লবণ বাতাসের সমুদ্র খাঁড়িতে ওদের সেটা তৃতীয় দিন।

আগের দুটো দিন গেছে হইচইয়ে। বড় একটা দল। বেশির ভাগ নিজেদের চেনা, অনেক বছরের চেনা, তাদের আউটিং। এখন তো এও এক আমোদ। শহর থেকে দূরে রাত্রিবাস, মোচ্ছব, রি-ইউনিয়ন। সেসবে আগের দুদিন। টানা। সেদিন সকাল থেকে সমুদ্র শান্ত।

সমুদ্র কি শান্ত! সকালবেলা ভাটায় সরে যাওয়া সাগর দেখে ওদের তেমনই মনে হলো। গত দুটো দিনের টানা হুল্লে­াড়, গান, পৃথুলা নাচ, পানজনিত আবৃত্তি। সাগরও যেন মেতে উঠেছিল সঙ্গে। নতুন গজিয়ে ওঠা এই তট সংলগ্ন কয়েকটি কটেজে সাত-আটটি পরিবার। তাদের লাগামহীন গুলজার। দিনরাতের কাব্য। তবে সেদিন ভোর থেকে তা উধাও।

মাঝারি আকারের সাদা যে-বাসটি এসেছিল তাতে চড়ে পরিকল্পনামাফিক ট্যুরের ইতি ঘটেছে প্রায় সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে। সকালে তাই ফাঁকা কটেজ, বাতাস শান্ত। উঠোনে পাতা মাদুরের মতো ভাটার সমুদ্র বিছিয়ে শুয়ে আছে দূরে। ওরা দুজনে রয়ে গেছে। পাঁচ বছরের কন্যাটিসহ। ওরা বেরোবে পরের দিন। এবং এটুকুও পরিকল্পনা অনুযায়ী।

মাসখানেক আগে জায়গা খুঁজতে আরো কজনের সঙ্গে এখানে এসেছিল অনুপম। আগাম জেনেছিল একটু। সেই প্রথম এসেই পছন্দ। তখন থেকে মাথায় এ-দিনের ভাবনা। দুদিনের বাইরে সদ্য তৈরি হওয়া জায়গাটিতে বাড়তি একদিন থাকা, শুধু ওরা তিনজন। সেই ভাবে বুকিং।

তবে এদিনের সকালে কেমন বাড়তি নৈঃশব্দ্য। ফাঁকা। মফস্বলের মাঠ থেকে যাত্রাপালা বা সার্কাস বিদায় নিলে পরদিন সেই মাঠ যেমন লাগত শৈশবে, খানিক তেমন। আগের রাতেও হইচই, উচ্চ ডাক, গান তখন শূন্য। ইন্দ্রাণী আর অনুপম বালুতটে হেঁটে বেড়ায়। প্রশ্নমতী মেয়েটি এগিয়ে পিছিয়ে, কখনো গায়ে গায়ে।

ওদের কটেজের পেছন থেকে পাড় ধরে দুদিকে রওনা হয়ে গেছে গায়ে গা লাগানো ঝাউয়ের সার। অনেক দূর পর্যন্ত। খানিকটা সহজ পাঠের ত থ দ ধ দলে দলে বোঝা নিয়ে হাঁটে চলে, নন্দলাল বসুর সাদা-কালো ছবি। ঝাউয়েরা যেন পাতার বোঝা নিয়ে হাট করতে চলেছে দিগন্তের দিকে। দুপাশেই। হেঁটে খানিক এগিয়ে অনুপম আর ইন্দ্রাণীর চোখে পড়ে একদিকে ঝাউ সারির পেছনে এলোমেলো কয়টি ঘর। বেড়া বা মাটির খাপছাড়া, নিশ্চিত জেলে বসত। গত দুদিনে যখন পারিপার্শ্বিকে কারো মন ছিল না, বন্ধু রজত তখন শেষ বিকেলে অনুপমকে ডেকে দেখিয়েছিল দূরে দুটি বড় জেলে নৌকোর ঢেউ ঠেলে পাড়ে লাগার চেষ্টা। পাড়ে দাঁড়িয়ে কয়েকজন শরীর পেছনে বাঁকিয়ে নৌকোয় বাঁধা দড়ি টেনে যাচ্ছিল। তাদের কৃশ অবয়ব। রজত জানাতে আরো কজন বাইরে এলো, ক্রমশ সবাই।

স্মার্টফোনে ছবি উঠে গেল পরপর। ছবি ছড়াল। ফলে সন্ধের মধ্যে লাইক, কমেন্টের বন্যা। কোথায়? কবে গেলে? আমরা নেই কেন? গতের মন্তব্য আরো যা যা হয়। ফেসবুক অবশ্য রাত পোহালেই বাসি। ফলে সকালে আবার নতুন কোনো ছবি।

অথচ এই রজত, অনুপমদের বন্ধু, বছর পনেরো আগে গড়চুমুক না কোথায় গিয়ে সাত সকালে গঙ্গা পার হওয়া নৌকোর স্কেচ এঁকেছিল। ভাঙা ইটের ঘাটের ওপর বসে। ওকে কেউ আঁকতে বলেনি। কেউ না-আঁকতেও নয়। ওর মনে হয়েছিল তাই। চওড়া ডায়েরির পাতায় কালো ডট পেনের উপোঝুপো দাগ। দলের আরো অনেকের মতো তখন খানিকটা রোগা ছিল ও। সরু ডট পেনের দাগ ছুটছিল এ-মাথা ও-মাথা, খানিকটা ওর সেদিনের স্বভাবের মতো। মনীষা কি গান গাইছিল পেছনে! উঁচু পাড়ে, স্ব-ইচ্ছায়, মেঘ বলেছে যাব যাব … ! সে তখন রজতের প্রেমিক, ওদের যাবতীয় কোলাহলে সঙ্গী। অথচ বছর তিনেক পর তেমন কারণ ছাড়াই হঠাৎ আত্মঘাতী। কেন, কেউ জানতে পারেনি।

জীবন অবশ্য এখন অতীতের আরো অনেক কেন-কে পেছনে ফেলে এসেছে। সন্ধের হল্ট স্টেশানের মতো নির্জন অন্ধকারে অতীতকে বসিয়ে রেখে সরে এসেছে এত দূর। প্রতিষ্ঠা আর প্রাচুর্য যাত্রায়। মেদ সঞ্চয়ে আর ভুলে যাওয়ায়। অ্যাপ, ক্যাব, ট্যাবের টোকায়। হয়তো এই বদলকে দেখায় এবং নেচে-গেয়ে তাকে অস্বীকার করতে চাওয়াতেই ওদের এই সব রি-ইউনিয়ন।

পরদিন সকালে রজত নেই, রজতেরা নেই, ইন্দ্রাণী বলল, আমরা কত দূর যাব এভাবে হেঁটে?

অনুপম বলল, আজ সারাদিন নো গন্তব্য। পা যখন চাইবে না, কিংবা মন, তখন ফেরা। বসবে কোথাও?

কোথায়?

এই বালিতে।

শাড়ি ভিজে যাবে না!

এদিকের বালি শুকনো। অবশ্য ভেজা থাকলেই বা কি!

বালিতে বসে ইন্দ্রাণী ফেরাল গত দুদিনের কথা। টানা-সঙ্গের অবসেশন সকালের বাতাস তখনো ওর কাছ থেকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। ইন্দ্রাণী বলল, তোমার কাছে রজতদার যেমন সব গল্প শুনেছি তার সঙ্গে আজকের উনি কি মেলেন! জল খেতে গেলেও এখন বউদির পারমিশান। অথচ ইনিই নাকি …

অনুপম বলল, টাইগার হিলে সূর্যোদয় দেখতে আমাদের সঙ্গে জিপে গেল না। ভোররাতে হোটেল থেকে বেরিয়ে হেঁটে গেল চূড়ায়। দুদিনের জন্য সুন্দরবন যাচ্ছি বলে ফিরে এসেছিল এক মাস পরে। সঙ্গে এক-ডায়েরি বাদাবনের স্কেচ। তবে মানুষ তো বদলায়ই। সময় বদলে যায়। সেদিনের আমাকে আজ যারা দ্যাখে তাদেরও নিশ্চয়ই খটকা লাগে কোথাও।

তখন এগিয়ে এলো দিয়া। ঘুরছিল আশেপাশে। সাদা-হলুদ ছোপ একটা শামুকের খোল কুড়িয়ে পেয়েছে বালিতে। তাই নিয়ে বাবা-মার সামনে।

ইন্দ্রাণী বোঝাল, স্নেইল।

অনুপম বলল, আসলে এটা একটা বাড়ি।

কার বাড়ি!

অনুপম বলল, এ-বাড়িতে যে থাকত সে বাড়ি-কাঁধে দেশ ঘুরতে বের হতো। পরে বুড়ো হয়ে বাড়ি ফেলে মিশে গেছে বালিতে। তারপর ইন্দ্রাণীর দিকে ফিরে বলল, এও এক বদল, তাই তো!

এই অনুপমকে এখনো কোথাও দুর্বোধ্য লাগে ইন্দ্রাণীর। সাত বছর একসঙ্গে থাকা, তারপরেও। তবে না বুঝতে পারাটা মানিয়ে নেওয়ার একটা অভ্যাসও তৈরি হয়েছে ভেতরে। এও বোঝে, এটুকু ফারাকের জন্যই অনুপম এই রকম এক প্রান্তরে ওদের নিয়ে বাড়তি একদিন থাকার কথা ভাবে। এমন এক জায়গায় যেখানে সবাই দু-একদিনের জন্য আসে, জমাটি মজা, পরে ইরেজার দিয়ে দাগ তোলার মতো নিজেদের মুছে দিয়ে চলে যায়। অনুপম নির্জনতার কাছে বাড়তি ছুটির এক্সটেনশন চেয়ে নিয়েছে।

আর এই সময় যখন শাড়ি বা প্যান্ট ভিজেছে বা ভেজেনি, হালকা রোদ, জেলেপাড়ার দিক থেকে একটি ছেলে চলে আসে। ওদের পাশে এসে দাঁড়ায়। বলে। কিছু একটা বলে।

রোগা চেহারা। হাফ-প্যান্ট। সরু পা। বছর দশ-বারো হবে। গলাটিও সরু। ইন্দ্রাণী বলে, কী বলছে যেন।

অনুপম দেখে ছেলেটিকে। চোখ দুটি কেমন গোল। খড়খড়ে হাত। ওদের পাশে দাঁড়িয়ে আবারো কথা বলে। নামানো স্বর। – কচ্ছপের ঘর দেখতে যাবে কি?

কচ্ছপের ঘর! এদিকে?

ছেলেটি দূরে আঙুল তোলে। অনেকখানি ওদিকে, যেখানে কোনা বরাবর জল আর বালির চিকচিক। দূরের পাড়ে একটা নৌকো তোলা, বেশ দূর।

কচ্ছপের ডিম পাড়তে আসার তট এটি নয়। অন্তত প্রচলিত অর্থে নয়, অনুপম জানে। সেসব জায়গা বেশ খ্যাত। শিরোনাম। সেখানে কচ্ছপদের সঙ্গে জিওগ্রাফিকের ক্যামেরা আসে। এখানের নাম তো সেসবের সঙ্গে কখনো শোনা যায়নি। ওরা হাঁটতে থাকে ছেলেটির সঙ্গে। বালি বরাবর। জল বরাবরও।

একটি সারাদিন। হাতে অনেকখানি সময়। এমন একটি ডাকের যেন অপেক্ষায়ও ছিল ওরা। ইন্দ্রাণী পেছনে হাঁটতে হাঁটতে বলে, কচ্ছপেরা রয়েছে নাকি এখনো?

ছেলেটি সবার আগে। একটু এগিয়ে। মাঝে দিয়ার পাশে অনুপম। ছেলেটি বলে, ক-বছর আগে ওরা এসেছিল। এখন বাসা ছেড়ে গেছে। আর আসে না।

কেন?

কেউ বুঝতে পারেনি কো …। ছেলেটি রোগা পা ফেলে-ফেলে সামনে।

রোদ এগিয়েছে খানিকটা। তবু সকাল। অস্বস্তি হয় না। ঠিক কতটা দূর ওরা বুঝতেও পারে না। দিয়ার অন্তহীন উৎসাহ। বালিতে তুলে রাখা বড় নৌকোটির সঙ্গে দূরত্ব কমছে। তারও ওদিকে সমুদ্রের জল যেন এতক্ষণে বাড়তে শুরু করল।

ইন্দ্রাণী বলে, আমরা ফিরব না?

পেছন ফিরে অনুপম দেখে, উঁচু পাড়ে ওদের থাকার কটেজগুলি খানিকটা ছোট। কত হবে, হয়তো মাইলখানেক দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে। ও বলে, ফেরা তো থাকেই।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই বালক যেখানে পৌঁছে দিলো সে-জায়গাটি তেমন কিছু নয়। জল বেশ কাছে। যে তট পেছনে ছেড়ে এসেছে, তেমনটাই। কোনো দিক থেকে আলাদা রকম নয়। রোদে হাঁটা হলো, খিদে পাবে, এই। তার জন্য এতটা কি আসতেই হতো!

ছেলেটি ঠিক সেই সময় কী যেন তুলে ধরল হাতে। না-ঝিনুক, না-শামুক, ছোট টুকরো কাঠ। ওর তালুতে ধরে যাওয়ার মতো। যেন পোড়া কাঠ। দেখাল। অনুপম জানতে চায়, কী এটা?

ছেলেটির রোগা হাত বাড়িয়ে ধরা। একটু বেশি বাড়ানো। বলল, কচ্ছপের ছা।

তার মানে?

ছেলেটি বলল, এইখানে ছা-দের রেখে মাগুলা পালায় গেছে সাগরে। ছা-কটা কেন্দে কেন্দে মরেছে। মা-রা ফেরেনি কো …।

ওরা তিনজন বাড়ানো তালুর ঘনিষ্ঠ হয়। ততক্ষণে স্পষ্ট। ছেলেটির কথায় স্পষ্ট। ছোট একটি কাছিমের অবয়ব। শিশু কাঠামো, শুকনো। বাড়ানো গলা। ছোট ছোট চোখের খোলে দুটি গর্ত। যেন শিশু কাছিমের মমি। ইন্দ্রাণী মুখ তুলে বলল, ফিরি চলো।

ছেলেটি জানতে চাইল, আর দেখবেন নাই!

বলে আঙুল দিয়ে এখানে-ওখানে দেখাল বালির দিকে। এতক্ষণ খেয়াল করেনি ওরা, দেখল আশপাশে আরো কটা তেমন। এদিক-ওদিকে। দূরের ঝাউ, উঁচু পাড় অনেক তফাতে। এলোমেলো বাতাস। সোঁদা গন্ধ। সবার চুল উড়ছে। হঠাৎ একটা নির্জন গোরস্তানে যেন। ছেলেটি দাঁত বের করে হাসছে।

অল্প কিছুক্ষণের জন্য দিয়ার চঞ্চলতা উধাও। বাতাস বইছিল ইন্দ্রাণীর আঁচল টেনে। অনুপম নিচু গলায় বলল, কেমন ব্যাপার। সব কয়টির মুখ জলের দিকে ফেরানো। ইন্দ্রাণী আবারো বলল, ফিরব।

ছেলেটি বলল, মা ছেড়ে যাওয়ার কথাটা এদিকে সবার জানা। বছর বছর ফিরা আসত কাছিমেরা। ছা রেখে যাওয়ার পর আর ফেরেনি কো।

কেন ফেরেনি? প্রশ্ন অনুপমের। উত্তর নেই।

ইন্দ্রাণীর কথাতেই সেই নির্জন বালিয়াড়ি থেকে ফেরা শুরু হলো। রোদ খানিকটা বেড়েছে। এগিয়ে এসেছে সমুদ্রের জল। ঝাউয়ের পেছনে অনেকটা দূরে পাড়ের দিকে নারকেল গাছের সারি। নারকেলের মাথা বাতাসে দুলছে। ওদিকে আরো কিছু বসত। ছেলেটিও নিশ্চয়ই ওদিককার।

হাঁটতে হাঁটতে অনুপম বলল, কাছিমেরা তবে …

ইন্দ্রাণী থামাল, প্লিজ …।

ওরা যেদিন এলো সেদিন বিকেলে একটি লোক এসেছিল কটেজের কাছে। রোগাটে গড়ন। এসে বলেছিল, বালির পাড় ধরে হেঁটে খানিকটা দূরে নদীর মোহনা। ও নাকি লাল কাঁকড়া দেখাতে নিয়ে যায়। এখানে যারা আসে তারা সবাই লাল কাঁকড়া দেখে। জনপ্রতি অল্প কটা টাকা। লোকটা তার নম্বরও দিয়ে গিয়েছিল। পরে আমোদ আর কোলাহলে সেসব সবাই ভুলেছে।

অনুপম বলে, লাল কাঁকড়া দেখতে যাওয়াই কি তবে ভালো ছিল!

ইন্দ্রাণী আবারো ওকে থামায়।

তবে এই ছেলেটি টাকাপয়সা নিল না। কটেজে পৌঁছানোর খানিক আগেই ও ছাড়া হয়ে গিয়েছিল। সেই যেখানটায় সোজাসুজি জেলেপাড়া। অনুপম মানিব্যাগ বের করেছিল। ভেতরে আঙুল চালাতে চালাতে ছেলেটিকে বলেছিল, এই শোন …। ছেলেটি দাঁত বের করেছে, লাগবেনি কো, তারপর এক ছুটে ঘরের দিকে।

সেদিন বিকেলে ওরা দূরে কোথাও গেল না। কটেজের সামনেটা পার্ক মতো, ক’টা বেঞ্চ, তারপর সরু রাস্তা। রাস্তার ওপাশ থেকেই বালি, সমুদ্রের শুরু। ওরা অল্প হাঁটল। বসে থাকল বেঞ্চে।

দিয়া দোলনায়। বিকেলের পর থেকে সন্ধের জোয়ার শুরু হয়ে যায়। সমুদ্র এগিয়ে আসে কাছে। সেদিনও সন্ধেয় পা ফেলে-ফেলে ঢেউ কাছাকাছি হলো। অন্ধকারে সাদা সাদা ভাঙা জলের মাথা।

অনুপম উঠে গিয়ে দুজনের জন্য কাগজের কাপে দুটো কফি আনে।

দিয়া খানিকটা দূরে। একা খেলছিল। কখনো এগিয়ে এসে ওর দু-একটা প্রশ্ন, পরে আবার তফাতে।

সারাদিন তেমন বোঝা যায় না, কিন্তু রাত হলেই ঢেউয়ে শব্দ তৈরি হয়। ইন্দ্রাণী হঠাৎ বলল, ছেড়ে গেলে বাচ্চারা মারা যাবে, তেমনটা কি মা-কাছিমেরা বোঝেনি!

ইন্দ্রাণী আবার আসছে সকালের কথায়। যে-কথা নিজেই সকালে সরিয়ে দিতে চেয়েছে। এবার অনুপম আলগোছে উত্তর দিলো, … হয়তো বুঝেছে। বা বোঝেনি। বায়োলজিক্যাল মিস্ট্রি।

চুপ থাকে ইন্দ্রাণী। অন্ধকার সমুদ্র থেকে উঠে আসা বাতাস। জলের কণা, শব্দ। ও যেন শোনে। বলল, আমাদের জন্যও কি তাই?

কী তাই!

ওই যে মিস্ট্রি …

অনুপম চুপ রয়ে যায়।

ইন্দ্রাণী কী বলতে চায়, জলের শব্দের আড়াল আর এই নির্জন সমুদ্র চরে, অনুপম আঁচ পায়। এমন অভিজ্ঞতা ওর আগেও হয়েছে দু-একবার। ইন্দ্রাণীর আবার সেই স্মৃতিতে ফিরে যাওয়া। যে -স্মৃতি থেকে ওরা অব্যাহতি চায়, বরাবর চেয়েছে, গত তিন বছর। ইরেজার ঘষে দাগ তোলার মতোই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারল কি? এই সমুদ্র চরে পুনর্বার!

কিন্তু কী-ই বা করার ছিল তখন। দিয়ার দেড় বছর। অনুপমের বদলির সুবাদে কমাস হলো ওরা তখন বহরমপুরে। বুঝতেই তো চলে গিয়েছিল বেশ ক’টা দিন। বাড়িতে কার্ড কিনে আনা হলো। ইউরিন টেস্ট পজিটিভ! সাময়িক অথই জল। দিশেহারা হয়ে কাছাকাছির ডক্টরস ক্লিনিক, আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে সেভেন উইকস্!

সে ছিল এক অদ্ভুত অবস্থা। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছে দুজন। ইন্দ্রাণী একবার বলেছে, রাখা কি যায়! পরেই আবার মত বদলেছে। অনুপম ওকে বলেছে, তুমি ভাবো, তুমি ভেবে দেখো …। ইন্দ্রাণী চুপ হয়ে ভেবেছে কটা দিন। জানালায় বসেছে। ছাদে গেছে। বালিশে মুখ ডুবিয়ে রেখেছে সারা বিকেল। তারপর সন্ধেয় অনুপম ফিরলে কাছে গেছে। চোখ মুছে বলেছে, আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না …।  অনুপম কিছু বলেনি। তখন ইন্দ্রাণীই আবার বিড়বিড় করেছে, না, চলো, ডাক্তারের কাছে যাই …

বয়স্ক ডাক্তারবাবু। তিনি আশ্বস্ত করার মতো করে বলেছিলেন, তেমন কিছু এটা নয়। আন্ডার লাইট-

অ্যানাসথেসিয়া একটা মিনিট দশেকের ব্যাপার। সকালবেলা না খেয়ে আসবেন। দু-ঘণ্টা পর ছুটি।

অনুপমের পাশে ছিল ইন্দ্রাণীও। একেবারে চুপ। চেম্বার ছেড়ে উঠতে উঠতে অনুপম বলেছিল, ডাক্তারবাবু, সেভেন উইকসে কি কিছু বোঝা যায়?

কী বোঝা যাবে?

অনুপম বলল, প্রাণ!

ডাক্তারবাবু চুপ ছিলেন কয়েক সেকেন্ড। তারপর বলেছিলেন, প্রাণ তো আলাদা কিছু নয়, কিছু লক্ষণ মাত্র। তবে আল্ট্রাসনোতে ফাইভ উইকসের পরপরই হার্টবিট এসে যায়। ডিসিশন যখন নিয়েছেন, এসব তখন আর ভাবার দরকার কী!

মাথা নামিয়ে ওরা বেরিয়ে এসেছিল চেম্বার থেকে।

… সমুদ্র থেকে একই ভাবে জল আর বাতাসের শব্দ আসছিল। দিয়া সামান্য দূরে। অন্ধকার জেলেপাড়ায় কেউ যেন গলা তুলে দূরের কাউকে ডাকল। ইন্দ্রাণী অস্ফুটে বলল, মা-কাছিমেরা কি এই জায়গাটায় আর কখনো ফিরবে না!

অনুপম কিছু বলে না। তাকিয়ে থাকে দূরে। যেন বাতাসের শব্দে মৃদু একটি হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছিল।