মাধব-মালঞ্চী : নির্মল বিনোদনের নাটক

‘শিল্পের জন্য শিল্প? নাকি মানুষের জন্য শিল্প?’ – শিল্প-আন্দোলনের নানা বিতর্ক, নানা মতাদর্শ মানুষকে নানাভাবে ভাবিত করলেও একজন দর্শকের নির্মল আনন্দপ্রাপ্তিকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখা যায় না। তবে সে-আনন্দ মানুষ, সমাজ, জাতিসত্তা,  সভ্যতা-সংস্কৃতি কিংবা নীতিবোধের বাইরে নয়। গত ২১শে জুন শিল্পকলা একাডেমীর এক্সপেরিমেন্টাল মঞ্চে তেমনই এক নির্মল আনন্দের প্রকাশ ঘটালো থিয়েটার আর্ট ইউনিট নাট্যদলের নতুন প্রযোজনা মাধব-মালঞ্চী। সেদিন ছিল নাটকটির উদ্বোধন প্রদর্শনী। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের বহুল প্রচলিত মাধব-মালঞ্চী কইন্যা পালাটি বিভাস চক্রবর্তীর নাট্যরূপে মঞ্চে এনেছে থিয়েটার আর্ট ইউনিট। নির্দেশনা দিয়েছেন অভিনেত্রী-নির্দেশক রোকেয়া রফিক বেবী। প্রথম প্রদর্শনীতেই নাটকটি দর্শকদের ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে।

পালা বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী নাট্যাঙ্গিক। বন্দনা, বর্ণনা, নৃত্য-গীত ও অভিনয়ের অদ্বৈত মিলনে কাহিনিনির্ভর এ-নাট্যধারা। বৃহত্তর বঙ্গভূমিতে পালানাট্য যুগে যুগে মানুষের শিল্পতৃষ্ণা মিটিয়েছে। মাধব-মালঞ্চী পালার উৎসমূল জানা জরুরি। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে বদিউজ্জামানের সম্পাদনায় বাংলা একাডেমি প্রকাশ করে মোমেনশাহী গীতিকা। মাধব মালঞ্চী কইন্যা পালাটি এ-সংকলনের প্রথম খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত। এই পালাগুলি সংগ্রহ করেন মোহাম্মদ সাইদুর। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের অত্যন্ত জনপ্রিয় পালা ছিল এটি। এর পাঠান্তর আছে। প্রচলিত এ-পালাটি কিশোরগঞ্জের নিকলী থানার অন্তর্গত গোপদিঘি এলাকার ইব্রাহিম বয়াতির কাছ থেকে সংগৃহীত। এর প্রকৃত পালাকারের নাম জানা যায় না। তবে ইব্রাহিম বয়াতি এ-পালা তিরিশ পঁয়ত্রিশ বছর আগে নিজ গ্রামে কাউছার বয়াতির কাছ থেকে শেখেন। (মোমেনশাহী গীতিকা, প্রথম খণ্ড, পৃ ৩৭)। এ-পালার মধ্যে গদ্যে বর্ণনা, উক্তি-প্রত্যুক্তি ও গানের অদ্বৈতনীয় মিশ্রণ আছে। মোমেনশাহীর পশ্চিম পাড় দিঘুলি অঞ্চলের মোহাম্মদ আমজাদ হোসেনের কাছ থেকেও মাধব মালেঞ্চার গান নামে পালা সংগ্রহ করেছে বাংলা একাডেমি। কলকাতার নাট্যজন বিভাস চক্রবর্তী বাংলাদেশের পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের সঙ্গে গবেষণার সূত্রে জনপ্রিয় এ-পালাটির সঙ্গে পরিচিত হন। পরবর্তীকালে বিভাস চক্রবর্তী এর কাহিনিকে প্রসেনিয়াম থিয়েটার ধারায় উপস্থাপনের জন্য নাট্যরূপ দেন। গল্পে কিছুটা পরিবর্তন আনলেও উক্তি-প্রত্যুক্তি, ভাষা একই রাখেন। গানের আবেগগুলি একই। উপস্থাপনের জন্য সংলাপগুলি চিহ্নিত করেন। বিভাস চক্রবর্তী-প্রতিষ্ঠিত ‘অন্য থিয়েটার’ ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে নাটকটি মঞ্চে আনে। তৎকালীন কলকাতার প্রচলিত থিয়েটারচর্চায় এক ভিন্নমাত্রা নিয়ে আসে এ-নাটক। সংলাপ ও দ্বন্দ্বনির্ভর থিয়েটার চর্চার মধ্যে গীতল এ-নাট্য রীতিমতো ব্যতিক্রম। নানা কারণেই অন্য থিয়েটার-প্রযোজিত মাধব মালঞ্চী কইন্যা নাটকটি জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যায়। একাধারে দেড় শতাধিক প্রদর্শনীতে লক্ষ করা গেছে দর্শকের ভিড়। জানা যায়, কলকাতা সিটি করপোরেশন কী এক অজ্ঞাত কারণে একসময় এ-নাটকের প্রদর্শন বন্ধ করে দেয়। নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে ঢাকায় আয়োজিত নাট্যোৎসবে কলকাতার অন্য থিয়েটার মাধব মালঞ্চী কইন্যা নাটকটি প্রদর্শন করে। সে-সময় নাটকটি এদেশের নাট্যকর্মী, নাট্যবোদ্ধা ও দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।

বিভাস চক্রবর্তী এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি যদি সিলেটি না হতাম, তাহলে মাধব মালঞ্চী আমি করতে পারতাম না, আমার মনে হয়। আমি সিলেটি বলেই পেরেছি। দ্বিতীয় হচ্ছে, কোথাও একটা জাতিগত ব্যাপার থাকে। অর্থাৎ বাঙালিরা এক সময়ে থিয়েটার, নাটক বা যাত্রাপালা দেখতে যাবার সময়ে বলত, গান শুনতে যাচ্ছি। ওই গান। অর্থাৎ গানের সঙ্গে আমাদের এই পারফর্মিং আর্টসের, তা যাত্রাই হোক বা পরবর্তীকালের থিয়েটার, একটা অদ্ভুত যোগাযোগ ছিল। গিরিশ ঘোষ থেকে আরম্ভ করে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত তাঁদের নাটকে গানের একটা বিশাল ভূমিকা আছে। … মাধব মালঞ্চী কইন্যাতে গান যদি না থাকে, তাহলে তো কিছুই থাকল না। লোকভাষা, লোককাহিনি, লোকসংগীত এই নাটকের ইন্টিগ্রাল পার্ট এবং পূর্ববঙ্গের কাহিনি। ময়মনসিংহ গীতিকার কাহিনি। সেখানে গান তো মূলেই আছে। তার ওপর আবার আমি দিনেন্দ্র চৌধুরীকে দিয়ে গান লিখিয়েও ছিলাম।’ (দেশ পত্রিকা)

বিভাস চক্রবর্তীর নাট্যরূপকৃত মাধব মালঞ্চী কইন্যা নাটকটি থিয়েটার আর্ট ইউনিট প্রযোজনা করেছে মাধব মালঞ্চী নামে। মাধব-মালঞ্চী কইন্যা প্রচলিত নামের ‘কইন্যা’ শব্দটি বাদ দেওয়ার মধ্য দিয়ে বোঝা যায় নির্দেশক নারীকে কমনীয়-নমনীয়-দুর্বল হিসেবে দেখাতে চাননি। বরং নতুন নামকরণ মাধব-মালঞ্চীতে নারী পুরুষের সমমর্যাদা, মানবিক প্রেমকেই প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। গল্পের মধ্যেও নারীর শৌর্য ও মহত্ব প্রাধান্য পেয়েছে। এটি থিয়েটার আর্ট ইউনিটের ৩৬তম প্রযোজনা।

১৯৯২ সালে ঢাকার ধানমন্ডির মধুবাজারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দলটি। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই থিয়েটার আর্ট ইউনিট জনপ্রিয় মঞ্চনাটক উপহার দিয়ে চলেছে। তাদের প্রথম প্রযোজনা কোর্ট মার্শাল বাংলাদেশের সর্বাধিক জনপ্রিয় নাটকের তালিকায় রয়েছে। এছাড়া গোলাপজান, খ্যাপা পাগলার প্যাঁচাল, আমিনা সুন্দরী অনন্য প্রযোজনা। 

মাধব-মালঞ্চী নাটকের মূল আখ্যান গড়ে উঠেছে মাধব নামে ছদ্মবেশী রাজপুত্র ও সুন্দরী রাজকন্যা মালঞ্চীর প্রেমকে উপজীব্য করে। আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী পালারীতিকে অবলম্বন করে সূত্রধরের বর্ণনা, অভিনয় ও দৃশ্যপরম্পরায় কাহিনির বিকাশ। কাহিনিতে দেখা যায়, দুর্লভ রাজা জীবনের শেষপ্রান্তে মাতৃহীন শিশুপুত্র মাধবকে জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূ চন্দ্রবনের হাতে দিয়ে যান। জ্যোতিষগণনায় মাধব সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হলে অন্য ভাইয়েরা তাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করে। উত্তরাধিকার নিয়ে সংঘর্ষের একপর্যায়ে আত্মরক্ষার জন্য রাজপুত্র কিশোর মাধবকে পালিয়ে দূরদেশে চলে যেতে হয়। সেখানে আরেক রাজা ও মন্ত্রীর আশ্রয়ে বড় হতে থাকে সে। রাজকন্যা মালঞ্চীর সঙ্গে একত্রেই পড়ালেখা করতে থাকে মাধব। একই সঙ্গে পড়ালেখা করলেও দুজন দুজনকে কখনোই দেখেনি। এক নাটকীয়তায় প্রেমে পড়ে মাধব। কিন্তু মালঞ্চীর তখন বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে অন্যত্র। মালঞ্চী শর্ত দেয়, যদি এক রাতের মধ্যে মনপবনের নাও নিয়ে গুরগুরি গাছের নিচে অপেক্ষা করতে পারে মাধব, তবে সে সব ছেড়ে তার কাছে চলে আসবে। মালঞ্চীর কথামতো সে-ব্যবস্থাই করে মাধব। কিন্তু ঘটে উল্টো ঘটনা। বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে পালিয়ে রাজকন্যা মালঞ্চী মনপবনের নাওতে গিয়ে ওঠে। দীর্ঘক্ষণ নাও চলার পর মালঞ্চী লক্ষ করে মাধব নেই। রাজপ্রাসাদত্যাগী মালঞ্চী হারিয়ে ফেলে মাধবকে। না পারে রাজপ্রাসাদে ফিরে যেতে, না পারে মাধবকে নিয়ে একসঙ্গে বাঁচতে। অবশেষে পুরুষের বেশে সিপাহি সেজে দেশ-বিদেশে মাধবকে খুঁজে বেড়াতে থাকে মালঞ্চী। নানা ঘটনা, উপঘটনা ও আবেগ-বিমোক্ষণের মধ্য দিয়ে কাহিনি এগিয়ে চলে।

নির্দেশক রোকেয়া রফিক বেবী উপস্থাপনায় দেশীয় নাট্যাঙ্গিককে গুরুত্ব দিয়েছেন। ঐতিহ্যবাহী পালারীতিকে অক্ষুণ্ন রেখে আধুনিক প্রসেনিয়াম মঞ্চবিন্যাসে উপস্থাপন করেছেন। পালানাট্যে একক অভিনয়ে পরিবেশনের রীতি প্রচলিত থাকলেও এতে পালার পরিবেশনারীতির মতো বর্ণনা, বন্দনা, নৃত্য-গীত, অভিনয় ও দৃশ্যসজ্জার সংযোজনে অদ্বৈত উপস্থাপনের প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। পরিবেশেনাটির গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, এর কাহিনি রাজ-রাজড়া নিয়ে হলেও এ যেন প্রাত্যহিক গ্রামীণ জীবনের মানবিক সমস্যাগুলিই চিহ্নিত করে। চরিত্র, সংলাপ, হাবভাব, চলনবিন্যাস ও আচরণ আমাদের চারপাশের বাস্তবতাকেই নির্দেশ করে। সংগীতনির্ভর কমেডি ও স্যাটায়ারের দ্রবণ বিদ্যমান।

নাটকের শুরুটা আকর্ষণীয়। দর্শক প্রবেশের সময় ধ্রুপদী রাগাশ্রিত কণ্ঠের বিস্তার চলতে থাকে। মঞ্চে তখন অভিনেতা-অভিনেত্রীরা বিভিন্ন ভঙ্গিমায় বসে। মনে হচ্ছে এই বুঝি নাটক আরম্ভ হবে। ঐতিহ্যবাহী নাট্যরীতিতে কুশীলবগণ সর্বদা দর্শকের সামনেই অবস্থান করেন। একসময় ধ্রুপদী রাগ ও ফোক মিশ্রণের অনবদ্য নিনাদ তৈরি হয়। তারপর সূত্রধর মধ্যমঞ্চে এসে দাঁড়ান। ওপরের ফোকাস লাইট জ্বলে ওঠে। সূত্রধর ঘটনার সূত্রপাত ঘটান। শুরু হয় বন্দনা। বর্ণনা, বন্দনা ও নৃত্যগীতে যেন মঞ্চ কেঁপে কেঁপে ওঠে। ঘোড়া দৌড়ায়, চরিত্ররা আসে, মালব-মালঞ্চী মনপবনের নৌকায় বসে একজন যেন আরেকজনকে ছুঁতে যায়। আসে নানা কিছু। শুরুতেই বুঝিয়ে দেওয়া হয় কী ঘটবে নাটকে বা কী নিয়ে নাটক। মাধব-মালঞ্চীর রোমান্টিকতা যেন গানে গানে ছন্দে ছন্দে মঞ্চ কাঁপিয়ে তোলে। দর্শক প্রবিষ্ট হয় নাট্যের গল্পে।

দশ মিনিটের বিরতিসহ প্রায় আড়াই ঘণ্টা নাটকের ব্যাপ্তি। গল্পটিতে দৈত্য-দানবনির্ভর রাজা-বাদশা কিংবা রূপকথার অবদমিত সমাজবাস্তবতার নানা ইঙ্গিত থাকে। এ-নাটকের গল্প প্রায় সম্পূর্ণই অলীক। এক রাতে বিশেষ ক্ষমতাবাহী মনপবনের নাও বানানোও নিশ্চয়ই অসম্ভব। কিন্তু অলীক হলেও গল্পটির সামগ্রিকতায় আজকের রাজনৈতিক, পারিবারিক কিংবা সমাজের কুটিলতার চিত্রই যেন ফুটে ওঠে। গ্রামবাংলার মানুষের সাধারণ আচরণগুলিও যেন প্রতিফলিত হয়েছে। চরিত্রায়নে কৌতুক এবং ব্যঙ্গ আছে। রাজা চরিত্রটি সংলাপের প্রতিটি বাক্যেই ‘বলদ’ বলে। আসলে সে নিজেই যে বলদ, তা প্রকাশ পায়। এই বলদ শব্দ ব্যঙ্গাত্মক। অপরদিকে আরেক রাজা সারাক্ষণ ‘রাজবাক্যি নড়চড় হয় না’ বলে বেড়ায়। ‘বাঁশের আগায় তুলে রাজত্বি দেখায় দে’ – এসবের মধ্যেও রয়েছে ভিন্ন ইঙ্গিত। চন্দ্রবনের নির্দেশে পেয়াদা কাঠুরিয়াকে মনপবনের নাও বানাতে বাধ্য করে। ক্ষমতার কৌশল নানাভাবে ব্যাখ্যাত হয়। সাইক্লোরামায় মনপবনের নাও ফুটে ওঠে – দর্শক রোমাঞ্চিত হয়। মালঞ্চী পালিয়ে গিয়েও যখন একা হয়ে পড়ে তখন তার বিয়োগব্যথা/ ট্র্র্যাজেডি দর্শকের হৃদয়কে স্পর্শ করে।

নাটকের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সূত্রধর। সূত্রধর নাট্যকাহিনি বর্ণনা করে এবং সঙ্গে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয়ও করে। সূত্রধর চরিত্রে অভিনয় করেছেন নুরুজ্জামান বাবু। পালানাট্যে পালাকার বর্ণনা, নৃত্যগীত ও অভিনয়ের মাধ্যমে নাট্যক্রিয়া সম্পন্ন করেন। দোহারগণ কাহিনি বিকাশে সঙ্গত দেন। এ-নাটকে সূত্রধর অনেকাংশে সেই ভূমিকাই অবলম্বন করেছে।

সূত্রধর কখনো বর্ণনাকারী, কখনো দোহারী সংগত দেয়। নৃত্যগীত, অভিনয় ও বর্ণনার অপূর্ব কৌশলে যেন তার চলন। জার্মান নাট্যতাত্ত্বিক ব্রেখট বুর্জোয়া নাট্যরীতির আগ্রাসনের বিপরীতে দর্শককে বিযুক্তিকরণ প্রক্রিয়ায় নিয়ে গেছেন। দর্শককে মোহাবিষ্টতার আবেষ্টন থেকে নিজস্ব বুদ্ধিমত্তায় বাস্তবতায় রাখতে চেয়েছেন। হাজার বছরের বাংলা অঞ্চলের নাট্যরীতিতেও তেমন কৌশলের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। পালাকারগণ নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে দর্শককে বারবারই বুঝিয়ে দেন যে, তারা মূলত পালা দেখছেন। এ-নাটকেও নির্দেশক ব্রেখটের এলিনিয়েশন কিংবা পালাকারের বিযুক্তিকরণের মতো সূত্রধর বারবার দর্শককে নিয়ে বিযুক্তিকরণ প্রক্রিয়ায় এগিয়েছেন। এক নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে নির্দেশক নাট্যগল্পটি সাজিয়েছেন। 

নাটকে চন্দ্রবন চরিত্রটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা না রাখলেও মাধব চরিত্রের বিকাশে অবশ্যম্ভাবী ছিল। চন্দ্রবন চরিত্রে অভিনয় করেছেন নাহিদ সুলতানা লেমন। তাঁর অভিনয়ে একদিকে মাধবের প্রতি যেমন স্নেহসুলভ কমনীয়তা প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি মাধবকে রক্ষা করার জন্য অগ্নিমূর্তিও তাকে ধারণ করতে হয়েছে। মনপুতার চরিত্রের দোলন আজিজকে ক্ষমতার কৌশলে কাজ করতে হয়েছে। বলরাজ ও মালি চরিত্রে সুজন রেজাউল, উজির চরিত্রে কাজী তানভীর, হাসনাত প্রদীপ, বুইট্রাল রাজা চরিত্রে মোকাদ্দেম মোরশেদ, রাজকন্যা চরিত্রে বাঁশরী হাস্যরস তৈরি করেছেন। গাম্ভীর্যের পরিবর্তে প্রকাশ পেয়েছে সহজ-সরল মানসিকতা। মডুলেশন, বাচনিকরীতি, সংলাপ, প্রপস, কোরিওগ্রাফির মধ্য দিয়ে বিনোদনের প্রধান অনুষঙ্গগুলি মূর্ত হয়ে উঠেছে।

মাধব চরিত্রে অভিনয় করেছেন মেহমুদ সিদ্দিকী লেলিন ও ঐতিহ্য (ছোটমাধব)। ছোটমাধব চরিত্রে ঐতিহ্যের অভিনয়ের ভাবপ্রকাশের সরলতা চরিত্রকে মাধুর্যমণ্ডিত করেছে। সংলাপ, হাঁটা-চলার মধ্যে তাঁর স্বাচ্ছন্দ্য বজায় রেখেছেন। রাজ্যত্যাগ করে পলায়নের পরেও মাধব কখনো ভেঙে পড়েনি।

গান : চক্ষু দিয়া যায় না দেহা, কার কপালে কি যে লেহা গো

      এই যে রাজার কুমার রাজ্য না পায় হয় যে ভাগ্যহীন

      মাধবরে তার যায় না জীবন।

উজিরের অধীনে প্রতিপালিত হলেও মাধব পড়াশোনা করতে চায়। উজির শেষ পর্যন্ত রাজার আনুকূল্যে তাকে পড়ালেখা করায়। বলরাজার মন্দিরে মাধব পড়াশোনা করে। সিনেম্যাটিক কায়দায় মাধব চরিত্রের বড় হওয়া দেখানো হয়। ওপরতলায় বসে পড়ে মালঞ্চী আর নিচতলায় মাধব। কিন্তু মাধব কখনোই মালঞ্চীকে দেখার জন্য কোনো আকুলতা প্রকাশ করেনি। একসময় মাধবের টোলের পড়া শেষ হয়। মাধব যখন অন্য শিক্ষকের অধীনে পড়তে যাবে তখন মালঞ্চী তাকে দেখতে চায়। তাই কৌশলে ওপরতলা থেকে বারবার কলম নিচে ফেলে দেয় মালঞ্চী। মাধব বারবার তার কলম ওপরে তুলে দিলেও মালঞ্চী মাধবকে দেখতে পায় না। অবশেষে নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে দুজন দুজনকে দেখে।

মালঞ্চী চরিত্রে অভিনয় করেছেন ইন্দ্রানী ঘটক। একদিকে প্রেমপরায়ণতা, অন্যদিকে চারিত্রিক বলিষ্ঠতা তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। মহত্ত্বর করে তুলেছে। মাধবের প্রেম নিবেদনকে সে প্রত্যাখ্যান করেনি। সেও ভালোবেসেছে মাধবকে।

যে-মালঞ্চী বিয়ের রাতে স্বজনদের ছেড়ে যে বিশ্বাসে পালালো, সেই মালঞ্চীই নিজ ভুলে হয়ে উঠলো একা এবং অসহায়। গুরগুরি গাছের নিচে মনপাবনের নাও পেয়ে উঠে বসল। একজনকে মুখ ঢেকে ঘুমাতে দেখে মাধব মনে করে বিস্মিত করে দেবে ভেবে নিজেই নৌকা চালিয়ে দূরদেশে যেতে থাকে সে। একসময় আবিষ্কার করে ঘুমন্ত ব্যক্তিটি মাধব নয়। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। কী করবে এখন। মালঞ্চী কোনো উপায়ান্তর খুঁজে পায় না। নানা ঘটনা, উপঘটনায় সিপাহি বেশে দেশে-বিদেশে মাধবকে খুঁজে বেড়াতে থাকে। নারী যে ঘরের কোণে আবদ্ধ কোনো প্রাণী নয়, নারী যে শুধু পুরুষের দাসী নয়; তারও যে সাহস আছে, অধিকার আছে, ক্ষমতা আছে – সেই রূপই যেন প্রতিভাত হয়ে উঠতে থাকে দৃশ্যের পর দৃশ্যে। একসময় বুইট্রাল রাজার অধীনে সে চাকরি করে। খুঁজে বেড়াতে থাকে মাধবকে। নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে অনেক কৌশল, ছলনা আর শক্তির পরীক্ষা তাকে দিতে হয়। অবশেষে পুকুর খননের কাজের মধ্য দিয়ে মাধবের সাক্ষাৎ পায় মালঞ্চী।

নাটকের অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন – রাকিবুল ইসলাম মানিক, সজল চৌধুরী, ইসমাইল সিরাজী, রানা সিকদার, দোলন আজিজ, ফুয়াদ সিদ্দিকী, স্মৃতি সরকার, ফারহানা প্রমুখ।

নাটকের সেট নির্মাণে কুশলতার পরিচয় পাওয়া যায়। কিছু দৃশ্য নির্মাণে স্থির স্থাপত্য ব্যবহার করা হয়েছে। আবার কিছু দৃশ্যে চলনশীল সেট। নাটকের আলো ও সেট ডিজাইন করেছেন জুনায়েদ ইউসুফ। চন্দ্রবনের দৃশ্যে স্থাপত্য হিসেবে একটি দরজার সাজেশন তৈরি করা হয়েছে। বলরাজার ক্ষেত্রে উঁচু পাটাতন ও সিঁড়ি দিয়ে রাজপ্রাসাদের সাজেশন তৈরি করা হয়েছে। অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য রূপেই যেন ধরা পড়ে রাজপ্রসাদ। এ অংশের সেটেই মাধব ও মালঞ্চীর পড়াশোনা, রোমান্টিকতা ও প্রেম। ওপরের তলায় পড়ে মালঞ্চী, নিচে মাধব। সংলাপে, গানে, আলো ও কোরিওগ্রাফির চলনে রোমান্টিকতা ছড়িয়ে পড়ে মঞ্চজুড়ে। মনপবনের নাওটিও আকর্ষণীয়। কালো কাপড়ে মোড়ানো বাক্সের ভেতরে বসে কেউ এটি ঠেলে ঠেলে নিয়ে যায়; কিন্তু দর্শক তাকে দেখতে পান না। ফলে দর্শক অভিভূত হন। বুইট্রাল রাজার ক্ষেত্রেও সিঁড়ি ও পাটাতন দিয়ে প্রাসাদের সাজেশন তৈরি করা হয়।

নাটকের প্রপস নির্মাণ করেছেন এস তহুর আহমেদ।  রাক্ষসের মুখোশ নির্মাণে প্রচলিত অর্থে বৃহৎ ও ভয়ংকর অর্থেই ইমেজ তৈরি করেছেন। জুয়ার পট তৈরিতে সময়কেই বড় করে দেখা হয়েছে। তাছাড়া পানের বাটা, বাজারের দৃশ্যে বাংলার মধ্যযুগের শেষ পাদের সংস্কৃতিকেই ইঙ্গিত করেছেন।

নাটকের পোশাক ডিজাইন করেছেন এনাম তারা সাকি। চরিত্রের বাস্তববাদী রূপের সঙ্গে চিরন্তন কিছু রূপরেখা টেনেছেন। সাজসজ্জার ক্ষেত্রেও উচ্চকিত না হয়ে বাস্তববাদী রূপই প্রকাশিত হয়েছে।

নাটকটির আরেকটি প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এর আবহ। আবহ ও সংগীত পরিকল্পনা করেছেন সেলিম মাহবুব। নাটকটিতে গানের এত ব্যবহার যে-কেউ বলেই বসতে পারেন, এটি একটি মিউজিক্যাল প্লে। তবে সংগীত থাকলেও নাটকটি নাট্যগুণপ্রধান। এই নাটকে লাইভ মিউজিকের পাশাপাশি রেকর্ডেড মিউজিকও ব্যবহৃত হয়েছে। লাইভ মিউজিকে রাগাশ্রিত সুর থেকে নিয়ে আবহমান লোকজরীতির গান বা সুর ব্যবহার করা হয়েছে। সংগীত কখনো আবহ তৈরিতে, কখনো চরিত্র বা ঘটনার আবেগ প্রকাশে কিংবা কখনো সংলাপ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। সংগীতদলে ছিলেন সেলিম মাহবুব, সুজন, সান্টু, শাফিন, জামিল, শাপলা ও বিপ্লব।

নাটকের নির্দেশক রোকেয়া রফিক বেবী বলেন, ‘আজ থেকে প্রায় বত্রিশ বছর আগে বিভাস চক্রবর্তীর নাটক মাধব মালঞ্চী কইন্যা দেখেছিলাম। নাটকের সংলাপ, সংগীত, আলো সেসময় মনে দাগ কেটেছিল, তৈরি করেছিল নতুন ভাবনা। কোভিডের পর দলের নতুন প্রযোজনার শর্ত ছিল যে, নাটকটি হতে হবে বড় পরিসরের (এ-সময়ে যা বেশ চ্যালেঞ্জিং)। ভাবছিলাম পালা করলে কেমন হয়। ফেরদৌস অমি বিপ্লব মনে করিয়ে দিলো মাধব মালঞ্চীকে। তৎক্ষণাৎ যোগাযোগ করলাম বিভাস চক্রবর্তীর সঙ্গে। … নাটক পড়তে গিয়ে ‘রাজকন্যার রাজপুত্র উদ্ধার’ এবং ‘চন্দ্রবনের আশ্চর্য হারছরা’ আমাকে বেশ প্রভাবিত করলো। নাটকটিতে মালঞ্চীকে আমি দেখতে চাইলাম নারী শক্তির প্রতীক হিসেবে।’

নাটকটির নির্দেশনায় সহযোগী ছিলেন মোকাদ্দেস মোরশেদ। নাটকের কোরিওগ্রাফি করেছেন কামরুল হাসান ফেরদৌস। পল্লীকবি জসীমউদ্দীনও মাধব-মালঞ্চী শিরোনামে রচনা করেছেন। কিশোরগঞ্জের গোপদিঘি গ্রামে প্রতিষ্ঠিত ‘ইব্রাহিম বয়াতি সাংস্কৃতিক সংঘ’ এ-নাটকটি উপস্থাপন করে। বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটার ধারায় নাট্যবেদ নামে একটি দল মন পবনের নাও শিরোনামে এ-পালানাটক মঞ্চস্থ করেছে। ভোলা থিয়েটারও প্রযোজনা করেছে মাধব মালঞ্চী কইন্যা। থিয়েটার আর্ট ইউনিটের এ-প্রযোজনা গল্প-অভিনয়, সংগীত, চলনবিন্যাসে একধরনের মোহনীয় ভালোলাগা তৈরি করে। বিনোদন ও ঐতিহ্যবাহী নাট্যরীতির চর্চার জায়গা থেকে নাটকটি গুরুত্বপূর্ণ।