কেয়ারার

সেদিন খবর পেলাম আসমা নেই। ওর মেয়ে ফোনে বলেছে। চমকে গেলাম। এমন প্রাণবন্ত মেয়েটার কী হলো? মেয়ে না বলে ওকে নারী বলা ভালো। আমার সঙ্গে বেশ কিছুদিন আগে আলাপ হয়েছিল। আমরা একদিন পার্কে বসে কথা বলেছিলাম। ও বাড়িতে কখনো কাউকে ডাকেনি। কেন? আসমা বলেছিল – কারো সঙ্গে হাসি, গল্প, কথা বলা ও পছন্দ করে না। কেন? ও ভাবে এতে ওর অসুখের প্রতি রেসপেক্ট দেখানো হয় না। আমি এখন ভাবি কিম জন উন উত্তর কোরিয়ায় তার চাচার মৃত্যু দিবস উদযাপন করতে সারাদেশের মানুষকে এমন নির্দেশ দিয়েছেন – তারা কেউ উনিশ দিন হাসতে পারবে না। এমনই জীবনযাপন করেছে আসমা। তবে বিনু আর লরির গল্পগুলো একটু অন্যরকম। লরি তার হাঁটুর ওপর থেকে পুরো দুটো পা কেটে ফেলা স্বামীকে তিরিশ বছর হলো দেখাশোনা করে। আমরা ওকে ফোন করি বলি – লরি, তোমার স্বামী কেমন আছেন? আমরা কি কখনো বলেছি – লরি, তুমি কেমন আছো? আসমারও একই কথা। আর বিনু? ও নেই। একজন কেয়ারার চলে গেছে আমাদের পৃথিবী থেকে। জীবনপ্রাচুর্যে পরিপূর্ণ আসমা কেমন থাকে? না, কখনো আমরা তা জানতে চাইনি। বিনু আসমা চলে গেছে। লরির মতো অনেকেই বেঁচে আছে। সহ্য করো, ভালো থাকো, বেহেশত তোমার জন্য পাকা – এ ছাড়া লরিকে আমরা কী বলতে পারি? আমি খুব বেশি হলে ওদের নিয়ে গল্প লিখতে পারি। ওর মেয়ে রিয়াকে প্রশ্ন করেছিলাম – কেমন আছেন তোমার বাবা? মোটামুটি ভালোই। এখন একজন কেয়ারার এসে বাবাকে দেখেন। তার মানে আসমার কেয়ারারের অসুখ ওর বাবার চাইতেও গুরুতর ছিল কি? কেউ জানে না সে-কথা।

বাড়িটা পার্কের খুব কাছে। আসমা যখন-তখন সেখানে যেতে পারে। এবং এই যাওয়াটা ওকে বেশ খুশি করে। আর পার্কটা যদি গ্রিনিচ নামের একটি নিথর সবুজ পার্ক হয়, তাহলে তো আর কথাই নেই। আসলে পার্কটাই গ্রিনিচ। যার নামে চারপাশের জায়গাটা পরিচিত। লন্ডনের অনেকগুলো মনোলোভা পার্কের মধ্যে গ্রিনিচ একটি। কিন্তু আসমার মতে, এটি লন্ডনের শ্রেষ্ঠ পার্ক। অ্যান বোলিন যে-গাছটার চারপাশে নেচে নেচে তার জীবনের এক হাজার দিনের কয়েকটি দিন এখানে কাটিয়েছিলেন, সেই বিশাল গাছটিকে বাঁচিয়ে রেখেছিল একটি দুর্দান্ত বুনো আইভির ঝাড়। আইভি লতা সেই আশির মধ্য দশক পর্যন্ত  পাঁচশো বছরের পুরনো একটি গাছ বাঁচিয়ে রেখেছিল। পাঁচশো বছর বয়সের একটি গাছ? ভাবা যায়? আসমা এক একদিন সেই বিস্ময়কর আইভির ঝাড় এবং তার আশ্রয় নেওয়ার, সবগুলো পাতা নিয়ে জড়িয়ে থাকার সেই দুর্নিবার গাছটির দিকে তাকিয়ে কত সময় যে কাটিয়ে দিত তার ঠিক নেই। আইভির লতাপাতা  ফণাতোলা সাপের মতো বাতাসে দুলতো। মনে হয়, এগুলো লতাপাতা নয়, ফণা বিস্তার করে আছে অ্যান বোলিনের দুরন্ত চুলের রাশ। কী করে আইভি জানলো এইভাবে পুরনো, কিংবদন্তির মতো একটি গাছকে বাঁচানো যাবে। ভেবে পায় না আসমা। অ্যান বোলিন রাজা অষ্টম হেনরির দ্বিতীয় স্ত্রী। যাকে ইতিহাস বলে ‘কুইন অব এ থাউজেন্ড ডেইজ’। এ-জায়গাটি নাকি ছিল খেয়ালি রাজার গেমপার্ক। রাজা এখানে শিকারে আসতেন। রানী আর রাজা না হলে রানী তার বন্ধুবান্ধব নিয়ে পিকনিক করতেন। আরো শুনেছে আসমা, রানী প্রায়ই এই গাছটির চারপাশ ঘুরে ঘুরে নাচতেন ঝলমল পোশাকে। আসলে সেই রাশিয়ার বৈজ্ঞানিক যদি সেই জাদুর মেশিন আবিষ্কার করতে পারতেন যা দিয়ে অতীত দেখা যাবে, টেলিভিশনের ছবির মতো, তাহলে ও হয়তো দেখতে পেত সেই সময়ের ছবিটা যখন অ্যান বোলিন তাঁর রাজকীয়তায়, রানীর জীবনে এই গাছটির চারপাশে নেচে চলেছেন। তখনো যে জানে না তাঁর আসন্ন মৃত্যুর কথা। জানে না তাঁর জীবনের পরমায়ু আর মাত্র অল্প কিছুদিন। যাকে রাজা অষ্টম হেনরি চার্চ অব ইংল্যান্ড সৃষ্টি করে বিয়ে করেছিলেন। তাঁর রানী হয়ে থাকার ইতিহাস মাত্র এক হাজার দিন? ইতিহাস। এমন অনেক ইতিহাস আসমা জানে। আর তখনই সেই মেশিনটার কথা ওর মনে পড়ে, যা দিয়ে ইতিহাসের ছবিগুলো সিনেমার মতো পর্দায় জেগে উঠবে। যে-মেশিন আবিষ্কার করতে গেলে আইনস্টাইনের কোনো একটি থিওরি নাকি মিথ্যা হয়ে যাবে। বলেছিল এরশাদ। এরশাদ একজন চমৎকার বিজ্ঞানী হতে পারতো, কিন্তু পারেনি। এখন সে বিছানায় শয্যাগত। মেরুদণ্ডে আঘাত পেয়ে চুপচাপ শুয়ে আছে ঘরে। ও প্রশ্ন করে – কেন সেই মেশিনটা হবে না বলো তো।

– কোন মেশিনটা?

– যা দিয়ে অতীতের সবকিছু দেখা যায়।

– তাহলে আলোর গতি আর থিওরি অব রিলেটিভিটি নিয়ে যেসব কথাবার্তা তা মিথ্যা …। কী মুশকিল এক কথা কতবার শুনতে চাও তুমি? অতীতের কী দেখতে চাও?

– আজ আবার গ্রিনিচ পার্কে গিয়েছিলাম তো তাই। আমি অ্যান বোলিনের সত্যিকারের মুখটা দেখতে চাই, যখন সেই বিশাল গাছটির চারপাশে ঘুরে ঘুরে তিনি নাচতেন।

– তুমি এবার আমার ওষুধগুলো আনো। আর সময় পেলেই ওই পার্কে যাবে না।

আসমা একটি একটি করে ওষুধ এনে এরশাদের সামনে রাখে। আর এরশাদ নিঃশব্দে একটি একটি করে ওষুধ খেয়ে পাশ ফেরে। দেয়ালের দিকে মুখ করে কী ভাবছে, ও কী করে বলবে।

আসমা এবার মেয়েকে ফোন করে। রোববার ও বাড়িতেই থাকে – কী করছো রিয়া?

– বিশ্রাম।

– তুমি কী করছো?

– আমি খানিক আগে গ্রিনিচ পার্ক থেকে ঘুরে এলাম। আচ্ছা সেই মেশিনটা কি সত্যি সত্যি আবিষ্কার হবে না?

হাই তুলতে তুলতে বলে রিয়া – কোন মেশিনটা?

– যা দিয়ে টেলিভিশনের ক্যামেরার মতো মহাশূন্য থেকে অতীতের ছবি টেনে আনা যায়।

– তোমার বৈজ্ঞানিক স্বামীকে বললেই তো বলে দেবে। তা তুমি কাকে দেখতে চাও?

– অ্যান বোলিনকে।

– আমি দেখতে চাই ক্লিওপেট্রাকে। রিয়া বলে – কাল অনেক রাতে পার্টি থেকে ফিরেছি। ভিকির জন্মদিনের পার্টি। এবার আমি একটু ঘুমাবো।

– এখন সকাল এগারোটা।

– এবং আজ রোববার। এই বলে রিয়া ফোন রেখে দেয়।

আসমা অনেকক্ষণ সিঁড়িতে বসে থাকে। ভাবে অ্যান বোলিনের কথা, ভাবে ক্যাথারিন হাওয়ার্ডের কথা। অষ্টম হেনরির ছয়টি রানীর মধ্যে তিনটিরই নাম ছিল ক্যাথারিন। ক্যাথারিন অ্যারাগঁ, ক্যাথারিন হাওয়ার্ড এবং সর্বশেষ ক্যাথারিন পার। আর ক্যাথারিন হাওয়ার্ডকেও অ্যান বোলিনের মতো বিহেড করেছিলেন তিনি। ভয়ানক সন্দেহবাজ রাজা। সিঁড়িতে এসব ভাবতে ভাবতে ওপরের ঘরের বুকশেলফ থেকে ইতিহাসের একটি বই নামিয়ে পড়তে থাকে। ব্রিটেনের রাজা-রানীর গল্প।

নিচে দেয়াল থেকে টেলিভিশনে মুখ ফিরিয়েছে এরশাদ। বলে – আমার চা কই? স্ত্রী মন দিয়ে কী পড়ছে? এসব দৃশ্য তার পছন্দ নয়।

আসমাই প্রথম ফোন করেছিল রিয়াকে। লন্ডনের সেই মস্তবড় ঝড়ের পর। – রিয়া জানো, সেই আইভির ঝাড় যে-গাছটিকে দীর্ঘদিন ধরে রেখেছিল এখন তা শেকড়সুদ্ধ উৎপাটিত। কতগুলো বুনো আইভি পাঁচশো বছরের পুরনো একটি গাছকে বাঁচিয়ে রেখেছিল।

– তুমি জানো কিউ গার্ডেনের অনেক দুর্লভ গাছও ঝড়ে শেষ।

– ইস। তাই নাকি।

– কী আর করা যাবে। গাছ নিয়ে তুমি ভাবতে থাকো

যখন তোমার হাতে আর কোনো কাজ নেই। এই বলে রিয়া ফোন রেখে দেয়। এরপর অনেকদিন সেই শেকড় উৎপাটিত গাছের দিকে তাকিয়ে ওর কান্না পেত। ঝড় ওকে বিচ্ছিন্ন করেছে মাটি থেকে, দীর্ঘদিনের চেষ্টার পর। মনে মনে অ্যান বোলিনের সঙ্গে যে সখ্য হয়েছিল, সেই উৎপাটিত গাছের দিকে তাকিয়ে ওর যেসব কথা মনে হয়েছিল আজ থেকে তার পরিসমাপ্তি। কেউ কেউ নাকি রাতের হাম্পটন কোর্টের ছাদে অ্যান বোলিনের ছায়া দেখতে পায়। ভূত আর গাছে পার্থক্য আছে। আসমা ভূতের ভেতর অ্যান বোলিনকে দেখতে চায় না। ও দেখতে চায় সবুজ পাতার ভেতর।

আসমা এসে বসে এরশাদের পাশে। এখন এরশাদ বড় চেয়ারটায় বসে কাগজ পড়ছে। আসমা গাছ ভেঙে যাওয়ার গল্প করে। এরশাদ দু-একবার হু-হা করে ডুবে যায় কাগজে।

– তোমার আজ গোসলের দিন না?

– এখন নয়। পরে।

দুই দিন পরপর গোসল সারে এরশাদ। আর রাতে সকলে ঘুমিয়ে গেলে বাথটাবের নোনা ও সাবান-মেশানো পানিতে নিজেকে ডোবায় আসমা। আর কী ভাবে।

– জানিস তরু সেই গাছটা না ঝড়ে পড়ে গেছে।

– কোন গাছটা রে আসমা?

– সেই অ্যান বোলিনের গাছটা। গ্রিনিচ পার্কে ছিল। বাতারসিতে অনেক গাছ আছে। তরু গাছ নিয়ে ভাবে না। ওরা একসঙ্গে কলেজে পড়তো। তরু এখন সোনার মতো উজ্জ্বল একটি মেয়ে। বোধহয় খুব তাড়াতাড়ি ডেপুটি হেড হবে। অংকে শানিত মাথা।

– তোর মতো এত সময় নেই আমার গাছ নিয়ে ভাবার।

– জানি। তোকে ডেপুটি হেড হতে হবে। গাছ নিয়ে ভাববি কখন।

– কারেক্ট। তুই তো কাজকারবার ছেড়ে কেবল গাছ, মাঠ, ফুল আর চাঁদ করছিস।

– কেয়ারার না? বলে আসমা। সরকার কেয়ারারকে অ্যালাউন্স দেয়।

– কী মজা। বলে তরু।

– মজা? ও বলে একটু অবাক হয়ে। কেয়ারার অ্যালাউন্স যে পায় তাকে তো করুণা করে সকলে। তার আবার মজা। ওর কেয়ারার অ্যালাউন্স, ওর স্বামীর অ্যাটেন্ড্যান্ট অ্যালাউন্স। সোশাল সিকিউরিটির মুষ্টিভিক্ষা। এর মধ্যে মজা কোথায়? যে-চাকরিতে আসমা একটা প্রমোশন পাবে ভাবছে, তখনই ঠিক হলো এখন থেকে ওর আর কাজে যাওয়া চলবে না। আর যে কেমিক্যাল ফার্মে দুজন সাহেবকে ডিঙিয়ে উঁচুতে উঠবার কথা কেবল বলাবলি করছিল সকলে, তখনই সড়ক দুর্ঘটনায় মেরুদণ্ড শক্তিহীন হলো এরশাদের। ঘরে বন্দি। কেবল একটি চাকা চেয়ারে মাঝে মধ্যে বাইরে। মেরুদণ্ড ভাঙার সকল দোষ তার। লাল আলো জ্বলে উঠবার পর অন্যমনস্ক এরশাদ রাস্তা পার হতে গিয়ে করলো বিপত্তি। এখন ওর জীবনের সামনে অসংখ্য লাল আলোর বাতি ওকে স্তব্ধ করে রেখেছে। মামলা করলে ফল হতো না। অন্যমনস্কতার কারণে যে-ঘটনা ঘটে, সেখানে মামলায় কেউ জেতে না। অতএব এই দম্পতি যাদের নাম আসমা ও এরশাদ সরকারের বদান্যতায় বেঁচে আছে। এরশাদ চাকা চেয়ারে আর চার দালানে বন্দি এবং আসমা বন্দির ক্লান্তিহীন প্রহরী হয়ে জীবনযাপন করে।

– কী মজা? একটা প্রেমের কবিতা লিখেছিল বলে এরশাদ বলেছিল – মনে মনে কী মতলব করো তুমি? টেবিলে রেখে বাথরুমে যাওয়াতে কবিতা পড়ে ফেলেছিল এরশাদ। এরপর সে কবিতা লুকিয়ে রাখে।

ওর বাড়িটা চাকা চেয়ারে চলাচলের উপযুক্ত। সরকার এসব করে। ফলে আসমা এরশাদকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে বাথরুমে, রান্নাঘরে, পাশের ঘরে নিয়ে যেতে পারে। এখন ও এরশাদকে বাথরুমে নিয়ে যায়। এরশাদের হাতে প্লাস্টিকের মগ ধরিয়ে দিয়ে গানের যন্ত্র অন করে।

– গান কেন? এরশাদের কথার সঙ্গে সঙ্গে গান বন্ধ করে। গান এবং বাথের ধোঁয়া ওঠা নরম পানি ওর পছন্দ! তাই বলে এরশাদেরও পছন্দ হবে তার কোনো মানে নেই। এরশাদকে ভালোমতো গোসল করিয়ে আসমা আবার তাকে ঠেলে এনে সোফাতে বসায়। তার সামনে টেবিল এনে খাবারের ট্রে রাখে। এরশাদ চুপচাপ খায়। আসমা কথা বলে – রিয়া আবার নতুন করে পিয়ানো লেসন নিতে শুরু করেছে, জানো।

– তার চেয়ে ভালো হতো না কি নতুন কোনো ভাষা শেখা?

– পিয়ানোটা ওর আনন্দের ব্যাপার।

– জীবনের কোন কাজটা সম্পন্ন হয় এই পিয়ানোর কি-বোর্ডগুলোকে বশে এনে?

– কেন? পিয়ানো খারাপ কেন? এই কথার পর এরশাদ একবার আসমাকে দেখে। বলে খেতে খেতে – আমি মারা গেলে এসব তুমি অনেক করতে পারবে। কতদিন আর আমি আছি। একটু ধৈর্য ধরো। তারপর গজগজ করতে করতে বলে – যত্তসব। এবার আর একটু ঝোল ঢালে প্লেটে। আসমা আর কিছু বলে না। ওর খুব শখ ছিল যদি মেয়েটা ব্যালে নাচ শিখত। আহা ‘সোয়ানলেকের’ ব্যালের কথা ও জীবনেও ভুলবে না। বলশয় ব্যালে কোম্পানির নাচ। একদিন দুপুরের শোতে চুপ করে আসমা গিয়েছিল। মনে হয়েছে এমন অপূর্ব অনবদ্য জিনিস ও আগে দেখেনি। এমনি চুপচাপ ও হঠাৎ হঠাৎ  আরো কিছু করে। এরশাদের ভাষায় বিশ্রী ছেলেমানুষি সবকিছু। ছেলেমানুষি!

এরপর এরশাদ যখন খেয়ে ঘুমোয়, আসমা উপরতলায় উঠে ভিভালডির ‘ফোর সিজন’ ছেড়ে দিয়ে পার্কের কোনো এক গাছের মতো বাতাসে দোল খায়। বই গোছায়। ঘর গোছায়। আয়না মোছে। ডাস্টপ্যান দিয়ে সমস্ত ময়লা তুলে ঝকঝকে করে ঘরের কার্পেট। চাকরির একজন জুইশ কলিগ মিসেস সিংগার ওকে এসব ক্লাসিক্যাল ইংরাজি সংগীতের হাতে খড়ি দিয়েছিল। শুনতে শুনতে সুরের ব্যাকরণ না বুঝেও এগুলো এখন দীর্ঘসময়ের সঙ্গী। কানের ভেতর দিয়ে মরমে পশে। ওর হাত দুটো সোয়ানলেকের হাঁসের মতো আকাশে পাখা মেলতে চায়। কি জানি পঞ্চান্ন বছরের আর সব মহিলার ভেতরে সোয়ানলেক বেঁচে থাকে কি না। কিন্তু ওর সেই হাঁস আজো বেঁচে আছে। যে দুধ আর জলের ভেতর থেকে কেবল দুধ তুলে আনতে পারে। যদি না পারতো এতদিনে আর একটি হুইলচেয়ারে ও বসে যেত হয়তো। তরু, আফরোজা, মিরা এসব করে না। ও জানে। কোনো বোন বা ননদ তো এসব ভাবতেও পারে না। আর তাই কি দুম করে এসব থামিয়ে নিচে নামে ও। যেন বয়সটার মতোই একজন হওয়ার সাধনায়, গম্ভীর মুখে খবর শুনতে শুনতে ওকে এখন উল বুনতে হবে। সোয়েটারটা এরশাদের। সাদা আর হালকা নীলের বর্ডার দেওয়া।

– আমার সোয়েটারে ওসব নীলের বর্ডার বাদ দাও। এরশাদ বলেছিল ওকে।

– না। গম্ভীর মুখে জবাব দিয়েছে আসমা, না। নীলের একটু আভাস থাক। ক্ষতি কী?

এরশাদ এরপর আর কিছু বলে না। যে আসমা উল বুনছে এরশাদের পছন্দ নয় বলেই যে ফরফর সোয়েটার খুলে প্রথম থেকে কেবল সাদা দিয়ে বুনতে শুরু করবে না। সময় বিশেষের সেই নারীকে চেনে না এরশাদ। একটু অনমনীয়। উল বুনতে বুনতে একসময় রাখে। ইতালি নিয়ে লেখা বইটা পড়তে পড়তে কী ভাবনা করে। ভেনিসের গন্ডোলায় চোখ রাখে। তারপর ফ্লোরেন্সের দ্য ভিঞ্চি মিউজিয়াম। এরপর লেক কোমোর নিথর জলে চোখ রেখে ও সোফায় ঘুমিয়ে পড়ে। এরশাদ উঠে বসে ওর চায়ের জন্য। চোখ ঘষতে ঘষতে আসমা বলে – ইস আমি কবে ইতালি যাব? আসমার এসব প্রলাপোক্তিতে অভ্যস্ত এরশাদ কথা বলে কেবল – কখন? আমি মারা গেলে। তোমার মতলব সব জানি। – বলেছিলে অরোরা বরিয়ালিসের দেশে যাবে। এখন আবার গতি বদলে ইতালি? এরশাদ চা পান করে। বলে কেবল – এখন যদি যাও আমার জন্য একজন কেয়ারার ঠিক করে যেও।

– সুন্দরী একজন মেয়ে ঠিক করে যাব। বলে ও। ভাবখানা এই যেন কালই যাবে ও।

– সুন্দরী মেয়ে দিয়ে কি ধুয়ে খাব?

– তাহলে কুৎসিত পুরুষ। তাকে ধুয়ে খেয়ো। এই বলে ও চলে যায়।

– কাল তোমাকে গ্রিনিচ পার্কে নিয়ে যাব। বলে আসমা। মাঝে মাঝে ও এরশাদকে নিয়ে পার্কে যায়। ব্ল্যাকহিথের মাঠ পার হয়ে চাকাচেয়ার চলে। আসমা শক্ত হাতে চেয়ার ঠেলে।  মাঠ পার হলেই পার্ক। তাই যেতে পারে।

– আগামীকাল তো সোমবার।

– সেটাই তো কারণ। পার্কে তেমন ভিড় হয় না সোমবারে।

এরশাদ কিছু বলে না। আসমা বুঝতে পারে, এরশাদ পার্কে যেতে চায়। এরশাদ আর ও পার্কে আইসক্রিম খায়, স্যান্ডউইচ খায়। এরশাদের হাতে একটা বই বা ম্যাগাজিন তুলে দিয়ে কাঠবেড়ালি খাইয়ে তারপর বাড়ি ফেরা। মিনারেল ওয়াটারের বোতল থেকে ঘুরে বেড়ানো আসমা পানি খায়। বলে – পার্ক তোমার স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। শরীর আর মন দুটোই ভালো করে পার্ক, গাছেরা।

– পার্কে যাবে তার আবার অজুহাত খোঁজ কেন?

– অজুহাত? আমি তো কেবল পার্কে যাব বলেছি। ইতালিতে তো নয়। আমি তো একাও যেতে পারি যখন তুমি ঘুমিয়ে থাকো। না যেতে চাইলে জেগে খবর শোনো, কাগজ পড়ো।

– তা পারো। একা পার্কে যেতে। আরো অনেক কিছু করতে। তোমাকে আমি ভালো করে চিনি। এখন একটু ভালো সেজে আছো। এই তো। এই বলে এই নারীর চলমান পায়ের দিকে তাকায়। একটি লাল স্লিপার পায়ে। এমনিতেই ও-বাড়িতে খালি পায়ে থাকে। স্লিপারের ফাঁকে নীলার কিউটেক্স মাখানো লাল নখ চোখে পড়ে।

– পায়ে কিউটেক্স লাগিয়ে নামাজ হয় না।

– ঈশ্বরবাবু কি তোমাকে ফোন করে বলেছেন?

– তুমি কেবল তর্ক করো।

– আর তুমি কেবল চারপাশে তাকিয়ে খুঁজতে থাকো কী নিয়ে আমাকে একটু গালমন্দ করা যায়। এমনকি আমার প্রাণ খুলে হাসিও তোমার পছন্দ নয়।

– সত্যি কথা গালমন্দ?

– বলবার ধরন থাকে। তুমি যেভাবে বলো …

– আমি বিজ্ঞানী। কবি নই। আসমার কথা শেষ করতে দেয় না এরশাদ।

– আইনস্টাইন কবি ছিলেন না কিন্তু বেহালা বাজাতেন। জগদীশচন্দ্র বসু গাছের প্রাণের কথা বলতেন। তারপর …

এরশাদ এবার জোরে টেলিভিশন ছেড়ে বাজেট বক্তৃতা শুনবে বলে ঠিক করে। আসমা সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠে। বড় করে বাঁধানো ছবির সামনে দাঁড়ায়। যখন এরশাদ সচল ছিল ওরা তিনজন গিয়েছিল বেড়াতে – ডেভোনে। ছবিটি ওর প্রিয়। সেখানে রিয়া চৌদ্দ বছরের মেয়ে। এখন ওর বয়স আটাশ। ও শাড়ির আঁচলে ছবিটাকে মোছে। তারপর বই আর সিডি নতুন করে সাজিয়ে রাখে। মনে মনে রিয়ার লেখা একটি কবিতার কথা ভাবে। ‘দি গুড থিংগস এভার হাপেন্ড টু মি/ অল দোস সিডি।’ স্কুলের খাতায় সাহিত্যচর্চা। এখন রিয়া এসব লেখে না। একটি রকিং চেয়ারে ও একটু দোল খায়। মনে মনে হাসে, কারণ এর পরের লাইন ও লিখেছিল ‘দি গুড থিংগস এভার হাপেন টু মি/ ইজ ডে ড্রিম।’ এখন কি ও ডে ড্রিম করছে? ফ্লোরেন্স, জেনোয়া, ভেনিস আর গন্ডোলা। তারপর ঘর অন্ধকার করে সন্ধ্যা নামে। হঠাৎ উঠে বসে। ক্রমাগত কলিং বেল বেজে চলেছে। এভনলেডি তাঁর ক্যাটালগ ফেরত নিতে এসেছেন।

সোমবার পাঁচটার দিকে পার্কে ঢুকতেই বেশ লাগে। সেপ্টেম্বরের আশ্চর্য সুন্দর দিন। সঘন সবুজ। আকাশে নীল। একটু বাতাস। আর গরম তেমন নয়, আবার শীতও তেমন নয়। সোমবার হলেও আবহাওয়ার কারণে লোকজনের ভিড় আছে। তবে থিকথিকে নয়। স্কুলের বাচ্চারা মাঠে ফুটবল খেলছে। আর কেউ কেউ গাছের তলা দিয়ে হেঁটে এদিক-সেদিক ঘুরছে। মাঠেও বসে আছে। কেউ গাছের নিচে। কেউ বেঞ্চে। সেই পরিচিত জায়গা। হর্সচেস্টনারের তলায় ওরা এসে থামে। এরশাদকে ভালোমতো বসতে সাহায্য করে। এরশাদ চারপাশে তাকায়। যেসব চলমান মানুষ হাঁটছে তাদের পায়ের দিকে চোখ ওর। তাদের বিবিধ জুতো, কারো পায়ে স্যান্ডেল। কেউ পরেছে প্রিমসোল। দু-একজন শৌখিন হাইহিল। এখানে অনেকেই আসে সাইকেল চালাতে। স্কুলে আর কলেজে আসমার সাইকেল ছিল। সে দীর্ঘ নির্জন পথ সাইকেলে ঘুরেছে। একা। এখন আর পারবে বলে মনে হয় না। এরশাদও সাইকেল চালাতো। আসমা? গুন গুন গানের সঙ্গে। ওর দিকে তাকিয়ে সে-কথা এখন কে বিশ্বাস করবে? এরশাদ গাছের নিচে এবং এখন ও নিজে এক গাছের মতো। এক জায়গা থেকে আর নড়তে পারে না। শেকড় গজায়নি কারণ স্ত্রীর চলমান জীবন বোধকরি তাই। গাছেদের কোনো হুইলচেয়ার থাকে না। বেচারা গাছ? কিন্তু গাছের পাতায় আসমার প্রিয় সুমন্দ বাতাস। পাতাদের অবাধ বিস্তার। দিঘল গাছে ছন্দ। বিকালের আলো মেখে হাওয়ায় হাসছে, ভাসছে। গাছের না চলার দুঃখ পাতায় নেই। গাছের যদি মস্তিষ্ক থাকতো তাহলে দুঃখ থাকতো। একদিন বলেছিল এরশাদ।

আসমা উল কাঁটা রেখে বলে – আমি তোমার জন্য আইসক্রিম আনবো?

– এখন থাক। তারপর হাতে তুলে নেয় একটা বই।

– তাহলে তুমি বই পড়ো। আমি একটু হেঁটে আসি। আসার পথে আইসক্রিম আনবো।

আসমা উঠে দাঁড়ায়। এখন স্যান্ডেলশুর ফাঁকে ওর নখের লাল রং চোখে পড়ে। হাঁটাচলার সুবিধার জন্য শাড়ির সঙ্গে ছন্দহীন প্রিমসোল পরতে হয় মাঝে মাঝে। আঁচল কার্ডিগানের ওপর। সামারে প্রায়ই শাড়ি পড়ে ও। শীতে নয়। ঘাসের উপর পড়ে আছে উল, কাঁটা, স্যান্ডউইচ, পানির বোতল, কলা আর আপেল। বড় এক প্লাস্টিকের বাক্সে খাবার। পাখিরা মাথার উপর কিচকিচ করছে। দুটো ছেলে সাইকেল চালাতে চালাতে হ্যালো বলে চলে যায়। এরশাদ বইটিকে কোলের উপর রেখে কী ভাবে।

গ্রিনিচের মানমন্দির পার হয়ে ঢালুতে নামে আসমা। আপনমনে হাঁটছে ও। চারপাশের এই অপরূপ আবহাওয়ায় ও নিসর্গে গুনগুন সুর ওঠে। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যায় সেই ছোট্ট লেকের পাশে যেখানে ছেলেমেয়েরা পয়সা দিয়ে নৌকাবিহার করে। তখনই দেখা হয় এমন একজনের সঙ্গে যাকে আসমা দেখবে বলে ভাবেনি। রুস্তম রায়। একটি অফিসে ওরা দুজন একসঙ্গে কাজ করতো।

– আসমা! হাউ লাভলি। এই নামটা জানে রুস্তম রায়। আর ও জানে উনি কেবল কেবল মিস্টার রায় নয়।

– রুস্তম রায়! হোয়াট অ্যান অ্যানচান্টিং মিটিং।

দুজনে চেয়ার টেনে বসে। গল্প করে। লেকের পারে চেয়ার থাকে। ভাড়া না নিয়ে একটু বসা। ওই অফিসটাতে আসমা ছিল তিন বছর। এখন রুস্তম রায় আর ওখানে কাজ করে না। আপাতত ওর হাতে কোনো কাজ নেই। তবে দু-একদিনের মধ্যেই একটা কাজে যোগ দেবে। ও আসমার দিকে তাকিয়ে জানে ও এখন চাকরি করে না। কিন্তু কেন চাকরি করে না সেকথা ও বলে না। রুস্তমের সেই চমৎকার স্টাইলিশ ফ্রেঞ্চকাট ব্যাপারটি এখন নেই। সব ক্লিন শেভড। আলটাব্রাইট হাসিটা আগের মতোই আছে।

– ব্যাপার কী? আর্লি রিটায়ারমেন্ট? রুস্তম একসময় প্রশ্ন করে।

– ওইরকমই কিছু। কত আর চাকরি করবো। একটাই তো জীবন।

– ঠিক। বলে রুস্তম রায়। তারপর চারপাশে তাকিয়ে বলে – পার্কটা আমার খুব পছন্দের।

– আমারও। বলে আসমা।

তারপর ওরা উঠে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে রুস্তম ওর বিবাহবিচ্ছেদের কথা বলে। স্কটিশ মেয়েটা খসে গেছে ওর জীবন থেকে। এমন তো কতই হয়। 

ডিভোর্সের হ্যাংগওভারে ক্লান্ত। আপাতত আর কোনো রেলগাড়ি প্ল্যাটফর্মে ইন করবে না। একা অনেক ভালো।

ওরা হাঁটতে হাঁটতে জানতে পারে রুস্তমেরও অ্যান  বোলিনের গাছটা বড় প্রিয় একটা জায়গা ছিল। গাছ নেই। কেবল সেখানে একটা বোর্ড টানিয়ে ও যে ছিল সে-কথা বলা হয়েছে। ওরা দুজন হাঁটতে হাঁটতে বোর্ডের দিকে এগোয়।

– এখন আমাদের দরকার একটা টাইম মেশিন। রুস্তম রায় বলে।

– আমিও তাই ভাবি। পৃথিবীতে এই দরকারি জিনিসটা কেন এখনো আবিষ্কার করছে না কেউ।

তারপর ওরা দুজন সেই সাইনবোর্ড পাঠ করে। বলে রুস্তম – জানো আসমা, মারা যাওয়ার আগে কী বলেছিল অ্যান বোলিন?

– কী বলেছিল?

– আই হ্যাভ হার্ড দ্যাট দি এক্স ইজ ভেরি সার্প, অ্যান্ড আই অনলি গট এ লিটিল নেক।

এই কথার পর কিছু সময় চুপ করে থাকা।

তারপর আসমা বলে – আর যখন গলা কাটার হাঁড়িকাঠের দিকে চলেছিল বাগানে ফুল দেখে বলেছিল – ও হানিসাকল। ইটস মে নাউ। আসলে মে মাসটা ওর সবচেয়ে প্রিয় মাস ছিল।

কথার আবহাওয়া একটু হালকা হয় কাঠবেড়ালিকে বাদাম খাওয়াতে গিয়ে। ওরা কাঠবেড়ালির দিকে তাকিয়ে গল্প করে। তারপর আর একটু হাঁটা। রুস্তমের সঙ্গে সমানতালে পা ফেলে হাঁটতে ওর খুব ভালো লাগছে। আর রুস্তম বুঝতে পারে যে অফিসে ছিল মিসেস মোহাম্মদ এখন পার্কের ফুরফুরে হাওয়ায়, শেষ বিকেলে তাকে সত্যিই অন্যরকম লাগছে। যে কথায় কথায় হাসে এবং হাসাতে পারে। ওর হাসিটা ঝর্ণার মতো। অবারিত। অপরূপ। আর আসমাও বুঝতে পারে অ্যাকাউন্ট ক্লার্ক রুস্তম রায় এক দারুণ প্রাণবন্ত মানুষ, এ রিয়াল স্পোর্ট। কাজের অফিসে কে কাকে কতটুকু বুঝতে পারে। তাছাড়া রুস্তম তখন স্কটিশ মেয়ের সঙ্গে জমিয়ে প্রেম করছে। আর কারো দিকে তাকানোর কথা ভাবেও না। আর মিসেস মোহাম্মদ বর্মের মতো নামের আগে একটা মিসেস লাগিয়ে বোধকরি সর্বপ্রকার আর্বজনামুক্ত থাকতে চেয়েছে। বোধকরি আজকের আবহাওয়া। বোধকরি পার্ক। বোধকরি বিকেলের আলো। কিন্তু আসমা মানুষটাকে মনে রেখেছে এবং রুস্তম রায় আসমাকে। অফিসে ও সকলের জন্য চা বানাতো। সেটাও কারণ। বোধকরি ওরা দুজন সেই অফিসের একমাত্র কালার্ড কাজের লোক, তাই। না হলে কাজ শেষ হলে কে কাকে মনে রাখে আর? রুস্তম তাকে চা খেতে ডাকে। বসে পড়ে রেস্তোরাঁর বাইরে। যেখানে চেয়ার আর টেবিল ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। রুস্তম চায়ের অর্ডার করে। আসমা বলে কেবল চা আর কিছু নয়।

পটভর্তি গরম চা আসে। কেবল চায়ের অর্ডার ভালো দেখায় না ফলে ফেজারি কেক। আসমা চায়ে চিনি খায় না। কিন্তু রুস্তম রায় চায়ে তিন চামচ চিনি খায়।

– কী ব্যাপার ডায়াবেটিসের ভয় নেই?

– মারো গুলি ডায়াবেটিসকো।

ওরা দুইজন চায়ের ভেতরে অরুন্ধতি রায়কে এনে ফেলে। আসে ঐশ্বরিয়া রাই ও দেবদাস। তারপর রুস্তম বলে অস্তিত্ববাদের গল্প। ওর মতে, এটাই বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফিলসফি। বলে – যদি তুমি কোনো চয়েস না করো মানে ইফ ইউ ডোন্ট হ্যাভ এ চয়েস দ্যাট ইজ অলসো ইয়োর চয়েস।

আসমা অস্তিত্ববাদী একটি কবিতার কথা বলে। বলে – ঠিক তাই। একটাই তো জীবন। আমাদের ইচ্ছেমতো বাঁচা দরকার। সময় পার হয় দ্রুত। ‘হিটলারের জীবন’ বইটা নিয়ে ডুবে আছে এরশাদ, আসমা তো তাই ভাবছে। ওর প্রিয় বইটা। সময় পেলেই পড়ে। যেমন নীলা সময় পেলেই পড়ে রবীন্দ্রনাথের গল্প। যদি ও জানতো এরশাদ বইটা কোলে করে কেবল হেঁটে চলে যাওয়া মানুষের জুতো দেখছে তাহলে হয়তো এমন নিশ্চিন্তে গল্প করতে পারতো না। একজন হেঁটে চলা মানুষের সঙ্গ। বনঝোপ পার হয়ে, বড় বড় গাছের তলা দিয়ে যেতে খুবই আনন্দ হয় ওর। রুস্তম রায়ের সঙ্গই মজার। সে ফিলোসফি ও ঐশ্বরিয়া রাইকে একসঙ্গে জানে। যে চয়েস বানায় না কারণ সেটাই তার স্বাধীনতা। হয়তো স্কটিশ মেয়েটা তাকে এসব শিখিয়েছে। মানে তার খসে পড়ার বেদনা থেকেই ও আজকের এমন একজন। কিংবা ও বরাবরই এমন। কেবল টেবিলে বসে হিসাব মেলানো ওর কাজ নয়। সন্ধ্যা হবে এখন। নীলা একবারও বলে না হর্সচেস্টনাট গাছের তলায় বসে থাকা বর্তমানের মহাস্থবির জাতকের কথা। কেন বলে না? সহানুভূতি সে কারোরই চায় না। কিংবা এই স্থবিরতাই তাকে এমন করে চলিষ্ণুতার কথা বলে, সেটাও সে কাউকে বলতে চায় না। কাকে বলবে? কেউ নেই যাকে মন খুলে সব বলা যায়। কেউ নেই যাকে দেখলে সে আনন্দে উদ্বেল হতে পারে। আসমার হাতে একটি আইসক্রিম তুলে দিয়ে রুস্তম রায় বলে – সি ইউ সামটাইম আসমা। এই বলে গেটের ওপারে চলে যায়। আসমা গেটের দিকে তাকিয়ে কী ভাবে। রুস্তম একবার মুখ ফেরায়। একটু হাসে। সুন্দর হাসি।

একা একা চলমান মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন অস্থির হয়ে ওঠে এরশাদ। উল কাঁটা আর ‘এগ লেটুস স্যান্ডউইচ’ তেমনি পড়ে আছে। ইচ্ছা করে না কিছু খেতে। কেবল পানির বোতল থেকে পানি খেয়েছে এরশাদ। বড় তৃষ্ণা পেয়েছে ওর। ঘড়িতে সময় দেখে বারবার। খোলা বইয়ের পাতা তেমনি থাকে। দেড় ঘণ্টা পার হয়ে এখন দুই ঘণ্টা হতে চলেছে; আসমা আসছে না। একা হুইলচেয়ারে বসে চেয়ে আছে চলমান, ভ্রাম্যমাণ পথিকের দিকে।

– হ্যালো মেট ইউ ওকে?

কোনো কোনো পথচারীর দৃষ্টি ওকে তীরবিদ্ধ করে। এরশাদ উত্তর করে না। ওর ভেতরে যে অনুভূতি কাজ করছে তা কেউ বুঝতে পারে না। একবার চাকাচেয়ার ঠেলে একটু পেছনে আর সামনে করে। আবার ঘড়ির দিকে তাকায়। পা দিয়ে মাটি স্পর্শ করে। কিন্তু জানে কেবল স্পর্শ। ওর উপরে দু-পায়ে ভর করে দাঁড়াতে পারবে না কখনো আর। বারবার মাটি স্পর্শ করতে করতে মাটিই বোধহয় সাহস দিয়ে বলে, চেষ্টা করতে দোষ কী। পায়ের ওপর থেকে লাল কম্বল সরায়। ‘হিটলার’ মাটিতে পড়ে মুখ থুবড়ে। এখন যাদের দেখছে বাড়িতে তাদের দেখতে পায় না এরশাদ। সে কেবল দেখতে পায় আসমার হেঁটে যাওয়া, দিনে একশবার সিঁড়ি ভাঙা, তার পায়ের নখের লাল কিউটেক্স। কখনো তার কপালের টিপ। এখন এই চলমান পৃথিবী তাকে আরো বেশি হতাশ করে। অসহিষ্ণু করে। ওর ভয়ানক রাগ হয় নিজের উপর এবং আসমার ওপর। মনে হয়, নিজের এই চলিষ্ণুতা দেখাতেই, এরশাদকে পার্কে একা রেখে ফুরফুরে হাওয়ায় উধাও হয়ে গেছে। এরশাদ মরিয়া হয়ে ওঠে। সে চায় উঠে দাঁড়াতে।

দূর থেকে একটা ভিড় দেখতে পায়। প্রায় ছুটে আসে আসমা। হাতে টুটিফ্রুটি আইসক্রিম। কী হলো ওখানে? ছুটে আসতে আসতে দেখতে পায়, কিছু লোক ঠেলেঠুলে এরশাদকে আবার চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছে। একটা ক্রুদ্ধ বন্যপ্রাণীর মতো এরশাদ রেগে আছে। আসমার হাতে তখনো আইসক্রিম। ঘড়িতে পার হয়ে গেছে দুই ঘণ্টা তিন মিনিট। গ্রিনিচ মানমন্দির সামনে রেখেও আসমা সময় খেয়াল করতে পারেনি। কারণ কি চলার ছন্দ ও সঙ্গ যেখানে পাখি, কাঠবেড়ালি আর গাছেদের ভেতর দিয়ে পথ, সেখানে ছিল ওরা? আর ছিল কিছু স্বাভাবিকতা। যারা এরশাদকে চেয়ারে বসতে সাহায্য করেছিল তারা ওকে দেখতে পেয়ে এক এক করে চলে যায়। তেমন কোনো মারাত্মক ক্ষতি হয়নি। কনুইয়ের কাছে একটু ছিলে গেছে। হাতে আইসক্রিম নিয়ে একটু বিব্রত মুখে যে দাঁড়িয়ে, তার দিকে আগুনের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে এরশাদ। মনে হয় এরশাদ জানে আসমা এবার ন্যাকামি করে কী বলবে। স্ত্রীকে সময় বিশেষে ওর অভিনেত্রী মনে হয়। আর? এতগুলো মানুষের সামনে এমন নাটক করারই বা কী দরকার ছিল! পায়ে ভর দিয়ে একা একা দাঁড়ানো? সেও গনগনে চোখে তাকায়। যখন পুরো ব্যাপারটি বুঝতে পারে ওর রাগ হয়। হাতের টুটিফ্রুটি ছুড়ে ফেলে দূরে। এরশাদকে ছুঁতে যেতেই তীব্র ভয়ংকর কণ্ঠে এরশাদ বলে – থাক।

– তোমার কি লেগেছে? দেখি কোথায়।

এরশাদ অনেকক্ষণ ওর উদ্বেগের উত্তর দেয় না। তারপর ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর শোনে আসমা – কী হবে দেখে, যা করছিলে করো। সে-কথার আগুন আসমার গায়ে লাগে। চামড়া পুড়িয়ে দেয়। এরপর এরশাদ প্রস্তুত থাকে আসমার একটু ন্যাকামির জন্য। না হলে বেশ একটু মোম গলানো আদরের ভাষা। সে নিজেও ভাবে না এই স্থবিরতা তার, কিন্তু আসমা তার চলমান জীবন ভুলে কেমন করে তার সঙ্গে লেগে থাকে। এসব এরশাদ কখনো ভাবে না। কেউই ভাবে না। সকলে বাড়িতে এসে এরশাদের খোঁজখবর করে। আসমার নয়। সেইসব অতিথির আপ্যায়নও করতে হয় আসমাকে। 

কিন্তু এখন কোনো প্রকার ন্যাকামি নয়। বোধকরি আজকের অস্তিত্ববাদের দর্শন একটা বড় ডোজের মতো তার মাথায় কাজ করতে শুরু করেছে। চরিত্রবিরোধী গলায় বলে – তুমি কি কোনোদিন ভাবো কেয়ারারেরও জীবন থাকে। আমরা কথা বলছিলাম। যেমন কথা তুমি বলতে চাও না।

– আমরা? মনে হয় এরশাদের শরীরে কেউ গরম খুন্তির ছ্যাঁকা দিয়েছে।

এরশাদ এরপরও কথা বলে না। কেবল সে রাগী চোখে আসমার দিকে তাকায়। পারলে আগুনদৃষ্টিতে তাকে পুড়িয়ে মারবে।

আসমার লেখা একটি কবিতা আজো আছে আমার কাছে। মনে হয় রুস্তম রায় নামের কোনো একজনকে নিয়ে লেখা।  ‘যদি কখনো ইতালি যাই, তুমি কি আমার সঙ্গী হবে? ভেনিস আর গন্ডোলায় তুমি কি একটি মজার গল্প করবে?’ চমৎকার কবিতা। একদিন আমি গ্রিনিচ পার্কে গিয়ে সেই অ্যান বোলিনের গাছের তলায় কবিতাটি রেখে আসবো। ও কি এখন ঈশ্বরের নিবিড় সবুজ বাগানে। যেখানে থাকো ভালো থাকো আসমা।  তুমি এত আগে এক্সিট নেবে কেউ কি ভেবেছিল?