আশ্চর্য সম্পাদক : শ্রমসাধ্য সাধনা
সত্যিই ভাবতে অবাক লাগে! তিনি এলেন ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে; আর মাত্র ১০ বছরের মধ্যে তাঁর লেখা প্রকাশিত হলো। তাও আবার তিনি বিদেশি, ফরাসিভাষী। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে দেশের মতো গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকায় তাঁর ‘ডায়েরির ছেঁড়াপাতা’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে
থাকলো। বিস্ময় বইকি!
একদিন হাসতে হাসতে তিনি বলে ফেলেছিলেন – ‘আমাকে জেসুইট কর্তৃপক্ষ বলেছিলেন – ১০ বছর বাংলা ভাষা শেখার পর আসবেন।’ আর তিনি মাত্র ১০ বছরের মধ্যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য শিখে, সৃজনশীল বাংলা গদ্য সৃষ্টি করে, ‘দেশ’ পত্রিকার মতো গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষের মন জয় করে নিয়েছিলেন। আপামর বাঙালি পাঠক তাঁকে শুভেচ্ছা আর অভিনন্দন জানিয়েছেন – ‘দ্যতিয়েন’ কোনো বাঙালির ছদ্মনাম! বাঙালি ভাবতেই পারেনি – ফাদার দ্যতিয়েন নামটি কোনো বাঙালির ছদ্মনাম নয়!
‘ডায়েরির ছেঁড়াপাতা’ (১৯৫৯) প্রকাশিত হওয়ার পর, বৃহত্তর বাঙালি পাঠকের কাছে – ‘ফাদার দ্যতিয়েন’ নামটি এক জনপ্রিয়, নতুন ধরনের বাংলা গদ্যলেখক হিসেবে পরিচিতি পায়। কিন্তু গদ্যপরম্পরা একটি আশ্চর্য গদ্য গবেষণামূলক সম্পাদনা। এই রকম গদ্য সম্পাদনা এর আগে করেননি কেউ। তিনিই প্রথম ও তিনিই শেষ – কারণ এই সময়পর্বে তিনিই একক এবং অদ্বিতীয়। ৪৮৫ জন গদ্যলেখকের গদ্যনমুনা সংগ্রহ করা এক দুঃসাধ্য কাজ। তিনি তখন ছিলেন উত্তর কলকাতার ৩৪/১, তোলপাড়া লেন, কলকাতা ৪-এর ঠিকানায়। তেলিপাড়া থেকে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ গ্রন্থাগারে আসতেন – সাইকেল সাহেব ফাদার দ্যতিয়েন। কখনো বা পায়ে হেঁটে। পরিষদের লাইব্রেরিতে দুপুরের পর দুপুর সময় কাটিয়েছেন। তিনি লিখেছেন – প্রতিদিন হপ্তার পর হপ্তা, মাসের পর মাস, কি শীতে কি গ্রীষ্মে, কি বর্ষায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের গ্রন্থাগারে অপরাহ্ণ কাটাতে গিয়েছি। … গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত পুরানো পুরানো গ্রন্থগুলো একে একে আনিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছি … আর হঠাৎ সুলিখিত কোন এক পৃষ্ঠা উল্লেখযোগ্য বলে মনে করলে স্বহস্তে লিপিবদ্ধ করেছি।
হ্যাঁ, তিনি নিজেই করেছেন। নিজেই সমস্ত পুরনো বই নিজের চোখে দেখেছেন – পড়েছেন; উপযুক্ত গদ্যরচনাগুলি নিজের হাতেই কপি করেছেন। জেরক্স নয়। সম্ভবত সেই উত্তাল সাতের দশকেও জেরক্স মেশিন কলকাতায় আসেনি। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে তো নয়ই। শুধু সময় নয়, মননের সঙ্গে শ্রম মিশিয়েছেন – এক বঙ্গপ্রেমিক বিদেশি মিশনারি ফাদার দ্যতিয়েন (১৯২৪-২০১৬)।
আশ্চর্য তাঁর মনোবল, অবাক করার মতো তাঁর ধৈর্যশক্তি। সবচেয়ে বিস্ময়কর তাঁর বাংলা ভাষার প্রতি দরদ, আন্তরিক টান – যা এককথায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তিনি গদ্যপরম্পরা গ্রন্থের নিবেদনে লিখেছেন – তাঁর ‘ব্যক্তিগত প্রয়োজনবোধে’ এই বিদ্যাচর্চা করেছেন। কিন্তু এই ‘ব্যক্তিগত প্রয়োজনবোধ’ শব্দ দুটির প্রকৃত অর্থ কোথায় লুকিয়ে আছে। আসলে তিনি কলকাতা তথা বঙ্গদেশে এসে – বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে গভীরভাবে ভালোবেসে, বুঝতে চাইছেন বাংলা গদ্যের প্রাণভোমরার প্রকৃত সম্পদকে। তিনি একজন উচ্চমানের বাংলা গদ্যশিল্পী হতে চেয়ে – বুঝে নিতে চান – তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কোথায় অবস্থান করছেন? তাই তিনি লিখলেন – গদ্যপরম্পরা – তা সে উপস্থিত গ্রন্থই হোক কিংবা অন্যতর প্রকৃষ্টতর চয়নিকা – সাহিত্য-ইতিহাসের এক অপরিহার্য পরিপূরক।
ফাদার দ্যতিয়েন-সম্পাদিত শ্রমসাধ্য গদ্য গবেষণাগ্রন্থ গদ্যপরম্পরা – বাংলা গদ্যসাহিত্যের গবেষণার ইতিহাসে এক মাইলস্টোন হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
ভাষাচার্য সুনীতিকুমার
গদ্যপরম্পরা (১৯৭৭) গ্রন্থটি ফাদার দ্যতিয়েন ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে উৎসর্গ করেছেন। কিন্তু কেন এই উৎসর্গ! গদ্যপরম্পরা গ্রন্থের সঙ্গে ভাষাচার্য সুনীতিকুমারের কি কোনো সম্পর্ক আছে? গদ্যপরম্পরা গ্রন্থটি গভীরভাবে পাঠ ও পর্যালোচনা করলে এসব প্রশ্নের সহজ উত্তর মিলবে।
প্রথমত – ফাদার দ্যতিয়েন গদ্যপরম্পরা গ্রন্থে যে ৪৮৫ জন গদ্যকারের কথা বলেছেন, সেখানে ভাষাচার্য সুনীতিকুমারের নাম নেই।
দ্বিতীয়ত – ৪৮৬ নম্বর গদ্যকার হিসেবে সর্বশেষ গদ্যকারের নামও নমুনা হিসেবে ভাষাচার্যের নাম আছে।
তৃতীয়ত – এই সর্বশেষ গদ্যনমুনা পাঠ করলে বাংলা গদ্যের বিচিত্র বহুরূপী বস্তু ধরা পড়ে, যা সম্পাদক ফাদার দ্যতিয়েন দেখাতে চান।
চতুর্থত – সুনীতিকুমারের এই গদ্যনমুনা ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত, যা তাঁর মূল ভাবনার সঙ্গে মেলে।
পঞ্চমত – ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (১৮৯০-১৯৭৭) শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে। আর গদ্যপরম্পরা গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে।
তাই গদ্যপরম্পরা গবেষণাগ্রন্থের উৎসর্গপত্রে ফাদার দ্যতিয়েন লিখেছেন – ‘ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় স্মরণে’।
ফাদার দ্যতিয়েন যখন কলকাতায় আসেন, তখন ছিল ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দ। ভাষাচার্য সুনীতিকুমারের ODBL (The Origin and Development of the Bengali Language) (1926) প্রকাশিত হয়েছে অন্তত ২৩ বছর আগে। প্রসিদ্ধ ভাষাতাত্ত্বিক, বহুভাষাবিদ মনীষী সুনীতিকুমারের সান্নিধ্য ফাদার দ্যতিয়েন পেয়েছেন। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দকে মান্যতা দিয়ে, ফাদার দ্যতিয়েন গদ্যপরম্পরায় বাংলা ভাষা আর বাঙালি জাতের গোড়ার কথা (১৯২৬) থেকে গদ্যের উদাহরণ হিসেবে এক চমকপ্রদ মান্যতা দিয়েছেন। একই সঙ্গে ও.ডি.বি.এল গ্রন্থ ও গদ্যপরম্পরাকে একই সূত্রে মেলবন্ধন করতে চেয়েছেন। ভাষাচার্যের রচনার মূল কথা সূত্রাকারে সাজানো যেতে পারে, যা ফাদার দ্যতিয়েনের গদ্যপরম্পরায় প্রকাশিত হয়েছে –
১. বাংলা ভাষার রূপ ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’ নয়।
২. সব ভাষার মতোই বাংলা ভাষা বহুরূপী বস্তু।
৩. বাংলা ভাষায় দুই রূপ সাধু ও চলিত।
৪. এই দুই সর্বজনপরিচিত ছাড়া আরো নানা অঞ্চলে নানান আঞ্চলিক ভাষারূপ আছে।
৫. আঞ্চলিক ভাষা রূপগুলি – এক বাংলা তরুর নানা শাখা পল্লব।
ফাদার দ্যতিয়েন গদ্যপরম্পরা গ্রন্থে ৪৮৫ জন গদ্যকারের নমুনা দিয়ে – বাংলা গদ্যভাষার নানান রূপ দেখাতে চেয়েছেন। যেখানে নারী ও পুরুষ যেমন আছে, তেমনি ভিন্নভাষী ও ভিন্নদেশি গদ্যলেখকেরাও আছেন।
আসলে গবেষক-সম্পাদক ফাদার দ্যতিয়েন – বাংলা ভাষার উৎস ও উৎপত্তি ভালো করে, সামনে আনার জন্য ভাষাচার্যের ও.ডি.বি.এল.-কে মান্যতা দিয়েছেন – তা নয় – গদ্যপরম্পরা গবেষণাগ্রন্থটি ভাষাচার্য সুনীতিকুমারকে ‘উৎসর্গে’র নৈবেদ্য দান করে – গভীরভাবে বাংলা ভাষাকে ভালোবাসার অর্ঘ্য দিয়েছেন। বঙ্গপ্রেমিক দ্যতিয়ন চির-নমস্য।
৩০০ বছরের গদ্যচর্চা
ফাদার দ্যতিয়েনের গদ্যপরম্পরা ৪৮৬ (৪৮৫ + ১) জনের গদ্যকারের প্রথমজন হলেন আন্তোনিও রোজারিও। সম্পাদক দ্যতিয়েন আন্তোনিও রোজারিও বা দোম আন্তোনিওর কোনো সময়সীমা উল্লেখ করেননি। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের
গবেষক-অধ্যাপক তারাপদ মুখোপাধ্যায় উপেক্ষিত ইতিহাস গ্রন্থে দোম আন্তোনিওর সম্ভাব্য সময়সীমা নির্ণয় করেছেন। দোম আন্তোনিও রোজারিওর সম্ভাব্য জীবনপঞ্জি –
জন্ম – ১৬৪৩ খ্রিষ্টাব্দ
অপহরণ – ১৬৪৯ খ্রিষ্টাব্দ
প্রত্যাবর্তন ও বিবাহ – ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দ
গ্রন্থরচনা – ১৬৬৮-৭০ খ্রিষ্টাব্দ
মৃত্যু – ১৬৯৫ খ্রিষ্টাব্দ
গদ্যপরম্পরার সময়সীমা ১৬৭০-১৯৭১ পর্যন্ত প্রায় ৩০০ বছর।
আমাদের মনে রাখতে হবে, ৪৮৬ (৪৮৫ + ১) জনের গদ্যনমুনায় – ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দকে শেষ সময়সীমা ধরেছেন। গদ্যপরম্পরা প্রকাশিত হচ্ছে ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে। আসলে ‘১৯৭১’ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়সীমা সম্পাদক-লেখক ফাদার দ্যতিয়েনের কাছে নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথমত – ফাদার দ্যতিয়েনের প্রথম সৃজনশীল গদ্যগ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে ১৯৭১-এ ডায়েরির ছেঁড়াপাতা।
দ্বিতীয়ত – পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভ ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাও ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে।
বাংলা ভাষা-সাহিত্য ও বাঙালির ইতিহাসে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দ তাই অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
যদিও ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের সময়পর্বের আগে, ফাদার দ্যতিয়েন লেখক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। দেশ পত্রিকায় ‘ডায়েরির ছেঁড়াপাতা’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৩ এবং ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত। দীর্ঘ প্রায় আট বছর ধরে ধারাবাহিক সৃজনশীল গদ্য ‘ডায়েরির ছেঁড়াপাতা’ – ফাদার দ্যতিয়েনকে জনপ্রিয়তার শীর্ষবিন্দুতে নিয়ে গেছে। তাঁর প্রথম সৃজনশীল গদ্যরচনা শেষ হচ্ছে – ১৯৭১-এ।
বাংলা গদ্যের ৩০০ বছরের গদ্যনমুনায় গদ্যপরম্পরা গ্রন্থটি চিরস্মণীয় হয়ে আছে। আজ আমরা এই ৩০০ বছরে পেলাম – সপ্তদশ, অষ্টাদশ, উনবিংশ ও বিংশ শতক – অর্থাৎ চারটি শতকের মধ্যে ৩০০ বছরের বাংলা গদ্যের ইতিকথা – যা প্রামাণ্য হিসেবে আমাদের সামনে রয়ে গেল। ৪৮৬ (৪৮৫ + ১) জনের বাংলা গদ্য একসঙ্গে একমলাটে আনার এই দুঃসাহসিক অভিযানের নাবিক একজন ফরাসিভাষী বিদেশি।
১৯৭৭-২০২৩ পর্যন্ত প্রায় ৫০ বছর পরে এসেও গদ্যপরম্পরার মতো গবেষণাগ্রন্থ আর সামনে আসেনি। আজ স্বীকার করতে কোনো দ্বিধা নেই – গদ্যপরম্পরার মতো বই আগে হয়নি, এখনো পর্যন্ত হয়নি; ভবিষ্যৎ বলতে পারবো না। আগামীতে এই ধরনের গদ্যসংকলন লিখিত হলেও ফাদার দ্যতিয়েনের গদ্যপরম্পরা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে পথিকৃৎ হয়ে রইলো।
বাংলা সাহিত্যের গদ্যচর্চার ভুবনে, বিদেশি বঙ্গপ্রেমিক ফাদার দ্যতিয়েনের গদ্যপরম্পরার মতো দুঃসাধ্য সম্পাদনা বাংলা গদ্যের বৈচিত্র্যের সন্ধান দিয়েছে। বাংলা গদ্যের এই অনুসন্ধান ভারতীয় গদ্যসাহিত্যের ইতিহাসেও স্মরণযোগ্য। এই গদ্যপরিক্রমার সময়সীমা বিগত ৩০০ বছর হলেও (সপ্তদশ থেকে বিশ শতক) একুশ শতকেও সমান প্রাসঙ্গিক। বাংলা গদ্যের বিবর্তনের ইতিকথায় গদ্যপরম্পরা এক অপরিহার্য গ্রন্থ।
গদ্য প্রতিনিধি ৪৮৬
ফাদার দ্যতিয়েন তাঁর গদ্যপরম্পরা গবেষণাগ্রন্থে ৪৮৫ জনের সংখ্যা উল্লেখ করলেও আসলে সংখ্যাটা ৪৮৫ + ১ = ৪৮৬। সর্বশেষ প্রতিনিধি যাঁকে রেখেছেন তিনি ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। সুনীতিকুমারকে তিনি সংখ্যায় বাঁধেননি। যদিও তাঁর গদ্যনমুনায় দেখানো হয়েছে – ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের। তবু তাঁকে ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের গদ্যনমুনায় না রেখে সর্বশেষে রেখেছেন – গদ্যপরম্পরার প্রধান ‘ধুয়া’ হিসেবে।
ফাদার দ্যতিয়েন এখানে বিনয়ের সঙ্গে নিজেকে সম্পাদক না বলে, সংকলক বলেছেন। অথচ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পুস্তকগুলি সম্পর্কে সমালোচনা করে, এমন গুরুত্বপূর্ণ মূল্যায়ন করেছেন – যা মৌলিক মতামত, যা আগে কেউ বলেননি। যেমন – সাহিত্যের প্রচলিত ইতিহাস-পুস্তিকাগুলিতে লেখকদের আমরা যে-পরিচয় পাই (কোথায় জন্ম, কবে মৃত্যু, কার প্রভাব কার কোন গ্রন্থে পড়েছে…) সেটা কতক পরিমাণে বহিরঙ্গ ও খণ্ডিত। লেখকের রচনাতেই লেখকের প্রকৃত পরিচয়।
বিগত ৩০০ বছরের বাংলা গদ্যের উৎকৃষ্ট গদ্যসংকলনের অভাব নেই। কিন্তু যেটা অভাব, উপেক্ষিত গদ্যশিল্পীদের গদ্যের ‘হদিস কোথাও মেলে না’। সেদিক থেকে সম্পাদক ফাদার দ্যতিয়েনের উদ্দেশ্য খুব স্পষ্ট – ‘অধিকতর সামগ্রিক আর – ফলত – অপেক্ষাকৃত সীমিতও।’ সম্পাদক দ্যতিয়েন তাঁর সম্পাদকীয় কৈফিয়তে জানিয়েছেন, বাংলা সাহিত্যের প্রকৃত সংরক্ষণের সমস্যা ছিল – আছে – তা ভবিষ্যতে থাকবে – তবুও তিনি আপ্রাণ উদ্যোগ নিয়েছেন – বিগত ৩০০ বছরের ৪৮৬ জন গদ্যপ্রতিনিধির গদ্যনমুনা এক মলাটে এনেছেন, যা শুধু বিস্ময়কর নয়, দুঃসাধ্য কলম্বাসের মতো সামুদ্রিক অভিযানের মতো। তবুও বিদেশি বঙ্গপ্রেমিক থেমে থাকেননি! অনেক গদ্যলেখকের শ্রেষ্ঠ রচনা পাওয়া গেলেও শ্রেষ্ঠ পৃষ্ঠাটি হয় ছিন্ন, নয় ভঙ্গুর, নয় বল্মীকদংশনে বিনষ্ট। বাঙালির যেমন ইতিহাস নেই, সাহিত্যের ইতিহাসও সেরকম অনেকটা বিচ্ছিন্ন। সম্পাদক ফাদার দ্যতিয়েন সুধী পাঠকের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন – সেই আরো-ভালোর সন্ধানদানে তাঁরা যেন সঙ্কলয়িতার এই
যথাসাধ্য-ভালো খসড়াটিকে পরিশোধনে পরিবর্জনে পরিবর্ধনে পরিমার্জিত করেন।
সম্পাদকের এই বিনীত নিবেদনের মধ্যেও একটা প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ আছে। বাংলা গদ্যসংকলনে ‘পরিশোধনে পরিবর্জনে পরিবর্ধনে পরিমার্জিতে’র মধ্যে দুঃসাধ্য অনুশীলন লুকিয়ে আছে – যা বাঙালি সুধী পাঠকের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। তবু তিনি ভবিষ্যৎ গবেষকদের জন্য দরজা খুলে দিলেন।
৪৮৬ জন বাংলা গদ্যের প্রতিনিধির সংখ্যাচিত্রও অসাধারণ। যেমন –
মোট লেখক = ৪৮৬
লেখিকা = ৩৭
বিদেশি লেখক = ৭
অবাঙালি লেখক = ৪
গদ্যপরম্পরার (১৯৭৭) সর্বশেষে বর্ণনাক্রমিক সূচিটিও গুরুত্বপূর্ণ। লেখকদের জন্ম-মৃত্যু সাল খুব জরুরি; যদিও ৪৮৬ জনের মধ্যে ৯০ জন গদ্যলেখকের জন্ম-মৃত্যু সাল পাওয়া যায়নি। তবুও গদ্য প্রতিনিধিদের এই পরিশ্রমসাধ্য অনুশীলন, – বাংলা গদ্যসাহিত্যের ভুবনে এক মৌলিক গবেষণা পদক্ষেপ, যা আমাদের চিরকাল কাজে লাগবে।
ভাষা এক বহমান নদীর মতো – নানা পরিবর্তনে নানা পরিশোধনে – বাংলা গদ্যের পরীক্ষা-নিরীক্ষার এই দুঃসাধ্য বিদ্যাচর্চার জন্য সম্পাদক ফাদার দ্যতিয়েনকে মনে রাখতে বাধ্য। মননশীল ও পরিশ্রমসাধ্য গদ্য-গবেষণার এই সংকলন নির্মাতাকে চিরপ্রণাম।
গদ্যপরম্পরা ও ‘অমলকান্তি’
ফাদার দ্যতিয়েনের গদ্যপরম্পরা গ্রন্থের সঙ্গে একটি নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। তিনি হলেন দ্যতিয়েনের মুন্সী নামে খ্যাত। পুরো নাম অমলকান্তি ভট্টাচার্য (১৯৪৩-৮৮)। শুধু গদ্যপরম্পরা গ্রন্থে নয়, ফাদার দ্যতিয়েনের সবচেয়ে জনপ্রিয় বই ডায়েরির ছেঁড়াপাতা (১৯৭১) গ্রন্থের ভূমিকার সঙ্গে ‘অমলকান্তি’ সংলিপ্তি। ডায়েরির ছেঁড়াপাতা গ্রন্থে ঋণ স্বীকারে লিখেছেন – অমলকান্তি
– অন্তরঙ্গ সুহৃদ। প্রত্যক্ষ ঋণ অমলকান্তি ভট্টাচার্যের কাছে। তিনি বয়ঃকনিষ্ঠ, স্নেহভাজন, পরামর্শে অকৃপণ আর সমালোচনায় ভা-রি খুঁতখুঁতে।
কে ছিলেন এই ফাদার দ্যতিয়েনের সুহৃদ মুন্সী অমলকান্তি! অমলকান্তি ভট্টাচার্য ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের ছাত্র। বুদ্ধদেব বসু ফাদার দ্যতিয়েনের কাছে তাঁকে পাঠিয়েছিলেন। প্রায় ২০ বছর ধরে ফাদার দ্যতিয়েনের সঙ্গে এই ‘অমলকান্তি’ অনুবাদ ও আমাদের জীবন পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। সাহিত্যপ্রাণ ও প্রতিভাবান ‘অমলকান্তি’ ফাদার দ্যতিয়েনের মুন্সী হিসেবে পরিচিত হয়েছেন।
গদ্যপরম্পরা বইটির নামকরণ ‘অমলকান্তি’ করেছেন। শুধু নামকরণ নয়, প্রুফ দেখেছেন, সেই সঙ্গে বইটির উপযোগিতা বিচারে মতামত দিয়েছেন। গদ্যপরম্পরা গ্রন্থের ভূমিকায় ঋণ স্বীকার করে ফাদার দ্যতিয়েন লিখেছেন –
শ্রী অমলকান্তি ভট্টাচার্য সমগ্র পাণ্ডুলিপি পাঠ করেছেন; প্রুফ সংশোধন করেছেন; নির্বাচিত উদ্ধৃতিগুলির
উপযোগিতা-বিচারে মহামূল্য সহায়তা করেছেন; ‘গদ্যপরম্পরা’ নামটিও তাঁরই উদ্ভাবন।
‘অমলকান্তি’ মাত্র ৪৫ বছর বয়সে চলে গেলেন। তখন ফাদার ফিরে গেছেন তাঁর দেশে। ফাদার দ্যতিয়েন যখন ১৯৭৮-এ ফিরে গেলেন – তখন সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলেন যিনি, তিনি ফাদার-সুহৃদ অমলকান্তি। আর ১৯৮৮-তে যখন অমলকান্তি অকালে চলে গেলেন – তখন বিদেশে বসে এই বঙ্গপথিক চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি।
গদ্য অনুসন্ধান : পরিশ্রমী অনুশীলন
গদ্যপরম্পরা ৩০০ বছরের (১৬৭০-১৯৭১) – বাংলা ভাষার গদ্যসাহিত্যের আদিযুগ থেকে বিশ শতকের সাতের দশক পর্যন্ত বাংলা গদ্যচর্চার এক রম্য অভিযান। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পাদক দ্যতিয়েনের আট পৃষ্ঠার ভূমিকা। হয়তো ভূমিকা আট পৃষ্ঠার হতে পারে; কিন্তু মনোযোগ দিয়ে পাঠ করলে অনুভব করা যাবে, বাংলা গদ্যলেখকদের বৈচিত্র্য বৈভব। সেইসঙ্গে অসাধারণ লেখকদের সম্পর্ক আর সম্বন্ধ। যেমন –
১. ভ্রাতৃদ্বয়, ভ্রাতৃত্রয় –
২. ভগ্নীযুগল –
৩. পিতা ও পুত্র, পিতা ও কন্যা –
৪. পতি ও পত্নী –
৫. ঠাকুরবাড়ির ২৮ জন লেখক (চার প্রজন্মের লেখক) –
শুধু লেখকদের পারিবারিক সম্পর্ক নয়, বিষয়বৈচিত্র্য ও বিষয়শৈলী এক সীমাহীন গদ্যধারাকে সামনে এনেছে। যেমন –
১. ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ ও গোকুল নাগের সমধর্মী ‘লিপিকা’ ও ‘রূপ-রেখা’ কাব্যিক আমেজের শিল্পিত গদ্য।
২. ইসমাইল হোসেন সিরাজীর একটিমাত্র সুদীর্ঘ বাক্য – (প্রায় ২০০ শব্দ)।
৩. রাসবিহারী মণ্ডলের রচনায় দাঁড়ি ছাড়া যতিচিহ্ন বর্জন।
৪. অমিতকুমার হালদারের লেখায় কোনো যুক্তাক্ষর নেই।
৫. ১২ জন লেখকের ৩ জন করে একটি নামের লেখক আছেন।
৬. কালিপ্রসন্ন নামে ৫ জন লেখক আছেন।
৭. তিন বিখ্যাত সাহিত্যিক কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রিয়নাথ সেন ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় – সমনাম ও অভিন্নপদবি লেখক আছেন একজন করে।
জীবনী, স্মৃতিকথা, ভ্রমণকাহিনি, নাটক, সাহিত্যতত্ত্ব, পত্রিকার সম্পাদকীয় ও অনুবাদ থেকে গদ্যনমুনা গদ্যপরম্পরার সম্ভার – যা এককথায় ব্যথায় ও ব্যঙ্গরচনার বৈপরীত্যে এক অসাধারণ অনুসন্ধান-অনুশীলন বাংলা গদ্যের ভুবনে স্মরণযোগ্য সম্পাদনা। বাংলা গদ্যের চর্চায় বিদেশি সম্পাদক চিরনমস্য। তিনি যে অকৃত্রিম বঙ্গসুহৃদ বঙ্গপ্রেমিক।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.