কবিতায় গণমুখিতা ও কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ

হুমায়ূন মালিক

পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশের কবিতাঙ্গনে বেশ কয়েকজন শক্তিমান কবির আবির্ভাব হয় এবং তাঁদের হাতে বাংলা কবিতা একটি সমৃদ্ধ রূপ লাভ করে। শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, আল মাহমুদ, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, ফজল সাহাবুদ্দীন তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখের দাবিদার। বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে ষাটের দশকের গণজাগরণ ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলাদেশের আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্ভিক্ষ, রাজনৈতিক অস্থিতি ইত্যাদি এদের অস্তিত্বের সঙ্গে একাকার। এ-সময়ের মধ্যে বাংলা কবিতা বহু বাঁক, বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা অতিক্রম করে বিচিত্র বৈশিষ্ট্যমন্ডিত সমৃদ্ধির দিকে অগ্রসর হয়েছে। অগ্রসরমান এই স্রোতে অন্যদের পাশাপাশি কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ একটি বিশেষ শক্তি ও সামর্থ্যের স্বাক্ষর রাখতে সমর্থ হন। পঞ্চাশের সমসাময়িক অন্যান্য কবির মধ্যে তাঁর বিশিষ্টতা ধরা পড়েছে তাঁর জীবনবোধ ও শিল্প-চেতনায়। শিল্পবিচারের প্রসঙ্গে না এসে যদি কেবল তাঁর এই জীবন বা সমাজ-চেতনার কথা বলা যায় তবে এটি সত্য যে, তাঁর এই চেতনা যতটা তীব্রতা পেয়েছে, যতটা জীবনের গভীরে পৌঁছেছে, সমসাময়িক অনেকের কবিতায় তেমনটি হয়নি। এক্ষেত্রে কবির গণমুখী চেতনা তীব্র আশাবাদে উজ্জ্বল হয়ে নিজস্ব একটি কাব্যসত্য নির্মাণে সমর্থ হয়েছে। তাঁর এই কাব্যসত্যের পরিপূরক উপকরণগুলো হচ্ছে দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদ, পরাবাস্তববাদ, রূপকল্পবাদ ও নবগড়নবাদ। এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে তাঁর চেতনা-বিশ্বাস ধর্ম, বর্ণ, ভৌগোলিক সীমারেখার সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে সমর্থ হয়েছে। এখানে কবির ধর্ম বিশ্বমানবতার। আজাদের কবিতায় যে-স্বদেশ তা কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের মাতৃভূমি নয়, তা সকল মানুষের নিজ নিজ মাতৃভূমি তথা স্বদেশ-চেতনার বাহক। বস্ত্তত তিনি জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণতায় শৃঙ্খলিত হয়ে পড়েননি।

আজাদের কবিতায় যে গণমুখী বিপ্ল­বী চেতনা প্রধান হয়ে উঠেছে, তা উদার মনুষ্যত্ববোধেরই উৎসারণ। পল এলুয়ারের দৃঢ়তা  – I hate the rule of bourgeois, the rule of cops, priests. I hate even the man who does not hate it as do with all my strength. তাঁর ভেতরও উপস্থিত। মানুষের জন্য তীব্র মমত্ববোধ থেকেই তাঁর এ-দৃঢ়তা, বিপ্ল­ববোধের জন্ম।

শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আল মাহমুদ, ফজল সাহাবুদ্দীন, শহীদ কাদরী – তাঁদের মধ্য থেকে গণমুখী বিপ্ল­বী চেতনাকে সার্থকভাবে ধারণ করে যাঁর কবিতা একটি স্বতন্ত্র ধারায় প্রবাহিত তিনি আলাউদ্দিন আল আজাদ। তাঁকে বলা হয় বাংলাদেশের গণচেতনামুখী কবিতার জনক। আজাদীয় গণমুখী চেতনার স্বরূপটিকে বিশেষভাবে শনাক্ত করা যেতে পারে; যেহেতু বাংলাদেশের সমকালীন গণমুখী চেতনার কবিতার তিনিই প্রধান পুরুষ। আজাদের এই বৈশিষ্ট্যকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে হলে দুটি বিষয়ের বিশ্লে­ষণ প্রয়োজন। প্রথমত, আজাদ তাঁর কবিতায় বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো মার্কসীয় তত্ত্ব কিংবা বিখ্যাত উক্তিকে সরাসরি প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর নন। সেজন্য তাঁকে পুরো মার্কসবাদী কবি বলে চিহ্নিত করা যাবে না। যেমন হাইনরিক বোল, ফয়েজ আহমদ ফয়েজ কিংবা দীনেশ দাশকে বলা যায় না মার্কসবাদী লেখক। এঁরা প্রত্যেকেই মার্কসীয় চেতনার জারকরসে সম্পৃক্ত হয়েছেন কিন্তু মোহান্ধের মতো সে-স্রোতে ভেসে যাননি। সমৃদ্ধ চেতনা-বিশ্বাসকে নির্মাণের জন্য অস্তিত্ববাদ, পরাবাস্তববাদ, রূপকল্পবাদ, নবগড়নবাদ ইত্যাদিতে অবগাহন যেমন অনিবার্য, তেমনি অনিবার্যতার একটি দিক এই মার্কসবাদ, যাতে আজাদ নিজেকে সমৃদ্ধ করেন। দ্বিতীয়ত, আজাদীয় বাম চেতনার স্বরূপ সম্পর্কে আরেকটি বিষয় সত্য যে, তিনি মূলত দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদেই আস্থাশীল তথা দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়াকে অবলম্বন করে কবিতা-সত্য নির্মাণে বিশ্বাসী, কোনো তত্ত্বই শেষ কথা কিংবা চরম সত্য বলে আজাদ বিশ্বাস করেননি। এ সবকিছুর ঊর্ধ্বে তিনি সর্বজনীন কল্যাণের কথাই ভেবেছেন।

এই কবি সর্বজনীন মানবতাবাদকেই প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর। সর্বোপরি তাঁর সাহিত্যকর্মে যে বাম-চেতনা তা সুস্থ প্রগতিশীল মানবিক উপলব্ধির ফসল। আজাদের কাব্যগ্রন্থ (১) মানচিত্র, (২) ভোরের নদী মোহনায় জাগরণ, (৩) সূর্য জ্বালার সোপান, (৪) লেলিহান পান্ডুলিপি, (৫) নিখোঁজ সনেটগুচ্ছ, (৬) আমি যখন আসবো, (৭) এসেস অ্যান্ড স্পার্কস (ইংরেজি) ইত্যাদি উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যের বাহক।

আজাদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকে তাঁর কবিতা ক্রমশ শৈল্পিক উৎকর্ষের দিকে অগ্রসরমান। প্রথম গ্রন্থে কবিতাগুলো উপমা-উৎপ্রেক্ষার সূক্ষ্ম রূপায়ণে কিংবা রূপকল্পবাদ, পরাবাস্তববাদের জটিলতায় আবৃত নয়। কিন্তু তাঁর শেষের দিকের কাব্যগ্রন্থ আমি যখন আসবোতে (প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮) এসে কবি এসবের সফল প্রয়াস বা উৎকর্ষ দেখিয়েছেন। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লে­খযোগ্য বিষয় এখানেও কবির গভীর জীবন-চেতনা আশাবাদী বিপ্ল­বী উপলব্ধির সুরে সমুজ্জ্বল। তাঁর আমি যখন আসবো কাব্যগ্রন্থের ‘পূর্বলেখ’, ‘জীবন’, ‘একটু দাঁড়াও’, ‘ফেরেনি যে জন’, ‘বাড়ি ফিরে যাবো’, ‘সময়টা’, ‘একজন প্রতারকের উক্তি’ ইত্যাদি কবিতা তার উজ্জ্বল উদাহরণ।

বিষয়বস্ত্তর সার্বিক মূল্যমানে কিংবা শিল্পবিচারে কে শ্রেষ্ঠ তা হয়তো সমালোচনার অপেক্ষা রাখে; কিন্তু গণমুখী জীবন-চেতনার গভীরতার ক্ষেত্রে আজাদের অনন্য স্বভাব, তাঁর বিশিষ্টতা অনস্বীকার্য। তাঁর কবিতাচর্চার প্রথম থেকে শেষ পর্যায় পর্যন্ত এই সত্য প্রবাহিত। তাঁর কবিতা-কর্মের ধারাবাহিকতা থেকে বিষয়টি তুলে ধরা যাক।

প্রত্যাবর্তন, চোখ, মিউজিয়ামের সিঁড়ি, প্রোফাইল, প্রার্থনার শেষ, হাসি, একটি রাতের চোখে, মুখবন্ধ, শান্তিগাথা, স্মৃতিস্তম্ভ এই দশটি কবিতাকে (১৯৪৯ থেকে ১৯৫২ সালের মধ্যে প্রকাশিত) আজাদের প্রাথমিক পর্যায় বলে চিহ্নিত করা যায়। কবিতাগুলোতে প্রকরণ কিংবা বিষয়গত উভয় দিক থেকেই তিরিশ-উত্তর এবং তিরিশ-পূর্ব কবিদের বৈশিষ্ট্যের বন্ধন, যুগপৎ বন্ধনমুক্তির স্বভাব লক্ষণীয়। এক্ষেত্রে প্রথাসিদ্ধ ধ্রুপদী ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার সংমিশ্রণ কবিতাগুলোকে বৈচিত্র্য দিয়েছে। বলা বাহুল্য, একজন কবির প্রথম আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্রে এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।

এখানে কবিতাগুলোর বিষয়ের ক্ষেত্রে জীবন-চেতনার তীব্রতাই মুখ্য হয়ে উঠেছে। এই চেতনার আলোতে কবি উপলব্ধি করেছেন বাস্তবের রূঢ়তাকে। শোষণ-শাসন, বৈষম্য আর বাস্তবের রূঢ় বৈপরীত্যকে। এই উপলব্ধিই কবিকে করে তুলেছে সংগ্রামী, যুগপৎ বাম চেতনার ধারক। সর্বোপরি বিপ্ল­বী, যে-বিপ্ল­বের মাধ্যমে কবি তাঁর আকাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের ব্যাপারে দৃঢ়ভাবে আশাবাদী। অর্থাৎ কবিতাগুলোর ক্ষেত্রে জীবন-চেতনাই মুখ্য ব্যাপার। কাব্যালঙ্কারের সমৃদ্ধি এখানে বিশেষ হয়ে ওঠেনি। তবে কিনা কাব্যকলার ব্যাপারে কবি এক্ষেত্রে একেবারেই উদাসীন সে-কথা বলা যায় না। তবে জীবন-চেতনার তীব্র স্রোত অনেক ক্ষেত্রে কাব্যালঙ্কারকে যেন উপেক্ষা করেছে। কিংবা এমনটি হওয়ার কারণ, তখন পর্যন্ত তিনি কাব্যকলায় ততটা দক্ষ হয়ে ওঠেননি।

এখন সরাসরি কবিতাগুলোর বিচার-বিশ্লে­ষণ করে দেখা যাক কী সত্য এখানে উন্মোচিত।

মুখবন্ধ, প্রোফাইল, হাসি, শান্তিগাথা প্রভৃতি কবিতায় জীবনকে পূর্ণভাবে চাওয়ার পাশাপাশি বঞ্চনা-বৈপরীত্যের সংঘাত স্পষ্ট। জীবনের প্রাপ্য অধিকারের সঙ্গে না-পাওয়ার বিরোধ, প্রার্থিত সুন্দরের সঙ্গে বাস্তবের টানাপড়েন এবং এই দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মন্থনে এখানে জন্ম হচ্ছে এক সত্যদ্রষ্টার, যিনি তাঁর কর্তব্য, তাঁর জীবনব্রত সম্পর্কে অনিবার্য বা পরম সত্যকেই যেন উপলব্ধি করেন।

উদাহরণ :

নিজ হাতে কিছু দিলে না’ক, তাই

বিনয়েরে দিই নির্বাসনেই

দস্যুর দলে লেখাই আমার নাম

জয় করে নেব তোমারে এবার

হয়েছি রাতের ঘোড়-সওয়ার

পথের পরেই কাটবে সকল মাস।

(‘মুখবন্ধ’, মানচিত্র)

কবির এই যে দ্রোহ, বিপ্ল­বের স্বপ্ন তা বিশ্বমানবতাকে সামনে রেখে। আমরা দেখেছি তাঁর এই কবিতাগুলোতে যে ইতিহাস-চেতনা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রকাশ এবং মিথলজিক্যাল ইমেজ সৃষ্টির প্রয়াস তা কোনো শ্রেণি বা জাতি কিংবা ভৌগোলিক সীমারেখায় সীমাবদ্ধ নয়।

উদাহরণ :

নীল-নদ ঘেরা বৈজয়ন্ত প্রাসাদে

কত দুরন্ত ছায়া নাট্যের মহড়া,

পিরামিড আর মমি নয় তার কাহিনী,

তারি বিবৃতি পার্সি পোলিসে লেখা

রোমের বিজয়স্তম্ভ ভোলেনি সে গাথা

ভোলেনি কোনো বাগদাদের শীর্ষ সুজাতা।

(‘শান্তিগাথা’, মানচিত্র)

এখান থেকেই আমরা কবির ভেতর এক আন্তর্জাতিকতাবোধ-সমৃদ্ধ মানুষের সাক্ষাৎ পাই। এবং তিনি যখন উচ্চারণ করেন  –

শান্তি শিবিরে লৌহসেনানী আমরা

শ্বেত-কপোতের পাখার ছায়ায় দুর্জয় ব্যূহ রচেছি

সৌর বলয়ে সূর্যের মতো প্রহরা,

লৌহসেনানী আমরা।

(‘শান্তিগাথা’, মানচিত্র)

এই উচ্চারণ থেকেই কবির দৃঢ়তার পরিচয় মেলে। এই দৃঢ়তা, দুর্জয় ব্যূহ থেকেই তাঁর বিশ্বমানবতা বোধের উৎসারণ। তবে এই সত্যটি এখানে উজ্জ্বল যে, কবি প্রথমে তাঁর স্বদেশের কথা বলেছেন। কিন্তু এ শুধু কবির স্বদেশ নয়। সমগ্র মানব জাতির স্বদেশ। যেহেতু পরবর্তী পঙ্ক্তিতেই কবি পৃথিবীর কথা বলেন।

উদাহরণ :

গ্রাম-নগর ও পথে-প্রান্তরে দিই ডাক

স্বদেশ আমার হুঁশিয়ার

রণদৈত্যের অক্ষৌহিনী তোলে হাঁক

পৃথিবী আমার হুঁশিয়ার!!

(‘শান্তিগাথা’, মানচিত্র)

উপরোক্ত যে-বক্তব্য তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশে উন্মোচিত হলো, পরবর্তীকালে তা ক্রমশ পুষ্টি লাভ করে ব্যাপকতার দিকে, সমৃদ্ধি ও পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হয়েছে।

 

আজাদের কবিতায় সমাজ, সমাজ-চেতনা ও বিপ্ল­ব

আলাউদ্দিন আল আজাদের প্রথম কাব্যগ্রন্থে গণমুখী জীবন-চেতনা খুব স্পষ্ট। এই চেতনা পুঞ্জীভূত হয়েছে বিপ্লবী বিশ্বাসে। চেতনার দর্পণে তিনি উপলব্ধি করেছেন শ্রেণিবিভেদ, শোষণ, শাসন, অসাম্য। এই উপলব্ধি থেকেই তিনি এর পরিবর্তনের মহৎ ইচ্ছাকে লালন করেন। জন্ম দেন বিপ্লবী বাম-চেতনার। এক্ষেত্রে দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঘটনা তাঁর বাম-চেতনায় ব্যাপকভাবে প্রভাব রেখেছে এবং তা হয়ে উঠেছে তীব্র, তীক্ষ্ণ, তির্যক ও বস্ত্ততান্ত্রিক।

উদাহরণ :

অথচ আমারে করেছ বন্দি

কারাগারে

কয়লা কুঠির অতল গর্ভে

প্রেতছায়া

মধ্যবিত্ত আকাশ বিদারী

আশা চোখে

ফাইলে ফাইলে সঞ্চারমান

পিপীলিকা

নিজ হাতে কিছু দিলে নাক, তাই

বিনয়েরে দিই নির্বাসনেই

দস্যুর দলে লেখাই আমার নাম

জয় করে নেব তোমারে এবার

হয়েছি রাতের ঘোড় সওয়ার

পথের পরে কাটবে সকল সময়।

(‘মুখবন্ধ’, মানচিত্র)

এক্ষেত্রে কবি পরিপূর্ণভাবে আশাবাদী। তিনি বিশ্বাস করেন, বিপ্ল­বের মাধ্যমে এই সমাজব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা সম্ভব। নাটক হবে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার – এই নবনাট্যতত্ত্বের বিশ্বাস থেকে ইবসেন নাটকের পটভূমি নির্মাণ করেছেন। শিল্পের এই গণমুখী উদ্দেশ্য সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দিনেশ দাশ, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সিকান্দার আবু জাফরের কবিতার প্রেরণা। তাঁদের কবিতা তাই মিছিলের, বিপ্ল­বের, জনতার ভাষা। আজাদের কবিতাও সে-স্বভাবকে সার্থকভাবে ধারণ করছে।

উদাহরণ :

শান্তি শিবিরে লৌহসেনানী আমরা

শ্বেত-কপোতের পাখার ছায়ায় দুর্জয় ব্যূহ রচেছি

সৌর বলয়ে সূর্যের মতো প্রহরা,

গ্রাম-নগর ও পথে-প্রান্তরে দিই ডাক

স্বদেশ আমার হুঁশিয়ার

রণদৈত্যর অক্ষৌহিনী তোলে হাঁক;

পৃথিবী আমার হুঁশিয়ার!!

(‘শান্তিগাথা’, মানচিত্র)

মার্কসবাদী চেতনার স্পষ্ট বাহক এই কবিতাগুলো শুধু যেন এক দৃঢ় উচ্চারণ। শৈল্পিক উৎকর্ষলাভের কার্যকর প্রয়াস এখানে অনুপস্থিত। যেহেতু কবিতা এখানে হাতিয়ার, সেক্ষেত্রে এর বিষয়িক কার্যকারিতার গুণই এক্ষেত্রে প্রধান। এর শৈল্পিক সৌন্দর্য নয়। যার ফলে তাঁর এই পর্যায়ের কবিতায় বক্তব্য যতটা তীক্ষ্ণ, স্পষ্ট সে-অনুপাতে কাব্যিক সাফল্যকে ধারণ করতে পারেনি। মানবমুক্তির মন্ত্রকে কেন্দ্র করে আবর্তিত দৃঢ় উচ্চারণই এখানে বড় হয়ে উঠেছে।

উদাহরণ :

ঝোপঝাড় মাঠবন প্রান্তরের

শরীরে জুড়ানো সবুজ কাঁথায় লেখো

পুষ্পের বর্ণলিপিতে লেখো।

লেখো আমি গড়ে তুলি গণতন্ত্র

ধানের গমের গুচ্ছ গণতন্ত্র

পাটের তুলোর জন্ম গণতন্ত্র

ক্ষুধার তৃষ্ণার তৃপ্তি গণতন্ত্র

দিনের রাতের দীপ্তি গণতন্ত্র

(‘গণতন্ত্র’, সূর্য জ্বালার সোপান)

কবি যেখানে কোনো তত্ত্ব, তথ্য, মূল্যবান বক্তব্যকে তুলে ধরায় তৎপর হন, সেখানে শিল্পমান ক্ষুণ্ণ হওয়াটাই স্বাভাবিক। আজাদের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। কিন্তু তাঁর অজস্র কবিতায় এমন দেখা যায় যে, বক্তব্য সেখানে সরাসরি উঠে এসেছে কিন্তু বক্তব্যের দৃঢ়তার জন্য, উপস্থাপনার নিপুণতার জন্য শৈল্পিক নির্লিপ্ততা পীড়া দিতে পারে না। বস্ত্তত বক্তব্যের জোয়ারই পাঠককে ভাসিয়ে নেয়।

কবি আলাউদ্দিন আল আজাদের কবিতায় সমাজ-চেতনার বিষয়বৈচিত্র্য বিশেষভাবে আলোচিত হওয়ার দাবি রাখে। আর এই আলোচনা অপূর্ণাঙ্গ থেকে যাবে যদি না তাঁর বিভিন্নমুখী পরিপূরক স্রোতগুলো নিয়ে আলোচনা করা যায়। আজাদের সমাজ-সচেতনতাকে পরিপূর্ণ রূপ দিতে যেসব পরিপূরক স্রোত সংযোজিত হয়েছে সেগুলো হচ্ছে :

(ক) রাজনৈতিক প্রজ্ঞা

(খ) ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ

(গ) ইতিহাস-চেতনা

(ঘ) দেশজ বা লোকজ প্রতীতি

(ঙ) ঐতিহ্য সংযোগ

(চ) আন্তর্জাতিকতা।

 

(ক) রাজনৈতিক প্রজ্ঞা

রাজনীতির মধ্যে যতই ভন্ডামি, গলাবাজি, স্বার্থসিদ্ধির পাঁয়তারা থাক, একজন সুস্থ রাজনীতিক কিন্তু এর ভেতর থেকে তাঁর কর্তব্য, তাঁর সত্য ও সুন্দরকে তুলে আনেন। আধুনিক জীবনে সুস্থ সমাজ-চেতনার জন্য স্বদেশ এবং বহির্বিশ্বের রাজনৈতিক বিষয়ে সচেতনতা একটি অপরিহার্য ব্যাপার। এই রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অবগাহন থেকে আজাদের চেতনায় যে-ঋদ্ধি ঘটেছে তা তাঁর কাব্যদর্শনে প্রতিফলিত।

উদাহরণ :

বিপ্ল­বী নেতারা বিবৃতি দেবেন

গণজমায়েতে গরম বক্তৃতা

উড়বে কয়েকটি হেলিকপ্টার

পিএল ৪৮০এর উপরে লাল

কালির অাঁচড়

কি আবার হবে আকাল?

(‘দুর্ভিক্ষ’, লেলিহান পান্ডুলিপি)

 

(খ) ব্যঙ্গবিদ্রূপ

ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের মাধ্যমে সত্যকে তুলে ধরা, ভন্ডামির মুখোশ উন্মোচন আধুনিক কবিতার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এটি আধুনিক কবিতার জন্মলগ্ন থেকেই চলে আসছে। আজাদের কবিতায় এটি একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। ‘ইকড়ি মিকড়ি’, ‘পূর্বলেখ’, ‘চৈতালী’, ‘পঙ্ক্তি’, ‘পয়লা বৈশাখ’ এবং লেলিহান পান্ডুলিপির পরিশিষ্টে সংযোজিত আটত্রিশটি লিমেরিক এর উজ্জ্বল উদাহরণ।

ছলাকলা রপ্ত ছিলো দেখিয়ে দিলাম কলা

চোরের কাঁধে কাঁঠাল রেখে খেলাম গলা গলা

বোঝে না কেউ বাটপাড়ি

লাফিয়ে সিঁড়ি দেই পাড়ি

দেখবো এবার কদ্দুর যায় নরম শিল্পকলা।

(‘কলা’ লেলিহান পান্ডুলিপি)

 

(গ) ইতিহাস-চেতনা

ইতিহাসে বহু ন্যায়-অন্যায়, ভাঙা-গড়া, উত্থান-পতন আছে এবং এর প্রভাবেই মানুষের মনে প্রকৃত সুন্দরের আদর্শ প্রতিষ্ঠিত। এক্ষেত্রে কাল ও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ঐতিহাসিক বিবর্তনের ধারায় কল্যাণ এবং সুন্দর যেভাবে নির্মিত হয়েছে আজাদের প্রতীতি তাতে একাত্ম।

উদাহরণ :

স্বদেশ আমার বক্র রাতের মুঠোয় ভরা

গ্রাম জনপদ কাঁপে বর্গীর অশ্ব খুরে

সোনার শস্য পুড়ে ছারখার; দৃষ্টি পুড়ে

হল সঙ্গিন, তাই নেই আর অশ্রুঝরা

যুদ্ধ মিছিল দিল্ল­ীর পথে, টোটায় ঝরে

অযূত প্রাণের অগ্নি শিখায় সূর্য-কুঁড়ি

 

(ঘ) দেশজ বা লোকজ প্রতীতি

এখানে কবি তাঁর দেশের মাটি-মানুষের খুব কাছাকাছি। তাদের কৃষ্টি, স্বপ্ন, আশা, আকাঙ্ক্ষা ও বিশ্বাস এক্ষেত্রে প্রতিফলিত। অবশ্য এক্ষেত্রে কবি লোকজ বিশ্বাসের সংকীর্ণতাকে প্রশ্রয় দেননি।

উদাহরণ :

আমি কিছু বুঝতে পারি না ও বিবি হাওয়া কোথায় তুমি

উনানের ধারে জটাচুলে বসে বসে কি করছো? শোনো শোনো

তোমার ঘটিতে একমুঠো চাল নেই, তোমার বাটিতে নেই পিঁয়াজ মরিচ

(‘আদম জবান’, আমি যখন আসবো)

 

(ঙ) ঐতিহ্য সংযোগ

কবিতায় ঐতিহ্য মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কবি ধর্ম, বর্ণ কিংবা রাষ্ট্রিক সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ নন। এক্ষেত্রেও আজাদের ভেতর একটি  সর্বমানবিক উপলব্ধি জাগ্রত।

উদাহরণ :

সে পানীয় রক্তিম অমৃত, তাই বিস্মিত শিল্পীর

দৃষ্টি মেলে দেখি চারিদিকে : ময়না পাড়ার সেই কালো মেয়ে

কেমন হরিণ চোখে; ওরা কাজ করে নগরে প্রান্তরে আর

অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গে সাগর সমুদ্র নদীর ঘাটে; নাগিনী-নিঃশ্বাসে

বিজয় রথের চাকা ব্যর্থ হয় আদিম বাহুতে বারবার

(‘পূর্বলেখ-২’, মানচিত্র)

 

(চ) আন্তর্জাতিকতা

এক্ষেত্রে কবি দেশ-কালের সীমানা অতিক্রম করে সর্বমানবিক একটি উপলব্ধিকে তুলে ধরেন। কবির সর্বজনীন মানবতাবাদের বিশ্বাস থেকেই এর উৎসারণ।

উদাহরণ :

পুরনো য়ুরোপ নতুন এশিয়া নাগকন্যা মনিমালা

যৌবন স্বপ্ন বিভোরা আফ্রিকা

সকলের কাছে যাবো

মালা নেব যদি দেয় মার্কিনী বান্ধবী

সফল করি স্বপ্নের অভিসার

(‘মৃত্যু দাও’, ভোরের নদীর মোহনায় জাগরণ)

 

প্রেমের কবিতায় আজাদ

আলাউদ্দিন আল আজাদের কবিতায় যে-বিষয়গুলো মুখ্য স্থান দখল করে আছে প্রেম তার মধ্যে অন্যতম। অন্য প্রধান বিষয়গুলোকে বাদ দিয়ে শুধু প্রেমের কবিতার বিবেচনায় আজাদ সম্পন্ন প্রেমের কবি। সমকালীন বৈশিষ্ট্যের উজ্জ্বল বাহক এই কবিতাগুলো শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতার লক্ষণ-সমৃদ্ধ।

সমকালীন প্রেমের কবিতা নিঃসন্দেহে চর্যাপদ, বৈষ্ণব পদাবলি কিংবা রাবীন্দ্রিক ঐতিহ্য থেকে আলাদা। বস্ত্ততান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার আলোকে সমকালীন প্রেমের কবিতায় সংযোজিত হয়েছে ভিন্নমাত্রা। এই প্রেম ফ্রয়েডীয় জারকরসে সম্পৃক্ত। অস্তিত্ববাদের তাৎপর্যে পরিশ্রুত। প্রয়োজনীয় সংক্ষেপণ, সংযোজনে ভিন্নরূপে উন্মোচিত। অতিমাত্রায় মানবিক এই প্রেমে ধর্মীয় অধ্যাত্মবোধ অনিবার্যভাবে অনুপস্থিত বা বর্জিত। বলা বাহুল্য, কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ তাঁর প্রেমের কবিতায় এ-বৈশিষ্ট্যের ধারক।

বিষয়গত দিক মূল্যায়নের আলোকে আলাউদ্দিন আল আজাদের প্রেমের কবিতাকে মোটামুটি তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। প্রথমত : সময়ের প্রেক্ষিতে প্রেমের সঙ্গে যেখানে বাস্তবের দ্বন্দ্ব-সংঘাত, টানাপড়েন।

উদাহরণস্বরূপ ‘বৃত্ত’, ‘জনান্তিক’, ‘রোমান্টিক’, ‘শেষ দেখা’, ‘ভালোবাসি’, ‘বিস্মৃতি-২’, ‘জীবনে জীবন’ ইত্যাদি কবিতার কথা উল্লে­খ করা যায়। এক্ষেত্রে আজাদের প্রেম উপলব্ধি আর হাইনরিক হাইনের জীবন-দর্শনের মিল লক্ষণীয়। হাইনে প্রেমকে উপলব্ধি করেছেন সমস্যাগ্রস্ত পৃথিবীর মানুষের ভেতর। এই প্রেম পরিপ্রেক্ষিত-বহির্ভূত, অজানা উৎসের উৎসারণ নয়। এই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি আজাদের কবিতাকে সমৃদ্ধি দিয়েছে।

প্রেম সমাজ-সংসার, রাষ্ট্রনীতি-বহির্ভূত কোনো ঘটনা নয়। ভোরের নদীর মোহনায় জাগরণ কাব্যে সংযোজিত জুলায়খা কাব্যনাট্যে ইউসুফ জুলায়খা কাব্য উপাখ্যানটি কবি কোনো তরল প্রেমের কাহিনি বিবৃত করার জন্য বেছে নেননি। বরং তাকে গ্রহণ করেছেন জীবন-জগৎ সম্পর্কে দার্শনিক উপলব্ধি প্রকাশের উপযুক্ত মাধ্যম হিসেবে, যা তাঁর গভীর প্রজ্ঞা ও মননের ফসল।

উদাহরণ :

ইউসুফ যখন এ-অধমকে ভালোবেসেছেন তাই বলি :

স্বাধীনতা, স্বাধীনতা ছাড়া আমার নিকট অন্য

সব অর্থহীন, অর্থহীন বাঁচা জীবন যৌবন

অর্থহীন এ জগৎ, অর্থহীন প্রেম – অশ্রুজল।

(‘জুলায়খা’, ভোরের নদীর মোহনায় জাগরণ)

দ্বিতীয়ত, বিপ্ল­ব ও প্রেম যেখানে পরস্পর সম্পৃক্ত। ‘হাসি’, ‘জনান্তিক’, ‘প্রোফাইল’, ‘আমাকে ভুলেছো’ ইত্যাদি কবিতায় এই উপলব্ধির বিকাশ লক্ষণীয় –

আমাকে ভুলেছো তুমি, কোনো দুঃখ নেই।

জানি আমি, আবার তোমার সাথে দেখা

হবে গ্রীষ্মের দুপুরে আন্দোলিত

রাজপথে যখন বিশাল জনারণ্যে

উত্তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ মিছিলে

সারি সারি মুষ্টিবদ্ধ হাত উৎক্ষিপ্ত ক্রোধে

প্রতিবাদে

সেখানে হঠাৎ তোমার এলোমেলো চুল

একরাশ

ছড়িয়ে পড়বে আমার ঘামে ভেজা

মুখের উপরে

তক্ষুণি সরিয়ে দেবো

(‘আমাকে ভুলেছো’, আমি যখন আসবো)

এ ক্ষেত্রে বিপ্লবী প্রেমিক কবি একটি মহৎ ইচ্ছাকে লালন করেন। উদাহরণ –

তার আগে যতক্ষণ বেঁচে আমি একমাত্র প্রতিজ্ঞা জানাই।

এ জৈবিক দেহকে করব দুর্জয় প্রতিরোধের শিবির।

সারা পৃথিবীতে

উদ্দাম শান্তির আগে

আমার শান্তি নেই।

(‘প্রোফাইল’, মানচিত্র)

তৃতীয়ত, এই শ্রেণির কবিতা চিরায়ত মানব উপলব্ধির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। এই শাশ্বত প্রেম উপলব্ধি কবির একান্ত ব্যক্তিগত উচ্চারণ হয়েও তা সার্থকভাবে সর্বজনীন। তার কারণ প্রেম উপলব্ধির বিস্তার, জীবনবোধে প্রেমের তাৎপর্যের ব্যাপকতা এবং প্রেমের সব দিককে ধরে রাখার প্রয়াস।

উদাহরণ :

গুচ্ছে গুচ্ছে তাদের আলাপ গান

হয়ে গেল গান

সে গান তোমার নাম :

কেউ জানল না কখন তাদের ঠোঁট

থেকে ঠোঁটে ছড়িয়ে পড়ল

তোমার রাধিকা নামের রাগিণী,

কেউ জানল না, জানল না কেউ

সোনালী রৌদ্রে শুধু একঝাঁক

কপোতের কলরব :

তাদের তুখোড় বিচারে নিরিখে

ভাঙ্গল তোমায়, গড়ল তোমায়

তরুণ জীবের উপমা অশেষ, তুলনাবিহীন।

(‘নাম’, মানচিত্র)

আজাদের কাব্যগ্রন্থ নিখোঁজ সনেটগুচ্ছ প্রেম উপলব্ধির পূর্ণাঙ্গ ফসল। চিরকালীন মানবিক আবেগের আধুনিক সংস্করণ। বৈষ্ণব পদাবলি থেকে গ্রিক-রোমান-পারস্য প্রেমের ঐতিহ্যসহ পৃথিবীর সব প্রেম উপলব্ধির সারসংক্ষেপ যেন এর দেহে নিপুণভাবে সংস্থাপিত। এই সংমিশ্রণ-মন্থিত সুধাই এর প্রধান সৌন্দর্য। এই বৈশিষ্ট্যকে বহন করা সত্ত্বেও কবিতাগুলো প্রেমের দার্শনিক ব্যাখ্যা, বিশ্লে­ষণ নয়। একান্ত ব্যক্তিগত উপলব্ধির নিঃসরণ। নিখোঁজ সনেটগুচ্ছে প্রেমের পরিপক্ব আবেগের যে মুন্শিয়ানা, সেখানে কবিতার সঙ্গে কবির সম্পৃক্তির কৃত্রিমতা অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু কবি সে-দুর্বলতাকে অতিক্রম করতে সমর্থ হয়েছেন।

কি ভালো সময় ছিল সে আমার প্রথম যৌবন

সব গাছে পাখি ছিল সব গাছে অতিরিক্ত ফুল

কোনো বাধা ছিল নাকো

ভোরবেলা কুড়াতে বকুল

জানালায় বসে তুমি ডাক দিতে বাজিয়ে কঙ্কন;

(‘স্থির চিত্র-২’, নিখোঁজ সনেটগুচ্ছ)

 

শব্দ, রূপকল্প ও আঙ্গিক

কোলরিজের সংজ্ঞা অনুযায়ী কবিতা হচ্ছে Best Words In best Order. এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, এই সর্বোত্তম শব্দ কোনটি এবং সুন্দরতম বিন্যাসইবা কাকে বলে। বলা যায়, কোনো শব্দ যে-অবস্থায় কোনো বিষয় প্রকাশে চূড়ান্ত অর্থকে ধারণ করতে পারে, তাকেই সর্বোত্তম শব্দের সুন্দরতম বিন্যাস বলা যায়। এই সর্বোত্তম বিন্যাস প্রচেষ্টার মধ্যে থাকে উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক, প্রতীক, চিত্রকল্প, পরাবাস্তব দ্যোতনা সৃষ্টি, সর্বোপরি একটি সঠিক কাব্যভাষা নির্মাণ এবং তার ছন্দ, প্রকরণ। একজন কবির সাফল্য-ব্যর্থতার মাপকাঠি নিঃসন্দেহে এর ভেতরই নিহিত। কবি আলাউদ্দিন আল আজাদের ক্ষেত্রে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যাক।

 

উপমা

কবি আলাউদ্দিন আল আজাদের কবিতায় উপমার ব্যবহার খুব কম। সম্ভবত উপলব্ধি উপস্থাপনে উন্নততর প্রয়াসই এর কারণ। কবি সর্বদা উৎপ্রেক্ষা, রূপকল্প, প্রতীক, রূপক ইত্যাদির সাহায্যে তাঁর চিন্তা-চেতনা প্রকাশে তৎপর। উপমা ব্যবহারের ক্ষেত্রে যেসব উপম বাস্তব জীবনের তিক্ততা, রূঢ়তাকে ধারণ করে সেগুলো ব্যবহারে কবির পক্ষপাত দেখা যায়।

উদাহরণ  –

হঠাৎ একি, গোখরোর মতো ফুঁসিয়ে

ওঠে প্রাণচঞ্চল মুখ

(‘হাসি’, মানচিত্র)

 

উৎপ্রেক্ষা

উৎপ্রেক্ষা নির্মাণের ক্ষেত্রে আজাদের অনায়াস সফলতা লক্ষণীয়। যেখানে একটি বিষয় প্রকাশে উপমা অনিবার্য হয়ে ওঠে, সেখানে কবি এ-উপমাটি উৎপ্রেক্ষায় রূপান্তরিত করেন। এটি যেন সৃষ্টির স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ, স্বেচ্ছাকৃত রূপান্তর নয়। তাঁর উৎপেক্ষা আশ্চর্য চমকের মধ্য দিয়ে এই সত্যকেই তুলে ধরে।

উদাহরণ  –

জুলায়খা তোমার শরীর শাওনের নোয়ানো আকাশ

আমারে আচ্ছন্ন করে,

(‘কারাকক্ষে ইউসুফের আত্মহনন’, সূর্য জ্বালার সোপান)

 

চিত্রকল্প

আধুনিক কাব্যে ইমেজিস্টদের আন্দোলন উপমা, উৎপ্রেক্ষার মাধ্যমে আবেগ-উপলব্ধি প্রকাশের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা করেছে। আধুনিক কবিতায় এজরা পাউন্ড ইমেজিজম বা চিত্রকল্পবাদের প্রথম সার্থক কবি। আধুনিক কবিতায় চিত্রকল্প ফ্রয়েডীয় চিন্তা-চেতনার প্রভাবে সমৃদ্ধতর এক নতুন তাৎপর্যে উন্মোচিত।

এই চিত্রকল্পের সমকালীন রূপটি কী হওয়া উচিত C. Day Lewis-এর উক্তির আলোকে বিষয়টি স্পষ্ট হতে পারে : Lewis বলেছেন, What the moderns look for in imagery, I suggest, is freshness, intensity and evocative power. Freshness the potentiality of an image through the novelty of its diction, its material or both to reveal something we had not realized before.

আজাদের প্রথম দিকের কিছু কবিতা এবং নিখোঁজ সনেটগুচ্ছে এই বক্তব্যের সচেতনতা অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত। এখানে আজাদ যেন আধুনিক জীবনযাত্রার জটিলতা থেকে অনুপস্থিত। এক্ষেত্রে কবি এ-ধরনের মোহাচ্ছন্নতা থেকে ক্ল্যাসিক্যাল রীতির দিকে ঝুঁকেছেন বেশি। তবে নিখোঁজ সনেটগুচ্ছের সর্বত্রই এই বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত নয় নিঃসন্দেহে। এমনও দেখা যায়, কবি চিরন্তন আবেগ-উপলব্ধিকে ক্ল্যাসিক্যাল সাহিত্যের উপকরণে রূপ দিচ্ছেন কিন্তু ক্ল্যাসিক্যাল সাহিত্যের আধুনিক মূল্যায়নে সেখানে কবি বিশেষভাবে সচেতন। এক্ষেত্রে  Day Lewis-এর উক্তির তাৎপর্য সার্থকভাবে প্রতিফলিত।

উদাহরণ :

বৃষ্টি বৃষ্টি অবিশ্রাম অক্রেস্ট্রি নায়েগ্রা হাজার

শহরের ছাদে ছাদে ইলেকট্রিক লাইনে ফেনিল।

ছবির মতো ট্রাক যার নিচে ধারা ঝিল ঝিল

মুখর শার্সিতে : তুমি কি আর্শিতে গাইছ মল্লার?

লেলিহান পান্ডুলিপি, আমি যখন আসবো ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থে অবশ্য আজাদ ইমেজ সৃষ্টিতে পরিপূর্ণ আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন।

আমাকে বাঁচাও : সুন্দর তোমার চাষ করবো উর্বরা পলিমাটিতে

সোনালি শস্যের রূপে ঘোমটা খুলবে তুমি খামারে খামারে

লাল পদ্ম পায়ে রূপালী নূপুর

হাতে বসন্তের গৈরিক নিশান

হেমন্তের চিকন নদী কোমর তোমার, উড়ন্ত পাখির

মালা মেঘলা

তোমাকে পেঁচিয়ে ধরে নাচবো আমি

রসিক বেদের মতো

এবং তোমার গলায় হাত রেখে বাজাবো বাঁশী জ্যোৎস্নার

মায়াজালের ভিতর খড়ের শয্যায়।

(‘আমি ডুবছি হে সুন্দর’, লেলিহান পান্ডুলিপি)

লেলিহান পান্ডুলিপির অজস্র কবিতায় উপলব্ধি প্রকাশের অনিবার্য মাধ্যম হিসেবে এসেছে বিস্তারিত রূপকল্প –

এঁকেছে কারা আমার পোর্ট্রেট

সেলের প্রাচীরে

দেওয়ালে দেওয়ালে ফেস্টুন পোস্টারে।

(‘স্বাধীনতা, ওগো স্বাধীনতা’, লেলিহান পান্ডুলিপি)

Chain imagery বা শৃঙ্খল বাকপ্রতিমা নির্মাণে কবির সবচেয়ে বেশি দক্ষতা। লেলিহান পান্ডুলিপি কাব্যগ্রন্থের কবিতাবলি কবির এই বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল।

উদাহরণ :

কেশর ফোলা দুর্বার

মেঘের কুদানো

কালো ঘোড়া

ছুটছে

উড়ছে

পত্

পত্

বিজুরি,

নিশান

দ্যাখ, দ্যাখ

কি ভীষণ

শব্দের বাহিনী

জ্বলছে; জ্বলছে দাউ দাউ লেলিহান

আমার পান্ডুলিপি, কখনো উত্তাল সাগর

কখনো নদীর ফেনিলতা

কখনো অরণ্য

সারা গ্রাম

অক্লান্ত নগরী।

(‘লেলিহান পান্ডুলিপি’, লেলিহান পান্ডুলিপি)

 

পরাবাস্তববাদ

আধুনিক কবিতার অনিবার্য বিষয় এই পরাবাস্তববাদ। পরাবাস্তবতার ভেতরই আধুনিক কবিতার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য নিহিত। আলাউদ্দিন আল আজাদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকেই এই পরাবাস্তববাদের দ্যোতনা স্পষ্ট। পরবর্তী কাব্যগ্রন্থগুলোতে তাঁর সমৃদ্ধতর বিস্তার লক্ষণীয়। পরাবাস্তববাদী কবিতা নির্মাণেও তাঁর সবচেয়ে সফল প্রয়াস দেখা যায় আমি যখন আসবো কাব্যগ্রন্থে।

উদাহরণ –

তোমাকেই আমি চাই

চাই আমি তোমাকেই চাই

আরক্তিম, গুচ্ছগুচ্ছ ফুল হোক আমার সে প্রেমের প্রতীক।

একি, মানস দর্পণে দেখি দূর থেকে এসে পড়েছে।

তোমার মুখের ছায়া, ঠিক যেন মোনালিসার জানালার কাঠামোতে।

তুমি কি জানতে সকল কুসুম ওরা লুট করে নিয়ে গেছে?

খুব বুদ্ধিমান, চালাক চতুর, ওদের সোনালী চশমার কাচে

প্রতিবিম্বিত সভ্যতা ও সংস্কৃতির নাড়ি নক্ষত্র

(‘একটি পুষ্পস্তবক’, আমি যখন আসবো)

 

অন্ত্যমিল বিন্যাস

অন্ত্যমিলের দিকে আজাদের প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। প্রথম গ্রন্থের প্রথম কবিতা থেকে শুরু করে আমি যখন আসবো পর্যন্ত এই মিলের প্রয়াস দেখা যায়। এই অন্ত্যমিল যাতে কবিতার স্বাভাবিক গতিপথে হয় সে ব্যাপারে কবি সচেতন।

 

সুশৃঙ্খল স্তবক গঠন

সুশৃঙ্খল স্তবক গঠন যা এখন অনেক কবির ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত – আজাদ এই ব্যাপারে বিশেষভাবে সচেতন। প্রথম কাব্যগ্রন্থের ‘মুখবন্ধ’, ‘দুঃখ’, ‘প্রান্তিক’, ‘শিলালিপি’ ইত্যাদি কবিতা তার উদাহরণ। পরবর্তীকালেও কবি এ-ব্যাপারে উদাসীনতার পরিচয় দেননি বরং আরো বেশি সচেতনতা দেখিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ আমি যখন আসবো কাব্যগ্রন্থের ‘আত্মপ্রতিকৃতি’, ‘কোন শহীদ বন্ধুর প্রতি’, ‘পয়লা বৈশাখ’, ‘আমার মাকে যখন’, ‘চৈতালি পঙ্ক্তি’, ‘একজন প্রতারকের স্বগতোক্তি’, ‘ফেরেনি যে জন’, ‘নষ্ট চাঁদ’ ইত্যাদি কবিতার উল্লে­খ করা যায়।

 

সনেট

সনেট আঙ্গিকের কবিতা আজাদের কাব্যজগতে এক বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ মানচিত্র থেকেই এ-সনেটের যাত্রা শুরু। লেলিহান পান্ডুলিপিতে তাঁর অনেকগুলো সনেট সংকলিত হয়েছে। আজাদের পুরো সাহিত্যকর্মের একটি উল্লে­খযোগ্য অবদান নিখোঁজ সনেটগুচ্ছের একশত সনেট। কবি বিভিন্ন রীতিতে সনেট নির্মাণ করেছেন। কিন্তু নিখোঁজ সনেটগুচ্ছের সনেটগুলো পেত্রার্কীয় নিয়মের যে দুধরনের মিলবিন্যাস দেখা যায়, তা এখানে রক্ষিত হয়েছে। কবিতাগুলোর মিল বিন্যাস ষষ্টক, অষ্টক।

অষ্টকঃ                            ঃ  ষষ্ঠক

ক খ খ কঃ ক খ খ কঃ         গ ঘ গঃ ঘ গ ঘ

ক খ খ কঃ ক খ খ কঃ         গ ঘ ঙঃ গ ঘ ঙ

 

পেত্রার্কের ইম্প্রেসিভ বৈশিষ্ট্যও আজাদ এক্ষেত্রে ধারণ করেছেন। আলাউদ্দিন আল আজাদ কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ প্রত্যেক ক্ষেত্রেই শক্তির স্বাক্ষর রেখেছেন। তবে যেহেতু ইউনেস্কো, বাংলা একাডেমি ইত্যাদি পুরস্কার তিনি পেয়েছেন কথাশিল্পী হিসেবে, সেহেতু এক্ষেত্রেই তাঁর অধিক পরিচিতি গড়ে উঠেছে এবং তা তাঁর কবি খ্যাতিকে করেছে আড়াল। অথচ কাব্যকলার মানের বিচারে তাঁর কবিতা যে উৎকৃষ্টমানের, সে-সত্য নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করা যায়।