গজাবিলের লাশ

‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন – আমরা তো আল্লাহরই সৃষ্টি, তিনি লা-শরিক, এবং নিশ্চয়ই তাঁর কাছেই আমাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে …।’

অবতীর্ণ এবং শাশ্বত এই বাণীর কখনোই ব্যত্যয় ঘটে না। ঘটবেও না কোনোদিন। তাই তো, মানুষ সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই, কেউ কারো মৃত্যুসংবাদ শুনলে, অবতীর্ণ এই বাণী পাঠ করে। এটি মৃত ব্যক্তির, যার আত্মা কি প্রাণবায়ু নশ্বর দেহ ছেড়ে অচিনলোকে চলে গেছে, সেই বিদেহী আত্মার কল্যাণ কামনা করা। বেঁচে থাকতে আমিও বহু মানুষের অবিনশ্বর আত্মার কল্যাণ কামনা করে এই শ্লোক পড়েছি। হিন্দু সম্প্রদায়ের কারো মৃত্যুসংবাদ শুনলে পড়েছি সংস্কৃত শ্লোক – ‘ওঁ দিব্যান লোক্যান স গচ্ছতু …।’

এই যে আমি বললাম – ‘বেঁচে থাকতে’ – তাহলে আমি কি মারা গেছি? পরলোকের পথে, কোথায়, কতদূর সেই পরবসতি, কে জানে; আমার কি সেই পথে যাত্রা শুরু হয়েছে? আমার যদি মৃত্যু হয়ে থাকে, তবে তো অবতীর্ণ এই বাণী আমার শোনার কথা নয়, এই শ্লোক আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করার কথা নয়, কিন্তু আমি তো শুনতে পাচ্ছি – ঠিক আমার ভাষায়, বাংলায় – কেউ একজন শ্লোকটি … ‘নিশ্চয়ই তার কাছেই আমাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে’ – পাঠ করতে করতে আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল …।

আমি তাহলে মরি নাই, আমার মৃত্যু হয়নি, বেঁচে আছি; কিন্তু কী অদৃষ্ট আমার, বেঁচে থাকতেই মৃত্যুর শ্লোক শুনতে হচ্ছে …!

‘কেউ একজন’ এর অর্থ করলে দাঁড়ায় – ‘একজন মানুষ!’ একাকী – একজন। কিন্তু আমি তো কখনো একজনের গলার স্বর শুনতে পাই, কখনো বহুজনের কথা কানে আসে। এই কথাপুঞ্জ গাভিন বোয়াল মাছের মতো ঘাই মারে আমার কানে, তখন বুঝতে পারি এই শ্লোক মনুষ্যবচন নয়, এগুলো পাখিবচন; একঝাঁক পাখি যেন কোরাস গাইছে – ‘নিশ্চয়ই তার কাছেই আমাদের প্রত্যাবর্তন …।’

পাখিগুলোও নিশ্চয়ই ভেবেছে মানুষের মড়া পড়ে আছে। না-হলে ওরা মৃত্যুশ্লোক গাইবে কেন? আমি যে মরিনি, মৃতবৎ পড়ে আছি, যে দু-চারজন মানুষের মুখে মৃত্যুশ্লোক শুনলাম, কিংবা এই পাখিরা, সবারই হয়তো বিশ^াস এবং ধারণা – মহুয়ার প্রাণপাখি অনেক আগেই পরলোকের উদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছে …।

হ্যাঁ, আমি বেঁচে আছি, আমার প্রাণবায়ু এখনো বেরোয়নি, মড়ার মতো পড়ে আছি, এই যা; কিংবা মহুয়ার মৃত্যু হয়েছে, ঠিক কতক্ষণ আগে মৃত্যু হয়েছে, হয়তো বেশি আগে নয়, দুর্গন্ধ ছড়ায়নি তো, মানুষের শরীর পচে গেলে, অন্য

পচা-গলা প্রাণীর চেয়ে বেশি দুর্গন্ধ ছড়ায়, চারদিক দমবন্ধ বিষাক্ত পরিবেশ তৈরি করে, এজন্যই যতটা সম্ভব দ্রুত লাশ পুড়িয়ে কিংবা মাটির নিচে কবর দিয়ে সৎকৃত্য করা হয়; তা যাই করা হোক, কিন্তু একটা লোকও এগিয়ে এলো না। দেখলো না – আমি জীবিত নাকি মৃত, মানুষের মনের কৌতূহলেরও কি মৃত্যু ঘটেছে? এই ভোরবেলা, পূর্বদিকে বিলের ওপার থেকে কেবল সূর্য ঘোমটা খুলে বেরুচ্ছে, এখানে একটি লোক, তাও আবার নারী, বিলের ধারে চিৎপটাং শুয়ে কিংবা পড়ে আছে কেন, দেখবে না কেউ …?

মানুষ দিনকে দিন, দ্যাখো কেমন পাথর বনে যাচ্ছে! অনেক সময় তো, শুনেছি, পাথরও গলে; কিন্তু মহুয়াকে বিলের ধারে পড়ে থাকতে দেখে কারো মন গললো না। আফসোস …।

সূর্য তরতরিয়ে ওপরের দিকে উঠছে। বিলে ছড়িয়ে পড়ছে সদ্য-উদিত সূর্যের কাঁচা সোনার মতো রং। বিল এখন আছে শুধু নামেই, গজাবিল; বিলে একসময় বিশালাকার সব গজার মাছ পাওয়া যেত, হেমন্তের শুরু কি মধ্যকাল থেকেই শুরু হতো মাছ ধরা, তিন ফুট-চার ফুট আকারের গজার মাছ, দাদা বলতো – বিলে গজার মাছের প্রাচুর্য ছিল বলেই, এই প্রাচুর্য কবে থেকে ছিল কেউ তার সঠিক হিসাব জানে না; কিন্তু গজার মাছের নামেই বিলের নামকরণ হয়েছে গজাবিল, এ নিয়ে রসুলপুর, সাদুল্লাপুর, গালা, পৌলি, শালিনা, বেথইর, রাবনা, খয়রাহাটি – কোনো গাঁয়ের মানুষের দ্বিমত ছিল না। বর্ষায় এই গজাবিলে সাগরের মতো মানুষ সমান ঢেউ উঠতো; এখন না-আছে সেই ঢেউ, না-আছে গজার মাছের সমারোহ; আবার যে-বিলে শোল-বোয়াল-গজার মাছের প্রাচুর্য থাকতো, দাদা-দাদির মুখেই শুনেছি সেই বিলে মেছোদেও থাকতো, একাকী কেউ রাতের বেলা মাছ ধরতে গেলে মেছোদেওয়ের গ্রাসে পড়ে প্রাণ যেত তার; গজাবিলেও এককালে দেও-দানোর উৎপাত কম ছিল না; আমার আবছা-আবছা মনে পড়ছে, আমি তো এই বিলপাড়েরই মানুষ, রসুলপুরের মেয়ে, এও কিছুটা মনে পড়ে, স্মৃতি যেন একটু-একটু করে খুলতে শুরু করেছে, আমি রসুলপুরের আইনুদ্দিনের মেয়ে, তা ঠিক আছে; কিন্তু অনেকদিন গাঁয়ে ছিলাম না। তখন আমি বেতসলতার মতো কিশোরী, কেবল বুনি উঠতে শুরু করেছে, আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজেই নিজের বুক দেখে মুগ্ধ হই, আয়না থেকে চোখ ফেরাতে ইচ্ছা করে না, ভূঁইয়াবাড়ি কাজ করতাম, ভূঁইয়াদের দুই ছেলে তমিজ আর ইন্তাজ আমাকে কান্দাপাড়া বিক্রি করেছিল, সেই আখ্যান সুযোগ পেলে পড়ে শোনাবো; এখন মনে করার চেষ্টা করছি – আমি বিলপাড়ে এলাম কী করে …!

গজাবিল যে বিল নয়, যেন সাগর, বিশেষ করে বর্ষাকালে – সে তো খানিক আগেই বলেছি। বিলের কাছাড়ে কত যে হিজলগাছ, তার কোনো লেখাজোখা ছিল না। দূর থেকে মনে হতো বিশাল হিজলের বন। বিলের মাঝখানেও, একটু দূরে দূরে ছিল কয়েকটি হিজলগাছ। বর্ষায় বিলে পানি যতই হোক গাছগুলো ডুবতো না। এ-এক অলৌকিক ব্যাপার, গাছ যেন পানির সঙ্গে সঙ্গে বাড়তো। জিরাফের গলার মতো গলা উঁচু করে থাকতো মধ্যবিলের হিজলগাছগুলো। দাদি বলতো – ওই হিজলগাছগুলোতে বাস করতো দেও-দানোরা। … আর বর্ষার জল নেমে গেলে বিলের কাছাড়ে গজিয়ে উঠতো উলুখাগড়া, বৈচি, আশশেওড়া, ভাঁট, কচু, বিছুটিলতার গাছ। সবাই একসঙ্গে জড়াজড়ি করে থাকতো – কী বন্যসৌন্দর্য যে ফুটে উঠতো বিলপাড়ে …!

আমার নাকে ভাঁটফুলের সুগন্ধ আসছে। বেগুনি-সাদা ফুলগুলো দেখতে খুবই সুন্দর। আমি মড়ার মতো পড়ে আছি তো, দেখতে পাচ্ছি না; কিন্তু ভাঁটফুলের ঘ্রাণ নাকে প্রবীণ গজার মাছের মতো ঘাই মারছে। ফাগুন-চৈত্রে ফুটতে শুরু করেছে ভাঁটফুল। এখনো ফুটছে …।

এই যে ভাঁটফুলের গন্ধ পাচ্ছি, আশশেওড়ার গন্ধ পাচ্ছি, আমি কি তাহলে বেঁচে আছি? জীবিত? নাকি মৃত্যু হয়েছে আমার? কিংবা হিজলগাছের কোনো দানো আমাকে কুপোকাত করেছে! আমি সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছি না – আমি জীবিত নাকি মৃত …! জীবন্ত ও মৃত্যুর মাঝামাঝি কি কোনো পর্ব আছে! হয়তো আছে, থাকলে থাকতেও পারে; আমি হয়তো সেই পর্বেই আছি …।

বিলজুড়ে এখন ধানের চাষ হয়। এক ফসলি। বছরে একবারই ধানচাষ করতে পারে চাষিরা। পৌষ-মাঘ মাসে বিলে কিছুটা বর্ষার পানি থাকতে থাকতেই চাষিরা ধানের চারা রোপণ করে। আগাম জাতের ধান। ফাগুন-চৈত্রে বিলের মাঝ-বরাবর যে দওটি আছে, সেই দওয়ের পানি সেঁওতি দিয়ে চাষিরা ক্ষেতে  জলসিঞ্চন করে। মেশিন বসিয়ে ক্ষেতে পানি দিতে হয় না। এখন বিলের চকে ধান নেই। বৈশাখের শুরুতেই গৃহস্থরা ধান কেটে ঘরে তুলেছে। ক্ষেতে এখন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আধা-হাতের মতো লম্বা-লম্বা খড়। খড়ের গোড়া থেকে কুশি গজিয়েছে। গৃহস্থবাড়ির গরু-ছাগল দিনমান চড়ে বেড়ায় এই বিলচকে। আমি বিলপাড়ে পড়ে আছি। শরীরের অর্ধেক বিলের কাছাড়ে, অর্ধেক ক্ষেতের চ্যাপচেপে পানিতে। রাতে কিছুক্ষণ, আমাকে এখানে রেখে যাওয়ার পর ঝুমবৃষ্টি নেমেছিল, সম্ভবত মৌসুমের প্রথম বৃষ্টি, ক্ষেতের জমি খরায় ফেটে ছিল, তাই বৃষ্টির পানি খুব বেশি ক্ষেতে জমেনি; পানি চ্যাপচ্যাপ করছে…।

সূর্যোদয়ের আগে দু-চারজন লোক আমাকে দেখলো। তারা হয়তো প্রাতকৃত্য সারতে এসেছিল। গাঁ-ঘরে এখনো কিছু লোক আছে, বয়সে প্রবীণ, তারা বিলের ধারেই প্রাতঃকাজ করতে পছন্দ করে। তারা আমাকে দেখে ধরেই নিয়েছিল – লোকটি মৃত; লোকটি পুরুষ নাকি নারী, কাছে এসে তাও দেখার গরজবোধ করলো না, মৃত্যুর দোয়া – ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ – পড়তে পড়তে চলে গেল। লাশ দেখার সাক্ষী হলে কত যে যন্ত্রণা, তা তাদের জানা আছে। … আর পাখিগুলো, টুনটুনির ঝাঁক বোধহয়, ওরা কোনদিকে গেল …!

দুই

কাটা-ধানের মোথায়-মোথায় বৃষ্টির ফোঁটা ঝুলে আছে। এই বৃষ্টি-ফোঁটায় পড়েছে সূর্যের আলো। এই আলোয় জল-গোলা সোনার মতো চিকচিক করছে কাটা-ধানের মোথা। একদল লোক প্রায় দৌড়ের মতো করে, দ্রুতপায়ে এদিকেই আসছে। এতক্ষণে, বোধহয় দুপুর হয়ে এলো, গাঁয়ে খবর রটেছে – বিলপাড়ে এক যুবতীর লাশ পড়ে আছে। কে লাশ প্রথম দেখেছে, কেউ তার হদিস জানে না। তবে লাশ যে একটা পড়ে আছে তা দিনের আলোর মতোই সত্য। তাহলে কি ওই পাখিগুলোই খবর দিলো? ভোর-সকাল থেকেই একঝাঁক পাখি, আকারে ছোট, টুনটুনির মতো, গাঁয়ের মণ্ডলবাড়ি, সরকারবাড়ি, ভূঁইয়াবাড়ি, দাসপাড়া, বেহারাপাড়া, পালপাড়ার ওপর দিয়ে ওড়াউড়ি করছিল, কিচির-মিচির করছিল অবিরাম …।

খবর যে-ই দিক, সেটি বড় কথা  নয়, খবর হাছা কি মিছা, তা আগে যাচাই করো বাপু …। মণ্ডলবাড়ির নবুর আলী মণ্ডল বললো।

– তা ঠিক কইছেন নবু চাচা …। বললো জনতার একজন।

নবুর আলী মণ্ডল কোথাও কোনো কথা বললে – সেটি যেন বেদবাক্য – গাঁয়ের কেউ এদিক-সেদিক আর কোনো কথা বলে না। এখনো কেউ আর কিছু না বলে দ্রুতপায়ে বিলের দিকে হাঁটতে লাগলো …।

গজাবিলের কাছাড়ে কি মাঝ-বরাবর প্রত্যেক মাসে কিংবা দু-মাস কি তিন মাস অন্তর একটি লাশ পড়ে থাকে, এ আর নতুন কী …?

একবার তো একসঙ্গে তিনটি লাশ ছিল, দুটি দুই যুবকের, একটি এক যুবতীর। সেটা প্রায় পাঁচ বছর আগের ঘটনা। এরপর আর কোনো নারীর লাশ পড়ে থাকেনি এখানে। আবার নারীর লাশ পড়লো এবার। কে এই যুবতী – কে জানে! এখানে, এই যে বিলের ধারে জোয়ান, বুড়ো, এমনকি শিশু-কিশোরের লাশও পড়ে থাকে, কোনো লাশেরই পরিচয় মেলে না। খবর পেয়ে পুলিশ এসে লাশ নিয়ে যায়, ময়নাতদন্ত করে, তারপর হয়তো অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে লাশটির সৎকৃত্য করে। এবার যে মহুয়ার লাশ পড়ে আছে, তাকেও কেউ শনাক্ত করবে কি না, কে জানে …!

এই যে লাশ পড়ে থাকে, দু-চারদিন শালুক-নদের খেয়াঘাটে, বটতলা বাজারে কিংবা মসজিদে নামাজের আগে-পড়ে লাশটি নিয়ে বেশ আলোচনা হয়। কার লাশ, কোন গাঁয়ের মানুষ! কেউ চিনলো না? অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে ঠাঁই হলো কবরে কিংবা শ্মশানে। লাশটি কোনো নারীর কিংবা শিশুর হলেই বিপদ! লাশটি কোনো হিন্দুর নাকি মুসলমানের তা নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ে। বিলের ধারে তুমুল তর্কও বাধে কখনো-সখনো – লাশটিকে কবর দেওয়া হবে কি চিতায় তুলে পোড়ানো হবে? বয়স্ক-পুরুষ মানুষ হলে, লাশের পুরুষাঙ্গের মাথার বাড়তি চামড়া কাটা কি কাটা না – দেখেই লোকটি হিন্দু কি মুসলিম তা নির্ণয় করা যায় সহজেই, কিন্তু লাশটি যদি হয় শিশুর এবং মুসলমান-ঘরের, কিন্তু তার পুরুষাঙ্গের মাথার বাড়তি চামড়া কাটার বয়সই হয়নি কিংবা লাশটি কোনো নারীর, তার স্ত্রীলিঙ্গের কোথাও চামড়া কাটাকুটির দরকার হয় না, আমাদের দেশে ‘সতীচ্ছেদ’ প্রথাও নেই, এমনকি লাশের সিঁথিতে সিঁদুরও নেই, সৎকৃত্যের পদ্ধতি নির্ণয়ে গোল বাধে। তখন হঠাৎ কোত্থেকে যেন সুনীল বয়াতির আবির্ভাব ঘটে। এতক্ষণ, এখানে, কোথাও সে ছিল না, কারো চোখে পড়েনি দশাসই চেহারার বাউলের, যেন এই মাত্র সে বিলের জলরাশি ভেদ করে বেরিয়ে উঠে এলো; এবং এই তর্কাতীত বিতর্ক শুনতে-শুনতেই সে তার দরাজকণ্ঠে গেয়ে উঠলো – ‘জাত গেল জাত গেল বলে এ কী আজব কারখানা …।’

থানার দারোগা হয়তো লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি নিয়ে ব্যস্ত ছিল। কারো দিকে তাকানোর অবকাশ ছিল না। যারা তর্ক করছে করুক। কিন্তু সুনীল বয়াতির গলা শুনেই দারোগা চোখ বড় বড় করে …।

– আরে, বয়াতি যে! কখন এলে …?

– আমি তো সেই কখন এসেছি …।

– দেখলাম না যে …।

– চোখ থাকলেই দেখা যায় …।

– তা ঠিক বয়াতি, তা ঠিক। আমার আর তোমার চোখ এক না। আমার চোখ দিয়ে আমি যা দেখি তার সবই তুমি দেখো। কিন্তু তোমার চোখ দিয়ে তুমি যা দেখো, তার সবই আমি দেখি না। এর জন্যই তুমি বাউল আর আমি থানার দারোগা …।

কথা শেষ করে দারোগা তর্করত জনতার দিকে চোখ তুলল। ‘এই তোমরা সবাই তর্ক থামাও। তোমরা কেউ শরৎবাবুর শ্রীকান্ত পড়েছ …।’

জনতার মুখে খিল।

পড়ো নাই। শ্রীকান্ত উপন্যাসে একটা চরিত্রের নাম ইন্দ্রনাথ। দুর্দান্ত চরিত্র। তার কোনো ভয়ডর নাই। যা হোক – ঘটনাচক্রে একদিন নদীতে ভাসমান একটি লাশ দেখে শ্রীকান্তকে ইন্দ্র বলে – ‘মড়ার আবার জাত কী রে! মড়ার কোনো জাত নাই …।’ একশভাগ খাঁটিকথা। পাঁচশভাগ খাঁটিকথা। তোমরা তর্ক বাদ দাও। আসলেই মড়ার কোনো জাত নাই। এই মড়াটাকে আমি কবর দিই আর চিতায় তুলে পোড়াই, যাই করি, মড়ার পবিত্রতা অক্ষুণ্ন রেখেই করবো। কী, ঠিক আছে …?

সুনীল বয়াতি গান ধরে – ‘সুন্নত দিলে হয় মুসলমান/ নারী লোকের কী হয় বিধান/ বামুন চিনি পৈতে প্রমাণ/ বামনী চিনি কীসে রে…/ … সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে …।’

তারপর একদিন সবার অজান্তে, সবাই লাশটির কথা ভুলে যায়। ভুলে যাওয়াই সম্ভবত স্বাভাবিক। কারণ, আমরা দেখি তো, আমার কিংবা আপনার; আমাদের চোখের সামনেই ঘটতে দেখি – নিজের স্বজনেরই কারো মৃত্যুর পর, হোক সে মা-বাবা,
স্ত্রী-সন্তান-পরিজন; কেউ কেউ দু-চারদিন কাঁদে, মনমরা হয়ে থাকে, বিষণ্নতায় ভোগে, তারপর যা, তাই! সব স্বাভাবিক। সবাই লাঙল-জোয়াল-গরু কিংবা পাওয়ার টিলার নিয়ে ক্ষেতে যায়, বাজার-গঞ্জে ব্যবসার গদিতে বসে, চাকরি করলে অফিসে যায়; যেন, এই যে মা-বাবা, ভাই-বোন কেউ মারা গেল কিংবা প্রিয়তমা স্ত্রী বা সন্তান কি কারো স্বামী কথা নেই বার্তা নেই; কোনো অসুখ-বিসুখ নেই; হুট করে পরপারে পাড়ি জমালো – সাতদিন কি দশদিন পর সব স্বাভাবিক; নিজের স্বজন-পরিজন মারা গেলেই যদি এই পরিস্থিতি হয় তাহলে অজ্ঞাতপরিচয়, অনাত্মীয়ের জন্য মানুষ আর কতটা শোকসন্তাপ করবে? লাশটি দেখে কিছুক্ষণ হয়তো হা-হুতাশ করবে, বাড়ি যেতে যেতেই, কেন সে – কার জন্য শোক প্রকাশ করলো, কার জন্য চোখ ছলছল করছিল জলে – তাই হয়তো মনে পড়বে না। মানুষ বড় অদ্ভুত প্রাণী, হয়তো বন্যজন্তুর চেয়েও নিচুস্তরের। মহুয়ার লাশ দেখতে এই যে গাঁয়ের মানুষ দলে-দলে গজাবিলের দিকে দ্রুতপায়ে ছুটছে, তার লাশটি যদি কেউ শনাক্ত করতে না পারে, কেউ যদি না চিনে – লাশটি আইনুদ্দির মেয়ে মহুয়ার, তাহলে কেউ কেউ হয়তো যৎকিঞ্চিত হা-হুতাশ করবে, কারো কারো চোখ কিছুক্ষণের জন্য জলে টইটম্বুর হবে, কিন্তু বাড়িতে যেতে-যেতেই মহুয়ার গলাকাটা লাশের কথা আর কারো মনে থাকবে না। শুকনো মৌসুমে গজাবিলের পানি যেমন শুকিয়ে যায় – সবার চোখের জলও তেমনি শুকিয়ে যাবে। এটাই নাকি প্রকৃতির নিয়ম। প্রকৃতির নিয়ম ভাঙার কোনো সুযোগ নাই …।

গজাবিলে লাশ পড়ে, হয়তো বিলের ধারে, কিংবা মধ্যবিলে, প্রতিমাসেই একটা কিংবা দু-মাস কি তিন মাস পরপর একটা। কোনো লাশেরই পরিচয় মেলে না, কেউ শনাক্ত করতে পারে না; পুলিশও শুধু লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়, লাশকাটা ঘরে নিয়ে ময়নাতদন্তের ব্যবস্থা করে, তারপর অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে লাশ দাফন করে, কোনো একটা লাশেরও ঠিকুজি বের করতে পারে না; এটা একটা অবাক কাণ্ড ঘটে। যাহোক, গজাবিলে পতিত কোনো লাশেরই যে পরিচয় মেলে না, এ নিয়ে বিলের চারপাশের কোনো গ্রামের মানুষের হেলদোল নাই, তারা আরেকটি লাশের অপেক্ষায় থাকে। কারণ, তারা তো জানে, এ মাসে লাশ পড়ে নাই, তাতে কী? আগামী মাসে কিংবা পরের মাসে কি আরো দু-মাস পরে লাশ পড়বেই। তখন না হয় দেখা যাবে – পতিত লাশটির পরিচয় মেলে কি মেলে না …।

কিন্তু যেবার রীতি ভেঙে একসঙ্গে তিনটি লাশ পড়ল, দুটি লাশ যুবকের, বয়স ২৪-২৫ হবে; আরেকটি লাশ এক যুবতীর, বয়স হবে ১৭ কি ১৮; সেবার খুব হুলস্থূল বেধে গেল। একসঙ্গে তিন-তিনটি খুন! কোথায় যে এই দুই যুবক আর যুবতীর বাড়ি! তিনজনেরই গলাকাটা। মুণ্ডু আর ধর আলাদা-আলাদা পড়ে আছে। নিহত যুবতীর হাতের কাছাকাছি পড়ে আছে জমাটবাঁধা রক্তযুক্ত একটি চাপাতি …।

গজাবিলে লাশ পড়ে, যথারীতি প্রতিমাসে একটা কিংবা দু-তিন কি চার মাস পর একটা – এ নিয়ে এলাকার মানুষের তেমন মাথাব্যথা নেই, পুলিশেরও নেই, এটা যেন একটা রীতি, নিয়ম; রীতি ও নিয়ম প্রতিপালিত হবেই। কিন্তু সেবার তিনটি লাশ পড়ে থাকার খবরে এলাকাবাসী তো বটেই, পুলিশও নড়েচড়ে বসেছিল। থানার ওসি নিজে এসেছিল লাশ উদ্ধার করতে। তিন-তিনটে লাশ বলে কথা! তাও আবার একটি লাশ নারীর! কোথাকার মানুষ, কীভাবে খুন হলো – বের করা দরকার …।

– মনসুর, তোমার কী মনে হয়। কাউকে সন্দেহ …?

– না স্যার। কোনোকিছুই বুঝতে পারছি না। না-বুঝে কাকে সন্দেহ করবো। আগে দেখেছি, একটা-একটা লাশ পড়তো। একটা লাশ দেখে গাঁয়ের লোকেরা বলতো – ভূত-প্রেতের কারবার হতে পারে। এখানে প্রচুর হিজল গাছ। হিজলগাছে নাকি ভূত-প্রেত, দেও-দানো বাস করে। এবার তো তিনটে লাশ। তাও আবার গলাকাটা, আগে গলাকাটা লাশ দেখিনি …।

– আমার কী মনে হয়, জানো …?

– কী স্যার …?

– এই তিনজনের কোনো একজন বাকি দুজনকে খুন করেছে …।

– লাশ যে তিনটে স্যার …।

– যে খুন করেছে, সে হয়তো পরে আত্মহত্যা করেছে। এবং এই খুন দুটো এই মেয়েমানুষটার হাতে হতে পারে …।

– কীভাবে সম্ভব, স্যার …?

– এই মেয়েটি প্রথমে দুই যুবকের একজনকে নিজের পক্ষে নিয়ে দুজনে মিলে দ্বিতীয় যুবককে গলা কেটে খুন করেছে।

 তারপর যে-যুবকটিকে নিজের পক্ষে রেখেছিল তাকে খুন করে নিজে আত্মহত্যা করে …।

– স্যার, আপনার কেন এরকম মনে হচ্ছে …।

– একটা গল্প তৈরি করলাম আর কী। মেয়েটির চেহারা দেখেছো তো। যেন দেবী সরস্বতীর যমজ বোন। হতে পারে – এই দু-যুবকই ভালোবাসতো মেয়েটিকে কিংবা পথঘাটে উত্ত্যক্ত করতো। মেয়েটি হয়তো এই দুই যুবকের কারো হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারেনি – তারই প্রতিশোধ নিয়েছে …।

– ধরে নিলাম, মেয়েটি প্রতিশোধ নিয়েছে। কিন্তু সে নিজে আত্মহত্যা করবে কেন …?

– হতে পারে – মেয়েটির পেটে বাচ্চা ধরেছিল। অবৈধ সন্তানের মা হিসেবে হয়তো সে বেঁচে থাকতে চায়নি। সারদার ট্রেনিংয়ে পাওনি – মেয়েরা কিঞ্চিত দুর্বল মানসিকতার হয়। আর দুর্বল মানুষেরাই হুট করে আত্মহত্যা করে বসে …।

– জি, স্যার। এরকমটা হতে পারে …। কিন্তু …।

– কিন্তু কী …?

– দুই যুবকের মধ্যে মেয়েটিকে নিয়ে বিরোধ থাকতে পারে স্যার। হয়তো এই দুই যুবকের একজন মেয়েটিকে হাত করে অন্য যুবককে খুন করেছে। তারপর খুন করেছে মেয়েটিকে এবং দুজনকে খুনের পর নিজে আত্মহত্যা করেছে …।

– তাও হতে পারে …।

ভিড়ের মধ্য থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এলো সুনীল বয়াতি। গান ধরল – ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়/ ধরতে পারলে মনোবেড়ি দিতাম পাখির পায়…।’

না খাঁচার ভেতরের এই পাখিটাকে কেউ ধরতে পারে না। লালন সাঁইজিও পারেননি। মহুয়ার প্রাণপাখিটা এতক্ষণ খাঁচার ভেতর আছে কি নেই, তাই বা কে জানে …!

তিন

আমি জীবিত কি মৃত – ঠিকমতো ঠাহর করতে পারছি না। যখন টের পাই, অনুভব করতে পারি – আমি গজাবিলের কাছাড়ে পড়ে আছি, গ্রাম থেকে একদঙ্গল লোক মহুয়াকে দেখার জন্য ছুটে আসছে, তখন মনে হয় আমি জীবিত। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি মারা যাবো, ট্রাকের ড্রাইভার জলিল আমার গলা সজোরে চেপে ধরেছে, বিকটদর্শন যমদূত আমার শিয়রে এসে বসল, জলিল আরো শক্ত করে চেপে ধরছে আমার কণ্ঠনালি; হয়তো এখনই মরবো, কিন্তু বেঁচে আছি। আর টুনটুনি পাখির ঝাঁকের মুখে যখনই শুনি – ‘আমরা তো আল্লাহরই সৃষ্টি এবং নিশ্চয়ই তাঁর কাছেই প্রত্যাবর্তন’ – তখন মনে হয় আমি জীবিত নই। মৃত্যু হয়েছে আমার। হয়তো কিছুক্ষণ আগেই আমি পরলোকের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছি। খবরটা শুনেই টুনটুনি পাখিরা অনবরত জপ করছে – ‘আমরা তো আল্লাহরই সৃষ্টি …।’

আমি তো নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তন করবো, কিন্তু যতক্ষণ বেঁচে আছি, মহুয়ার গল্প খানিকটা আপনাদের শোনাই…।

আমি তখন বারো কি তেরো বছরের বালিকা। বুকে কেবল বুনি উঠতে শুরু করেছে। ছোট বোন ময়নার বয়স সাত।

মা-বাবা দুজনেই ভূঁইয়াবাড়ি কাজ করে। বছর কড়ালে কামলা। বাবা ভূঁইয়াদের ক্ষেতখোলার কাজ করে। ভূঁইয়াবাড়িতে আরো দুজন কামলা আছে। বাবা সর্দার কামলা। মা বাড়িঘরের কাজ করে। আমি মায়ের সঙ্গে টুকটাক কাজ, যেমন, হেঁসেলের ছাই তোলা, গোয়ালের গোবর সাফ করা – এইসব করি। ভূঁইয়াবাড়িতেই তিনবেলা খাবার খাই। মা-বাবা, ময়না, আমি – সকলেই। রাতে আমরা নিজেদের বাড়িতে ঘুমাই। ‘বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি/ একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি …।’ এই পরিস্থিতি দেখে ভূঁইয়াবাড়ির দাদি রাতে তাদের ঢেঁকিঘরে থাকতে বলে। ঢেঁকিঘরটাও বিশাল বড়। বিছানা পেতে চারজনে আরাম করে শোয়া যায়। কিন্তু মা-বাবা ভূঁইয়াবাড়িতে রাতে থাকে না। মা বলে – ভূঁইয়াবাড়ির ছেলেদের খাসলত খারাপ। চাচি-খালাও মানে না …।

আমি যখন ময়নার বয়সী ছিলাম তখন মায়ের কথার অর্থ বুঝিনি। কিন্তু বারো-তেরোয় পা দিতেই মায়ের কথার অর্থ বুঝতে শুরু করলাম। আমি গোয়ালঘরে, ঘরটি বারবাড়ি, ঢুকলেই বাড়ির বড় ছেলে তমিজভাই কিংবা ছোট ছেলে ইন্তাজভাই, যে যখন বাড়িতে থাকে সেই গোয়ালঘরে ঢুকে বাঁহাত দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরে ডান হাতে আমার দুই বুনি কচলাতে থাকে। আমি চিৎকার করতে চাইলে আমার গলা চেপে ধরে। আমি আর চিৎকার করতে পারি না। এরকম কিছুদিন চলতে থাকলো। আমার বুনিতে হাত পড়ায় বুনিও বড় হতে লাগলো। পরনের কামিজের ভেতর বুনি আর আঁটে না। মা কী ভেবে বড় কামিজের ব্যবস্থা করে দিলো। কিছুদিন যাওয়ার পর, তমিজভাই কি ইন্তাজভাই শুধু বুনি কচলিয়ে, কামড়ে আমাকে ছাড়তো না – আমাকে রক্তাক্ত করে ফেলতে শুরু করল …।

এভাবে, বছর না ঘুরতেই আমি টের পাই আমার তলপেট ভারী ঠেকে, ভাত খেতে পারি না, বমি আসে, খালি চুলার পোড়ামাটি খেতে ইচ্ছে করে …।

ঘটনা কী, বুঝে ফেললো মা। একরাতে আমার চুলের মুঠি ধরে মারতে-মারতে জিজ্ঞেস করলো – ‘মাগি, ক, কারলগে হুইছিলি …?’

আমি পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকি। কথা বলি না। মা কাঁদতে শুরু করে। ‘মহুয়া মা, ক ছে দেহি, কোন জাউরার পোলা তর এই সর্বনাশ করলো …।’

সর্বনাশ! আমিও বুঝি – মহুয়ার সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমি মুখ খুলি। বলি – ‘তমিজভাই, ইন্তাজভাই …।’

– জাউরার পুতেগো আমি ছাড়মু না …।

কদিন পর, এক মধ্যরাতে, সেদিন বোধকরি অমাবস্যা ছিল, চারদিকে কাদামাটির মতো থকথকে অন্ধকার, আমাদের ঘরে ডাকাত পড়লো। ডাকাতরা কী নেবে আমাদের বাড়ি থেকে। মা-বাবা, আমরা দু-বোন, এছাড়া ঘরে তো কিছুই নাই। ডাকাতরা মহুয়াকে তুলে নিয়ে গেল …।

সেই থেকে মহুয়া কান্দাপাড়ার বাসিন্দা। এই বসতিতে শিউলি, শেফালি, চম্পা, বকুল – কত যে মেয়ে! শহরের একপাশে অন্যরকমের আরেক শহর। যেন এক নারীরাজ্য …!

নারীরাজ্যে প্রথম-প্রথম আমার মন বসছিল না। খেতে পারি না। বমি আসে। রানি খালা জোর করে খাওয়ায়। বমি করে উগড়ে দিই সব। ভাত, বেগুনভর্তা, পুঁটি মাছের তরকারি, মসুরের ডাল – সব বেরিয়ে আসে। কী যে দুর্গন্ধ! এসব দেখে আবারো বমি আসে। ঘুমাতে পারি না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুয়ে থাকি। চোখের পাতা বন্ধ হয় না। এ আমি কোথায় এলাম!

মা-বাবার মুখ চোখে-চোখে ভাসে। ময়নার মুখ ভাসে। গজাবিলের শাপলা, শালুক, কচুরিপানা, কোড়া পাখি, ডাহুক, পানকৌড়ি – পুরো বিলটাই, বিলের ঢেউ, বিলের সন্তানেরা – সব চোখের সামনে উঠে আসে। মাথাব্যথায় কাতরাতে থাকি। আর কি কোনোদিন বাড়িতে যেতে পারবো? দেখতে পাবো মা-বাবা-ময়নার মুখ। যে জগতে এসে পড়েছি, দুদিন যেতে না যেতেই তো বুঝে ফেলেছি, কোথায় আমার ঠাঁই হয়েছে, গ্রামের লোকজন কি আর কান্দাপাড়ার পতিতা মেয়েকে মেনে নেবে …?

কোনো-কোনোদিন ভাবি – আত্মহত্যা করবো। রানি খালার খুপরির সঙ্গে ঝাঁকড়া একটা বকুলগাছ। আমি ছোটবেলা থেকেই গাছ বাইতে জানি। ভূঁইয়াবাড়িতে বড়-বড় দুটো গাবগাছ। গাছে উঠে কত যে গাব খেয়েছি, তার ইয়ত্তা নাই। যা হোক – মধ্যরাতে সব খুপরিঘর থেকে খদ্দের চলে যাওয়ার পর পাড়া যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন বকুলগাছে উঠে একটা ডালের সঙ্গে শাড়ির আঁচলের একপ্রান্ত, আরেকপ্রান্ত গলায় বেঁধে ঝুলে পড়লেই সব দুঃখকষ্ট শেষ। কিন্তু বকুলগাছে উঠে ডালের সঙ্গে ঝুলতে পারি না। সবার অজান্তে দু-রাতে গাছে উঠেছি, কিন্তু ঝুলতে পারিনি। যেই না গলায় শাড়ির আঁচল বেঁধে ঝুলতে যাবো তখনই আমার কানে বাজে মায়ের গলার ডাক – ‘কই গেলিরে মহুয়া, হাঁসগুলা বিলে দিয়া আয় …।’

আমার নিত্যদিনের কাজ ছিল বাড়ির হাঁসগুলোকে বিলে ছেড়ে দেওয়া। ভূঁইয়াবাড়ি যাওয়ার আগে আমি হাঁসগুলোকে বিলে দিয়ে আসতাম। ময়না হাঁটতে শেখার পর থেকেই গুটিগুটি পায়ে হেঁটে আমার সঙ্গে বিলপাড়ে যেতো। হাঁসের প্যাঁক-প্যাঁক ডাক শুনে ময়না হাঁস ধরতে যেত; কিন্তু ধরতে পারতো না। হাসতো খলবল করে। এখন হাঁসগুলোকে বিলে ছেড়ে আসে কে? ময়না কি…?

কান্দাপাড়া দিনে নিঝুমপুরি। যেন মৃত বসতি। সন্ধ্যা থেকে জেগে ওঠে পাড়া। মধ্যরাত পর্যন্ত পাড়ার মেয়েদের খলখল হাসি, মদ্যপ খদ্দেরদের চিল্লাফাল্লা – দিনে দিনে সবকিছুই আমি মেনে নিই। বেঁচে থাকার জন্য এই ক্লেদাক্ত জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি …।

কী বলছি এসব? ক্লেদাক্ত! সত্যিই কি কান্দাপাড়ার জীবন ক্লেদাক্ত? যারা এখানে রাতে আসে, হয়তো তাদেরই কেউ-কেউ দিনের বেলা কান্দাপাড়ার নাম শুনলেই ‘ওয়াক থু’ করে বমি করার ভাব করে। কিন্তু আমি মনে-মনে হিসাব কষি – জীবন কী? বেঁচে থাকাটাই তো জীবন, নাকি? আপনারা ‘হ্যাঁ’ বলুন কি ‘না’ বলুন – তাতে আমার কিছু যায়-আসে না। আমি বলবো বেঁচে থাকাটাই জীবন …।

দেখুন, এই যে আমি বেঁচে আছি, তা রসুলপুরেই হোক আর কান্দাপাড়াই হোক – বেঁচে আছি বলেই আমি জীবনের রং-তামাশা, মানুষের অন্ধিসন্ধি দেখতে পাচ্ছি। আমার ছেলেটি বেঁচে নেই, ‘জীবন’ কী, তা সে দেখলো না …।

কান্দাপাড়া আসার পাঁচ মাসের মাথায় আমি বাচ্চা প্রসব করি। ছেলে-বাচ্চা। প্রসবব্যথা ওঠার পর আমি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। জ্ঞান ফিরলে টের পাই আমার পেট হালকা। নিম্নাঙ্গ রক্তাক্ত। অবশ। রানি খালা বললো – তোর একটা ছেলে-বাচ্চা হয়েছিল। দশ মিনিটের মতো জীবিত ছিল। তারপরই মারা গেছে। আসলে ঘটনা কি, তুই নতুন তো, তাই জানিস না। পাড়ায় ছেলে-বাচ্চা বাঁচে না। মেয়ে-বাচ্চা হলে ঠিকই দেখতি বেঁচে যেত। একটা হিক্কা তুলেই মারা যেত না। তুই কিছু চিন্তা করিস না মহুয়া …।

– বাচ্চাটা কই খালা। মৃত বাচ্চাটাই একটু দেখি …।

– মড়া আর দেখতে হবে না। ওটা ফেলে দিয়েছি। তুই এখন ঘুমা একটু। শরীরের ওপর দিয়া যা ধকল গেছে …।

এটাই মহুয়াদের জীবন …।

কিন্তু আমি এখানে কেন? এটা তো দেখছি, গজাবিল …।

আমার স্মৃতির দরজা খুলতে শুরু করেছে। বিলে কালিমের ডাক শুনতে পাচ্ছি …।

কান্দাপাড়া আছি দশ বছর হয়ে গেল। গজাবিলের আশপাশের কোনো গাঁয়ের খদ্দের পাইনি কোনো দিন। সে-রাতে রানি খালা একজন খদ্দের নিয়ে আমার খুপরিঘরে ঢুকলো। লোকটিকে একনজর দেখেই আমি চিনে ফেলেছি। ইন্তাজ ভূঁইয়া। লম্পটের বাচ্চা লম্পট এখানে কেন? বিস্ময় চেপে রাখতে পারলাম না। বললাম – ইন্তাজ ভাই, তুমি এখানে কেন…?

– তোকে খুঁজতে খুঁজতে এসেছি …।

– আমার জীবনটা নষ্ট করে তোমার আঁশ মেটেনি। এখন আবার খুঁজতে-খুঁজতে এসেছ …।

– সেদিন ভুল করেছিলাম মহুয়া। বড় ভাইয়ের চাপে পড়ে সব করেছিলাম। তোকে এখান থেকে নিয়ে যাবো …।

– মা-বাবা, ময়না ওরা সবাই কেমন আছে …?

– ভালো আছে সবাই। তুই যাবি না …?

– যাবো ইন্তাজ ভাই, যাবো। আমি মায়ের কাছে যাবো। আমার হাঁসগুলো আছে …?

– আছে। এখন অনেক হাঁস। চাচি নিজে হাঁসগুলোর দ্যাখাশোনা করে …।

– গজাবিলে কি এখনো কালিম ডাকে? পানকৌড়ি …?

– সব আগের মতোই আছে। গেলেই দেখতে পাবি …।

আমি মায়ের কাছে যাবো, ইন্তাজ ভাইয়ের সঙ্গে রওয়া দিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের বাড়ি কই? মা-বাবা, ময়না – ওরা কই। ইন্তাজ ভাইকেও তো দেখছি না …।

মধ্যবিলে, যেখানে সারাবছরই কিছু পানি থাকে, কালিম ডাকছে; জোড়া কালিম …।

পাদটীকা

আমাকে দেখে নবুর আলী মণ্ডল চিৎকার করে উঠলো – ‘এ যে দেখছি, আইনুদ্দির মেয়ে। সেই যে ডাকাইতে ধইরা নিছিল। কী যেন নাম …?’

– মহুয়া। সমস্বরে বললো কয়েকজন।

– দেখতো কেউ, মেয়েটি জীবিত নাকি মারা গেছে …।

আবার মধ্যবিলে কালিম ডেকে উঠলো। এবার একটি। স্ত্রী কালিম। পোয়াতি …।