একাত্তরের উত্তাপ নিয়ে বীরেন সোমের চিত্রকলা

মুক্তিযুদ্ধ তাঁর সারাজীবনের গৌরব। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সেই গৌরবকে তিনি স্পর্শ করেছিলেন। যুদ্ধ জয় করে মুক্ত করেছেন জন্মভূমি বাংলাদেশকে। শিল্পী বীরেন সোম তাঁর জীবনের এই প্রধান তিনটি বিষয়কে ভালোবেসে ছবি এঁকেছেন অজস্র। সেসব কাজের কতক নির্বাচিত চিত্রকর্ম নিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রদর্শনী করলেন ঢাকার গ্যালারি চিত্রকে।
গত শতকের ষাটের দশকের মধ্যভাগে ঢাকার চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন শিল্পী বীরেন সোম। ষাটের সেই উত্তাল সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের এগারো দফা আন্দোলন ও দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য বঙ্গবন্ধু-ঘোষিত ছয় দফার সংগ্রামে যুক্ত হয়েছেন। আন্দোলনের সমর্থনে দেয়ালে দেয়ালে সেøাগান লিখেছেন, ছবি এঁকেছেন, লিখেছেন অসংখ্য পোস্টার ও ব্যানার। সেই উত্তাল ঊনসত্তরেই চারুকলার স্নাতক হলেও ছাত্র-গণআন্দোলনে তিনি সক্রিয় ছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সেই মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বাংলার নিসর্গ, সংস্কৃতি ও জীবনবোধ নিয়ে শিল্পী অজস্র স্কেচ করেছেন, কোলাজ করেছেন, ছোট-বড় ছবি এঁকেছেন। সেই চিত্রগুলোর নির্বাচিত অংশ নিয়ে বারো দিনব্যাপী এই প্রদর্শনী হয়ে গেল গত ১৫ নভেম্বর শুক্রবার থেকে ২৬ নভেম্বর মঙ্গলবার পর্যন্ত। প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ল, ১৯৭৯ সালে চারুকলার জয়নুল গ্যালারিতে শিল্পী বীরেন সোমের প্রথম একক চিত্রপ্রদর্শনী আয়োজনের চল্লিশতম বর্ষে এটি তাঁর এগারোতম একক চিত্রপ্রদর্শনী।
বীরেন সোম শিল্পের নানা শাখায় অনবরত নিজের সৃজন করে চলেছেন বিগত অর্ধশতক ধরে। পত্রপত্রিকায় ইলাস্ট্রেশন করেছেন, বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন, বিস্তর ছবি এঁকেছেন। কালি-কলমে রেখাচিত্র, স্কেচ, জলরঙে তিনি সিদ্ধহস্ত। বিভিন্ন সময়ে আঁকা সেসবের কতক এই প্রদর্শনীতে জায়গা করে নিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে কলকাতা ও দিল্লিতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের চিত্রশিল্পীদের চিত্রপ্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া সে-সময়ের তরুণ চিত্রকর বীরেন সোমের আঁকা চিত্রকর্ম। এর চারটি চিত্রকর্ম তিনি যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছেন। সময়টার উষ্ণতা আমরা উপলব্ধি করতে পারি তাঁর এসব ঐতিহাসিক চিত্রকর্ম প্রত্যক্ষ করে।
‘স্বাধীনতা যুদ্ধ’ শিরোনামে ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক রঙে আঁকা দুটি চিত্রকর্মের প্রথমটিতে ক্ষমতা মদমত্ত এক ঘোড়া হামলে পড়েছে শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষের ওপর। এই কাজটি স্পেনের গৃহযুদ্ধের পটভূমিকায় পাবলো পিকাসো-অঙ্কিত গোয়ের্নিকার কথা মনে করিয়ে দেয়। অন্যটিতে তোবড়ানো অবয়বের বর্ষীয়ান এক মূর্তি চাঁদের মতো আলোকিত অবয়বের সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করছে। দুটি ঘটনাই দুর্বলের প্রতি সবলের নির্মমতাকে মনে করিয়ে দেয়।
বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে অধিকার আদায়ের জন্য স্বাধীনতা ও মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। তাঁর প্রেরণায় সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধ বীরেন সোমকে শিখিয়েছে দেশপ্রেম কী! সেই প্রেম ও প্রেরণাকে বুকে ধারণ করে তিনি ছবি আঁকছেন চার যুগ ধরে। এমনকি বাংলার নিসর্গকে ভালোবেসে তিনি এর রূপ-রস-রং-রেখা-আকাশ-দিগন্ত-জল- কাদামাটিমাখা রূপ তুলে ধরেন অনুবাদকের মতো বিশ্বস্ততায় নতুবা নৈর্ব্যক্তিক রূপারোপের ভাবনায়।
প্রদর্শনীতে এরূপ নিসর্গকেন্দ্রিক বেশ কিছু চিত্র দর্শকদের চোখকে আরাম দিয়েছে।
এগুলোর শিরোনাম দিয়েছেন Ñ ‘মাতৃভূমি’। নিজ ভূমির প্রতি শিল্পীর ভালোবাসা বিম্বিত হয়েছে এতে। এগুলো প্রধানত নৈর্ব্যক্তিক। তবে আমাদের প্রকৃতিতে, আশপাশেই এমন ইমেজগুলো ছড়িয়ে আছে। শিল্পী সেগুলোকে বিন্যস্ত করে চিত্রপটে তুলে এনেছেন।
বীরেন সোম শিল্পীজীবনের শুরু থেকে বহুদিন আমাদের লোকশিল্পের অঙ্কনবৈশিষ্ট্যকে আধুনিক আঙ্গিকে তাঁর চিত্রপটে তুলে ধরেছেন। যেমন Ñ পাখি হাতে নিয়ে তরুণীর অপেক্ষা, একতারা হাতে বাউল Ñ এমন ধরনের কাজগুলো আমাদের এখনো চোখে লেগে আছে। শিল্পী কামরুল হাসানকে সামনে রেখে তাঁর এই সৃজন যখন স্বকীয়তায় পূর্ণতা পাচ্ছে, তখন সেই অঙ্কনধর্মী চিত্রশৈলী থেকে সরে তিনি স্থিত হয়েছেন বিমূর্ত প্রকাশবাদী চিত্ররীতিতে।