বাংলার লোকসাহিত্যে মৈমনসিং গীতিকা নামের পালাগুলির সিংহভাগই কিশোরগঞ্জের, কিছু পার্শ্ববর্তী নেত্রকোনার। ব্রিটিশ আমলের বৃহত্তম জেলা ময়মনসিংহের অংশভুক্ত হওয়ায় গ্রন্থের এরূপ নামকরণ। নিজস্বতার পাশাপাশি কিশোরগঞ্জের ভৌগোলিক সীমানা চারপাশ থেকে চার সমৃদ্ধ সংস্কৃতির জনপদকে আলিঙ্গন করেছে : উত্তরে গারো পাহাড়ের উপত্যকা, দক্ষিণে ঢাকা-ভাওয়ালের অরণ্য, পূর্বে চিরায়ত সিলেট-কামরূপ, পূর্ব-দক্ষিণে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লার নদী অববাহিকা আর পশ্চিমে বৃহত্তর ময়মনসিংহের বাদবাকি অংশ। ঘটনাক্রমে কিশোরগঞ্জ আমার জন্মস্থান এবং পুরনো ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকার ঐতিহ্যসমৃদ্ধ জনপদটি আমার শৈশব-কৈশোরের ভিত্তিভূমি। আমার পরিবারের বংশানুক্রমিক আদিবাসও কিশোরগঞ্জেই। কিশোরগঞ্জ সীমান্তবর্তী অঞ্চল নয়, যেমনভাবে সীমান্ত-সংলগ্ন নয় এপারের বিক্রমপুর, ফরিদপুর ইত্যাদি এবং ওপারের বর্ধমান বা হুগলি। সীমান্তের জেলা চব্বিশ পরগণা, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদা, দিনাজপুর, কোচবিহার ইত্যাদির মতো প্রত্যক্ষ আঁচড় বা ভৌগোলিক বিভাজন উভয় বঙ্গের সীমান্ত থেকে দূরবর্তী জেলা বা জনপদগুলিতে দৃশ্যমান হয়নি। কিন্তু দেশভাগের পরোক্ষ প্রভাবে সর্বত্রই জনবিন্যাস, সমাজকাঠামো ও সংস্কৃতিতে ব্যাপক রূপান্তর ঘটেছে। ফলে দেশ, দেশভাগ, বিভাজন, মানবমণ্ডলী সংক্রান্ত আলোচনা বা পর্যবেক্ষণ ওপরতলার জাতীয় স্তরের পাশাপাশি তৃণমূল পর্যায়কে আশ্রয় করে করারও অবকাশ রয়েছে। কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে ৭৫ বছর পরেও দেশভাগের ক্ষত সমাজের শেকড় পর্যায়ের মানুষের মধ্যে কীভাবে ও কেমনভাবে বিরাজমান, তা অনুভব করা সম্ভব হতে পারে।
ক) কিশোরগঞ্জ শহরে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কার্যালয়কে পুরনো লোকজন ভূপেশ বাবুর বাড়ি বলে জানেন। ভূপেশ গুপ্ত পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের কমিউনিস্ট নেতা। দেশভাগের আগেই তিনি কলকাতার বাসিন্দা। যেমনভাবে ইটনার আনন্দমোহন বসু, কটিয়াদির উপেন্দ্রকিশোর রায় প্রমুখের বসতবাড়ি পড়ে আছে; কিন্তু তাঁরা নেই। তাঁদের শূন্যতা দেশভাগের কথা বারবার মনে করিয়ে দেয়। দেশভাগের কারণে উদ্বাস্তু না হয়েও তাঁরা কেউই আর ফিরে আসেননি। এমন পরিবার অনেক যাঁরা দেশভাগের আগে এবং দেশভাগের কারণে জন্মভূমি ছেড়েছেন। কখনো কলকাতা বা ভারতের কোথাও কোথাও তেমন পরিবারগুলির সন্ধান পাওয়া যায়। স্থানীয় লোকজন তাঁদের দেখা পেলে সেসব কথা ফিরে এসে সঘন আবেগের সঙ্গে বর্ণনা করেন এবং সমগ্র শহরে তা আলোচিত হয়।১
খ) কলকাতার গড়িয়াহাট রোডে খাজা নাজিমুদ্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখের বাড়িগুলিও হাতবদল হয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। দেশভাগ কলকাতার এমন অসংখ্য বাড়ির বাসিন্দাদের প্রত্যাবর্তনের পথ রুদ্ধ করেছে।
গ) দেশভাগের তোড়ে শুধু বাঙালিরাই নন, একদল বিহারি এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন আমাদের কিশোরগঞ্জ শহরে। সাধারণত উদ্বাস্তুরা সীমান্তের আশেপাশেই বসতি গড়েন। যশোর-চব্বিশ পরগণা, নদীয়া-কুষ্টিয়া, মালদা-চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মুর্শিদাবাদ-রাজশাহী, উভয় দিনাজপুরে এমন পরিস্থিতি দৃশ্যমান। অপশন দিয়ে কিংবা সম্পত্তি অদলবদল করে উভয় অংশের উদ্বাস্তু বা দেশান্তরী মানুষেরা সীমান্তের কাছাকাছিই অবস্থান করেন। এর কয়েকটি কারণ রয়েছে : ১. দেশের কাছাকাছি থাকা। ২. ভাষা ও সংস্কৃতির নৈকট্যের মধ্যে থাকা। ৩. রাজধানী বা বড় শহরে আর্থিক বা অন্যবিধ কারণে জায়গা করতে না পারা। তাছাড়া স্থানান্তরিত লোকজন নতুন বসতি স্থাপন করেছেন কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি এমন স্থানে। যে-কারণে সীমান্তসংলগ্ন জেলাগুলির মতোই শিল্পশহর খুলনা ও বগুড়া, রেলশহর ঈশ্বরদী, সান্তাহার, জয়পুরহাটে বাঙালি ও অবাঙালি উদ্বাস্তুর ভিড় বেশি। রেলের চাকরির সুবাদে বিহারিরা সেসব জায়গাতেই সংখ্যায় অধিক। কিন্তু একদল বিহারি, পেশায় যারা ধুনকর, বাস্তুচ্যুত হয়ে কিশোরগঞ্জে বসতি স্থাপন করেন। শৈশব থেকেই আমরা তাঁদের অবাক চোখে দেখতাম ভাষা ও সাংস্কৃতিক বিভিন্নতার কারণে। বর্তমানে অবশ্য এঁদের স্থানীয়দের চেয়ে আলাদা করা যায় না। তথাপি বিহারের পূর্ণিয়া বা মুঙ্গের থেকে কিছু কিছু আত্মীয় প্রতিবছরই তাঁদের দেখতে আসেন, তাঁরাও পালা করে ভারতের বিহারের আদিভিটায় তাঁদের ভাষায় ‘জিয়ারত’ করতে যান। সেসব আসা-যাওয়া ও মিথস্ক্রিয়ার সূত্র এতো দ্বন্দ্ব-সংঘাত-বিভক্তি ও তিক্ততার পরেও ছিন্ন হয়নি।
অতএব, দেশভাগে কেবলমাত্র সীমান্তবর্তী জেলাগুলি বিভাজিত হলেও তা সমগ্র বঙ্গদেশ তথা ভারতবর্ষকেই নানা মাত্রা ও পরিমাণে স্পর্শ করেছে এবং ভূগোলের বিভাজন মানুষের হৃদয় ও আবেগকে বিদীর্ণ করেছে। দেশভাগ মোটেও রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক ভাগাভাগিতেই আচ্ছন্ন কিংবা সীমিত থাকেনি, তীব্রভাবে বিভক্ত ও বিভাজিত করেছে মানবমণ্ডলীর নানা প্রসঙ্গ ও প্রপঞ্চকেও। পঁচাত্তর বছর পর সেই ফাঁক ও ফারাক বেড়েছে, নাকি কমেছে – এমন প্রশ্ন উত্থাপন করা কী অনুচিত হবে? হয়তো রাজনৈতিক তর্কে এই প্রশ্নের মীমাংসা খুঁজে পাওয়া যাবে না। তথাপি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরে প্রশ্নটিকে আদৌ উপেক্ষা করা সম্ভব হয় কি? মানুষের ‘মানবিক মন’ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে অক্লান্ত ও বিরামহীন।
দুই
অত্যল্প আকারে হলেও জন্মস্থানকে টেনে আনা এবং এর মাহাত্ম্য ও ভৌগোলিক গাম্ভীর্য বর্ণনার মূল কারণ এই যে, অবিভক্ত বৃহৎ বঙ্গদেশের সঙ্গে এর বহুমাত্রিক সম্পর্কের নিরিখে ‘দেশভাগ’ নামক বিষয়টিকে পর্যালোচনা করা। তাছাড়া দেশভাগের ফলে সৃষ্ট ফাঁক, ভেদ ও বিভেদ, ক্ষতগুলি এবং অর্জন ও বিসর্জনগুলি সম্পর্কে বিগত পঁচাত্তর বছরের পরিসরকে সামনে রেখে একটি পর্যবেক্ষণ সম্পন্ন করা। যদিও দেশভাগকে বীক্ষণ করার নানা মাত্রা ও দৃষ্টিভঙ্গির অভাব নেই। নানা তাত্ত্বিক ও বিদ্যায়তনিক কাঠামোতে এসব প্রচেষ্টা কমবেশি সচল এবং এক্ষেত্রে সর্বপ্রথম কাজ শুরু করেন সাহিত্যিকগণ, পরবর্তীকালে চলচ্চিত্র নির্মাতারা এবং সর্বশেষে, অতিসম্প্রতি ইতিাহাস ও সমাজবিজ্ঞানের নানা শাখার অ্যাকাডেমিকগণ। বলা বাহুল্য, দেশভাগ সংক্রান্ত যাবতীয় চর্চার কাজে ভারতের পশ্চিম সীমান্তের পাঞ্জাব অঞ্চল যতটুকু অগ্রগামী ও তৎপর, পূর্ব সীমান্তের বাংলা ভাষাভাষীগণ ততটুকু নয়, যদিও উভয় প্রান্তই দেশভাগের আঘাতে রক্তাক্ত, ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপর্যস্ত।
ভারতের পশ্চিমাংশে উর্দু ভাষায় ১৯৪৭ সালের আগে ও অব্যবহিত পরেই দেশভাগ নিয়ে তীব্রভাবে লেখালেখি, চর্চা ও ডিসকোর্স নির্মাণ শুরু হয়, যার প্রভাব সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রে এবং নাটক, চলচ্চিত্রসহ সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনের প্রতিটি অঙ্গনকে প্রবলভাবে স্পর্শ করে। দেশভাগ বা স্বাধীনতার আদিভোরেই উপনিবেশোত্তর সমাজে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকার জনগণের সম্পদে পরিণত হওয়ার বদলে নানা স্বার্থগোষ্ঠীর কুক্ষিগত হওয়ার প্রতিবাদে উচ্চকিত হয়েছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত উর্দু কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ (১৯১১-৮৪) তাঁর ‘স্বাধীনতার সকাল : আগস্ট ১৯৪৭’ শিরোনামের কবিতায়২ :
ইয়ে দাগ দাগ উজালা, ইয়ে শাব গাজিদা সাহার
উযো ইন্তিজার থা জিস কা, ইয়ে উয়ো সাহার তো নেহি।
[এই ফ্যাকাশে আলো, অন্ধকারে-মোড়া এই সকাল
এর জন্য তো অপেক্ষায় ছিলাম না আমরা।]
বাংলা ভাষায় দেশভাগ বিষয়ক আলাপ-আলোচনার সূত্রপাত আরো অনেক পরে এবং ধীরলয়ে। ষাটের দশকে পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু জীবনের নানা যন্ত্রণা চিত্রিত হতে থাকে, সঙ্গে কিছু স্মৃতিকথা। বাংলাদেশে শরণার্থী হয়ে আগত লেখকগণ নিজের মাটি তৈরির কাজটি সামলিয়ে আরো পরে কলম ধরেন। কলকাতার চলচ্চিত্রে মূর্ত হওয়া দেশভাগ বৃহত্তর দর্শকদের আলোড়িত করে এবং দেশভাগ সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনার পরিধি বৃদ্ধি পায়। কলকাতার উপান্তের এক বস্তিতে নীতা, গীতাদের রিফিউজি বাবা কিশোরগঞ্জের মাস্টার মশাইয়ের পরিবারকে আবর্তিত ঘটনা দেশভাগের ভয়ংকর প্রতিক্রিয়াগুলি উন্মোচনের মাধ্যমে স্পর্শ মানুষকে করে। সবাই তখন আশেপাশে তাকিয়ে এমন আরো শত-সহস্র উদ্বাস্তু পরিবারের সাক্ষাৎ পান এবং তাঁদের পরিবর্তিত আত্মপরিচিতির অন্তরালে জীবনসংগ্রামের গভীর দিকগুলিকে অনুভব করেন। শক্তিপদ রাজগুরুর মূল কাহিনি থেকে ঋত্বিক ঘটক মেঘে ঢাকা তারা চলচ্চিত্রে তেমনই শৈল্পিক প্রতিফলন ঘটিয়েছেন দেশান্তরী মানুষের চিরন্তন আর্তিতে।৩ বহু বছর পেরিয়ে দেশভাগের ফলে বিভাজিত মানবমণ্ডলীর আর্তি চাপা পড়লেও একেবারেই শেষ হয়ে যায়নি। নতুন পরিবেশ, নতুন পরিচিতি, নতুন জীবনের হাতছানির মধ্যেও বুক-চাপা দীর্ঘশ্বাস ভেসে ভেসে ঠিক চলে যায় পূর্বপুরুষের আদিভিটায়, যা হয়তো হাতছাড়া হয়ে পড়ে আছে বিভক্ত বাংলা বা পাঞ্জাব বা ভারতবর্ষের কোনো কোনো প্রান্তে ও উপান্তে।
তিন
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আমার কর্মক্ষেত্র বাংলার সর্বদক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের চট্টগ্রামে অবস্থিত। কিন্তু আমার জন্মস্থানের অবস্থান পূর্ববঙ্গ বা আজকের বাংলাদেশের মোটামুটিভাবে মধ্যভাগে, যে এলাকা অবিভক্ত বৃহৎ বঙ্গদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, রাজনীতি ও সংস্কৃতি তথা সর্বক্ষেত্রেই তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছে। বিস্তারিত বিবরণ এড়িয়ে কয়েকজনের নাম করছি : কবি চন্দ্রাবতী (ষোড়শ/ সপ্তদশ শতাব্দী),
মসনদ-ই-আলা ঈসা খাঁ (১৫৩৬-৯৯), আনন্দমোহন বসু (১৮৪৭-১৯০৬), উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
(১৮৬৩-১৯১৫), নীরদ সি চৌধুরী (১৮৯৭-১৯৯৯), শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন (১৯১৪-৭৬), মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী (১৮৮৯-১৯৭০), রেবতীমোহন বর্মণ (১৯০৩-৫২), ড. নীহাররঞ্জন রায় (১৯০৩-৮১), দেবব্রত বিশ^াস (১৯১১-৮০), ভূপেশ গুপ্ত (১৯১৪-৮১), চুনী গোস্বামী (১৯৩৮-২০২০)। এইসব নমস্য মানুষ বলতে গেলে কেউই দেশভাগজনিত কারণে বাস্তুচ্যুত ও দেশান্তরী নন। এঁদেরকে চলতি ভাষায় পূর্ববঙ্গীয় অর্থে বাঙাল বলা হলেও রিফিউজি বলা যায় না। দেশভাগের বহু বছর আগে থেকেই তাঁরা অবিভক্ত বাঙলার অগ্রসর নাগরিক রূপে তৎকালের রাজধানী শহর কলকাতার বাসিন্দা এবং বঙ্গীয় সমাজের নানা ক্ষেত্রে প্রভাবশালী বলে পরিগণিত। কিন্তু স্ব-স্ব ক্ষেত্রে কৃতবিদ্য এইসব মানুষের বা তাঁদের উত্তরপুরুষের আর ঘরে ফেরা হয়নি। দেশভাগের রাজনৈতিক পালাবদল ও ভৌগোলিক বিভাজনের কারণে তাঁরাও চিরতরে তাঁদের ‘দ্যাশ’ হারিয়েছেন। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ কেবল তৎকালের এবং পরবর্তী প্রজন্মকে উন্মূল করেনি, পূর্বাপর প্রজন্মেরও হানি ঘটিয়েছে। প্রজন্মের পাশাপাশি পরম্পরা, ঐতিহ্য, ঐক্য ও সংহতিতেও ছেদ ঘটিয়েছে। দেশভাগ একটি নতুন সামাজিক বাস্তবতা ও রাজনৈতিক কাঠামোর জন্ম দিয়েছে চিরায়ত সামাজিক পাটাতনের বিনাশ ঘটিয়ে। দেশভাগের ফলাফল হয়েছে মিশ্র : হারানোর বিনিময়ে পাওয়া। আর দেশভাগের অঙ্কটির দৃশ্যপট যদিও রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিসর, তথাপি এর প্রচণ্ড প্রভাব পড়েছে উভয় প্রান্তের বিভাজিত মানুষের আত্মপরিচিতি ও আত্মস্মৃতিমালায় এবং এর সুপ্ত বা প্রকাশ্য প্রভাব পড়েছে সামাজিক বিন্যাসে, সাংস্কৃতিক বুননে, ব্যক্তিগত আবেগের স্তরে। চিন্তা ও মননের পরিসরে এবং চেতনাপ্রবাহে দেশভাগের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উপস্থিতি পঁচাত্তর বছর পরেও তিরোহিত হয়নি। বরং দেশভাগের বড়মাপের
আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বিভাজনের আড়াল থেকে প্রান্তিক মানুষের হাহাকার৪, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্ষত, পচন ও প্রশ্ন উত্থাপিত হয়ে সামনে চলে আসছে।৫ সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো এই যে, সময়ের পরিবর্তনে দেশভাগ রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক বিতর্ক পেরিয়ে ক্রমেই ব্যক্তিগত স্মৃতিচর্চা ও সাহিত্য সাধনার মতো নিরাপদ ক্ষেত্রের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে বলে মনে করা হলেও বাস্তবে তা এখনো জীবন্ত উপস্থিতিতে বিরাজমান এবং ‘জাতীয় ইতিহাস রচনার সমস্যা’৬ রূপে গবেষকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি, ব্রিটিশ-ভারতের রক্তক্ষয়ী বিভক্তির কারণ সম্পর্কে জানা পঁচাত্তর বছর পরেও শেষ হয় না। নতুন প্রযুক্তি এবং কৌশল ব্যবহার করে গবেষকরা ১৯৪৭ সালের বিপর্যয়ের কারণগুলির জন্য এখনো উত্তর খুঁজছেন, যা লক্ষ লক্ষ লোককে হত্যা করেছিল।৭
চার
শুধু ১৯৪৭ সালেই নয়, ব্রিটিশরা বাংলা হয়ে ভারতের ক্ষমতা দখলের কারণে বাংলাকে এবং পরবর্তীকালে ভারতের নানা অংশকে সময়-সময় রাজনৈতিক প্রয়োজনে ও প্রশাসনিক সুবিধার্থে বিভক্ত ও বিন্যস্ত করে। ব্রিটিশদের যে ‘ভাগ করো ও শাসন করো’ নীতিকে হিন্দু-মুসলমান বিভাজন ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার নেপথ্য কারণ রূপে বিবেচনা করা হয়, মাটি ও ভূগোলের বিভাজনেও তা অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিল, যার দীর্ঘমেয়াদি কুপ্রভাব ১৯৪৭ সালের দেশভাগকালে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। বাংলার প্রসঙ্গে বলা যায় যে, বাংলা তথা অবিভক্ত বঙ্গ প্রদেশ বা বেঙ্গল প্রভিন্সকে ভৌগোলিক বিপুলায়তন এবং বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে ‘পূর্বাঞ্চলীয় বাংলা’ এবং ‘পশ্চিমাঞ্চলীয় বাংলা’ নামে অভিহিত করা হতো। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর বিভক্ত ভারত ও বিভক্ত বাংলায় পূর্ব ও পশ্চিমের অঞ্চল দুটি নতুন রাজনৈতিক ইউনিট হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। একটি হয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং অপরটি পাকিস্তানের পূর্ববঙ্গ। ১৯৫০ সালে ভারতের সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর প্রদেশগুলির প্রধানমন্ত্রী পরিচিতি পান মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আর প্রদেশগুলি পরিচিতি পায় রাজ্য হিসেবে। অন্যদিকে, ১৯৫৭ সালের পর পূর্ববঙ্গ পরিচিতি পায় পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে, যা ১৯৭১ সাল থেকে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। এই রাজনৈতিক পালাবদলের প্রভাব পড়েছে মানুষের পরিচিতিতে। কখনো তাঁরা ভারতীয় হয়েছেন, কখনো পাকিস্তানি বা বাংলাদেশি। এর বাইরেও তাঁদের ধর্মীয় পরিচিতি হিন্দু বা মুসলমান, অনেক সময়ই প্রাধান্য পেয়েছে। এইসব রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় পরিচিতির চাপে তাঁদের জাতিগত মূল পরিচিতি ‘বাঙালি’ বহুলাংশেই চাপে পড়েছে। পূর্বাঞ্চলের বাঙালিরা পাকিস্তানি-পাঞ্জাবি-উর্দুর চাপ প্রতিহত ও পরাজিত করে স্বাধীন বাংলাদেশ হয়েছে। এতে বাঙালির জাতিগত আত্মপরিচিতি দীর্ঘ অবদমনের পর রাষ্ট্রনৈতিক আত্মপরিচিতির সাংবিধানিক-রাজনৈতিক বৈধতা ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে।৮ দেশভাগের ফলে বাঙালির আত্মপরিচিতিতে যে বিভক্তি ও ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে, তার কতটুকু উপশম হলো এবং বাঙালি জাতিসত্তার সংকট কতটুকু কমলো বা বাড়লো, পঁচাত্তর বছর পর এমন প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানের যৌক্তিকতা এবং আত্মসমীক্ষার প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করা যায় না।
পাঁচ
১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে চিরতরে বিদায়ের আগে ব্রিটিশদের যাবতীয় লুণ্ঠন ও অপশাসনের ইতিবৃত্ত ও জাতিগত নিপীড়ন চাপা পড়ে স্বাধীনতা ও দেশভাগের দ্বৈরথে সৃষ্ট রাজনৈতিক, সামাজিক, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার আবর্তে। ভারতভাগের অংশ হিসেবে বাংলা ও পাঞ্জাবকে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। অবিভক্ত বাংলার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তানের পূর্ব বাংলা এবং অবশিষ্টাংশ নিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ গঠন করা হয়। তবে ব্রিটিশরাজের কাছ থেকে স্বাধীনতাপ্রাপ্তি বা ভারতবিভক্তি, যা-ই বলা হোক না কেন, ঘটনাটি দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বাঁক এবং পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম বড় আকারের একটি দেশান্তরেরও ঘটনা। দেশভাগের ঘটনা ঐতিহাসিক নথিপত্রে যেমন লিপিবদ্ধ রয়েছে, তেমনিভাবে বেঁচে আছে মানুষের স্মৃতিতে। বিপর্যস্ত ও ভুক্তভোগী পরিবারের পরম্পরায় ঘটনাটি অমোচনীয়। পূর্বপুরুষের ভিটা দেখতে গিয়ে প্রতিবারই এসব দেশান্তরী মানুষের মনে জাগে দেশভাগের স্মৃতি। সাধারণ মানুষ থেকে উচ্চপদাধিকারীও দেশভাগের রাজনৈতিক অভিঘাতের আবেগ থেকে বিযুক্ত হতে পারেননি।
প্রসঙ্গত, সিপিএম যখন পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায়, তখন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ও তাঁর স্ত্রীর বৃহত্তর ঢাকা জেলায় তাঁদের পৈতৃক নিবাসে বাংলা ভাগের পর প্রথম আগমনের কথা স্মরণযোগ্য। বসু পরিবারের দেশের মাটি ছোঁয়ার সময়কার আবেগময় বর্ণনা তৎকালের গণমাধ্যমগুলি গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করেছিল। এমনকি, যেখানে একসময় পরিবারের পূর্বপুরুষগণ তাঁদের দৈনন্দিন পূজা-আচার সম্পন্ন করতেন, সেই পরিত্যক্ত মন্দির থেকে জ্যোতি বসুর স্ত্রী ফিরে যাওয়ার সময় স্মৃতিস্বরূপ এক মুঠো মাটি নিয়ে গিয়েছিলেন। সন্দেহ নেই, দীর্ঘকাল পর পূর্বপুরুষের একদার আবাস দেখে বহুমাত্রিক অনুভূতি ও সংবেদনশীলতা প্রকাশিত হওয়াই স্বাভাবিক। পূর্বপুরুষের ভিটা, স্মৃতিমন্দির, শ্মশানভূমি, ধর্মস্থান হয়তো পরিত্যক্ত কিংবা কালের করাল গ্রাসে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে, কিন্তু সেখানেই দেশভাগের ফলে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন পরবর্তী প্রজন্ম কখনো ফিরে এসে ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের শেকড়ের ছোঁয়া পেয়েছেন। দেশভাগ ও ভৌগোলিক বিভাজন রাজনৈতিকভাবে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করলেও মানবমণ্ডলীর আবেগ ও অনুভূতি, ঐতিহ্য ও পরম্পরার জায়গাটিকে নস্যাৎ করতে পারেনি, যদি না কেউ, খুবই ব্যতিক্রমস্বরূপ, স্বেচ্ছায় নিজের অতীত ও পরিচিতি থেকে বিস্মৃত ও বিযুক্ত না হয়। কারণ, অনেক উদ্বাস্তুই বিদ্যমান বাস্তবতার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে না এবং পরিস্থিতির কাছে হার মানে এজন্য যে, ‘Refugees often find a conflict between the identity they have left behind and the one that lies before them. The boundary between the ‘self’ and the ‘other’ becomes futher exacerbated in a space of strong national identity.’৯
নতুন দেশ, সংস্কৃতি ও সমাজের অভিঘাতে দেশান্তরী বা অভিবাসী বা উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীর একটি ক্ষুদ্র অংশ পরিচিতির সংকটে আক্রান্ত হয়। কেউ কেউ তখন ধর্ম, বর্ণ, নাম, ধাম, ঠিকানা-ঠিকুজি পূর্বপরিচিতি মুছে আশ্রয়দাতা সমাজে বিলীন হয়ে যায়। এদের পক্ষে অতীত, ঐতিহ্য ও পরম্পরার যোগসূত্র রক্ষা করা সম্ভব হয় না। বিশেষত শক্তিশালী ও আগ্রাসী পরিচিতির দ্বারা আক্রান্ত ও নিমজ্জিত হলেও উন্মূল উদ্বাস্তুদের দুর্বল অংশ স্বকীয় আত্মপরিচিতি বিসর্জন দেয়।
তথাপি, দেশভাগ নিয়ে ব্যক্তিগত ও বিদ্যায়তনিক পর্যায়ে প্রশ্ন, সমীক্ষা, অনুসন্ধান ও দ্বিধার পাশাপাশি আত্মপরিচিতি পুনর্নির্মাণের প্রচেষ্টা পঁচাত্তর বছর পরেও তাৎপর্য হারায় না। রাজনৈতিকভাবে ‘সঠিক’ লেবেল এঁটে নেতৃবৃন্দ কর্তৃক ‘দেশভাগের সঙ্কুলতায় বিহ্বল’ জনতার ওপর যে বিভাজন ও দুর্ভোগ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেই জনতাও ঘোর কাটিয়ে সচকিত হয়। সচেতন মন তখন বাস্তবের মাটির একদিকে দেখতে পায় একদল লোককে, যাঁরা বিভাজন চেয়েছিলেন, অন্যদিকে, আরেক দল লোক, যাঁরা বাটোয়ারা চাননি।১০ তবে সবচেয়ে বড় যে দল বা অংশটি ছিলেন আমজনতা, তারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই রক্ত, আগুন, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা ও সশস্ত্র-উত্তেজনার মধ্য দিয়ে ভাগাভাগি মানতে বাধ্য হয়েছিলেন, যে-ভাগাভাগি সম্পন্ন করা হয়েছিল সুদূর দিল্লিতে তাঁদের মতামতকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে এবং তা তাঁদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল অতি সংক্ষিপ্ত সময়ের পরিসরে। ফলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাঁরা ঘরবাড়ি হারিয়েছেন এবং নতুন আশ্রয়ের সন্ধানে মানবস্রোতের সঙ্গে ভেসে গিয়েছেন। আর সেই নিরীহ জনতার বৃহদংশই দাঙ্গাকবলিত ও দেশভাগের শিকার হয়ে বাস্তুচ্যুত হন। রাজনীতিবিদগণ তখন অনেক দূরে, ক্ষমতার অলিন্দে পদ-পদবি-সুযোগ-সুবিধা-সম্পদ ইত্যাদির
ভাগ-বাটোয়ারায় ব্যস্ত ছিলেন। জনতার রক্তপাত দেখার মতো মানসিকতা তাঁদের অধিকাংশেরই তখন ছিল না। স্ব-স্ব রাজনৈতিক বিজয়ে তাঁরা ছিলেন উৎফুল্ল ও খুশি এবং বিদ্যমান রক্তাক্ত পরিস্থিতি সম্পর্কে নেতাদের অত্যল্পসংখ্যকই অনুভূতির প্রকাশ ও সংবেদনশীলতা প্রদর্শন করতে ইচ্ছুক ছিলেন।
ছয়
পঁচাত্তর বছরে নানাভাবে দেশভাগের ক্ষত মোচনের কাজ করা হয়েছে। উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের নানা রকম প্রকল্প গৃহীত হয়েছে। সংগ্রামশীল মানুষও সংকুলতা কাটিয়ে নিজস্ব মাটি তৈরি করে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছেন। কিন্তু ‘দেশভাগ’ ঘটনাকে ভুলতে পারেননি। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, দেশভাগ নিয়ে দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, আত্মসমীক্ষা, পরিচিতির সংকট ও নানাবিধ চর্চা ও বিতর্ক এখনো পণ্ডিতমহলে যেমন টাটকা, তেমনিভাবে জনমানসেও সজীব। সর্বসাম্প্রতিক সমীক্ষায় তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। সমীক্ষাটি চালিয়েছিল ভারতের ‘সি ভোটার’ নামে একটি সংস্থা। দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশে এই সমীক্ষায় অংশ নেন বাংলাদেশি, ভারতীয় ও পাকিস্তানি নাগরিকগণ। এই সমীক্ষায় উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য। ২০২২ সালের মে থেকে সেপ্টেম্বর মাসে পরিচালিত এই সমীক্ষায় ৪৪ শতাংশ মানুষ মনে করেছেন, দেশভাগ তথা
ভারত-পাকিস্তান ভাগ ঠিক হয়নি। কিন্তু ৪৬ শতাংশ মানুষ মনে করেছেন যে, দেশভাগ সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। বড়মাপের এই সমীক্ষায় পাঁচ হাজার আটশো পনেরো জন ভারতীয় অংশ নেন। এর মধ্যে গুজরাট, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান এবং গোয়ার মানুষজন দেশভাগ বা পার্টিশনের বিরুদ্ধে অভিমত দেন। সমীক্ষায় প্রশ্ন করা হয়েছিল, ভারতের জন্যে কারা সব থেকে নিরাপদ প্রতিবেশী? এই প্রশ্নের জবাবে ৬০ শতাংশ বলেছেন, ভারতের সব থেকে নিরাপদ প্রতিবেশী রাষ্ট্র হলো বাংলাদেশ। ভারতের পক্ষে নিরাপদ কি পাকিস্তান? এই প্রশ্নের জবাবে ৮৬ শতাংশ বলেছেন, না, পাকিস্তান নিরাপদ প্রতিবেশী নয়। উল্লেখ্য, পনেরোটি ভাষায় এই সমীক্ষা চালানো হয়। ‘সি ভোটার’-এর সাহায্যকারী সংস্থা হিসেবে সমীক্ষায় কাজ করেছিল ‘সিপিআর’।১১ একই প্রশ্ন যদি একটু ঘুরিয়ে করা হয়, তাহলে কেমন উত্তর পাওয়া যাবে, সমীক্ষায় তার উল্লেখ করা হয়নি। তবে, একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, ‘পাকিস্তানের পক্ষে নিরাপদ কি ভারত?’ এই প্রশ্নের জবাবে অধিকাংশই বলবেন, না, ভারত মোটেও পাকিস্তানের নিরাপদ প্রতিবেশী নয়। যেমনটি ভারতীয়রা মনে করেন যে, পাকিস্তান নিরাপদ প্রতিবেশী নয়। যে বৈরিতার উত্তরাধিকার পঁচাত্তর বছর আগে রক্ত ও মৃত্যুর পথে বিভাজন এনেছিল, সেই বৈরিতার অবসান যে এখনো হয়নি, জনসমীক্ষা তারও প্রমাণবহ। বিভক্তির জন্য সাতচল্লিশের যে নেতৃত্বকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়, বছরের পর বছর দূরত্ব ও শত্রুতা জিইয়ে রাখার জন্য পরবর্তী নেতৃত্ব নিশ্চয় ইতিহাসের কাঠগড়ায় নিজেদের দেখতে পাবেন।
সমীক্ষার আরেকটি প্রশ্ন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তা হলো, ‘ভারতের জন্যে কারা সব থেকে নিরাপদ প্রতিবেশী?’ সিংহভাগের উত্তর ছিল, বাংলাদেশ। কিন্তু এই প্রশ্নটি কিঞ্চিৎ বদলে যদি জানতে চাওয়া হয়, ‘বাংলাদেশের জন্যে কারা সব থেকে নিরাপদ প্রতিবেশী?’ এই প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশের জন্য দ্বিতীয় বিকল্প খুঁজে পাওয়াও সম্ভব হবে না। কারণ, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমান্ত প্রায় পুরোটাই ভারতের সঙ্গে। অতি সামান্য সীমান্ত রয়েছে মিয়ানমারের সঙ্গে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমানার ৪১৫৬ কিলোমিটার ভারতের সঙ্গে আর মিয়ানমারের সঙ্গে রয়েছে মাত্র ২৭১ কিলোমিটার। ফলে ভারতের বাইরে অন্য কোনো নিকট-প্রতিবেশীর কথা বিবেচনায় আনা প্রাকৃতিক-ভূগোলের কারণেই প্রায় অসম্ভব। তদুপরি মিয়ানমার প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের সীমান্তে সংঘাতের বিস্তৃতি ঘটাচ্ছে এবং তার দেশের দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা সংখ্যালঘু নাগরিককে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠিয়ে চরম বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে বৈরী প্রতিবেশীর তকমা পেয়েছে।
পক্ষান্তরে, ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তের আর্থ-সামাজিক-নিরাপত্তা ইত্যাদি যাবতীয় ইস্যু যেমনভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে নির্ভরশীল, তেমনিভাবে বাংলাদেশও তিন দিক দিয়েই ভারতের সঙ্গে সম্পর্কিত। সীমান্তের এই নিবিড় সম্পর্কের পাশাপাশি ছিটমহল, অভিন্ন নদীসহ আরো অনেক সম্পর্ক দুই দেশের মধ্যে রয়েছে। সবচেয়ে বেশি আছে ঐতিহাসিক ঐতিহ্য, যাকে নস্যাৎ করেছে দেশভাগ। দেশভাগের পরেও কিছু বিষয় ভাগ হতে পারেনি : আবেগ, পরম্পরা, স্মৃতি ও শেকড়, যা দুই দেশের মানুষই বহন করছেন। ফলে কার্যক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারত যেন নিজেদের সবচেয়ে নিরাপদ প্রতিবেশী ভাবতে পারে, তার জন্য স্ব-স্ব দেশের সরকারগুলির পাশাপাশি নাগরিক সমাজের পক্ষেও সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গৃহীত হওয়া উচিত। অন্তত, শান্তিকামী ও মুক্তমনা মানুষদের, যাঁদের ন্যূনতম ইতিহাসবোধ, আত্মমর্যাদা ও স্বকীয় পরিচিতি আছে এবং হানাহানি, সাম্প্রদায়িকতা ও বিভেদের অতীত সম্পর্কে অত্যল্প হলেও পাঠ রয়েছে, তাঁদের অবশ্যই উভয় দেশ ও দেশের মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্য, মৈত্রী ও সম্মানজনক সহাবস্থানের প্রশ্নে আপোসহীন হতেই হবে।
সাত
সন্দেহ নেই, দেশভাগ বিভাজিত ভূগোলের বিভাজিত মানুষের জীবন-ইতিহাস ভাঙা-গড়া, নির্মাণ-বিনির্মাণের ক্ষেত্রে একটি প্রধান প্রসঙ্গ। যে-ইতিহাসের অর্ধেক দৃশ্যমান ও নিত্যসঙ্গী; বাকি অর্ধেক অদৃশ্য, যা ফেলে আসতে হয়েছে। রাজনৈতিক আইন কিংবা সাংবিধানিক আলোচনার পরিধিতে ব্যক্তিমানুষের এসব ত্যাগ স্থান পায়নি। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার পূর্ব ও পশ্চিম, উভয় সীমান্তের দুই পারের বাসিন্দাদের একটি বড় অংশের জীবনও যে বিভাজিত হলো, দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে, সে-জীবনের বিপর্যয় ও অভিজ্ঞতাকে ‘সরকারি ভাষ্যে’ তুলে ধরার কোনো পরিসরই রাখা হয়নি। পরিবেশটি ছিল এমনই যে, কে কাকে তাড়িয়ে নিজের অবস্থান মজবুত করতে পারবে, সেটাই ছিল মূল লক্ষ্য। রাজনীতিবিদগণ ক্ষমতা মজবুত করেছেন আর আমজনতা সামাজিক-আর্থিকভাবে তৃণমূল স্তরে নিজেকে সুসংহত করেছেন। এমতাবস্থায়, প্রান্তিক, সংখ্যালঘু, নিরীহ মানুষেরা আলিঙ্গন করেছেন দেশভাগের জ্বালা, বিভাজন, সীমাহীন ত্যাগ ও দুর্ভোগ। একথাও আমরা ভুলে যাই যে, ব্রিটিশ-ভারতের বিভক্তিকরণ শুধু একটি সাংবিধানিক দেশবিভক্তিতেই আলোচনার টেবিলে বা আইনসভার বৈঠকে বসেই নিষ্পন্ন হয়নি, বরং দক্ষিণ এশিয়া নামের আসমুদ্রব্যাপী একক ও একটি জীবন্ত ভৌগোলিক ইউনিটকে কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। বিভাজিত ও কর্তিত হয়েছে নদী, পাহাড়, বনাঞ্চল, মানুষ ও পশুপাখির আবাস। সুন্দরবন, কচ্ছের রান কিংবা থর মরুর জীববৈচিত্র্য ও প্রাণিকুল পর্যন্ত উন্মূল হয়েছে এই বিভাজনের কারণে এবং বহু ক্ষেত্রেই অসংখ্য মানুষের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন পর্যন্ত তছনছ হয়ে গিয়েছে। সীমান্তরেখায় অসংখ্য ঘরগেরস্তালি, পরিবার ও মানুষের জীবনের মর্মান্তিক ব্যবচ্ছেদ যার প্রমাণবহ।
রাজনীতির চৌহদ্দির বাইরে এসে মানবিক বিপর্যয়ের এইসব ইতিবৃত্ত ও স্মৃতিমালার গুরুত্ব কতটুকু? কিংবা এসবের আদৌ কি কোনো তুল্যমূল্য ও গুরুত্ব রয়েছে? পঁচাত্তর বছর পর দেশভাগের বহুমুখী অভিঘাতসমূহ কতটুকু জীবন্ত রয়েছে? কিংবা কতটুকু জীবন্ত থাকা উচিত? এসব প্রশ্নের উত্তর একেকজনের কাছে একেক রকমের হওয়াই স্বাভাবিক। পাকিস্তানের পাঞ্জাবি তরুণী আনাম জাকারিয়া১২ যেমন দেশভাগ সম্পর্কে কয়েক প্রজন্ম পরের অভিব্যক্তি সংগ্রহ করেন তাঁর গ্রন্থসমূহে১৩, তেমনি অনেকেই রিফিউজি-অতীত মুছে নতুন পরিচিতি নির্মাণে অতি সাবধানতায় তৎপর হন। দেশভাগ নিয়ে রাজনীতিতে যেমন দ্বিধার বিস্তার, ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে আর জনমানসেও রয়েছে বিহ্বলতা। বরং বলা ভালো, একটি অভিযোজন ধারায় দেশভাগকে আত্মস্থ করেই এগিয়ে চলেছে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে বাস্তুচ্যুত মানুষজন। কলকাতার পার্ক সার্কাস, বালিগঞ্জ বা আলিপুরের পরিত্যক্ত বাড়িগুলিতে নতুন বাসিন্দারা স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করছেন। ঢাকার ওয়ারী, শাঁখারীবাজার, গেণ্ডারিয়ায় নবাগতরা আরামে দিনযাপন করছেন। কলকাতার আশেপাশে যেসব ছিল ‘রিফিউজি কলোনি’, সেগুলির চমৎকার নামকরণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলিতে ভারত-প্রত্যাগতদের যে ‘রিফিউজি পাড়া’ ছিল, সেগুলি নতুন নতুন বর্ণাঢ্য নামে অলংকৃত হয়েছে। রাজনীতি যে-দেশভাগ এনেছিল, সামাজিক বিবর্তনে সেগুলির বহুলাংশ হয়তো সহনীয় হয়ে গেছে। কিন্তু পঁচাত্তর বছর পরেও দেশভাগের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে সমীক্ষার অন্ত নেই। দেশভাগের স্মৃতি ও দ্রষ্টব্য সংরক্ষণ বন্ধ নেই। দেশভাগের বহুমাত্রিক অভিঘাত মানুষ-সমাজ-রাজনীতিতে কতটুকু জীবন্ত রয়েছে কিংবা কতটুকু জীবন্ত থাকা উচিত, এমন প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসের ‘যুগান্তকারী আলোচ্য বিষয়বস্তু’১৩ হিসেবে দেশভাগ নামক প্রপঞ্চটি সামনে এসে দাঁড়াবেই। আর তখনই দেখতে পাওয়া যায় যে, রাজনৈতিক স্পর্শকাতরতায় জারিত উগ্র জাতীয়তাবাদী পেশাদার ঐতিহাসিকদের চেতনাবোধের প্রলেপ দেশভাগের যাবতীয় প্রপঞ্চে প্রবলভাবে আধিপত্য বিস্তার করে রয়েছে। আবার ‘সাম্প্রদায়িকতা’র ইতিহাসবেত্তাগণ হিন্দু ও মুসলমান দৃষ্টিকোণ থেকে যে-ইতিহাস রচনা করেছেন, তা দেশভাগের পূর্ব ও পরবর্তী রাজনৈতিক ইতিহাসের চর্বিতচর্বণ মাত্র। এই উভয়বিধ ইতিহাসচর্চার সীমাবদ্ধতা এই যে, দক্ষিণ এশিয়ার বিভক্তিকালে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতি, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, বিশেষত ভাষা ও সাংস্কৃতিকভাবে প্রান্তিক, পশ্চাৎপদ ও সংখ্যালঘুতর মানুষের কথা সরকারি ইতিহাসভাষ্যে প্রায় অনুপস্থিত। এতে দেশভাগের মূলস্রোতের ঘটনাবলির আড়ালে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ষড়যন্ত্রের এবং সংকটের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বহু উপাখ্যান চাপা পড়ে যায় এবং দেশভাগ নামক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মাসুল জনজাতি ও প্রান্তিক সম্প্রদায়সমূহের মানবমণ্ডলী আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কীভাবে বহন করেছে, সেই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটুকু আদৌ গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। বস্তুতপক্ষে, দেশভাগের অফিসিয়াল ইতিহাসের ভাষ্যে মূলত আলোচিত হয়েছে রাজনৈতিক সংকটের বিষয়াবলি, যে-ইতিহাস কখনোই সেইসব মানুষের জীবন আর অভিজ্ঞতার কথা লিপিবদ্ধ করেনি, যাঁরা দেশভাগের সংকটকাল পাড়ি দিয়েছিলেন। এটাও ইতিহাসের ব্যর্থতা যে, দেশভাগের পূর্বাপর ঘটনাপ্রবাহ মানুষের মনে কেমন ছাপ ফেলেছিল, কীভাবে মানুষের পরিচিতির সংকট তৈরি হয়েছিল, অনিশ্চয়তার অমানিশা নেমে এসেছিল সমাজজীবনে এবং সর্বোপরি দেশভাগের কারণে সমাজে ও মানুষের জীবনে যে ক্ষত, হতাশা ও বেদনা আরোপিত হয়েছিল তা পুরোপুরিভাবে চিত্রিত করা হয়নি।
বরং ইংরেজ, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের আলাপ-আলোচনা, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির টানাপড়েনের বৃত্তেই আবর্তিত হয়েছে দেশভাগের যাবতীয় অনুষঙ্গ। দেশভাগের রেকর্ড বা নথিপত্রের বিশাল ভাণ্ডারও এক মানববিপর্যয় মিশ্রিত স্বাধীনতার তথ্য উপস্থাপন করে, যার চূড়ান্ত পরিণতি হলো ট্র্যাজিক দেশভাগ। জন্মভূমি থেকে উৎখাত হওয়ার বাস্তবতা, উদ্বাস্তু মানুষের জনস্রোত, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশত্যাগ, ধর্ষণ, অপহরণ, বলপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণ প্রভৃতি নির্মম ঘটনাপ্রবাহের ভিত্তিতে নির্মিত হয়েছে যে-দেশভাগ, যা আসলে দেশের ব্যবচ্ছেদ, মানুষের বিচ্ছেদ আর এসবই সংঘটিত হয়েছে একটি দীর্ঘ সময়কালের পরিধিতে এবং তা সুপ্তভাবে অব্যাহত থেকেছে সরকারিভাবে দেশবিভক্তির অনেক বছর পর্যন্ত। এমনকি, দেশভাগের পঁচাত্তর বছর পরেও দেশভাগ ও বিভাজনের ঘটনাবলির ঐতিহাসিক দায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাড়িত করছে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক, সংস্কৃতি, নাগরিকত্ব, জাতিত্ব, আত্মপরিচিতি, সীমান্ত, সমাজব্যবস্থা এবং সর্বোপরি মানবমণ্ডলীকে।
আট
বাংলাদেশের ও পশ্চিমবঙ্গের মূলধারার গণমাধ্যমে দেশভাগের পঁচাত্তর বছরের পর্যালোচনায় অপ্রাপ্তির ঐতিহাসিক দায়বোধ থেকে উচ্চারিত কথাগুলিকেই উপসংহার হিসেবে বলা যেতে পারে। ঢাকার একটি জাতীয় দৈনিকের ভাষ্যে :
‘Seventy-five years after the partition of the Indian subcontinent, we are still a long way from understanding the complex ways in which this event affected the everyday lives of people and communities then, and how it still continues to shape our collective consciousness, politics and ways of being.’১৪
কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকাও এ-বিষয়ে সরব। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ যে কতটাই উপরিতলের ভাগ ছিল, অন্তরটানে দুই বাংলা যে কতটা যুক্ত ছিল, শুধু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ নয়, মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিক্রিয়া তার সাক্ষ্য বলে মনে করে পত্রিকাটি। তাদের ভাষ্যে : অর্ধশতাধিক বছর পরে ফিরে তাকিয়ে মনে হয়, ১৯৭১ সালের গুরুত্ব স্বাভাবিকভাবে কেবল পূর্ববঙ্গের দিক থেকেই দেখা হয়েছে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গেও যে তার একটা বিরাট ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছিল, তা যেন এখনো ততটা বোঝা হয়নি। সেই গুরুত্ব খতিয়ে দেখতে গিয়ে যদি দাবি করা হয়, বঙ্গীয় হিন্দু ও মুসলমান সমাজ এত বেশি কাছাকাছি তার আগে বা পরে কখনোই আসেনি, খুব ভুল হবে কি? বিশ শতকের ইতিহাসে এমন আর একটি মুহূর্ত পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না, যখন দুই বাংলার হিন্দু-মুসলমান সম্মিলিত জনসমাজ একই আবেগে থরোথরো, একই প্রতিক্রিয়ায় উদ্ভাসিত।
বঙ্গভঙ্গ-স্বদেশি যুগের কথা মনে করতে পারেন কেউ। ইতিহাস-পাঠক তাঁকে তখন মনে করিয়ে দিতে পারেন, আকারে ও প্রকারে দুই সময়ের আন্দোলিত জনসমাজের কোনো তুলনাই হয় না। একে তো স্বদেশি আন্দোলনের ব্যাপ্তি ছিল কম, তার উপরে বাঙালি মুসলমান তাতে কতখানি অংশ নিয়েছিলেন, বিতর্কের বিষয়। পরবর্তী রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোতেও একত্র রাজনৈতিক কার্যক্রমের প্রসার অতখানি ছিল না। ১৯৩০-এর দশক থেকে দুই সমাজ আরো দূরবর্তী হতে শুরু করে, যার চরম বিপর্যয় ঘটে কিংবা রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির মাধ্যমে ঘটানো হয় ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময়। আবার ১৯৭১ সালের দিনগুলো বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসে এক দুর্লভ মাহাত্ম্যে ও সৌহার্দ্যে পরিপূর্ণ। আর সব পরিচয়, বিশেষত ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দূরত্ব তুচ্ছ হয়ে যায় বাঙালি পরিচয়ের সামনে। বাংলাদেশের বাঙালি হিন্দু-মুসলমান হাতে হাতে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছে দেখে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা চুপ থাকতে পারেনি। দেশভাগের বিশাল দূরত্ব ১৯৭১ সালে ইতিহাসের সবচেয়ে কাছাকাছি এসেছিল আর কলকাতার বিশিষ্ট লেখক-সাংবাদিক প্রকাশ্যে লিপিবদ্ধ করলেন ঐতিহাসিক ভাষ্য, যা প্রকাশ পায় আনন্দবাজার পত্রিকায়। ১৩ই এপ্রিল ১৯৭১ সালে সন্তোষকুমার ঘোষ লিখছেন : ‘ভুল, ভুল, একেবারে ভুল। সাত কোটি বাঙালিরে জননী মানুষও করেছেন। রবীন্দ্রনাথের ভুলটা ধরা পড়েছে এত দিনে। ওঁরা ধরিয়ে দিলেন। আমরা কৃতজ্ঞ।’১৫
দেশভাগের ক্ষত সারিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ ও একাকার করেছিল। বাঙালির আত্মপরিচয়ের দীপ্তিতে মুছে গিয়েছিল সাম্প্রদায়িক হানাহানির অতীতের গর্ভে লুক্কায়িত ভ্রাতৃঘাতের পাপ। বাংলার আকাশে মুক্তির লাল সূর্য উদ্ভাসিত করেছিল প্রতিটি বাঙালিকে।
পঁচাত্তর বছর পেরিয়ে গেল দেশভাগের বিভাজনের পথপরিক্রমায়। কিন্তু ১৯৭১-এর মতো আত্মপরিচিতির উদ্ভাস
যুক্ত-বাঙালির ঐতিহাসিক ঐক্যের ছায়াপাতে আবার কবে দেখতে পাওয়া যাবে?
তথ্যসূত্র
১. মাহফুজ পারভেজ, বঙ্গবন্ধু : সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, ঢাকা, স্টুডেন্ট ওয়েজ, ২০২৩।
২. মাহফুজ পারভেজ, ‘দেশভাগের রক্তাক্ত পদচিহ্ন’, কালি ও কলম, ২২শে নভেম্বর ২০১৭।
3. Ali Madeeh Hashmi, Love and Revolution : Faiz Ahmed Faiz-The Authorized Biography, New Delhi, Rupa Publications, India, 2016.
4. John Zaw, ‘Suu Kyi’s Call for Peace Sounds Hollow’, UCANEWS, 13 October, 2017.
টীকা
১. আমার নিজের এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে একাধিকবার। একবার শিলিগুড়ি শহরে খুঁজে পেলাম ত্রিদিব রায় নামক একজনকে, যে কিশোরগঞ্জের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমার সহপাঠী ছিল। আরেকবার কলকাতার দমদম এলাকার ক্যান্টনমেন্ট ও গোরাবাজারে আকস্মিকভাবে শিবাণী সরকারকে পেয়ে যাই, যিনি ছিলেন আমার বড় বোনের সহপাঠী। কিশোরগঞ্জ আমার বাড়ি শুনে স্থানীয় কয়েকজন আলাপ করাতে নিয়ে গেলে আমি শিবাণীদির সাক্ষাৎ পেয়ে ভীষণভাবে চমকে উঠি। প্রায় পঞ্চাশ বছরের ব্যবধানের দেখার আবেগ ছিল বর্ণনাতীত।
২. ফয়েজ যে প্রতিবাদভাষ্য নির্মাণ করেছেন তা দেশভাগের পঁচাত্তর বছর পর আজো প্রাসঙ্গিক। ২০১১ সালে ফয়েজের জন্মশতবার্ষিকী পালনকালে তাঁর কবিতা পড়ে প্রাচ্যবিদ-পণ্ডিত এডওয়ার্ড সায়ীদ তাঁকে একদিকে জন কিটসের ইন্দ্রিয়ময়তা, অন্যদিকে পাবলো নেরুদার ঝাঁজ খুঁজে পেয়েছিলেন। ফয়েজ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার জন্য, দেখুন, Ali Madeeh Hashmi, Love and Revolution : Faiz Ahmed Faiz-The Authorized Biography, New Delhi, Rupa Publications India, 2016; Estelle Dryland, Faiz Ahmed Faiz : Urdu Poet of Social Realism, Karachi, Vanguard Books, 1993; Gopi Chand Narang, Urdu Language and Literature : Critical Perspectives, Delhi, Sterling Pub. Ltd., 1987.
৩. সাধারণার্থে দেশবিভাগ এবং বিশেষার্থে বাংলাভাগের পটভূমিতে ঋত্বিক ঘটক-নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০)। পরে তিনি ১৯৬১ সালে কোমল গান্ধার, ১৯৬২ সালে সুবর্ণরেখা নির্মাণ করেন। এই তিনটি চলচ্চিত্রকে মিলিতভাবে ত্রয়ী বা ট্রিলজি বলা হয়। আরো জানতে, দেখুন, ঋত্বিককুমার ঘটক, মেঘে ঢাকা তারা : চিত্রনাট্য ও সমালোচনা, ঢাকা, নালন্দা, ২০১৬; ঋত্বিককুমার ঘটক, চলচ্চিত্র মানুষ এবং আরো কিছু, কলকাতা, দে’জ পাবলিশিং, ২০১৩; মাহফুজ পারভেজ, ‘ঋত্বিক ঘটক : চলচ্চিত্রের শিল্পিত কারিগর’, বার্তা২৪.কম; মাহফুজ পারভেজ, ‘সুবর্ণরেখা : নদী ও মানুষের আখ্যান’, বাতা২৪.কম।
৪. সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় এমনই বিষয় আলোচিত হয়েছে, দেখুন, Rup Kumar Barman, ‘Partition of Bengal and Struggle for Existance of the Host Society : The Case of the Rajbanshis of North Bengal’ in Chhanda Chatterjee (ed.), The Partition of the Indian Subcontinent (1947) and Beyond : Uneasy Borders, New Delhi, Routledge India, 2023.
৫. আদিবাসী-জনজাতির জীবনসংগ্রাম ও আন্দোলনে দেশভাগের আর্থ-সাংস্কৃতিক প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া নিয়েও আলোচনার পরিসর তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার ÔTribal Movements of IndiaÕ শিরোনামে অনুষ্ঠিত হয় ১৭ই ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে কলকাতার Heramba Chandra
College-Gi SC/ST Cell-এর উদ্যোগে।
৬. এ-সংক্রান্ত আলোচনার সর্বসাম্প্রতিক প্রবণতা সম্পর্কে জানতে, দেখুন, আহমেদ কামাল, ‘দেশবিভাগের অভিজ্ঞতা ও জাতীয় ইতিহাস রচনার সমস্যা’, প্রতিচিন্তা, জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১১ সংখ্যা।
৭. Alvin Powell, ‘Using new technology and techniques, scholars seek answers for 1947 cataclysm that killed millions’, Harvard Gazette, April 6, 2018.
Elena Montazemi Safari, ‘The Refugee Identity Crisis’, BizGees, 7 May 2021.
৮. এ-সংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনার জন্য, দেখুন, মাহফুজ পারভেজ, বঙ্গবন্ধু : সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, ঢাকা, স্টুডেন্ট ওয়েজ, ২০২৩।
৯. Elena Montazemi Safari, ‘The Refugee Identity Crisis’, BizGees, 7 May 2021.
১০. দেশভাগের রাজনৈতিক মেরুকরণ সম্পর্কে দেখুন, জয়া চ্যাচার্জি, বাংলা ভাগ হলো, ঢাকা, ইউপিএল, ২০১৪; জয়া চ্যাটার্জি, দেশভাগের অর্জন : বাঙলা ও ভারত (১৯৪৭-১৯৬৭), ঢাকা, মাওলা ব্রাদার্স, ২০২২।
১১. ‘৬০ শতাংশ ভারতীয় মনে করে বাংলাদেশ নিরাপদ প্রতিবেশী’, মানবজমিন, ৫ই অক্টোবর, ২০২২।
১২. বিস্তারিত দেখুন, মাহফুজ পারভেজ, ‘দেশভাগের রক্তাক্ত পদচিহ্ন’, কালি ও কলম, নভেম্বর ২০১৭।
১৩. আধুনিক দক্ষিণ এশিয়া এবং বাঙালি জাতিসত্তার ইতিহাসে আরেকটি যুগান্তকারী ঘটনা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন। দেখুন, সেমন্তী ঘোষ, ‘একাত্তর ছিল এ বঙ্গের বাঙালির পরিচয় গৌরবের সেরা পরীক্ষা’, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৫শে মার্চ, ২০২৩।
১৪. ‘75 Years of Partition’, The Daily Star, 7 October, 2022.
১৫. বিস্তারিত দেখুন, সেমন্তী ঘোষ, ‘একাত্তর ছিল এ বঙ্গের বাঙালির পরিচয় গৌরবের সেরা পরীক্ষা’, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৫শে মার্চ, ২০২৩।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.