ভারতের সর্বশেষ ও মারাত্মক পরিকল্পনা ছিল সবচেয়ে বড় এবং আমাদের উপর চূড়ান্ত আক্রমণ। আমরা ধৈর্যের শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছি। শত্রুদের উপর এখন চূড়ান্ত আক্রমণ করার সময় এসেছে। ১২ কোটি মুজাহিদ – আপনারা সব সময় আল্লাহর রহমত পেয়ে থাকেন। আপনাদের অন্তর নবীর প্রতি ভালোবাসায় পূর্ণ। আমাদের শত্রুরা আরো একবার আমাদের আত্মসম্মানের প্রতি আঘাত হেনেছে। শত্রুদের প্রতি আমাদের লৌহকঠিন মনোভাব, সম্মান ও বেঁচে থাকার অভিপ্রায় নিয়ে একযোগে প্রতিরোধ করতে হবে। আপনারা ন্যায় ও সত্যের পক্ষে আছেন : সাহস ও দৃঢ় সংকল্পে উদ্বুদ্ধ হয়ে মিথ্যার বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে যুদ্ধ শুরু করুন। শত্রুদের জানিয়ে দিন যে, মাতৃভূমিকে রক্ষার তাগিদে প্রতিটি পাকিস্তানি জান দেওয়ার জন্য তৈরি আছে। অভূতপূর্ব বীরত্ব ও সাহসিকতা প্রদর্শনের মাধ্যমে আমাদের সাহসী জওয়ানেরা অগ্রসরমান শত্রুবাহিনীকে আটকে দিয়েছে। শত্রুরা আমাদের চাইতে শক্তিশালী হলেও ইসলামে গাজিদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে আমাদের জওয়ানেরা তাদের বিরুদ্ধে অকুতোভয়ে, দৃঢ়তার সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। তারা জানে যে বিজয় শুধুমাত্র সৈন্যসংখ্যা বা যুদ্ধাস্ত্রের ওপর নির্ভর করে না; বরং নির্ভর করে বিশ্বাস ও আদর্শের শক্তি এবং সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছার ওপর।’
এই দিনে অর্থাৎ ৪ঠা ডিসেম্বরে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পোল্যান্ড যুদ্ধবিরতি ও রাজনৈতিক মীমাংসা নিয়ে একটি প্রস্তাব পেশ করে।
৫ ডিসেম্বর : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাংবাদিক সম্মেলনে বলে যে, অনভিপ্রেত পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের জন্য ভারত দায়ী। তারা পরিকল্পিতভাবে এই কাজটি করেছে। অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি দরকার। যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করা হচ্ছে।
আখাউড়াতে ভারতীয় বাহিনী প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়।
কুমিল্লার দক্ষিণ অঞ্চলে একটি পাকিস্তানি ব্যাটালিয়ন আত্মসমর্পণ করে।
নিউইয়র্কে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আনা হলে রাশিয়া দ্বিতীয়বারের মতো ‘ভেটো’ প্রয়োগ করে।
রুহুল কুদ্দুসকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের চিফ সেক্রেটারি নিয়োগ করা হয়।
৬ ডিসেম্বর : প্রথমে ভুটান সরকার স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের ঘোষণা দেয়।
ভারত সরকার বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। প্রত্যুত্তরে পাকিস্তান সরকার ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেয়।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ‘বাংলাদেশ বেতার’ হিসেবে অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু করে।
মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন যে, পাকিস্তানের সশস্ত্রবাহিনী ভারতের সঙ্গে ‘বেশ কিছু দিন’ প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য সম্পূর্ণভাবে সক্ষম। এ-সম্মেলনে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের চারপাশে বিভিন্ন স্থানে ভারতীয় বাহিনীর আক্রমণের ব্যাপারে বিশদ মন্তব্য করেন।
৭ ডিসেম্বর : যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলার জন্য জেনারেল নিয়াজীকে ডেকে পাঠান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. এম এ মালেক। আলোচনার সময় জেনারেল নিয়াজী সশব্দ কান্নায় ভেঙে পড়েন।
গভর্নর ডা. মালিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে একটি ‘জরুরি বার্তা’ পাঠিয়ে অবহিত করেন যে, ইস্টার্ন ফ্রন্ট অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর আক্রমণের মুখে পতনের সম্মুখীন।
এই দিনে ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধারা যশোহর শহর দখল করে নেয়।
জেড ফোর্সের অধিনায়ক কর্নেল জিয়াউর রহমান সিলেটে পৌঁছে ঘাঁটি গাড়েন।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতা নুরুল আমিনকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে সহকারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করে কোয়ালিশন সরকার গঠনের আহ্বান জানান।
৮ ডিসেম্বর : জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং এবং সৈন্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে প্রস্তাব পাশ করে। সাধারণ পরিষদে ভারতীয় প্রতিনিধি সমর সেন বলেন, পাকিস্তানের অবশ্যই বাংলাদেশকে স্বীকার করে নিতে হবে এবং উপমহাদেশে শান্তি পুনঃস্থাপনের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে হবে।
এই দিনে ভারতীয় বাহিনী ঢাকার উপর দশবার বিমান হামলা পরিচালনা করে। তবে পাকিস্তান বিমান বাহনী পাল্টা বিমান হামলায় সক্ষম হয়নি। পূর্ব পাকিস্তান সরকার অনির্দিষ্টকালের জন্য সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া দেশের সহকারী প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে জাতিসংঘে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন।
৮ ডিসেম্বর রাতে কলকাতাস্থ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত সংক্ষিপ্ত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জানান যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এখন একেবারে শেষ পর্যায়ে। তিনি বলেন, ‘আজ সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে চিরতরে আঘাত করুন। মুক্তাঞ্চলের জনতাকে এখন ধৈর্য ও দৃঢ়তা নিয়ে কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে।’ মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করায় ভারতকে আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘এই দুই দেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থানের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।’ বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য তিনি ভুটান এবং ভারতের সরকার ও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, বিশ্বের অন্যান্য দেশও ভুটান ও ভারতের পথ অনুসরণ করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে।
৯ ডিসেম্বর : কলকাতায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা এবং উপদেষ্টা কমিটির যুক্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। মুক্তিবাহিনী কর্তৃক অধিকৃত মুক্ত এলাকায় বেসামরিক প্রশাসন শুরু করা, খাদ্য, চিকিৎসা এবং পুনর্গঠন প্রভৃতি বিষয় ছাড়াও জাতিসংঘের সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহের চক্রান্তের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির বিষয়ে আলোচনা হয়।
একই দিনে গভর্নর হাউস থেকে পাঠানো একটি গোপনীয় বার্তায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরামর্শ দেওয়া হয়। প্রত্যুত্তরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান রাজনৈতিক সমাধানসহ যে-কোনো একটি মীমাংসায় পৌঁছার জন্য গভর্নরকে উদ্যোগ নিতে বলেন।
লন্ডন থেকে বিবিসি রেডিও প্রচার করে যে, জেনারেল নিয়াজী পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করে পালিয়ে গেছেন।
১০ ডিসেম্বর : সেনাপতি জেনারেল নিয়াজীকে অবহিত না-করেই জেনারেল রাও ফরমান আলীর পরামর্শে গভর্নর ডা. এ. এম. মালিক যুদ্ধবিরতি, ক্ষমতা হস্তান্তর ও পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যদের পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত গমনের একটি প্রস্তাব ঢাকাস্থ জাতিসংঘ প্রতিনিধির কাছে হস্তান্তরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের অনুমতি কামনা করেন। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের অনুমোদন ব্যতিরেকেই রাও ফরমান আলী প্রস্তাবটি ঢাকাস্থ জাতিসংঘ প্রতিনিধির হাতে পৌঁছে দেন। জাতিসংঘ প্রতিনিধি তৎক্ষণাৎ ওই বার্তা জাতিসংঘে পাঠিয়ে দেন।
জেনারেল নিয়াজী আকস্মিকভাবে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এসে বিবিসির সাংবাদিককে বলেন, ‘আমি পালিয়ে যাইনি, আপনার সম্মুখেই আছি।’
১১ ডিসেম্বর : পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান এক গোপনীয় বার্তায় জেনারেল নিয়াজীকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. এ. এম. মালিকের নির্দেশ মেনে চলতে বলেন, অর্থাৎ কার্যত আত্মসমর্পণের পরামর্শ দেন।
এই দিনে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানিকশ বেতারকেন্দ্র ‘আকাশবাণী’ থেকে প্রচারিত এক বিবৃতিতে অবিলম্বে আত্মসমর্পণের জন্য পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আত্মসমর্পণ ভিন্ন পালিয়ে যাওয়ার কোনো পথ খোলা নেই। যদি তোমরা আত্মসমর্পণ করো তাহলে নিশ্চিত থাকতে পারো যে তোমাদের প্রতি মানবিক শিষ্টাচার প্রদর্শন করা হবে এবং জেনেভা কনভেনশনের সকল সুযোগ-সুবিধা তোমরা পাবে।’
এই দিনে লাকসাম, হিলি, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া ও নোয়াখালী স্বাধীন হয়।
খুলনাতে ভারতীয় বিমান বাহিনীর বোমাবর্ষণে দুটি বাংলাদেশি জাহাজ বিধ্বস্ত হয়।
এদিন ভারতীয় নৌবাহিনীকে ভীতি প্রদর্শনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস এন্টারপ্রাইজকে বঙ্গোপসাগরে পাঠানো হয়।
১২ ডিসেম্বর : পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অফ জেনারেল স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল গুল হাসান জেনারেল নিয়াজীকে ৩৬ ঘণ্টা টিকে থাকার নির্দেশ দেন এবং বলেন যে, চীন ও মার্কিন সাহায্য সমাগত। কিন্তু এটা ছিল মিথ্যা আশ্বাস।
১৩ ডিসেম্বর : গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা জেনারেল রাও ফরমান আলী ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালকে একটি ‘আন্তর্জাতিক নিরাপদ অঞ্চল’ হিসেবে ঘোষণা করেন।
লে. কর্নেল পান্নুর নেতৃত্বে ভারতীয় ছত্রীবাহিনী ৫০টি বিমানে করে টাঙ্গাইলের মধুপুর এলাকায় অবতরণ করে।
ভারতীয় বিমান বাহিনী গভর্নর হাউসে বোমাবর্ষণ করে।
লে. কর্নেল শফিউল্লাহর ‘এস’ ফোর্স ঢাকার উপকণ্ঠে ডেমরা পৌঁছে যায়।
১৩ ডিসেম্বর মধ্যরাতের পরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জেনারেল নিয়াজীকে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন।
সোভিয়েত রাশিয়ার নৌবাহিনী বঙ্গোপসাগরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসএস এন্টারপ্রাইজকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে এক বহর রণতরী মোতায়েন করে।
এদিন থেকে রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রের অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ হয়ে যায়।
কলকাতার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র জানায় যে, ঢাকা ছাড়া বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলা শহর মুক্ত হয়ে গেছে এবং যৌথবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে।
কুমিল্লা হয়ে সিলেটের মুক্তাঞ্চল পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে একটি বড় হেলিকপ্টারে উড়ে জেনারেল ওসমানী ১৩ ডিসেম্বর বিকালে কুমিল্লা শহরে পৌঁছান।
১৪ ডিসেম্বর : পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডাক্তার এম. এ. মালিক ও তাঁর মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী আলবদরের সহযোগিতায় বাংলাদেশের প্রখ্যাত বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবীকে বাছাই করে নৃশংসভাবে হত্যা করে। বগুড়া শহর স্বাধীন হয়।
১৫ ডিসেম্বর : রাশিয়ার সমর্থনে পোল্যান্ড জাতিসংঘে একটি শান্তি প্রস্তাব উপস্থাপন করে। এতে ১৯৭০-এর নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং প্রাথমিকভাবে ৭২ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব করা হয়। যাতে স্বাধীন বাংলাদেশে কোনো প্রশাসনিক শূন্যতা সৃষ্টি না হয়, তাই কলকাতাস্থ প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ১৫ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের ১৯টি জেলায় জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার নিয়োগের আদেশ জারি করে।
ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী আত্মসমর্পণের জন্য জেনারেল নিয়াজীর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। বিমান থেকে প্রচারপত্র ফেলা হয় যাতে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয়েছিল।
১৬ ডিসেম্বর : সকালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেকশ ওইদিনই আত্মসমর্পণ প্রস্তাব দিয়ে বার্তা পাঠান। জেনারেল নিয়াজী এই বার্তা পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনী প্রধানের কাছে পাঠিয়ে দেন। সশস্ত্রবাহিনী প্রধান এ প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করেন এবং আত্মসমর্পণ করতে বলেন।
ভারতীয় বাহিনীর জেনারেল নাগরা’র টাঙ্গাইল থেকে টঙ্গী হয়ে ঢাকা আসার কথা ছিল। তবে তিনি কালিয়াকৈর থেকে পথ বদল করে সাভার হয়ে সকালের দিকে মিরপুর সেতুর নিকট পৌঁছান। সেখানে অবস্থান নিয়ে তিনি সাদা পতাকাবাহী জিপে তার এডিসি ক্যাপ্টেন হিতেম মেহতাকে দিয়ে জেনারেল নিয়াজীকে একটি চিরকুট পাঠান। তিনি লিখেছিলেন, ‘প্রিয় আবদুল্লাহ, আমি এখানেই। খেলা শেষ। আমি আমার নিকট আত্মসমর্পণের জন্য আপনাকে পরামর্শ দিচ্ছি এবং আপনার দেখভালের দায়িত্ব আমি নিচ্ছি।’ এরপর জেনারেল জামশেদ একটি মার্সিডিজ গাড়ি নিয়ে এসে জেনারেল নাগরাকে জেনারেল নিয়াজীর দপ্তরে নিয়ে আসেন। এর প্রায় এক ঘণ্টা পর জেনারেল জ্যাকব আত্মসমর্পণের দলিলের খসড়া নিয়ে উপস্থিত হন।
আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য ভারতীয় সেনা কর্মকর্তারা হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় অবতরণ করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা।
১৬ই ডিসেম্বর অপরাহ্ণ ৪টা ১৯ মিনিটে জেনারেল নিয়াজী রেসকোর্স ময়দানে আয়োজিত এক সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন। যৌথবাহিনীর পক্ষে আত্মসমর্পণ দলিলে ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীর পক্ষে স্বাক্ষর করেন জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। এ সময় জেনারেল অরোরা এবং জেনারেল নিয়োগী উপবিষ্ট ছিলেন। ঢাকা ক্লাব থেকে একটি টেবিল ও দুটি চেয়ার আনা হয়েছিল। তাদের পেছনে দাঁড়িয়েছিলেন বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর উপপ্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ. কে. খন্দকার, ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর অ্যাডমিরাল কৃষ্ণান, এয়ার মার্শাল দেওয়ান, জেনারেল স্বাগত সিং এবং জেনারেল জ্যাকব। আত্মসমর্পণের দলিলের ছয়টি প্রতিলিপি বানানো হয়েছিল। প্রথমে জেনারেল নিয়াজী সই করেন, তারপর জেনারেল অরোরা। দুঃখের বিষয়, ভারতীয়রা বাংলাদেশকে আত্মসমর্পণের দলিলের কোনো অনুলিপি দেয়নি।
আত্মসমর্পণ দলিল
পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ, লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানের সকল সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণে সম্মত হলেন। পাকিস্তানের সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীসহ সব আধা-সামরিক ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষেত্রে এই আত্মসমর্পণ প্রযোজ্য হবে। এই বাহিনীগুলো যে যেখানে আছে, সেখান থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কর্তৃত্বাধীন সবচেয়ে নিকটস্থ নিয়মিত সেনাদের কাছে অস্ত্রসমর্পণ ও আত্মসমর্পণ করবে।
এই দলিল স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার নির্দেশের অধীন হবে। নির্দেশ না-মানলে তা আত্মসমর্পণের শর্তের লঙ্ঘন বলে গণ্য হবে এবং তার প্রেক্ষিতে যুদ্ধের স্বীকৃত আইন ও রীতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আত্মসমর্পণের শর্তাবলির অর্থ অথবা ব্যাখ্যা নিয়ে কোনো সংশয় দেখা দিলে, লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আত্মসমর্পণকারী সেনাদের জেনেভা কনভেনশনের বিধি অনুযায়ী প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করছেন এবং আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি সামরিক ও আধা-সামরিক ব্যক্তিদের নিরাপত্তা ও সুবিধার অঙ্গীকার করছেন। লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার অধীন বাহিনীগুলোর মাধ্যমে বিদেশি নাগরিক, সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ও জন্মসূত্রে পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যক্তিদেরও সুরক্ষা দেওয়া হবে।
আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করার সময় জেনারেল নিয়াজীর চোখে পানি এসে গিয়েছিল। স্বাক্ষর শেষে তিনি দাঁড়িয়ে পড়েন ও টুপি খুলে ফেলেন। রিভলভার থেকে গুলি বের করে সেগুলো জেনারেল অরোরার হাতে তুলে দেন। তারপর প্রথামাফিক মাথা নামিয়ে জেনারেল অরোরার মাথায় ছোঁয়ালেন।
আত্মসমর্পণের আগে একটি বেতার বার্তায় জেনারেল নিয়াজী তাঁর অধীনস্থ সকল সেনা ইউনিটকে যুদ্ধবিরতির কথা জানান এবং আশ্বস্ত করেন যে, ভারতীয় বাহিনী জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে মর্মে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
১৬ই ডিসেম্বর কর্নেল ওসমানী হেলিকপ্টারে কুমিল্লা থেকে সিলেটের উদ্দেশে যাত্রা করলে মধ্যপথে ভারতীয় সেনারা গুলি চালায়। এতে হেলিকপ্টারের তেলের ট্যাংক ফুটো হয়ে যায়। হেলিকপ্টার একটি ধানক্ষেতে অবতরণ করলে সবাই প্রাণে বাঁচেন। কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে ছিলেন ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার উজ্জ্বল দাসগুপ্ত, শেখ কামাল, কর্নেল রব, ওসমানীর পিআরও মোস্তফা আল্লামা এবং ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। হেলিকপ্টারটি চালাচ্ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ।
এই দিন গভীর রাতে নিরাপত্তার খাতিরে শেখ মুজিবুর রহমানকে মিয়াঁওয়ালী জেলখানা থেকে বের করে আবাসিক এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। এ নিবন্ধের শেষাংশে এ-বিষয়ে পৃথক অধ্যায় আছে।
১৭ ডিসেম্বর : এই দিন পাকিস্তান বাহিনীকে পরাভূত করে খুলনা, রাজশাহী, কিশোরগঞ্জ দখল করে নেয় মুক্তিবাহিনী।
ভারত সরকার জানায় যে, ১৩ দিনের যুদ্ধে ২৩০৭ জন ভারতীয় নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ৬১৬৩ জন। ২১৬৩ জনের খোঁজ পাওয়া যায়নি। যুদ্ধে ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীর ৭৩টি ট্যাংক ও ৪৫টি যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়েছে।
কলকাতা ও আগরতলাসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয়গ্রহণকারী বাংলাদেশের মানুষেরা মুক্ত দেশে ফিরতে শুরু করে।
১৮ ডিসেম্বর : পাবনা দখল করে মুক্তিবাহিনী।
কলকাতাস্থ প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের আটজন কর্মকর্তা মুখ্য সচিব রুহুল কুদ্দুসের নেতৃত্বে ঢাকায় আগমন করেন।
মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কাদের সিদ্দিকী পল্টন ময়দানে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তিনজন রাজাকার সদস্যকে জনসমক্ষে হত্যা করেন। ডেইলি এক্সপ্রেস পত্রিকার সাংবাদিক উইলিয়াম লাভলেইস এই দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করেন। কিন্তু ভারত সরকার এই ফটো প্রেরণ আটকে দেয়।
১৯ ডিসেম্বর : মুক্তিবাহিনী পাবনার ঈশ্বরদী দখল করে।
এই দিনে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের গলফ কোর্সে অনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানি সৈন্যরা অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করে। এ সময় জেনারেল অরোরা এবং জেনারেল নিয়াজী উপস্থিত ছিলেন।
২০ ডিসেম্বর : পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনারেল গুল হাসানের নেতৃত্বে বন্দুকের মুখে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের বেসামরিক রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথগ্রহণ করেন। ক্ষমতাগ্রহণের অব্যবহিত পরে ভুট্টো ইয়াহিয়া খানকে সেনাবাহিনী থেকে অবসর প্রদান করেন। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চিফ অফ জেনারেল স্টাফ জেনারেল গুল হাসানকে সেনাবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে নিয়োগ দান করেন।
২০ ডিসেম্বরে প্রকাশিত টাইম ম্যাগাজিনের প্রধান প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল : ‘বাংলাদেশ : যুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি জাতির অভ্যুদয়’।
২১ ডিসেম্বর : মধ্যরাতে একটি সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তানের নবনিযুক্ত রাষ্ট্রপতি ভুট্টো জানান যে, শেখ মুজিব বেঁচে আছেন এবং ভালো আছেন। পাকিস্তানের জনগণ আপত্তি না-করলে তাকে মুক্তি দেওয়া হবে এবং মাতৃভূমিতে ফেরত পাঠানো হবে।
ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ একটি সর্বদলীয় জাতীয় সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানান।
২২ ডিসেম্বর : কলকাতাস্থ প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ অন্যান্য মন্ত্রী এবং কর্মকর্তারা ভারতীয় সামরিক বাহিনীর বিমানে ঢাকায় আগমন করেন। অন্তত এক লক্ষ মানুষ তাদের প্রিয় নেতাদের দেখতে ও বরণ করে নিতে বিমানবন্দরে ভিড় জমায়। ভিড়ের কারণে তাঁরা গার্ড অফ অনারের স্যালুটও নিতে পারেননি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সিহালাস্থ পুলিশ ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে কমান্ড্যান্ট বাংলোর অদূরে অবস্থিত সিহালা রেস্ট হাউসে স্থানান্তর করা হয়।
২৩ ডিসেম্বর : স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্ত মাটিতে মন্ত্রিপরিষদের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ দূত দুর্গাপ্রসাদ ধর তথা ডিপি ধর ঢাকায় আগমন করেন।
২৪ ডিসেম্বর : শেরেবাংলা নগরের ক্যাম্পে বন্দি সরকারি কর্মকর্তা আইয়ুবুর রহমান, আ. ন. ম. ইউসুফ, সৈয়দ রেজাউল হায়াত, শাহ মোহাম্মদ ফরিদ, নূরুল মোমেন খান, লোকমান হোসেন প্রমুখকে মুক্ত করা হয়।
আইনমন্ত্রী এএইচএম কামারুজ্জামান ঘোষণা করেন যে, রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও গণহত্যার অপরাধে ডা. এ. এম. মালিকের বিচার হবে।
২৫ ডিসেম্বর : পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক আহমেদ ঘোষণা করেন যে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির মূলভিত্তি হবে : ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়।’
২৬ ডিসেম্বর : ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ জেনারেল মানেকশ ঢাকা আগমন করেন।
২৭ ডিসেম্বর : মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে মন্ত্রিপরিষদ সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
২৮ ডিসেম্বর : মন্ত্রিসভার বৈঠকে পাকিস্তানের কারাগারে আটক শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে উপযুক্ত কৌশল নির্ধারণ নিয়ে আলোচনা করা হয়।
এই দিনে ভারতীয় সেনাবাহিনী কুর্মিটোলা গলফ কোর্স থেকে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের ভারতের উদ্দেশে নেওয়া শুরু করে।
জোহরা তাজউদ্দীন কলকাতায় গিয়ে কবি কাজী নজরুলকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান।
২৯ ডিসেম্বর : মন্ত্রীদের দায়িত্ব পুনর্বণ্টন করা হয়।
৩০ ডিসেম্বর : প্রতি রোববারে সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকা পুনঃপ্রকাশের ঘোষণা দেওয়া হয়।
৩১ ডিসেম্বর : আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক আহমেদ পদত্যাগ করেন। তবে মন্ত্রিপরিষদ তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেনি।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে একাত্তরের ডিসেম্বর
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরে পূর্ব পাকিস্তান পৃথিবীর মানচিত্রে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়, যার নাম ‘বাংলাদেশ’। কিন্তু নভেম্বর মাসের শেষ ভাগেও দখলদার পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পরাজয় এতটা সন্নিকট বলে প্রতীয়মান হয়নি। নভেম্বর মাসে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রাধান্য লাভ করেছিল বাঙালিদের নেতা শেখ মুজিবের বিচার। ভারতের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয়গ্রহণকারী বাঙালিদের দুরবস্থার খবরাখবর আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকায় সংক্ষিপ্তাকারে নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া পাকিস্তান-ভারত সীমান্তে ঘন ঘন সশস্ত্র সংঘর্ষের খবরও কিছু প্রকাশিত হয়েছে। কোনো পত্রিকাতেই ভারতের যুদ্ধপ্রস্তুতির কোনো ইঙ্গিত প্রদান করা হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় ও খোদ ঢাকা শহরে মুক্তিযুদ্ধ এসময় তীব্ররূপ ধারণ করেছিল। দেশের বহু এলাকা বিচ্ছিন্নভাবে পাকিস্তানি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে এসেছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের এরকম অগ্রগতি সম্পর্কে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম অবহিত ছিল বলে মনে হয় না।
পাকিস্তান সরকার ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত কবে-কখন নিয়েছিল তা সর্বজনবিদিত; তবে ডিসেম্বরের শুরুর দিকেই যুদ্ধ বন্ধ করে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সেনাদল প্রত্যাহার করে সেনাসদস্যদের ঢাকায় সরিয়ে আনার তৎপরতা পরিলক্ষিত হয়। এই গুরুত্বর্পূণ সংবাদটিও যথাযথ গুরুত্ব লাভ করেনি। পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে পদস্থ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রায় অর্ধ লক্ষ সৈন্যের মধ্যে প্রায় ২৫ হাজার সৈন্য ১২ই ডিসেম্বরের আগেই ঢাকায় পৌঁছে গিয়েছিল। ঢাকা শহরকে সুরক্ষিত রাখার জন্য এত বিপুলসংখ্যক সেনাসদস্যের প্রয়োজন ছিল না। সম্ভবত মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে মার খাওয়ার পরিবর্তে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত পাকিস্তানি সেনাপতিরা। জেনারেল নিয়াজী সম্ভাব্য পরাজয় ও আত্মসমর্পণের কথা বিবেচনা করেছিলেন বলে মনে হয়। আনুষ্ঠানিক যুদ্ধে আত্মসমর্পণের ক্ষেত্রে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী পরাভূত সামরিক বাহিনীর জানমালের সুরক্ষা নিশ্চিত করা বিজয়ী বাহিনীর অবশ্য কর্তব্য।
বিদেশি সংবাদপত্রে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৬ই ডিসেম্বর কীভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল তার পর্যালোচনা একটি কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের কথা বাদ দিলে বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্রে প্রকাশিত অনেক সংবাদ প্রতিবেদন প্রধানত চর্বিত চর্বন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলো বার্তা সংস্থা এপি বা রয়টার্সের খবরের হুবহু প্রতিলিপি অথবা নিউইয়র্ক টাইমস, লন্ডন অবজারভার, গার্ডিয়ান, ডেইলি টেলিগ্রাফ, ভারতের দ্য স্টেটসম্যান প্রভৃতি সংবাদপত্রের বিলম্বিত প্রতিধ্বনি মাত্র। ১লা ডিসেম্বর থেকে ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮৩টি সংবাদ প্রতিবেদনের শিরোনাম এ-নিবন্ধে উদ্ধৃত করা হলো যা থেকে পাকিস্তনের প্রকৃত সমস্যা সম্বন্ধে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সচেতনতার মাত্রা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে ধারণার অভিমুখ সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা যায়। বোধগম্যতার স্বার্থে অনেক ক্ষেত্রে শিরোনাম ব্যাখ্যামূলকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বলা দরকার, এই নিবন্ধের পরিধি থেকে ভারত ও পাকিস্তানের সংবাদসমূহকে বোধগম্য কারণে বাদ রাখা হয়েছে।
১৭ই ও ১৮ই ডিসেম্বর সারা পৃথিবীর শত শত পত্রিকায় ১৬ই ডিসেম্বর তারিখে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় ভারতীয় সামরিক বাহিনীর কাছে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবরটি মুদ্রিত হয়েছিল। তবে বিস্তারিত প্রতিবেদন পরবর্তী সপ্তাহের বিভিন্ন দিনেও প্রকাশিত হয়েছে। নিম্নোক্ত ৮৩টি শিরোনাম প্রকৃত ইংরেজি শিরোনামের ভাবানুবাদ। তদুপরি স্পষ্টতার স্বার্থে অনেক ক্ষেত্রে ব্যাখ্যামূলক শব্দাবলি সংযোজন করা হয়েছে :
১ ডিসেম্বর ১৯৭১, দ্য গার্ডিয়ান : ‘পাকিস্তান শান্তি চায় তার ইঙ্গিত স্বরূপ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সৈন্য প্রত্যাহার করতে পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানালেন।’
২ ডিসেম্বর ১৯৭১, নিউইয়র্ক টাইমস : ‘ভারত ও পাকিস্তানের সংঘর্ষ অতিরঞ্জন করে প্রচার করা হচ্ছে।’
৩ ডিসেম্বর ১৯৭১, বার্মিংহাম পোস্ট : ‘সীমান্তে লড়াই অব্যাহত রয়েছে।’
৩ ডিসেম্বর ১৯৭১, এস্কানবা ডেইলি প্রেস : ‘পাকিস্তানি বিমান ভারতে আঘাত হেনেছে।’
৩ ডিসেম্বর ১৯৭১, বিবিসি রেডিও : ‘পাকিস্তান ভারতীয় ভূখণ্ডে বিমান আক্রমণ তীব্রতর করেছে।’
৪ ডিসেম্বর ১৯৭১, নিউইয়র্ক টাইমস : ‘উপমহাদেশে যুদ্ধ’।
৪ ডিসেম্বর ১৯৭১, বার্মিংহাম পোস্ট : ‘পাকিস্তানের সর্বাত্মক যুদ্ধ, দাবি ভারতের।’
৪ ডিসেম্বর ১৯৭১, ফিলাডেলফিয়া ডেইলি নিউজ : ‘পাকিরা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।’
৪ ডিসেম্বর ১৯৭১, ক্রনিকল অফ থাইল্যান্ড : ‘ভারতীয় বিমানঘাঁটিতে পাকিস্তানি জেট বিমানের আক্রমণ’ এবং ‘ভারতীয় ডেস্ট্রয়ার পাকিস্তানি সাবমেরিনকে ডুবিয়ে দিয়েছে।’
৪ ডিসেম্বর ১৯৭১, কভেন্ট্রি ইভনিং টেলিগ্রাফ : ‘যে যুদ্ধ সারা পৃথিবীকে বিপদে ফেলে দিতে পারে : পশ্চিম বিশ্ব এখন কার পক্ষে যাবে?’
৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, টাইম ম্যাগাজিন : ‘ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।’
৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, দ্য হাচিনসন নিউজ : ‘ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ছে।’
৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, দ্য গার্ডিয়ান : ‘যুদ্ধ ব্যতিরেকে পাকিস্তানের উপায়ান্তর নেই।’
৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, নিউইয়র্ক টাইমস : ‘যুদ্ধে ভারতের আরো অগ্রগতি, কাশ্মিরে পাকিস্তানের সাফল্য দাবি, জাতিসংঘের শান্তি প্রস্তাবে বাধা।’ (প্রথম পৃষ্ঠার প্রতিবেদন)
৭ ডিসেম্বর ১৯৭১, আনন্দবাজার পত্রিকা : ‘বাংলাদেশ সরকারকে ভারত স্বীকৃতি দিল।’
৭ ডিসেম্বর ১৯৭১, ইভনিং এক্সপ্রেস : ‘ভারতীয় জেট বিমানের আক্রমণে ঢাকা বিধ্বস্ত।’
৭ ডিসেম্বর ১৯৭১, নিউইয়র্ক টাইমস : ‘ভারত পূর্ব রণাঙ্গনের শত্রুদের চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলার কৌশল অবলম্বন করছে।’
৭ ডিসেম্বর ১৯৭১, দ্য গার্ডিয়ান : ‘ঠান্ডা মাথায় সভ্য সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।’
৮ ডিসেম্বর ১৯৭১, দ্য গার্ডিয়ান : ‘ঢাকার পথে ভারতীয় বাহিনীর ত্বরিত বিজয়।’
৯ ডিসেম্বর ১৯৭১, বাল্টিমোর সান : ‘উৎফুল্ল বাঙালি জনতা যশোরে ভারতীয় বাহিনীকে অভিনন্দন জানাচ্ছে।’
৯ ডিসেম্বর ১৯৭১, ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড : ‘ঢাকার দিকে অগ্রসর হচ্ছে ভারতীয় বাহিনী।’
৯ ডিসেম্বর ১৯৭১, দ্য গ্যাস্টোনিয়া গেজেট : ‘ঢাকাকে ঘিরে আরোপ শক্ত হচ্ছে ভারতীয় ফাঁদ।’
১০ ডিসেম্বর ১৯৭১, বার্মিংহাম পোস্ট : ‘পাকিস্তানে অস্ত্রের চালান বন্ধ করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।’
১০ ডিসেম্বর ১৯৭১, দ্য হার্ভার্ড ক্রিমসন : ‘পাকিস্তানি সৈন্যরা পিছু হটে ঢাকায় সমবেত হচ্ছে।’
১০ ডিসেম্বর ১৯৭১, নিউইয়র্ক টাইমস : ‘ভারত জানিয়েছে চারদিক থেকে ঢাকা ঘিরে ফেলায় শত্রুরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে।’
১০ ডিসেম্বর ১৯৭১, ল্যান্সিং স্টেট জার্নাল : ‘ভারত পূর্ব পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের আহ্বান অব্যাহত রেখেছে।’
১০ ডিসেম্বর ১৯৭১, দ্য গার্ডিয়ান : ‘ভারতের বিজয় কোন পথে?’
১০ ডিসেম্বর ১৯৭১, কভেন্ট্রি ইভনিং পোস্ট : ‘পাকিস্তান বাহিনীর পশ্চাদপসরণ।’
১১ ডিসেম্বর ১৯৭১, দ্য গার্ডিয়ান : ‘আগামী সপ্তাহেই ঢাকার পতন অনিবার্য।’
১২ ডিসেম্বর ১৯৭১, নিউইয়র্ক টাইমস : ‘পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলে সামরিক পরিস্থিতিকে ‘ভয়াবহ’ বলে অভিহিত করেছে।’
১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১, কোয়াড সিটি টাইমস : ‘ভারত বলেছে শীঘ্রই ঢাকার পতন হবে।’
১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১, দ্য হাচিনসন নিউজ : ‘ঢাকার উপকণ্ঠে পৌঁছে গেছে ভারতীয় বাহিনী।’
১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১, নিউইয়র্ক টাইমস : ‘ঢাকায় বড় ধরনের আক্রমণের জন্য ভারতীয় সামরিক বাহিনীর প্রস্তুতি’ এবং ‘যুদ্ধবিরতির পদক্ষেপ নিতে জাতিসংঘের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বান’ (প্রথম পাতার প্রতিবেদন)।
১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১, ফিলাডেলফিয়া ডেইলি নিউজ : ‘এখানে একটি ‘বাংলাদেশ’ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।’
১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১, ডেইলি মেইল (লন্ডন) : মিরর প্রতিনিধি ডোনাল্ড ওয়াইজ প্রেরিত প্রতিবেদন : ‘টাইগার নিয়াজীর দুর্গের অভ্যন্তরে’ এবং ‘ভারত যুদ্ধবিরতিতে আগ্রহী তবে পাকিস্তানকে আত্মসমর্পণ করতে হবে।’
১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১, লুবক অ্যাভালাঞ্চ জার্নাল : ‘ঢাকার চারপাশে ভারতীয় কামানের ব্যূহ।’
১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১, লাস ভেগাস অপটিক : ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানীতে ভারতের বোমাবর্ষণ।’
১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১, নিউইয়র্ক টাইমস : ‘ভারতীয় বাহিনীর কামানের আওতায় ঢাকা শহর’ (প্রথম পাতার প্রতিবেদন)।
১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১, দ্য গার্ডিয়ান : ‘ভারত পূর্ববাংলায় পাকিস্তান বাহিনীকে পূর্ণ আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়েছে।’
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, বার্মিংহাম পোস্ট : ‘সোভিয়েত রাশিয়ার উপর্যুপরি ভেটোর কারণে ‘শান্তি প্রস্তাব’ অনুমোদন করতে পারছে না জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ।’
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, বার্মিংহাম পোস্ট : ‘চারপাশে অবরুদ্ধ ঢাকায় টাইগার নিয়াজীর যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব।’
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, নিউইয়র্ক টাইমস : ‘নিয়াজীর প্রতি মানেকশর বার্তা।’
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, হেরাল্ড-টাইমস : ‘জেনারেল নিয়াজী ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আত্মসমর্পণ-দলিলে স্বাক্ষর করলেন।’
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, ডেইলি গ্লোব : ‘পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ।’
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, ফিলাডেলফিয়া ডেইলি নিউজ : ‘পূর্ব পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের পর ভারত যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে।’
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, দ্য ব্রিজপোর্ট পোস্ট : ‘ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর পতনের পর ভারত স্বীয় সৈন্যদের পশ্চিমাঞ্চলে যুদ্ধ বন্ধ করার নির্দেশ দিলো।’
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, দ্য টাইমস অফ লন্ডন : ‘অশ্রুসিক্ত চোখে পাকিস্তানি জেনারেল রেসকোর্সের অনুষ্ঠানে স্বাক্ষর দিলেন।’
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনাল (বার্তা সংস্থা) : ‘মিসেস গান্ধী ভারতকে সতর্ক থাকার জন্য তাগিদ দিয়েছেন।’
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, দ্য গার্ডিয়ান : ‘বাংলাদেশের প্রচুর বৈদেশিক সাহায্যের প্রয়োজন হবে।’
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, বুলেট টেলিগ্রাফ : ‘পূর্ব পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ।’
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, দ্য জর্নাল ট্রিবিউন : ‘ইন্ডিয়ার ঘোষণা : পাকিস্তান আত্মসমর্পণ করেছে।’
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, নিউইয়র্ক টাইমস : ‘আক্রমণ স্থগিত।’
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, নিউইয়র্ক টাইমস : ‘বোমাবর্ষণ বন্ধ।’
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, নিউইয়র্ক টাইমস : ‘ঢাকা দখল : যুদ্ধবিরতি’ (প্রথম পাতায় আট কলাম জোড়া প্রতিবেদন)।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, কভেন্ট্রি ইভনিং পোস্ট : ‘এতক্ষণে ইয়াহিয়ার যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব।’
১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১, ম্যানিটক হেরাল্ড টাইমস : ‘পাক-ভারত যুদ্ধ সমাপ্ত : সমস্ত সংঘর্ষ বন্ধ।’
১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১, ডেইলি ওয়ার্ল্ড : ‘৭৮ মিলিয়ন আত্মা, নবজাতক বাংলাদেশের বিপজ্জনক শৈশবকাল।’
১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১, দ্য অস্টিন স্টেটসম্যান : ‘ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ থামলো পূর্ব-পশ্চিম উভয় রণাঙ্গনে।’
১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১, দ্য গার্ডিয়ান : ‘বাংলায় বিজয়ের পর পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধ বন্ধ করলো ভারত।’
১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১, দ্য হল্যান্ড ইভেনিং সেন্টিনেল, মিশিগান : ‘ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এখন শেষ।’
১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১, ইভেনিং টেলিগ্রাফ : ‘সব শেষ – যুদ্ধবিরতিতে সকলপক্ষ সম্মত।’
১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১, ডিক্সন ইভনিং টেলিগ্রাফ : ‘১৪ দিনের যুদ্ধ শেষে পূর্ব পাকিস্তান এখন বাংলাদেশ।’
১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১, প্রেস অ্যান্ড সান বুলেটিন : ‘পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পশ্চিম রণাঙ্গনে অস্ত্রবিরতি মেনে নেওয়ায় যুদ্ধ শেষ হলো।’
১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১, দ্য গার্ডিয়ান : ‘পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ – প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প।’
১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১, ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল : ‘পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে পূর্বাঙ্গনে যুদ্ধের সমাপ্তি হলো’ এবং ‘ভারতীয় বাহিনীর ঢাকা প্রবেশ’ (প্রথম পাতার আট কলাম জোড়া খবর, সঙ্গে দুটি ফটো)।
১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১, বার্মিংহাম পোস্ট : ‘ইয়াহিয়া খানের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার।’
১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট : ‘আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে পূর্ব রণাঙ্গনে যুদ্ধ শেষ হলো।’
১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১, জাপান টাইমস : ‘ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধ শেষ হয়েছে।’
১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১, কভেন্ট্রি ইভনিং পোস্ট : ‘খেলা শেষ – যুদ্ধবিরতিতে উভয়পক্ষ সম্মত।’
১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১, সিডনি মর্নিং হেরাল্ড : ‘পাকিস্তানি বহিনীর আত্মসমর্পণ।’
১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১, নিউইয়র্ক টাইমস : ‘পূর্ব পাকিস্তানে আত্মসমর্পণের খবরে পশ্চিম পাকিস্তানে বিক্ষোভ।’
১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১, জার্নাল : ‘রয়টারের প্রতিনিধির আত্মসমর্পণ-পরবর্তী ঢাকায় প্রবেশ।’
১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১, বার্মিংহাম পোস্ট : ‘ভারত ও পাকিস্তান অর্জন ও বিসর্জনের হিসাব কষছে এখন।’
১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ : নিউইয়র্ক টাইমস : ‘বাংলার সম্ভ্রান্ত ১২৫ জনকে হত্যা করা হয়েছে।’
২০ ডিসেম্বর ১৯৭১, টাইম ম্যাগাজিন : ‘বাংলাদেশ : যুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি জাতির অভ্যুদয়।’
২০ ডিসেম্বর ১৯৭১, দ্য গার্ডিয়ান : ‘ভুট্টো পাকিস্তানের নতুন রাষ্ট্রপতি।’
২০ ডিসেম্বর ১৯৭১, বার্মিংহাম পোস্ট : ‘জুলফিকার আলী ভুট্টো ইয়াহিয়ার স্থলাভিষিক্ত হবেন।’
২১ ডিসেম্বর ১৯৭১, নিউইয়র্ক টাইমস : ‘কে জানে কত লক্ষ বাঙালিকে পূর্ব পাকিস্তানে হত্যা করা হয়েছে।’
২১ ডিসেম্বর ১৯৭১, ইভনিং পোস্ট : ‘পূর্ব পাকিস্তানকে পুনরুদ্ধারের জন্য নতুন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার ভুট্টো সংগ্রাম করবেন।’
২১ ডিসেম্বর ১৯৭১, নিউইয়র্ক টাইমস : ‘পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবকে মুক্তির ব্যাপারে ঘোষণা দিয়েছে।’
২২ ডিসেম্বর ১৯৭১, দ্য জার্নাল হেরাল্ড : ‘পাকিস্তান জানিয়েছে বাঙালিদের নেতা শেখ মুজিব জীবিত আছেন।’
২২ ডিসেম্বর ১৯৭১, রেডিও পাকিস্তান : ‘পাকিস্তানের নবনিযুক্ত রাষ্ট্রপতি এবং চিফ মার্শাল ল’ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর জুলফিকার আলী ভুট্টোর সিদ্ধান্ত মোতাবেক পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবকে মিয়াঁওয়ালী কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।’
২২ ডিসেম্বর ১৯৭১, নিউইয়র্ক টাইমস : ‘শেখ মুজিব মুভড ফ্রম প্রিজন টু হাউজ অ্যারেস্ট।’ লেখা হয় – ‘তাকে অজ্ঞাত স্থানে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে।’
২২ ডিসেম্বর ১৯৭১, নিউইয়র্ক টাইমস : ‘যে সকল বিহারি শত্রুদের সহায়তা করেছিল বাঙালিরা তাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে।’
২৯ ডিসেম্বর ১৯৭১, নিউইয়র্ক টাইমস : ‘মুক্তিযোদ্ধারা হারানো স্বজনদের খুঁজে ফিরছেন।’
১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাদলের যৌথবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের উপরোল্লিখিত বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদন পরীক্ষা করে বলা যায়, অধিকাংশ সংবাদপত্র ঘটনাটিকে পাক-ভারত যুদ্ধের অবসান বলে বিবেচনা করেছে। কোনো পত্রিকা একে পাক-ভারত যুদ্ধবিরতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। কেউ দেখেছে এটি পাকিস্তানের হার ও ভারতের বিজয় হিসেবে; লিখেছে ভারতের জয়, পাকিস্তানের পরাজয়। ১৬ই ডিসেম্বর তারিখে অপরাহ্ণে ঢাকা শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত রেসকোর্স মাঠে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর কাছে পাকিস্তানি সেনাদল আত্মসমর্পণ করেছে – এটাই ছিল অধিকাংশ পত্রপত্রিকার প্রধান বার্তা।
অন্যদিকে এরকম শিরোনাম বিরল যে ‘চৌদ্দ দিনের যুদ্ধ শেষে পূর্ব পাকিস্তান এখন বাংলাদেশ’ (১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১, ডিক্সন ইভনিং টেলিগ্রাফ)। ‘পূর্ব পাকিস্তান এখন বাংলাদেশ’ প্রশংসার্হ একটি শিরোনাম যার যাথার্থ্য প্রশ্নাতীত। কিন্তু আমরা জানি এটা পাকিস্তান ও ভারতের ১৪ দিনের যুদ্ধ ছিল না। এই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ২৫শে মার্চ রাতে চট্টগ্রামে সশস্ত্র সেনাবিদ্রোহের মধ্য দিয়ে। এটি ছিল বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বিদ্রোহ, প্রতিরোধ ও যুদ্ধ।
টাইম ম্যাগাজিন ২০শে ডিসেম্বর ১৯৭১ সংখ্যার প্রচ্ছদে লিখেছিল : ‘বাংলাদেশ : যুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি জাতির অভ্যুদয়’। ১৬ বা ১৭ ডিসেম্বর প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকাগুলিতে এরকম শিরোনাম ছিল না বললেই চলে। আমরা ১৭ই ডিসেম্বরের অস্ট্রেলিয়ার দি এইজ পত্রিকা এখনো সংগ্রহ করতে পারিনি। আমরা আশা করি এটিতে হয়তো বস্তুনিষ্ঠতা থাকবে। কারণ ২৭ মার্চ ১৯৭১-এ দ্য এইজ (অস্ট্রেলিয়া) পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘ঢাকা আর পাকিস্তানের অংশ হিসেবে থাকবে না।’ এছাড়া এ-পত্রিকায় ২৯শে মার্চ ১৯৭১-এ প্রকাশিত সম্পাদকীয় নিবন্ধ ছিল ‘পাকিস্তানের দুঃখজনক পরিণতি।’
মার্কিন সাংবাদিক টম টিডি ১৬ই ডিসেম্বরের ঘটনাবলির ওপর একাধিক প্রতিবেদন রচনা করেন। ১৭ই ডিসেম্বর তারিখে কেনোসা নিউজ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর সংবাদ প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল – ‘এখন সেখানে সত্যই এক বাংলাদেশ।’ একই দিনে টেক্সাস থেকে প্রকাশিত ব্রাউনউড বুলেটিনে প্রকাশিত প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তবতা’। টম টিডি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার্তা সংস্থা নিউজপেপার এন্টারপ্রাইজ অ্যাসোসিয়েশনের যুদ্ধবিষয়ক প্রতিবেদক ছিলেন। তিনি যথার্থ অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, ১৬ই ডিসেম্বর তারিখে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ কেবল একটি যুদ্ধবিরতি ছিল না, তা ছিল একটি জাতির নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিণতি এবং বিশ্বের মানচিত্রে ‘বাংলাদেশ’ নামক নতুন একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়। টম টিডির এই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে ১৭ ও ১৮ই ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক আঞ্চলিক পত্রিকা স্বাধীন রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’-এর অভ্যুদয়ের সংবাদটি সঠিকভাবে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছিল।
শেখ মুজিবের বিচার
১৯৯৭-এ প্রকাশিত পাকিস্তানের কারাগারে শেখ মুজিবের নয় মাস গ্রন্থে আহমেদ সালিম লিখেছেন, ‘সেনাবাহিনীর দ্বারা গ্রেপ্তার হওয়ার অপেক্ষায় শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ধানমন্ডির বাসায় বসে ছিলেন, আওয়ামী লীগের চরমপন্থিরা তখন তাড়াহুড়া করে তাদের স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘোষণা করে। মুজিবকে গ্রেপ্তার করে করাচি নিয়ে যাওয়া হয় ২৬শে মার্চ সকালে।’ কিন্তু একথা ঠিক নয়। ১৯৭২-এর ১৮ জানুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্য টাইমস পত্রিকায় শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন মুদ্রিত হয়েছিল। সাক্ষাৎকারের ভাষ্য অনুযায়ী, গ্রেপ্তারের পর শেখ মুজিবকে তেজগাঁও সংসদ ভবনে অবস্থিত সামরিক দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল; বসার জন্যে সেখানে একটি চেয়ার দেওয়া হয়েছিল; এমনকি তাঁকে চা-বিস্কুট খেতে দেওয়া হয়েছিল। এরপর তাঁকে একটি স্কুলভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। এটি ছিল ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরভাগে অবস্থিত আদমজী পাবলিক স্কুল। পরদিন তাঁকে জেনারেল টিক্কা খানের বাসভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। পাঁচ রাত তিনি সেখানেই ছিলেন। এপ্রিলের ১ তারিখ অপরাহ্ণে তাঁকে ঢাকা বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের একটি বিশেষ বিমানে তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। বিমান প্রথমে করাচি বিমানবন্দরে অবতরণ করে। অতঃপর তাঁকে করাচি থেকে রাওয়ালপিন্ডি নিয়ে যাওয়া হয়। ২রা এপ্রিল (১৯৭১) থেকে পরবর্তী আট মাসের জন্য তাঁর ঠিকানা হয় লায়ালপুর কারাগার।
পাকিস্তানের কারাগারে আটক শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার নিয়ে যথেষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। এর কারণ হলো, সমগ্র বিচার প্রক্রিয়াটি গোপনে সংঘটিত হয়েছিল। ১৯৭১-এর ৪ঠা আগস্ট পাকিস্তান টেলিভিশনকে দেওয়া এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেন যে, আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার হবে; দেশদ্রোহিতার অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তিনি আরো বলেন যে, ১৯৭০-এর নির্বাচনে শেখ মুজিবের দাবি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের ‘স্বাধিকার’ আদায়। কিন্তু নির্বাচনে জেতার পর তিনি ও তাঁর কিছু দোসর বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রম শুরু করে। এক প্রশ্নের উত্তরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেন, শেখ মুজিব পাকিস্তানি নাগরিক এবং দেশের আইন অনুসারে তাঁর বিচার পরিচালিত হবে।
শেখ মুজিবের বিচার প্রক্রিয়ার খবরটি পরদিন সারা বিশ্বে প্রচারিত হয়ে যায়। যার ফলশ্রুতিতে শেখ মুজিবের ভাগ্য নিয়ে ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়করা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। অনেকেই মনে করতে শুরু করেন যে, এটা হবে বিচারের নামে প্রহসন এবং এক ধরনের ‘জুডিশিয়াল কিলিং’। অবশ্য একাধিক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, আদালত মৃত্যুদণ্ড দিলেই তা কার্যকর করা হবে. তা নয়। দেশের মানুষ চাইলে শেখ মুজিবকে ক্ষমা করা হবে।
১১ই আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। লন্ডনের টেলিগ্রাফ পত্রিকার ১৫ই আগস্ট সংখ্যায় জানানো হয়, ১১ই আগস্ট বুধবার শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারকার্য শুরু করা হয়েছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা ও অন্যান্য অভিযোগে তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। লাহোর থেকে ৮০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে লায়ালপুর (বর্তমানের ফয়সালাবাদ) কারাগারের অদূরে একটি সরকারি ভবনে আদালত স্থাপন করা হয়েছে। তিন সদস্যের বিশেষ সামরিক আদালতের প্রধান ছিলেন একজন ব্রিগেডিয়ার। শেখ মুজিবকে পুলিশ প্রহরায় আদালতে আনা হয়। তাঁর পরনে ছিল সাদা পাঞ্জাবি ও ঢোলা পায়জামার ওপর ওয়েস্ট কোট। চোখে ছিল কালো ফ্রেমের চশমা।
২০শে আগস্ট রেডিও পাকিস্তানের খবরে জানানো হয়, নামজাদা আইনজীবী এ. কে. ব্রোহী শেখ মুজিবুর রহমানের আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। খবরে আরো বলা হয়, মক্কেলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের জন্য ব্রোহী সাহেব ইতোমধ্যে করাচি থেকে রাওয়ালপিন্ডি চলে গেছেন। রেডিও পাকিস্তান আরো জানায়, শেখ মুজিব কয়েকজন আইনজীবীর একটি তালিকা দিয়েছিলেন যাতে প্রথমোক্ত আইনজীবী ব্রোহী সাহেবকেই আসামিপক্ষের আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালনের বিষয়ে রাজি করানো হয়েছে। ১৯৭২-এর ১৮ই জানুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্য টাইমস পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে শেখ মুজিবুর রহমান আইনজীবী হিসেবে এ. কে. ব্রোহীকে দেওয়ার কথাই উল্লেখ করেছিলেন।
বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে সর্বাগ্রগণ্য প্রশ্ন হলো, তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় দেওয়া হয়েছিল কি-না। দেওয়া হয়ে থাকলে রায়ের একটি কপি সংগ্রহ করা জরুরি। এছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে কী ধরনের সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছিল তা-ও জানা দরকার। তবে একজন ইতিহাসবেত্তার যা জানা সবচেয়ে বেশি জরুরি তা হলো, ওই সামরিক আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনে পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিব কী বলেছিলেন। দুঃখের বিষয় কখনোই সরকারিভাবে শেখ মুজিবের এই জবানবন্দি সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
আহমেদ সালিম তাঁর ব্লাড বিটেন ট্র্যাক গ্রন্থে লিখেছেন, ‘৩ ডিসেম্বর আদালতের কাজ শেষ হয় এবং ৪ ডিসেম্বর আদালত সর্বসম্মতভাবে কেবল পিতার মৃত্যুকালে অনুপস্থিত একমাত্র বেসামরিক সদস্য ব্যতীত, শেখ মুজিবকে আনিত সকল অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে ও মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রদান করে।’
অন্যদিকে ডেভিড ফ্রস্টের সাক্ষাৎকারে বিচারের প্রসঙ্গটি অবধারিতভাবে উঠে এসেছিল। ফ্রস্ট জিজ্ঞেস করেছিলেন : ‘পাকিস্তানে বন্দি থাকাকালে ওরা আপনার বিচার করেছিল। সেই বিচার সম্পর্কে কিছু বলুন। আপনার বিরুদ্ধে কি অভিযোগ আনল ওরা?’
জবাবে শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘অভিযোগের মধ্যে ছিল রাষ্ট্রদ্রোহ, পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ, পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার ষড়যন্ত্র, আরো কত কি! ১২ দফার অভিযোগ। এর ছ’টাতেই একেবারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু!’
ফ্রস্ট আবার শুধালেন, ‘আপনার পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন? আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো উপায় ছিল?’
শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘সরকারের তরফ থেকে গোড়ায় একজন আইনজীবী দিয়েছিল। কিন্তু আমি যখন দেখলাম, অবস্থাটা এমন যে যুক্তির কোনো দাম নেই, দেখলাম এ হচ্ছে বিচারের নামে প্রহসন, তখন আমি আদালতে দাঁড়িয়ে বললাম, জনাব বিচারপতি, দয়া করে আমাকে সমর্থনকারী আইনজীবীদের অব্যাহতি দিন। আপনারা বিলক্ষণ জানেন, এ হচ্ছে এক গোপন বিচার। আমি বেসামরিক নাগরিক লোক, আমি সামরিক লোক নই। আর আমার কিনা কোর্ট মার্শাল করা হচ্ছে!’
ফ্রস্ট জিজ্ঞেস করলেন, ‘তার মানে আপনি আদালতে যাওয়া বন্ধ করেছিলেন?’
শেখ মুজিব উত্তর দিলেন, ‘তার তো কোনো উপায় ছিল না। আমি তো কয়েদি।’
ডেভিড ফ্রস্ট আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘বিচার প্রক্রিয়া কি সম্পূর্ণ হয়েছিল? আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো রায় দেওয়া হয়েছিল?’
শেখ মুজিবের উত্তর, ‘৪ঠা ডিসেম্বর (১৯৭১) ওরা আদালতের কাজ শেষ করে। সঙ্গে সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য সব বিচারক, যথা লেফটেন্যান্ট কর্নেল, ব্রিগেডিয়ার – এদের সবাইকে রাওয়ালপিন্ডি ডেকে পাঠানো হয়। সেখানে ঠিক করল ওরা আমায় ফাঁসি দেবে।’
এ প্রসঙ্গে প্রণিধানের বিষয় হলো : ১৯৭২-এর ১৮ই জানুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্য টাইমস পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে শেখ মুজিবুর রহমান জানিয়েছিলেন, ইয়াহিয়া খানরা ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
সকল দলিলপত্র এবং সংবাদ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে প্রতীয়মান হয়, আদালত কর্তৃক শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসির আদেশ প্রদানের জনশ্রুতি সঠিক নয়। বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেও ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার কারণে আদালত রায় লিখে উঠতে পারেননি। আদালত রায় দিলে তা বঙ্গবন্ধুকে পড়ে শোনানো হতো এবং মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কনডেমড সেলে রাখা হতো। তাছাড়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হলে তা পাকিস্তানের ডন বা অন্য কোনো পত্রিকায় প্রকাশিত হতো। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, মিয়াঁওয়ালী কারাগারে ভারতীয় বিমানবাহিনীর বোমাবর্ষণ হতে পারে – এই আশঙ্কায় শেখ মুজিবের কারাকক্ষের সন্নিকটে একটি ‘এল’ (খ) আকৃতির ট্রেঞ্চ কাটা হয়েছিল।
শেখ মুজিবের মুক্তি
পাকিস্তানের কারাগার থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি সম্পর্কে বিভিন্ন গ্রন্থে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। কারাগার থেকে মুক্তি এবং পাকিস্তান ত্যাগ দুটি পৃথক বিষয় হিসেবে বিবেচনার দাবি রাখে। শেখ মুজিবুর রহমানকে লায়ালপুর (ফয়সালাবাদ) কারাগারে অন্তরীণ রাখা হয়েছিল। সেখানেই তাঁর বিচার হয়। ডিসেম্বরের ৩ তারিখে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে তাঁকে ডিসেম্বরের ৪ তারিখে লায়ালপুর কারাগার থেকে মিয়াঁওয়ালী কারাগারে নেওয়া হয়। মিয়াঁওয়ালী কারাগারের এক বন্দির বিবরণ অনুযায়ী, ডিসেম্বরের শুরুর দিকে এক রাতে জেল কম্পাউন্ডে একটি হেলিকপ্টার অবতরণ করে। হেলিকপ্টার থেকে কে বা কারা নেমে এলো সেটা তারা দেখতে পায়নি। কেননা তাদের সেল তালাবদ্ধ ছিল। সকালে তারা জানতে পারে, শেখ মুজিবকে লায়ালপুর জেল থেকে মিয়াঁওয়ালী আনা হয়েছে।
১৬ই ডিসেম্বর বিকেল ৪টায় পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করার পরে গভীর রাতে খাজা তোফায়েল নামে একজন জ্যেষ্ঠ কারা কর্মকর্তা মিয়াঁওয়ালী জেলখানায় আসেন এবং শেখ মুজিবের কারাকক্ষ এলাকার বহির্দ্বারে খুব জোরে করাঘাত করেন। শেখ মুজিবের নজরদার রাজা আনার খান ভেতর থেকে গেটের তালা খুলে দেন। তারপর দুজনে মিলে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মিয়াঁওয়ালী জেলখানা থেকে নিষ্ক্রান্ত হন। এ সময় শেখ মুজিব প্রশ্ন করেন, তাঁকে ফাঁসিকাষ্ঠে নেওয়া হচ্ছে কি না।
উত্তরে খাজা তোফায়েল বলেন, ‘আপনার পরিচয় ফাঁস হয়ে গেছে এবং জেলে থাকলে আপনার জীবন বিপন্ন হতে পারে; এ কারণে আপনাকে কারাগারের চৌহদ্দি থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।’
খাজা তোফায়েল ছিলেন কারা কর্মকর্তা এবং তখন স্পেশাল ব্রাঞ্চের এসপি ছিলেন শেখ আবদুর রহমান। তাঁরা বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার খাতিরে নিজেদের উদ্যোগেই তাঁকে মুক্ত করেছিলেন। না, এ-ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কারো নির্দেশ ছিল – তা নিয়ে কোথাও কারো লেখালেখি নেই। কিন্তু বিষয়টি যে কৌতূহলোদ্দীপক তাতে কোনো সন্দেহ নেই। উল্লেখ্য, রাজা আনার খান ছিলেন স্পেশাল ব্রাঞ্চের তরুণ গোয়েন্দা কর্মকর্তা, যিনি শেখ মুজিবকে ‘বাবা’ বলে সম্বোধন করতেন।
মিয়াঁওয়ালী জেলখানার অদূরবর্তী স্থানে একটি ফাঁকা বাড়িতে শেখ মুজিবের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। এটি ছিল স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিএসপি (হেডকোয়ার্টার্স)-এর জন্য নির্ধারিত বাড়ি। এ-বাড়িতে দু-তিনদিন থাকার পর শেখ মুজিবকে চশমা ব্যারেজে আরেকটি নতুন বাড়িতে স্থানান্তর করা হয়। কয়েক মাস আগে চশমা ব্যারেজের নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয়েছিল। পরবর্তীকালে, ২৫ বা ২৬শে ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুকে হেলিকপ্টারে করে রাওয়ালপিন্ডি শহরের কাছে অবস্থিত সিহালা রেস্ট হাউসে স্থানান্তর করা হয়। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘শেখ মুজিব মুভড ফ্রম প্রিজন টু হাউস অ্যারেস্ট’।
সিহালা রেস্ট হাউসটি সিহালার পুলিশ ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে কমান্ড্যান্ট বাংলোর অদূরে অবস্থিত। ছয় কক্ষের সুসজ্জিত এই রেস্ট হাউস গুরুত্ববহ রাজনৈতিক বন্দিদের জন্য প্রায়শ ব্যবহার করা হয়েছে। শেখ মুজিব এই রেস্ট হাউসে কিচেন-সংলগ্ন প্রথম কক্ষেই ছিলেন ২৫শে বা ২৬শে ডিসেম্বর রাত থেকে ৮ই জানুয়ারি দিন পর্যন্ত। রেস্ট হাউসটি সুসজ্জিত হলেও এর চারপাশে কোনো সীমানা প্রাচীর (বাউন্ডারি ওয়াল) ছিল না। শেখ মুজিব পাজামা-পাঞ্জাবির ওপর ওভারকোট পরে বিকেলে লনে হাঁটাহাঁটি করতেন।
১৯৭১ সালের ২২শে ডিসেম্বর রাতের খবরে রেডিও পাকিস্তান জানায় যে, পাকিস্তানের নবনিযুক্ত প্রেসিডেন্ট এবং চিফ মার্শাল ল’ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর জুলফিকার আলি ভুট্টোর সিদ্ধান্ত মোতাবেক পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবকে মিয়াঁওয়ালী কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। ওইদিন আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার পাকিস্তানের রাজধানী রাওয়ালপিন্ডি থেকে জানায় যে, ‘পূর্ব পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের নায়ক শেখ মুজিবুর রহমানকে পশ্চিম পাকিস্তানের একটি কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে এবং কোনো একটি অজ্ঞাত স্থানে গৃহবন্দি রাখা হয়েছে।’ উল্লেখ্য, রয়টারের পাঠানো এই খবরটি পরদিন ২৩শে ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় মুদ্রিত হয়েছিল।
এখানে পাঠক স্মরণ করতে পারেন যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানে একটি বেসামরিক সরকার গঠন করেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে জাতীয় পরিষদের সদস্য পদে বিজয়ী নুরুল আমিনকে প্রধানমন্ত্রী এবং জুলফিকার আলি ভুট্টোকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়। ২০শে ডিসেম্বর ইয়াহিয়া খান পদত্যাগ করেন এবং ভুট্টো স্থলাভিষিক্ত হন। যুদ্ধ থেকে ভারতকে নিবৃত্ত করতে আন্তর্জাতিক মহলের প্রতি আহ্বান জানাতে ভুট্টো ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে জাতিসংঘে গিয়েছিলেন। নিরাপত্তা পরিষদে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে জাতিসংঘ ভবন থেকে অশ্রুময় চোখে নিষ্ক্রান্ত হন। পারিবারিক সূত্রে ইয়াহিয়া খানের জরুরি বার্তা পেয়ে তিনি ২০ তারিখে রোম হয়ে রাওয়ালপিন্ডি প্রত্যাবর্তন করেন এবং অবিলম্বে শপথগ্রহণ পূর্বক প্রেসিডেন্ট ও চিফ মার্শাল ল’ অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
পাকিস্তানে নবনিযুক্ত রাষ্ট্রপ্রধান জুলফিকার আলি ভুট্টো ২৭শে ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ করেন। ভুট্টো সর্বমোট তিনবার এই রেস্ট হাউসে এসে সাক্ষাৎ করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। পাছে ভুট্টো শেখ মুজিবকে আক্রমণ করে বসে, তাই নিরাপত্তার স্বার্থে গুলিভরা রিভলভার হাতে পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকতেন স্পেশাল ব্রাঞ্চের ইন্সপেক্টর রাজা আনার খান। শেখ মুজিব এবং ভুট্টোর মধ্যকার কথোপকথন তিনি ভালোই শুনতে পেয়েছিলেন। এছাড়া স্পেশাল ব্রাঞ্চ মাইক্রোট্রান্সমিটার লাগিয়েছিল একটি গদিওয়ালা চেয়ারের নিচে। এই কথা টেপ রেকর্ড করা হয়েছিল। কিন্তু রেকর্ডিং ভালো হয়নি। পরবর্তীকালে জার্মানিতে নিয়ে গিয়েও রেকর্ডকৃত কথোপকথন সম্পূর্ণ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে যতখানি উদ্ধার করা গিয়েছিল তার কিছু স্টেইনলি ওলপার্ট ১৯৯৩-এ প্রকাশিত তাঁর জুলফি ভুট্টো অফ পাকিস্তান : হিজ লাইফ অ্যান্ড টাইমস গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন (পৃ ২২১ থেকে ২২৫)।
সিহালার রেস্ট হাউসে ভুট্টো সাক্ষাৎ করতে এলে প্রথমেই শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘আরে তুমি এখানে কি করছ?’
ভুট্টোর উত্তর ছিল : ‘আমি তো এখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এবং চিফ মার্শাল ল’ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর।’
কথোপকথনের এক পর্যায়ে ভুট্টো বললেন, পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে এখনো এক পাকিস্তানই আছে।
উত্তরে শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘তাই যদি হয় তাহলে তুমি না, আমি হচ্ছি অখণ্ড পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ও চিফ মার্শাল ল’ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর। এখন বলো, আমি মুক্ত না বন্দি?’
ভুট্টোর উত্তর ছিল, ‘তুমি মুক্ত, কিন্তু তোমাকে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করতে আমার কয়েকদিন লাগবে।’
সিহালার রেস্ট হাউসে জুলফিকার আলি ভুট্টোর মূল উদ্দেশ্য ছিল খুব ঢিলেঢালা হলেও পশ্চিম পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি কনফেডারেশনের ব্যাপারে শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজি করানো। স্টেইনলি ওলপার্টের উপর্যুক্ত বইয়ের ভাষ্য পড়ে বোঝা যায় তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন।
শেখ মুজিব ড. কামাল হোসেনকে দেখতে চাইলে ভুট্টো পরদিনই তার ব্যবস্থা করেন। হরিপুর জেল থেকে ড. কামাল হোসেনকে পরদিন বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে আসা হয়। এছাড়া পরদিন সেনাবাহিনীর এক কর্নেল নিয়ে আসেন একটি টিভি। পরদিন থেকে খবরের কাগজও সরবরাহ করা হতে থাকে।
বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন সম্বন্ধে তুরস্ক, ইরান বা লন্ডন হয়ে বিমানযোগে ঢাকা গমনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। তিনি সরাসরি ঢাকা আগমনের পক্ষে ছিলেন। পরে তিনি লন্ডন হয়ে ঢাকা গমনের বিষয়ে সম্মতি জ্ঞাপন করেন।
৭ই জানুয়ারি রাতে ভুট্টো তৃতীয়বারের মতো শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। পরদিন ৮ই জানুয়ারি মধ্যরাতের পরে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনালের একটি বিশেষ বিমানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান থেকে লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করেন। সঙ্গে ছিলেন ড. কামাল হোসেন ও তাঁর স্ত্রী। বঙ্গবন্ধুকে বিদায় জানাতে ভুট্টো বিমানবন্দরে এসেছিলেন। লন্ডন অবধি সঙ্গে ছিলেন এয়ার মার্শাল জাফর চৌধুরী।
মুক্ত ঢাকায় মন্ত্রীপরিষদের কর্মতৎপরতা
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলেও প্রবাসী সরকার ঢাকায় আসে কয়েকদিন পরে। ডিসেম্বরের প্রথম থেকে প্রবাসী সরকার ব্যস্ত ছিলেন বাংলাদেশ স্বাধীন হলে কী করে বেসামরিক প্রশাসন পরিচালিত হবে তার প্রাথমিক নকশা প্রণয়নে। এর আগে ভারত সরকার ১৯টি জেলার জন্য ১৯ জন জেলা প্রশাসক এবং ১৯ জন পুলিশ সুপার দিতে চেয়েছিল। বাংলাদেশ সরকার শেষ পর্যন্ত এ-প্রস্তাবে সম্মত হয়নি। উল্লেখ্য, কলকাতাতেই প্রবাসী সরকারে ১৪ জন সিএসপি অফিসার, ৬২ জন ইপিসিএস অফিসার এং ৫১ জন অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা কর্মরত ছিলেন।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চল মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হচ্ছিল। অনেক জায়গায় দেশের অভ্যন্তরে অগ্রসরমান মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা রাজাকার, আলবদর প্রভৃতি বাহিনীর সদস্যদের শাস্তি দিচ্ছিলেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। শান্তি কমিটির সদস্যদেরও অনেকে, যাদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকা ছিল না, তারাও মুক্তিবাহিনীর হাতে ভয়ংকর হেনস্থার শিকার হয়েছিলেন। অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত আক্রোশ এবং প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা শুরু হয়েছিল। প্রবাসী সরকার এ-সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিল। তাদের আশঙ্কা ছিল, এরকম অরাজকতা এবং নৈরাজ্য চলতে থাকলে স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশ শাসন কঠিন হয়ে পড়বে। ১০ই ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদ জরুরি বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয় যে, যে-কোনো শর্তে মুক্ত বাংলাদেশে মানবাধিকার ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখতে হবে। বিচার ছাড়া শাস্তি আরোপ করা যাবে না। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এই সিদ্ধান্ত ঘনঘন প্রচার হতে থাকে। নবনিযুক্ত ডেপুটি কমিশনার এবং এসপিদের স্বাধীন বাংলা বেতার এবং টেলিগ্রাম মারফত সরাসরি নির্দেশ দেওয়া হতে থাকে।
১৩ই ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের সঙ্গে কয়েকজন ভারতীয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং জেনারেল সাক্ষাৎ করে ঢাকা শহরে পাকিস্তানিদের বিভিন্ন স্থাপনায় বোমাবর্ষণ এবং তৎকালীন গভর্মেন্ট হাউসে বোমাবর্ষণের অনুমতি চাইলেন। পাকিস্তানি বাহিনী যেন সম্মানজনকভাবে আত্মসমর্পণ করে এই মর্মে মিত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল মানেকশর আহ্বান ১৩ই ডিসেম্বর থেকে ভারতীয় বেতারে পুনঃপুন প্রচারিত হতে থাকে। ১৬ই ডিসেম্বর প্রত্যুষে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ জানায় যে, জেনারেল নিয়াজী ওইদিন ঢাকায় আত্মসমর্পণ করবেন।
আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পক্ষে প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর উপস্থিত থাকা জরুরি ছিল। এজন্য সরকার আগেই তাঁকে জেনারেল হিসেবে পদোন্নতিও দিয়েছিল। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে জেনারেল ওসমানীকে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়নি। তিনি ১৩ই ডিসেম্বর কুমিল্লা ও সিলেট পরিদর্শনে বের হয়ে পড়েন। ১৬ই ডিসেম্বর সকালে মন্ত্রিপরিষদ জরুরি সিদ্ধান্ত নিল যে, আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সামিরিক বাহিনীর উপপ্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ. কে. খন্দকার বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণের পর কত দ্রুত প্রবাসী সরকারের প্রধান কার্যালয় কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হবে সেটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে ঢাকার পরিস্থিতি বিবেচনা করে নেতৃবৃন্দের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রশ্নটি বিবেচনা করা হয়েছিল। সিদ্ধান্ত হয়েছিল, মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমে যাবেন, এর পরে ঢাকায় যাবেন কয়েকজন সচিবের একটি দল এবং তাঁদের সবুজ সংকেত পেলে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীবর্গ ঢাকায় যাবেন।
১৬ই ডিসেম্বর নিউইয়র্ক টাইমস-এর একটি প্রতিবেদন থেকে প্রতীয়মান হয় যে, প্রবাসী সরকারের চারজনের একটি দল কলকাতা থেকে ১৭ই ডিসেম্বর ঢাকা এসেছিলেন। ড. মশিয়ুর রহমানের মতে, আইনমন্ত্রী এএইচএম কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে চারজনের দল বিজয় দিবসের পরের দিনই ঢাকায় এসে পৌঁছেন।
ডিসেম্বরের ১৮ তারিখে যে উচ্চ পর্যায়ের অগ্রবর্তী দলকে ঢাকায় পাঠানো হয় তাঁদের মধ্যে ছিলেন মুখ্য সচিব রুহুল কুদ্দুস, রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা এএফএমএ ফতেহ, সংস্থাপন সচিব নুরুল কাদের খান, পুলিশের মহাব্যবস্থাপক, তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব আনোয়ারুল হক খান, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব কে. এ. জামান প্রমুখ।
২০শে ডিসেম্বর কলকাতা থেকে তথ্য ও বেতারের একটি দল ঢাকায় পাঠানো হয়। এই দলে ছিলেন পরিচালক এ. জে. খান, প্রযোজক ও ক্যামেরাম্যান আসিফ আলী, যুদ্ধক্ষেত্রের ফটোগ্রাফার মোহাম্মদ আলম এবং সহকারী ক্যামেরাম্যান ফেরদৌস। ওইদিন কলকাতা থেকে প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকা যাওয়ার জন্য একটি বড় দলের তালিকা ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের সদর দপ্তরে পাঠানো হয়।
২১শে ডিসেম্বর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অত্যাবশ্যক রসদের একটি তালিকা ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
২২শে ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ এবং কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা সামরিক বিমানে করে একত্রে ঢাকা ফিরে আসেন।
হাসান তৌফিক ইমাম বলেন যে, ঢাকা প্রত্যাবর্তনের পর নেতৃবৃন্দের প্রথম কাজ ছিল বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান থেকে মুক্ত করে আনা; এই লক্ষ্যেই তাঁরা সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। ভারত এবং অন্যান্য সকল বন্ধুরাষ্ট্রের মাধ্যমে এবং জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় বিশেষ করে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
১৯৭১ সালের ২৩শে ডিসেম্বর ঢাকায় প্রথম মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক সাবেক পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কেবিনেট রুমে অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে প্রথম সিদ্ধান্ত ছিল, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি প্রদান এবং প্রাক্তন স্টেট ব্যাংককে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ হিসেবে নামকরণ। স্মরণযোগ্য, আগেই বিদেশি একটি ব্যাংকে বাংলাদেশ সরকারের হিসাব খোলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। এছাড়া মন্ত্রিপরিষদের প্রথম বৈঠকে জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রবাসী সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের একটি জাতীয় মিলিশিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১১ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় মিলিশিয়ায় বোর্ড গঠিত হয়। মন্ত্রিসভার এই বৈঠকে একই সঙ্গে সকল পাটকল রাষ্ট্রায়ত্ত করার সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়।
২৭শে ডিসেম্বর মন্ত্রিসভার বৈঠকে মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ করে শেখ আব্দুল আজিজ, ফণীভূষণ মজুমদার, আবদুস সামাদ আজাদ এবং জহুর আহমেদ চৌধুরীকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করা হয়। একদিন পরে অধ্যাপক ইউসুফ আলীকেও মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। খন্দকার মোশতাক আহমেদকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়ে আবদুস সামাদ আজাদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়। এর প্রতিবাদে তিনি পদত্যাগ করেন, যদিও তাঁর পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়নি। এ সূত্রে আরো স্মরণযোগ্য যে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত দুর্গাপ্রসাদ ধর (ডি.পি. ধর) ২৩ থেকে ২৯শে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করে বাংলাদেশ সরকারকে নানা বিষয়ে সহায়তা প্রদান করেছিলেন। তাঁরই পরামর্শে খোন্দকার মোশতাক আহমেদকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
স্মরণযোগ্য যে, ১৮ই ডিসেম্বর প্রবাসী সরকারের মুখ্যসচিব রুহুল কুদ্দুসের নেতৃত্বে অগ্রগামী দল ঢাকায় পৌঁছে বোমাবর্ষণে বিধ্বস্ত ‘গভর্নমেন্ট হাউস’ পরিদর্শন শেষে তাৎক্ষণিকভাবে এই ভবনটির নতুন নাম ‘বঙ্গভবন’ রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা দ্রুত কিছু সংস্কার করে বোমা বিধ্বস্ত ভবনটি কিছুটা ব্যবহারযোগ্য করতে পেরেছিলেন। মন্ত্রিসভার আনুষ্ঠানিক দ্বিতীয় বৈঠক হয় বঙ্গভবনে। ডিসেম্বরের ২৭ তারিখে সম্প্রসারিত মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান বঙ্গভবনেই অনুষ্ঠিত হয়।
প্রতীয়মান হয় যে, ২৩শে ডিসেম্বর যখন ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কেবিনেট কক্ষে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিপরিষদ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় তখন কারো জানা ছিল না যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইতোমধ্যে কারামুক্ত হয়েছেন, তাঁর বিরুদ্ধে আনীত দেশদ্রোহিতার অভিযোগ প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং পাকিস্তান সরকার তাঁকে ঢাকায় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
২৭শে ডিসেম্বর বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে ভুট্টো কর্তৃক ২২শে ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিদানের বিষয়টি আলোচিত হয়।
২৮শে ডিসেম্বর মন্ত্রিসভার একটি জরুরি সভা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনার বিষয় ছিল সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর পোশাক নির্ধারণ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পরিচালনা, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক কাঠামো নিরূপণ, কৃষি মন্ত্রণালয়ে বাজেট প্রণয়ন, ঢাকার বেতার কেন্দ্র নতুনভাবে চালুকরণ, গণবাহিনী সদস্যদের প্রস্তাবিত জাতীয় মিলিশিয়ায় অন্তর্ভুক্তি এবং উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীদের কর্মবিন্যাস।
শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত বন্দিশিবির থেকে মুক্ত করে যথাযথ সম্মানের সঙ্গে যাঁদের সরকারের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়া হয় তাঁরা হলেন – আইয়ুবুর রহমান, আ ন ম ইউসুফ, সৈয়দ রেজাউল হায়াত, নুরুল মোমেন খান, লোকমান হোসেন, শাহ মুহাম্মদ ফরিদ প্রমুখ। ১৫ই ডিসেম্বরে ১৯টি জেলায় জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার এবং অন্যান্য কর্মকর্তা নিয়োগের আদেশ জারি করা হয়েছিল, যার ফলে কোনো প্রশাসনিক শূন্যতা দেখা যায়নি।
২৮শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত করা। ৩১শে ডিসেম্বর মন্ত্রিসভা ফুড করপোরেশন গঠন, পাটনীতি অনুমোদন, তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত তথ্য ব্যবস্থাপনা অনুমোদন, জাতীয় মিলিশিয়া টিমের জন্য বোর্ড গঠন সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও অনুমোদন, গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটি গঠন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্য থেকে দালালদের চিহ্নিতকরণ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্ত নেয়। এর আগে ২৮শে ডিসেম্বরের মন্ত্রিসভা বৈঠকে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর বিধিমালা প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয় এবং এ-বিষয়ে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই মন্ত্রিসভায় বাংলাদেশের মুদ্রা প্রসঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, অর্থনৈতিক লেনদেনের মাধ্যম টাকা হিসেবে অভিহিত হবে। এছাড়া ‘মুজিব বাহিনী’র অস্তিত্ব বিলোপ করার বিষয়টিও আলোচিত হয়।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.