জীবন মাঝির নৌকায়

কর্তার মেয়ে গয়না নৌকায় উঠলো।

পাবনা মেন্টাল হাসপাতালের ঘাট। কেউ কেউ বলে, অনুকূল ঠাকুরের ঘাট।  তাল ও খেজুর গাছের আট-দশ ফুট লম্বা কয়েকটা কাণ্ড একসঙ্গে শেকল দিয়ে বেঁধে আপাতত ব্যবহারের জন্য, ছোট পদ্মার একটু উঁচু শুকনো পাড়ে, মাঝিরাই ঘাট তৈরি করেছে। আসল ঘাট ভেঙে গেছে। বন্যা বাড়তে পারে।

 দেশে যুদ্ধ হচ্ছে। শ্রাবণ মাস। এখন মেঘ নেই। সূর্য যাচ্ছে পশ্চিমে। ঘোলাটে পানির ঢেউয়ে রোদও মরা-মরা। 

বর্ষার পানিতে ডুবে গেছে অনুকূল ঠাকুরের সৎসঙ্গ আশ্রমের বারান্দা ও ঘরের মেঝে। ঘরের দেয়ালে লেখা ঠাকুরের বাণী, ‘হিন্দু ধর্ম, মুসলমান ধর্ম, খ্রিষ্টান ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম ইত্যাদি কথা আমার মতে ভুল, বরং ও সবগুলি এক একটি মত’ – পানিতে ডোবেনি; কিন্তু যখন বড়ো ঘাসিনৌকা এসে কূলে ভিড়ছে, উঠছে বড়ো বড়ো ঢেউ, ঢেউ আছড়ে পড়ছে আশ্রমের দেয়ালে, কয়েক মুহূর্তের জন্য পানিতে ডুবে যাচ্ছে হিন্দু-মুসলমান-খ্রিষ্টান-বৌদ্ধসহ ধর্ম শব্দটি। ঢেউ সরে আসতেই বর্ষার পানিতে ধোয়া বাণী রোদের আলোতে উজ্জ্বল। 

ঘাটে একসারি নৌকা। গয়না, ডিঙি আর কোশা থেকে একটু দূরে অনেক মালামাল নেওয়ার তিনটি ঘাসিনৌকা তীরে মাথা ঠেকিয়ে রাখলেও ছোট পদ্মার, তখন বাতাস হচ্ছিল, ঢেউয়ে দুলছে।

গয়না যাবে মাধবপুর। আরো দু-চারজন যাত্রী হলে জীবন মাঝি ছাড়বেন নৌকা। গয়নাতে বসেই কজন যাত্রী মেন্টাল হাসপাতালের পুব-পশ্চিমের ডোবা বারান্দায় পায়চারী করা একজন পাগলকে মজা পাওয়া কৌতূহলে দেখছে। পাগল মাঝেমধ্যে হাত তুলে জোরে জোরে বক্তৃতা দিচ্ছে। বক্তৃতার মেজাজ কত তা বোঝাতে মেঝের পানিতে লাথি মারছে। ‘আমি চালাই এই দ্যাশ আর তুই আমার কথা শুনিসনে, হারুনের কথা শুনিস। ও কিডা? সব জানি। যুদ্ধ শ্যাষ হোক। তোর বিচার হবি।’ কথাগুলো বলেই পাগল শূন্যে তর্জনী দিয়ে টোকা মারতে থাকে, ঠোঁট কামড়ায়, যেন শব্দ হলো, ‘দরজা খুলিসনে ক্যা’ শুনে ঘাটে দাঁড়ানো কজন ও নৌকার যাত্রীরা হাসে।  

বাদশা, আঠারো-কুড়ি বছরের যুবক, বলিষ্ঠ শরীর, রং ঘন শ্যামলা, সাধারণ রোদবৃষ্টিশীতে সহজে কাবু হবে না, জীবন মাঝির নৌকার হাল বাওয়া, পাল তোলা, যাত্রী ডাকার সঙ্গী। কখনো ছোট মাঝি। কর্তার মেয়ের বসার জন্য বাদশা নিমকাঠের ছোট, ময়লা, একটু ভেজা পিঁড়ি দিতে গেলে তার হাত থেকে কাদের মিয়া বুড়ো মোটা কালচে শিরা-ওঠা শুকনো হাত বাড়িয়ে পিঁড়ি নিয়ে নৌকার মাঝখানে রেখে বললেন, ‘মা, বসো।’

কর্তার মেয়ের পরনে পাবনার বড়ো নীল পাড়ের অফহোয়াইট শাড়ি, কালো ব্লাউজ। কালো চুলের বড়ো খোঁপা পড়ে আছে পিঠের ওপর। গলায়, দুই হাতে ও কানে ভারি নয়, হালকা সোনার গহনা।

কিছুক্ষণ পর বিকাল হবে। রৌদ্রে যাত্রীরা খুব একটা স্বস্তিতে নেই। কর্তার মেয়ের শ্যামলা রঙের চামড়ার ওপর সোনার চেইন, কানের দুল, হাতের চুড়ি রৌদ্রে ঝিকঝিক করছে। 

তিনজন যুবক অন্য নৌকায় না উঠে কর্তার মেয়েকে দেখতে দেখতে উঠলো গয়নায়। বয়সের অস্থিরতায় মাঝিকে বললো, ‘চাচা কখন ছ্যাড়বেন?’ জীবন মাঝি খসখসে গলায় বললেন, ‘হাতেম ব্যাপারী আসলিই ছাড়বো, আমার নৌকাত আয়ছে তো। চারো কিনব্যের গ্যেছে।’

নৌকা যাচ্ছে মাধবপুর।

নৌকায় ওঠার সময়ই হাতেম ব্যাপারী কর্তার মেয়েকে দেখেছিলেন। ‘তুমি ভালো আছ্যাও’, কেমন আছে না শুনেই, ‘তুমার জেনি কি নাম?’ প্রশ্ন করেন।

‘শায়লা।’

‘না না, একটা ডাকনাম আছে না?’

‘জেবা।’

‘তাই কও।’

কর্তার মেয়ের চোখ ঠাকুরের আশ্রমের দিকে। দেয়ালে বড়ো অক্ষরে লেখা ঠাকুরের বাণী কিছুটা আবছা, পড়া যাচ্ছে, ‘তোমার মন যত নির্মল হবে তোমার চোখ ততই নির্মল হবে, আর জগৎটা তোমার নিকট নির্মল হয়ে উঠবে’ – পড়তে পড়তে বাণীর পাশে আরো একটা বাণী, নৌকা চলে যাওয়ার কারণে জেবা পড়তে পারলো না। ‘ঢাকায় যাবার সময় ঠাকুরের কথাগুলি লিখে নিয়ে যাবো। তার বইও নেব।’

যখন নৌকা ছাড়েনি, হাতেম ব্যাপারী পড়েছিলেন ঠাকুরের বাণী। ‘তোমার নজর যদি অন্যের কেবল খারাপটাই দেখে, তবে তুমি কখনোই কাউকে ভালোবাসতে পারবে না। আর যে সৎ দেখতে পারে না সে কখনো সৎ হয় না।’ পড়ার পর জেবাকে তার বলতে ইচ্ছে করে, জেবা যেন তার বাপকে ঠাকুরের কথাটা পড়ায়। 

একজন যুবক সাদা জামার তেল চিটচিটে কলার ঠিক করে, বাতাসে উড়ন্ত চুলেও হাত দিলো, জেবার পিঠের মসৃণ ঢালুতে ঝুলন্ত খোঁপার দোলা দেখা থেকে চোখ সরাতেই পারছে না। 

‘কাদের চাচা আমাদের কতক্ষণ লাগবে?’ জেবার প্রশ্নে কাদের মিয়া মাঝিকে জিজ্ঞেস করেন, ‘ওই জীবন যাতি কতক্ষণ লাগবিরে?’

‘তা ঘণ্টাখানিক।’

কর্তার মেয়ের চোখ পদ্মার দুই পাড়ে ঘুরছে।

কাছে ও দূরের বাড়ির মাটির ডোয়া ও গাছের গোড়া পর্যন্ত পানি। ছোট ছোট বাবলাগাছের মাথার নিচে পানি।  দৃশ্য : ভাসমান অথচ স্থির সবুজ টুপি।

কোষা আর ডিঙি নৌকা নিয়ে চরের ধানক্ষেতে, ধানের মাথা এখনো ডোবেনি, কজন লোক দেখছে প্রায়-পেকে-ওঠা ধান। ‘গুইসাপ, গুইসাপ’ বলে একজন হাতে লাঠি নিল। অন্যজন লাঠি ধরে। নামিয়ে দেয়। ‘গুইসাপ ফড়িং খাচ্ছে,  পোকামাকড় খাচ্ছে, গুইসাপ কামড়ালি মানুষ মরে না। থুতুত ইক্টু বিষ আছে।’

‘একটা ক্যামেরা থাকলে ভালো হতো।’ জেবা দৃশ্যগুলোর ছবি তুলে ঢাকার হলের বন্ধুদের দেখাতে পারতো। একটা খেজুরগাছের বুকের ওপর একটা মাছরাঙা বসে গম্ভীরভাবে দেখছে ঢেউ, মাছের আশা নেই। কিন্তু দু-তিনটি গাঙচিল মাঝে মাঝেই ছোঁ মারছে  ঘোলাটে পানিতে।

বাবলা, খেজুর ও পাটক্ষেতের আশপাশ এবং নদীর পাড়ের ধার দিয়ে গয়না যাচ্ছে। ছেঁড়া ও তালি দেওয়া পালে বাতাস আছে। বাদশা বৈঠা মারছে। জীবন মাঝির হাতে হাল। একজন তরুণ লগি নিয়ে ভেসে আসা কচুরিপানা সরাচ্ছে এবং মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে নৌকার একমাত্র নারীযাত্রী জেবার দিকে। জেবা তরুণের কচুরিপানা সরানোর কাজ আড়চোখে একবার দেখেছিল। তখন তরুণ তার কর্মতৎপরতার যোগ্যতা  মেয়েটি যে দেখেছে তা দেখেনি।  

কাদের মিয়া খেয়াল করেছেন, হাতেম ব্যাপারী ফোলা ফোলা চোখে বারবার তাকাচ্ছেন কর্তার মেয়ের দিকে। তার অস্বস্তি লাগে। জিজ্ঞেস  করেন, ‘ব্যাপারী চারো কত লিলে?’

দাম চেয়েছিল নয় টাকা। ব্যাপারী কিনেছেন সাত টাকায়। চারোটা বড়ো। এক খ্যাপে কয়েকটা মাছ পড়তে পারে। পাকা বাঁশের শলা দিয়ে, বুনন ভালো, বাঁধন ভালো, বানানো।

‘ভালো হ্যয়ছে’, কাদের মিয়ার কথাতে জীবন মাঝিও সায় দেন। ‘আমারও এটা চারো কিনা লাগবি। খাল আর বিলের মাছ পানিত আয়ছে।’

কাদের মিয়া কথা বাড়াতে চান। ‘জীবন ঠিক কইছিস।’ কথা বাড়ানোর উদ্দেশ্য, ব্যাপারী যেন কর্তার মেয়ের ওপর থেকে চোখ সরান।

মাধবপুরের সকলেই জানে, কর্তার সঙ্গে ব্যাপারীর জমি নিয়ে একটা কেস চলছে। গ্রামের সালিশে ফয়সালা হয়নি। আরো একবার সালিশ বসার কথা ছিল। বসেনি। দেশে যুদ্ধ লেগে গেল। কাদের মিয়ার হিসাবে কর্তা জোর করে দখল করেছে ব্যাপারীর জমি।

‘কর্তার মিয়ে কি ঢাকার তেন আইসলে?’ ব্যাপারী জিজ্ঞেস করেন।

জেবা এসেছে ঢাকা থেকে। একুশে মার্চে হল থেকে চলে যায় খিলগাঁওয়ে ফুপুর বাসায়। খিলগাঁও আনসার হেডকোয়ার্টারে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্প। কদিন আগে একজন রাজাকার ক্যাম্পের গেটের সামনে জেবা ও তার ফুপার রিকশা ঠেকায়, জেবা গিয়েছিল ডাক্তারের কাছে। রাজাকার ও দুজন পাকিস্তানি সৈনিক জেবাকে দেখে। জেবার মুখের ওপর চোখ রেখে তার ফুপাকে রাজাকার বলে, ‘সন্ধে হচ্ছে। বাড়িত যান। কোন ব্লকে থাকেন?’  

 জেবা ও ফুপার বাসার সবাই সারারাত জেগে ছিল। ভয়, আতঙ্ক – কখন রাজাকারটা হানাদারদের নিয়ে বাসায় আসে। পরদিন সকালে জেবা চলে যায় সিদ্ধেশ^রীতে চাচার বাসায়। সেখানে কদিন থেকে আজ এসেছে মাধবপুর।

‘ও কর্তার মিয়ে ঢাকার অবস্থা কী?’ প্রশ্নটা করে ব্যাপারী নৌকার সবার দিকে তাকান। চোখে ভয় ও আতঙ্ক। বুঝতে চেষ্টা করেন, নৌকায় এমন কেউ আছে কি না, যে রাজাকার বা শান্তি কমিটির লোক।

মাধবপুরের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সফিউল্লা রাতেও টুপি পরে ঘুমান। ‘পাকিস্তানরে বাঁচান লাগবি’ যখন বলেন, তখন তার চোখেমুখে ভয়, ডান হাতের তসবিহ দোলে। ছেলে সেন্টু মুক্তি। চেয়ারম্যানের ক্ষীণ আশা, যুদ্ধশেষে মুক্তিযোদ্ধা ছেলে তাকে বাঁচাবে। কিন্তু যুদ্ধশেষে মাধবপুরের লোকজন দেখবে, জানবে – শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানকে মুক্তিযোদ্ধারা গাছের সঙ্গে বেঁধে গুলি করছেন। সেন্টু তখন থাকবে পাবনার মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। তার বাপকে হত্যা করার ঘোষণা তার সামনেই দেওয়া হয়।

জেবা ওই প্রশ্নের কোনো জবাব দেয় না – ‘চাচা আমার নাম জেবা।’

‘ওই একই কথা।’ বলে জিজ্ঞেস করেন ব্যাপারী, ‘ও কাদের ঢাকার তেন মিয়ে কার সাথে আইসলে?’

জেবা এসেছে তার খালাতো ভাই করিমের সঙ্গে। করিম ঘাটেও এসেছিল। জেবাকে নৌকায় তুলে দিয়ে পাবনার দিলালপুরের বাড়িতে চলে গেছে। তিনদিন পর ঢাকায় ফিরবে।

জেবা বিরক্ত। সবাই জানে, যুদ্ধের সময় ঢাকা ও সারাদেশের অবস্থা কমবেশি একইরকম। হত্যা, লুটপাট, গ্রাম পোড়ানো, শান্তি কমিটির কাজকর্ম, মেয়েদের তুলে নিয়ে যাওয়া, ইয়াহিয়া, ভুট্টো আর গোলাম আযম, নিজামী, সোবহানরা কী বলছেন, কী করছেন, গেরিলাদের আক্রমণ – সব চলছে। স্বাধীন বাংলা বেতার শুনে মানুষ আশা করছে, দেশ খুব শিগগির স্বাধীন হবে। সবই তো ব্যাপারী চাচা জানেন। জেবা কী বলবে?

‘আমি জেবারে পাবনার তেন আইনলেম’, কাদের মিয়ার কথা শুনে ব্যাপারী বললেন, ‘আমি আগেই জানি তুমি পাবনায় উয়েক আনবের গিছ্যাও।’

জেবা জানে তার বাপ ব্যাপারীর জমি দখল করেছে। ব্যাপারীকে মাধবপুরের মানুষরা ভালো মানুষ বলে জানে। জেবা বাড়িতে গিয়ে বাপকে বলবে ব্যাপারী চাচার জমিটা ফেরত দিতে। তার মা দু-তিনবার ফেরত দেওয়ার কথা বলেও ছিল। কর্তা তার বউকে ধমক দিয়ে বলেছেন, ‘জেবার মা, এই সবির মদ্যি তুমি আইসো না। ফের আর এই কথা ক্যবে না।’ জেবা দেখেছিল, বাপের চোখ রাগে তখন লাল।

ব্যাপারী ঝুঁকে নদীর পানি দু-তিনবার হাতে নিয়ে মুখ ও হাত ধুলেন। মাথার উসকো-খুসকো লালচে চুলেও পানি দেন। পানি লাগতেই চুল কপালে পড়ে। রোদেপোড়া হাতের পশম ধূসর ঘাসের মতো, পানি পেয়ে হাতের খসখসে চামড়ায় লেপ্টে যায়। কনুই থেকে কব্জির মধ্যে হাতে ফুলে-ওঠা শিরা-উপশিরা দেখে জেবা বোঝে, মানুষটা পরিশ্রমী।   

জীবনকে ব্যাপারী বললেন, ‘মাঝি আকাশ দ্যাখো। একটা ম্যাঘ।’

নৌকার যাত্রীরা তাকায়। পশ্চিম আকাশ থেকে বড়ো একখণ্ড ঘন কালো মেঘ দৌড়ে আসছে। মাঝি মেঘের দিকে চোখ রেখেই বললেন, ‘ঝড় আসতেছে।’

জেবাও দ্যাখে। মাঝির কথা শুনে শ্যামলা মুখ একটু ফ্যাকাসে হয়ে যায়। ব্যাপারীর চোখ এড়ায় না। ‘কর্তার মিয়ে ভয় পায়ছে।’ ব্যাপারী কথাটা বেশ জোরেই বললেন।

‘না না, আমি ভয় পাইনি।’ জেবা ভয় পেয়েছে, না পায়নি, সে-বিষয়ে কিছু না বলে, হাতেম ব্যাপারী বললেন, ‘তুমি সাঁতার জানো? জিজ্ঞেস ক্যরলেম কারণ, ঝড়ে যদি নইকে ডুবে যায়, তাই।’

জেবা সাঁতার জানে, ঝড়ের নদীতে নৌকা ডুবলে সাঁতার জানা কজন মানুষ বাঁচে?

বাতাস পড়ে গেল। পালে বাতাস নেই। কাদের মিয়ার চোখেমুখে ভয়। নৌকার অন্য যাত্রীরা আসন্ন ঝড় নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নয়। ঝড় বাড়লে জীবন মাঝি নৌকা নিয়ে পাটক্ষেত বা ধানক্ষেতে যাবেন বা কোনো বাবলাগাছের সঙ্গে বাঁধবেন নৌকা। ফসলের মাঠে বর্ষার পানির গভীরতা কত মাধবপুরের যাত্রীরা জানে।

বাতাসের গতি বাড়ছে। জীবন মাঝি হাতেম ব্যাপারীকে বললেন হাল ধরতে। কাদের মিয়া জেবাকে বললেন, ‘আমরা ঝড়ের আগেই দাপ্নে চলে যাবোনে। তারপরই তো মাধপুর। তুমি চিন্তা ক্যইরে না।’

 দাপনের নাম শুনে হাতেম ব্যাপারী নিজের তর্জনী কামড়ায়। তার দাপনের তিন বিঘা জমি কর্তা খাচ্ছে।

ঢেউ বড়ো হচ্ছে। দু-এক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়ছে। নৌকার দিকে দ্রুত ভেসে আসা কচুরিপানার বড়ো একটা দলকে দেখে মাঝি বললেন, ‘হাতেম ভাই সাবধানে হাল ধরো।’ ব্যাপারীর মুখে অল্প হাসি। বাঁ হাত তুলে বোঝান, ভয় নেই। কচুরিপানার মধ্যে গয়না ঢুকে গেল। একটা লাশ কচুরিপানার মধ্যে, পেট ফোলা, কপালে গুলির গর্ত। হাতেম ব্যাপারী বললেন,‘ইস্, মাইরে নদীত ফ্যালাইছিলে। মুক্তি ছিলে নাকি?’ নৌকার কজন যাত্রী নাকে হাত দিয়ে, যদিও কোনো গন্ধ পায়নি, লাশ দ্যাখে। 

নৌকার গতি কমে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সব কচুরিপানা ভেসে যাবে। নৌকা চলবে বাধাহীন। কাদের মিয়া খেয়াল করেছিলেন দাপুনিয়া শোনার পর হাতেম ব্যাপারীর দাঁত ঘষা। ব্যাপারী জিজ্ঞেস করলেন, ‘কাদের মিয়া দাপ্নের জমিত কর্তা ইবার কি বোনেছে? ও জমি তো ডোবে নাই।’

কাদের মিয়া জানেন। বললেন, ‘কী জিনি কী লাগায়ছে?’

একটা দীর্ঘশ^াস ছেড়ে হাতেম ব্যাপারী বললেন, ‘আমি জানি কী লাগায়ছে। তুমি তো ছিলে যখন কুশের লাগায়।’

কাদের মিয়া কোনো কথা বলেন না। জেবা ব্যাপারীর কথা বলার ধরন দেখে আন্দাজ করতে পারে না, হাতেম চাচা কথার উত্তর কেন এভাবে দিলেন। 

‘কর্তা ভালো জমিডা নষ্ট করতেছে ক্যা?’ ব্যাপারীর এই প্রশ্নের উত্তর কাদের মিয়ার জানা নেই।

ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টি বাড়ছে। একটা প্রায়মৃত পিপুল গাছ স্রোতের ধাক্কায় বেঁকে বেঁকে একবার ডুবছে, একবার মাথা তুলছে। নৌকা গাছটির পাশ দিয়ে দ্রুত যাচ্ছিল, হাতেম ব্যাপারী পিপুলের একটা পাতা ছিঁড়লেন। জেবা মানুষটাকে দেখছে। এক হাতে হাল, অন্য হাত অন্য কাজে সচল। চোখ চারোর ওপর। কখনো কখনো আকাশে।

সকলেই ভিজছে। দু-একজনের হাতে ছাতি। বাতাসে বৃষ্টির ঝাপটা। একজনের ছাতি উল্টে গেল। একজন তরুণ হাসে। একজন জেবাকে ছাতি দিতে চেয়েছিল। জেবা নেয়নি। ভিজছে। তার খোঁপা খুলে গেছে। শাড়ির আঁচল মাথায়। কাদের মিয়া ছাতা নিয়ে কেন আসেনি, জেবার মনে হয়। কিছু বলেনি। 

‘কাদের মিয়া শাউন মাস। একটা ছাতি আইনবে না। কর্তার মিয়ে যে ভেজতেছে?’ ব্যাপারীর কথার জবাব কাদের মিয়ার কাছে নেই।

বৈঠা জোরে মারতে মারতে জীবন মাঝির হাঁপ ধরে গেছে। শ^াস পড়ছে সশব্দে।। বললেন, ‘বাদশা আরো জোরে মার। সামনেই দাপ্নে, দেখা যাচ্ছে।’ আসলে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। ঘন মেঘ আর বৃষ্টির মধ্যে দৃষ্টিতে স্পষ্ট ছিল না আশপাশ। চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে।

‘হাতেম ভাই হাল শক্ত ক্যইরে ধরেন।’

‘জীবন আরো জোরে বইঠে মার।’

হাতেম ব্যাপারীর হাতের পেশি, রগ ফুঁসছে, দাঁতের মাঢ়ি এক চাষ দেওয়া ক্ষেতের মতো কর্কশ।     

পানিতে জোরে জোরে বাড়ি খাচ্ছে বাবলার ডালপালা। খেজুরের ডালগুলো বাতাসে দাপাচ্ছে। গ্রাম থেকে ভেসে আসছে চিৎকারের হালকা আওয়াজ। নৌকার যাত্রীদের চোখেমুখে আতঙ্ক। যাত্রীদের মধ্যে দু-তিনজন তরুণ ছাড়া সবার পরনে লুঙ্গি। তাদের মধ্যে কেউ কেউ কাছা মারে। একজন দাঁড়ায়। আজান দিতে থাকে এবং সবাইকে বলে দোয়া পড়তে। জেবার হাত ধরে আছেন কাদের মিয়া। বলছেন, ‘ভয় পাইও না, আল্লার নাম লেও। সুরা নিসা পড়ো।’ জেবা সুরা জানে না।

‘ওই বাদশা পাল নামা।’ ব্যাপারী চিৎকার করছেন। বাদশা শোনেনি।

‘হারামজাদা আগে পাল নামায় নাই’, জীবন মাঝির চিৎকার।

অন্ধকার আরো ঘন হয়েছে। প্রবল বাতাস আর ঢেউয়ের মধ্যে তীব্রগতিতে ছুটে যাচ্ছে নৌকা। বাদশা পাল নামাতে পারছে না। ওর সঙ্গে দুজন তরুণ খুব চেষ্টা করছে পাল নামাতে। এখন তরুণরাও ভীত।

জেবা কাঁদছে। কাদের মিয়া জানেন না কী বলে সান্ত্বনা দেবেন। সকলের চোখেমুখে মৃত্যুভয়। প্রচণ্ড জোরে বিদ্যুৎ চমকালো। মুহূর্তে আসা ও চলে যাওয়া আলোতে কারো মুখ ঠিকমতো কেউ দেখতে পায়নি। হাতেম ব্যাপারীর চোখ পড়েছিল জেবার মুখের ওপর। জেবার মুখ কিন্তু তার মনে হলো কর্তার মুখ।

যাত্রীরা চিৎকার করছে। ‘বাঁ-চা-ও’, ‘বাঁ-চা-ও’, ‘বাঁ-চা-ও’। কেউ কেউ ডাকছে আল্লাহকে। আজান দেওয়া লোকটা আবার আজান দিচ্ছে। একজন তরুণ তাকে ধরে আছে। বাতাসের ধাক্কায় যেন পড়ে না যায়। 

নৌকার পাল ছিঁড়ে গেল। নৌকা একবার চরকির মতো ঘুরে সোজা চলতে শুরু করে। বিদ্যুৎ চমকায়। কোথাও বাজ পড়ে। হাতেম ব্যাপারীর হাতে হাল। জীবন মাঝি চিৎকার করে মরণধরা গলায় বললেন, ‘ব্যাপারী ঠিক কইরে হাল ধইরেন।’

আবার বিদ্যুৎ চমকায়। ব্যাপারীর চোখে পড়ে সামনে একটা খেজুরগাছ বাঁচার জন্য মাথা ঝাপটাচ্ছে। ‘তাইলে খেজুরগাছের সাথেই।’ ব্যাপারীর কথা কেউ শোনেনি।

ব্যাপারীর দুই হাতের মুঠোতে শক্ত করে হাল ধরা। তিনি হালটা পানির ওপরে তুললেন। গয়না নৌকার সামনের গলুই ডান দিকে ঘুরে প্রচণ্ড জোরে বাড়ি খেল খেজুরগাছের সঙ্গে। অন্ধকারে যাত্রীদের আর্তনাদ বাতাসের শব্দে মিলে গেল।

প্রবল স্রোতের সঙ্গে ভাসতে ভাসতে একটা বাবলাগাছে হাত পড়লো হাতেম ব্যাপারীর। খুব হাঁপ ধরেছে। আর একজন মানুষও অন্ধকারের মধ্যে সাঁতরে এসে আন্দাজে হাত বাড়াতেই ওই একই বাবলাগাছে পড়লো হাত।

‘তুমি কিডা?’ ভীত প্রশ্ন হাতেম ব্যাপারীর।

‘আমি জীবন।’

বিদ্যুৎ চমকালো। পালের ছেঁড়া কাপড় দুলছে বাবলার ডালে। আলোর ঝলকানির মুহূর্তে দেখা গেল একটা পেট ফোলা লাশ ভেসে যাচ্ছে। 

ব্যাপারী বললেন, ‘শালার পাকিস্তানিরা মানুষ মারতেছে আর নদীত ফ্যালতেছে।’

‘হাতেম ভাই, তুমি আমার নৌকাক বাঁচালে না, হালডা উপেরে ত্যুললে?’

‘বাঁচাব ক্যা? কর্তার মিয়ে ছিলে তো। জীবন তুই জানিস নে?’

জীবনের দীর্ঘশ^াস পড়ে। শ^াসের শব্দ ব্যাপারীর কানে আসে না।  

‘আচ্ছা তোক্ নইকে বানা দেবনে। গয়নাই।’ বলে হাতেম ব্যাপারী জীবন মাঝির ভেজা কাঁধে হাত রাখেন।

বড়ো একটা সাপের লেজ দুজনের মাথার ওপর দুলছে। মুখে ব্যাঙ।