চন্দ্র-বন্দনা

আয় আয় চাঁদমামা টিপ দিয়ে যা

চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা।

                  – লৌকিক ছড়া

বাংলা কাব্যসাহিত্যে চাঁদ-ফুল-পাখি-নদী – এই চারটি প্রকৃতিসঞ্জাত বিষয় উপমা হিসেবে প্রাচীন। কবির চোখে এই বিষয়গুলো পরম সৌন্দর্যের প্রতীক। তবে এর মধ্যে চাঁদই সম্ভবত শ্রেষ্ঠ ও সুন্দরতম।  কাব্যোপমা হিসেবে ফুল চাঁদের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী – যেন ‘কেহ কারে নাহি জিনে, সমানে সমান’। তবে বিতর্ক এড়িয়ে শুধু এটুকু বলা যায়, সুদূরের অধরা চাঁদ শুভ্রসুন্দর আর ফুল নিকটের – রঙিনাযুত বর্ণিল ও দৃষ্টিনন্দন! ফুল-পাখি-নদী স্পর্শযোগ্য এবং নাগালের মধ্যে বলে তাতে বিস্ময়-বিহ্বলতা চন্দ্রদর্শনের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম। ‘ধরায় যখন দেয় না ধরা’ তখন চাঁদ সুদূরের বিস্ময়-জাগানিয়া। এর সৌন্দর্য ধরাছোঁয়ার বাইরে কেবল দৃষ্টিগ্রাহ্য বলে আমাদের সবিস্ময়ে আকর্ষণ করে বেশি। তাই কবিতার উপমা, প্রতীক এবং উৎপ্রেক্ষায় চাঁদ কাব্যালংকার হিসেবে সর্বাধিক ব্যবহৃত। চাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক জ্যোৎস্নার এবং চন্দ্রকলার সঙ্গে সম্পর্ক অমাবস্যা-পূর্ণিমার। পৃথিবীর এই সুন্দর উপগ্রহটির সঙ্গে সম্পর্ক সামুদ্রিক জোয়ারভাটার। কিন্তু এই চাঁদ কবে থেকে মায়ের ভাই এবং আমাদের মামা হলো তা আমরা কেউ জানি না। এ-লেখার শিরোধার্য যে প্রাচীন ও লৌকিক ছড়াটি, তার স্রষ্টা কে, তাও আমাদের অজানা। কিন্তু এমন কোনো বাঙালি শিশু নেই, যে-মায়ের মুখে এই ঘুমপাড়ানি ছড়াটি শোনেনি। তবে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের কৌতূহলী মনে প্রশ্ন জাগে, চাঁদ আমাদের মামা হলো কেন? কেন পিতৃপক্ষের সম্পর্কে কাকা বা জেঠা হলো না? এই প্রশ্নের উত্তর সম্ভবত নিহিত আছে প্রাচীন মানবসমাজের ইতিহাসে। মানবেতিহাসের ঊষালগ্নে মাতৃতান্ত্রিক সমাজে মায়ের পরিচয় ও প্রাধান্যই ছিল মুখ্য। তাই চাঁদ চাচা না-হয়ে মামা হয়েছে। তবে ‘চাঁদমামা’ শব্দযৌগটি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর বাঁধন-হারা উপন্যাসের একটি বাক্যে সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থে প্রয়োগ করেছেন এভাবে : ‘গত পরশু এক শুভ লগ্নে আমি আমার কোম্পানীর এক ক্যাপ্টেন সাহেবকে এক ঘুষিতে ‘চাঁদমামা’ দেখিয়ে এখন বন্দীশালায় বাস করছি।’

তাছাড়াও আমরা শিশুকালে পড়েছি, ‘চাঁদ উঠেছে, ফুল ফুটেছে,/ কদমতলায় কে?/ হাতি নাচছে, ঘোড়া নাচছে,/ খুকুমনির বে।’ আর যতীন্দ্রমোহন বাগচীর পাঠকনন্দিত শোককবিতা ‘কাজলা দিদি’র কথা কার না মনে আছে। ‘বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই/ মাগো, আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই?’ সেই ট্র্যাডিশন এখনো সমানে চলেছে। শুধু তা-ই নয়, এই মুক্তবাজার অর্থনীতি ও প্রতারক বাণিজ্যের যুগে বিজ্ঞাপনের ভাষায়ও চলে এসেছে চাঁদের উপমা : ‘তোমার চেহারাই যখন চাঁদের মতো তখন আলোর আর দরকার কী?’

এ-লেখার শিরে উল্লিখিত ‘চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা’ – এই বাক্যবন্ধের আলংকারিক সৌন্দর্যও প্রণিধানযোগ্য। শিশুটিকে চাঁদের অভিন্ন সত্তা হিসেবে কল্পনা করা প্রাচীন ভারতীয় অলংকারশাস্ত্রের উৎপ্রেক্ষারই নবরূপ। সমাসের উপমেয় ও উপমানপদ এখানে মিলেমিশে একাকার। কিংবা নজরুলের গানে যখন পাই : ‘চাঁদ হেরিছে চাঁদমুখ তার সরসীর আরশিতে’ – চাঁদের মধ্যে যেন নারীত্ব আরোপিত – যাকে অলংকারশাস্ত্রের ভাষায় বলে নরত্বারোপ। কাব্যের এসব শাস্ত্রকথা বাঁয়ে রেখে শুরুতে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের যথাশব্দ এবং অশোক মুখোপাধ্যায়ের সংসদ সমার্থ শব্দকোষ থেকে জেনে নেওয়া যাক চাঁদের সমার্থক শব্দগুলো :

চাঁদ, চন্দ্র, ইন্দু, বিধু, শশী, চন্দ্রমা, চন্দ্রিমা, চন্দ্রক, শশাঙ্ক, এণকতিলক, সুধাংশু, মৃগাঙ্ক, সুধাকর, হিমাংশু, শীতাংশু, সিতাংশু, তুহিনাংশু, নিশাকর, নিশানাথ, নিশাপতি, নিশিকান্ত, নিশামনি, নিশারত্ন, শশধর, শশভৃৎ, শশলক্ষণ, শশলাঞ্ছন, শশবিন্দু, রাত্রিকর, রাকাপতি, নিশিপতি, নক্ষত্রেশ, নক্ষত্রপতি, নক্ষত্রাধিপতি, ওষধিনাথ, ওষধিপতি, রজনীকর, রজনীশ, রজনীসখা, রজনীরাজ, রজনীকান্ত, পক্ষজ, পক্ষধর, পক্ষচর, রজনীপতি, কৌমুদীপতি, কুমুদপতি, কুমুদবান্ধব, কুমুদনাথ, তারানাথ, তারাধিপ, তারাপতি, তারাধিপতি, তারাপীড়, উড়ুপ, সোম, অম্ভোজ, অর্ণবোদ্ভব, যামিনীনাথ, যামিনীপতি, যামিনীভূষণ, যামিনীকান্ত, যামিনীপ্রকাশ, হিমকর, হিমধামা, হিমকিরণ, সিতরশ্মি, সিতরুচি, সিতকর, শ্বেতধামা, শীতকিরণ, শীতময়ুখ, শীতরশ্মি, রাকেশ, ঋক্ষেশ, হরিণাঙ্ক, ছায়াঙ্ক, কলাধর, কলানাথ, কলানিধি, কলাভৃৎ, রাত্রিমনি, সুধাময়, সুধাধার, সুধানিধি, রেবতীরমণ, সুধাধামা, সুধাবর্ষী, দ্বিজপতি, দ্বিজরাজ, দ্বিজেন্দ্র, ক্ষীরোদনন্দন, ক্ষীরাব্ধিজ, কান্তিভৃৎ।

এতে পাওয়া গেল তিরানব্বইটি শব্দ! অন্যান্য অভিধান ঘাঁটলে নিশ্চয়ই আরো মিলবে – সবমিলিয়ে শতাধিক তো হবেই। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে সুপ্রচল হলেও চন্দ্রের এই সমার্থক শব্দগুলোর সিংহভাগই একালের বাংলা ভাষায় অপ্রচলিত। বিদ্যাসাগর, মধুসূদন ও বঙ্কিমচন্দ্রে এসবের আংশিক নিদর্শন পাওয়া গেলেও একালের সাহিত্যে নৈব নৈবচ! সাধারণ শিক্ষিত বাঙালি তো বটেই, পণ্ডিত-লেখক যাঁরা, তাঁদেরও এসব জানা বলে বিশ্বাস করা শক্ত! তবে এ-কথা সত্য যে, আমাদের ভাষার সমৃদ্ধির স্মারক এই প্রতিশব্দ বা সমার্থক শব্দগুচ্ছ। সত্যিকার অর্থেই আমাদের মাতৃভাষা যে শব্দসম্পদে ধনবতী ও বিচিত্র ভাবব্যঞ্জনা প্রকাশে স্বতঃস্ফূর্ত – মাইকেলের ভাষায়, ‘মাতৃভাষা রূপখনি পূর্ণ মনিজালে’ – তা সপ্রমাণ হয়। জেনে আমরা বিস্ময়বিমূঢ় হই, একটি শব্দের সমার্থক শব্দই প্রায় শতাধিক!

দুই

মহাকাশ-বিজ্ঞানমতে, চাঁদ পৃথিবী নামক গ্রহের একমাত্র উপগ্রহ। চাঁদের নিজের কোনো আলো নেই। সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে চাঁদ আলোকিত হয়। তাতেই রাতের বেলা চাঁদ পৃথিবীকে জ্যোৎস্নান্বিত করে। এসব সবারই জানা কথা। তবে ঋণ করে চাঁদ-সম্পর্কিত বিজ্ঞানের সাধারণ কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক :

‘ব্যাস ৩৪৫৬ কিলোমিটার (২১৬০ মাইল)। একটি উপবৃত্তাকার পথে চাঁদ পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরছে। … পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব কখনো বাড়ে, কখনো কমে। সর্বাধিক দূরত্ব ৪,০৩,২০০ কিলোমিটার (২,৫২,০০০ মাইল)। আর সর্বনিম্ন দূরত্ব ৩,৬১,৬০০ কিলোমিটার (২,২৫,০০০ মাইল)। গড়ে পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব ধরা যায় প্রায় চার লক্ষ কিলোমিটার বা আড়াই লক্ষ মাইল। পৃথিবীর চারদিকে একবার ঘুরে আসতে চাঁদের সময় লাগে ২৭.৩৩ দিন। …

‘চাঁদের যে-দিকটি আমরা দেখতে পাই সে-দিকটি অতিমাত্রায় এবড়ো-খেবড়ো, সর্বত্র বিশাল পর্বতশ্রেণি ও উঁচু দেয়াল-ঘেরা গহ্বর। চাঁদের সবচেয়ে উঁচু পর্বতের চূড়া ভূমি থেকে ৭৯০০ মিটার (২৬০৯০ ফুট) উঁচু। চাঁদের উপরিতলে গহ্বরের সংখ্যা হাজার হাজার। কোনো কোনো গহ্বরের ব্যাস ২৬০ কিলোমিটারের বেশি।

‘চাঁদে কোনো বায়ুমণ্ডল নেই। … চাঁদের যেদিকে দিন সেদিকে তাপমাত্রা ১৯০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে, আর যেদিকে রাত সেদিকে তাপমাত্রা নেমে আসে হিমাংকের অনেক নিচে, (-) ১৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। … ১৯৬৯ সালের ২১ জুলাই (আমেরিকার তারিখ ২০ জুলাই) পৃথিবীর মানুষ প্রথম চাঁদের বুকে পদার্পণ করে। ওইদিন মার্কিন নভোযান অ্যাপোলো-১১-এর নভোচারী নীল আর্মস্ট্রং ও অ্যাডউইন অ্যালড্রিন চাঁদের মাটিতে নামেন। তৃতীয় নভোচারী মাইকেল কলিন্স তখন অ্যাপোলো-১১ নভোযানে চাঁদের কক্ষপথে ঘুরছিলেন।’ (সৌরজগৎ, সুব্রত বড়ুয়া, বাংলা একাডেমি,

পৃ ৫৮-৫৯)।

তিন

সংস্কৃত ব্যাকরণমতে চন্দ্র পুরুষবাচক বিশেষ্য পদ। চন্দ্রের যে সমার্থক শব্দগুচ্ছ ইতঃপূর্বে উল্লিখিত হয়েছে তার সিংহভাগই তৎসম এবং পৌরাণিক শব্দ। চন্দ্র বা চাঁদ দেবতার নাম। বায়ু পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ, স্কন্দ পুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, অগ্নি পুরাণ, মৎস্য পুরাণ, শিব পুরাণ, বরাহ পুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ এবং রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত, হরিবংশ, ঋগ্বেদ, অথর্ববেদ ইত্যাদি মহাকাব্য ও পৌরাণিক পুস্তকাদিতে চন্দ্রদেবতার বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। অভিধানকার নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর পুরাণকোষ দ্বিতীয় খণ্ডে ৮৫৩ থেকে ৮৬৫ পৃষ্ঠায় এর অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন। উল্লিখিত পৌরাণিক গ্রন্থাবলিতে চন্দ্রের সৃষ্টি ও স্থিতি নিয়ে অসংখ্য কাহিনি, ঘটনা ও বিবরণ আছে। সূত্র ও টীকাভাষ্যসহ নৃসিংহপ্রসাদ তা উল্লেখ করেছেন। ‘চন্দ্র’ শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে তিনি জানিয়েছেন : ‘পুরাণে বলা হয়েছে ‘চন্দ্’ ধাতু, যার অর্থ আহ্লাদন, শুক্লত্ব, অমৃতত্ব ইত্যাদি, তা থেকেই চন্দ্র শব্দের উৎপত্তি।’

অর্থান্তরের ভিত্তিতে নৃসিংহপ্রসাদের পুরাণকোষে চন্দ্র শব্দের আটটি ভুক্তি আছে। এগুলো নিম্নরূপ :

* চন্দ্র (১) = চাঁদ বা সনাতন ধর্মমতে চন্দ্রদেবতা। মহাভারত-পুরাণমতে তিনি অষ্টবসুর মধ্যে একজন। (ঋগ্বেদ)।

* চন্দ্র (২) = দনুর পুত্র, জনৈক দানব। (বায়ু পুরাণ)।

* চন্দ্র (৩) = একজন কিন্নর। মহানীল পর্বতে কিন্নরদের একটি নগরী আছে। তা চন্দ্রের আবাসস্থল। (বরাহ পুরাণ)।

* চন্দ্র (৪) = ইক্ষ্বাকু বংশের রাজা বিশ^গন্ধির পুত্র চন্দ্র। এই চন্দ্রের পুত্রের নাম যুবনাশ্ব। (ভাগবত পুরাণ)।

* চন্দ্র (৫) = হিরণ্যকশিপুর বংশধারায় বিরোচনের পুত্র বলি। বলির পুত্রদের মধ্যে চন্দ্র একজন। (মৎস্য পুরাণ)।

* চন্দ্র (৬) = কৃষ্ণ ও সত্যভামার এক পুত্রের নাম চন্দ্র। (ভাগবত পুরাণ)।

* চন্দ্র (৭) = বৈবস্বত মুনির পুত্র এবং কেবলের পিতার নাম চন্দ্র। (বিষ্ণু পুরাণ)।

* চন্দ্র (৮) = প্লক্ষদ্বীপের উত্তরাংশে একটি পর্বতের নাম চন্দ্র। সেটি বিভিন্ন জীবনদায়ী ঔষধিতে পরিপূর্ণ। (ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ)।

চন্দ্রদেবকে নিয়ে বিভিন্ন ভারতীয় পুরাণ ও মহাকাব্যে অসংখ্য কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। সেগুলো থেকে সুধীরচন্দ্র সরকার-সংকলিত পৌরাণিক অভিধান অবলম্বনে প্রধান তিনটি কাহিনি সংক্ষেপে বর্ণনা করা যায় :

১) কালিকা পুরাণমতে, চন্দ্র ব্রহ্মার মানসপুত্র অত্রি মুনির পুত্র। জন্মের পরই চন্দ্র ত্রিচক্র রথে চড়ে পৃথিবী পরিক্রমণ ও আলোকদান করতে শুরু করেন। দক্ষরাজের সাতাশজন কন্যাকে চন্দ্র বিয়ে করেন। তবে এদের মধ্যে রোহিণী চন্দ্রের সবচেয়ে প্রিয় হওয়ায় অন্য স্ত্রীরা পিতা দক্ষের কাছে স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। জামাতার একপেশে আচরণ পরিবর্তনে অসমর্থ হয়ে দক্ষ অভিশাপ দেন যে, চন্দ্র নিঃসন্তান ও যক্ষারোগগ্রস্ত হবে। তাতে তার স্ত্রীরা ভীত হয়ে পিতাকে অভিশাপ ফিরিয়ে নিতে অনুরোধ করেন। কন্যাদের প্রার্থনায় দক্ষ অভিশাপ পরিবর্তন করে বলেন যে, যক্ষারোগে চন্দ্র মাসের একপক্ষে ক্ষয়প্রাপ্ত ও অন্যপক্ষে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে। সেই থেকে চন্দ্রের দুই পক্ষ – কৃষ্ণপক্ষ এবং শুক্লপক্ষ – অমাবস্যার দিক ও পূর্ণিমার দিক।

২) সমুদ্রমন্থনের সময় চন্দ্রের জন্ম হয় এবং তিনি দেবতাদের মধ্যে অন্যতম বলে গণ্য হন। দেবতাদের অমৃতপানের সময় রাহু নামক এক অসুর গোপনে অমৃতপানের চেষ্টা করে। চন্দ্র তা দেখতে পেয়ে বিষ্ণুকে বলে দেন। অমৃত গলাধঃকরণের আগেই বিষ্ণু তার চক্র দিয়ে রাহুর মাথা ছেদন করেন। সেই থেকে চন্দ্রের সঙ্গে রাহুর শত্রুতা। সুযোগ পেলেই ছিন্নমস্তক রাহু চন্দ্রকে গ্রাস করে কিন্তু ছিন্ন কণ্ঠ দিয়ে চন্দ্র আবার বেরিয়ে আসে। এটাই চন্দ্রগ্রহণের পৌরাণিক ব্যাখ্যা।

৩) একদা রাজসূয় যজ্ঞ করে চন্দ্র অতি অহংকারী ও কামাসক্ত হয়ে ওঠেন। তিনি দেবগুরু বৃহস্পতির স্ত্রী তারাকে হরণ করে দেবতাদের বিরাগভাজন হন। এর ফলে দেবলোকে চরম অশান্তির সৃষ্টি হয়। বহু দৈত্যদানব ও
দেব-শত্রুরা চন্দ্রের পক্ষে যোগ দেয়। ইন্দ্র, শিব, শুক্রাচার্য ও অন্যান্য দেবতা বৃহস্পতির পক্ষ নেন। ফলে দু-পক্ষের ভীষণ যুদ্ধ হয়। অবশেষে ব্রহ্মা স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয়ে সকলকে নিবৃত্ত করেন এবং তারাকে চন্দ্রের কাছ থেকে এনে বৃহস্পতির হাতে ফিরিয়ে দেন। তারা তখন গর্ভবতী ছিল ফলে এক পুত্রের জন্ম হয়। দেবগুরু  বৃহস্পতি এই অপরাধে চন্দ্রকে অভিশাপ দেন। এই শাপে চন্দ্র যক্ষারোগে আক্রান্ত হয়ে পিতা অত্রির শরণাপন্ন হয়। অত্রির অনুগ্রহে চন্দ্র শাপমুক্ত হয়ে আবার দীপ্তিমান হয়।

চন্দ্র সম্পর্কে এই তিনটি পৌরাণিক কাহিনি নিঃসন্দেহে অলৌকিক। তাতে আধুনিক বিজ্ঞানের সত্যতা নেই। কিন্তু প্রাচীনকালের মুনিঋষিরা, বিজ্ঞানসম্মত না-হলেও, চাঁদের শুক্লপক্ষ-কৃষ্ণপক্ষ, অমাবস্যা-পূর্ণিমা ও গ্রহণের কার্যকারণের অলৌকিক ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছেন। তাতে কল্পনা ও গল্পবুনন থাকলেও তাঁরা সেসব প্রাকৃতিক ঘটনার ব্যাখ্যা নিজেদের মতো করে দিতে চেয়েছেন। আড়াই-তিন হাজার বছর আগেও যে ক্ষয়রোগ যক্ষ্মার ভয়াবহতা সম্পর্কে প্রাচীন মানুষদের অভিজ্ঞতা ছিল, তাও সন্দেহাতীত।

চার

পৌরাণিক ও সংস্কৃত সাহিত্যে ‘চন্দ্র’ শব্দটি বহুবিধ আলংকরিক সৌন্দর্যে ব্যবহৃত হয়েছে। সেদিকে বিস্তারিত আলোচনায় না-গিয়ে চাণক্যের সুপ্রচল একটি শ্লোক উল্লেখ করি, যাতে বিদ্বানকে সর্বোৎকৃষ্ট বিবেচনা করা হয়েছে। চাণক্য বলেছেন : ‘শর্বরী ভূষণাং চন্দ্রঃ, পৃথিবী ভূষণাং রাজা, বিদ্বান সর্বত্র ভূষণাং।’ অর্থাৎ রাতের অলংকার চাঁদ, পৃথিবী বা দেশের অলংকার রাজা কিন্তু বিদ্বান সর্বস্থানের অলংকার। তবে চন্দ্র কেবল রাতের ভূষণই নয়, এর অলংকারের মধ্যে আছে ময়ূরপুচ্ছের মতো নানান কলার বিস্তার। পক্ষকালব্যাপী প্রতিদিন একটু একটু করে বৃদ্ধি ও বিস্তারের মধ্যে আছে চাঁদের সৌন্দর্যের প্রকাশ। চাঁদের এই হ্রাসবৃদ্ধির সময়ের অংশকে বলা হয় চন্দ্রকলা বা শশিকলা। চন্দ্রকলার আছে ষোলোটি অংশ। সংস্কৃতে বলা হয় : ‘চন্দ্রস্য ষোড়শো ভাগঃ কলা।’ চাঁদের হ্রাসবৃদ্ধির প্রতিটি অংশ একেকটি কলা। তাই ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে বলা হয়েছে : ‘চন্দ্রে সবে ষোলোকলা হ্রাসবৃদ্ধি তায়।/ কৃষ্ণচন্দ্র পরিপূর্ণ চৌষট্টি কলায়।’ চাঁদের ষোলোকলার পূর্ণতায় আসে পূর্ণিমা। তাই কোনো কাজের সফল সমাপ্তিকে ষোলোকলায় পূর্ণ বলে আখ্যায়িত করা হয়। আবার ষোলোকলা একে একে ক্ষয় হয়ে অমাবস্যায় কলাহীন হয়। চন্দ্রের ষোলোকলার নামগুলোও খুব শ্রুতিমধুর : অমৃতা, মানদা, পূষা, পুষ্টি, তুষ্টি, রতি, ধৃতি, শশিনী, চন্দ্রিকা, কান্তি, জ্যোৎস্না, শ্রী, প্রীতি, অঙ্গদা, পূর্ণা ও পূর্ণামৃতা। এই কলা প্রতিদিন একেক করে বৃদ্ধি পেয়ে ষোলোকলা পূর্ণ হয়। পুরাণে বর্ণিত আছে, চাঁদে সুধা বা অমৃত আছে। ষোলোজন দেবতা একেক দিন একেক কলামৃত পান করেন। তাই কলা যুক্ত করে চন্দ্রের অন্য নাম : কলাধর, কলানাথ, কলানিধি।

পাঁচ

সহস্রাধিক বছরের প্রাচীনতম বাংলা কাব্যসাহিত্যের নিদর্শন চর্যাপদ থেকে আধুনিক কবিদের কবিতার গয়নাগাটিতে ছড়িয়ে আছে চন্দ্র বা চাঁদ। উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক, তুলনা,  প্রতিতুলনা, যমক, নরত্বারোপ – এসব প্রাচীন অলংকারশাস্ত্রে প্রায় সর্বত্রই রূপায়িত হয়েছে চাঁদের সৌন্দর্য। চাঁদ যে কত বিচিত্র ভাবপ্রকাশক ও শৈল্পিক সৌন্দর্যের সৃষ্টিকারী তার নিদর্শন লক্ষ করা যায় অষ্টাদশ শতকের কবিয়াল হরু ঠাকুরের (?-১৮২৪) রচনায়। তিনি ছিলেন কলকাতার শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণের সভাসদ। হরু ঠাকুর রাজার সভাসদের আসন লাভ করেন কবিগান রচনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে। কথিত আছে, একদিন রাজা নবকৃষ্ণ ‘বড়শি গিলেছে যেন চাঁদে’ – এই উৎপ্রেক্ষাটি দিয়ে একটি সম্পূর্ণ পদ রচনার জন্য প্রতিযোগিতা আহ্বান করেন। তাতে সকল কবিয়াল ব্যর্থ হলে হরু ঠাকুর রচনা করেন :

একদিন শ্রীহরি      মৃত্তিকা ভোজন করি

       ধূলায় পড়িয়া বড়ো কাঁদে।

যশোদা  অঙ্গুলি হেলায়ে ধীরে মৃত্তিকা বাহির করে

        বড়শি গিলেছে যেন চাঁদে।

(সূত্র : দুর্গাদাস লাহিড়ী-সম্পাদিত বাঙালির গান)

শিশু শ্রীকৃষ্ণের মুখ থেকে মাটি বের করতে তর্জনী নামক আঙুলের যে বঙ্কিম চন্দ্রাকৃতি অবস্থা, তা হরু ঠাকুর বড়শির সঙ্গে তুলনা করেছেন। এখানে কৃষ্ণের বদন যেন মুখচন্দ্র আর যশোদার বক্রাকৃতি আঙুল যেন বড়শি। উৎপ্রেক্ষার এমন কাব্যিক উৎকর্ষ বাংলা কাব্যে সত্যি দুর্লভ। তাই এই কাব্যালংকার প্রাচীন হলেও প্রকাশভঙ্গির উৎকর্ষে বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন লাভ করেছে।

বাংলা কাব্যসাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ থেকে প্রতিটি কাল ও পর্বের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা কমবেশি চাঁদের প্রসঙ্গ খুঁজে পাই। প্রাচীন ও মধ্যযুগের কাব্যসাহিত্যে চাঁদকে প্রধানত মুখমণ্ডলের সৌন্দর্যের উপমা বা তুলনায় ব্যবহৃত হয়েছে। আবার কখনো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনায়ও এসেছে চাঁদের প্রসঙ্গ। এক্ষেত্রে পূর্ণিমার চাঁদই কবিকুলকে বেশি আকৃষ্ট করেছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগের কাব্য থেকে কয়েকটি চুম্বক উদাহরণ এখানে তুলে ধরছি।

* চন্দ সূজ্জ দুই চকা সিঠি সংহার পুলিংদা। (১৪নং চর্যাপদ, ১২০০ খ্রি.)।

* সংপুন্ন চন্দ্র তোহোর বদন। (শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, ১৪৫০)।

* বাহির চন্দ্রকিরণে সোঅ। (বড়ুচণ্ডী দাস, ১৪৫০)।

* সামি সমাজ হম পেমে অনুরঞ্জি কুমুদিনী সন্নিধি চন্দা। (বিদ্যাপতি, ১৪৬০)।

* যখন পিরীতি কৈলা, আনি চাঁদ হাতে দিলা। (জ্ঞানদাস, ১৪৮০)।

* চন্দ্রবৎ কপালে শ্বেতরোমাঙ্কযুক্তা। (কৃত্তিবাসী রামায়ণ)

* জেহেন চন্দ্রমণ্ডল বরিসএ গরল। (মালাধর বসু, ১৫০০)।

* সেইকালে দৈবযোগে চন্দ্রগ্রহণ হয়। (কৃষ্ণদাস কবিরাজ, ১৫৮০)।

* চন্দ্রবতী রাত্রি বহে দক্ষিণ পবন। (বৃন্দাবন দাস, ১৫৮০)।

* মৎস্য পুড়ী চন্দ্রমুখী পাঙসে মলিন দেখি। (মুকুন্দরাম, ১৬০০)।

* চন্দ্রহার গলায় চৌদিক করে আলো। (ঘনরাম চক্রবর্তী, ধর্ম মঙ্গল)।

* সিন্ধু অগ্নি রাহুমুখে, শশী ঝাঁপ দেয় দুখে,/ যার যশে হয়ে অভিমানী। (ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর)।

* বদন বিকশ রূপে যেন চন্দ্রমাসা। (গরীবুল্লাহ, ১৭৬৫)।

* বিড়ালাক্ষী বিধুমুখী মুখে গন্ধ ছোটো। (ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, ১৮৩০)।

* গোকুলচন্দ্রের নখচন্দ্রে চন্দ্র লয় শরণ। (দাশরথী রায়ের পাঁচালী, ১৩০৯ বঙ্গাব্দ)।

* চন্দ্রমধ্যে চন্দ্র দীপ্ত সুচন্দনবিন্দু। (রামপ্রসাদ সেন, বিদ্যাসুন্দর, ১৩১৩ বঙ্গাব্দ)।

উল্লিখিত উদাহরণগুলোতে লক্ষ করা যায়, চর্যাপদের যুগ থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের অধিকাংশ ক্ষেত্রে চাঁদ নারীর মুখমণ্ডলের রূপ, প্রেমের আবেগ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও কদাচিৎ বিষাদময়তার বর্ণনায় উপমা হিসেবে এসেছে। মধ্যযুগে বড়ু চণ্ডীদাসের রচনায় চাঁদের একটু ভিন্নধর্মী উপমার প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে আছে : ‘মানিকরচিত চন্দ্রসম নখপান্তী।’ এখানে নখের সৌন্দর্য মানিকখচিত চন্দ্রের সঙ্গে কবি তুলনা করেছেন। দাশরথী রায়ের পাঁচালিতেও তা লক্ষিতব্য : ‘গোকুলচন্দ্রের নখচন্দ্রে চন্দ্র লয় শরণ।’ এ কাব্যপঙ্ক্তিতে উৎপ্রেক্ষার মাধ্যমে নখের শুভ্রসৌন্দর্যে চন্দ্রের আশ্রয় হিসেবে কল্পিত হয়েছে। প্রায় সমধর্মী আরো শিল্পগুণসম্পন্ন ও কাব্যময় একটি পঙ্ক্তি আছে ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গলে। তিনি লিখেছেন :

কে বলে শারদশশী ওমুখের তুলা

পদনখে পড়ে আছে তার কতগুলা।

এখানে নারীর মুখমণ্ডলের সৌন্দর্যময়তা শিখরস্পর্শী করতে কবি শারদীয় পূর্ণিমার চাঁদকে তুচ্ছ করে বলেছেন, তেমন অনেক চাঁদ পায়ের নখেই পড়ে আছে। যার পায়ের নখই শরতের চাঁদের মতো তার মুখমণ্ডলের সৌন্দর্য অলৌকিক ও কল্পনাতীত। (প্রথমাংশ) 

উনিশ শতক পর্যন্ত অধিকাংশ কবি মুখমণ্ডলের রূপের সঙ্গে পূর্ণিমার জ্যোৎস্নামাখা চাঁদের তুলনা করেছেন। তাই তাঁদের বর্ণনায় এসেছে : চাঁদমুখ, মুখচন্দ্র, চন্দ্রমুখী, বিধুমুখী, চন্দ্রাননা, চন্দ্রাননী, শশীকলা, চন্দ্রকান্ত, চন্দ্রবদনা, চাঁদবদনী, চন্দ্রলেখা, চন্দ্রসুধা, চাঁদপানা ইত্যাদি।  কিন্তু হাতের নখের সঙ্গে চন্দ্রসম নখপান্তী এবং পায়ের নখের সঙ্গে শারদশশীর তুলনা বিরল তো বটেই অনন্যসাধারণও। উল্লিখিত শব্দগুলোর ব্যাসবাক্যের ভিন্নতায় ও সমাসবিচারে কখনো উপমিত কর্মধারয়, কখনো বহুব্রীহি বা ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাসের অন্তর্গত। তবে ব্যাকরণগত সেই আলোচনা ভিন্ন এবং এখানে প্রয়োজনহীন।

চন্দ্র শব্দের সঙ্গে অন্য শব্দ সমাসবদ্ধ করে অনেক সংস্কৃত যমজ শব্দ তৈরি করা হয়েছে। সেসব শব্দের অর্থের সঙ্গে চাঁদের কোনো সম্পর্ক নেই বরং সেগুলো সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে। যেমন : চন্দ্রকলা (অলংকার বা নৃত্যবিশেষ), চন্দ্রকান্ত (মনিবিশেষ), চন্দ্রকান্তি (গোলাকৃতি সাদা পিঠাবিশেষ), চন্দ্রকীট (কালো রঙের পোকাবিশেষ), চন্দ্রচূড় (হিন্দু দেবতা শিব), চন্দ্রচূড়া (হিন্দু দেবতা শিবের পত্নী দুর্গা), চন্দ্রতারা (ডিঙি নৌকাবিশেষ), চন্দ্রপুলি (পিঠাবিশেষ), চন্দ্রবাণ (অস্ত্রবিশেষ), চন্দ্রবিন্দু (সানুনাসিক বর্ণবিশেষ), চন্দ্রবোড়া (ফণাহীন বিষধর সর্পবিশেষ), চন্দ্রব্রত (রাজধর্মবিশেষ), চন্দ্রভাগা (নদীবিশেষ), চন্দ্রমল্লিকা/ চন্দ্রমল্লি (ফুলবিশেষ), চন্দ্রশালা (চিলেকোঠা), চন্দ্রকূট (কামরূপের পাহাড়বিশেষ), চন্দ্রহার (অলংকারবিশেষ), চন্দ্রকেতু (লক্ষ্মণের পুত্র), চন্দ্রকোটাল (বৌদ্ধমঠের দ্বাররক্ষক), চন্দ্রভস্ম (কর্পূর), চন্দ্রভাগ (পর্বতবিশেষ), চন্দ্রভানু (কৃষ্ণসহচরী চন্দ্রাবলীর পিতা) ইত্যাদি।

চাঁদ বা চন্দ্র শব্দটি বাংলা বাগধারাতেও বিচিত্র অর্থ-ভঙ্গিমায় এসেছে। যেমন : চাঁদ-কপালে (ভাগ্যবান), চাঁদমারি (লক্ষ্যভেদ শেখার জন্য চাঁদের মতো চিহ্নযুক্ত লক্ষ্য), হাতে চাঁদ পাওয়া (দুর্লভ অথচ কাঙ্ক্ষিত বস্তু প্রাপ্তি), চাঁদের কণা (অতি সুন্দর শিশু), চাঁদের হাট (ধনেজনে পরিপূর্ণ সুখের সংসার)। আবার ‘গোরাচাঁদ’ ও কালোশশী’ যখন বলি তখন নবদ্বীপের নিমাই এবং কৃষ্ণাঙ্গ সুন্দরীকেই বোঝায়। আর ‘অর্ধচন্দ্র’ শব্দটি তো অপমানের পরাকাষ্ঠা! বাংলা সাহিত্যে চন্দ্র বা চাঁদ বহু বইয়ের শিরোনাম হিসেবেও অলংকৃত হয়েছে। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে, বিভূতিভূষণের উপন্যাস চাঁদের পাহাড়, আবদুল গাফফার চৌধুরীর চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান ও শেষ রজনীর চাঁদ এবং কৃষ্ণপক্ষ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর নাটক চাঁদের অমাবস্যা, শামসুর রাহমানের কাব্যগ্রন্থ ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুঁকছে ও জুলফিকার মতিনের নীলিমাকে চাঁদ দেব বলের কথা।

ছয়

বাংলা সাহিত্যের অন্ত্যমধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের সীমারেখার মধ্যপর্বের কবি বলে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে বলা হয় ‘যুগসন্ধিক্ষণের’ কবি। আর রবীন্দ্রনাথের কাব্যগুরু বিহারীলাল চক্রবর্তীকে বলা হয় ‘আধুনিক গীতিকবিতার ভোরের পাখি’। তবে মাইকেল মধুসূদন দত্তই মূলত বাংলা কবিতার প্রচলিত একঘেয়ে পয়ার ছন্দের শৃঙ্খল ভেঙে অমিত্রাক্ষর ছন্দের মুক্তপ্রবাহ সৃষ্টি করেছিলেন। ছন্দ ও ভাবের অবাধ মুক্তির নির্দেশনা দিয়ে কবিতার শব্দবন্ধ ও চরণকে মধুকবি করেছেন ভাবানুষঙ্গী। এজন্যই মাইকেল বাংলা কবিতার ইতিহাসে আধুনিকতার পথপ্রদর্শক এবং জনক হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই মন্ময় গীতিকবিতার বহুমুখী বিকাশ ঘটেছে। তাই আমরা লক্ষ করি, মধুসূদন থেকে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল থেকে জীবনানন্দ, তিরিশের পঞ্চকবি থেকে সুকান্ত এবং শামসুর রাহমান থেকে শঙ্খ-সুনীল পেরিয়ে নির্মলেন্দু গুণ ও মহাদেব সাহার হাত ধরে বিশ শতকের বাংলা কবিতায় চাঁদ উপমা-উৎপ্রেক্ষা হিসেবে কখনোই উপেক্ষিত থাকেনি। এমনকি বঙ্কিমচন্দ্রসহ সমকালীন গদ্যশিল্পীদের রচনায়ও এর সাক্ষ্য মেলে। সেসবের কয়েকটি উদাহরণ :

* চলিলা দুজনে চন্দ্রচূড়ালয়ে, যথা রক্ষ কুলেশ্বরী আরাধেন চন্দ্রচূড়ে রক্ষিতে নন্দনে। (মধুসূদন, মেঘনাদবধ কাব্য, ১৮৬০)।

* তুমি আমার চন্দ্রায়ণের চন্দ্রফলক। (বঙ্কিমচন্দ্র, ১৮৭৪)।

* খেলি চকোরের সনে, মেখে চাঁদের কর। (গিরিশচন্দ্র ঘোষ, ১৮৮৩)।

* পাণ্ডুচন্দ্রলেখা আজি অস্ত গেল, কুরুসূর্য একা। (রবীন্দ্রনাথ, ১৮৯৯)।

* থরে থরে ফুটে চন্দ্রমল্লি। (সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, ১৯১৫)।

* আকাশে ঢেউ লেগেছে/ চাঁদ ফুটেছে চাঁদের গায়। (ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ, ১৯২৫)।

* কল্পনাতে আঁকব তোমার চাঁদ-চুয়ানো মুখ। (নজরুল ইসলাম, ১৯২৮)।

* অনেক চাঁদ আগেকার কথা। (বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৩৩)।

* মনপবন আর চাঁদের বুড়ি মিলে কেমন যেন …। (জীবনানন্দ দাশ, ১৯৪৮)।

* যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ/ মরিবার সাধ হল তার। …

চাঁদ ডুবে গেলে অদ্ভুত আঁধারে …। … চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশত্থের আঁধারে একগাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে …।… বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে? (‘আট বছর আগে একদিন’, জীবনানন্দ, ১৯৪৪)

* রাত্র চাঁদের আলোয় শূন্য মরুভূমি জ্বলে/ বাঘের চোখের মতো;/ আজো জ্বলন্ত খড়গের মতো আকাশে চাঁদ ওঠে। (সমর সেনের কবিতা, সমর সেন)।

* আকাশের বাঁক ঘুরে চাঁদ এলো ছবির মতন …। (শ্রেষ্ঠ কবিতা, ফররুখ আহমদ)।

* সেই চাঁদজাগা রাতে সৈয়দবাড়ি থেকে ফেরার সময় …। (শহীদুল্লা কায়সার, ১৯৬৫)।

* তারপর কত চন্দ্রভুক অমাবস্যা চলে গেল কিন্তু সেই বোষ্টমী আর এলো না। (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, ১৯৬৯)।

* চান করে কে চাঁদবরণী। (আবুজাফর ওবায়দুল্লাহ, ১৯৭৪)।

*… আমার ভুরুর মাঝখানে/ যে অদৃশ্য চাঁদ আছে তা-ও কি আখেরে নিভে যাবে? (‘যে অদৃশ্য চাঁদ’, শামসুর রাহমান)।

* ভেবেছিলাম সে চাঁদ, অভিমানী কৃষকের মতো/ আর ফিরে আসবে না আকাশের মাঠে, …। (‘চাঁদ’, ওই)।

* রাতে চাঁদটা হঠাৎ যেন বেজায় বেঁকে বসল। (‘অথচ বেলা-অবেলায়’, ওই)।

* ধবল দুধের মতো জ্যোৎস্না তার ঢালিতেছ চাঁদ – পূর্ণিমার। (নূরলদীনের সারাজীবন, সৈয়দ শামসুল হক)।

* সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে/ কর্ণফুলীর কূলটায়,

দুধভরা ঐ চাঁদের বাটি/ ফেরেশতারা উল্টায়।

(‘পাখির মতো’, আল মাহমুদ)।

* ফুটেছে ফুল ঠোঁটের মতো লাল/ বিরহী চাঁদ বিরহী চিরকাল;/ ফুটেছে ফুল বিরহী তবু চাঁদ,/ বাইরে আলো, ভিতরে অবসাদ। (মহাদেব সাহা, ২০০৪)।

* একদিন চাঁদ উঠবে না, সকাল-দুপুরগুলো

  মৃতচিহ্নে স্থির হয়ে রবে, …।

  (‘পূর্ণিমার মধ্যে মৃত্যু’, নির্মলেন্দু গুণ)।

* আমরাও চাঁদকে ভালোবাসি।

আমরা চন্দ্রবিন্দু বানিয়ে ধরে রেখেছি মাথার উপ্রে।

চাঁদের আনন্দ-ঘ্রাণ ছড়িয়ে থাকে আমাদের বর্ণমালায়।

(‘চন্দ্রবিন্দু’, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল)।

বাংলা সাহিত্যে, বিশেষত কবিতায় বিচিত্রবিধ ব্যঞ্জনায় চাঁদ উপস্থাপিত হয়েছে। বিশ শতকের বাংলা ভাষার কয়েকজন  প্রধান কবির রচনা থেকে উল্লিখিত উদ্ধৃতিতে তার সাক্ষ্য পাওয়া যায়। তবে এসবও যৎসামান্যই – সমুদ্রজলের কাছে গোষ্পদবারির মতো। বাংলা সাহিত্যে এমন কোনো কবি সম্ভবত নেই, যাদের কবিতায় চাঁদ কোনো-না-কোনোভাবে রূপায়িত হয়নি। উপমা, উৎপ্রেক্ষা, অতিশয়োক্তি, নরত্বারোপ, যমক ইত্যাদি – অলংকারশাস্ত্রের যত রূপ আছে, অনুসন্ধান করলে তার প্রায় সবই পাওয়া যাবে। কালান্তরের সঙ্গে রূপান্তর ঘটে সমাজচেতনার। যুগধর্মের রূপান্তরের সঙ্গে পরিবর্তন ঘটে শিল্পচেতনার – পাল্টে যায় সাহিত্যের রূপরীতি, অঙ্গ-অন্তর এবং অলংকার। বদলে যায় উপমা-উৎপ্রেক্ষার বৈশিষ্ট্য। এ-বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষ করা যায় বাংলা কবিতায় চাঁদের উপস্থাপনার মধ্যে। একদা যে-চাঁদ মুখমণ্ডল, দৈহিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এবং প্রাকৃতিক রূপলাবণ্যের প্রতীক, তা কালের বিবর্তনে হয়ে উঠেছে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ এবং বিপ্লবোদ্দীপক সংগ্রামের চেতনায় ভাস্বর। শোষিত-বঞ্চিত মানুষের দুঃখ-দারিদ্র্য ও জীবন-সংগ্রামে চাঁদ রূপায়িত হয়েছে অদৃষ্টপূর্ব ভিন্নমাত্রিক চেতনায়। এই নবতর ব্যঞ্জনার বিষয়টি লক্ষ করা যায় বিশ শতকের চল্লিশের দশকের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ও দিনেশ দাসের কবিতায়।

প্রবাদপ্রতিম, জননন্দিত ও বহুল উদ্ধৃত ‘হে মহাজীবন’ কবিতায় সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৯২৬-১৯৪৭) লিখেছেন :

প্রয়োজন নেই কবিতার স্নিগ্ধতা –

কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি,

ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়

পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।

আর দিনেশ দাস (১৯১৩-১৯৮৫) শ্রেণিসংগ্রামের চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে ‘কাস্তে’ কবিতায় লিখেছেন :

নতুন চাঁদের বাঁকা ফালিটি

তুমি বুঝি খুব ভালোবাসতে?

চাঁদের শতক আজ নহে তো

এ-যুগের চাঁদ হলো কাস্তে!

এই দুই কবির কবিতায় ক্ষুধার্ত মানুষ ও সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে যুগধর্মের বিপ্লবোদ্দীপক চেতনা বিধৃত হয়েছে। বিশেষত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত ইউনিয়নের চেতনা ও ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের পর সাম্যবাদী ভাবধারার বিকাশ বাঙালি কবিদের সমাজচেতনায় ব্যাপক ভাবান্তর ঘটিয়েছিল। চাঁদের সঙ্গে ঝলসানো রুটি ও কাস্তের উপমায় যেমন সংগ্রামশীল শোষিত-বঞ্চিত মানুষের নিত্যবহমান জীবন-সংগ্রামের আকাঙ্ক্ষা রূপায়িত হয়েছে, তেমনি উপমার নতুনত্বও প্রকাশ পেয়েছে। উপমায় এই নতুন ব্যঞ্জনার অভিঘাত বাংলা কবিতায় সুদূরপ্রসারী। বাংলা কবিতা ও গানে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ এবং সমকালীন কথাসাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদের রচনায় চাঁদ-সম্পর্কিত উদ্ধৃতিযোগ্য রোদ-ঝলসানো ও জ্যোৎস্নাময় শত-শত পঙ্ক্তি পাওয়া যায়। এই বিষয়টি নিয়ে রচিত হতে পারে অভিনিবেশী অভিসন্দর্ভ। তবে সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘হে মহাজীবন’ ও দিনেশ দাসের ‘কাস্তে’ কবিতাদুটি যে পরবর্তীকালের বাংলা কবিতায় সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিল তার সাক্ষ্য পাওয়া যায় শহীদ কাদরীর ‘তুমি’ কবিতায়। তিনি লিখেছেন :

তৃতীয় বিশ্বের কবি দেখেছেন চাঁদকে ঝলসে ওঠা

রুটির মতন, কখনো-বা কৃষকের বলদৃপ্ত

হাতে ধরা শান দেয়া কাস্তের মতন।

(আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও, ২০০৯)।

কবিদের চন্দ্রবন্দনা বিশ্বাত্মবোধক – দুনিয়াজোড়া।

পৃথিবীর এই উপগ্রহটি দেশকাল ও সীমানা-নিরপেক্ষভাবে সকল কবিকে কবিতা রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের, ইউরোপ বা আমেরিকার, প্রাচীন কিংবা আধুনিক – যে-কোনো সমাজ-সময়ের কবিদেরই অনুপ্রাণিত এবং আবেগপ্রবণ করেছে চন্দ্র নামক পৃথিবীর উপগ্রহটি। এর নরম আলোর স্নিগ্ধতায়, কলাবৃত্তের হ্রাসবৃদ্ধিতে এবং রুপালি জ্যোৎস্নার প্লাবনে কবিপ্রাণ কল্লোলিত করে। চাঁদ কেবল সমুদ্রকেই আকর্ষণ করে না; মানুষের সমুদ্রতুল্য হৃদয়পুরেও জোয়ার-ভাটা আনে। মানবমনে চন্দ্রচেতনা একাধারে আধিদৈবিক ও আধিজৈবিক। পৌরাণিক চাঁদ সেকালের মানুষকে আধিদৈবিক চেতনায় অলৌকিকতায় নিবিষ্ট করেছে। আর আধিজৈবিক চাঁদ একালের মানবমনকে আবিষ্টক করেছে স্বপ্ন ও কল্পনায়। তাই চন্দ্রপ্রসঙ্গ কেবল ভাবপ্রবণ বাঙালি কবিদের রচনায়ই লক্ষিতব্য নয়; খ্যাতিমান বিদেশি কবিদের কবিতায়ও তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উল্লম্ফন উন্নয়নের এই যুগে কত অসাধ্য সাধন করেছে মানুষ! ‘হাতে চাঁদ পাওয়া’ বলতে যা বোঝায়, মানুষ তা-ই করায়ত্ত করেছে। ‘সুদূরের পিয়াসী’ মানুষ নিরন্তর মহাকাশ-গবেষণার মাধ্যমে চন্দ্রবিজয়ে সাফল্যলাভ করেছে। ভাবলোকের চন্দ্রে, কল্পরাজ্যের চাঁদে মানুষ এখন বসতি স্থাপনের অপেক্ষায়। মানুষ চাঁদে প্রথম পদার্পণ করে আজ থেকে পঞ্চান্ন বছর আগে – ২০ জুলাই ১৯৬৯। চন্দ্রাভিযানের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে ২০১৯ সালে পালিত হয়েছে সুবর্ণজয়ন্তী। এই উপলক্ষে সুব্রত বডুয়া-সম্পাদিত দেশের অন্যতম সাহিত্য পত্রিকা কালি ও কলম সে-বছরই আগস্ট সংখ্যায় এক ডজন চাঁদ-উদ্ধৃত কবিতা প্রকাশ করেছে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বারোজন খ্যাতিমান কবির এই কবিতাগুচ্ছ ভাষান্তর করেছেন আন্দালিব রাশদী। এই কবিবৃন্দ হলেন : খলিল জিবরান, মাহমুদ দারবিশ, নিজার কারবানি, সের্গেই ইয়েসেনিন, ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা, হোর্হে লুই বোর্হেস, হুয়ার র‌্যামন হিমেনিথ, ওমর খৈয়াম, জালালউদ্দিন রুমি, আবু নওয়াস, কো উন এবং পাবলো নেরুদা। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই কবিদের চন্দ্রবন্দনা চন্দ্রপ্রীতির বিশ^াত্মবোধকে আমাদের সামনে ফুটিয়ে তোলে।