ছাপচিত্রের আলো-ছায়ায়

জাহিদ মুস্তাফাBaoul Lithugraph

শিল্পী তাঁর শৈল্পিক মেধা ও দক্ষতার সমন্বয়ে যে-শিল্পকর্ম রচনা করেন, তা সৃজনশীল কাজ হিসেবে স্বীকৃত হয়। শিল্পী এই সৃজনশীলতা প্রধানত আহরণ করেন প্রকৃতির অফুরন্ত সৌন্দর্যের ভান্ডার থেকে। বীরেন সোম এমন একজন শিল্পী, যিনি নিসর্গের সৌন্দর্যে অবগাহন করে তাঁর সৌন্দর্য-চেতনাকে চিত্রপটে অনূদিত করেন। কালি-কলম, জলরং, তেলরং ও অ্যাক্রিলিক মাধ্যমে কাগজে-ক্যানভাসেই তাঁর বিচরণ বেশি। ছাপচিত্র মাধ্যমেও কাজ করেন তিনি।

সম্প্রতি ঢাকা আর্ট সেন্টারে অনুষ্ঠিত হলো শিল্পী বীরেন সোমের একক ছাপচিত্র প্রদর্শনী। ২৮ জুন থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত চলে এটি। শিল্পীর ছাত্রজীবন অর্থাৎ ষাটের দশকের শেষভাগ থেকে এ-বছর পর্যন্ত  নানা মাধ্যমের ছাপাই ছবি স্থান পায় এ-প্রদর্শনীতে। শিল্পীজীবনের নানা পর্যায়ে ছাপচিত্রের বিভিন্ন মাধ্যমে শিল্পকর্ম সৃজনে ব্যাপৃত থেকেছেন। তাঁর সৃজনের বিষয় মানুষ ও নিসর্গ। মানুষের মধ্যে নারীই প্রধানত চলে এসেছে শিল্পীর চিত্রপটে, তাঁর মুগ্ধতায়, ভালোবাসায়।

গত শতকের ষাটের দশকের শেষভাগে শিল্পী বীরেন সোমের আবির্ভাব হলেও আমরা সত্তরের দশকের শিল্পী হিসেবেই তাঁকে চিহ্নিত করতে পারি। ষাটের মধ্যভাগ থেকে একাত্তরের সেই উত্তুঙ্গ উত্তেজনাময় জীবনের যোদ্ধা তিনি। স্বাধীনতাযুদ্ধে তাঁর অংশগ্রহণ রং-তুলি-ক্যানভাসে। একাত্তরে কলকাতায় বাংলাদেশের চারুশিল্পীদের যে-প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল বীরেন সোম ছিলেন তাঁর অন্যতম যোদ্ধাশিল্পী। স্বাধীন বাংলা সরকারের তথ্য দফতরের অন্যতম নকশাবিদ ছিলেন তিনি। শিল্পী কামরুল হাসানের নেতৃত্বে ওই দলে আরো ছিলেন – মুস্তাফা মনোয়ার, প্রাণেশ মন্ডল, নিতুন কুন্ডুসহ অনেকেই।

যদি ফিরে তাকাই গত শতকের আশির দশকে – প্রিন্ট-মিডিয়া ক্রমান্বয়ে কম্পিউটারনির্ভর হয়ে উঠছিল। বীরেন সোম তখন সংবাদের বিখ্যাত সাহিত্যপাতার অঙ্কনশিল্পী। দৈনিক কাগজের পাতায় তাঁর অলঙ্করণগুলো আমাদের শিল্পভুবনে নতুনত্ব এনে দিয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে সংবাদপত্রের সাহিত্যপাতার অলঙ্করণের যে-আধুনিকতা আজ আমরা দেখছি বিভিন্ন শিল্পীর অাঁকায়, ওই আধুনিকতার উন্মোচন হয়েছে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, কালাম মাহমুদদের হাত ধরে। এই অগ্রজদের পরের প্রজন্মের শিল্পী বীরেন সোম ও কাজী হাসান হাবিবের অনেক অবদান এক্ষেত্রে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি আশির দশকে।

বীরেন সোমের ছাপচিত্র চর্চার সঙ্গে তাঁর অলঙ্করণের যোগসূত্র আছে বলেই মনে হয়। যদিও অলঙ্করণের আগেই তাঁর ছাপচিত্রকলার কাজ আমাদের চোখে পড়েছে, তবু পরবর্তীকালের কাজগুলোয় হয়তো নিজের অবচেতন মনেই ওই অলঙ্করণের প্রভাব চলে এসেছে। গল্প-কবিতার ইলাস্ট্রেশন আঁকতে আঁকতে সাদা-কালোর বৈপরীত্য তাঁকে আকর্ষণ করেছে। এই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বীরেনের ছাপাই ছবির অন্তঃপুরে। সাদা-কালোর বিপরীত চরিত্র আর রেখার তীব্রতায় যে জোরালো চিত্রভাষার সৃজন ঘটে, তার স্বাতন্ত্র্য শিল্পীকে আকর্ষণ করেছে বলেই তিনি মাঝে মাঝে ছাপচিত্রকলা চর্চায় মেতে উঠেছেন। রিলিফ কায়দায় সাদা-কালো ছাপাই শুধু নয়, নানাভাবে তিনি এই মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন।

আরেকটি ঘটনা প্রণিধানযোগ্য এক্ষেত্রে, সেটি হলো ১৯৯০ সালে তাঁর সমসাময়িক শিল্পী কালিদাস কর্মকারের সঙ্গে গ্রাফিক আতেলিয়ের ৭১ প্রতিষ্ঠা এবং এর এক যূথবদ্ধ প্রদর্শনীতে বীরেন সোমের অংশগ্রহণ। একই বছর বার্লিনের ইন্টারগ্রাফিক প্রদর্শনীতে তাঁর ছাপচিত্র প্রদর্শিত হয়। এ সময় থেকে ছাপচিত্রে তাঁর প্রকাশ বাড়তে থাকে এবং প্রসঙ্গক্রমেই বলতে পারি, আতেলিয়ের ৭১ স্টুডিও প্রতিষ্ঠার পর আমাদের ছাপচিত্র আরো আধুনিকতার পথে একধাপ এগিয়ে যায়।

গত শতকের সত্তরের দশকের শেষার্ধে শিল্পী অনেক এচিং ও এচিং অ্যাকোয়াটিন্ট মাধ্যমে ছাপচিত্র করেছেন। এসব ছবিতে শিল্পীর একাগ্রতা ও নিষ্ঠা আমাদের আলোড়িত করেছে। ১৯৭৯ সালের ‘ফুলের সঙ্গে মহিলা’ শিল্পীর একটি এচিং ছাপচিত্র। সাদা, কালো, লাল ও হলুদ জমজমাট একটি কাজ। আধো ঘোমটা দেওয়া এক তরুণীর হাতে একটি ফুল, যেন সে তাঁর প্রেমিকের প্রতীক্ষায়। রোমান্টিক এই ছাপচিত্রের পশ্চাৎপটে অন্ধকার অর্থাৎ প্রায় কালচে রঙের প্রাধান্য। হলুদাভ একটি চাঁদও নারীটির কপাল বরাবর একটু দূরত্বে অবস্থিত। একই সময়ের আরেকটি এচিং ছাপাই ‘অবয়বগুলো’য় একাত্তরের স্মৃতিকে তুলে ধরা হয়েছে। দুটি প্যানেলের নিচের বড় অংশে দুই নারী অবয়বের মাঝে শ্মশ্রুমন্ডিত এক পুরুষ, ওপরের অংশে জাতীয় পতাকার ছাপ।

‘সংগীতকার’ তাঁর একই সময়ের এচিং ছাপাই। সংগীতময় এক আবহের সামনে গিটার বাদনরত এক শিল্পীর কাঠামো অঙ্কন উপভোগ্য হয়েছে গঠন ও বর্ণ আয়োজনে। শিল্পীর এই কাজগুলো তাঁর তরুণ বয়সের। এক ধরনের রোমান্টিকতায় আচ্ছন্ন তাঁর  এ-কাজগুলো।

একই সময়ের এচিং ছাপাই ‘শান্তি’ শীর্ষক চিত্রকর্মে আমরা শিল্পীর শান্তি-চেতনার দেখা পাই। বিশ্বশান্তি পরিষদের নানা কর্মসূচির সঙ্গে শিল্পীর প্রত্যক্ষ যোগাযোগের ফসল ওই চিত্রকর্ম। এ-কথা প্রণিধানযোগ্য যে, সে-সময়ে আলী আকসাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের শান্তি পরিষদ বেশ তৎপর একটি সংগঠন। সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শ শিল্পী বীরেনের পছন্দ। পরক্ষণেই শিল্পী মরমি বাউলগুরু লালন সাঁইজির জীবনদর্শন নিয়ে সাদা-কালো এচিং করেছেন। ‘নিসর্গ আমার প্রেম’ শীর্ষক এচিং ছাপাইয়ে আমরা দেখতে পাই নিসর্গের নানা ফর্ম ও রেখার প্রয়োগ, নকশার বাহার। যেন শিল্পী বয়ান করছেন – প্রকৃতি থেকেই আমাদের নানা কিছু গ্রহণ করতে হয়, তাই প্রকৃতিই আমাদের পাঠশালা।

নারী ও নিসর্গের মধ্যে মিল খুঁজে পেয়েছেন প্রাচীন থেকে শুরু করে এখনকার কবি-সাহিত্যিক ও শিল্পীরা। বীরেন সোমও সে-পথে হেঁটেছেন। নারীর সঙ্গে নিসর্গের একাত্ম হয়ে ওঠার সৌন্দর্য বয়ান করেছেন শিল্পী তাঁর এচিং মাধ্যমে ‘নিসর্গ ও নারী’ শীর্ষক চিত্রকর্মে। নারী অবয়ব যেন আকাশের মতো, চেয়ে আছে বৃক্ষের দিকে পরম মমতায়। যেন সে বলছে, তোমার সবুজ আমি বৃষ্টিসিক্ত করে দেবো, তুমি হেসে উঠবে, আমার নিসর্গ আরো বর্ণিল হয়ে উঠবে। আশির দশকে বীরেনের ছাপচিত্রে আরো পরিবর্তন এসেছে। সামরিক স্বৈরশাসনে পিষ্ট সময় আর তার প্রতীকী প্রতিবাদ উঠে এসেছে তাঁর তখনকার ছাপচিত্রে। ‘ইমেজ’ শীর্ষক এচিং ছাপাইয়ে আমরা দেখি লতাপাতাগুল্মের ঘেরাটোপে থাকা অবয়ব। স্বৈরতার অাঁধার যেন গণতন্ত্রের আলোর পথে বাধা হয়ে এসেছে সেখানে। পুরনো সভ্যতার  ধ্বংস্তূপের ভেতর থেকে দেয়ালভেদ করে ছুটে আসা ঘোড়া ও ঘোড়সওয়ার ছুটছে সামনে। ঘোড়ার দৃষ্টি পেছনের দিকে, তবে সওয়ারির দৃষ্টি আগামী সম্ভাবনায়।

সাম্প্রতিকালে বীরেন কোলাগ্রাফ মাধ্যমে ছাপচিত্র করেছেন। ‘ট্রিবিউট টু রবীন্দ্রনাথ’ এ মাধ্যমের একটি উল্লেখযোগ্য কাজ। এটি ২০১১ সালের ছাপাই। ক্যানভাসের কেন্দ্রস্থলের সামান্য নিচে  সিংহদরোজার ভেতর রবীন্দ্র-প্রতিকৃতি, পশ্চাৎপটে নানারকম নকশার বিন্যাস। রবিঠাকুরের ১৫০তম জন্মবার্ষিকী স্মরণে এটি শিল্পীর শ্রদ্ধার্ঘ্য।

একেবারে সাম্প্রতিককালে বীরেন বেশকিছু রিলিফ প্রিন্ট করেছেন, যেগুলো ভারি রোমান্টিক, মজার। এসব কাজে প্রাচ্যরেখার নমনীয়তা যেমন আছে, তেমনি পাশ্চাত্যের পিকাসোর অঙ্কনরীতিও রয়ে গেছে। নানাকিছু মিলে বীরেন সোমের ছাপচিত্র-প্রদর্শনী জমে উঠেছিল বেশ।