জলের অক্ষরে লেখা

পর্ব : ১০

আড্ডা আর তেমন জমলো না। হাসি-ঠাট্টা-তামাশা-দুষ্টুমি সবই হলো, কিন্তু ঋভু ঠিক অংশ নিতে পারলো না। সেও হাসলো বটে, কথার পিঠে কথাও বললো, কিন্তু বারবার মনে হতে লাগলো, এসবের কোনো মানে নেই। অবশ্য কিসেরই বা মানে আছে? এই প্রশ্ন মনে এলে কোনো উত্তর খুঁজে পেল না নিজের ভেতরে। সে বরাবরই বলে কম, শোনে বেশি, দেখেও বেশি। কিন্তু মাঝে-মাঝে মনে হয়, একই কথা সে শুনে যাচ্ছে বহুকাল ধরে; না, একই কথা হয়তো নয়, একই ধরনের কথা – নতুন এমন কিছু থাকে না যে উৎকর্ণ হয়ে শুনতে ইচ্ছে করবে; পুরনো সেই চর্বিতচর্বণ, শুনতে শুনতে কান বিদ্রোহ করে বসেছে, আর শুনতে চাইছে না। মনে হয়, এত বেশি দেখে ফেলেছে সে, যে নিজের চোখদুটোকেও মনে হয় অচেনা। আর কত দেখবে সে, ‘চক্ষু তো মাত্র দুইখান, আর কত দেখাইবা ঈশ^র? আমারে তুমি তুইলা নাও।’ – মাহমুদুল হকের সেই অপূর্ব গল্পটির কথা মনে পড়লো তার, যেটি পড়ে সে অভিভূত হয়ে গিয়েছিল।

হঠাৎ করে কেন এমন এলোমেলো লাগছে, বুঝতে পারছে না ঋভু। অবশ্য এ নতুন কিছু নয়। মাঝে-মাঝে তার এমন হয় – ক্লান্ত লাগে, বিরক্ত লাগে, উদাস-উদাস লাগে, এলোমেলো লাগে; সবকিছু ছেড়ে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করে। অবশ্য তার আছেই কী আর ছাড়বেই বা কী, যাবেই বা কোথায়? বুঝতে পারে না সে। কখন যে মনের এমন অবস্থা হবে তারও কোনো ঠিকঠিকানা নেই, আগাম কোনো নোটিশ না দিয়েই তার মন নাগালেই বাইরে চলে যায়। 

অপলা নিজের হাতে সুস্বাদু সব নাস্তা বানিয়েছে, সেসব খাওয়া হলো। অবন্তি বসে বসে ঠিক করে নিল, কার সঙ্গে কবে বেরোবে। তার ছুটি শেষ হয়ে আসছে, ফিরে যেতে হবে, সেজন্য একটা দিনও সে অকারণে ব্যয় করতে চায় না।

আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখা করবে না এবার, শুক্রবার বাসায় ভাই-ভাবি আর তাদের বাচ্চাদের সম্মিলন, ওই দিনটা শুধু কাটাবে তাদের সঙ্গে। এইসব জানালো। তারপর ফেরার জন্য উঠে দাঁড়ালো। অপলা রাতের খাবার খেয়ে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলো, অবন্তি রাজি হলো না। বললো, তুমি না একদিন দাওয়াত করতে চেয়েছ! সেদিন এসে খাবো। দেশি কৈ মাছের ভুনা খেতে চাই তোমার কাছে। আজকে নিশ্চয়ই সেটা নেই!

অংশু মনে মনে চাইছিল, আজকেও একটু পানাহার হোক, অপলাও সেই আড্ডায় থাকুক, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই প্রসঙ্গ তুললো না। মনে হলো, ঋভু ঠিক মন বসাতে পারছে না এখানে, ও হয়তো না করবে না, বসবে, কথা বলবে, কিন্তু এখানে থেকেও থাকবে না। এখন ওকে আড্ডার কথা বলা ঠিক হবে না।

অবন্তির সঙ্গে বেরুলো ঋভুও, অবন্তি তাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে যাবে। যাওয়ার পথটুকুতে অবন্তি দারুণ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলো অংশুদের বাড়ি নিয়ে। ডিজাইনটা নাকি ওর ভীষণ পছন্দ হয়েছে। কালকেও ঋভুর বাড়িতে গিয়ে অংশুর প্রশংসা করেছিল সে, আজকে করলো তারচেয়ে তিন-চারগুণ বেশি। ঋভুর ভালো লাগছিল। অংশুর যে-কোনো সাফল্যে সে খুশি হয়, কেউ ওর প্রশংসা করলে খুশি হয়, ওকে কেউ ভালোবাসলে আরো খুশি হয়। অংশু তার নিজের কাজগুলির মাধ্যমে জীবনের একটা মানে খুঁজে পেয়েছে হয়তো। কেবল নিজেকে নিয়েই ভাবে না সে, ভাবে আরো অনেক মানুষকে নিয়ে, তাদের স্বস্তি, আনন্দ ও শান্তি নিয়ে। বাড়িই হোক আর অফিসই হোক, যে-কোনো ডিজাইনের মধ্যে ও এমন কিছু রেখে দেয় যেন মানুষ সেখানে গিয়ে স্বস্তি পায়। এই যে শূন্য থেকে শুরু করে অনেক কিছু গড়ে তোলা, হয়তো এর মধ্যেই জীবনের তাৎপর্য আছে।

ঋভু নিজের কথা ভাবলো। অংশুর জীবনের ঠিক বিপরীত দিকে যেন তার অবস্থান। কিছুই করেনি সে জীবনে, এখনো করে না। বছরে একবার মাসখানেকের ছুটি নিয়ে সে ঘুরে বেড়ায় দেশে-বিদেশে। তাও একাই। কখনোই কোনো ভ্রমণসঙ্গী থাকে না। বাকি সময়টা কীভাবে যেন কেটে যায়। সময় কাটানো যে এক বিরাট সমস্যা, সে তা জানতো। চাকরিটা সেজন্যই করে, যদিও প্রয়োজন নেই তেমন। পর্যাপ্ত টাকা আছে তার, খরচও তেমন কিছু নেই। চাকরির বেতন ছাড়াও জহিরের ফার্ম থেকে নিয়মিতই টাকা পায় সে। মা আর বাবার রেখে যাওয়া টাকা তো রয়েছেই। এত টাকা দিয়ে সে করবে কী, ভেবে পায় না মাঝে-মাঝে। সত্যি বলতে কি, সে খুব একটা ভাবেও না। এত ভেবে হবেই বা কী? চলছে চলুক। মাঝে-মধ্যে তার মনে হয়, একটু অভাব-অভিযোগ থাকা ভালো, একটু সমস্যা-সংকট, তাতে জীবন এমন স্থবির হয়ে পড়ে না। কিন্তু ওগুলো তো আর চেয়ে পাওয়া যায় না, কারো-কারো জীবনে এমনিতেই থাকে, না চাইলেও আসে, আর কারো জীবন থাকে নির্ঝঞ্ঝাট। ছোটবেলা থেকে সে কোনো সমস্যা-সংকট দেখেনি, নীলুর মৃত্যু ছাড়া। ওটা তো অন্য রকম ব্যাপার। মৃত্যুর ওপর তো কারো হাত নেই। কিন্তু অন্য ধরনের সংকট একেবারেই ছিল না। বাবাও ছিলেন উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পদশালী। দাদার পাটকল ছিল, সে যুগের সবচেয়ে বড় ব্যবসা। তাঁর মৃত্যুর পর পাটকলটা বিক্রি করে দেওয়া হয়। বাবা-চাচা-ফুপুরা টাকা ভাগাভাগি করে নেন। ওয়ারিতে দাদার ছিল বিশাল বাড়ি। ওটা এখনো আছে, চাচা-ফুপুরা ভাগ করে নিয়েছেন, কিন্তু বাবা সেখানে থাকেননি। নিজের প্রাপ্য অংশ ছেড়ে দিয়েছিলেন বলে তাঁর ভাইবোনেরা পাটকল বিক্রির টাকা কিছু বেশিই দিয়েছিলেন তাঁকে।

ওয়ারি থেকে বেরিয়ে এসে গুলশানে জমি কিনলেন, বাড়িও করলেন। কেন যে নিজের ভাই-বোন-আত্মীয়স্বজনদের ছেড়ে এসেছিলেন তিনি, ঋভু জানে না। বাবা কিংবা মা এই বিষয়টি নিয়ে কোনোদিন কথা বলেননি। ওই বাড়িতে যাওয়া-আসা ছিল, কিন্তু কোনোদিন ঋভুকে ওখানে যাওয়ার জন্য জোর করেননি। চাচা-ফুপু কিংবা কাজিনদের সঙ্গে তাই তেমন কোনো বন্ধন গড়ে ওঠেনি ঋভুর। একই শহরে থাকলেও তাদের সঙ্গে কখনো দেখা হয় না তার। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর ওই পর্ব তার জীবন থেকে একেবারেই মুছে গেছে। বাবা নিজেও ব্যবসা করতেন, কিন্তু নীলুর মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে সব গুটিয়ে এনেছিলেন। যথেষ্ট বিষয়বুদ্ধি ছিল বলেই কোথাও কোনো ক্ষতির মুখে পড়েননি। ব্যাংকে মোটা অংকের টাকা গচ্ছিত রেখেই তিনি বিদায় নিতে পেরেছিলেন। ফলে, ঋভুকে কোনোদিনই কোনো সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়নি।

উত্তরাধিকারসূত্রে অনেক সম্পদের মালিক হলে যে কিছু করা যাবে না, তা তো নয়। এদেশের অনেকেই তো উত্তরাধিকারসূত্রে ধনাঢ্য, তবু তারা নতুন নতুন উদ্যোগ নেয়। কিছু-না-কিছু করার চেষ্টা করে। যদিও সে ওদের মতো ধনাঢ্য নয়, তবু স্রেফ শুয়ে-বসেই কাটিয়ে দিলো জীবন। অংশুর জীবন যদি হয় তাৎপর্যময়, তাহলে তার জীবনকে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় তাৎপর্যহীন। তাতে তার আপত্তি নেই। এই জীবন সে নিজেই বেছে নিয়েছে। তাৎপর্যহীন জীবনও তো কেউ কাটাতে চাইতেই পারে, সচেতনভাবেই চাইতে পারে। নাকি?

অবন্তি একটানা কথা বলে যাচ্ছিল, ঋভু কিছু শুনছিল, কিছু শুনছিল না। যেটুকু শুনছিল তাতেও সাড়া দিচ্ছিল না, সে ডুব দিয়েছিল একান্ত নিজস্ব ভুবনে, যেখানে কারো প্রবেশাধিকার নেই। কিন্তু অবন্তি এত সহজে ছাড়ার পাত্রী নয়। যখন সে বুঝলো, ঋভু তার গল্প শুনছে না, গায়ে ধাক্কা দিয়ে বললো, এই কী হলো তোমার?

কই, কিছু না তো!

আমি যে এত কথা বলে যাচ্ছি, তুমি তো শুনছই না।

শুনছি তো!

না শুনছ না! বলো তো, একটু আগে কী বলছিলাম?

ঋভু বিপদে পড়ে গেল, অবন্তি দাম্পত্যজীবন নিয়ে কিছু একটা বলছিল। কিন্তু কী বলছিল, কার দাম্পত্যজীবন নিয়ে বলছিল, সে আসলেই শোনেনি। তবু ঝুঁকি নিয়ে বললো – তুমি অংশু-অপলার দাম্পত্য জীবন নিয়ে বলছিলে।

হ্যাঁ। শুনেছ তাহলে! তোমার কী মনে হয়?

কোন বিষয়ে?

এই যে দাম্পত্যজীবন নিয়ে!

প্রশ্নটা আরেকবার করো।

অবন্তি একটা দীর্ঘশ^াস ছাড়লো। তার সন্দেহই ঠিক, ঋভু কিছুই শোনেনি। তবু সে বললো – ওদেরকে দেখে আমার মনে হলো, দাম্পত্যজীবন খুব একটা খারাপ ব্যাপার না। তোমার কী মনে হয়?

খারাপ হতে যাবে কেন? ভালোই তো!

তাহলে তুমি ছেড়ে দিলে কেন?

কী ছেড়ে দিলাম?

তোমার বউকে!

প্রশ্নটা তো আমিও তোমাকে করতে পারি। তুমি কেন ছাড়লে?

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই করতে পারো। কিন্তু আমি আগে জানতে চেয়েছি …

ঋভু চুপ করে রইলো।

অবন্তি বললো – অবশ্য ব্যাপারটা তোমার একান্তই ব্যক্তিগত। না বলতে চাইলে …

না, সেজন্য নয়। তোমার সঙ্গে ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ তো শেয়ার করাই যায়। কিন্তু কী যে বলবো ভেবে পাচ্ছি না।

ছাড়াছাড়ির কারণটা বলো।

তিক্ত সম্পর্কের চেয়ে একাকিত্ব তো ভালো, না?

তোমাদের সম্পর্ক কি তিক্ত হয়ে গিয়েছিল?

না, হয়নি। তবে হওয়ার দিকে যাচ্ছিল।

শুধু এই সম্ভাবনার জন্যই …?

ঠিক তা নয়। আমাদের সম্পর্কটা শীতল ধরনের ছিল, কোনো উষ্ণতা ছিল না। দুজনের বিশেষ কথাবার্তাও হতো না।

কেন?

এটা বলা মুশকিল। দোষটা বোধহয় আমারই।

কার দোষ তা জানতে চাইনি। আচ্ছা, সম্পর্ক তিক্ত হয় কেন বলো তো!

নানা কারণে।

যেমন?

যেমন অভিযোগ।

অভিযোগ! কী রকম?

কিছু মানুষ আছে না যারা কেবলই অভিযোগ করে যায়? কেন আমার ফোন ধরলে না, কেন দিনটার কথা মনে রাখলে না, এইসব টুকিটাকি থেকে শুরু করে বড়সড় অভিযোগও …

অভিযোগ হিসেবে না নিয়ে প্রশ্ন হিসেবে নিলেই হয়। প্রশ্নগুলোর উত্তর দিলেই হয়।

না, হয় না। প্রশ্ন আর অভিযোগ তো এক ব্যাপার নয়!

হুম। বুঝলাম। কিন্তু কেবল অভিযোগ থেকেই তিক্ততার সৃষ্টি হয়?

না, কেবল অভিযোগের কথা তো বলিনি।

আর কী কী?

যেমন রাগ, ক্রোধ।

রিনির মধ্যে কি এগুলি ছিল?

না, ছিল না।

এগুলি তো মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, না? থাকলেও দোষের কিছু হতো না।

হ্যাঁ, স্বাভাবিক তো বটেই। কিন্তু ভালো কিছু দেয় না।

তা ঠিক। কারো ক্রোধের শিকার হলে মনে যে দাগ পড়ে তা কখনো মুছে যায় না।

এমনকি দুঃখ প্রকাশ করলেও না।

হ্যাঁ। এমনকি ক্ষমা চাইলেও না।

অবশ্য ক্ষমা করে দিতে পারলে খুব আনন্দ হয়, হয়তো দাগটাও চলে যায়।

ক্ষমা তো অত সহজ ব্যাপার নয়। ক্ষমা করতে জানে অসাধারণ মানুষরা।

হ্যাঁ। তা ঠিক। তবে, অসাধারণ মানুষরা কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে না। সাধারণ মানুষের মধ্যেই থাকে অসাধারণের সম্ভাবনা।

আচ্ছা, ঘৃণা থেকে তিক্ততা হয় না?

তা তো হয়ই। কিন্তু ঘৃণাটা হলো ফলাফল। কারণ হিসেবে একে চিহ্নিত করা যায় না।

কী রকম?

যেমন ধরো ক্রোধ থেকে ঘৃণা আসে, ক্ষোভ থেকে ঘৃণা আসে, তিক্ততা থেকে ঘৃণা আসে।

তার মানে ঘৃণাই হাইয়েস্ট ফর্ম অফ পয়জন?

তা বলতে পারো।

জানো, আমার মধ্যে ওই বিষটা ঢুকে পড়েছিল। জামিলকে আমি ঘৃণা করতাম।

ও! তোমাদের ছাড়াছাড়ির কারণ তাহলে এই!

হ্যাঁ। আমি কি ভুল করেছি?

তা আমি কীভাবে বলবো। বিচার করার আমি কে?

ভুল করিনি বোধহয়। আমি তো ভালোমন্দ-দোষত্রুটি মেশানো মানুষই। মহামানব তো আর নই যে নিঃশব্দে ভালোবেসেই যাবো চিরদিন।

হুম।

মহামানবদের নাকি বিরল সব গুণ থাকে। কিন্তু তারাও তো মানুষ। আচ্ছা তুমি কি মনে করো যে মানুষের পক্ষে মোহ, কামনা, লোভ, ঘৃণা, ক্রোধ এইসব থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব?

ঋভুর মনে হলো, সুসান কেবল বলার জন্যই কথা বলে যাচ্ছে, অর্থহীন সব আলাপ। তবু সে উত্তর দিলো – না, পুরোপুরি মুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। তবে কমিয়ে আনা যায় বোধহয়। যথেষ্ট পরিমাণ কমে গেলে যেটুকু থাকে সেটা ততটা ক্ষতিকর হয় না।

তুমি কি সেই স্তরে পৌঁছে গেছ?

হা-হা-হা-হা …

হাসছো কেন?

হা-হা-হা …

এত হাসির মতো কী বললাম?

তুমি কি আমাকে সাধুসন্ত ঠাউরাচ্ছো?

অনেকটা সেরকমই।

মোটেই সেরকম না।

প্রমাণ কী?

এই যেমন, আজকে দুপুরে যখন তোমার সঙ্গে দেখা হলো তখন নিজের ভেতরে ভীষণ এক কামনার অস্তিত্ব টের পেলাম।

তারপর?

তারপর আবার কী?

কেবল অস্তিত্বই টের পেলে? প্রকাশ করলে না?

না, করলাম না।

কেন করলে না?

আমি যে ওরকমই।

কিন্তু পুরুষদের চোখে তো কামনা ফুটে ওঠে …

তুমি কিন্তু আজকে আমার চোখের দিকে তাকাওনি!

তাও খেয়াল করেছ?

করবো না!

আমার তো মনে হচ্ছিল তুমি আমার কিছুই দেখছো না।

কেন মনে হচ্ছিল?

তোমার চোখের দৃষ্টিতে দূরবর্তী একটা ব্যাপার আছে। মনে হয় দূরে কোথাও তাকিয়ে আছো। আগে এটা ছিল না।

ঋভু অস্বীকার করলো না, ওরকম কিছু ব্যাপার তার মধ্যে থাকতেও পারে। তুমুল আড্ডার সময়ও সে কখনো কখনো

পালায়, দূরে কোথাও। তখন হয়তো সে তাকিয়ে থাকে, কিন্তু কিছুই দেখে না; শব্দ কানে যায়, কিন্তু কিছুই শোনে না। অংশুর বাসা থেকে বেরিয়ে আসার পরও বেশ কিছুক্ষণ তার এই অবস্থা ছিল। কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে কথা হচ্ছে, অন্তরঙ্গ সব আলাপ, উদাসীন থাকা যায় না তো। সে তাই হাসিমুখে অবন্তির চোখে তাকিয়ে বললো – এবার দেখ তো, কিছু দেখতে পাও কি না!

অবন্তিও অনেকক্ষণ চোখে চোখ রেখে কী যেন দেখলো, তারপর লাজুক হেসে চোখ ফিরিয়ে নিলো।

ঋভু বললো – কী দেখলে?

বলবো না। – মৃদু হেসে বললো অবন্তি।

না, বলতেই হবে।

যাও … বলতে পারবো না আমি।

ঋভু দেখলো, গাড়ি এসে তার বাসার গেটে দাঁড়িয়েছে।

ওহ এসে গেছি! – বললো সে – এত তাড়াতাড়ি পথ ফুরিয়ে গেল!

অবন্তি ফের তার চোখে চোখ রাখলো, কিন্তু কিছু বললো না। ঋভুই বললো – নামবে না?

তুমি না বললে কীভাবে নামবো!

চলো …

একটু ভাবলো অবন্তি, বললো, ভাবিকে একটু ফোন করে জানাই, হ্যাঁ? নইলে চিন্তা করবে।

জানাও।

ফোন করলো অবন্তি, জানালো, আসতে আরেকটু দেরি হবে ভাবি। ড্রাইভারকে কি ছেড়ে দেবো?

না, ছাড়ার দরকার নেই। ও অপেক্ষা করুক।

আচ্ছা, ভাবি।

করিম গেট খুলে দিয়েছে, মতিন গাড়ি নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। ঋভু বললো, মতিনের খাওয়ার ব্যবস্থা করো তো করিম।

জি আচ্ছা স্যার।

অবন্তিকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো ঋভু। চাচিকে ডেকে বললো, সুসান এসেছে চাচি। রাতে খেয়ে যাবে।

আজকে অংশু আসে নাই যে!

এতক্ষণ ওর বাসাতেই আড্ডা দিলাম। তাই আর বেরোয়নি।

ও আচ্ছা। এখন কি নাস্তা দেবো?

নাস্তা খেয়েছি চাচি, এখন আর কিছু দিয়ো না। একবারে ডিনার করবো।

আচ্ছা ঠিক আছে।

অবন্তিকে নিয়ে দোতলায় এলো ঋভু। কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বললো, চলো।

কোথায়?

আজকে আর ব্যালকনিতে বসতে দেবো না।

মৃদু লাজুক হাসলো অবন্তি, কিছু বললো না।

বেডরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো ঋভু। অবন্তি

ফিসফিসিয়ে বললো, কেউ কিছু মনে করবে না?

করলে করুক। ওসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।

দু-হাত বাড়িয়ে অবন্তিকে জড়িয়ে ধরলো ঋভু, অবন্তিও আলিঙ্গন করলো ঋভুকে। ঋভুর ঠোঁট নেমে এলো অবন্তির অধরে, তারপর গালে, চিবুকে, গলায়, ঘাড়ে। গভীর আবেশে চোখ বুজে রইলো অবন্তি, বোঝাই যাচ্ছে, উপভোগ করছে সে এই কাক্সিক্ষত আদর। কী ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে পারছিল সে, তবু যখন তার শাড়ির আঁচল আলগোছে সরিয়ে ব্লাউজের বোতামে হাত রাখলো ঋভু, সারা শরীর কেঁপে উঠলো তার। শাড়িটা খুলে দূরে সরিয়ে রাখলো ঋভু, তারপর পাঁজাকোলা করে অবন্তিকে নিয়ে গেল বিছানায়। চোখ বন্ধ করে রেখেছিল অবন্তি, ঠোঁটে মৃদু হাসি, মনের ভেতরে ঝড় বইছে সেই প্রথম যৌবনের মতো, কখন যে নিরাভরণ হয়ে গেছে টেরই পায়নি। শরীর জুড়ে ঋভুর চুম্বন-বৃষ্টি ঝরতে লাগলো। তারপর দু-হাতে তুলে নিল দুই স্তন। অবন্তির শরীরের প্রতিটি রোমকূপ যেন সাড়া দিচ্ছে ঋভুর আদরে, ঠিক এমন করেই সাড়া দিয়েছিল তার শরীর সেই লেখকের সঙ্গে সঙ্গমের সময়, তারপর আর কখনো দেয়নি। ঋভু আসলে আশা করেনি, অবন্তির শরীর এখনো এমন সুগঠিত থাকবে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শরীর তার লাবণ্য হারায়, কিন্তু অবন্তি হারায়নি। এখনো তার শরীর তিরিশ বছর বয়সী যুবতীদের মতো, এখনো তার স্তন ভরাট এবং সুগঠিত, নুইয়ে পড়েনি মোটেও। হয়তো সেজন্যই অমন পাগলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সে, এবং আদর করতে করতে নিজের উত্থানও অনুভব করতে পারছিল। অনেকক্ষণ আদর খেয়ে অবন্তি ফিসফিসিয়ে বললো, এবার আমি। ঋভু বোঝেনি প্রথমে, একটু পরই দেখলো, অবিন্ত নিজেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সেও চুমুর ঝড় বইয়ে দিলো, সর্বাঙ্গে আদর করলো অনেকক্ষণ ধরে। অধীর হয়ে উঠলো ঋভু, হয়তো সেটি বুঝতে পেরে অবন্তি আবার ফিসফিসিয়ে বললো, এবার এসো। ঋভু প্রবল বেগে ঢুকে পড়লো অবন্তির ভেতরে। দুজনের মুখেই ছুটলো সø্যাং আর শীৎকারের বান। তারপর একসময় সত্যিই বান নেমে এলো ঋভুর শরীর থেকে, ভিজে চুপচুপে হয়ে গেল অবন্তি। ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত দুজনেই, হাঁপাচ্ছে; কিন্তু মুখে তৃপ্তির হাসি। অবন্তি দুই হাতে ঋভুর মুখটা ধরে দীর্ঘ চুম্বনে সিক্ত করে দিলো, ফিসফিসিয়ে বললো, থ্যাংক ইউ।

পরস্পরকে ছাড়লো না তারা, জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইলো আরো অনেকক্ষণ।

অবন্তি বললো, এবার ওঠো, ফ্রেশ হয়ে এসো।

ঋভুর উঠতে ইচ্ছে করছে না। সে জানে, কিছুক্ষণ পরই সে আবার জেগে উঠবে। এটাই তো তার প্রথম অভিজ্ঞতা নয়, এর আগে তিনজন নারীর সঙ্গে সে মিলিত হয়েছে, প্রতিবারই সে দেখেছে, একবারে হয় না তার, কমপক্ষে দুবার হতে হয়। অবশ্য দুবারের বেশিও হয়েছে কখনো কখনো, একটু বেশি সময় পেলে। কিন্তু এখন তো সে সুযোগ নেই, তারা তো আর একসঙ্গে থাকছে না। রাতও বাড়ছে, অবন্তিকে ফিরতে হবে।

ঋভু বললো, তুমি আগে যাও।

আচ্ছা।

অবন্তির পর ঋভুও গেল ওয়াশরুমে, ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো অবন্তি ততক্ষণে শাড়ি পরে ফেলেছে।

ঋভু এসে জড়িয়ে ধরলো ওকে, বললো, খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে।

এতক্ষণে তোমার এই কথা মনে হলো?

না, সুন্দর সবসময়ই লাগে, কিন্তু এখন অন্যরকম লাগছে। এরকম কখনো দেখিনি।

সুন্দর না, বলো সুখী লাগছে। আমাকে কখনো এতটা সুখী হতে দেখনি।

তৃপ্তির হাসি খেলে গেল ঋভুর ঠোঁটে। করতলের ভেতরে অবন্তির মুখটা ধরে চুমু খেলো ফের, তারপর বললো, চলো ডিনারটা সেরে ফেলি।

না খেলে হয় না?

এত রাতে না খেয়ে যাবে?

ভাবি অপেক্ষা করবে যে!

ভাবিকে জানিয়ে দাও।

আচ্ছা, ঠিক আছে।

একটা ঘোরের মধ্যে ছিল অবন্তি। ভাবছিল, দিনের শুরুটা ছিল অভিমানে ভরা আর শেষটায় এলো অপ্রত্যাশিত এক আনন্দের জোয়ার। শারীরিক সম্পর্ক তো তার কাছে নতুন নয়, কিন্তু ঋভুর সঙ্গে হঠাৎ করে এভাবে কিছু ঘটে যাবে, ভাবতেও পারেনি। খেতে বসেও বেশি কথা বললো না সে, যেমনটি বলেছিল গতকাল। খেলোও না বেশি। ঋভুর দিকে চোখ তুলে তাকাতে কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগছে, এমনকি চাচির দিকেও ভালো করে তাকাতে পারছে না সে; মনে হচ্ছে, উনি বুঝে ফেলেছেন সবকিছু। এই সময় অংশু থাকলে ভালো হতো। ইয়ার্কি-দুষ্টুমি করে একটু সহজ করে তুলতে পারতো তাকে। নিজের এই অনুভূতির কারণও বুঝতে পারছে না অবন্তি। যতটা লজ্জা পাচ্ছে, ততটা লাজুক সে নয়। শরীরবিষয়ক সংস্কারগুলো সে কাটিয়ে উঠেছে বহু আগেই, সেই যে তার তরুণ বয়সে, যখন সে এক লেখকের শয্যায় গিয়েছিল স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে। বিবাহিত জীবনেও অনিবার্যভাবে শরীরে শরীর মিশে গেছে, এমনকি জামিলের সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পরও সে একজনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিল। প্রেমের নয়, শরীরের সম্পর্ক। ভালো লাগেনি বেশিদিন। সত্যি বলতে কি, তার যৌবনের দ্বিতীয় চূড়া – যা এসেছিল মধ্য তিরিশে – কেটে গেছে পুরুষের স্পর্শবিহীন অবস্থায়। তখন খুব ইচ্ছে করতো কারো সান্নিধ্য পেতে, শরীর পুড়ে যেত কামনার তীব্রতায়, এখন আর সেই তীব্রতা নেই, তবু কী অসামান্য কুশলতায় ঋভু ফিরিয়ে আনলো তার ভরা যৌবনের অনুভূতি! সত্যি, এই বয়সে এই অভিজ্ঞতার তুলনা হয় না।

প্রায় নিঃশব্দেই খাওয়া-দাওয়া শেষ করলো তারা। ঋভু বললো – চলো ওপরে যাই।

চকিতে একবার ঋভুর চোখের দিকে তাকালো অবন্তি, কী যেন একটু ভাবলো, তারপর বললো, ওপরে আর না গেলাম। রাত হয়ে গেছে, বাসায় যাই।

তা তো যাবেই। আরো কিছুক্ষণ থাকো। চলো ওপরে গিয়ে ব্যালকনিতে বসি। চা খাবে? দিতে বলবো?

যেন সম্মোহিত হয়ে আছে অবন্তি। ডিনারের পর চা খাওয়ার অভ্যাস নেই তার, তবু বললো, হ্যাঁ বলো।

ঋভু চাচিকে চা পাঠাতে বলে অবন্তিকে নিয়ে ওপরে গেল।

চা এলো একটু পরই। চুমুক দিতে দিতে অবন্তির মনে হলো, ব্যালকনিটা সত্যিই সুন্দর। কালকে যতটা সুন্দর মনে হয়েছিল, তারচেয়েও সুন্দর। ব্যালকনি থেকে বাড়ির তিন পাশ দেখা যায়। প্রচুর গাছপালায় ছেয়ে আছে বলে ঠিক ঢাকা শহরের বাড়ি বলে মনে হয় না। মনে হয়, এক নির্জন মফস্বল শহরের প্রান্তবর্তী কোনো নির্জনতম বাড়ি। রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে অবন্তি দেখছিল সব, ঋভু পেছন থেকে তার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়ালো। বললো, একদম চুপ করে আছো! কী ভাবছ এত?

ঋভুর চোখে গভীরভাবে তাকালো অবন্তি, যেন কিছু খুঁজছে সেখানে।

কী হলো তোমার?

ভাবছি।

কী ভাবছো?

এখন বলতে পারবো না।

কেন, কী এমন কথা যে বলা যাবে না?

বলা যাবে, তবে এখন না।

কেন?

গুছিয়ে উঠতে পারছি না।

এত গুছিয়ে বলতে হবে না। এমনিই বলো।

না, এমনিই বলা যাবে না।

আচ্ছা, বলতে হবে না। এখন চলো।

কোথায়?

ঋভু আচমকা পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নিল অবন্তিকে।

দু-হাতে ঋভুর গলা পেঁচিয়ে ধরে ‘এই কী হচ্ছে কী হচ্ছে’ বলতে বলতে হাসতে লাগলো অবন্তি।

দুষ্টুমির হাসি হেসে ঋভু বললো, দেখাচ্ছি কী হচ্ছে।

বেডরুমে নিয়ে এসে বিছানায় শুইয়ে দিলো ঋভু। শাড়ির আঁচল সরিয়ে ঠোঁট রাখলো বুকে।

তোমার হলো কী! – ফিসফিসিয়ে বললো অবন্তি।

আরেকবার হয়ে যাক।

আবার!

হ্যাঁ।

এই না না। কাপড়চোপড় পরে ফেলেছি তো!

তাতে কী, আবার পরবে।

অবন্তিকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না ঋভু। শাড়ি খুলে ছুড়ে মারলো দূরে। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়লো বাঘের মতো। অবন্তি বাধা দিলো না। তার মজা লাগছে। এত অল্প সময়ের মধ্যে দ্বিতীয়বার! সে ভাবতেই পারছে না। কিন্তু ঋভু এবার আগের চেয়ে আগ্রাসী, প্রবল বিক্রমে ঢুকে পড়লো তার ভেতরে। অবন্তির সমস্ত শরীর একসঙ্গে কথা বলে উঠলো। তীব্র, আবেগময়, গভীর তৃপ্তিদায়ক এক সঙ্গমের অভিজ্ঞতা হলো দুজনের। ঋভুর যখন স্খলন হলো, অবন্তি হাসছিল তখন, বললো : মনে হচ্ছে বাঁধ ভেঙে বানের জল ঢুকে পড়ছে হুড়মুড় করে। এতখানি কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলে শুনি?

তোমার জন্য জমিয়ে রেখেছিলাম।

হুম। এরকম আগ্রাসী পুরুষ ছেড়ে বউ যায় কীভাবে?

সে যে আমার সুসান ছিল না!

হ্যাঁ, সুসান এরকম সুপুরুষ ছেড়ে কোনোদিনও যেত না। রিনি একটা গাধা মেয়ে।

ঋভু কিছু বললো না। রিনির সঙ্গে এরকম আগ্রাসী সঙ্গম হতো না, ও একেবারেই অংশ নিতো না, চুপচাপ পড়ে থাকতো। আনন্দ হতো না সেসব মিলনে, বরং গ্লানি হতো। কিন্তু সেসব কথা এখন মনে করতে চায় না ঋভু। এখন কেবল সুসানই থাকুক, অন্য সবাই বাতিল।

অনেকক্ষণ দুজনের খুনসুটি চললো। একসময় অবন্তি বললো, আজকে যেতে দেবে না, নাকি?

তোমাকে ছাড়তে ইচ্ছে করছে না।

আমারও যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু উপায় নেই তো! আজকে যাই, হ্যাঁ?

আচ্ছা। ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসবো।

তুমি? না, তোমাকে যেতে হবে না।

এত রাতে একা যাবে!

একা কোথায়, মতিন আছে তো! ও খুব বিশ^স্ত।

আচ্ছা। ঠিক আছে। ফ্রেশ হয়ে নাও।

অবন্তিকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য গাড়ি পর্যন্ত গেল ঋভু।

ড্রাইভারকে বললো, সাবধানে যেয়ো, মতিন। অবন্তিকে বললো, পৌঁছে জানিয়ো।

অবন্তি বুঝলো, ঋভু ঠিক স্বস্তি পাচ্ছে না তাকে একা ছাড়তে। মানে, ড্রাইভারকেও বিশ^াস করতে পারছে না। এই শহরের সবাই কি এরকম অদ্ভুত নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে? সবসময় এরকম সাবধান থাকতে হয়? আশ্চর্য!

রাস্তা একদম ফাঁকা, অথচ ঘড়িতে কেবল সাড়ে এগারোটা, উপরন্তু আজ বৃহস্পতিবার রাত। মানে, উইকএন্ড শুরু হলো। পশ্চিমা দেশগুলোতে উইকএন্ড শুরু হলে সারারাত হই-হল্লা চলে। নাইট-ক্লাব, বার আর জুয়ার আসরগুলি জমজমাট হয়ে ওঠে। রাস্তাঘাটে দলবেঁধে ঘুরে বেড়ায় তরুণ-তরুণীরা। যেন কোনো উৎসব। একসময় এই শহরও সারারাত জেগে থাকতো, শুধু উইকএন্ডে নয়, সারা সপ্তাহই; আর এখন ন’টার পর থেকেই নিঝুম হয়ে পড়ে। দেখে মনে হয়, যেন এক দুর্যোগ নেমে এসেছে শহরবাসীর জীবনে, সন্ধ্যা হতে-না-হতেই তাই ঘরের নিরাপদ ঘেরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে সবাই। অবশ্য এরকম নির্জন শহর অবন্তির ভালো লাগে। এই নিয়ে পরপর তিনদিন সে গভীর রাতে বাড়ি ফিরছে। প্রথম দুদিন অংশু ছিল সঙ্গে, গল্পে গল্পে সময় কেটে গেছে। আজকে একলা। একটু নিবিড়ভাবে ভাববার সুযোগ এলো তার।

সে অনুভব করতে পারছে, ঋভুকে নিয়ে যে দ্বিধা ছিল তার, তা কেটে গেছে। তাকে পাওয়ার তীব্র আকাক্সক্ষা না থাকলে ঋভু এত আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারতো না। শুধু আকাক্সক্ষা নয়, সম্ভবত খানিকটা আক্রোশও ছিল, হয়তো সেজন্যই দ্বিতীয়বার আরো বন্য হয়ে উঠেছিল ও। দ্বিতীয়বার না হলে যেন কিছুটা অপূর্ণতা রয়ে যেত, মনে হলো অবন্তির। একেবারে কানায় কানায় ভরে দিয়েছে তার দেহ এবং মন। ঋভুর দৃশ্যমান চরিত্রের সঙ্গে ওই সময়কার আচরণ একেবারেই মেলানো যায় না। অবশ্য সব পুরুষই বাইরে একরকম, বিছানায় আরেকরকম। হয়েতো নারীরাও তাই। ঋভুর আকাক্সক্ষার কথা ভেবে অবন্তির মনে হলো, ও সবসময়ই তাকে পেতে চেয়েছে, কিন্তু স্বভাবের কারণে প্রকাশ করতে পারেনি। কিন্তু আক্রোশের কারণ কী? ওটা কি তাকে না পাওয়ার বেদনা থেকে উৎসারিত? যদি জিজ্ঞেস করে সে ঋভুকে, ও কি বলবে সত্যি কথাটা? যা হোক, কারণ যাই হোক না কেন, ওই আকাক্সক্ষা আর আক্রোশ, আজকের এই আকস্মিক মিলন অবন্তির মন থেকে অনেক দ্বিধা দূর করে দিয়েছে। অন্তত, ঋভু তাকে চায় কি না, এই দ্বিধা একেবারেই নেই। শরীর অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেয়। ঋভু যদি মুখে এই কথা শতবারও বলতো তবু তার ভেতর থেকে সংশয় যেত না, অথচ ওই যে সমগ্র শরীর একসঙ্গে কথা বলে উঠলো দুজনেরই, তখনই যেন বলা হয়ে গেল বহুকালের জমানো না-বলা সব কথা। যতবার মনে পড়ছে তার সেসব কথা, ততবার লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে সে, শরীরে বয়ে যাচ্ছে আনন্দময় শিহরণ।

সকালে মন ভার করে বাসা থেকে বেরিয়েছিল, রাতে ফিরলো পরিপূর্ণ সুখী চেহারা নিয়ে।

যথারীতি দরজা খুললো আফসানা। পিছে পিছে এলো রুম পর্যন্ত, তারপর বললো, কী ব্যাপার আজকে তোমাকে এত খুশি খুশি লাগছে?

অবন্তি আহ্লাদ করে ভাবির গলা জড়িয়ে ধরলো, দুষ্টুমির হাসি হেসে বললো – কারণ নিশ্চয়ই আছে।

কারণটাই তো জানতে চাইছি।

উঁহু, এখন তোমাকে বলা যাবে না।

এখন বলা যাবে না? তো, কখন বলবে শুনি?

ধৈর্য ধরো বৎস, যথাসময়ে সব জানিতে পারিবে।

আফসানা হেসে ফেললো, আচ্ছা। যথাসময়ের অপেক্ষায় রইলাম। কিছু খাবে এখন?

আরে না। যথেষ্ট খেয়েছি।

কী খেলে?

আবার দুষ্টুমির হাসি খেলে গেল অবন্তির ঠোঁটে, বললো – হরেক রকমের খাবার। শুধু পেট না, সারা শরীর ভরে আছে!

হাসিটা আফসানার চোখ এড়ালো না, এমনকি গলায়, ঠোঁটে, কাঁধে হালকা কামড়ের দাগও। মুচকি হেসে বললো, ঠিক আছে, এখন লক্ষ্মী মেয়ের মতো ঘুমিয়ে পড়ো। আমিও ঘুমাতে যাই। কালকে মেলা কাজ।

কালকে? কিসের কাজ?

ও মা! ভুলে গেছ! সবাই না কালকে বাসায় আসবে!

ও হ্যাঁ। সত্যিই ভুলে গিয়েছিলাম। ঠিক আছে, তুমি যাও, আমি একটু ফ্রেশ হয়ে ঘুমাবো।

আফসানা চলে গেল, কিন্তু অবন্তি বিছানা থেকে উঠলো না। সঙ্গমের পর স্নানের অভ্যাস তার, কিন্তু এখন সেটি করতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে, স্নান করলেই ঋভুর স্পর্শ-গন্ধ মুছে যাবে, মিলিয়ে যাবে আদরের দাগগুলিও। এত তাড়াতাড়ি ওগুলি সরিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে না। থাকুক না হয় ওগুলি, যতক্ষণ ইচ্ছে থাকুক। (চলবে)