দুই বাংলার শিল্পীদের দলগত চিত্র-প্রদর্শনী

আমাদের চারুশিল্পীদের সঙ্গে পাশের দেশ ভারতের, বিশেষ করে ওপার বাংলার, শিল্পীদের আত্মিক বন্ধন এখন অনেকটাই সুদৃঢ়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে দুদেশের শিল্পীদের মধ্যে এই যোগাযোগের সূচনা হয়। ১৯৭৩ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে ভারতের কলকাতা, দিলিস্ন ও মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের সমকালীন শিল্পের এক প্রদর্শনী। এতে জয়নুল আবেদিনসহ বাংলাদেশের সমকালীন শিল্পীদের ১১৫টি শিল্পকর্ম স্থান পায়। গত এক যুগে উভয়পক্ষের আগ্রহে দুই বন্ধুরাষ্ট্রে চারুশিল্পীদের পারস্পরিক যোগাযোগ বাড়ছে; দুদেশে যৌথ চারুকলা প্রদর্শনীর আয়োজন হচ্ছে। আমাদের শিল্পীরা নিজেদের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে ওপারে যাচ্ছেন, তাঁরাও আসছেন, একের পর এক প্রদর্শনী হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদের জয়নুল গ্যালারিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হলো দুই বাংলার চারুশিল্পীদের একটি দলীয় চিত্র-প্রদর্শনী। গত ৯ অক্টোবর বুধবার থেকে ১৪ অক্টোবর ২০১৯ সোমবার পর্যন্ত প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। দুদেশের শিল্পীদের এই প্রদর্শনীর শিরোনাম একত্রিত হওয়া, যাকে বলা যায় সীমান্ত পেরিয়ে শিল্প ও সৃজন ভাবনার এক যূথবদ্ধতা।
বাংলাদেশের এগারোজন শিল্পীর সঙ্গে এ-আয়োজনে অংশ নিয়েছেন ভারতের দশজন চিত্রশিল্পী। একুশজন শিল্পীর মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ ভারতীয় শিল্পী প্রভাত চন্দ্র সেনের জন্ম বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কালিকচ্ছ গ্রামে ১৯৪২ সালে। তাঁর বেড়ে ওঠা ও পড়াশোনা এদেশেই। ১৯৬৬ সালে ঢাকার চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। যুবক বয়সে তিনি ভারতে গমন করে কলকাতার একটি স্কুলে শিক্ষকতায় নিযুক্ত হন। পাশাপাশি ভারতবর্ষে আয়োজিত নানা চিত্র-প্রদর্শনীতে তিনি অংশ নিয়েছেন।
প্রদর্শনীতে শিল্পী প্রভাত সেনের দুটি চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে। অ্যাক্রিলিকে কাগজের বোর্ডে তিনি এঁকেছেন ক্ষয়ে যাওয়া কংক্রিটের দেয়াল, সে-দেয়ালের একটিতে দুটি পায়রার প্রেম ও অন্যটিতে একটি ছাগলের ছবি প্রতিফলিত হয়েছে। এ যেন অজন্তার দেয়ালচিত্রের অনুরূপ ভাবব্যঞ্জনা নিয়ে আঁকা সমকালীন চিত্র।
শিল্পী অঞ্জন সেনগুপ্ত পাঁচটি একক চিত্র-প্রদর্শনী করেছেন, ভারতের জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীসহ নানা দলীয় প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন। কাগজে অ্যাক্রিলিকে তাঁর আঁকা দুটি চিত্রকর্মের একটি হলো ভূদৃশ্য ও অন্যটি দুই মুখ। তারাভরা নীল আকাশতলে পোড়ামাটি রঙের কয়েকটি বৃক্ষ আর তার ফাঁকে ফাঁকে কালচে ঘাস। অনেকটা আলংকারিক ধরনের দৃষ্টিনন্দন দ্বিমাত্রিক কাজ। অন্য চিত্রপটে মিষ্টি লাল, সাদা ও সবুজ রঙের আস্তরণের ওপর কালো রঙের রেখায় নারী ও পুরুষের অবয়ব এঁকেছেন শিল্পী।
শিল্পী রূপালি রায় শৈশব থেকে ছবি আঁকেন। বিশিষ্ট শিল্পী অসিত পাল ও সমীর আইচের কাছে ছবি আঁকায় শিক্ষা নিয়েছেন। তিনি বিমূর্তরীতিতে ভূদৃশ্য আঁকেন। প্রদর্শনীতে তাঁর দুটি চিত্রকর্মের একটির শিরোনাম ‘আশা’ ও অন্যটির নাম ‘পারিলের নিসর্গ’। দুটিই ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিকে আঁকা। ‘আশা’ নামের কাজটিতে শিল্পী আগামীর সম্ভাবনাকে মেলে ধরেছেন অন্ধকার থেকে আলোর উদ্ভাসনকে তুলে ধরে।
উমা বর্ধন বাস্তবানুগ রীতিতে ছবি আঁকেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষা তিনি নেননি। শিল্পে তিনি দীক্ষা নিয়েছেন শিল্পী মাখনলাল দত্ত ও মানিকলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। প্রদর্শনীতে তাঁর দুটি চিত্রকর্মের একটির শিরোনাম – ‘ঐতিহ্যবাহী পটচিত্রী’। ছবিতে দুজন নারী পটুয়া পটচিত্র আঁকছেন। আরেকটি চিত্রে তিনি এঁকেছেন সকালের মিষ্টি আলোয় এক নারী তাঁর শিশুকে কোলে নিয়ে বৃক্ষঘেরা ফুলেল প্রকৃতির ভেতর দিয়ে এগিয়ে আসছেন।
শিল্পী সন্দীপ ভট্টাচার্য দৃশ্যশিল্পে স্নাতক করেছেন কলকাতা চারুকলা মহাবিদ্যালয় থেকে ১৯৯১ সালে। শান্তিনিকেতনের বনের পুকুরডাঙায় তাঁর আবাস ও স্টুডিও। লোকশিল্পের ফর্ম ও রং নিয়ে যেন উপকথার গল্প তুলে ধরেছেন। এ-প্রদর্শনীতে থাকা শিল্পীর দুটি কাজের শিরোনাম ‘আনন্দ’ ও ‘শান্তি’। অ্যাক্রিলিকে বোর্ডে আঁকা প্রথম চিত্রটিতে আমরা দেখতে পাই বাদনরত বংশীবাদক, উপবেশনরত নারী ও দ-ায়মান শিশু। চিত্রপটের ওপর মেঘের কোলে সন্তরণশীল এক পরি। গ্রামীণ জনজীবনের লোকাচার নিয়ে আনন্দময় এক পরিবেশ তুলে ধরেছেন শিল্পী তাঁর চিত্রকর্মে।
পপি ব্যানার্জি দৃশ্যশিল্পে ১৯৯২ সালের স্নাতক। গাছের শেকড় নিয়ে মানবাকৃতিতে নানা রূপ তুলে ধরেন শিল্পী। একই বছর শিল্পে স্নাতক করেছেন শান্ত সরকার। শৈশব নিয়ে কালি-কলমে দৃষ্টিনন্দন ছবি এঁকেছেন তিনি। আবার মিশ্রমাধ্যমে এঁকেছেন দুর্গার সাদামাটা অবয়ব।
তন্ময় বিশ্বাস বস্ত্রনকশায় স্নাতক সম্পন্ন করে ট্যাপেস্ট্রি মাধ্যমে শিল্পসৃজন করছেন, মা ও শিশুর চিরন্তন সম্পর্ক নিয়ে। প্রত্যুষা মুখার্জি হাতে তৈরি কাগজে কালি-কলমে ভূদৃশ্য ও জড়জীবনের ছবি এঁকেছেন। সোমা মাজি দৃশ্যশিল্পে কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। তিনি মানব অবয়ব ও জ্যামিতিক ফর্ম নিয়ে জলরঙে ছবি এঁকেছেন; যার শিরোনাম দিয়েছেন – ‘আমাকে বাঁচাও’। শিশু, নারী ও পরিবেশকে বাঁচানোর আকুতি এখানে।
এ-প্রদর্শনীর উদ্যোক্তা বাংলাদেশের কয়েকজন সহপাঠী শিল্পী। তাঁরা হলেন – গোলাম মোহাম্মদ জোয়ারদার, সুজন দে, লায়লা আন্জুমান আরা, কমর মুস্তারী শাপলা ও প্রহ্লাদ কর্মকার। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন শিল্পী আফরোজা আকতারি, শর্বরী রায় চৌধুরী, উর্মিলা দাস, আহসান আহমেদ, শর্মিলা কাদের ও রেজওয়ান পিলো।
আমাদের শিল্পীরা প্রধানত বাস্তবানুগ ও এর কাছাকাছি রীতিতে ছবি এঁকেছেন। বেঁচে থাকার আশায় উত্তাল সমুদ্র পেরিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসার ঘটনা নিয়ে ছবি এঁকেছেন ১৯৮৫ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চারুকলায় স্নাতকোত্তর শিল্পী আফরোজা আকতারি। ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিকে আঁকা তাঁর দুটি চিত্রকর্মের নাম – ‘রোহিঙ্গা সমস্যা’ ও ‘ঝিনুক কুড়োনোর বেলায়’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে ১৯৯০ সালে প্রাচ্যকলায় স্নাতকোত্তর করা শিল্পী লায়লা আন্জুমান আরা ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিকে নিসর্গের বাস্তবানুগ ছবি এঁকেছেন। কমর মুস্তারী শাপলা প্রাণী ও পাখি নিয়ে মানুষের মমতা তুলে ধরেছেন।
সুজন দে আমাদের নিসর্গের ফর্ম ও রং নিয়ে এর রূপকে লোকায়ত বিন্যাসে তুলে ধরেন দর্শকের সামনে। জলরঙে আঁকা তাঁর চিত্রকর্মের শিরোনাম – ‘শব্দের ছন্দ ১ ও ২’। শিল্পী প্রহ্লাদ চন্দ্র কর্মকার ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিকে বাস্তবানুগ রীতিতে এঁকেছেন – ‘ইম্প্রেশন অব ন্যাচার’।
শিল্পী গোলাম মোহাম্মদ জোয়ারদার নিসর্গের রূপ-রস-রং নিয়ে তাঁর চিত্রপটে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে নান্দনিক আবহ তৈরি করেছেন। ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিকে আঁকা তাঁর দুটি চিত্রকর্মের শিরোনাম – ‘আকাশের নানা রং’ ও ‘শিরোনামহীন’।
শিল্পী শর্বরী রায় চৌধুরী ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভের চারুকলা বিভাগের গ্রাফিক ডিজাইনের সহযোগী অধ্যাপক। অ্যাক্রিলিক রঙে তিনি তাঁর চিত্রপটে আবেগের দ্যোতনা, আবেগের ওঠানামা এসব তুলে ধরেছেন সাদা-কালোর বর্ণপর্দায়।
তরুণ চারজন শিল্পী এই দলীয় প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন। তাঁরা হলেন – উর্মিলা দাস, আহসান আহমেদ, শর্মিলা কাদের ও রেজওয়ান পিলো। প্রাচ্য ঘরানায় পটের ছবি আঁকেন উর্মিলা। তাঁর চিত্রকর্মের নাম – ‘লোকশিল্প ১ ও ২’।
শিল্পী আহসান আহমেদ কাগজে জলরঙে এঁকেছেন – ‘কালো সময় ও ঐতিহ্য’। শর্মিলা কাদের চিত্রপটে নাটকীয়ভাবে নানারঙের কাপড়ের ভাঁজের ফাঁকে নগ্নিকার ছবি তুলে ধরেছেন। শিল্পী রেজওয়ান পিলো প্রায় পুরো ক্যানভাসে আকাশছোঁয়া ও জলে নিমগ্ন এক নারী অবয়ব এঁকেছেন। এর নাম দিয়েছেন ‘প্রকৃতির প্রতিবিম্ব’। পড়ার ঘর নিয়ে তিনি আরেকটি বাস্তবানুগ ছবি এঁকেছেন।
প্রতিবেশী দুটি দেশের শিল্পীদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ ও আন্তরিকতা সৃষ্টিতে এ-প্রদর্শনী কিছুটা হলেও অবদান রেখেছে বলে আমি মনে করি।