দ্বারকানাথ ঠাকুর : আধুনিকতার বিস্মৃত পথিকৃৎ

গোলাম মুরশিদ

সমকালে তো নয়ই, কালের দূরত্বেও ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের যথার্থ মূল্যায়ন সবসময় হয় কিনা, সন্দেহের বিষয়। কারণ মূল্যায়নের নিক্তিতে একদিকে থাকে সেই ব্যক্তির অবদান, অন্যদিকে থাকে একটা বিশেষ সময় এবং সমাজের মূল্যবোধ ও মনোভাব। সেজন্যে, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি অনুকূল হলে যোগ্যতার তুলনায় কেউ কেউ অনেক বেশি স্বীকৃতি লাভ করেন; অপরপক্ষে কেউ কেউ হন উপেক্ষিত। এমনকি, মন্দভাগ্য হলে বিস্মৃত এবং ধিকৃতও হতে পারেন। সম্প্রতি এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা ঘাঁটার সময় কথাটা বিশেষ করে মনে হলো। দ্বারকানাথ ঠাকুর সম্পর্কে খুঁজতে গিয়ে দেখলাম, তাঁর নামে কোনো এন্ট্রি নেই। তবে তাঁর পুত্র দেবেন্দ্রনাথের আছে। রবীন্দ্রনাথের তো থাকবেই।

দেবেন্দ্রনাথকে এককথায় একজন জাতীয়তাবাদী ধর্মীয় নেতা ছাড়া আর কী বলা যায়? আরেকটু বিস্তৃত পরিচয় দিলে বলা যায়, তিনি পাশ্চাত্যকে প্রত্যাখ্যান করে সংশোধিত এবং তুলনামূলকভাবে আধুনিক একটি ধর্ম সম্প্রদায় গড়ে তোলার প্রয়াস পেয়েছিলেন। তাতে তিনি আংশিকভাবে সাফল্যও লাভ করেছিলেন। সেই ধর্মের সূত্র ধরেই ভক্তদের কাছে তিনি ‘মহর্ষি’ বলে পরিচিত হয়েছিলেন। এছাড়া, তাঁর একটি পরিচয় – তিনি কয়েকটি অসাধারণ প্রতিভাবান সন্তানের জনক। কিন্তু জিনতত্ত্বের যুগে সেটাকে তাঁর একক কৃতিত্ব বলে গণ্য করা কঠিন। এর বাইরে তাঁর আর বিশেষ কী অবদান আছে? তাঁকে ছোট করার চেষ্টা করছি না, কিন্তু এনসাইক্লোপিডিয়ার সম্পাদকদের কাছে একটা প্রশ্ন অবশ্যই করা যেতে পারে : আধুনিক বঙ্গদেশ তথা ভারতবর্ষ গড়ে তোলার ব্যাপারে দ্বারকানাথের অবদান কি দেবেন্দ্রনাথের তুলনায় অনেক বেশি নয়? এমনকি রামমোহন রায়কে আধুনিক ভারতবর্ষের জনক বলা হলে দ্বারকানাথের নাম কি সেইসঙ্গে উচ্চারিত হওয়া উচিত নয়?

বস্ত্তত, যে-কালে বেঁচেছিলেন, তখনকার তুলনায় দ্বারকানাথের চিন্তাধারা ছিল অনেক অগ্রসর। রামমোহনের মতোই অগ্রসর – যদিও দুজনের বিচরণক্ষেত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। একজন বিচরণ করেছিলেন প্রধানত মননশীলতা ও আধ্যাত্মিকতার জগতে, অন্যজন ইহলৌকিক জগতে। ভাবলে একান্তভাবে বিস্মিত হতে হয় : যে-কালে মানুষের জন্ম-মৃত্যু এবং তাবৎ কীর্তিকলাপ সীমাবদ্ধ থাকত কয়েক মাইলের একটা গন্ডির মধ্যে, যখন বাঙালিরা ছিলেন এককথায় কূপমন্ডূক – সে-কালে রামমোহন এবং দ্বারকানাথ কেবল বঙ্গদেশ নয়, বরং ভারতবর্ষেরও অনেক বাইরে বিশ্বের দিকে নিজেদের দৃষ্টিকে প্রসারিত করেছিলেন। বিশেষ করে রামমোহন সেই শম্বুকগতির যুগেই ইউরোপ-আমেরিকার ভাবুকদের সঙ্গে চিন্তার আদান-প্রদান করেছিলেন। সুদূর ইউরোপের কোন দেশে কী ঘটল, সে-কালের সীমিত যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যেও তার খবরাখবর রাখতেন তিনি এবং সে-সম্পর্কে নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতেন।

যখন তিনি কলকাতায় বসবাস করতে আরম্ভ করেননি, সে-সময়ে – ১৮১২ সালে – স্পেনের বিপ্লবীদের রচিত ‘বিকল্প সংবিধান’ উৎসর্গ করা হয়েছিল ছ-হাজার মাইল দূরবর্তী একটি দেশের একজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি – রামমোহনের নামে। এ থেকেই বোঝা যায়, বাইরের বিশ্বের সঙ্গে তিনি কত ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন। মনেপ্রাণে তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক মানুষ। রামমোহনের চেয়ে দ্বারকানাথের বয়স ২০ বছরেরও কম। তাই দ্বারকানাথ নিজেকে বিশ্বনাগরিক হিসেবে ভাবতে শুরু করেছিলেন রামমোহনের থেকে আরো বছর বিশেক পরে। এই দুই অসাধারণ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি কেবল নিজেরাই যে আধুনিক ছিলেন, তাই নয়; গোটা ভারতবর্ষকেই তাঁরা মধ্যযুগীয়তা থেকে আধুনিকতার আলোকে নিয়ে আসতে চেষ্টা করেছিলেন। সে-কারণে, রামমোহনকে যে আধুনিক ভারতবর্ষের জনক বলা হয়, তা অযথার্থ নয়। অন্তত চিন্তক হিসেবে এ-অভিধা তিনি পেতেই পারেন। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস, রামমোহন এই স্বীকৃতিলাভ করলেও, জনক তো দূরের কথা, দ্বারকানাথ আধুনিকতার পিতৃব্য বলেও স্বীকৃতি পাননি। একটু কাছ থেকে দেখলে আমার বরং দ্বারকানাথকেই রামমোহনের তুলনায় বেশি আধুনিক মনে হয়। কারণ রামমোহনের যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা ছিল। আনুষ্ঠানিক অথবা আধ্যাত্মিক ধর্মের সীমানাকে তিনি লঙ্ঘন করতে পারেননি। আবার, পাশ্চাত্যের ধ্যান-ধারণার সঙ্গে পরিচিত হয়ে, বিশেষ করে যুক্তিবাদ এবং উদারনৈতিকতার আলোকে তিনি প্রচলিত ধর্মের অনুশাসনকে পুরো মেনেও নিতে পারেননি। তাই সংস্কার করে ধর্মের সেই পরিধিকে তিনি খানিকটা প্রসারিত করতে চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু ঐশ্বরিক ধর্মের চৌহদ্দির মধ্যে থেকেই। তাঁর আরেকটা সীমাবদ্ধতা এই যে, তিনি ভাবনার ক্ষেত্রে যতটা আধুনিক হয়ে উঠেছিলেন, আধুনিকতার সে-ধারণাকে বাস্তবে প্রয়োগ করার প্রক্রিয়ায় ততটা উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। এমনকি, আপাতদৃষ্টিতে যাকে আধুনিকতা বলা হয়, কখনো কখনো তিনি তার বিরোধিতাও করেছিলেন। উনিশ শতকের বঙ্গদেশে যে-জাগরণ এবং ভাষা-সাহিত্য-সংগীতে সৃজনশীলতার যে-বিস্ফোরণ লক্ষ করি, ঐতিহাসিকরা যাকে সীমিত অভিধায় বঙ্গীয় রেনেসাঁস বলে আখ্যায়িত করেছেন, তাতে যাঁরা অসামান্য ভূমিকা রেখেছিলেন, তাঁরা অনেকেই ছিলেন হিন্দু কলেজের ছাত্র। অনেকেই বলি কেন, বেশিরভাগই। সেই হিন্দু কলেজ স্থাপনে রামমোহনের কোনো ভূমিকা ছিল না। বিরোধিতা না-করলেও কোনো রকম সহযোগিতা করেননি তিনি। তিনি সহায়তা করলে রক্ষণশীল হিন্দুরা বিরোধিতা করবেন বলে যে-কৈফিয়ত দেওয়া হয়, তাকে একটা খোঁড়া কৈফিয়ত ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না। আরো একটা কথা মনে রাখতে হয় : তিনি হিন্দু কলেজের মতো ধর্মনিরপেক্ষ একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ধারণাকেও সমর্থন করতে পারেননি। ধর্মশিক্ষা ছিল তাঁর মতে শিক্ষার আবশ্যিক অঙ্গ। কয়েক বছর পরে তিনি নিজে যে-স্কুল খুলেছিলেন, সে-স্কুলে ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। আমার বিশ্বাস, উনিশ শতকের বঙ্গদেশে মুক্তবুদ্ধির যে-চর্চা আরম্ভ হয়, হিন্দু কলেজই ছিল তার সূতিকাগৃহ। আর, সেই বুদ্ধিচর্চার প্রবর্তক এবং গুরু ছিলেন হেনরি ডিরোজিও। আপ্তবাক্য এবং পুরনো মূল্যবোধকে প্রশ্ন করা; যূথবদ্ধ বিশ্বাসকে অগ্রাহ্য করে নিজের দৃষ্টিতে জগৎ এবং জীবনকে দেখা; প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সংজ্ঞা অনুসারে ভালো-মন্দের বিচার না-করে যুক্তিবাদ এবং উদারতা দিয়ে প্রতিটি জিনিসের মূল্যায়ন করা; প্রচলিত অন্ধবিশ্বাস এবং আচার-আচরণকে অগ্রাহ্য করা; এমনকি, ঈশ্বর আছেন কি নেই, সে নিয়ে ১৮৩০-এর দশকে যে-বিতর্কের সূচনা হয়, রামমোহন তা প্রবর্তন করেননি; তা প্রবর্তনের কৃতিত্ব মাত্র তেইশ বছর বয়সে মৃত এক তরুণ শিক্ষক – ডিরোজিওর। ইউরোপ-আমেরিকার ইউনিটারিয়ান খ্রিষ্টানদের প্রভাব রামমোহনের ওপর নিঃসন্দেহে পড়েছিল। তাঁদের বাইরে নিরীশ্বর দার্শনিক জেরিমি বেন্থামের সঙ্গে তাঁর বেশ ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ঘটেছিল। এমনকি, বেন্থামের দুই বন্ধু – জেমস মিল আর রবার্ট ওয়েনের সঙ্গেও তিনি পরিচিত হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের ইহলৌকিক জীবনদর্শন রামমোহনকে প্রভাবিত করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং তাঁর চিন্তাধারা ও কার্যকলাপ বিবর্তিত হয়েছে প্রধানত ধর্মকে কেন্দ্র করে। একাধিক ভাষায় সাময়িকপত্র প্রকাশ করে তিনি সমকালীন সমাজের প্রতি নিশ্চিতভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। সেক্ষেত্রে তাঁর পত্রিকারও প্রধান বিষয়বস্ত্ত সাধারণভাবে সমাজের জাগরণ ছিল না, বরং ছিল ধর্মীয় বিতর্ক। শিক্ষাবিস্তার এবং জনকল্যাণের জন্যে সেকালে হিন্দু কলেজ এবং পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন কমিটিসহ অনেক সামাজিক সংগঠন গড়ে উঠেছিল। ইংরেজ এবং বাঙালি উভয় সম্প্রদায়কে নিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু এগুলোর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল না।

একমাত্র যে-প্রতিষ্ঠান তিনি স্থাপন করেন, সেটিও ছিল একটি ধর্মীয় সভা। স্বীকার করতে হবে যে, সমাজ সংস্কারের জন্যে তিনি তাঁর কলমকে তলোয়ার করে তুলেছিলেন। আজীবন সে-যুদ্ধ তিনি চালিয়ে গেছেন; কিন্তু তাঁর সংস্কার-আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল প্রধানত একটি – অমানবিক সতীদাহ প্রথা রোধ করা। সতীদাহ বঙ্গসমাজের অতি ক্ষুদ্র একটি অংশের সমস্যা ছিল। বৃহত্তর বঙ্গদেশকে আধুনিক করে তোলার ব্যাপারে তিনি যা কিছু করেছিলেন, তা ছিল তত্ত্বগত; হাতে-কলমে সমাজকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তাঁর অবদানকে নগণ্যই বলতে হয়। এমনকি, তিনি কোনো জনহিতকর কাজ করেছিলেন কিনা, তাতেও সন্দেহ আছে। সংবাদপত্রে সেকালের কথা খুললে বিভিন্ন জনহিতকর কাজে বিভিন্নজনের চাঁদা দেওয়ার ফর্দ পাওয়া যায়। রামমোহনের নাম তাতে অনুপস্থিত। তাঁর প্রধান ভূমিকা প্রবল শক্তিশালী রক্ষণশীল সমাজের রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করা। স্বীকার করতে হবে, আধুনিকতার পথে সেটা একটা মস্ত সাহসিকতার কাজ – সমাজের ভিত্তি ধরে নাড়া দেওয়া। বস্ত্তত, এভাবেই তিনি যূথবদ্ধতার বিরুদ্ধে ব্যক্তি-স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়েছিলেন, যা আধুনিকতারই আবশ্যিক অঙ্গ।

ঈশ্বর এবং ধর্মের প্রতি তাঁর আনুগত্য সত্ত্বেও রেনেসাঁসের হিউম্যানিস্ট পন্ডিতদের সঙ্গে রামমোহনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সাদৃশ্য লক্ষ করি। হিউম্যানিস্টরা প্রাচীন ভাষা ও সাহিত্যসহ ধ্রুপদী বিদ্যার চর্চা করেছিলেন। আপাতদৃষ্টিতে সেটাকে পশ্চাৎমুখিতা বলে মনে হতে পারে। কিন্তু, না, প্রাচীন ভাষা-সাহিত্য চর্চার মধ্য দিয়ে তাঁরা প্রাচীনকালে ফিরে যেতে চাননি, বরং প্রাচীন সাহিত্য-দর্শনের অনুবাদ করে এবং তার নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে সমকালীন                  সমাজ-মানসকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। রামমোহনও বেদ-উপনিষদের অনুবাদ করেছিলেন। মুদ্রণশালার সুযোগ নিয়ে ছাপিয়ে তা প্রচার করেছিলেন; কিন্তু পেছনে ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে নয়। তাঁর সে-প্রয়াস ছিল হিউম্যানিস্ট পন্ডিতদের মতো। প্রাচীন শাস্ত্র অনুবাদ করে, তার নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে এবং তাকে প্রচার করে তিনি সমকালীন হিন্দু সমাজকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। দেখাতে চেয়েছিলেন যে, প্রাচীন শাস্ত্রের অবক্ষয় এবং অপব্যাখ্যার মাধ্যমে সমাজের পরতে-পরতে কুসংস্কারের আবর্জনা জমে উঠেছে।

তাঁর তিন দশক পরে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও এ-ধারা অনুসরণ করেছিলেন। তিনিও শাস্ত্রের অনুবাদ করে এবং তার নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে রক্ষণশীলতার দুর্গে আঘাত করতে চেয়েছিলেন। ধর্মীয় শাস্ত্র দিয়েই ধর্মীয় কুসংস্কারকে আক্রমণ করেছিলেন। তাছাড়া, তিনি কেবল আলোচনা ও বিতর্কের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। বাস্তবতার পথে অনেকদূর এগিয়ে গিয়ে সমাজের পন্ডিত এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সংগঠিত করে রীতিমতো সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। এভাবে রক্ষণশীল সমাজের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন তিনি। বাল্যবিধবাদের পুনর্বিবাহের আইন প্রণয়নে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিলেও তাকে তিনি জনপ্রিয় করতে পারেননি। তাই বলে তাঁর আন্দোলন ব্যর্থ হয়নি, কারণ তাঁর প্রয়াসের ফলে সমাজের ভিত্তি যেমন কেঁপে উঠেছিল, তেমনি বিধবাদের দুর্দশা সম্পর্কে সমাজের সচেতনতাও বৃদ্ধি পেয়েছিল। বহুবিবাহের বিরুদ্ধেও তিনি সমাজের বিবেক উস্কে দিয়েছিলেন। স্ত্রীশিক্ষা প্রবর্তনে তাঁর ভূমিকা যে অসামান্য, তা স্বীকার করতেই হয়। সেজন্যে, তাঁকে উনিশ শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে সফল সমাজ-সংস্কারক বললে একটুও বাড়িয়ে বলা হয় না। রামমোহন যা করেননি, হিউম্যানিস্ট পন্ডিত হিসেবে বিদ্যাসাগর তার অতিরিক্ত আরেকটা ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি প্রাচীন সাহিত্য অনুবাদ করে এবং/ অথবা সেই প্রাচীন সাহিত্য অবলম্বনে নতুন সাহিত্য রচনা করেও হিউম্যানিস্ট পন্ডিতের একটা প্রধান দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এবং তিনি তা করেছিলেন আদৌ প্রাচীন ভারতবর্ষে ফিরে যাওয়ার জন্যে নয়, বরং সমকালীন পাঠকের আধুনিক সাহিত্যরুচি গড়ে তোলার জন্যে। তাঁর সাহিত্যে পৌরাণিক চরিত্রও তিনি নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু দেবত্বের পোশাক থেকে মুক্ত করে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্লেষণ ও আধুনিক মূল্যবোধের আলোকে তিনি এই পৌরাণিক চরিত্রগুলোকে যুগোপযোগী এবং পরিচিত সমাজের ব্যক্তি করে তুলেছিলেন। তাঁর সাহিত্যে তাঁরা হাজির হন মানুষরূপে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো কেউ কেউ তাঁকে অনুবাদকের চেয়ে বেশি মর্যাদা দিতে কুণ্ঠা বোধ করেছেন। কিন্তু বেতালপঞ্চবিংশতি থেকে আরম্ভ করে শকুন্তলা ও সীতার বনবাস বিশ্লেষণ করলে তাঁর মৌলিকত্ব কম ধরা পড়ে না।

বিদ্যাসাগরের কয়েক বছর পরে বঙ্কিমচন্দ্রও হিউম্যানিস্ট পন্ডিতের ভূমিকা পালন করেছিলেন – বিশেষ করে প্রাচীন ভারতবর্ষ এবং পৌরাণিক চরিত্রের নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে। বস্ত্তত, রামমোহন, বিদ্যাসাগর এবং বঙ্কিমচন্দ্রই বঙ্গদেশের সবচেয়ে সুপরিচিত হিউম্যানিস্ট পন্ডিত। আর, কবিতা এবং নাটকের মাধ্যমে হিউম্যানিস্ট পন্ডিতের ভূমিকা পালন করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। এ-বিষয়ে তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রচনা মেঘনাদবধ কাব্য, যাকে এক কথায় বলা যায় নব্য-রামায়ণ। কিন্তু তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য, ব্রজাঙ্গনা ও বীরাঙ্গনাও পুরাণের নতুন ব্যাখ্যা।

দ্বারকানাথ ঠাকুর এ-পথে যাননি। সে-কালের তুলনায় তিনি অসামান্য বিদ্বান এবং বিদগ্ধ হলেও হিউম্যানিস্ট পন্ডিত তিনি ছিলেন না। তিনি শাস্ত্রের অনুবাদ করেননি অথবা তার নতুন ব্যাখ্যা দেননি। ধ্রুপদী বিদ্যাচর্চাও করেননি। তা সত্ত্বেও তিনি রেনেসাঁসের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। তিনি তাঁর সে-ভূমিকা পালন করেছিলেন ভিন্ন পথে। এ-পথের কথা বলতে গিয়ে খানিকটা পরিচয় দিতে হয় ইউরোপীয় রেনেসাঁসের।

ইউরোপীয় রেনেসাঁসের ইতিহাস লক্ষ করলে দেখা যায়, গোড়ার দিকে ইতালিতে ধর্মীয় পন্ডিতরা নন, দান্তে এবং পেত্রার্কার মতো হিউম্যানিস্ট পন্ডিতরা প্রাচীন ভাষা-সাহিত্যের চর্চা করে একটা নতুন মানবমুখী মনোভাব গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। অতঃপর তারই অনুবর্তনে প্রথমে ইতালিতে এবং তারপর একে-একে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে একটা অভূতপূর্ব জাগরণ ও সৃজনশীলতার বিস্ফোরণ লক্ষ করা যায়। কেবল অভূতপূর্ব বললেই একে ঠিক বোঝানো যায় না, বলতে হয় : এই সময়ে চিত্রকলা, ভাস্কর্য ও স্থাপত্যের ক্ষেত্রে রীতিমতো বিস্ময়কর প্লাবন দেখা দিয়েছিল।

শুধু পরিমাণের দিক দিয়ে নয়, এই সৃজনশীলতার চরিত্রও আমূল পালটে গিয়েছিল। ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেও, ঈশ্বর এ-সময়ে নিখুঁত মানুষের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। মানুষের দৃষ্টি ঈশ্বরের দিক থেকে মানবমুখী হয়েছিল; পরলোকের দিক থেকে ইহলোকমুখী হয়েছিল। আর জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিকে তাকালে দেখতে পাই, এ-সময়ে পৃথিবীর চারদিকে সূর্য ঘোরে – এ-বিশ্বাস ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়। আরো পরে জানা যায়, সৌরজগতের অজানা অনেক তথ্য। সে-জ্ঞান প্রচলিত বিশ্বাসের তুলনায় এতই যুগান্তকারী ছিল যে, তার জন্যে গ্যালিলিওকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছিল। কোপারনিকাসকেও। মহাকাশের কথাই নয়, রেনেসাঁসের যুগেই জানা যায় এ-পৃথিবীর অজানা দেশ এবং মহাদেশের কথা। এ-সময়ে ছাপাখানা আবিষ্কৃত হয়, এমনকি, আবিষ্কৃত হয় নাবিকের কম্পাস ও বারুদ। আর, প্রাচীন গ্রিক ও লাতিন ভাষা-সাহিত্যের চর্চার পাশাপাশি বিকাশ লাভ করে বিভিন্ন দেশের জাতীয় ভাষা।

তাছাড়া, জ্ঞানবিজ্ঞান এবং ধ্রুপদী বিদ্যাচর্চার পাশাপাশি প্রবল ধারায় চলতে শুরু করে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকর্ম। স্বদেশে যখন তার বিকাশের ক্ষেত্র সীমাবদ্ধ হয়ে আসে, তখন বণিকরা নতুন বাজার খোঁজেন অন্য মহাদেশে – এশিয়া, আমেরিকা ও আফ্রিকায়। এ-রকমের বিপুল অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের ফলে একটি নব্য ধনিক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। নতুন যুগে সামন্তদের কাছ থেকে অর্থনৈতিক শক্তি চলে যায় এই বণিকদের হাতে। ইতালির মেদিচি পরিবারের মতো এই নব্য ধনীরাই স্থাপত্য, চিত্রকলা, ভাস্কর্য ইত্যাদির পৃষ্ঠপোষণা আরম্ভ করেন। এমনকি, আধুনিক ভাবধারা দিয়ে প্রভাবিত একাধিক পোপও স্থাপত্য, চিত্রকলা, ফ্রেস্কো এবং ভাস্কর্যের পৃষ্ঠপোষণা করেন। চার্চের সেই চিত্রকলা, ফ্রেস্কো ও ভাস্কর্যে দেবতা দেখা দিলেন মানুষের বেশে – নিখুঁত মানুষের বেশে। বস্ত্তত, সে-পৃষ্ঠপোষকতার ছায়াতেই বিকাশ ঘটে তাবৎ বস্ত্তর, যাকে আমরা রেনেসাঁসের সঙ্গে অভিন্ন করে দেখি। এই বণিক শ্রেণি এবং চার্চের এই পৃষ্ঠপোষণা ছাড়া রেনেসাঁসের বিকাশ ঘটা সম্ভব হতো না।

ইংরেজ রাজত্বের চরিত্র যে শোষণমূলক – এ-কথাটার মধ্যে সত্যের কোনো অভাব নেই। প্রকৃতপক্ষে, এ নিয়ে কেউ বিতর্ক করবেন না। কিন্তু ইংরেজ শাসন আমাদের দেশের সব অনর্থের মূল – এমন একটা ধারণা এক শ্রেণির ইতিহাসবিদ, বিশেষ করে সাম্প্রতিক দশকগুলোতে, সৃষ্টি করেছেন। ইংরেজদের বদলে সিরাজ-উদ-দৌলা এবং তাঁর বংশধররা বঙ্গদেশ শাসন করলে দেশ সামনের দিকে এগোতো কিনা, সেটা এই ইতিহাসবিদরা বিবেচনা করেন বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। বলা বাহুল্য, বঙ্গদেশ তথা ভারতবর্ষকে মধ্যযুগীয়তা থেকে উদ্ধার করার মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে পরম করুণাময় ঈশ্বর ইংরেজদের এদেশে প্রেরণ করেননি। ইংরেজরাও পালক-পুত্রের মতো বঙ্গদেশকে গ্রহণ করে আদরের সঙ্গে তাকে ‘মানুষ’ করেননি। তাঁরা ব্যবসা-বাণিজ্য করে আর্থিক লাভ করার জন্যেই এদেশে এসেছিলেন। তারপর রাজশক্তির অধিকারী হয়ে শাসনের নামে এদেশের মানুষের ওপর অত্যাচার করে যদ্দুর সম্ভব আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন। এদেশ থেকে কম দামে কাঁচামাল নিয়ে কেবল স্বদেশের শিল্পের উন্নতি করেননি, সেই শিল্পজাত পণ্য এদেশে এনে, এদেশের শিল্পকে ধ্বংস করেছেন; এদেশ থেকে ক্রমাগত সম্পদ স্বদেশে পাচার করে এদেশকে নিঃস্ব করেছেন। এককথায় ঔপনিবেশিক শাসন যেমন হয়, তাঁরা তেমনই করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের শাসনের বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থায়, সভ্যতায়, বিচার-ব্যবস্থায়, আধুনিক ধ্যান-ধারণায় দেশ সামনের দিকে এগিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ইংরেজ আমলে মানুষ উপলব্ধি করল যে, দিল্লীশ্বর জগদীশ্বর নন।

অপরপক্ষে, মুসলমান নবাবদের শাসন বহাল থাকলে বঙ্গদেশ এই প্রগতির পথে যেতে পারত কিনা, সেটা সন্দেহের বিষয়। মধ্যযুগে মুসলমানরা যখন এদেশে এসেছিলেন, তখন তাঁরা যে-সভ্যতা, জ্ঞানবিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি নিয়ে এসেছিলেন, দু-তিন শতাব্দীর মধ্যে তা নিঃশেষিত হয়েছিল। তারপর তাঁদের আর কিছু দেওয়ার ছিল না। তাছাড়া, মোগলদের শাসনও ছিল একধরনের ঔপনিবেশিক শাসন। তাঁদের শাসন চলতে থাকলে এদেশে আধুনিকতা কোনোকালে আসত না, তা বলছি না; মধ্যযুগীয়তা   অন্তত আরো দু-এক শতাব্দী বহাল থাকত।

কলকাতা-কেন্দ্রিক ইংরেজ আমলে ব্যবসা এবং দালালি করে নবকৃষ্ণ দেব, রামদুলাল দে ও মতিলাল শীলের মতো প্রচুর বিত্তবান তৈরি হয়েছিলেন। তৈরি হয়েছিলেন বড় বড় জমিদার। ১৮৭২ সাল নাগাদ ছোটখাটো জমিদার মিলে তাঁদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল দেড় লাখেরও বেশি। কিন্তু যেটা বিশেষ করে লক্ষ করার বিষয়, তা হলো : ইংরেজ রাজত্বের ফলে বঙ্গদেশে কেবল ব্যবসায়ী আর জমিদার তৈরি হলেন না, রামমোহন-বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমচন্দ্রের মতো মানুষও দেখা দিলেন।

ধনীরা সেকালে পিতা-মাতার শ্রাদ্ধে লাখ-লাখ টাকা ব্যয় করতেন – এখনকার হিসাবে যা কোটি কোটি টাকা। এ-টাকা তাঁরা ব্যয় করতেন যতটা পুণ্য অর্জনের আশায়, তার থেকে অনেক বেশি নাম কেনার লোভে। অপরপক্ষে, রামমোহন, রামকমল সেন, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, বঙ্কিমচন্দ্র বিদ্যা দিয়ে মধ্যবিত্ত হলেন, কিন্তু ব্যবসার পথে না-গিয়ে, জ্ঞানের পথে যাত্রা করলেন। ইংরেজ রাজত্বের সঙ্গে নবাবি আমলের এখানটায় একটা মস্ত পার্থক্য লক্ষ করি। এই বিদ্বান ব্যক্তিরাই বঙ্গীয় রেনেসাঁসের কর্মী। কিন্তু বঙ্গদেশে রেনেসাঁসের বিকাশ যে ঘটল সীমিত মাত্রায়, তার কারণ এর পৃষ্ঠপোষক মিলল না। শোষক ইংরেজদের তরফ থেকে এ-পৃষ্ঠপোষণা প্রত্যাশা করার প্রশ্ন অবান্তর – যদিও এশিয়াটিক সোসাইটি এবং ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপন করে জ্ঞানের চর্চায় তাঁরা নিঃসন্দেহে উৎসাহ দিয়েছিলেন। কিন্তু বাঙালি নব্য ধনীরা ইতালির ধনিক শ্রেণির মতো শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষণা করেননি। জ্ঞানবিজ্ঞানের বিকাশে সহায়তা করেননি। তাও দ্বারকানাথ ঠাকুর, কালীপ্রসন্ন সিংহ, প্রতাপ ও ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ এবং যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের মতো হাতেগোনা কয়েকজন খানিকটা পৃষ্ঠপোষণা করেছিলেন, এবং তার ইতিবাচক ফলাফলও আমরা সাহিত্য-সংগীত-নাটকের ক্ষেত্রে অবশ্যই লক্ষ করি। যেমন, রামনারায়ণ তর্করত্ন নাটক রচনায় এগিয়ে আসেন রংপুরের এক জমিদারের আহবানে। এমনকি, পাইকপাড়ার জমিদার ভ্রাতাদের পৃষ্ঠপোষণা ছাড়া মাইকেল বাংলায় সাহিত্য আদৌ রচনা করতেন কিনা, অথবা তখনই করতেন কিনা, সন্দেহ হয়।

তবে সাধারণভাবে বললে, বঙ্গদেশের নব্য ধনীরা জমিদারি, দালালি এবং বণ্টন ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত থেকে বিত্তবান হওয়ার সবচেয়ে সহজ পথটাই বেছে নিয়েছিলেন। এমনকি, উৎপাদনের পথে পা বাড়াননি। প্রাকৃতিক সম্পদ খুঁজে বের করে তাকে মানুষের কাজে লাগানোর কথা অথবা সৃজনশীলতার দিকে এগিয়ে যাওয়া – এসব তাঁদের মাথায় আসেনি। তাঁরা বেনিয়ান আর মুৎসুদ্দির কাজ করেই তৃপ্ত ছিলেন এবং নিজেদের ভাগ্য গড়ে তোলেন। এ-লাইনে রামমোহনও কম সময় ব্যয় করেননি। সমাজের চোখে আভিজাত্যলাভের জন্য ধর্মকর্মে ধনীরা প্রভূত ব্যয় করেছেন। মন্দির নির্মাণকে সাধারণ সমাজ পুণ্যের কাজ বলেই বিবেচনা করতো। এই ধনীরা নিজেরাও তা-ই ভাবতেন। তাই এঁদের কল্যাণেই আঠারো এবং উনিশ শতকে কলকাতা ও বঙ্গদেশের অন্যত্র মন্দির-স্থাপত্যের খানিকটা বিকাশ ঘটেছিল। এই ধনীরা আর কিছু না হলেও টেরাকোটার কাজে অলংকৃত মন্দিরের পেছনে অনেক অর্থ ব্যয় করেছিলেন এবং সেইসঙ্গে ব্যয় করেছিলেন নিজেদের বসবাসের জন্য ইউরোপীয় স্থাপত্যের অনুকরণে প্রাসাদ নির্মাণ করে। পুণ্য অর্জন, অন্যদের চোখ ধাঁধানো এবং নাম-কেনাই ছিল তাঁদের মুখ্য উদ্দেশ্য। অনেকটা এই ব্যয়ের জোরেই রকেটের গতিতে সমাজ-সচলতার ঊর্ধ্বপথ ধরে তাঁরা নব্য-অভিজাত শ্রেণিতে পরিণত হয়েছিলেন। ফলে নিম্নবর্ণের ‘মহারাজারা’ রাতারাতি কলকাতার ব্রাহ্মণদেরও নেতা বলে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন। রাধাকান্ত দেব তাঁদের সবচেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

দ্বারকানাথ তাঁদের থেকে ভিন্ন রকমের ছিলেন। ধর্মেকর্মে তিনিও প্রয়োজনমতো ব্যয় করেছেন। কিন্তু তার থেকে ঢের বেশি ব্যয় করেছেন জনহিতকর কাজে। পিতা-মাতার শ্রাদ্ধে প্রতিযোগিতা করে ব্যয় করার রীতি সেকালের ধনীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে চালু হয়েছিল। তা সত্ত্বেও, দ্বারকানাথ মায়ের মৃত্যুতেও উজাড় করে টাকা না-ঢেলে সে-টাকার বড়ো অংশ ব্যয় করেছিলেন জনহিতকর কাজে। এমন মহৎ দৃষ্টান্ত তখনকার অন্য কোনো ধনী স্থাপন করেননি। চিরাচরিত শ্রাদ্ধের কাজে পঞ্চাশ হাজার টাকা ব্যয় করে, বাকি এক লাখ টাকা তিনি দিয়েছিলেন ডিস্ট্রিক্ট চ্যারিটেবল সোসাইটিতে, অন্ধদের জন্যে। পিতার শ্রাদ্ধেও তিনি ঘটা করেননি, বরং ডিস্ট্রিক্ট চ্যারিটেবল সোসাইটিকে অর্থ দান করেন। এ-সমিতিকে তিনি মাসিক নিয়মিত দান করতেন। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ স্থাপিত হওয়ার পর তাতেও নিয়মিত চাঁদা দিতেন। তাছাড়া, পুরস্কার দিতেন ছাত্রদের উৎসাহিত করার জন্যে। কলকাতার নব্য ধনীদের মধ্যে তিনি যেভাবে শিল্পকর্মের উৎসাহ দিয়েছেন, তাঁর সমকালে অন্য কেউ তা কল্পনাও করেননি। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ির শিল্পকর্মগুলো নিলামে বিক্রির জন্যে একটি বর্ণনামূলক মুদ্রিত তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। তাতে ৯২৯টি শিল্পকর্ম ছিল – ছবি, ভাস্কর্য ইত্যাদির। সেসব ছবির মধ্যে নামকরা অনেক চিত্র ছিল যেগুলো মূলের কপি। কিন্তু মূল ছবিও কম ছিল না। তাঁর বৈদগ্ধ্য এবং পরিশীলিত রুচির নির্ভুল প্রমাণ পাওয়া যায়, এই দীর্ঘ তালিকা থেকে। ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে পুস্তকাকারে মুদ্রিত এ-তালিকার একটি কপি আছে। তিনি যেভাবে শিল্পকর্মে উৎসাহ দিয়েছিলেন, বাঙালি-কলকাতায় সেটা ছিল সম্ভবত একমাত্র ব্যতিক্রম।

ইতালির মেদিচি পরিবারের নাম আগেই উল্লেখ করেছি। এই বণিক পরিবারের সদস্য লোরেনৎসো প্রথম থেকেই হিউম্যানিস্ট ধারার শিক্ষা লাভ করেছিলেন। রেনেসাঁসের শিল্পকর্মের সবচেয়ে প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তিনি পরিচিত হয়েছিলেন। কলকাতার ধনীদের মধ্যে মেদিচি পরিবারের অনুরূপ প্রথম শিল্পকর্মের পৃষ্ঠপোষক পরিবার পত্তন করেন দ্বারকানাথ ঠাকুর।

ইউরোপীয় রেনেসাঁসের পিছু-পিছু ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রযুক্তি এবং শিল্পের যে-ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল, বঙ্গদেশে দ্বারকানাথই প্রথম  সে-ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। সে-কালে কলকাতার সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা ছিল টাকা ধার দেওয়া আর বিদেশি কোম্পানির দালালি করা। বেশিরভাগ বিদেশি কলকাতায় আসতেন খালি হাতে অথবা সামান্য মূলধন নিয়ে। বেনিয়ানদের কাছে টাকা ধার করেই তাঁরা স্থানীয় কাঁচামাল কিনে স্বদেশে রফতানি করতেন এবং স্বদেশ থেকে তৈরি মাল এনে এদেশে বিক্রি করতেন। এভাবেই তাঁরা দ্রুত ফেঁপে উঠতেন। রামমোহনও টাকা ধার দেওয়ার ব্যবসা করেছিলেন। কিন্তু আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী দ্বারকানাথ বেনিয়ান না-হয়ে ব্যাংকার হয়েছিলেন। ইউনিয়ন ব্যাংকের মূলধন দিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু ব্যাংক পরিচালনা এবং ব্যাংকের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের জন্যে তিনি সঙ্গে নিয়েছিলেন সাহেবদের। ১৮৩৩ সালে কমার্শিয়াল ব্যাংক দেউলে হওয়ার পর, সে-ব্যাংকও তিনি কিনে নিয়েছিলেন। বেনিয়ানদের যুগ শেষ হয়ে ব্যাংকের যুগ আরম্ভ হয়েছে – এই দূরদৃষ্টি তাঁর ছিল; কিন্তু কলকাতার বেনিয়ানদের ছিল না। ব্যাংকের সঙ্গে তিনি আরো শুরু করেছিলেন বীমা কোম্পানি।

কার, টেগোর অ্যান্ড কোম্পানিও তিনিই গড়ে তুলেছিলেন তাঁরই টাকা দিয়ে। এই কোম্পানির ছত্রচ্ছায়ায় তিনি উদ্যোগ নিয়েছিলেন নানা ধরনের ব্যবসা এবং শিল্পকর্মের, যা আগে ছিল ইউরোপীয়দের হাতে। তাঁর নিজের জমিদারি এবং মধ্যবাংলায় তৈরি হতো নীল, চিনি এবং রেশম। কলকাতায় নিয়ে এসে সেখান থেকে তিনি এই পণ্য বিদেশে রফতানি করতেন। এসব রফতানি পণ্য কলকাতায় আনার জন্যে জাহাজ প্রয়োজন। সেই জাহাজের কোম্পানি গড়ে তুলেছিলেন তিনি। তখন নদীতে চলাচলের জন্যে কেবল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কয়েকটি জাহাজ ছিল। তার বাইরে ব্যক্তিগত মালিকানায় প্রথম জাহাজের কোম্পানি গড়ে তোলেন দ্বারকানাথই। আবার কলকাতা থেকে বিদেশে রফতানির জন্যে সমুদ্রগামী জাহাজ দরকার, তিনি সে-জাহাজেরও কোম্পানি গঠন করেছিলেন। এই যে সর্বব্যাপী অর্থনৈতিক ক্রিয়াকর্মের বলতে গেলে সাম্রাজ্য বিস্তার, সে তাঁর আধুনিক এবং দূরদৃষ্টিরই পরিচয়। এই পরিচয় তিনি আরো দিয়েছিলেন জয়েন্ট স্টক কোম্পানি গড়ে তোলার মাধ্যমে। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, আধুনিক যুগে বিরাট মাপের অর্থনৈতিক কর্ম কারো একার মূলধন অথবা পরিকল্পনা দিয়ে সার্থকভাবে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। সেজন্যেই তিনি ইংরেজ শরিকদের নিয়ে এ-ধরনের কাজ আরম্ভ করেছিলেন।

আসামের বাগানে চা আবিষ্কারের বছরদশেক পরে ১৮৩৪ সালে লর্ড বেন্টিংক যখন চায়ের ব্যবসার অনুমোদন দেন, দ্বারকানাথ অমনি চা-শিল্পে নেমে পড়েন। বাগিচা-শিল্পের প্রযুক্তিকে এভাবেই তিনি দুহাতে স্বাগত জানান। তিনিই আসামের চা প্রথম কলকাতায় এনে ইংল্যান্ডে রফতানি করেন। লবণ তৈরির কোম্পানিও করেছিলেন তিনি।

যেসব জিনিস ইউরোপের রেনেসাঁসে প্রেরণা দিয়েছিল, তাঁর মধ্যে একটা ছিল প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করে মানুষের বিজয় ঘোষণা। বঙ্গদেশে তার বহিঃপ্রকাশ ইংরেজ আমল শুরু হওয়ার প্রথম অর্ধশতাব্দীতেও হয়নি। কিন্তু রানীগঞ্জের কয়লাখনি কিনে তার সম্পদ আহরণের দৃষ্টান্ত দেশীয়দের মধ্যে দ্বারকানাথই প্রথম স্থাপন করেছিলেন। তিনি যখন এ-খনি কেনেন, তার এক বছরের মধ্যে তার উৎপাদন দ্বিগুণ হয়ে যায়। তারপর তা চক্রবৃদ্ধি হারের মতো বাড়তে থাকে। ঢাকা থেকে আরম্ভ করে এলাহাবাদ পর্যন্ত তাঁর কোম্পানি সবচেয়ে বেশি এবং সবচেয়ে ভালো কয়লা সরবরাহ করত। বস্ত্তত, জাহাজ কিনে এবং কয়লা সরবরাহ করে বঙ্গদেশে তিনি বাষ্পীয় প্রযুক্তিগত বাণিজ্যের বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

উনিশ শতকের গোড়ায় সাহেবরা ছিলেন বাঙালিদের বাপ-মা। সেই সাহেব-ভজার যুগে দ্বারকানাথ ইঙ্গ-বঙ্গ সহযোগিতা দিয়ে তাঁর কোম্পানিগুলো গড়ে তুলেছিলেন। সাহেবরা বেনিয়ানদের সঙ্গে ব্যবসা করতেন, কিন্তু বেনিয়ানদের সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতে শেখেননি। রামমোহন এবং দ্বারকানাথই দেশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহেবদের চোখে সম্মানযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হন। তাঁরা দুজনই আবার চেয়েছিলেন সাহেবদের সঙ্গে অধিকতর সহযোগিতা এবং বর্ধিত ইঙ্গ-বঙ্গ সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক আদান-প্রদান। তিনি তখনকার সবচেয়ে দুটি বড়ো সংবাদপত্র – ইংলিশম্যান পত্রিকার মালিক এবং বেঙ্গল হেরাল্ড পত্রিকার অংশীদার হয়েও সাহেবদের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিলেন।

বেনিয়ানদের কাছ থেকে ধার-করা টাকা দিয়ে বাণিজ্য করে ইংরেজরা রাতারাতি নবাব হয়ে স্বদেশে ফিরে যাবেন বঙ্গদেশের সম্পদ নিয়ে – রামমোহন অথবা দ্বারকানাথ এটা ঠিক অনুমোদন করতে পারেননি। তার পরিবর্তে ইংরেজ ভাগ্যান্বেষীরা যাতে ভারতবর্ষে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন, তাতে এঁরা দুজনই উৎসাহ দিয়েছিলেন। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বঙ্গদেশ জয় করে মুসলমানরা বেশিরভাগ এদেশেই স্থায়ী বসতি স্থাপন করেন। তার ফলে মধ্যপ্রাচ্যের সভ্যতা দিয়ে বঙ্গদেশের সভ্যতা-সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছিল। দেশের সম্পদও বিদেশে পাচার হয়ে যায়নি। রামমোহন এবং দ্বারকানাথও আশা করেছিলেন, ইংরেজরা কেবল বণিকবৃত্তি না-করে বঙ্গদেশে বসতি স্থাপন করলে, তাঁদের সভ্যতা দিয়ে বঙ্গদেশ লাভবান হবে। তাঁদের দুজনের আশা অবশ্য আশাই থেকে যায়। কারণ, ইংরেজরা বঙ্গদেশ অথবা ভারতবর্ষকে কখনোই নিজেদের স্থায়ী আবাস হিসেবে বিবেচনা করতে পারেননি – যদিও আরো পরে স্বদেশে সুযোগ-সুবিধা যখন সংকীর্ণ হয়ে আসে, তখন তাঁরা আফ্রিকায়ও উপনিবেশ গড়ে তুলেছিলেন। আমেরিকায় বসতি স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছিল আগে থেকেই। ইংরেজদের আগে মোগল শাসকরাও বঙ্গদেশকে শোষণ এবং শাসন করেছিলেন, কিন্তু বঙ্গদেশে বসতি স্থাপন করেননি। অনেক মুসলমান ধর্ম-প্রচারকও বঙ্গদেশকে শান্তির ভূমিখন্ড বলে গণ্য না-করে, দারুল হার্ব অর্থাৎ অশান্তির দেশ বলে বিবেচনা করেছিলেন।

ইংরেজরা বঙ্গদেশে এসে ব্যবসা-বাণিজ্য করে অথবা শাসনকার্যে নিয়োজিত থেকে ভাগ্য গড়ে তুললেও, আগেই বলেছি, দেশীয়দের কখনো নিজেদের সমান বলে গণ্য করেননি। রামমোহন এবং দ্বারকানাথের নিমন্ত্রণে এসে তাঁরা বাইজিনাচ দেখে আর দুর্মূল্য মদ্যপান করে ফুর্তি করলেও, নিজেদের বাড়িতে এঁদের নিমন্ত্রণ করতেন না। অন্য ভাষায়, দেশীয়দের তাঁরা সামান্য শিক্ষিত অবিদগ্ধ কৃষ্ণাঙ্গ বলেই গণ্য করতেন। সেজন্যেই ইঙ্গ-বঙ্গ সহযোগিতার            যে-স্বপ্ন রামমোহন ও দ্বারকানাথ দেখেছিলেন, তা অনেকাংশে ব্যর্থ হয়। কিন্তু দ্বারকানাথ কলকাতার ইংরেজ সমাজের সঙ্গে অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি আদান-প্রদান করেছিলেন। রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্ম এবং বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়ে ইংরেজ সমাজের অনেক কাছাকাছি এসেছিলেন।

সামাজিক সংগঠন গড়ে তুলে বিভিন্ন রকমের সহযোগিতামূলক কার্যক্রম পরিচালনার ব্যাপারে রামমোহনের তুলনায় দ্বারকানাথ অনেক বেশি অগ্রসর এবং সক্রিয় ছিলেন। ১৮৩০-এর দশকে বলতে গেলে কোনো সামাজিক সংগঠন দ্বারকানাথের অংশগ্রহণ ছাড়া চলত না। চাঁদা দেওয়ার বেলাতেও সবচেয়ে মোটা অঙ্কটা আসত তাঁরই কাছ থেকে, যদিও তাঁর থেকে ধনবান লোক কলকাতায় অনেকেই ছিলেন। সমাচার দর্পণ পত্রিকায় ১৮৩৮ সালে একটি পত্রে তাই বলা হয়েছিল : দ্বারকানাথ ঠাকুরের মতো দাতা এদেশে কেউ জন্মগ্রহণ করেননি। পত্রলেখক এরপর খেদ প্রকাশ করে লিখেছিলেন যে, তা সত্ত্বেও দ্বারকানাথ ‘রাজা’ উপাধি পাননি। একই বছর ইয়ং বেঙ্গলদের পত্রিকা জ্ঞানান্বেষণেও তাঁর দানের অকুণ্ঠ প্রশংসা করা হয়। আমার ধারণা, কোম্পানির কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর দহরম-মহরম থাকলেও তাঁরা তাঁকে প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করতেন। কলকাতায় দেশীয়দের গভর্নমেন্ট হাউস হিসেবে গণ্য হতো দ্বারকানাথের বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ি। সেখানে গভর্নর জেনারেলও নিমন্ত্রণে এসেছেন, কিন্তু দ্বারকানাথকে কোনো সরকারি স্বীকৃতি দিতে ইংরেজরা কুণ্ঠিত ছিলেন।

ভারতীয় আয়ুর্বেদের উৎকর্ষ সম্পর্কে দেশীয়দের মতামত যেমনই হোক না কেন, দ্বারকানাথ অনুভব করেছিলেন যে, পাশ্চাত্য শিক্ষার মতোই দেশের অগ্রগতির জন্য পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যার কোনো বিকল্প নেই। সেজন্যে ১৮৩৫ সালে কলকাতায় যখন মেডিক্যাল কলেজ স্থাপিত হয়, তখন তিনি তাতে সর্বাত্মক সাহায্য ও সহযোগিতা করেছিলেন। যে-কালে মানুষ মরার আগেই তাকে গঙ্গার তীরে নিয়ে যাওয়া হতো মৃত্যুকে আরো ত্বরান্বিত করতে,  সে-কালে মেডিক্যাল কলেজ অথবা হাসপাতাল স্থাপন ছিল     যুগান্তকারী ঘটনা। অসম্ভব নয় যে, তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর মাকে যে তাঁর মৃত্যুর তিন দিন আগেই গঙ্গাতীরে নিয়ে গিয়ে মরতে বাধ্য করা হয়েছিল, সে-দুঃখও এক্ষেত্রে তাঁর মনে কাজ করেছিল। মেডিক্যাল কলেজ স্থাপন এবং আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষা এমন যুগান্তকারী ঘটনা ছিল যে, মধুসূদন গুপ্ত যখন ১৮৩৬ সালের ২৮ অক্টোবর কলেজের চারজন ছাত্রকে নিয়ে প্রথম মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করেন, তখন রক্ষণশীল সমাজ ঘৃণায় ঢিঢি করেছিল। কিন্তু ফোর্ট উইলিয়াম থেকে এই স্মরণীয় ঘটনাকে সম্মান জানানোর জন্য তোপধ্বনি করা হয়েছিল।

প্রথমদিকে দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া ব্রাহ্মণরা মেডিক্যাল কলেজে পড়তে যাননি; গিয়েছিলেন কায়স্থ এবং বৈদ্যরা। তাঁদের সংখ্যাও ছিল নগণ্য। সে-পরিস্থিতিতে কলেজ-কর্তৃপক্ষ এবং দ্বারকানাথের মতো কলকাতার হাতেগোনা কয়েকজন নাগরিক অনুভব করেন যে, ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেশীয়দের চিকিৎসাবিদ্যায় শিক্ষিত করে আনতে না-পারলে, দেশীয়রা মেডিক্যাল কলেজে পড়তে আগ্রহী হবেন না, এমনকি, হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতেও চাইবেন না। সেজন্যে, ১৮৪৫ সালের মার্চ মাসে দ্বারকানাথ যখন দ্বিতীয়বার ইংল্যান্ড ভ্রমণে যান, তখন মেডিক্যাল কলেজের চারজন শিক্ষার্থী এবং একজন অধ্যাপক – হেনরি গুডিবকে – সঙ্গে নিয়ে যান। এই চারজন ছাত্রের দুজনের খরচ দিয়েছিল কোম্পানি। একজনের খরচ দিয়েছিলেন কলকাতার নগরবাসী। কিন্তু একজনের ব্যয় বহন করেছিলেন দ্বারকানাথ একাই। কারো কারো মতে, তিনি দুজনের খরচ বহন করেছিলেন। লন্ডনে থেকে লেখাপড়া করার খরচ এবং ডক্টর গুডিবের খরচ অবশ্য কোম্পানিই দিয়েছিল।

এই ছাত্রদের সঙ্গে নেওয়া ছাড়া, তিনি সঙ্গে নিয়েছিলেন ষোলো বছর বয়সী তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র নগেন্দ্রনাথ আর এক ভাগ্নে নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে। উদ্দেশ্য ছিল ছেলেকে লাতিনসহ ধ্রুপদী এবং ইংরেজি ভাষা-সাহিত্য ভালো করে শিখিয়ে আনবেন। সেইসঙ্গে শিখিয়ে আনবেন ইংরেজি আচার-আচরণ। নবীনচন্দ্রকেও অকারণে নেননি। তাঁকে নিয়েছিলেন লন্ডনের ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে অত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে সে-কৌশল শিখিয়ে আনবেন বলে। এই যে শিক্ষার্থীদের ইংল্যান্ডে নিয়ে গিয়ে সেখানে উন্নত শিক্ষার ব্যবস্থা করে তারপর স্বদেশে ফিরিয়ে এনে তাঁদের কাজ করার সুযোগ করে দেওয়ার লক্ষ্য – একে সে-যুগের তুলনায় নিঃসন্দেহে অত্যন্ত প্রাগ্রসর বলেই বিবেচনা করতে হয়। বর্তমান যুগে তো এটাই অনুসরণ করা হচ্ছে!

লন্ডনে পৌঁছানোর বছরখানেক পরেই দ্বারকানাথ অকালে মারা যাওয়ায়, তাঁর পুত্র এবং ভাগ্নেকে অবশ্য ফিরে আসতে হয়েছিল তাঁদের শিক্ষা অসম্পূর্ণ রেখেই। কিন্তু চিকিৎসাবিদ্যার চারজন ছাত্রই পরীক্ষায় বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন। দেশে এসে ভালো বেতনের এবং সম্মানজনক চাকরি পেয়েছিলেন তাঁরা। তাঁদের আদর্শ অনুসরণ করেই পরবর্তী দশকে হাজারখানেক বাঙালি ছাত্র বিলেতে গিয়েছিলেন উচ্চশিক্ষা লাভ করে স্বদেশে ফিরে ‘বড়লোক’ হওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে। এঁরা কেউ গিয়েছিলেন ডাক্তার হওয়ার জন্যে, কেউ গিয়েছিলেন আইসিএস হওয়ার জন্যে, কেউ গিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্যে আর বেশিরভাগই গিয়েছিলেন ব্যারিস্টার হওয়ার জন্যে। এঁদের মধ্যে দ্বারকানাথের দুই পৌত্রও ছিলেন – সত্যেন্দ্রনাথ আর রবীন্দ্রনাথ। পাশ্চাত্যকে ঘৃণা করলেও, নিতান্ত হিসেবি বুদ্ধি থাকার জন্যেই দেবেন্দ্রনাথ নিজের দু-পুত্রকে বিলেতে পাঠিয়েছিলেন ইংরেজি  বিদ্যা অর্জনের জন্যে। ‘মহর্ষি’কে এই লাভের, এবং সে-কারণে লোভের, পথ দেখিয়েছিলেন তাঁর ইহলৌকিকতায় বিশ্বাসী পিতা, দ্বারকানাথ।

দ্বারকানাথ গোড়া থেকে ইংরেজি শেখার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং ইংরেজি ভাষা এতটাই ভালো শিখেছিলেন যে, লন্ডনের মননশীল ব্যক্তিরা তাঁর ইংরেজি এবং সে-ভাষায় রসিকতা করার অসাধারণ ক্ষমতা সম্পর্কে বিশেষ প্রশংসা করেছিলেন। আর, তাঁর ইংরেজি শুনে বিশেষ করে রানী ভিক্টোরিয়া এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, নিজের ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ব্রাহ্মণ চমৎকার ইংরেজি বলেন। কণ্ঠসংগীত এবং যন্ত্রসংগীত – উভয়ই তিনি শিখেছিলেন। পিয়ানো বাজাতে শিখেছিলেন ইংরেজ ওস্তাদের কাছ থেকে। বিলেতে থাকার সময়েও তিনি ইংরেজ গায়কের কাছে নিয়মিত গানের তালিম নিয়েছেন। তিনি ভারতীয় সংগীত কতটা জানতেন, তাঁর পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় ম্যাক্স মুলারের সাক্ষ্য থেকে। ভারতের সব বিদ্যার প্রতিই ম্যাক্স মূলারের প্রবল আগ্রহ ছিল। দ্বারকানাথ যখন প্যারিসে, তখন ম্যাক্স মুলার তাঁর সঙ্গে শাস্ত্র নিয়ে আলোচনা করা ছাড়াও তাঁর কাছ থেকে ভারতীয় সংগীতের ভিত্তি সম্পর্কে জেনে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দ্বারকানাথের সংগীত শুনে বুঝতে পারেন যে, ভারতীয় সংগীতে তাঁর পক্ষে হাতে খড়ি নেওয়াও সম্ভব হবে না অত সহজে। ম্যাক্স মুলার তাঁর সঙ্গে সংস্কৃতশাস্ত্র নিয়েও নিয়মিত আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন।

জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চায় নিজেকে তিনি সীমাবদ্ধ রাখতে পারেননি, কিন্তু জ্ঞানবিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির প্রতি তাঁর আন্তরিক আগ্রহ ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে – প্রযুক্তির প্রতি তাঁর আকর্ষণের কারণে তিনি লন্ডনের ধারেকাছে যেসব কলকারখানা ছিল, তা ঘুরে ঘুরে পরিদর্শন করেছিলেন। বিশেষ করে নিজের যেসব ব্যবসা ছিল, তার সঙ্গে যুক্ত কলকারখানা দেখে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে চেষ্টা করেছিলেন। চার্লস ব্যাবিজ ততদিনে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে গণনার কৌশল আবিষ্কার করেছিলেন। সে-পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করেই তাঁর একশ বছরেরও পরে কম্পিউটার তৈরি হয়। ব্যাবিজের সঙ্গেও দ্বারকানাথ বেশ পরিচিত হয়েছিলেন। ব্যাবিজকে লেখা তাঁর তিনটি চিঠি ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে রক্ষিত আছে। সম্বোধন থেকে বোঝা যায়, তাঁদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছিল।

তিনি লন্ডনে থাকার সময়ে রাজপরিবারের সদস্যসহ অভিজাতদের আপ্যায়ন করেছিলেন। কিন্তু কেবল অভিজাতদের সঙ্গে মেলামেশা করেননি, ডিকেন্স আর থ্যাকারের মতো সাহিত্যিকদের নিমন্ত্রণ করেও আন্তরিকতার সঙ্গে আপ্যায়ন করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে এ-সময়ে পরিচয় হয়েছিল জে ডিক্স নামে একজন সাহিত্যিকের। তিনি দ্বারকানাথের সঙ্গে আলাপ করে খুবই মুগ্ধ হয়েছিলেন। পরে তিনি লিখিত মন্তব্য করেছিলেন : দ্বারকানাথ এতেই শিক্ষিত এবং বিদগ্ধ যে, যে-কোনো বিষয় নিয়ে যথেষ্ট গভীরতার সঙ্গে আলাপ করতে পারেন।

বিলেতের সরকার এবং লন্ডনের সমাজ তাঁকে সম্মান দেখিয়েছিল, কিন্তু তিনি যে-স্বীকৃতি পাওয়ার উপযুক্ত ছিলেন, সে-স্বীকৃতি দেয়নি। তিনি স্বল্পকালের জন্য স্কটল্যান্ডে ভ্রমণ করতে গেলে সেখানকার লোকেরা তাঁকে দুহাত বাড়িয়ে গ্রহণ করেছিলেন। এডিনবরা নগরীর স্বাধীনতার চাবি উপহার দিয়েছিলেন। অথচ, প্রথমবার লন্ডনে পা রাখার পরের দিনই প্রধানমন্ত্রী রবার্ট পিলের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। তাছাড়া, কেবল রানী ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে তাঁর কয়েকবার দেখা হয়নি, রাজপরিবারের প্রধান সদস্য সবার সঙ্গেই তাঁর বেশ চেনাজানা হয়েছিল। পারস্পরিক নিমন্ত্রণ রক্ষার ব্যাপারও ঘটে। তিনি কেবল ইংরেজ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেননি, বরং মননশীল সমাজের সঙ্গেও বন্ধুত্বের সম্পর্ক রচনা করেছিলেন। রামমোহন তাঁর বারো-চোদ্দো বছর আগে এসে রাজকীয় মহল অথবা মননশীল পরিধিতে এতটা মিশতে পারেননি অথবা এত সম্মানও লাভ করেননি। তা সত্ত্বেও রাজা, মহারাজা অথবা নাইট উপাধি দ্বারকানাথের ভাগ্যে জোটেনি।

তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি আধুনিক শিল্পোন্নত ভারতবর্ষের, কিন্তু ইংরেজরা সেটা আদৌ চাননি। তাঁরা চেয়েছিলেন ভারতবর্ষ তাঁদের শিল্পের জন্যে কাঁচামাল জোগাবে। তাঁরা ভারতবর্ষে বসতিও স্থাপন করেননি, তাঁরা কেবল বঙ্গদেশকে যদ্দুর সম্ভব শোষণ করে ধনসম্পদ আহরণ করেছেন। সে-ধন বঙ্গদেশ থেকে ইংল্যান্ডে পাচার করেছেন। রামমোহন এবং দ্বারকানাথ উভয়ই চেয়েছিলেন একটি আন্তর্জাতিক ভারতবর্ষ, কিন্তু তাঁদের মৃত্যুর পর যে-ভারতবর্ষ গড়ে ওঠে, সে-ভারতবর্ষ জাতীয়তাবাদী ভারতবর্ষ। দ্বারকানাথের পুত্র দেবেন্দ্রনাথও সেই জাতীয়তাবাদী ভারতবর্ষের একজন প্রধান পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেন। এখানেই দ্বারকানাথের ব্যর্থতা এবং ট্র্যাজেডি।

খুলনা থেকে যে-পীরালি ঠাকুর পরিবার কলকাতায় এসেছিল, সে-পরিবারের নিরন্তর চেষ্টা ছিল সমাজের সোপান বেয়ে জাতে ওঠার, অপরপক্ষে, দ্বারকানাথ সে-সমাজকে অবজ্ঞা করে ইংরেজ সমাজের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে দেশীয় এবং বিদেশীয়দের যে-সহযোগিতা জন্ম নিচ্ছিল, তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার অবসান হয়।

মূলত ব্যবসায়ী হলেও, তিনি আসলে জ্ঞানবিজ্ঞানের অনুরাগী ছিলেন। তাঁর নানা রকমের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্রিয়াকর্মের মধ্য দিয়ে তিনি আধুনিক ভারতবর্ষের ভিত্তি স্থাপন করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেই ভিত্তি ভালো করে জমে ওঠার আগেই তিনি মঞ্চ থেকে বিদায় নেন। তিনি রক্ষণশীল সমাজে এমন একজন অরক্ষণশীল ব্যক্তি ছিলেন যে, নিজের পরিবারও তাঁকে সমর্থন করতে পারেনি। বরং তাঁর প্রতি বিরোধিতাই দেখিয়েছে। তাঁর ৩৭ হওয়ার পর থেকে স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল না। তিনি এজন্য বাড়ির অন্দরমহলে যেতেন না। থাকতেন বাইরের বাড়িতে। তাঁর চিন্তাধারা সময়ের তুলনায় এতই অগ্রসর ছিল যে, তিনি ছিলেন গোল গর্তে চারকোনা খুঁটার মতো। বেমানান। সেজন্যেই, একজন নিঃসঙ্গ ব্যক্তি ছিলেন তিনি – পরিবারের সদস্যরা এবং দেশীয় ও বিদেশীয়রা – সবাই যাঁকে ত্যাগ করেছিলেন। এই নিঃসঙ্গতার মধ্যেই তিনি ১৮৪৬ সালের ১ আগস্ট লন্ডনের এক হোটেলে প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টির মধ্যে মারা যান, যেন অভিমান করেই তিনি আর নিজের দেশে ফিরে আসেননি। যে-দেশকে অতো ভালোবেসেছিলেন,  সে-দেশের মাটিতেই চিরদিনের জন্যে থেকে যান।