ঠগিবাজ তৈফুর

হোটেল দিলশাদে এসে প্রথমে মনে পড়ল সারাতুনের কথা, সে ব্যাংক কর্মকর্তা, ভালো পরামর্শক হতে পারে। তারপর কালবিলম্ব না করে ছুটবে মেয়েকে আনতে কুমারখালি। হোটেল দিলশাদ তার পছন্দের হোটেল কারণ এখানে নিজের মতো বাস করতে পারে – পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আন্তরিক পরিবেশ। বস্তুত নোংরা অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ খুবই অপছন্দ তার। প্রতিদিন দুবার স্নানে ঘণ্টাখানেক এই কাজে ব্যয় চিত্তে আনন্দ দেয়। অন্তর্বাস প্রতিদিন ধোয়া চাই, বাসি অন্তর্বাস কীভাবে পরা যায় তা সে ভেবেই পায় না! সত্যি কথা, এদেশে একবার পরা কাপড় না ধুয়ে দ্বিতীয়বার পরার কথা ভাবা যায়! এখন প্রতি পকেটে তার গোটাদুই করে রুমাল থাকে, দুটো জুতো মোছার, দুটো মুখ মোছার। লন্ডনে অবশ্য একটা করেই যথেষ্ট ছিল।

সাত বছর পর দেশে ফিরেছে। লন্ডন তার পছন্দের শহর, খুবই পছন্দ। ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত, সব, মানুষও। হোটেলে কাজ করে কাটিয়ে এসেছে সাত বছর, তার বানানো আলুর ভর্তা কি আলু ভাজি যে খেয়েছে একবার তার আর কারো বানানো ভর্তায়-ভাজিতে অরুচি হবে, নিশ্চিত। উড়োজাহাজে চড়ে গেছে, একজন ডাকসাইটে ব্যারিস্টারের ব্যক্তিগত পাচক হিসেবে, তিনি তার এই সাহায্যটুকু করে দিয়েছিলেন বাবার মুরিদ হিসেবে, সেসব অন্য গল্প।

জাহাজে ফিরেছে সঙ্গে ছয়টা ট্রাঙ্ক, সেই রকম সাইজ! হ্যাঁ, আর যাবে না। মেয়েকে নিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দেবে ইনশাল্লাহ। লন্ডন থেকে এই ঢাকা পর্যন্ত তার যেসব লিংক আছে তাতে একটা ভালো হোটেলে কাজ পাওয়া শুধু সময়ের ব্যাপার।

চারটা ট্রাঙ্কে তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র থাকায় খোলা হয়েছে। তাতে হাতাখুন্তিসহ আছে নানা পদের সস থেকে গিফটের কিছু আইটেমও। বাকি দুটোতে মেয়ের জিনিস, খুলবে মেয়ে এলেই। মেয়ে অবাক হয়ে দেখবে, বাবা বলে কথা!

হ্যাঁ, সারাতুন আখতার বুনকে ডেকেছিল, নাতনি বিধায় বোন, সে ডাকে বুন বলে। দশ বছরের ছোট তো হবেই। তাকে দিয়েছে একটা আলু কুচানোর যন্ত্র। দিতে দিতে বলেছে, দেখে নাও বুন, মেইড ইন, দিশি জিনিস নয় কিন্তু! সে হেসে হেসে বলে, আল্লাহ হাফেজ নানা হলো দুনিয়ার এক নাম্বার জিনিস, সে দুই নাম্বার জিনিস দিতেই পারে না! বস্তুত সে জানে, আল্লাহ হাফেজ নানাও খুব খাঁটি জিনিস না।

এই হোটেল এবং ব্যাংকে সারা বুনের বাসার ঠিকানা ব্যবহার করেছে নিরুপায় হয়ে। সারার নানির খালাতো ভাই সে, দূরের নয়, নয় খুব কাছের। মোহাজের আমি, সুযোগ পেলেই এই কথা বলে কী একটা যেন বোঝাতে চায়। মোহাজের আল্লাহ হাফেজ অনেক সাধ্য সাধনা করে তাজমহল রোডে একটা দেড় কাঠার জমিসহ ছোট্ট বাড়ি বাগাতে পেরেছিল তার দারুণ তৎপরতায়, বিয়েরও বেশ আগে। লন্ডনে গিয়ে টাকা পাঠিয়ে তাতে একখানা তিনতলা বাড়িও করিয়েছিল, যার সবটার দায়িত্ব দিয়ে রেখেছিল ছোটবোনের একমাত্র পুত্রের কাছে। যে-বোন তার বিবাহ নামক অঘটনটি ঘটাতে পেরেছিলেন বিশেষ কায়দায়! দেশে ফিরে প্রথম সে নিজের বাড়িতেই উঠেছিল। উঠে দেখল, ভাগ্নে আর তার বউ-বাচ্চারা দুটো ঘরে থাকে, আরেকটা ঘরে ভাগ্নের শালা। একতলা-দোতলা ভাড়া। কী আর করা, তার আকস্মিক আগমন! বারান্দায় একটা বেঞ্চি পেতে তাতেই শয্যা পাতা হলো। মাত্রই দু-রাত ছিল আর দ্বিতীয় মাঝরাতে বড় বড় কিছু আরশোলা কোথা থেকে এসে তার গায়ে হেঁটে বেড়াতে লাগল যেন-বা তাদের সুখের চারণভূমি ফর্সা নাদুসনুদুস এই দেহ, গায়ের সুগন্ধও তাদের পছন্দ হয়েছে খুব। আর ট্রাঙ্কগুলো নিয়ে গবেষণা অহোরাত্রি ভাগ্নে-ভাগ্নেবউ, এমনকি বাচ্চাদের। থাকার বন্দোবস্ত নিয়ে প্রথম ভেবেছিল এ-বুঝি দু-একদিনের জন্য, কিন্তু না, এর-ওর কাছ থেকে জেনে গেছে বাড়িটা ভাগ্নে নিজের নামে করে নিয়েছে। মুখোমুখি হয়নি তখন, মেয়েকে আগে পাই, তারপর লড়াই!

 বড়বোনের নাতিন, যাকে সে প্রথমে ছোট্ট বাড়িসহ জমির দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিল দেশ ছাড়ার আগে, দেশ স্বাধীনেরও আগে, যার চিঠির মাধ্যমে কীর্তিমান শ্বশুরের গল্প শুনেছিল, ফিরে তাকেও দিয়েছে একটি অনিয়ন কাটার। এমন উপকারী বন্ধুকে এই উপহারটা একটু তুচ্ছই বোধ হয় হলো! আরেকটা জিনিস দিতে চেয়েছিল, একটি পর্নোবই, খোদ লন্ডনের, দারুণ কিন্তু। পরে মনে হলো সে বোধ হয় এসবের ঠিক উপযুক্ত নয়!

 লন্ডন যাওয়ার সময় রেখে যায় বউ আর ছ-মাসের কন্যা। মায়া আর কাকে বলে! কিন্তু মায়া দিয়ে তো জীবন চলে না। অর্থ লাগে, বুদ্ধি লাগে, লাগে একটু সাহস আর লেগে থাকার মতো ধৈর্য। মোহাজের হিসেবে দেড় কাঠা নিজের করে নিতে পেরেছিল এই ধৈর্যের পরাকাষ্ঠায়, বস্তুত সে তো মোহাজেরই। নদীয়া থেকে পীরসাহেব বাবাকে নিয়ে এপারে আসার আয়োজনে বাবা রাজি ছিলেন না, ছিলেন না বলে আসা প্রলম্বিত যেমন হয়েছে তেমনি বাবারও আর আসা হয়নি আকস্মিক প্রয়াণে। সে এসেছিল বড়বোনের পরিবারের সঙ্গে।

সেসব গল্পও বাদ, লন্ডনের পাউন্ড ভাঙিয়ে টাকা-পয়সা ব্যাংকে রাখল, সে অনেক টাকা। আর বাড়ি-হারানোর বেদনা চেপে রাখল আপাতত, কারণ এখন এসবের সময় নয়। কলকাঠি ঠিকমতো নাড়লে নাতিন বাড়ি ফিরিয়ে দিতে হুঁশ পাবে না সে জানে। আর যে-নাতিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মোহাম্মদপুরের দেড় কাঠা পাহারা দিত বছরের পর বছর তাকেও স্মৃতিতে সামান্য আসা-যাওয়ায় রাখল অনিয়ন কাটার দিয়ে। কে জানে কখন এই বেকার বোকা নাতিন ফের কাজে লাগে!

যে-লোকটা খবর দিয়েছিল তোমার মেয়ে তুলতুলি বেঁচে আছে, সে শুধু একটাই চিঠি দিয়েছিল। উত্তরে পরপর তিনটে চিঠি লিখলেও উত্তর পায়নি। ধরেই নিয়েছে লন্ডনে চিঠি পাঠানোর মতো পয়সা লোকটার নেই; চিঠির কোনো একটা বাক্য এই অনুভূতিটা দিয়েছিল তাকে। লোকটা তার স্ত্রীর মামাতো ভাই। শিহাব নাম, এই পরিচয়ই দিয়েছিল পত্রে।

দুই

গড় মানুষের তুলনায় আবেগ জিনিসটা একটু কম হলেও এবার দেখল ততটা কম কিন্তু নয়। লঞ্চে যমুনা পার হওয়ার সময় শীতের নদী জড়িয়ে ফেলে আষ্টেপৃষ্ঠে। স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে কিছু ঢেউ কাছে এসে করে ঘুরঘুর। সারাদেশ যখন উত্তাল তখনই বোন, মায়ের পেটের ছোটবোন ডেকে পাঠায়, বলে, খুব জরুরি। কিছু না বুঝেই ছুটে যায়, যেতে যেতে এরকম একটা লঞ্চের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে সেদিন কিছুই ভাবেনি। ভাবনার কী, বোন ডেকেছে – যাও! তারপর যখন পৌঁছল দেখে একটা অল্পবয়সী মেয়ে সেজেগুজে সামনে। তোমাকে এই বিয়ে করতেই হবে, না হলে তোমার এই বোন বিষ খাবে, এ-জগতে আমি ছাড়া তোমার কেউ নেই ভাই! সত্যি কথা, বড়বোন মারা গেছে সদ্য, আর তারও বয়স পেরিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু সে তো ঠিক করেছে বিয়ে-টিয়ে নয়। নিজের মতো স্বাধীন-সুন্দর একটা জীবন কাটাবে। সংসার মানে যত অশান্তি আর অসুন্দরের ঘাঁটি। এই ঘাঁটি কি দুর্গ থেকে কেউ বের হতে পারে না, কত দেখা হলো জীবনে! এর আগের বহু প্রচেষ্টা ব্যর্থ করতে সমর্থ হলেও এবার এড়ানো গেল না। পাত্র হিসেবে এক নাম্বার, যেমন উচ্চবংশীয়, সুন্দরও বইকি। হ্যাঁ হবু বধূও সুন্দরী, ডাক্তারের মেয়ে, অবস্থাপন্ন। হাজার না না এর মধ্যে কী থেকে কী হয়ে গেল, বিয়ে হলো। মেয়েও হলো একটি বছরান্তে।

মেয়ের ছয় মাস বয়সে লন্ডন পারি, দেশে তখন নির্বাচন, শ্বশুর মহাশয় দাঁড়িপাল্লায় দাঁড়িয়েছেন। বউ জানে এই সমস্ত ঝামেলা মোটেই পছন্দ নয় তার; কিন্তু শ্বশুর এসব খুব ভালোবাসে। তারপর যুদ্ধ। পিস কমিটির লোক ডাক্তার সাহেব, তো বউবাচ্চা তার অবর্তমানে বাপের আশ্রয় নেবে এটাই স্বাভাবিক।

লন্ডনে বসেই খবর পেয়েছে দেশ স্বাধীনের পর মুক্তিযোদ্ধারা শ্বশুরের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে, শ্বশুর পালিয়েছিল আগে, বেঁচে গেছে; কিন্তু পুড়ে মরেছে শাশুড়ি-বউ-দুধের মেয়ে। স্বাধীন দেশ থেকে মানুষ পায় কত কত আনন্দসংবাদ, সে পেল মৃত্যুর সংবাদ, বীভৎস মৃত্যু। ভেবেছিল বিয়েই করতে চাইনি তাই বুঝি আল্লাহ ইচ্ছা করেই মিটিয়ে ফেলল! ছয় মাসের চাঁদের মতো মেয়ে কখনো মস্তিষ্কে ভেসে ভেসে ওঠে, কখনো হাত-পা নেড়ে ডাকে তারপরই অ্যান্টেনাহীন টিভির মতো ঝিরঝির মাছি।

প্রথমে তো বিশ্বাস করেনি, ছয় বছর পর মেয়েকে কোথায় পেলে! চিঠিতে লিখেছে অস্ত্র কাঁধে মুক্তিবাহিনী দেখে জুলেখা বুঝতে পেরেছিল কী হতে চলেছে, সে মেয়েকে পোয়ালের গাদায় ছুড়ে ফেলে ঘরে খিল দেয়। যেন জানত আগুনই দেবে, মেয়ে বেঁচে যায়।

মেয়েকে পাওয়ার উত্তেজনায় কাঁপছে, ঘামছে। দামি কোটটা খুলে হাতে নিয়ে যমুনার ঘোলাজলে মনোযোগ দেয়। সেখানে মেয়ের হাত-পা নড়ে না, মুখের আদল যায় মুছে মুছে। বড় বড় ট্রাঙ্ক বেকার পড়ে থাকে তালাবদ্ধ। কিন্তু কি আশ্চর্য, এত উত্তেজনায়ও বাড়িটা বুকের ভিতর ধক্‌ধক্ করে ওঠে, নিজের বাড়ি, কত কায়দা করে কত ঘাট ঘুরে জমিটা পাওয়া, তারপর বাড়ির জন্য টাকা পাঠানো, রক্তবিন্দু! কাকরাইলের সেই ‘ঠগিবাজ তৈফুর’ নামাঙ্কিত বাড়িটা মনে আসে, রোষ, প্রতিশোধ কাকে বলে! সেই বাড়ির একজন দারোয়ান কৌতূহলী জনতাকে নামের মাহাত্ম্য বর্ণনা করার জন্য মুখিয়ে থাকে, পারলে ডেকে ডেকে লোককে জানায় তৈফুরনামা। বিদেশ অবস্থানরত ভাগ্নের টাকায় তৈফুর মামা নিজের নামে বাড়ি করলে ভাগ্নে ফিরে এসে মামাকে বিতাড়ন করেই ক্ষান্ত হন না, তৈরি করেন প্রকল্প। ঠগ মামার পরিচয়কল্পে মামার নামে নেমপ্লেট, ‘ঠগিবাজ তৈফুর’। হ্যাঁ পথচারীদের অপার আনন্দ জুগিয়েছে এই ঘটনা। তো সেও ঠিক করে যদি মেয়েকে ফিরে পায় তো ভাগ্নেকে হালকা-পাতলা শায়েস্তা করে ছাড়বে। সেটা কেমন হবে এখনো ঠিক করে উঠতে পারেনি। আর রাজাকার শ্বশুরও মস্তিষ্কে ঘোরাঘুরি করে কখনো, যে কিনা লন্ডনে সাড়ে তিন বছর থেকে ঢাকায় এসে বাটা সিগন্যালে রাজপ্রাসাদ বানিয়ে নতুন বউ নিয়ে থাকার জন্য আবার চেম্বার খুলে রোগীও নাকি দেখা শুরু করেছে, তাকে কী করা উচিত!

ভাবনা বেশিদূর গড়ায় না, মানে গড়াতে দেয় না, মেয়েকে পেলে কিছু মানুষকে ক্ষমাও করে দিতে পারে, ক্ষমা মহত্ত্বম গুণ! আপাতত সিদ্ধান্ত পেন্ডুলাম!

শিহাব নামে জুলেখার কোনো মামাতো ভাইকে খুঁজে পাওয়া গেল না কুমারখালি। পাঁচ মাস আগে পাঠানো চিঠিটা দেখায় জনে জনে। পাকা হাতের লেখা। কেউ কেউ বলে পাইলট কলমে লেখা চিঠি। হাতের লেখাটা নাকি অনেকটাই ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন লেখার মতো, প্যাঁচানো হলেও দুর্বোধ্য নয়। ডাক্তার দীর্ঘ বিরতির পর এখন মাসে দুবার এলাকায় আসে। ‘শ্বশুর মানুষ তোমার তার কাছে শুধাও!’ কেউ কেউ বলে, তিনি এখন শুধু নিরাপদই নন, প্রভাবশালীও। শ্বশুরের এত সংবাদ কে জানতে চায়! কেউ তুলতুলির খবর জানে না, একাত্তরের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে যা হয়েছে তার বাইরে আর কোনো খবর নেই। বোনের সঙ্গে দেখা করে ছেলের কা- বলে এসেছে, বোন আহত ভাব দেখালেও তাকে ক্ষমা করা হবে না জানায়।

ঢাকায় ফিরে এসে মনে হয় শেষ একটা খবর নিলেই মিশন শেষ। বাটা সিগন্যালে শ্বশুরের প্রাসাদ তারপর ফিরে যাব লন্ডন। আচ্ছা নতুন বাড়িতে কি তুলতুলিকে যত্ন করে রেখে দিয়েছে তার নানা! আট বছর বয়সের একটা মেয়ে এসে হাত ধরে বলবে, তুমি কে? তুমি কে? আল্লাহ হাফেজ চোখের পানি মুছতে মুছতে বলবে, কেউ না আমি, তুমি আমার মা!

আশা নেই জানে তবু বাটা সিগন্যালের নতুন ঝকঝকে বাড়ির গেটে এসে দাঁড়ায়। শক্তিশালী দারোয়ানকে বোঝাতে গিয়ে কাহিল অবস্থা। কিছুতেই ওপরে উঠতে দেবে না। চোখেমুখে অবিশ্বাসের প্রখর চিহ্ন। চেম্বারেও নাকি আর বসেন না এখন যে সেখানে গিয়ে ধরবে। মাঝে মাঝে কোথাও মিটিং করতে যান, গোপন রাজনৈতিক মিটিং – পালাবদলের কাল। শেষ পর্যন্ত, যা হোক দেখা হলো শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে। আহ্লাদিত ভাব করলেন তিনি, চিঠির ব্যাপারে কিছুই জানেন না। অনেক এলোমেলো কথার পর বললেন, ফুলপরিকে বিয়ে করেন, সে তো জুলেখারই বোন আর লন্ডনে আমার ব্যবসাটা দেখেন, সামনে কত বড় একটা জীবন পড়ে আছে! সামনে আমাদের দিন, আপনার সব ঠিক করে দেব। আপনার শাশুড়ি, জুলেখা আর তুলতুলি আমাদের চাঁদতারা, তারা বেহেস্তে। তারা তো আর ফিরবে না!

ফুলপরি তার একমাত্র শ্যালিকা, হিসেবে বয়স এখন বিশ-বাইশ বছর হতে পারে, বিয়ে হয়ে যাওয়ার কথা! নিজের বয়স পঞ্চাশ হচ্ছি-হবো করছে। ফুলপরির সঙ্গে দেখা হয় না, শ্বশুর বারবার বলতে থাকেন, ওকে আমার পছন্দের পাত্রকেই বিয়ে করতে হবে, ওর মতের কি দাম! আপনি শুধু একবার হ্যাঁ বলেন বাবা।

হোটেল দিলশাদে ফিরে বিষাদে ভরে যায় মন। রাতে কাঁপিয়ে আসে জ্বর। সকালে বড় বড় না-খোলা মেয়ের ট্রাঙ্ক দুখানা কোথায় রাখে কী করে ভাবতে ভাবতে বমি করে দুবার। শীতেও তীব্র ঘাম। প্রথম যাকে জমিটা দেখার ভার দিয়েছিল সেই বড়বোনের নাতিনকে একটা খবর দেয়, পোস্টকার্ডে। সে তার নিজের লোক বটে বেকার আর সৎ, সামান্য একটা অনিয়ন কাটার দিয়ে যার ঋণ শোধ করতে চেয়েছিল।

তার দুদিন পর ঠিক সময়ে নাতিন আসে, খবর পেয়ে আসে সারাতুন বুন, আসে দিলশাদের বয়-বেয়ারারা। তার বাড়ির মালিক চিটার ভাগ্নেটাকে শায়েস্তা করা গেল না বলে খবর দেওয়া হয় না।

সারাতুনের খেয়াল হলো কাগজপত্রের দিকে, সেই তো নমিনি লক্ষ লক্ষ টাকার। আর বয়-বেয়ারাদের চোখ থাকে ট্রাঙ্কগুলোর ওপর। আর বেকার সৎনাতিন নিয়ে যায় নানাকে আজিমপুরে কারণ এই কাজ করার মতো আর কোনো সহি মানুষ সত্যি ছিল না।