জলের অক্ষরে লেখা

পর্ব : ৮

সকালে ঘুম ভাঙতেই অবন্তির মনে হলো, আজ সে কোথাও যাবে না। অবশ্য অংশু আর ঋভুর সঙ্গে আড্ডায় যাওয়া ছাড়া গত কয়েক দিনে অন্য

কোথাও যায়ওনি সে। আজ ওদের কাছেও যাবে না। ঘুম ভাঙার পর প্রথম অনুভূতিটা এরকম হলো কেন, এ নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলো অবন্তি। রাতের কথা মনে পড়লো। ঋভুর বাসায় আড্ডা, আকস্মিক চুম্বন – ওরকম কিছু হতে পারে একটু আগেও ভাবেনি সে; ফিরে আসার সময় অংশুর বলা কথাগুলি, ভাবির সঙ্গে গল্পস্বল্পের পর বৃষ্টি দেখা, বৃষ্টির ঝাপটায় খানিকটা ভিজে গেলেও কাপড়চোপড় না পাল্টে এবং রাত্রিকালীন প্রসাধন না করেই শুয়ে পড়া, তারপর ঋভুর কথা ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়া – এর মধ্যে কোনটি তার এই অনুভূতির জন্য দায়ী? মনে পড়লো, শেষ রাতে ঋভুর কথা ভাবতে ভাবতেই গভীর অভিমানে ভরে উঠেছিল তার বুক। চুমুর পর সে চেয়েছিল, ঋভু আরো কিছুক্ষণ তাকে জড়িয়ে ধরে থাকুক, এমনকি তার শরীরও জেগে উঠতে চাইছিল, মনে হচ্ছিল আরো কিছু হোক। ঋভু যদি তাকে আকর্ষণ করতো, যদি নিয়ে যেত বিছানায়, সে এতটুকু আপত্তি করতো না। আপত্তি তো করতোই না, বরং দারুণ আনন্দিত হতো। কিন্তু ওর সেই উদাসীনতা ফিরে এসেছিল ফের, অবন্তির অনুভূতি বুঝতে পারেনি অথবা বুঝতে চায়ইনি। ও এমন কেন? তাকে যে ঋভু পছন্দ করে তাতে কোনো সন্দেহই নেই তার, কিন্তু সেই পছন্দের ধরন কী? প্রেম নেই তার ভেতরে? কামনাও নেই? কেবলই বিশুদ্ধ ভালো লাগা? প্লেটোনিক? কিন্তু সে তো বরাবর ঋভুকে চেয়েছে ওর সবকিছু সহ, রক্তমাংসের মানুষটিকেও সে ভালোবেসেছে। কুড়ি বছর আগেও কথাটা বলা হয়নি, অপেক্ষা করেছে ঋভুর পক্ষ থেকে কিছু শোনার জন্য; কুড়ি বছর পরও সেই একই ব্যাপার। তাদের সম্পর্ক এগোয় না কেন? এত উদাসীনতা যার, এত শীতল যার আচরণ, কেন সে যাবে তার কাছে? না, যাবে না।

আলস্য এখনো কাটেনি, বিছানায় শুয়ে শুয়েই এসব ভাবছিল অবন্তি। এবার পাশ থেকে ফোনটা তুলে নিল, ডায়াল করলো অংশুর নাম্বারে।

এই সকালেই ফোন, কী ব্যাপার রে?

ব্যাপার হলো, আজকে আমি কোথাও যাবো না।

কেন?

ইচ্ছে করছে না।

সন্ধ্যার আড্ডা?

তোরা আড্ডা দে। আমি যাবো না।

এটা কোনো কথা হলো? তোকে ছাড়া আড্ডা জমবে?

কেন, আমি আসার আগে জমতো না?

না, জমতো না। কসম।

মর তুই। আমি যাবো না।

তাহলে ঋভুকে কী বলবো?

আমি কী জানি!

কী হয়েছে বলবি তো!

কিছু হয়নি রে অংশু, ভালো লাগছে না – অবন্তির কণ্ঠে এবার স্পষ্ট ক্লান্তি।

আজকে একা থাকতে চাইছিস?

হুম।

ঠিক আছে। থাক তাহলে। কিন্তু …

কিন্তু আবার কী?

না তেমন কিছু না। পরে কথা হবে।

ফোন কেটে গেল। অবন্তি আড়মোড়া ভেঙে উঠলো। ঘরের ভেতর থেকেই জোর গলায় ডাকলো – ভাবি।

কী হলো?

একটু শুনবে?

আসছি।

আফসানা এলো একটু ত্রস্ত ভঙ্গিতে, দেখলো অবন্তি হাঁটু ভাঁজ করে বালিশ কোলে নিয়ে বসে আছে।

কী হয়েছে?

কিছু হয়নি। একটা কথা জিজ্ঞেস করার জন্য ডেকেছি।

কী কথা?

এখন কী করা যায় বলো তো?

মানে?

মানে হলো, কী করা যায় বুঝতে পারছি না। খিদে পেয়েছে, আবার গোসলও করা দরকার। কী করি?

ওহ! ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে!

কেন?

আমি ভেবেছি কী-না-কী বলবে!

কেন? এটাকে জরুরি মনে হচ্ছে না?

হাতমুখ ধুয়ে খেতে এসো। ওঠো।

না। উঠতে ইচ্ছে করছে না! 

তোমার হলোটা কী?

সেটাই তো বুঝতে পারছি না। একটু বসো না এখানে।

আফসানা বসলো। অবন্তি গলা জড়িয়ে ধরে বললো, রাতে যেভাবে আদর করেছিলে ওরকম একটু আদর করো না!

হেসে অবন্তিকে জড়িয়ে ধরলো আফসানা। বললো  – তুমি একটু পাগল আছো। নাও ওঠো। আমি কিন্তু এখনো নাস্তা করিনি।

সে কি! বেলা তো অনেক হলো!

তোমার সঙ্গে খাবো বলে বসে আছি।

উফ্! তুমি যে কী না! না উঠিয়েই ছাড়বে না। ঠিক আছে টেবিলে যাও, আমি এখনি আসছি।

খেতে খেতে অবন্তি জিজ্ঞেস করলো, এত বেলা পর্যন্ত না খেয়ে বসে আছ কেন?

বললাম না, একসঙ্গে খাবো বলে।

ভাইয়ার সঙ্গে খেয়ে নিলেই পারতে!

সব সময় তো তাই করি। তুমি আসার পর রুটিনটা একটু পাল্টে নিয়েছি।

কোনো দরকার ছিল না ভাবি।

সব কাজ কি দরকারের জন্যই করতে হয়?

জানি না। কিন্তু আমি একা খেয়ে, একা থেকে অভ্যস্ত।

কিন্তু আমি তো তোমাকে একা দেখতে অভ্যস্ত না। যতদিন দেশে ছিলে ততদিন তো আমরা একসঙ্গেই ছিলাম।

তা ঠিক। আমার পরবর্তী জীবন তো তোমরা দেখনি।

তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো সুসান?

অনুমতি নিচ্ছ কেন? তুমি আমাকে যে-কোনো কিছু বলতে পারো।

ব্যাপারটা তোমার একান্তই ব্যক্তিগত কি না!

তাতেও অসুবিধা নেই, বলো কী জানতে চাও।

ঋভুর সঙ্গে তোমার কী হয়েছিল?

অবন্তি অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলো আফসানার দিকে, তারপর বললো – আমি ভেবেছিলাম, তুমি জামিলের কথা জিজ্ঞেস করবে।

জামিলের কথা!

হ্যাঁ। কেন আমাদের সংসার টিকলো না, সেই কথা জানতে চাইবে ভেবেছিলাম।

তোমার বলতে ইচ্ছে করলে বলো।

তোমার জানতে ইচ্ছে করে না ভাবি?

না, করে না।

কেন?

জামিলের সঙ্গে তো তোমার মেলার কথা না। তুমি যে কেন ওকে বিয়ে করেছিলে জানি না। সংসার টেকেনি তাতে আমি অবাক হইনি।

ঋভুর সঙ্গে বিয়ে হলে টিকতো?

সম্ভবত টিকতো।

কেন মনে হলো এ-কথা?

তুমি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নিজেই প্রশ্ন করে চলেছ।

ও হ্যাঁ। ঋভুর সঙ্গে আমার কী হয়েছিল জানতে চেয়েছিলে। কিছুই হয়নি ভাবি।

কিছুই না?

না।

তাহলে ওকে ছেড়ে গেলে কেন?

ওকে তো ধরিইনি, ছাড়ার প্রশ্ন আসে কেন?

তুমি ওকে ভালোবাসতে না?

জানি না।

বাসতে।

তুমি কীভাবে জানো?

ঋভু যখন তোমার সঙ্গে থাকতো, তোমার চোখে-মুখে এক অদ্ভুত আলো খেলা করতো।

তুমি ওকে ক’বার দেখেছ?

অনেকবার। ও তো অনেকবার এসেছে এ-বাড়িতে। ভুলে গেছ?

না ভুলিনি। হ্যাঁ ভাবি, ওকে আমি ভালোবাসতাম, কিন্তু ও বাসতো না।

ভুল জানো।

মানে?

ঋভুও তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসতো।

তোমাকে বলেছে?

না বলেনি। কিন্তু বোঝা যায়। এগুলো আড়াল করা যায় না।

তুমি সব বুঝতে পেরেছিলে?

কেন নয়?

অন্য সবাই?

তোমার ভাইয়ারা? মা-বাবা?

হ্যাঁ।

সবাই জানতো।

সবার অনুমোদন ছিল?

নিশ্চয়ই ছিল। ঋভু তো খুবই ভালো ছেলে।

ভাবি, তোমরা একটু বাড়িয়েই ভেবেছিলে। ও আমাকে কখনোই কিছু বলেনি।

বলতেই হবে? এমনিতে কি বোঝা যায় না?

যায়। কিন্তু ওরটা বোঝা যেত না।

কেন?

ওর মধ্যে একটা অদ্ভুত উদাসীনতা ছিল, এখনো আছে।

তারপরও তো বোঝা যায়।

হয়তো যায়। কিন্তু কনফিউশনও থাকে। সেজন্যই অন্তত একবার যদি ও বলতো …

সেটাই তো জানতে চাইছি, কী হয়েছিল তোমাদের যে বলার ব্যাপারটা ঘটলো না?

আমি সত্যিই জানতাম না ভাবি।

এখন জানো?

এখনো জানি না। তবে এবার এসে জেনেছি, ওর বাবার মৃত্যুর পর মায়ের সঙ্গে জটিল কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছিল। সেটাই কারণ কি না জানি না।

এখন তো জেনে নিতে পারো!

এখন আর জেনে কী হবে?

কিছুই কি হওয়ার নেই?

অবন্তি আবারো তাকিয়ে রইলো অনেকক্ষণ ধরে, তারপর বললো – কী বলতে চাও পরিষ্কার করে বলো তো ভাবি! ঝেড়ে কাশো।

হেসে ফেললো আফসানা, বললো – এত কঠিন স্বরে বলছো কেন? নরম সুরেও তো জানতে চাইতে পারো।

আচ্ছা, নরম সুরেই জিজ্ঞেস করছি, তোমার উদ্দেশ্যটা কী শুনি!

কোনো উদ্দেশ্য নেই। আমি কেবল সম্ভাবনার কথা ভাবছি।

কিসের সম্ভাবনা?

এই ধরো, ভেঙে যাওয়া জোড়টা আবার জোড় বাঁধতে পারে কি না!

খিলখিল করে হেসে ফেললো অবন্তি, বললো – তুমি এত সুন্দর করে বলো ভাবি, সত্যিই জোড় বাঁধতে ইচ্ছে করে।

বাঁধো না কেন?

অনেক কনফিউশন ভাবি, অনেক প্রশ্ন, অনেক সংশয় …

কিসের এত কনফিউশন?

পোড় খেয়েছি তো, আবারো খেতে হবে কি না; ঋভু সত্যিই ভালোবাসে কি না, বাসলেও তা কতদিন থাকবে; কিংবা ও নিজে জোড় বাঁধতে চায় কি না; জোর বাঁধলে আমি মানিয়ে চলতে পারবো কি না কিংবা আমার সঙ্গে ও মানাতে পারবে কি না; আমাকে দেশে এসে থাকতে হবে কি না, নাকি ও আমার সঙ্গে যাবে; যাওয়ার দরকার হলে ও রাজি হবে কি না, আমার আসতে হলে নতুন করে এ-দেশে জীবন শুরু করতে কষ্ট হবে কি না; ও গেলে একই প্রশ্ন ওর জন্যও …

এত ভেবে কূল পাবে না সুসান। সহজভাবে ভাবো। জীবন খুবই ছোট। ট্রায়াল অ্যান্ড এররের মধ্যে দিয়েই যেতে হয়।

হুম। তা ঠিক। ঠিক আছে ভাবি, আমি ভাবছি ব্যাপারটা, আরো ভাববো। এখন বলো তো, কোথায় যাওয়া যায়?

এই বৃষ্টির মধ্যে কোথায় যাবে?

বাসায় থাকতে ইচ্ছে করছে না যে! 

আজকে আড্ডা নেই?

না, আজ ওখানে যাবো না। নিজের মতো ঘুরবো। ড্রাইভার নেই? গাড়িতে করেই ঘুরে বেড়াতাম।

হ্যাঁ আছে।

তাহলে বেরোই?

আচ্ছা। মতিনকে বললেই ও নিয়ে যাবে। শহরটা খুব ভালো করে চেনে ও।

তাহলে ওকেই বলবো ঘুরিয়ে দেখাতে।

তাও বলতে পারো। তবে বৃষ্টিতে ভিজো না।

কেন?

ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। অনেকদিন অভ্যাস নেই তো।

ঠিক আছে ভাবি। একদম চিন্তা করো না। বৃষ্টি থাকলে গাড়ি থেকে নামবোই না, লক্ষ্মী মেয়ের মতো বসে থাকবো।

অবন্তি উঠলো তৈরি হয়ে নেবে বলে।

আফসানা মতিনকে ডেকে বললো, তোমার আপাকে একটু বেড়াতে নিয়ে যাও তো মতিন।

কই নিয়া যাবো ম্যাডাম?

একটু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখাও। যেখানে যেতে চায় নিয়ে যাও।

আচ্ছা ম্যাডাম।

অবন্তি বেরুলে মতিন জানতে চায়, কই যাবো আপা?

তা তো জানি না। যাও একদিকে।

হাতিরঝিলে যাবো আপা?

যাও। ওখানে কী আছে?

আপনে এখনো যান নাই?

না। শুনেছি অনেক, যাইনি কখনো। দেশেই তো এলাম কত বছর পর!

খুব সুন্দর জায়গা আপা। দেখলেই বুঝবেন।

ঠিক আছে চলো।

মতিন গল্প করতে করতে ধীরে-সুস্থে চালিয়ে হাতিরঝিলে ঢুকে পুরো এক চক্কর ঘুরে এসে বললো – দেখছেন আপা? সুন্দর না?

হ্যাঁ, খুব সুন্দর। আগে তো এখানে ডোবা ছিল। কবে বানালো এটা?

কয়েক বছর আগে বানাইছে।

তুমি কতবার এখানে এসেছ মতিন?

হিসাব নাই আপা। সুযোগ পাইলেই এইদিক দিয়া যাই।

এতবার এসেও সাধ মেটেনি? খুব ভালো লাগে বুঝি?

হ আপা। খুব ভালো লাগে। সন্ধ্যায় আসলে আসল মজাটা বুঝতেন।

সন্ধ্যায় আবার কী হয়?

থইথই করে মানুষ।

কেন?

দেখতে আসে।

কী দেখতে আসে?

এইটাই দেখতে আসে। তারপর ধরেন, লাইটগুলা জ¦ালায়া দেয়। অনেক রঙের লাইট। দেখতে খুব সুন্দর লাগে।

অবন্তি ভাবলো, এরা কত অল্পেই খুশি হয়! গুন্টার গ্রাসের একটা বইয়ের কথা মনে পড়লো তার – শো ইওর টাং, জিভ কাটো লজ্জায়। গত শতকের আশির দশকের শুরুর দিকে ভদ্রলোক কলকাতায় এসে মাস তিনেক ছিলেন। তখনো নোবেল পুরস্কার পাননি, তবু বিশ^বিখ্যাত লেখক। কলকাতায় এসে বাসা নিলেন শহরের বাইরে, প্রতিদিন লোকাল ট্রেনের ভিড়ে যাতায়াত করার অভিজ্ঞতা নেবেন বলে। ঘুরে বেড়ালেন পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মাদ্রাজের নানা প্রান্ত। একবার ঢাকায় এসেও ঘুরে গেলেন। কিন্তু বেশির ভাগ সময় কাটালেন কলকাতায় এবং তার আশেপাশে। সেখানে মানুষের দুর্দশা, দুরবস্থা আর অমানবিক জীবন-যাপন দেখে তাঁর মনে হয়েছিল, পুরো ইউরোপের লজ্জায় জিভ কাটা উচিত। সেই সভ্যতার মূল্য কী, যেখানে পৃথিবীর অন্য প্রান্তের মানুষের জীবন এত বিভীষিকাপূর্ণ? মা কালীর সেই জিভ কাটা মূর্তি দেখে তাঁর মনে হয়েছিল, মানবতার এই বিপর্যয়ে লজ্জা পেয়েই তিনি জিভে কামড় দিয়ে আছেন। সংবেদনশীল লেখকের মন কেঁদে উঠেছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু পড়া শেষে অবন্তির মনে হয়েছিল, গুন্টার গ্রাস একটা ব্যাপার ধরতে পারেননি। নিজেকে প্রশ্ন করেননি, এত গ্লানি, এত বিপর্যয়, এত দুর্দশা নিয়েও মানুষ হাসে কীভাবে, প্রেম করে কীভাবে, উৎসব করে কীভাবে, জীবনকে উদযাপন করে কীভাবে? মানে, প্রাণের স্পন্দনটা তিনি খুঁজে পাননি। ঢাকাকে দেখেও তাঁর নিশ্চয়ই সে-কথাই মনে হয়েছিল! এমনকি, এখনো কোনো সংবেদনশীল বিদেশি মানুষ যদি এ-দেশে এসে কয়েক মাস থাকেন, তিনিও ভেবে পাবেন না, এখানে মানুষ বেঁচে আছে কী করে? মানুষের আনন্দ-সূত্র, বেঁচে থাকার সূত্র আর জীবনের ছন্দ যে কোথায় লুকানো থাকে, বোঝা সত্যিই কঠিন।

অবন্তি দেখলো, মতিন মনের আনন্দে হাতিরঝিলে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এখান থেকে বেরোচ্ছে না, অবন্তি অন্য কোথাও যেতে চায় কি না তাও জিজ্ঞেস করছে না। যেন সে নিজেই আজ বেড়াতে বেরিয়েছে। অবশ্য অবন্তিরও ভালো লাগছে। বৃষ্টি এখনো থামেনি। জলভরা বিলে বৃষ্টির অবিশ্রান্ত শব্দ শুনতে বেশ লাগছে।

অবন্তি মগ্ন হয়ে ভাবছিল ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। ঢাকার জীবন তো মন্দ ছিল না। জন্ম থেকেই তো সে এই শহরে, পঁচিশটি বছর একটানা থাকার পরও কখনো একঘেয়ে মনে হয়নি, কখনো ক্লন্তি আসেনি। তখন জীবনে আনন্দ ছিল, উত্তেজনা ছিল, অভিমান ছিল। দুঃখ-বেদনা-হাহাকারও ছিল, কিন্তু সেগুলো খুব বেশি দখল নিতে পারতো না। জীবন তখন সহজ ছিল, হয়তো সেজন্যই শহরটাকেও সহজই মনে হতো, আপন মনে হতো। এখন হয় না। অচেনা লাগে, নিজেকে বহিরাগত মনে হয়। মনে হয়, এই শহরে সে কোনোদিনও আসেনি! ‘রুটলেসনেস’ ভাবলো সে। শেকড়হীনতা। এখান থেকে যাওয়ার সময় সে শেকড় উপড়েই গিয়েছিল, তাই তো ফিরতে কুড়ি বছর সময় লাগলো। কতকিছু ঘটে গেছে এর মধ্যে, কত বদলে গেছে জীবন, কত মানুষ হারিয়ে গেছে, শহরটাই বা কেন বদলাবে না? শহরের চরিত্রই তো ক্রমাগত বদলে যাওয়া। এখানে ফিরে কি আর ভালো লাগবে তার? মানিয়ে নিতে পারবে? যদিও ফেরার কথা খুব বেশি ভাবছে না সে, তবু যদি সম্ভাবনা হিসেবেও সেটিকে দেখা হয়, আর ফিরে আসা কি সম্ভব? কীভাবে পারবে সে?

আপা এখন কই যাইবেন?

হঠাৎ মতিনের প্রশ্নে তার মগ্নতা কাটে, বলে, চলো একদিকে।

কোনদিকে যাবো?

ধানমন্ডি লেকের দিকে যাও। অনেকদিন যাইনি ওদিকে। 

জি আচ্ছা।

বৃষ্টি থেমে গেছে। রাস্তায় জমেছে জল। মতিন বেশ কায়দা করে গাড়ি চালাচ্ছে। ঢাকার এই ব্যাপারগুলো ইউনিক। যত ঝঞ্ঝাটই থাকুক, জীবন কখনো থেমে থাকে না এখানে।

ধানমন্ডিও বেশ বদলে গেছে, অনেক নতুন নতুন বিল্ডিং, সবই উঁচু উঁচু। ঢাকা এখন ওপরের দিকে বাড়ছে, পুরনো বাড়িগুলো ভেঙে নতুন করে বহুতল ভবন বানানো হচ্ছে, শহরজুড়ে আজদাহা সব ফ্লাইওভার, কোনো শ্রীছাঁদ নেই সেসবের, ছিমছাম ব্যাপারটা আর থাকছেই না। আচ্ছা, যারা এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা, তাদের মন খারাপ হয় না? এই যে বদলে যাচ্ছে পুরনো সবকিছু, হারিয়ে যাচ্ছে অনেক স্মৃতি, কষ্ট হয় না সেজন্য? অবশ্য মহানগরের বাসিন্দাদের সবকিছুর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়।

গাড়ি থেকে নেমে লেকের পাড় ধরে হাঁটছিল অবন্তি। এই জায়গাটা প্রায় একইরকম আছে। এখনো অনেক গাছ, অনেক ছায়া, অনেক সবুজ, অনেক মায়া। ‘কেন বৃক্ষরা এত সবুজ আর কেনই-বা সবুজ দেখলে আমাদের এত ভালো লাগে?’ – বিদ্যুচ্চমকের মতো মনে পড়লো এরকম এক পঙ্ক্তি। একজন অলৌকিক মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল অবন্তির, অনেকদিন আগে, এই শহরেই। গল্প লিখতেন তিনি, লিখতেন উপন্যাসও, কিন্তু তাঁর লেখার টেবিলে কখনো-কখনো পড়ে থাকতো এরকম বিচ্ছিন্ন, একাকী পঙ্ক্তি। ‘শেকড় নিয়েও কচুরিপানা কেন চিরকাল ভেসে বেড়ায়/ কেনই-বা তার ফুলের এত রূপমাধুর্য, এত মায়া?’ – এইরকম অদ্ভুত সব পঙ্ক্তি। এসব অবন্তির জানাই হতো না যদি না তাঁর বাসায় যাওয়ার সুযোগ ঘটতো। অদ্ভুত সুন্দর ছিল তাঁর কথা বলার স্টাইল, ছিল ভরাট কণ্ঠস্বর, শুনলে বুক কাঁপতো, আর দেখতেও ছিলেন দারুণ রূপবান। এমন দিব্যকান্তি পুরুষ সে জীবনে খুব একটা দেখেনি। কী করে যে কী হলো, সে এমন করে জড়িয়ে পড়লো, যে, শেষ পর্যন্ত সম্পর্কটা শরীর পর্যন্ত পৌঁছলো। তার জীবনের প্রথম শরীরী সম্পর্ক ছিল তাঁর সঙ্গেই। দ্বিধা-থরথর, ভয়-লজ্জা-সংকোচভরা সেই প্রথম মিলনের কথা ভাবলে এখনো শরীর কাঁপে তার। প্রথমটিতেই শেষ হয়নি অবশ্য, আরো বেশ কয়েকদিন মিলনের পর নিজে থেকেই সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল অবন্তি। তখন ঋভুর সঙ্গে তার প্রেম হয়-হয় ভাব, একটা অপরাধবোধও কাজ করছিল হয়তো, মনে হয়েছিল – এখান থেকে সরে না গেলে সে মহাবিপদে পড়বে। জীবনের সেই স্বল্পস্থায়ী পর্বটি সে সযত্নে মুছে দিতে চেয়েছে, চেয়েছে ভুলে যেতে। কেউ জানতো না তার সেই সম্পর্কের কথা, ঋভু-অংশু-জামিল তো নয়ই, তার কোনো মেয়েবন্ধুও নয়। এখনো জানে না। এমনকি নিজেকেও মনে করাতে ভয় হয় তার, সব এলোমেলো হয়ে যাবে বলে। আজ, এতদিন পর কেন যে তাঁকে মনে পড়লো ফের!

নাহ, বেশি ভাবা ঠিক হবে না। বরং লেকটা ভালো করে দেখে নেওয়া যাক। বিশেষ যত্ন নেওয়া হয়েছে লেকটার, বোঝাই যায়। নইলে ঢাকার আর সবকিছুই যখন ধ্বংসপ্রায়, এমনকি গুলশান লেকও দূষিত হয়ে উঠেছে, সেখানে কেবল এটাই বেঁচে যাবে কেন? তার ভালো লাগলো। থাকুক। কিছু অন্তত আগের মতো থাকুক। যেন বহুকাল পরে ফিরে এলেও মনে হয়, নিজের শহরে এলাম।

হাঁটতে হাঁটতে রবীন্দ্র সরোবরে এলো সে। বৃষ্টিভেজা দিন, মানুষজন তেমন নেই, তবু সে এলো দেখার জন্য। দেশ ছাড়ার আগে এখানে কত আড্ডা দিয়েছে সে, বন্ধুদের সঙ্গে। বৃষ্টিতে ভিজে আছে সব, বসার উপায় নেই, অথচ তার কিছুক্ষণ বসতে ইচ্ছে করছে। কী করা যায় ভাবছিল সে, তখনই বেজে উঠলো ফোন। ভুলেই গিয়েছিল ফোনের কথা। বাসায় রেখে আসতে চেয়েছিল, ভাবি অনুমতি দেয়নি। বলেছে, ‘নিয়ে যাও। বিপদ-আপদের কথা তো বলা যায় না, ফোনটা সঙ্গে রাখাই ভালো।’ আসার পর থেকেই সে দেখেছে, এই শহরে সবাই বিপদের ভয় পায়। শহর নাকি খুব অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। খুন-ধর্ষণ-অপহরণ-ছিনতাই-সড়ক দুর্ঘটনা নাকি নিত্যদিনের ঘটনা! তবু তো সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই চলছে। এত ভয় পাওয়ার কী হলো? যা হোক, ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখলো, ঋভু কল করেছে।

ধরবো? ভাবলো সে। নিশ্চয়ই অংশু জানিয়েছে ওকে, আজকে আড্ডা হবে না। সেজন্যই কি এই ফোন? ভাবতে ভাবতে ফোনটা থেমেই গেল। কলব্যাক করবে সে? সেটাই তো সৌজন্য, না? নাকি আজ আর কথাই বলবে না? অভিমানটা থাকুক না আরো কিছুক্ষণ। আসলেই অভিমান? তার ভেতরে এই অনুভূতি কি সত্যিই অবশিষ্ট আছে? এসব ভাবতে ভাবতেই আবার বেজে উঠলো ফোন। ঋভু! বাহ, আবার ফোন করেছে ও! কী সুন্দর ব্যাপার! ফর্মাল হলে নিশ্চয়ই দ্বিতীয়বার ফোন করতো না। প্রথমবার ফোন রিসিভ না হলে তো ধরেই নেওয়া হয়, ওপাশের মানুষটা ব্যস্ত আছে! ঋভু ওরকম কিছু ভাবছে না দেখে ভালো লাগলো তার। নিজের চিন্তায় নিজেই অবাক হচ্ছে অবন্তি। তারও তো অল্পতেই ভালো লাগতে শুরু করেছে! এই শহরের বাতাস লাগলো নাকি গায়ে?

এবার ফোনটা রিসিভ করলো সে, ওপাশ থেকে ঋভু বললো, কেমন আছো?

এই তো, আছি।

কোথায় তুমি, বাইরে নাকি?

হ্যাঁ। তুমি বুঝলে কী করে?

বাইরের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।

ও!

কী করছো?

ঘুরে বেড়াই।

বাহ! একাই বেরিয়েছ?

হ্যাঁ। সঙ্গী পাবো কোথায়?

আমাকে বললেই পারতে!

বললেই তুমি আসতে?

অবশ্যই।

সত্যি?

হ্যাঁ সত্যি।

আচ্ছা! এখন আসতে বলছি।

তুমি কোথায় আছো বলো, আসছি।

সত্যি আসবে?

আগে বলো কোথায় আছো!

ধানমন্ডি। রবীন্দ্র সরোবরে।

থাকো। আমি আসছি।

এই শোনো শোনো …

এসে শুনবো। দশ মিনিট অপেক্ষা করো।

লাইন কেটে গেল। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো অবন্তি। এটা কী হলো? হঠাৎ করেই ঋভুর ফোন, দশ মিনিটের মধ্যে আসছি বলে ফোন কেটে দেওয়া, এত তাড়াতাড়ি ও আসবে কোত্থেকে? ওর বাসা তো বেশ দূরে, নাকি আশেপাশেই কোথাও আছে? আমি যে এখানে তা কি ও জানতো? না, জানা সম্ভব নয়। মতিন ছাড়া আর কেউ জানে না, কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। ঋভু নিশ্চয়ই মতিনকে ফোন করে জানতে চায়নি!

দশ মিনিট পার হবার আগেই চলে এলো ঋভু। হাসছে।

কোত্থেকে এলে তুমি? এরকম ঝড়ের বেগে?

অবাক হয়েছ?

তা তো হয়েছিই। কথা নেই বার্তা নেই, হঠাৎ ফোন, তারপর সশরীরে হাজির! ব্যাপার কী?

বিশেষ কিছু না। মনে হলো তোমার একটু খবর নিই। তুমি যে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছ তা তো জানতাম না, ভেবেছিলাম বাসায়ই বসে আছো।

তা তো বুঝলাম, এত তাড়াতাড়ি এলে কীভাবে?

এটা কাকতালীয়। একটা কাজে এসেছিলাম ধানমন্ডি। ফিরে যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠে তোমাকে ফোন করলাম, তুমি বললে এখানে আছো, চলে এলাম।

হুম। খুব করিৎকর্মা। এখন আবার ফিরে যাবে?

কোথায়?

অফিসে?

আরে নাহ। তোমাকে রেখে অফিসে যাবো কেন?

এটা কোনো দায়িত্ববান চাকরিজীবীর মতো কথা হলো না।

আমার আবার চাকরি!

মানে?

মানে হলো, আজ আছে কাল নেই।

এর মানে কী?

এত মানে বোঝার দরকার কী? চাকরি করছি সময় কাটানোর জন্য। যেদিন ভালো লাগবে না সেদিন ছেড়ে দেবো।

ও!

ও মানে কী?

কত সহজেই ছেড়ে দেওয়ার কথা বললে!

হ্যাঁ, সহজে বললাম, কারণ ছাড়লেও আমার কোনো সমস্যা হবে না। আমার ধারণা সব চাকরিজীবীই চাকরি ছাড়তে চায়, কিন্তু পারে না। বিপদে পড়বে বলে।

সেটাই ভাবছিলাম।

বাদ দাও। এখন কোথায় যাবে?

কিছু ঠিক করিনি তো! আবোলতাবোল ঘুরে বেড়াচ্ছি।

লাঞ্চ করোনি নিশ্চয়ই!

না। দেরি করে ব্রেকফাস্ট করেছি তো।

খিদে পায়নি?

তা একটু পেয়েছে।

আমিও খাইনি এখনো। চলো লাঞ্চ করি।

কোথায় যাবে? বাসায়?

না, বাইরে কোথাও করি।

ঠিক আছে চলো।

কোথায় যেতে চাও বলো, নিয়ে যাই।

যেখানে যেতে চাইবো সেখানেই নিয়ে যাবে?

হ্যাঁ, অবশ্যই।

যদি তোমার বাসায় যেতে চাই?

সানন্দে নিয়ে যাবো। যাবে?

না। এখন না গেলাম। বাইরেই কোথাও খেয়ে নিই। অফিসে যেহেতু যাচ্ছো না, একসঙ্গে একটু ঘুরি।

উত্তম প্রস্তাব। ড্রাইভারকে ছেড়ে দাও। আমি পৌঁছে দেবো।

না। আমাকে ছাড়া মতিন বাসায় গেলে ভাবি অস্থির হয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করবে। বারবার ফোন করবে। তার  চেয়ে তুমি গাড়ি ছেড়ে দাও।

ঠিক আছে, তাই করি। কিন্তু যাবে কোনদিকে?

তুমি বলো।

পুরান ঢাকার দিকে যাবে? আমাদের পুরনো দিনে?

পুরনো দিনে? ফেরা যাবে ওখানে?

দেখিই না, যায় কি না!

তারা দোয়েল চত্বরের কাছে গাড়ি রেখে শহীদুল্লাহ হলের সামনে দিয়ে হেঁটে চানখাঁরপুল পার হয়ে পুরান ঢাকায় ঢুকলো। তারপর অলিগলিতে ঘুরলো কিছুক্ষণ। অবন্তির মনে হলো, এই এলাকাটাও খুব একটা বদলায়নি। সেই সরু গলি, দোকানপাট, লোকজনের হই-হল্লা, প্রাণের এক দারুণ উচ্ছ্বাস যেন বয়ে চলেছে এখানে। আগের মতোই। মানুষজনও খুব একটা বদলায়নি। একইভাবে কথা বলছে, হাহা করে হাসছে, খিস্তিখেউর করছে, প্রচুর খাচ্ছে। যেন কেবল যাপনই নয়, জীবনকে ভীষণভাবে উদযাপন করে নিচ্ছে সবাই। হয়তো এই উৎসবের ভেতরেই চোরাস্রোতের মতো বইছে দুঃখের নদী, খালি চোখে তা দেখা যাচ্ছে না; মানুষ তো দুঃখী প্রাণীই, দেখা না গেলেও দুঃখ থাকেই, তবু অবন্তির ভালো লাগছিল।

একটা পুরনো রেস্টুরেন্টে বসে খেলো তারা। মিতালী, সোহাগ, নীরব – এইসব রেস্টুরেন্ট এখনো আছে দেখে ভারি আনন্দ হলো অবন্তির। তার কেন যেন ধারণা হয়েছিল, কিছুই আর আগের মতো নেই, সব শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু কুড়ি বছর খুব বেশি সময় নয়, সবকিছু হারায় না, সবকিছু বদলায়ও না, আসলে বদলেছে তার নিজের জীবন এবং জগৎ সম্বন্ধে তার বোঝাপড়া, সেটা সে এখন যেন উপলব্ধি করতে শুরু করেছে। এইসব রেস্টুরেন্টে তারা দুপুরে এসে খেতো মাঝেমধ্যে, সবারই খুব প্রিয় ছিল এদের খাবারগুলো। আগের চেয়ে বড়সড় আর সুদৃশ্য হয়েছে রেস্টুরেন্টগুলো, তবু কুড়ি রকমের ভর্তা, ভাজি, আর বিবিধ পদের খাবার খেয়ে মনে হলো, না, সব বদলায়নি, খাবারের স্বাদও একইরকম রয়ে গেছে। তৃপ্তি করে খেলো অবন্তি, ঋভু যতটা না খেলো তারচেয়ে বেশি দেখলো অবন্তিকে। এমনভাবে খাচ্ছে মেয়েটা যেন অনেকদিন কিছু খায়নি। খাওয়া শেষ করে কথাটা বললোও অবন্তি – জানো, গত বিশ বছরে এত তৃপ্তি করে খাইনি কখনো। আজকে আমি তিনদিনের খাবার এক বেলায় খেয়ে ফেলেছি। রাক্ষসের মতো খেয়েছি। কেন এত স্বাদ লাগলো বলো তো!

আজ তোমার মন ভালো, তাই।

চকিতে একবার ঋভুর চোখের দিকে তাকালো অবন্তি, বললো, ভুল বললে। আজকে সকাল থেকে আমার মন খারাপ।

খারাপ ছিল, এখন নেই।

কেন মনে হলো এ-কথা?

একা একা ঘুরতে বেরিয়েছ, বোঝাই যাচ্ছে, তোমার মন ভালো ছিল না। কিন্তু এখানে এসে বিষণ্নতা কেটে গেছে তোমার।

থ্যাংক ইউ।

কী কারণে পেলাম?

পুরান ঢাকায় নিয়ে এসেছ বলে। সত্যিই আমার মন ভালো হয়ে গেছে।

আসলে অবন্তির মন খারাপ ভাবটা কেটে গেছে ঋভুর সঙ্গে দেখা হওয়ার পরপরই। কিন্তু সে-কথা বললো না সে। নিশ্চয়ই ঋভুও তা বুঝতে পেরেছে, সে-ও তো কিছু বলেনি!

ঋভু বললো, আরো কিছুক্ষণ বসবে এখানে? নাকি বেরোবে?

চলো বেরোই। এখন হাঁটতে পারবো না। রিকশা নাও।

যাবে কোথায়?

বুড়িগঙ্গায় যাওয়া যায় না?

না যাওয়াই ভালো।

কেন?

মন খারাপ হয়ে যাবে তোমার।

কিন্তু কেন?

বুড়িগঙ্গার অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। পানি এত দূষিত যে দুর্গন্ধে টেকা যায় না।

আহারে! নদীটাকে মেরেই ফেললো!

হ্যাঁ।

থাক, তাহলে এমনিই একটু ঘুরি।

আচ্ছা।

আবারো বেরোলো তারা, রিকশায় ঘুরে বেড়ালো অলিগলি, দেখলো মানুষ, জীবন, জীবনের উচ্ছ্বাস। বিকেল হয়ে এলে অবন্তি বললো, একটা জায়গায় যেতে চাই, নিয়ে যাবে?

নিশ্চয়ই। কোথায় যেতে চাও বলো।

আসলে একটা নয়, যেতে চাই দুটো জায়গায়। একটার ব্যাপারে নিশ্চিত, অন্যটার ব্যাপারে বুঝতে পারছি না।

অন্যটাই আগে বলো।

এমন একটা জায়গায় যেতে চাই যেখানে গেলে মনে হবে, সব আগের মতো আছে। আমার ফেলে যাওয়া শহরকে খুঁজে পাওয়া যাবে সেখানে।

এই যে পুরান ঢাকায় ঘুরে বেড়ালে, মনে হয়নি যে সব আগের মতোই আছে?

হ্যাঁ, হয়েছে। কিন্তু এখানে আমার স্মৃতি কম, খুব বেশি তো আসা হতো না। কিন্তু এখানে এসেই মনে হলো, আমার অনেক স্মৃতি আছে এরকম কোনো জায়গা কি এখনো আগের মতো আছে? থাকলে একটু দেখে আসতাম।

নিজেকে ফিরে দেখতে চাও!

শুধু নিজেকে না। তুমি তো অনেক দেশে ঘুরেছ, নিশ্চয়ই দেখেছ, প্রতিটি শহরে কিছু জায়গা আগের মতোই রেখে দেওয়া হয়। শহর তো বদলাবেই, এ নিয়ে আফসোস করে লাভ নেই। কিন্তু শহরের পুরনো রূপের কিছু চিহ্ন রেখে দেওয়া দরকার যেন বয়স্করা তাদের স্মৃতিকে খুঁজে পেতে পারে, যেন পরের প্রজন্মকে দেখাতে পারে – এই যে আমাদের সময়ের শহর, দেখ কত সুন্দর ছিল, কত মায়াময় ছিল!

হুম, বুঝলাম। যাবে সেরকম জায়গায়?

আছে? সেরকম জায়গা আছে এখনো?

নিশ্চয়ই আছে।

সত্যি বলছো?

হ্যাঁ, সত্যি বলছি। যাবে?

না, এখন যাবো না। সময় নিয়ে যেতে হবে।

তাহলে কোথায় যেতে চাও এখন? 

অংশুর বাসায়।

হঠাৎ ওর বাসায়?

ওর সংসারটা দেখতে ইচ্ছে করছে। আমার তো সংসার হয়নি। সুখী দম্পতির সংসার কেমন হয় দেখার খুব সাধ।

আচ্ছা চলো।

অংশুকে ফোন করো।

কেন? ওকে ফোন করবো কেন?

বারে! ওর বাসায় যাবে, জানাবে না?

ওকে জানিয়ে যেতে হবে নাকি?

আহা, বাসায় তো নাও থাকতে পারে।

না থাকলে থাকবে না। আমরা তো আর ওর কাছে যাচ্ছি না। অপলা থাকলেই হবে।

তাহলে অপলাকেই ফোন করো। বাসায় আছে কি না জেনে নাও।

আরে চলো তো! না থাকলে চলে আসবো। এত ভাবাভাবির কী আছে?

এভাবে কারো বাসায় যাওয়া যায়?

তুমি খুব ফর্মাল হয়ে গেছ সুসান। সবার বাসায় যাওয়া যায় না, কারো কারো বাসায় না বলেই যাওয়া যায়। আমরা দেশসেরা আর্কিটেক্ট জহির আমিনের বাসায় যাচ্ছি না, যাচ্ছি অংশুর বাসায়। আমাদের বন্ধু অংশু। বুঝলে?

হুম বুঝলাম। বিখ্যাত আর্কিটেক্ট জহির আমিন আর পাজি দ্য গ্রেট অংশুকে আলাদা করে দেখতে হবে।

একদম ঠিক ধরেছ।

আচ্ছা ঠিক আছে চলো এবার। (চলবে)