ঘুণপোকা ও তিন নরনারী : আপস্টেজের রাত ভ’রে বৃষ্টি

অংশুমান ভৌমিক

বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাস রাত ভ’রে বৃষ্টি নিয়ে ঢাকায় নাটক হচ্ছে জেনে যারপরনাই উত্তেজিত হয়েছিলাম। শিক্ষিত বাঙালির মনে, বিশেষ করে নাগরিকদের একাংশের মধ্যে এ-উপন্যাসকে ঘিরে নানাবিধ উত্তেজনার খোরাক জমা আছে। এর নামকরণের মধ্যেই এক কুহক টান বিদ্যমান। একদা তাতে ইন্ধন দিয়েছে খোদ বিচারালয়ের দেগে দেওয়া অশ্লীলতার সিলমোহর। বিচারালয় আর ভজনালয় নিয়ে যে জাতির আতিশয্যের অবধি নেই, সে-জাতি যে পড়ে বা না-পড়ে রাত ভ’রে বৃষ্টি নিয়ে উত্তরফাল্গুনী রচনা করবে তাতে আর আশ্চর্যের কী!

১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে কলকাতার খানদানি বইওয়ালা এম সি সরকার অ্যান্ড সন্স থেকে রাত ভ’রে বৃষ্টি ছেপে বেরোতেই কলকাতার সমাজশাস্ত্রীদের একাংশ আঁতকে উঠেছিলেন। আজকের দিনে শুনলে অবাক হতে হয়, কিন্তু এ-কথা সত্যি যে অশ্লীলতায় দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিল রাত ভ’রে বৃষ্টি। জজসাহেবের এজলাসে হাজিরা দিতে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল বুদ্ধদেব বসুকে। এবং এত অল্পে চিঁড়ে ভেজেনি। লোয়ার কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেট এই বই তো ছার, বইয়ের পাণ্ডুলিপিসুদ্ধ জ্বালিয়ে দেবার হুকুম দিয়েছিলেন। দেগে দেওয়া হয়েছিল ‘অশ্লীল’ বলে, ‘সমাজের পক্ষে হানিকারক’ বলে। প্রায় ছ-বছরের বিচারের পর কলকাতার হাইকোর্টের রায়ে রাত ভ’রে বৃষ্টির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা ওঠে। ভাবলে অবাক লাগে যে, সারা বাংলাজুড়ে যখন চিনের ধাঁচে সমাজবিপ্লবের মহড়া চলছিল, ছয় দফা দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছিল পূর্ব পাকিস্তানের সরেজমিন, তখন একটা বই ‘শ্লীল’ না ‘অশ্লীল’ তার চুলচেরা বিচার হচ্ছিল কলকাতার উচ্চ ন্যায়ালয়ে।

দুই

পুরনো কাঁসুন্দি ঘাঁটতে হলো কারণ ওই রাত ভ’রে বৃষ্টি নিয়ে একটা নয় দুটো নাটক চলছে দুই বাংলায়। কল্যাণী কলামণ্ডলম নামে নিরীক্ষাধর্মী নাট্যকর্মে হাত পাকানো একটা দল বছর আড়াই আগে এই উপন্যাসের নাট্যায়ন করেছে, অনন্যা দাসের নির্দেশনায়। ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার প্রাক্তন অধিকর্তা দেবেন্দ্র রাজ অঙ্কুরের দৌলতে নামমাত্র মঞ্চ সাজিয়ে নাটকীয় ঢংয়ে গল্প পড়ার যে রেওয়াজ এখন ‘কহানি কি রঙ্গমঞ্চ’ নামে চাউর হয়েছে, কল্যাণী কলামণ্ডলম তারই অনুসরণ করেছে। আলাদা করে নাট্যরূপ না দিয়ে বুদ্ধদেবের উপন্যাসের আনুপূর্বিক বিবৃতিই এই প্রযোজনার মুখ্য বৈশিষ্ট্য। অবিশ্যি সবটুকু নয়। যেটুকু না বললে নয়নাংশু-মালতী-জয়ন্তর ত্রিকোণ প্রেমের সৌধ অসম্পূর্ণ থাকে, যেসব চরিত্র না আনলে নানান কৌণিকতায় ওই প্রেম-অপ্রেমের টানাপড়েন মালুম হয় না, সেটুকু রেখেছিলেন অনন্যা। সবচাইতে মজার ব্যাপার, যে-উপন্যাস নিয়ে পাঁচ দশক আগের কলকাতা টালমাটাল হয়েছিল, তার এই মঞ্চায়ন নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামায়নি সেই শহর। এর কিছুদিনের মধ্যেই ঢাকায় আপস্টেজ নামে একটা নতুন নাটকের দল সাইফ সুমনের নির্দেশনায় রাত ভ’রে বৃষ্টি প্রযোজনা করে। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ জুলাই তারিখে বেইলি রোডের মহিলা সমিতিতে এর উদ্বোধনী মঞ্চায়নের আগে থেকেই যে দুর্বার কৌতূহল আছড়ে পড়েছিল এই  প্রযোজনাকে ঘিরে, এখনো তার ঢেউ উঠছে। বছরখানেক আগে ওই মহিলা সমিতি চত্বর থেকে রহস্যজনকভাবে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল এই প্রযোজনার পোস্টার। অশ্লীলতার দোহাই পাড়া হয়েছিল। মর‌্যাল পোলিসিংয়ের এই সক্রিয়তা আমাদের নজর এড়ায়নি। তার পরেও পরিপূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে মঞ্চস্থ হয়েছে এ-নাটক। এই দুর্বার কৌতূহলের পেছনে বুদ্ধদেব বসুর জন্য ঢাকার স্মৃতিকাতরতার অবদান কতটা, কতটা ওই উপন্যাস ঘিরে সারস্বত আগ্রহ, আর কতটা মেধাবী বিপণনের হাতযশ, তার হিসাবনিকাশ করা এ-লেখার উদ্দেশ্য নয়। এই সমালোচক আপস্টেজের রাত ভ’রে বৃষ্টি দেখেছিলেন চট্টগ্রামের থিয়েটার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে, ‘তির্যক নাট্যমেলা ২০১৯’-এর সমাপনী সন্ধ্যায়, অর্থাৎ গত ২৯ ডিসেম্বর। ওই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমরা বুঝে নিতে চাইব আপস্টেজের এই সাড়াজাগানো প্রযোজনার খুঁটিনাটি, বিশেষ করে তার নাট্যরূপের কৌশল, তার স্থানীকরণের কায়দা ও তার অন্ধিসন্ধিতে গাঁথা লিঙ্গ-রাজনীতির কেরামতি।

স্থানীকরণের দিকটা জরুরি। কারণ বুদ্ধদেব যে-পটভূমিতে ভঙ্গুর দাম্পত্যের এই গল্প সাজিয়েছিলেন তাতে ১৯৬০-এর দশকের কলকাতা, বিশেষ করে বালিগঞ্জ, বেশ প্রবল ছিল। পুরনো কলকাতার একান্নবর্তী পরিবার ছেড়ে দক্ষিণ কলকাতার ফ্ল্যাটবাড়িতে সস্ত্রীক উঠে আসা এক শিল্পসংস্কৃতিপ্রেমী অধ্যাপকের সংসারে একটু একটু করে কোণঠাসা হয়ে পড়া মালতী মুখোপাধ্যায় হয়ে উঠেছিলেন রাত ভ’রে বৃষ্টির আলম্ববিন্দু। ওই পটভূমিকে এই আমলের ঢাকাতে সোজাসুজি তুলে আনলে হরেক কিসিমের ঠোক্কর লাগতে পারত। সেই সম্ভাবনাকে অঙ্কুরে নাশ করেছেন সাইফ সুমন। চেতনাপ্রবাহের আদত কাঠামোকে বড় একটা ধাক্কা না দিয়ে বদলে নিয়েছেন পটভূমি। ষাট বছর আগেকার কলকাতার বদলে হালফিলের ঢাকা। বুদ্ধদেবের রচনাতে যে ঈষৎ ব্রাহ্মণ্যবাদী সুর ছিল, বা বলা যেতে পারে রক্ষণশীল হিঁদুয়ানি আর তথাকথিত আধুনিক জীবনবোধের চোরাগোপ্তা টক্কর ছিল, তাকে ঘাট মাড়াননি সুমন। জবাব দিয়েছেন ঔপনিবেশিক আদবকে। সুমনের নাট্যরূপে ‘মালতী মুখোপাধ্যায়’ হয়েছেন স্রেফ ‘মণিমালা’, ‘নয়নাংশু’ হয়েছেন ‘অংশু’, ‘জয়ন্ত’ হয়েছেন ‘জয়’। একইভাবে ‘পিসিমা’ হয়েছেন ‘খালা’, ‘বেলেঘাটা’ হয়েছে ‘মিরপুর’। ‘মেয়ে হওয়া’ আর ‘মেয়েলিপনা’র যে দ্বন্দ্বসমাস ছকে দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব, সেটাকে খারিজ করেননি সুমন। কিন্তু ‘মেয়েলিপনা’র যেসব মাত্রা বেঁধেছিলেন বুদ্ধদেব, অর্থাৎ ‘শাড়ি-গয়না-হিন্দি সিনেমা’, তাকে পালটে ‘দল বেঁধে শপিংয়ে যাওয়া, টিভি সিরিয়াল দেখা, এর-ওর সাথে অযথাই গপ্পো করা’র গতে এনে ফেলেছেন। তাদের ঘরগেরস্থালি পাতিয়েছেন আজকের ধানমন্ডিতে।

প্রধান তিন চরিত্রের চারপাশে গণ্ডী কেটে দিলেও তাদের বৃত্তি বদলাতে যাননি সুমন। মণিমালা গৃহকর্মনিপুণা ঘরনীই আছেন। অংশু ইউনিভার্সিটির প্রফেসরি ছেড়ে অ্যাড এজেন্সিতে যোগ দিয়েছেন। জয়ের মধ্যে বাম রাজনীতির ছোঁয়াচ রেখে তাকে পত্রিকা সম্পাদক করেছেন সুমন। ফোরজি স্পিডের ডিজিটাল রেভলিউশনের ধাক্কায় এখন দিনকাল যা পড়েছে তাতে খবরের কাগজগুলোরই উঠে যাবার জো! এই বাজারে কম রেস্তোর এক পত্রিকা সম্পাদকের সঙ্গে বিজ্ঞাপন সংস্থার প্রভাবশালী আধিকারিকের পরিবারের মেলামেশার ব্যাপারটা একটু কেমন-কেমন দেখালেও বাল্যবন্ধুত্বের সুতো টেনে তাকে পোক্ত করতে চেয়েছেন সুমন। আখ্যানের পাশাপাশি চরিত্র প্রতিস্থাপনের এই জরুরি দিকটা মুন্সিয়ানার সঙ্গে সামাল দিয়েছেন বলে বাদবাকিটা উতরোতে বেগ পেতে হয়নি তাঁকে।

কারণ ওই ‘বাদবাকিটা’ অর্থাৎ বিবাহিতা যৌন স্বাধীনতার কূট প্রশ্নটা ঢাকার মধ্যবিত্ত ও মুখ্যত পিতৃতান্ত্রিক সমাজে এখনো বিস্ফোরকপ্রতিম। গত পাঁচ দশকের বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ যে-পর্যায়েই পৌঁছক না কেন, নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নে ধানমন্ডির মতো উচ্চমধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজ অনেক উদারতা দেখালেও, তার যৌনতার ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা পুরুষতন্ত্রের মৌল প্রবণতা। এই বজ্র আঁটুনির গেরো ফস্কে বেরোনো নারীর সহজাত প্রবৃত্তি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও অধিকার সচেতনতা তাঁকে শেখায় অসুখী দাম্পত্যের উপসর্গ চিনতে। তাঁকে স্বৈরিণী হবার ফুসমন্তর দেয়। পুরুষতন্ত্রের ঘেরাটোপে থেকে আয়ত্ত করা ন্যায়-অন্যায়, পাপ-পুণ্যের সনাতন ধারণাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবার মুরোদ দেয়, বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের সামনে আঙুল তোলার হিম্মত জোগায়। তখন ‘কী পেয়েছি তার হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজি’র নিস্পৃহতাকে পাশ কাটিয়ে, নিজের ভেতরে নিঃশব্দ বোঝাপড়ার পালা চলে স্বয়ংসিদ্ধার। সংস্কারের বাঁধ ভাঙলে কূল ভাঙার ভয়ও থাকে। সেই ভয় জয় করতে পারলে মুক্ত হয় সে। নারী স্বাধীনতার এই বয়ান রাত ভ’রে বৃষ্টির জিয়নকাঠি।

তাতে ফরাসি গতের নারীবাদী চেতনার কিয়ৎ প্রভাব থাকলেও বাংলার মাটিতে তা বেমানান নয়।

সাইফ সুমন এই সূক্ষ্ম ও সংবেদনশীল জায়গাটা চিনতে ভুলচুক করেননি বলে নাগরিক দাম্পত্যের সুখী গৃহকোণের আনাচেকানাচে জমতে থাকা ঝুলকালি মাকড়সার জাল নিয়ে গড়ে উঠেছে আপস্টেজের রাত ভ’রে বৃষ্টি। এমনিতে মনে হতে পারে, এই প্রযোজনার মুখে ‘প্রাপ্তমনস্কদের জন্য’ এই মোহর লাগানোর তেমন দরকার ছিল না। আবার মনে হয় দরকার ছিল। বোধ করি অর্থের অপকর্ষের দরুন ‘প্রাপ্তবয়স্ক’ কথাটার একটা ইতর ব্যঞ্জনা আপস্টেজের মাথায় ছিল। ইতরজনের বিতরণার্থ অন্ন যে এ-নাটকে একেবারেই নেই, সেটাও ফলাও করে বলে দেবার ছিল। বিশেষত এই প্রযোজনার যাবতীয় প্রচার উপকরণে ইউক্রেনের এক চিত্রকরের অনুসরণে সম্ভোগের যে ধূসর জগতের আবাহন করা হয়েছে, তা যে কেবলই শরীরী নয়, তার যে মানসিক মাত্রাও আছে, সেটার ওপর দাগা না বুলোলে চলছিল না। এই বুদ্ধিদীপ্তি এই নাট্যায়নের অন্যান্য অনুষঙ্গেও বর্তমান।

তিন

চট্টগ্রামের থিয়েটার ইনস্টিটিউটের ছিমছাম অডিটোরিয়ামে ঢুকেই দেখেছি প্রসেনিয়ামের পর্দা টানা নেই। খোলা। ওপেন কার্টেন স্টেজ। একেবারে রিয়্যালিস্টিক সেটিং। বসতে বসতে দেখছি মঞ্চবিন্যাস। উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের বেডরুম। ডিপ সেন্টারস্টেজে একটা বেতের বোনা রকিং চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছেন এক নারী। আনমনে গান শুনছেন। লাইট ক্লাসিক্যাল। পরনে রাতপোশাক। তার ডান দিকে একটা আলনা। তাতে রোজকার জামাকাপড় পাট করে রাখা। আলনার গা ঘেঁষে একেবারে উইংসের ধার অবধি চলে গেছে একটা কুইন সাইজ বেড। তাতে পাশাপাশি আটপৌরে ঢংয়ে শুয়ে আছেন দুজন পুরুষ। চিত হয়ে, পাশ ফিরে। ওই শোবার ঘরের এক পাশে স্টেজের ডাউন রাইটে একটা ড্রেসিং মিররের আভাস। খালি ফ্রেমটুকু আছে। তার আড়ালে একটা সিটিং টুল। ঘরের অন্য পাশে একটা ডেস্ক, একটা চেয়ার। তার কোলঘেঁষে একটা দরজার ফ্রেম। সেখান দিয়ে গলে স্টেজের ডাউন লেফটে এক চিলতে ড্রয়িংরুম। সেখানে আসবাব বলতে দুটো বেতের মোড়া আর একটা খাটো  টি-টেবল।

দেখছি। আর একটু একটু করে ঢুকে পড়ছি একান্ত ব্যক্তিগত এক দাম্পত্য পরিসরে। এক দ্বিচারিণীর আবছা চেহারা ফুটে উঠছে ইশারা-ইঙ্গিতে।

খানিক বাদে বাজনা থামল। দুই পুরুষ ধীরেসুস্থে উঠে বেরিয়ে গেলেন। তারা কেন ছিলেন, কেন চলে গেলেন, এই জিজ্ঞাসা উঁকি দিলো মনে। উত্তর পেলাম, ওই দ্বিচারিণীর মনোজগতের প্রক্ষেপণ হয়ে তারা ছিলেন। মনের রং বদলেছে। বেজে উঠেছে বেদনাবিধুর বাঁশি। তাই তারা চলে গেছেন। নারী এসেছেন ছেড়ে যাওয়া ওই খাটে। আরাম করে আড়মোড়া ভেঙেছেন। এবারে দ্রুত লয়ে বেজে উঠেছে সরোদ। মল্লার সুরে। ময়ূরের মতো পেখম তুলে। বুকের ভেতর যে বৃষ্টি ঝরছিল রাতভর, ঘুম ভাঙতে তা বেরিয়ে এসেছে বাদল রাগিণীর বেশে। নারী নরম করে আলতো হাতে আবেশভরে নিজেকে ছুঁতে ছুঁতে বলে উঠছেন, ‘হয়ে গেছে – ওটা হয়ে গেছে – এখন আর কিচ্ছু বলার নেই।’ বলতে বলতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে তার মুখ। সেই উদ্ভাসে উত্তাপ আছে, অনুতাপ নেই। শিহরণ আছে, শ্বাসাঘাত নেই। সেই উত্তাপ, সেই শিহরণ সংক্রমিত হচ্ছে দর্শকাসনে। তাদের থতমত খাইয়ে হুট করে শুরু হয়ে যাচ্ছে রাত ভ’রে বৃষ্টি। 

তৃপ্ত এই নারীই মণিমালা (কাজী রোকসানা রুমা)।

মূলত তাঁর তৃপ্তি-অতৃপ্তির সাতকাহন করে চলে রাত ভ’রে বৃষ্টি। তাঁর চোখ দিয়ে, তাঁর মন দিয়ে ঘরেবাইরের একটা ছবি আঁকে। এই ছবিতে জয়ের (রঞ্জন দে সাথী) ভূমিকা নিছক অতিথিশিল্পীর মতো। দমকা হাওয়ার মতো। মণিমালার জীবনে ঘনিয়ে ওঠা শূন্যতা ভরাট করার জন্য যেটুকু হাজিরা না দিলেই নয়, বিবাহ ও যৌনতার মাঝখানকার অভাববোধ ঘনিয়ে তোলার জন্য যেটুকু ঠেকা না দিলেই নয়, সেটুকুই। বরং অংশু (প্রশান্ত হালদার) আছেন এ নাটকের বারো আনা জুড়ে। কতক নিজের মুদ্রাদোষে, কতক পরিস্থিতির চাপে পড়ে, কতক খেয়াল না করে, কতক হেলাফেলা করে, কীভাবে স্ত্রী মণিমালার থেকে সব দিক থেকে আলাদা হয়ে পড়লেন অংশু, এ-নাটক তারই খোঁজ করে। বুদ্ধদেবের লেখায় মণিমালার প্রতি খানিক পক্ষপাত ছিল। সুমনের সম্পাদনাগুণে ভারসাম্য পায় আখ্যান। অংশুর জবানবন্দি হয়ে ওঠে সমান জোরদার। সংলাপ আর স্বগতোক্তি চলে ডালে ডালে পাতায় পাতায়। যে-বর্ণনাত্মক নাট্যরীতির বেদিতে তনুমনপ্রাণ সঁপে দিয়েছে ঢাকা-জাহাঙ্গীরনগরের মঞ্চনাটকের এক প্রভাবশালী মহল, তারও কিছু সুতো ছড়ানো আছে বুদ্ধদেবের গদ্যরীতিতে। মওকা বুঝে তা সুযোগে সুদে-আসলে উশুল করেন নির্দেশক। হামেশাই মিলেমিশে যায় স্বপ্ন আর বাস্তব। এই গভীর চলা, এই মণিকাঞ্চনযোগের উপযোগী এক মঞ্চভাষ রচনা করা ছিল এই প্রযোজনার বড় বাজি। সাকিল সিদ্ধার্থের নকশা করা মঞ্চস্থাপত্যের কোনো পরিবর্তন না ঘটিয়ে, কেবল মঞ্চজুড়ে কুশীলবদের মসৃণ যাত্রাপথ ছকে দিয়ে সদাচঞ্চল মনযমুনার অঙ্গে অঙ্গে ভাবতরঙ্গের খেলার অনুবাদ করে চলেন রুমা ও প্রশান্ত। তাঁদের নিটোল বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে মণিমালা-অংশুর দাম্পত্যের চ্যুতিবিন্দু ফুটে ওঠে নিশুতি রাতের আকাশের বুকে জেগে থাকা তারাদের মতো হয়ে। ওই ড্রেসিং মিরর হয়ে ওঠে মনের জানালা। তাতে যে আলো এসে পড়ে তার মধ্যে দিয়ে রংবদলের আভাস মেলে। আলনায় রাখা নাইটি, ড্রেসিং গাউন হয়ে ওঠে মণিমালার ওই রংবদলের দোসর। অম্লান বিশ্বাসের আলোক পরিকল্পনায় আবছায়া প্রাধান্য পায়। আবার হিসাব কষে ফেলা টপলাইটে ঝলমলিয়ে ওঠে রুমার নাসাগ্র, চুঁইয়ে পড়া রক্তিম আভায় ভরে যায় তাঁর লাজুক কপোল। 

এই কাব্যময়তাকে সুরের বিমূর্ত ভাষায় অনুবাদ করে চলেন অমিত কুমার। বস্তুত রাত ভ’রে বৃষ্টির অদৃশ্য চতুর্থ কুশীলব এর আবহ সংগীত। হিন্দুস্তানি রাগসংগীতের আলাপ ও বিস্তারের সঙ্গে যে মানবিক অনুভূতির গভীর সম্বন্ধ আছে এ আমাদের জানা। যন্ত্রসংগীতের বিহ্বল মূর্ছনায় এই রসায়ন জমে ভালো। মাঝেমধ্যে মঞ্চনাটকে তার প্রয়োগ হলেও একেকটা বিমূর্ত অনুভবের স্তর ছুঁয়ে যাবার জন্য, সুরেলা আলপনায় তাকে রাঙিয়ে দেবার জন্য যে দরদিয়া মন লাগে সেটা অমিতের আছে। সব সময় যে রাগদারির শরণাপন্ন হয়েছেন এমন নয়, দুয়েক জায়গায় পশ্চিমি ধাঁচের অর্কেস্ট্রেশনের মদদ নিয়েছেন, একবার একটু আনাড়ির মতো ভিভাল্ডির ‘ফোর সিজনসে’র বাজিয়েছেন, আবার ঠিক তার আগেই পাশ্চাত্য সুইফোঁড়ে রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেছেন অমিত। ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে’র মতো বহুব্যবহৃত গানের কোরাস ছুটে গেছে মনোজাগরণের অভ্রান্ত নিশানায়।

তা বলে কি আপস্টেজের রাত ভ’রে বৃষ্টি  সর্বাঙ্গসুন্দর? না। সম্পূর্ণও না। ৭৫ মিনিটের এই নাট্যায়নে মূল রচনার অসংখ্য পরত আনা যায়নি। নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির সাথে লতায়-পাতায় জড়িয়ে বৃহত্তর সমাজব্যবস্থা তো উধাও হয়েছে প্রায়। অভিনয়ের কথায় যদি ফিরি তবে দেখব আধুনিক জীবনের উপরিকাঠামোর ঠিক নিচে যেখানে বাসা বেঁধেছে অস্তিবাদী সংকট, যার মূল ধরে নাড়া দিতে চেয়েও কূলকিনারা পাচ্ছে না বুদ্ধিজীবী সমাজ, নিজেও ডুবছে, ডোবাচ্ছে আশপাশের সবাইকে, সেই বিপন্নতার ঘোর রুমা-প্রশান্তের গলায় বেজে ওঠেনি সবসময়। অচরিতার্থতার যে বোধ উপস্থিত আমাদের অস্তিত্বের গহিনে দোলা দেবে, আমাদের আত্মরক্ষার বর্মকে শিথিল করে দেবে, বাইরের ‘আমি’ আর ভেতরের ‘আমি’র দ্বন্দ্ব ঘুচিয়ে টালমাটাল করে দেবে, রুমা-প্রশান্তর উচ্চারণে মাঝেসাঝে সেই বোধ অধরা থাকায় এ-নাটকের মর্মে প্রবেশ করতে অসুবিধে হয়েছে। আলগা হয়ে গেছে রাত ভ’রে বৃষ্টির আঁটোসাটো যুক্তিপরম্পরা। জয়ের ভূমিকায় রঞ্জনকে এত ম্রিয়মাণ লেগেছে যে মণিমালার চিত্তচাঞ্চল্য কতক বায়বীয় হয়ে পড়েছে। অন্তর্গত উচ্চারণের এইসব ঘাটতি খানিক পুষিয়ে দিয়েছে প্রসেনিয়াম জুড়ে কুশীলবদের স্বচ্ছন্দ বিহার। আবার তাকে উদোম করেছে থিয়েটার ইনস্টিটিউটের চমকপ্রদ ধ্বনিব্যবস্থা।

এ-প্রযোজনার বিস্ময় মণিমালার চরিত্রাভিনেত্রী কাজী রোকসানা রুমা। পরিচ্ছদ পরিকল্পক রুনা কাঞ্চন যে কেন তাঁকে হালকা রঙের খাটো রাতপোশাকের নিচে কালো স্ন্যাকস পরিয়েছিলেন কে জানে? মাখনের রং বা নিদেনপক্ষে মেটে রং বুঝি মিলছিল না! কালার প্যালেটের ওই অনভিপ্রেত ঠোকাঠুকি বাদ দিলে মণিমালার চরিত্রায়ণ মখমলের মতো মসৃণ। সাইফ সুমন মণিমালাকে যৌনপুত্তলী করে গড়েননি। রুমার বচনে এক সহজাত বলিষ্ঠতা আছে, যা ওই চরিত্রায়ণের পক্ষে অন্তরায় হতে পারত। এক্ষেত্রে দেখা গেল চাইলে নরম নদীও হতে পারেন তিনি। রাত ভ’রে বৃষ্টির আখ্যান যেহেতু এক পা এগিয়ে দু-পা পিছোয়, চক্রাকার আবর্তে চলে ফেরে, সেহেতু লাগাতার বলিষ্ঠতা আর ভঙ্গুরতার মিশেলে মণিমালাকে গড়া যেত না। ধারাবাহিকতার দরকার ছিল। ব্যক্তিত্বের একটা ঋজু ধরনকে কায়েম রেখে তার আগুপিছু কোমলে কড়িতে নানান কারুকাজ করে যাওয়াই ছিল চরিত্রের দাবি। জৈবিক তাড়নার একটা মেধাবী প্রেক্ষাপট রচনাও ছিল সমান দাবিদার। যথেষ্ট নৈপুণ্যের সঙ্গে এসব জটিল দাবি মিটিয়েছেন রুমা।

বটতলার এই দাপুটে অভিনেত্রীকে নতুন করে পাওয়া এই প্রযোজনার বড় বিজ্ঞাপন।

রাত ভ’রে বৃষ্টির মধ্যে কিছু চোরাবালির চর আছে। পড়তে পড়তে বা দেখতে দেখতে তলিয়ে যাবার ভয়ে আগেভাগে নিজেকে আড়াল করে একটা উপমান খাড়া করার প্রবণতা যে-কোনো বিচক্ষণের মধ্যে উথলে ওঠা স্বাভাবিক। তাদেরই একজনের দেখা মিলল ২৯ ডিসেম্বর রাত ভ’রে বৃষ্টির অষ্টম মঞ্চায়নের শেষে। উঠে যাবার মুখে দ্বিতীয় সারিতে বসে থাকা ক্ষয়াটে চেহারার এক মাঝবয়সী তার তরুণতর সহচরকে বললেন, ‘নাটকটা বুঝলি?’ তরুণকে ভাবলেশহীন দেখে ক্ষয়াটে চেহারা খোলাসা করলেন, ‘জয়টা হচ্ছে কবি নজরুল! বুদ্ধদেব বসু, প্রতিভা বসু আর কবি নজরুল!’ শুনে মনে হলো আপস্টেজ পেরেছে। রসিক দর্শকের মনে এমন বিচিত্র ব্যঞ্জনার সঞ্চার করা যদি মহৎ শিল্পের উদ্দেশ্য হয়, তবে সাইফ সুমন-নির্দেশিত রাত ভ’রে বৃষ্টির লক্ষ্যমাত্রার খুব কাছে পৌঁছে গেছে।