শহুরে নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে মশিউলের পলায়নপর আর নির্বিরোধ জীবনের সংকট-সন্ত্রস্ততার ভেতর দিয়ে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়ের আখ্যান বর্ণিত হয়েছে সিরাজুল ইসলামের উপন্যাস গুহাতে।
নিম্ন জীবনমান আর চরম দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত পরিবারটির সংকট যেন ঘুচতেই চায় না। অশিক্ষিত বাবা-মায়ের নৈমিত্তিক কলহ আর মায়ের ওপর বাবার শারীরিক নির্যাতন; বেড়ে ওঠার সময় থেকেই পরিবারের প্রতি এক ধরনের ক্ষোভ আর ঘৃণা নিয়ে বড় হতে থাকে মশিউল। উনিশ বছর বয়সে যখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ পায় তখন তার মনে হয়, মুক্তি যেন ধরা দিয়ে গেছে তার হাতে।
কোম্পানীগঞ্জের চিপাগলির ভাড়া বাড়ি থেকে, বাড়ি বলতে তিন ভাই-বোন আর মা-বাবা মিলে গাদাগাদি করে থাকার মতোও নিতান্তই অপর্যাপ্ত, রুদ্ধশ্বাস দেয়ালের গণ্ডির ভেতর থেকে মুক্ত হওয়ার স্বাদ। কিন্তু আসলেই কি মুক্তি সম্ভব? শুরু হয় একের পর এক বাধা আর সংকটের দেয়াল টপকানো। জীবন থেকে পালিয়ে জীবন খোঁজার এক সন্তর্পণ যাত্রা।
এ এক বিদীর্ণ সময়, অস্বস্তি আর অস্থিরতার ভেতর থেকে অন্যরকম এক তরুণকে বের করে আনেন লেখক। পরিবার থেকে পালিয়ে কায়েদে আজম হলে স্বস্তি খোঁজে মশিউল, সিনেমা আর আবাসিক হলের নানাবিধ অনুষঙ্গে ডুবে থাকতে চায় সে।
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়ে মশিউলের শৈশব-কৈশোরের যাপিত দিনের গল্প আর ঘটনার সাক্ষী কোম্পানীগঞ্জের সঙ্গে অদৃশ্য ভেদরেখা গাঢ় হতে থাকে দিনে দিনে। পরিবর্তন হতে থাকে পরিবার এমনকি পুরনো বন্ধু দেলোয়ারের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণভঙ্গিও। ঔপন্যাসিক আশ্চর্য দক্ষতায় আঁকেন তিলে তিলে মশিউলের অস্তিত্বের সঙ্গে বাড়তে থাকা যৌবনের সহজাত শ্রেণিবোধের চিত্রও।
তাই দেলোয়ারের সঙ্গে পুরনো দিনের ভালো লাগার মানুষ নাজমার ব্যাপারে আলাপ করা গেলেও অভিজাত শ্রেণির দোতলা বাড়ির বাসিন্দা গোপন মনের বহু আকাক্সিক্ষত প্রেমিকা মিলির ব্যাপারে আলাপ করে না মশিউল।
ছুটিতে দেলোয়ারের বাড়িতে সময় কাটানোর জন্য বিনা নোটিশে হাজির হতে পারলেও দেলোয়ারকে কখনো তার আবাসিক হলে আসার ভদ্রতাসূচক নিমন্ত্রণটুকুও জানায় না সে। ব্যাপারটা পরবর্তীকালে আরো পরিষ্কার হয় মর্মাহত দেলোয়ারের এই খেদোক্তিতে, ‘তুমি ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তির চান্স পেয়ে খবরটা আমাকে যেভাবে দিয়েছিলে মনে হয়েছিল তুমি আলাদা ক্লাস। তখন থেকে তুমি আমাকে নিচু চোখে দেখতে শুরু করেছিলে।’
মশিউলের শ্রেণিবোধটা মেকি। শক্ত কোনো ভিত্তি নেই, যেন হাওয়ায় ফোলানো বেলুন। আদতে সে সন্ত্রস্ত ও কল্পনাপ্রবণ এক সত্তা। পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা উচ্ছেদকৃত বস্তির ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়ও তার ভেতরে দ্রোহের আগুন দপ করে জ্বলে না। বরং সুসজ্জিত ও বিশ্বখ্যাত এই সৈন্যদের শৌর্যবীর্যের তুলনায় এই ধ্বংসযজ্ঞ তার কাছে কমই মনে হয়।
আবার গল্পের পরবর্তী অংশে পাকিস্তানি বাহিনীর নিপীড়নের সাক্ষী এমনকি শিকারে পরিণত হয়েও কোনো ধরনের বিক্ষোভ তার ভেতরে নাড়া দিয়ে ওঠে না। মুক্তিযুদ্ধকালীন বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও হলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার যখন একেবারে কমে যায়, তাকে তখনো ক্লাসে যেতে দেখা যায়। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য তাড়িত প্রহর গুনতে দেখা যায়। অব্যক্ত প্রেমের কাল্পনিক কুলকুল স্রোতোধারায় ভাসতে দেখা যায়।
ভঙ্গুর পরিবার, চিরলালিত অব্যক্ত অসম প্রেম আর ক্রমাগত যুদ্ধের ধ্বংসলীলার শিকার অপরিণত যৌবনের মশিউলের প্রতি সহানুভূতি আর সহমর্মের দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া পাঠকের আর কিছুই করার থাকে না।
হলে অভিজাত পরিবার থেকে উঠে আসা মশিউলের তিন রুমমেট। তাদের চলাফেরা, খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে হোমিওপ্যাথি ওষুধের কাঠের বাক্স নির্মাতা ফকির চাঁনের ছেলে মশিউলের স্কলারশিপের সামান্য টাকায় দিনাতিপাত ও খাবার-দাবারের পার্থক্যের পাঠদর্শিতা মর্মাহতই করে বটে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন খাঁ খাঁ ইউনিভার্সিটি হলে বস্তুত নিঃসঙ্গ জীবনযাপনের একপর্যায়ে হলে দেলোয়ারের আকস্মিক আগমন এবং দেলোয়ারকে অনুসরণ করে গিয়ে হোমিওপ্যাথি কবিরাজ সুশীল বাবুর বাড়ির আঙিনায় পড়ে থাকা পাকসেনা কর্তৃক নিহত ফকির চাঁনের লাশ দেখে চিরদিনের ঘৃণিত পিতার প্রতি মশিউলের আপাত খামখেয়ালি কর্তব্যপরায়ণতার দেখা মেলে। কিছুটা যেন কামুর ‘আউটসাইডারে’র সেই চরিত্রের মতো।
মশিউলের ঘাড়ের ওপরে বোঝা হয়ে নেমে আসে মা আর স্কুলপড়ুয়া বোনের জীবন ও নিরাপত্তার দায়িত্ব।
বাউণ্ডুলে ছোট ভাই মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে হয়ে ওঠে অদৃশ্য বিষের কাঁটা। সংসারের দায়িত্বে অনভ্যস্ত ও পলায়নপর মানসিকতার যুবক মশিউলের চোখের সামনে থেকে পর্দা সরে যায় আশ্চর্য স্বাভাবিকতায়। কাহিনি এগোতে থাকে আর সংকটের ডালপালাও বিস্তৃত হতে থাকে। সময়ের সন্ত্রাসে জর্জরিত হতে থাকে মশিউল। যুদ্ধ, দারিদ্র্য আর পারিবারিক অসহায়ত্বে কাবু হতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া এই তরুণ। ভীতু মশিউল বর্বর পাকসেনাদের ভয়ে এখানে-ওখানে পালিয়ে বেড়ায় বিভিন্ন ছদ্মবেশে, তবু তার মুক্তি মেলে না। এক অচেনা সন্ত্রাস তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।
সাবলীল গদ্যে দারুণভাবে অস্থির সময়ের গল্প বলে যান লেখক। সময় ও সমাজের ভেতর থেকে তুলে আনা এক ভিন্নমাত্রিক গল্প বলেছেন সিরাজুল ইসলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন এক দরিদ্র পরিবার আর স্বপ্নাতুর এক যুবকের জীবনকে চিত্রায়িত করেছেন অপূর্ব কুশলতায়। নিঃসন্দেহে উপন্যাসটি মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের এক ব্যতিক্রমী ক্যানভাস। যেখানে কেবল সাহসী আর বিজয়ীর গল্প নয়, তটস্থ ও পলায়নপর এক পরিবারের অনিশ্চয়তার গল্পও বলা হয়েছে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.