রায়পুরা থেকে ময়মনসিংহ

পঁয়ত্রিশ

আমরা বন্ধুরা মিলে যে শুধু বাংলাদেশ ঘুরেছি তা নয়। আমাদের বন্ধুত্বের ২৫ বছরে আমরা ভারত, নেপাল, ভুটান ছাড়াও মালয়েশিয়া এবং থাইল্যান্ড গিয়েছি। একবার নার্গিস এবং তার স্বামী নুরুল ইসলাম মোল্লা দিল্লি যাওয়ার সময় আমাকে এবং জরিফাকেও তাদের ভ্রমণসঙ্গী করে। দিল্লি থেকে আমরা হায়দারাবাদ এবং ব্যাঙ্গালোরও গিয়েছি। মুসি নদীর তীরে অবস্থিত হায়দারাবাদ শহরটি নানা কারণে পর্যটকদের পছন্দের। রসনাতৃপ্তির জন্য শুধু জগদ্বিখ্যাত হায়দারাবাদি বিরিয়ানি নয়, চোখে দেখার মতোও অনেক কিছু আছে হায়দারাবাদে। পৃথিবীর অন্যতম বড় ফিল্ম সিটি হিসেবে পরিচিত রামোজি ফিল্মসিটি হায়দারাবাদ শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি একটি দেখার মতো জায়গা। চলচ্চিত্রের দৃশ্যধারণের জন্য সব রকমের ব্যবস্থা রামোজিতে রয়েছে। নির্মাতারা শুটিংস্পট হিসেবে এটা পছন্দ করেন।

হায়দারাবাদে দেখার মতো আরেকটি জায়গা নিজাম প্যালেস। এই প্যালেসে কত কিছু যে সংরক্ষিত আছে। এমনকি বাঙালি শিল্পী হেমেন্দ্রনাথ মজুমদারের আঁকা স্নানরত নারীর ছবিও সেখানে যত্নের সঙ্গে সংরক্ষিত আছে।

হেমেন মজুমদারের জন্ম কিশোরগঞ্জ জেলায়। তিনি অজয় রায়ের দূর সম্পর্কের আত্মীয় হওয়ায় তাঁর বিষয়ে আমি আগে থেকেই জানি। ১৮৯৪ সালে কিশোরগঞ্জে তাঁর জন্ম হলেও তিনি পড়াশোনার জন্য অল্প বয়সেই কলকাতা চলে গিয়েছিলেন। কলকাতা গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফটের ছাত্র ছিলেন। সিক্তবসনা নারীর ছবি আঁকায় তাঁর খ্যাতি ছিল। এমন একটি ছবি কলকাতায় গৌরী মাসির ঘরে ক্যালেন্ডারে দেখে আমি ছবিটি কার আঁকা জানতে চাইলে মাসি আমাকে বলেন শিল্পী হেমেন মজুমদার সম্পর্কে। মাসির কাছ থেকে আমি ওই ছবিটি চেয়ে এনেছিলাম। আমার কাছ থেকে সেটা নিয়েছে আমার ভাই, যে কানাডায় থাকে এবং শিল্পী। হেমেন রায়ের ছবি নকল করে অমন ছবি এঁকে সে কানাডায় ভালো উপার্জনও করেছে। হেমেন মজুমদার সম্পর্কে আরো জেনেছি তাঁর আরেক আত্মীয় প্রসূন মজুমদারের কাছ থেকে। হেমেন মজুমদার ছবি আঁকার জন্য বেশির ভাগ সময় মডেল হিসেবে ব্যবহার করতেন নিজের স্ত্রীকে। স্বামীর প্রতি গভীর ভালোবাসার কারণে তিনি এতে সম্মত হতেন। এমন উদারতাও খুব বেশি বাঙালি নারীর মধ্যে দেখা যায় না। ছবি এঁকে হেমেন মজুমদার অনেক পুরস্কারও পেয়েছেন। পাঞ্জাবের পাতিয়ালা রাজ্যের রাজশিল্পী হিসেবেও তিনি কয়েক বছর কাজ করেছেন। কাশ্মিরের মহারাজাও হেমেন মজুমদারকে কাশ্মিরে থেকে ছবি আঁকার অনুরোধ করেছিলেন। হায়দারাবাদের নিজাম প্যালেসে তাঁর আঁকা ছবি দেখে আমি খুবই শিহরিত হয়েছিলাম। বাংলাদেশের কজন আজ এই শিল্পীর নাম জানেন।

সাবেক ভারতীয় ক্রিকেটার মোহাম্মদ আজাহারউদ্দিনের জন্মও হায়দারাবাদে। মার্জিত ব্যাটসম্যান হিসেবে খ্যাত আজাহার ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়কও ছিলেন। পরে তিনি রাজনীতিতেও যোগ দিয়েছিলেন। তিনি মুম্বাই চলচ্চিত্রের অভিনেত্রী ও মডেল সঙ্গীতা বিজলানিকে বিয়ে করেছিলেন। আমরা আজাহারউদ্দিনের বাড়িও দেখেছি।

হায়দারাবাদ থেকে আমরা যাই মহীশূর প্যালেস দেখতে। মহীশূরকে বলা হয় ‘সিটি অফ প্যালেস’। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রাসাদ হলো মহীশূর প্যালেস। তাজমহলের পর বেশি দর্শনার্থী ভিড় করেন মহীশূর প্যালেস দেখতে। এই প্যালেসের নির্মাণশৈলীও সবাইকে মুগ্ধ ও আকৃষ্ট করে। প্রাসাদের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে বিস্ময়কর এবং দৃষ্টিনন্দন সব শিল্পকর্ম। সোর্ড অফ টিপু সুলতান নামে ধারাবাহিক টেলি-সিরিয়ালটি  যাঁরা দেখেছেন তাঁরা মহীশূর প্যালেসের সদর-অন্দর দেখার সুযোগ পেয়েছেন।

মহীশূর প্যালেস দেখার পর আমরা বৃন্দাবন গার্ডেনে গিয়ে ফুলের অপূর্ব সমারোহ দেখে মুগ্ধ হয়েছি। অনেক হিন্দি ছবিতে এই বাগানের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখা যায়। সেখানে প্রকৃতির অপরূপ সাজ দেখে চোখ জুড়িয়ে তারপর গিয়েছি বিখ্যাত কাবেরী নদী দেখতে। এটাও প্রকৃতিরই আরেক অনবদ্য সৃষ্টি। কাবেরী নদীর স্বচ্ছ জল দেখার মতো। এই জল ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সেচকাজে ব্যবহৃত হয়ে কৃষিকে পুষ্ট করেছে। আবার কাবেরীর জল বণ্টন নিয়ে কর্ণাটক ও তামিলনাড়ু রাজ্যের মধ্যে বিরোধও দীর্ঘদিনের। তবে কাবেরীর কাছে গিয়ে আমার কানে কেবলই বেজেছে কাজী নজরুল ইসলামের বহুশ্রুত সেই গানের কথা :

কাবেরী নদী জলে কে গো বালিকা

আনমনে ভাসাও চম্পা-শেফালিকা।

প্রভাত সিনানে আসি আলসে

কঙ্কন-তাল হানো কলসে

খেলে সমীরণ, ল’য়ে কবরীর মালিকা।

একবার আমরা নারীবন্ধুরা ভূস্বর্গ বলে পরিচিত কাশ্মিরেও গিয়েছি। কাশ্মিরে আমরা দশদিন ছিলাম। বিশ্বের সৌন্দর্যপিয়াসী দর্শনার্থীরা ভিড় করেন এখানে। কাশ্মিরের রাজধানী শ্রীনগর থেকে শুরু করে পুরো কাশ্মির জুড়ে রয়েছে দেখার মতো অনেক জায়গা। শ্রীনগর শহরেই আছে ডাল লেক, নাগিন লেক, বোটানিক্যাল গার্ডেন, ইন্দিরা গান্ধী টিউলিপ গার্ডেন, শালিমার বাগ, হযরত বাল দরগাহ, শংকরাচার্য হিলসহ আরো কিছু দর্শনীয় স্থান। শ্রীনগর থেকে আমরা গিয়েছি পাহেলগাম বা পাহেলগাঁও। শ্রীনগর থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে চোখ-ধাঁধানো সৌন্দর্যের নদী-উপত্যকা শোভিত পাহেলগাঁও এমন একটি জায়গা যা দেখে সাধ মেটে না। পাহেলগাঁওকে বলা হয় কাশ্মিরের ‘বিউটি স্পট’। এশিয়ার সুইজারল্যান্ড বলেও পাহেলগাঁওকে উল্লেখ করা হয়। রাস্তার দুপাশে আপেলের বাগান। এখানে প্রচুর জাফরান চাষ হয়। খাবারের রং, ঘ্রাণ ও স্বাদ বাড়াতে জাফরানের ভূমিকা অদ্বিতীয়। কাজুবাদাম, আখরোট, কিশমিশ এবং নানা ধরনের মসলাও পাওয়া যায় এখানে। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে পাথরের ওপর গড়িয়ে পড়া বরফগলা জল দেখতে কার না ভালো লাগে। আমাদেরও লেগেছে।

পাহেলগাঁও থেকে আমরা অমরনাথ মন্দিরেও গিয়েছি। শ্রীনগর থেকে ১৪১ কিলোমিটার দূরে অমরনাথ গুহা অবস্থিত। এটি সমতল থেকে ১২ হাজারের বেশি উঁচু জায়গা। গুহাটি বছরের বেশিরভাগ সময় তুষারে ঢাকা থাকে। গ্রীষ্মকালে খুব অল্পসময়ের জন্য এই গুহার দ্বার প্রবেশের উপযোগী হয়। তখন লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রী অমরনাথ যান পুণ্যলাভের আশায়। অমরনাথের গুহাতে চুঁইয়ে পড়া জল জমে শিবলিঙ্গের আকার ধারণ করে। কখনো কখনো আট ফুট উঁচুও হয় এই শিবলিঙ্গ। অমরনাথ যাত্রার মূল উদ্দেশ্য এই শিবলিঙ্গে পূজা দেওয়া। তবে অন্য ধর্মের মানুষও শুধু দেখার জন্য অমরনাথ যান।

আমরা বন্ধুরা মালয়েশিয়া এবং থাইল্যান্ডেও ঘুরে এসেছি। মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুর ছাড়াও আমরা লংকাওয়ে দ্বীপেও গিয়েছি। আর ব্যাংকক, পাতায়া এবং পুকেতে আমরা ঘুরেছি। এই সব জায়গাই পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। ফুকেট তো বিনোদনের সব পসরা সাজিয়ে পর্যটকদের আহ্বান জানায়। সুন্দর সমুদ্রসৈকত, স্বচ্ছ জলরাশি, মনোরম পরিবেশ – সব মিলিয়ে যেন এক স্বপ্নপুরী।

ভুটান এবং নেপালেও আমরা খুবই আনন্দের সময় কাটিয়েছি। দুটি দেশই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পাহাড়ি পথঘাট। সব জায়গায়ই পাহাড়ি মেয়েদের অনেক পরিশ্রমী মনে হয়েছে। তারা ঘরের কাজ এবং বাইরের কাজ সমানতালে করে। নেপালের কাঠমান্ডু ছাড়াও ভক্তপুর এবং পোখরা গিয়েছি আমরা। ভক্তপুরে আছে একাধিক হিন্দু এবং বৌদ্ধ মন্দির। আর পোখরার বৃহত্তম প্রাকৃতিক লেক সবারই মনোযোগ আকর্ষণ করে।

আমাদের বন্ধু গ্রুপের মধ্যে নার্গিসের কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করতে হয়েছিল। ভারতের চেন্নাই অ্যাপোলো হাসপাতালে তিন মাস থেকে নার্গিস তার কিডনি বদল করে এসেছিল। চার-পাঁচ মাস পরপর ওকে চেকআপের জন্য চেন্নাই যেতে হতো। ওর স্বামী নুরুল ইসলাম মোল্লা সব সময় সঙ্গে যেতে পারতেন না। তাই আমাকে কয়েকবার তার সঙ্গে যেতে হয়েছে। আমাদের সম্পর্কটা ছিল পরস্পর আস্থা-বিশ্বাস এবং নির্ভরতার। আমাকে বউদি বলে ডাকতো। নিজের অন্য আত্মীয়দের সঙ্গে যেতে ভরসা না পেলেও আমার ওপর তার ভরসা ছিল ষোলো আনা।

একবার ওর চেন্নাই যাওয়ার সময় আমাকে সঙ্গে যেতে বললে আমি একটু গররাজি ছিলাম। কারণ অজয় রায়ের শরীরটাও তখন খুব ভালো যাচ্ছিল না। জ্বরে ভুগছিলেন। মোল্লা সাহেব অজয় রায়কে দেখতে এসে বিষয়টি উল্লেখ করতেই অজয় রায় বলেন, জয়ন্তী অবশ্যই নার্গিসের সঙ্গে যাবে। জ্বর তো কোনো বড় অসুখ নয়। সেরে যাবে। আমাকে দেখার মতো লোকজন আছে।

ব্যস, আমরা দুই বন্ধু চেন্নাই গেলাম। ডাক্তার দেখানোর পর বড় কোনো সমস্যা না থাকায় নার্গিস বললো, বউদি, শরীরটা তো ভালোই লাগছে, চলো আমরা একটু পন্ডিচেরি ঘুরে আসি। চেন্নাই থেকে গাড়িতে পন্ডিচেরি যেতে ঘণ্টা চারেকের একটু বেশি সময় লাগে। আমরা ভোর পাঁচটায় রওনা দিয়ে পন্ডিচেরি ঘুরে আবার রাত এগারোটার দিকে চেন্নাই ফিরে আসি। পন্ডিচেরিতে আমরা ঋষি অরবিন্দের আশ্রম দেখেছি। সমুদ্রের পাড়ে অধ্যাত্মসাধনার এই আশ্রমটি বেশ সুন্দর। ঋষি অরবিন্দ জীবনের শুরুতে স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হলেও পরে পন্ডিচেরি গিয়ে স্থায়ী হন এবং এক বিদেশি নারীর সঙ্গে পরিচিত হয়ে ধ্যান ও আধ্যাত্মিকতার লক্ষ্যে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন ১৯২৬ সালে। ওই বিদেশি নারী শ্রীমা নামেই খ্যাত। পন্ডিচেরি থেকে ফেরার পথে রাজীব গান্ধীকে যেখানে হত্যা করা হয়েছিল সেই শ্রীপেরামবুদুরও আমরা দেখে এসেছি।

নার্গিস পরদিন আবার কন্যাকুমারী যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলো। আমি একটু গাইগুঁই করলেও নার্গিসের চাপাচাপিতে শেষ পর্যন্ত সম্মত হই। চেন্নাই থেকে আরামদায়ক ট্রেন আছে কন্যাকুমারী যাওয়া-আসার। ট্রেনের নামও কন্যাকুমারী এক্সপ্রেস। সন্ধ্যায় যাত্রা করে সকালে গিয়ে পৌঁছে আবার সন্ধ্যায় ফেরা যায়। কন্যাকুমারীও একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। এই শহরের সৈকতে আরব সাগর, ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগর পরস্পর মিলিত হয়েছে। এখানে দেবী কুমারীর মন্দির অবস্থিত।

কন্যাকুমারীতেই আছে বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়াল। এটি হিন্দুদের একটি পবিত্র স্মারকস্থল এবং পর্যটনকেন্দ্র। ১৮৯২ সালের ডিসেম্বরে স্বামী বিবেকানন্দ এখানে এসে এই শিলাখণ্ডের ওপর বসে দীর্ঘক্ষণ ধ্যান করেছিলেন। তাঁরই স্মৃতিতে ১৯৭০ সালে বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়াল কমিটি এখানে একটি স্মারকস্থল নির্মাণ করে। চারদিকে সমুদ্রঘেরা কন্যাকুমারীও একটি স্বপ্নের শহর। স্টিমারে করেও আমরা কিছুক্ষণ ঘুরেছি, সমুদ্রের হাওয়া খেয়েছি।

নার্গিস চেন্নাই থেকে ওষুধপথ্য কিনে দেশে ফিরে আসে বেশ খুশি মনেই; কিন্তু অল্প কিছুদিন পর তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে জরুরিভাবে ভর্তি করা হয়। একদিন মধ্যরাতে আমার মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। ঘুমচোখে ফোন কানে লাগিয়ে শুনতে পাই আর্তচিৎকার – ‘বউদি গো আমাকে তুমি এখান থেকে নিয়ে যাও।’ একই বাক্য কয়েকবার উচ্চারিত হলো। আমার বুঝতে কষ্ট হলো না যে, নার্গিস হাসপাতাল থেকে ওই ফোন করেছে। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে অ্যাপোলোতে ছুটলাম। নুরুল ইসলাম মোল্লা স্ত্রীর শয্যাপাশে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন। আমাকে দেখে নার্গিসের দু-চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকায় এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে নার্গিসকে চেন্নাই নেওয়া হয়। কিন্তু চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে নার্গিস আমার জন্য স্মৃতির বেদনাভার রেখে চিরবিদায় নিল। এটা ২০১৪ সালের ঘটনা। প্রায় চল্লিশ বছরের সখ্য আমাদের। কত আনন্দময় ছিল আমাদের বন্ধুসংঘ। নার্গিসের কথা মনে হলে এখনো আমার চোখ ছলছল হয়। নুরুল ইসলাম মোল্ল­ার সঙ্গে যোগাযোগ আছে। স্ত্রীকে হারিয়ে তিনিও কাটাচ্ছেন নিঃসঙ্গ বিষণ্ন সময়। আমিও হারিয়েছি অজয় রায়কে। জীবন বুঝি এমনই। কেবলই ছন্দপতন হয়।

আটত্রিশ

২৫শে জানুয়ারি ২০২১ তারিখে সন্ধ্যায় টেলিভিশনের খবর দেখতে গিয়ে একটি খবর শুনে খুবই উৎফুল্ল বোধ করি। মনটা ভালো হয়ে যায় এমন একটি ভালো খবর শুনে। আমাদের শ্রদ্ধেয় এবং প্রিয় সন্জীদা আপা – অধ্যাপক ড. সন্জীদা খাতুন – ভারতের মর্যাদাপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘পদ্মশ্রী’ পদকে ভূষিত হয়েছেন। এ সম্মান তাঁর প্রাপ্য। জ্ঞান সাধনায় যিনি জীবনভর নিবেদিত তাঁর যে-কোনো সম্মানপ্রাপ্তিতে তাঁর স্নেহধন্য-প্রীতিধন্য সবাই প্রীত ও আপ্লুত না হয়ে পারে না। আমিও হয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে তাঁর নীরোগ দীর্ঘায়ু কামনা করেছি।

সন্জীদা খাতুনের মতো একজন বড়মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি, তাঁর ভালোবাসা পেয়েছি – এটা আমার মতো মানুষের জন্য অনেক বড় পাওয়া। তিনি আমাকে যে কাছে টেনেছেন এতে আমি নিজেকে অনেক ভাগ্যবতী মনে করি। কবে, কিভাবে প্রথম তাঁর সঙ্গে সরাসরি পরিচয়ের সুযোগ ঘটে তা এখন মনে নেই। তবে অজয় রায়ের মাধ্যমেই যে প্রাথমিক পরিচয় হয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সন্জীদা খাতুনের নাম শুনেছি অনেক আগেই। তবে সাক্ষাৎ-পরিচয় হয়েছে পরে। তাঁর প্রতি যেমন সম্মান-সমীহের ভাব ছিল, তেমনি তাঁর ব্যক্তিত্বের কারণে এক ধরনের ভয়ও ছিল। এমন গুণী মানুষের কাছাকাছি গিয়ে কথা বলতেও এক ধরনের সংকোচ হতো। কিন্তু দূরত্বটা তিনিই দূর করেছিলেন আমাকে তাঁর স্নেহের বাঁধনে বেঁধে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তাঁর বাসায় একসময় পাঠচক্র হতো। মাসে দুদিন। সকাল দশটা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত সেই পাঠচক্রে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হতো। অবশ্যই রবীন্দ্রসাহিত্য ছিল আলোচনার প্রধান বিষয়। আলোচনা শেষে হতো সমবেত সংগীত। শ্রোতা-আলোচক হিসেবে যাঁরা উপস্থিত থাকতেন তাঁরাও সবাই খ্যাতিমান। ড. আনিসুজ্জামান স্যারেরও ওই পাঠচক্রে নিয়মিত উপস্থিতি ছিল। আমার পরম সৌভাগ্য যে, আপা আমার মতো একজনকে ওই পাঠচক্রে উপস্থিত থাকার সুযোগ দিয়েছিলেন। মুগ্ধ হয়ে আপার আলোচনা শুনতাম। বিষয়ের গভীরে গিয়ে এমন চমৎকার করে বলতেন যা এখনো কানে বাজে। স্পষ্ট উচ্চারণ এবং সুচিন্তিত শব্দ চয়নের কারণে তাঁর আলোচনা হৃদয় ছুঁয়ে যেত।

২০০৪ সালে আমি চাকরি থেকে অবসর নিই। তখন ধানমণ্ডিতে ছায়ানট ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। নানাজনের কাছ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা নিয়েই ওই কাজ চলছিল। আমি একদিন অজয় রায়কে সঙ্গে নিয়ে আপার বাসায় গিয়ে তাঁর হাতে সামান্য কিছু টাকা তুলে দিয়েছিলাম। তাঁর সামনে গেলে কেন যেন জড়োসড়ো হয়ে পড়তাম। সেদিনও সেভাবেই টাকার খামটা তাঁর হাতে দিয়ে বলেছিলাম, আমি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি। তাই ছায়ানটের জন্য অতি সামান্য উপহার।

আপা হাসিমুখে সেটা গ্রহণ করে বললেন, বিন্দু দিয়েই তো সিন্ধু হয়। চা-নাস্তা না খেয়ে আপা আমাদের আসতে দেননি। এটা তাঁর একটা অভ্যাস। বাসায় কেউ গেলে তাকে খালি মুখে ফিরতে দেন না। সন্জীদা আপা খুবই পরিচ্ছন্ন এবং রুচিশীল মানুষ। আমি আমার গৌরী (আইয়ুব) মাসির সঙ্গে সন্জীদা আপার অনেক মিল খুঁজে পেয়েছি। কলকাতায় গৌরী মাসির বাসায়ও তাঁকে দেখেছি। তাঁদের দুজনের মধ্যেও খুব ভাব ছিল।

আমি কিভাবে যেন সন্জীদা আপার প্রিয়পাত্রী হয়ে উঠেছিলাম। সম্ভবত ২০০৫ সালে রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য ত্রিপুরা সরকারের পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। আমাকেও কেন যেন তিনি তাঁর সফরসঙ্গী করেছিলেন। বুলবুল ললিতকলা একাডেমীর আব্দুল কাইয়ুমও তাঁর সঙ্গে গিয়েছিলেন। আগরতলায় রবীন্দ্র সদনে অনুষ্ঠান হয়েছিল। শান্তিনিকেতন থেকে মোহন সিং ও তাঁর পুত্র বিক্রম সিং এবং কলকাতা থেকে স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত-ও ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। মোহন সিং-বিক্রম সিংয়ের সঙ্গে আমার পূর্বপরিচয় ছিল। বিক্রম এবং আমার বড় মেয়ে অনিন্দিতা পর্ণা সহপাঠী ছিল। সেই সুবাদে শান্তিনিকেতনই তাঁদের সঙ্গে আমার দেখা ও পরিচয় হয়েছিল। আগরতলায় রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে পিতাপুত্র দুজনের গানই শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছিল। মোহন সিং গেয়েছিলেন :

ওই পোহাইল তিমির রাতি

পূর্ব গগনে দেখা দিল নব প্রভাতছটা,

জীবনে-যৌবনে হৃদয়ে-বাহিরে

প্রকাশিল অতি অপরূপ মধুর ভাতি। –

আর বিক্রম গেয়েছিল :

নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে,

রয়েছ নয়নে নয়নে।

হৃদয় তেমারে পায় না জানিতে,

হৃদয়ে রয়েছ গোপনে।

বাসনার বশে মন অবিরত

ধায় দশ দিশে গাগলের মতো,

স্থির-আঁখি তুমি মরমে সতত

গাহিছ শয়নে-স্বপনে।

আগরতলার একটি জন্মান্ধ ছেলের গাওয়া :

আমার মাথা নত করে দাও হে

তোমার চরণ ধুলার তলে

সকল অহংকার হে আমার

ডুবাও চোখের জলে …

গানটি কয়েক হাজার দর্শক-শ্রোতার চোখে জল এনেছিল।

অনুষ্ঠানে সন্জীদা আপা আলোচনা করেছেন, গানও গেয়েছেন। পিনপতন নীরবতায় সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তা শুনেছেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক চৌধুরী। তিনি আপাকে উত্তরীয় পরিয়ে দিয়ে বিশেষ সম্মাননা জানিয়েছিলেন। মূল মঞ্চে আপার সঙ্গে কাইয়ুম ভাই এবং আমাকেও বাংলাদেশের অতিথি হিসেবে বসতে দেওয়া হয়েছিল।

আগরতলায় অবস্থানকালে সন্জীদা খাতুন এবং আব্দুল কাইয়ুম স্থানীয় শিল্পীদের নিয়ে একটি ওয়ার্কশপেরও আয়োজন করেছিলেন।

সন্জীদা আপাকে থাকতে দেওয়া হয়েছিল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে। আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল একটি ভালো মানের হোটেলে। পরদিন আপা আমাদের হোটেলে এসে উপস্থিত। বললেন, অতিথিশালার অমন রাজকীয় ব্যবস্থা তাঁর ভালো লাগছে না। তিনি আমাদের সঙ্গেই থাকবেন। এই হলেন আমাদের সন্জীদা আপা।

আপা ছিলেন ভিআইপি অতিথি। সেজন্য তাঁর সফরসঙ্গী হয়ে আমরাও হয়ে যাই ভিআইপি। আগরতলা থেকে আমাদের সরকারি ব্যবস্থাপনায় উদয়পুর নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে গোমতী নদীর তীরে বিখ্যাত ভুবনেশ্বরী মন্দির আমরা দেখেছি। কথিত আছে যে, এই মন্দিরে মা কালীর উদ্দেশে একসময় নরবলি দেওয়া হতো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিসর্জন নাটক এই ভুবনেশ্বরী মন্দিরের ভাবধারায় রচিত বলে মনে করা হয়। আমাদের এই সফরকালে আপা বিসর্জন নিয়েও কত কথা বলেছিলেন। তাঁর ছেলে পার্থকে গল্প বলে ঘুম পাড়াতে হতো। বিসর্জনের কাহিনি বর্ণনা করার সময় ওই বলির প্রসঙ্গ এলে পার্থ নাকি চিৎকার করে বলেছিল – ‘ওকে মেরো না।’ ছেলেকে খুশি করতে আপা কাহিনি একটু বদলে দিয়েছিলেন।

সন্জীদা আপার সঙ্গে ২০০৬ সালে আমাদের সুন্দরবন ভ্রমণেরও সুযোগ হয়েছিল। ছায়ানটের শিক্ষক-ছাত্র এবং কমিটির সদস্য মিলে ৪০ জনের মতো আমরা সুন্দরবন গিয়েছিলাম। অন্যদের মধ্যে অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, ডা. সারওয়ার আলী, আবুল হাসনাতও আমাদের সঙ্গে ছিলেন বলে মনে আছে। সবমিলিয়ে দিন চারেক আমরা কী যে মজার সময় কাটিয়েছি। খুলনা থেকে আমরা স্টিমারে সুন্দরবন গিয়েছি। স্টিমারে প্রচুর খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। সন্জীদা আপার পছন্দের লুচি-তরকারি, ডালপুরি, পাকোড়া তো ছিলই। নাচ-গান-কবিতা আবৃত্তি – কোনোটারই কমতি ছিল না। কটকা নামক স্থানে আমরা যাত্রাবিরতি দিয়েছিলাম। সেখানে বন বিভাগের অফিসে যিনি কর্মকর্তা ছিলেন তিনি সন্জীদা আপার ছাত্র হওয়ায় আমরা বাড়তি খাতিরযত্নও পেয়েছিলাম।

গত শতকের ষাটের দশক থেকে বাঙালির সাংস্কৃতিক জাগরণের যে ধারাবাহিক কর্মোদ্যোগ তার সঙ্গে সন্জীদা খাতুন ওতপ্রোতভাবেই জড়িয়ে আছেন। ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। ছায়ানটের উদ্যোক্তাদের মধ্যে আরো ছিলেন মোখলেসুর রহমান সিধু, শামসুন্নাহার রহমান, সুফিয়া কামাল, সাইদুল হাসান, ওয়াহিদুল হক, ফরিদা হাসান, কামাল লোহানী, আহমেদুর রহমান, সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিকসহ আরো অনেকে।

পাকিস্তানি শাসকদের বিরোধিতা উপেক্ষা করে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন আয়োজনের সঙ্গেও সন্জীদা আপা ছিলেন। ১৯৬৪ সাল থেকে ছায়ানটের উদ্যোগে রমনা বটমূলে পহেলা বৈশাখ বাংলা বর্ষবরণের যে আয়োজন তারও অন্যতম উদ্যোক্তা সন্জীদা আপা। পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধে সন্জীদা খাতুন ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি গেয়েছিলেন। এটা পরে আমাদের জাতীয় সংগীত হয়েছে।

সন্জীদা খাতুনের কর্মকাণ্ডের পরিধি অনেক বিস্তৃত। তিনি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্রী। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তিনি পিএইচ.ডি ডিগ্রি এবং ‘দেশিকোত্তম’ সম্মাননা অর্জন করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। দুটি স্মৃতিকথা ছাড়াও বেশ কয়েকটি স্মরণীয় গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং একুশে পদকপ্রাপ্ত গুণী রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী সন্জীদা খাতুন রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ এবং নালন্দা নামের ব্যতিক্রমী শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরও প্রধান কর্ণধার। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। অসাম্প্রদায়িক ও আধুনিকমনস্ক একটি জাতি গঠনের কাজে নিরলসব্রতী সন্জীদা খাতুন সুশৃঙ্খল, গোছানো অথচ অতি সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত। তাঁর কাছে আমাদের অনেক ঋণ। অনেক কিছু শেখার আছে তাঁর জীবন থেকে।

প্রতিবছর তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে তাঁর বাসায় যাওয়া আমার একটি নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। তিনি অনুমতি দিলে তাঁর পছন্দের লুচি এবং ছোলার ডাল রান্না করে নিয়ে যাই। বেলিফুল তাঁর খুব প্রিয়। কেউ না কেউ তাঁর জন্মদিনে বেলিফুল নিয়ে যায়। একবার আমি কোথাও বেলিফুল না পেয়ে আমাদের বন্ধু দিপালী চক্রবর্তীকে বলি বেলিফুল জোগাড় করতে। দিপালী তাদের বাসার ছাদ থেকে বেলিফুল চুরি করে এনেছিল। কলাপাতায় করে সেই ফুল নিয়ে আপার হাতে দিয়েছিলাম। তিনি খুশি হয়ে তা গ্রহণ করেছিলেন।

ছায়ানট ভবন তৈরি হলে সেখানে আমার মতো বয়স্কদের জন্য গান শেখার কোনো সুযোগ করা যায় কি না ভয়ে ভয়ে একদিন সে অনুরোধ রেখেছিলাম আপার কাছে। সঙ্গে সঙ্গে কোনো উত্তর পাইনি। তিনি চুপ ছিলেন। নতুন ভবনে কার্যক্রম শুরু হলে একদিন তিনি আমাকে ডেকে বলেন, একটি বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা করা হবে একটু বয়স্কদের জন্য। আমি তো খুশিতে আত্মহারা। তিন হাজার টাকা বাৎসরিক ফি দিয়ে আমি সেই বিশেষ ক্লাসের প্রথম ছাত্রী হয়েছিলাম। সপ্তাহে একদিন ক্লাস হতো। আমার বয়সী বা কাছাকাছি বয়সের অনেকেই সেই ক্লাসে অংশ নিয়েছেন। আপা শুধু গান শেখাতেন না, সেই গান নিয়ে আলোচনাও করতেন। ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’ – গানটি নিয়ে একদিন প্রায় এক ঘণ্টা আলোচনা করেছিলেন আপা। ওয়াহিদুল হক ছাড়া আরো কেউ কেউ আমাদের গান শিখিয়েছেন। শেখার তো কোনো বয়স নেই। দরকার শুধু আগ্রহ।

আপা ছিলেন খুবই সময়নিষ্ঠ। দেরি করে ক্লাসে উপস্থিত হওয়া একদম পছন্দ করতেন না। আমিও একদিন কয়েক মিনিট দেরিতে উপস্থিত হয়ে আপার বকা খাওয়ার পর ১০ মিনিট আগে গিয়ে বসে থাকতাম।

জমকালো পোশাক আপার পছন্দ নয়। নিজেও তাঁতের শাড়ি পরতে পছন্দ করতেন। তবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হতে হবে পরিধেয় বস্ত্র। ক্লাসে কেউ সিল্ক বা সেরকম কোনো ঝলমলে পোশাক পরে গেলে আপা মুখ ভার করে তাঁর অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতেন। এলোমেলো, অগোছালো কিছুই তিনি পছন্দ করতেন না। তাঁর বাসাও একেবারে সাজানো ছবির মতো। ছায়ানট ভবনটিও তিনি পরিপাটি দেখতে চান। ক্লাসে বা মিলনায়তনে ঢোকার আগে জুতা-স্যান্ডেল রাখার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা আছে। সেগুলো কেউ ঠিকমতো তাকে না রেখে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখলে তিনি অখুশি হন।

সন্জীদা আপার জীবনসঙ্গী ছিলেন আরেক সংস্কৃতিবান বোদ্ধা মানুষ ওয়াহিদুল হক। রবীন্দ্রানুরাগী, শিল্প এবং সংস্কৃতির সমঝদার উদারমনের এই দুজন মানুষ শেষ পর্যন্ত একসঙ্গে ঘর করতে না পারলেও মত ও পথের দিক দিয়ে কাছাকাছি ছিলেন। একসঙ্গে অনেক কাজ করেছেন একে অপরের সহযোগী হয়ে। আপা এবং ওয়াহিদুল হক আমার বাসায়ও এসেছেন। খুব বেশি মানুষের বাসায় সন্জীদা আপার যাতায়াত ছিল বলে শুনিনি। আমার বাসায় এসেছেন, এটা আমার কম সৌভাগ্য নয়! ঘরোয়া পরিবেশে আমরা গান করেছি। ওয়াহিদ ভাই খই, দুধ, কলা দিয়ে রাতের খাবার খেতেন। আমি চেষ্টা করতাম তাঁদের পছন্দের খাবার তৈরি করতে। বেশি রাত হলে তাঁদের নিজ নিজ গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতাম।

নানা উপলক্ষেই আপার গান শোনার সুযোগ হয়েছে। অপূর্ব তাঁর গায়কী। একবার শুনলে বারবার শুনতে মন চায়। তাঁর কণ্ঠে শোনা :

এবার দুঃখ আমার অসীম পাথার

পার হলো যে পার হলো

তোমার পায়ে এসে ঠেকলো শেষে

সকল সুখের সার হলো। …

এবং –

প্রভু, আজি তোমার দখিন হাত রেখো না ঢাকি

এসেছি তোমারে, হে নাথ, পরাতে রাখী।

যদি বাঁধি তোমার হাতে পড়বো বাঁধা সবার সাথে

যেখানে যে আছে কেহই রবে না বাকি। …

এই গান দুটি আমার কানে বাজবে আমৃত্যু।

অজয় রায়ের মৃত্যুর খবর শুনে আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, ‘জয়ন্তী, শক্ত হও। শক্ত হয়ে দাঁড়াতে হবে। শক্ত না হলে এই কঠিন পৃথিবীতে টিকে থাকা যাবে না।’ সত্যি, অত্যন্ত কোমল হৃদয়ের সংবেদনশীল মানুষ হয়েও সন্জীদা আপা এই সমাজের অহিতকর সবকিছুর বিরুদ্ধে কি শক্তভাবেই না সংগ্রাম করে চলেছেন। মানুষের মনের সংকীর্ণতা ও অন্ধকার দূর করে, উদার ও আলোকিত করার জন্য যেভাবে তিনি এই পরিণত বয়সেও মাথা উঁচু করে চলেন, তা দেখে শ্রদ্ধায়, কৃতজ্ঞতায় কার না মাথা নত হয়ে আসে!

আপাকে জানাই গভীর প্রণতি।

ঊনচল্লিশ

১৯৯০ সালে অজয় রায়ের সঙ্গে আমার আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী বঙ্গেশ্বর রায় এবং কমিউনিস্ট নেত্রী নিবেদিতা নাগের অতিথি হয়েই আমরা আন্দামান যাই। বঙ্গেশ্বর রায় এবং নিবেদিতা নাগ দুজনই অজয় রায়ের পরিচিত। তাঁরা ভারত সরকারের বিশেষ অতিথি হয়ে আন্দামান যাচ্ছিলেন। আমাদেরও তাঁদের সঙ্গী হিসেবে যাওয়ার আহ্বান জানালে অজয় রায় প্রথমে যেতে রাজি হননি, কারণ তিনি আগেই আন্দামান ঘুরে এসেছেন; কিন্তু আমার আগ্রহের কারণে শেষ পর্যন্ত সম্মত হন। আমরা তখন কলকাতা বেড়াতে গিয়েছিলাম বলেই আন্দামান যাওয়া সম্ভব হয়েছিল।

আন্দামান, বিশেষ করে সেখানকার সেলুলার জেল দেখার আমার খুব ইচ্ছা ছিল। কমিউনিস্ট পার্টির নেতা অনিল মুখার্জির মুখে আন্দামান ও সেলুলার জেলের অনেক গল্প শুনেছি। অনিলদাও আন্দামানে নির্বাসনদণ্ড পেয়েছিলেন স্বদেশি আন্দোলনে অংশ নেওয়ার অপরাধে। ব্রিটিশ সরকার ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের গ্রেফতার করে আন্দামানে পাঠাতো। সেখানে রাজনৈতিক বন্দিদের ওপর নিষ্ঠুর অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হতো। অনেকে সেখানে মৃত্যুবরণও করেছেন। অনিলদা যে একটু বাঁকা হয়ে হাঁটতেন, সেটাও ওই আন্দামানে নির্যাতনের কারণেই।

বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এখন ভারতের কেন্দ্রশাসিত একটি অঞ্চল। রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ার। কলকাতা থেকে ১২৫৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সেলুলার কারাগারটি এখন জাতীয় স্মৃতিস্মারক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অনেক দর্শনার্থী-পর্যটক সেটা দেখতে যান। ভারত সরকার প্রবীণ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে সেখানে নিয়ে যান। সেখানে বিভিন্ন গ্যালারিতে স্বাধীনতা সংগ্রামী যাঁরা আন্দামানে নির্বাসিত হয়েছিলেন তাঁদের ছবি এবং স্মারকচিহ্ন সংরক্ষিত আছে। কীভাবে অমানবিক নির্যাতন চালানো হতো, হাতেপায়ে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে শ্রমসাধ্য কাজ করানো হতো, পা ওপরে ঝুলিয়ে মাথা নিচে দিয়ে বেত্রাঘাত করে রক্তাক্ত করা হতো, ফাঁসিতে ঝোলানো হতো – সেসবের চিত্র দেখে যে কেউ বুঝতে পারবেন, কতটা হিংস্র ছিল ইংরেজ শাসকদের মনোভাব। ইংরেজদের ভারতছাড়া করতে অসংখ্য মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে, অকথ্য নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে।

আন্দামানকে কালাপানিও বলা হতো। কালা বলতে মৃত্যু বোঝানো হতো আর সাগরের উপকূলে পানিবেষ্টিত বলে পুরো নাম হয়েছিল কালাপানি। একবার কাউকে কালাপানিতে পাঠানো হলে তার জীবিত ফিরে আসার সম্ভাবনা কম থাকতো। অন্যদিকে আন্দামানে পানির রংও কালো। ওই পানিতে কেউ পা ডোবায় না। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পর থেকেই ইংরেজরা আন্দামানকে বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। ১৯০৬ সালে সেলুলার জেলের নির্মাণকাজ শেষ হয়। অসংখ্য ছোট ছোট সেল বা কুঠুরির সমন্বয়ে তৈরি বলেই এর নাম হয় সেলুলার জেল। ৬৯৩টি সেল ছিল। ১০ ফুট লম্বা এবং ৮ ফুট চওড়া প্রতি সেলে একজন বন্দি থাকার ব্যবস্থা। কেউ কারো মুখ দেখার সুযোগ পেতেন না। আলো-বাতাসহীন বদ্ধ সেলে বছরের পর বছর কাটিয়েছেন অনেক বন্দি। অনেক বাঙালি বিপ্লবীও সেখানে ছিলেন। তাঁদের ছবি সেখানে এখন সংরক্ষিত আছে। মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী, আমাদের শেরপুরের রবি নিয়োগী, অনিল মুখার্জিসহ অনেকের ছবি আমিও দেখেছি।

আমরা খিদিরপুর থেকে স্টিমারে উঠেছিলাম। স্টিমারে প্রচুর খাবার-দাবার ছিল। যেহেতু যাত্রীদের বেশির ভাগ সরকারের অতিথি, সেহেতু কারো যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, সেদিকে ছিল কড়া নজরদারি। আন্দামানে আমাদের থাকার ব্যবস্থাও ছিল ভালো। সেখানে তখন ফরেস্ট অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন অজয় রায়ের মামা দীপক দত্ত। আমরা তাঁকে দীপু মামা বলে ডাকতাম। তিনি ছিলেন গৌরী মাসির ভাই। দীপু মামাও একটি বড় বাড়িতে থাকতেন। তাঁর চলাফেরার জন্য একটি জিপ গাড়িও ছিল। তিনি আমাদের তাঁর বাসায় থাকতে বললেও আমরা অন্য সহযাত্রীদের সঙ্গেই থেকেছি। তবে দীপু মামার সঙ্গে তাঁর জিপে চেপে ঘোরাঘুরি করেছি। পোর্ট ব্লেয়ার রাজধানী হলেও তখন পর্যন্ত যানবাহনের সংকট ছিল। রাস্তাঘাট তেমন ভালো ছিল না। সেখানে আমার অবশ্য দেখার আগ্রহের তালিকার শীর্ষে ছিল সেলুলার জেল। আমি সারাদিন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব দেখেছি। স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবী নায়কদের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে তাঁদের সবার প্রতি নীরবে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছি। সন্ধ্যায় লাইট এবং সাউন্ডের মাধ্যমে ইংরেজদের নিষ্ঠুরতার প্রামাণ্যচিত্র অতিথি-পর্যটকদের দেখানো হয়। দেখলে গা শিউরে ওঠে। মনে হয়, ইংরেজরা এতো বর্বর ছিল!

আন্দামানে পানীয় জলের খুব সমস্যা। সমুদ্রের নোনা জল পানের অযোগ্য। বৃষ্টির জল ধরে রাখা হয় এবং তা পরিশোধন করে পান করা হয়। আমাদের জন্য অবশ্য স্টিমারে কলকাতা থেকে পানীয় জল নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সে সময় সপ্তাহ দুদিন কলকাতা থেকে বিভিন্ন সবজিও আন্দামানে নেওয়া হতো। আন্দামানে সবজি উৎপাদন কম হতো। তবে নারকেল পাওয়া যায় প্রচুর। চারদিকে সারি সারি নারকেল গাছ আমাদের চোখে পড়েছে।

আন্দামানে দক্ষিণ ভারতীয় মানুষের বাস বেশি। কয়েকশো বাঙালি পরিবারও আছে। তবে আন্দামানের আদিবাসী মানুষদের আর দেখা যায় না। তারা নাকি এখনো গভীর জঙ্গলে বসবাস করে আর সমুদ্র থেকে মাছ ধরে এবং জঙ্গলের পশুপাখি বধ করে ক্ষুধা নিবারণ করে। সভ্যতার আলো থেকে ওরা নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছে। অনিলদার কাছ থেকেও আন্দামানে দক্ষিণ ভারতীয়দের কথা শুনেছিলাম। অনিলদা গল্প করেছিলেন, একবার তাঁর চোখের সমস্যা দেখা দিলে একজন দক্ষিণ ভারতীয় চিকিৎসকের কাছে তাঁকে নেওয়া হয়েছিল। ওই চিকিৎসক কোনো ওষুধ না দিয়ে অনিলদাকে কাঁচা মুগডাল খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। অনিলদা তাতে উপকার পেয়েছিলেন।

আন্দামানে আমরা চারদিন ছিলাম। ফেরার পথে আমি একটু সি সিকনেসে ভুগেছি। মাথা ঘোরাসহ কিছু অস্বস্তি হয়েছে। তবে সব মিলিয়ে ভ্রমণ এবং নতুন জায়গা দেখে ভালোই লেগেছিল।

নিবেদিতা নাগের অতিথি হয়ে যেহেতু গিয়েছি সেহেতু তাঁর সম্পর্কে দু-একটি কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। নিবেদিতা নাগ ছিলেন একজন প্রকৃত বিপ্লবী নারী। কমিউনিস্ট পার্টি করতে গিয়ে তিনি অনেক শারীরিক-মানসিক কষ্ট সহ্য করেছেন। তিনি বিয়েও করেছিলেন আরেক কমিউনিস্ট বিপ্লবী ও শ্রমিক আন্দোলনের প্রথম সারির নেতা নেপাল নাগকে। তাঁর বাবা অধ্যাপক সঞ্জীব কুমার চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রামের বিপ্লবী সূর্য সেনের বন্ধু এবং স্বাধীনচেতা মানুষ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং নেপালের ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। নিবেদিতা (চৌধুরী) নাগের মা অমিয়াবালা চৌধুরী স্কুলশিক্ষিকা ছিলেন।

নিবেদিতা নাগের শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল চট্টগ্রামে। কিন্তু ওই বয়সেই বিপ্লবীদের গোপন চিঠিপত্র বহন এবং বাড়িতে অস্ত্র লুকিয়ে রাখার দায়ে চট্টগ্রাম থেকে বহিষ্কৃত হয়ে তিনি নারায়ণগঞ্জে মামার বাড়িতে থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে কলকাতা গিয়ে বিখ্যাত বেথুন কলেজে পড়াশোনা আরম্ভ করেন। সেখানেও তিনি বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হয়ে চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। চট্টগ্রাম থেকে বিএ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করেন। কিন্তু তিনি বাম রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে রাখেননি। ১৯৪৩ সালে নেপাল নাগকে বিয়ে করে তিনি এক ঝুঁকিময় জীবনকেই বেছে নেন। তিনি কখনো জেলে, কখনো আত্মগোপনে, আবার কখনো প্রকাশ্যে কাজ করেছেন। তিনি নারায়ণগঞ্জ তোলারাম কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষা হলেও রাজনৈতিক কারণে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর কোপানলে পড়ে শান্তিতে জীবন কাটাতে পারেননি। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই রাজনীতিতে সক্রিয় থাকায় তাঁদের সংসারে অভাব-অনটন লেগেই ছিল। এর মধ্যেই তাঁদের দুটি সন্তান হয়। নানামুখী সমস্যার চাপে তাঁরা দেশত্যাগে বাধ্য হন। কলকাতায় গিয়েও রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় না হয়ে আরো বেশি তৎপর হয়েছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেপাল নাগ-নিবেদিতা নাগ দম্পতি বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছেন।

অজয় রায়ের রাজনৈতিক অবস্থানের কারণেই এই পরিবারের সঙ্গে আমিও ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। নিবেদিতাদির ছেলে সুজয় নাগ একসময় ঢাকায় নিটল গ্রুপের বড় কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছে। সে সময় নিবেদিতাদি ছেলের বাসায় বেড়াতে এসেছেন একাধিকবার। আমাদের নিমন্ত্রণ করে খাইয়েছেন, আবার আমাদের বাসায়ও এসেছেন। গুলশানে ছেলের বাসায় একদিন সন্ধ্যায় আমাদের নিমন্ত্রণ করেন। অজয় রায়ের কী একটি জরুরি কাজ ছিল। কাজ শেষ করে তিনি যাবেন, আমাকে আলাদা যেতে বললেন। আমি তাড়াহুড়ো না করে আস্তে-ধীরে গিয়ে দেখি আমার আগেই অজয় রায়, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, পংকজ ভট্টাচার্যসহ অন্যরা পৌঁছে গেছেন। নিবেদিতাদি খুব মজার মানুষ ছিলেন। সব বিষয়ে খুব রসিকতা করতেন। আমাকে আলাদা যেতে দেখে তিনি গম্ভীর মুখে বললেন, কী ব্যাপার, তোমাদের ছাড়াছাড়ি কবে হলো?

সবাই তাঁর কথায় একচোট হাসলো। তারপর আমিই বললাম, আমরা একসঙ্গেই আছি। নিবেদিতাদি বললেন, আলাদা আলাদা এলে কি না, তাই মনে হলো তোমাদের বুঝি ছাড়াছাড়ি হয়েছে।

একটি মজার গল্প শুনেছি দিদির মুখে। তিনি কিছুদিন পুরনো ঢাকার একটি স্কুলেও শিক্ষকতা করেছেন। ২৫শে বৈশাখ রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করেন স্কুলে। পাকিস্তানি শাসকরা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে মাতামাতি পছন্দ করতো না। তবু নিবেদিতাদি রবীন্দ্রজয়ন্তীর আয়োজন করেন এবং প্রধান অতিথি করেন স্কুলের ধর্মশিক্ষক মৌলভি সাহেবকে। মৌলভি সাহেব তাঁর বক্তব্যে বলেন, রবীন্দ্রনাথের নামের শেষে ঠাকুর পদবি থাকলে কি হবে, তিনি একজন বড় মওলানা ছিলেন। তাঁর দাড়ি এবং আলখাল্লা আমার চেয়ে বড় ছিল!

এমনই ছিলেন নিবেদিতাদি, যিনি তাঁর জীবনের একটা বড় সময় কাটিয়ছেন চরম দুঃখকষ্টের মধ্যে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে। তিনি আমৃত্যু অতিসাধারণ জীবন যাপন করেছেন। ছেলে অনেক মোটা মাইনের বড় চাকরি করলেও নিবেদিতাদি শেষ জীবনেও কোনো বিলাসিতা করেননি। ছেলের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে না উঠে নিজের ছোট অথচ ছিমছাম এবং নানা ধরনের বইয়ে ঠাসা বাড়িতেই থেকেছেন। বই পড়ার নেশা ছিল তাঁর। ২০১৩ সালের ৫ই মে নিবেদিতা নাগ কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর জন্ম হয়েছিল ১৯১৮ সালের ৪ঠা আগস্ট নারায়ণগঞ্জে, মাতুলালয়ে।

বঙ্গেশ্বর রায়েরও প্রথম জীবন কেটেছে ঢাকায়, গেণ্ডারিয়া এলাকায়। তিনি লেখক সোমেন চন্দের বন্ধু ছিলেন। সোমেন চন্দ মার্কসবাদী সাহিত্যিক ছিলেন। প্রতিভাধর এই লেখক ফ্যাসিবাদবিরোধী সম্মেলনের আয়োজন করতে গিয়ে ১৯৪২ সালের ৮ই মার্চ ঢাকায় আততায়ীর হামলায় নিহত হয়েছিলেন। বঙ্গেশ্বর রায় ঢাকাইয়া ভাষায় সুন্দর কথা বলতে পারতেন। ঢাকায় প্রচলিত কিছু মজার কৌতুক আমি তাঁর কাছে শুনেছি।

এই সব মানুষের সান্নিধ্য পাওয়ার স্মৃতি আমি কখনো ভুলবো না।

চল্লিশ

২০০০ সালের ঘটনা। অজয় রায়ের কিছু শারীরিক সমস্যা দেখা দেওয়ায় তাঁকে কলকাতা যেতে হয়। বড় মেয়ে এবং ছেলে তাঁর সঙ্গী হয়। কলকাতা থেকে তাঁকে নেওয়া হয় দিল্লি স্কট হাসপাতালে। সেখানে তাঁর বাইপাস অপারেশনের দিন ঠিক হয়। কিন্তু ওইদিন আবার ঢাকায় আমার চাকরির পদোন্নতির জন্য একটি পরীক্ষার দিন নির্ধারিত থাকায় আমি পরীক্ষা না দিয়ে দিল্লি যাওয়া সঠিক মনে করিনি। মনের মধ্যে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা থাকলেও আমি ঠিক করি যে, পদোন্নতির পরীক্ষা দিয়েই আমি দিল্লি যাবো। সে অনুযায়ী আমি সব প্রস্তুতি নিয়ে রাখি।

দিল্লিতে অজয় রায়ের সঙ্গে ছেলেমেয়ে ছিল। তাছাড়া তখন দিল্লিতে আমাদের হেনা মাসি এবং ফনি বড়াও ছিলেন। তাঁরা সবাই মিলে অজয় রায়ের চিকিৎসার বিষয়গুলি তত্ত্বাবধান করায় আমার একটু স্বস্তি হচ্ছিল বা উদ্বেগটা চেপে রাখতে পারছিলাম।

নির্দিষ্ট দিন আমি পদোন্নতির জন্য – জীবন বীমা করপোরেশনে ডেপুটি ম্যানেজার থেকে ম্যানেজার পদে – পরীক্ষা দিতে ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে হাজির হই। ওই দিনই দিল্লিতে অজয় রায়ের বাইপাস অপারেশন। একধরনের চাপা অস্থিরতার মধ্যেই বোর্ডের মুখোমুখি হই। পরীক্ষা ভালো হয় বলেই আমার মনে হয়েছিল। কিন্তু আমার মন পড়েছিল দিল্লিতে।

যা হোক, ইন্টারভিউ শেষ করেই আমি আমাদের এমডি সাহেবের সঙ্গে দেখা করে আমার স্বামীর অপারেশনের কথা জানাই। দিল্লি যাওয়ার জন্য দশ দিনের ছুটি চাইলে তিনি তা মঞ্জুর করেন। এমডি সাহেব খুব ভালো মানুষ ছিলেন। অজয় রায়ের প্রতিও ছিল তাঁর শ্রদ্ধাবোধ। আমি সন্ধ্যায় এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে কলকাতায় গিয়ে রাতটা সেখানে কাটিয়ে পরদিন ভোরে দিল্লি পৌঁছি। স্কট হাসপাতালে আগের দিনই অজয় রায়ের অপারেশন হয়েছে। অপারেশন করেছেন নামকরা কার্ডিও-সার্জন ডা. নরেশ ত্রিহান। তিনি একই সঙ্গে আমেরিকা এবং ভারতে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করতেন। কতদিন দিল্লি আর কতদিন আমেরিকায় থাকবেন, তা আগে থেকেই ঠিক করা থাকতো বলে রোগীদের সমস্যা হতো না।

বাইপাস অপারেশনের পর ছয় ঘণ্টা রোগীর কোনো জ্ঞান থাকে না। আমি দিল্লি পৌঁছেছি ওই ছয় ঘণ্টা পার করেই। আমি দিল্লি­ গিয়ে উঠেছিলাম সিপিআই অফিস অজয় ভবনের অতিথিশালায়। অজয় রায় এবং ছেলেমেয়েদেরও ওখানেই ঠাঁই হয়েছিল। হাসপাতালে গিয়ে শুনলাম, অজয় রায়কে রিকভারি রুমে দেওয়া হয়েছে এবং আমার মেয়ে পর্ণা তার বাবাকে দেখেও এসেছে। তিনি ভালো আছেন। আমার বুক থেকে যেন একটি বড় পাথর নেমে গেল। আমি অনেকটাই হালকা  বোধ করলাম। ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে পরে আমিও গিয়ে রোগীকে দেখলাম। তিনি চোখ মেলে আমার দিকে চাইলেন। মুখে ফুটে উঠল এক চিলতে হাসি। হাসপাতালে তাঁর কোনো সমস্যা হয়নি। সেখানকার ব্যবস্থাপনা খুব উন্নত। বাইরে থেকে বেশি কিছু করার নেই। তারপরও সিপিআই নেতা ফনি বড়া সবসময় খোঁজখবর নিয়েছেন। হেনা মাসিও ছিলেন।

ছয় দিন পর হাসপাতাল থেকে রোগীকে রিলিজ দেওয়া হয়। ডা. নরেশ ত্রিহান রোগী ছাড়ার আগে রীতিমতো আমাদের পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে ব্রিফ করলেন বলা যায় ছোটখাটো একটি ক্লাসের মতো। রোগীর কীভাবে যত্নআত্তি করতে হবে, রোগীর মেজাজ একটু খিটখিটে হতে পারে, হঠাৎ করেই রেগে যেতে পারে, সে অবস্থায় তাকে কীভাবে সেবা দিতে হবে, শান্ত করতে হবে – সবকিছু বেশ বিস্তারিতভাবেই আমাদের বলা হলো। দুই মাস পর আবার রোগীকে নিয়ে চেকআপ করিয়ে আনতে হবে।

আমরা দিল্লি থেকে কলকাতায় চলে এলাম। গোলপার্কে রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের অতিথিশালায় দুটি রুম নেওয়া হয়। যেহেতু দুই মাস পর আবার দিল্লি যেতে হবে চেকআপের জন্য, সেহেতু দুই মাস অজয় রায়কে কলকাতায় রাখার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু আমার কিংবা আমার বড় মেয়ে কিংবা ছেলের পক্ষে দুই মাস কলকাতায় থাকা সম্ভব ছিল না। এবার ছোট মেয়ে অদিতির ওপর ভার ন্যস্ত হলো বাবার দেখাশোনা করার। অদিতি সানন্দেই এই দায়িত্ব গ্রহণ করে। সে তখন এমএ পাশ করে কম্পিউটার বিষয়ে কী একটা কোর্স করছিল। বড় মেয়ে এবং ছেলে জার্মানি এবং আমেরিকায় তাদের চাকরিস্থলে চলে যায়। আমিও সবকিছু গোছগাছ করে দিয়ে দেশে চলে আসি। কারণ আমার দশদিনের ছুটি শেষ হয়ে যায়। গোলপার্ক মিশনের সাধারণ সম্পাদক লোকেশানন্দ মহারাজের সঙ্গে অজয় রায়ের প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তাই সেখানে ছোট মেয়ের তত্ত্বাবধানে অজয় রায়কে রেখে আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি। অদিতি তার বাবার সেবাযত্নে কোনো ত্রুটি করেনি। তাঁর মন ভালো রাখার জন্য অদিতি সর্বক্ষণ সচেষ্ট থাকতো। পায়ের রগ যেখান থেকে কাটা হয়েছিল সেখানে প্রতিদিন ব্যান্ডেজ বদলে দেওয়া থেকে শুরু করে বিকেলে বাইরে থেকে ঘুরিয়ে আনার কাজ অদিতি দরদ দিয়েই করতো। দক্ষিণাপণ কমপ্লেক্সে গিয়ে ডলির দোকানে চা খেতে পছন্দ করতেন অজয় রায়, আমি তাঁকে সেখানে নিয়ে যেতাম। আমি চলে আসার পর অদিতিও নিয়ে গেছে।

আমি ঢাকা ফেরার আগে এক বিকেলে হঠাৎ কী নিয়ে যেন অজয় রায় হইচই শুরু করলেন। কিছুতেই তাঁকে শান্ত করা যাচ্ছে না। তাঁর এই বিগড়ে যাওয়ার আশঙ্কার কথা ডাক্তার আগে বলে দিলেও কেন যেন ছেলেমানুষি করে বাইরে বের হয়ে গেলাম। গড়িয়ার কাছে ‘প্রিয়া’ সিনেমা হলে তখন দেবদাস ছবিটি চলছিল। আমি টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকে কিছুক্ষণ ছবিটি দেখে তারপর অতিথিশালায় ফিরে দেখি, আমাকে খুঁজে না পেয়ে অজয় রায় কিছুটা অস্থির হয়ে উঠেছেন। মেয়ের কাছে জানতে চাইছিলেন, আমি কোথায় গেছি? আমি তো মেয়েকে না বলেই মেজাজ খারাপ করে বাইরে গিয়েছিলাম।

আমি ফিরে এসে বললাম, কাল তো চলে যাবো, তাই প্রয়োজনীয় দু-একটি জিনিস কিনতে বাইরে গিয়েছিলাম। তিনি কী বুঝলেন, একটু গম্ভীর হয়ে থাকলেন। আমি তাঁকে বলি, আমাকে তো চাকরি রক্ষা করতে হবে। তাই তোমাকে এখানে রেখেই ঢাকা যেতে হচ্ছে। দুই মাস পর চেকআপের জন্য দিল্লি­ যাওয়ার সময় আমি আবার কয়দিনের ছুটি নিয়ে আসবো। তিনি চুপ করেই থাকলেন।

ঢাকায় ফিরে অফিসে গিয়ে শুনি আমার প্রমোশন হচ্ছে। তবে অফিসের নিয়ম অনুযায়ী আমাকে প্রমোশন দিয়ে ঢাকার বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আমি একটু হতচকিত হয়ে পড়ি। অসুস্থ স্বামীকে ঢাকায় রেখে বাইরে যাওয়া আমার পক্ষে একটু কঠিন বইকি। আমি এমডি স্যারের সঙ্গে দেখা করে আমার অসুবিধার কথাটি জানাই। তিনি বলেন, কিন্তু অফিস কি আপনার জন্য নিয়মের ব্যতিক্রম করবে? তখন আমি বলি, দরকার হলে এক বছর প্রমোশন না নিয়ে হলেও আমি ঢাকায় থাকতে চাই। কর্তৃপক্ষ আমার প্রমোশন এক বছর স্থগিত রেখে আমাকে ঢাকায় থাকার ব্যবস্থা করে। এতে আমার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, কিন্তু অজয় রায়ের দেখাশোনা করার সুযোগবঞ্চিত হইনি। এর দুই মাস পর আবার ছুটি নিয়ে কলকাতা-দিল্লি যাই। ডাক্তার পরীক্ষা করে বললেন, অজয় রায় ঠিক আছেন। তিনি দেশে ফেরার জন্য শারীরিকভাবে উপযুক্ত। তবে বিভিন্ন নিয়ম মেনে চলতে হবে। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। কীভাবে চলতে হবে তার একটি ব্যবস্থাপত্র লিখে দিলেন ডা. নরেশ ত্রিহান।

২০০২ সালে আমার অফিসে আরেক সমস্যা দেখা দেয়। জীবন বীমা করপোরেশনের নিয়ম ছিল প্রতি তিন বছর পর এক মাসের অতিরিক্ত বেতনসহ এক মাসের ‘রিক্রিয়েশন লিভ’ দেওয়া হতো। আমি তখন এই বিশেষ ছুটি ভোগ করছিলাম। এর মধ্যে একদিন অফিস থেকে টেলিফোন করে আমাকে জরুরিভাবে যেতে বলা হলো। গিয়ে দেখি আমার নামে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন আমাদের এমডি সাহেব। চিঠিতে আমার ছুটি বাতিল করে অবিলম্বে দিলকুশা ব্রাঞ্চ অফিসে যোগদান করতে বলা হয়েছে। ওই ব্রাঞ্চ অফিস থেকে ২০ লাখ টাকা খোয়া গিয়েছিল। কে বা কারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত তা বের করার জন্য আমাকে উপযুক্ত বিবেচনা করে ওই ব্রাঞ্চে যোগ দিতে বলা হয়। এমন একটি ঝামেলার কাজ আমি করতে পারবো কি না, তা নিয়ে আমার মনে সংশয় দেখা দেওয়ায় আমি নতুন দায়িত্ব নিতে একটু গড়িমসি করলে এমডি স্যার বলেন, আপনাকে কিছুই করতে হবে না। আপনি শুধু ওখানে বসে চোখ-কান খোলা রাখবেন। আপনার মতো সৎ ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তার ওপরই আমরা নির্ভর করতে চাই। প্রকৃত অপরাধীদের ধরার জন্য যা করা দরকার তার সবই হেড অফিস থেকে করা হবে। আপনি তাদের সহযোগিতা করবেন।

আমি মেয়েমানুষ হয়ে এই কঠিন অবস্থা সামাল দিতে পারবো কি না – সে-কথা তুলতেই এমডি সাহেব বলেন, চাকরি নেওয়ার সময় কি আপনি মেয়ে হিসেবে নিয়েছিলেন? তাঁর এই কথা আমার মনে দাগ কাটে। আমি বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে দিলকুশা ব্রাঞ্চে গিয়ে যোগ দিই। ব্রাঞ্চে কর্মরত কেউ কেউ আমার এই নতুন দায়িত্ব গ্রহণে খুশি হয়নি। তারা আমার বিরুদ্ধে দল পাকাতে চেষ্টা করে। যারা ইউনিয়ন করতো এবং নানা উছিলায় কাজে ফাঁকি দিত, তারা আমাকে গ্রহণ করতে চায়নি। কিন্তু আমি দৃঢ়ভাবে এবং কোনো পক্ষপাত না দেখিয়ে দায়িত্ব পালন করায় খুব তাড়াতাড়ি ব্রাঞ্চের কর্মপরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে আসে। টাকা-পয়সার হিসাব ত্রুটিমুক্ত করার জন্য হেড অফিস থেকে আমাকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হয়।

সব অফিসেই ভালো-খারাপ সব ধরনের লোকই থাকে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তখন সেই সরকারের একটি সমর্থকগোষ্ঠী অফিসে অফিসে তৈরি হয়ে যায়। তারা কাজেকর্মে ফাঁকি দিয়ে ছোটখাটো সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ধান্দায় ব্যস্ত থাকে। আমি আমার দীর্ঘ চাকরি জীবনে চেষ্টা করেছি কোনো গ্রুপিংয়ের মধ্যে না জড়িয়ে নিজের কাজটা ভালোভাবে করতে। ভালো মানুষের সংখ্যাই আমাদের অফিসে বেশি ছিল। তাই আমি তাঁদের সহযোগিতা পেয়েছি। সিনিয়র-জুনিয়র সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে আমি অফিসে একটি  সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশেই কাজ করেছি।

দিলকুশা ব্রাঞ্চে কয়েকজন ইউনিয়ন করা ব্যক্তি আমার বিরুদ্ধ লেগেও শেষ পর্যন্ত সুবিধা করতে পারেনি। কারণ আমি কোনো ধরনের অনৈতিক কাজকে প্রশ্রয় দিইনি। আমার চোখে যাদের আচরণ সন্দেহজনক মনে হয়েছে, যারা অসততার সঙ্গে জড়িত বলে মনে হয়েছে, তাদের বেতনও আমি বন্ধ করে দিয়েছি। তারা আমাকে আমার অফিসকক্ষে ঘেরাও করে সারাদিন অবরুদ্ধ করে রেখেছে; কিন্তু দিনশেষে নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে আমার কাছে ক্ষমাও চেয়েছে। তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা কিছু অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিল; কিন্তু প্রধান কার্যালয়ের প্রশাসন বিভাগের সহায়তায় আমি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলাম।

২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমি চাকরি থেকে অবসর নিই। তখন আমি হেড অফিসে অডিট বিভাগে সহকারী জেনারেল ম্যানেজার পদে ছিলাম। আমার আগে কোনো নারী জীবন বীমা করপোরেশনে এতো বড় পদে দায়িত্ব পালন করেননি। অডিট বিভাগে তখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো সাবজেক্টে ভালো ফল করা অনেক চৌকষ ছেলে কাজ করতো। তারা সবাই আমাকে পছন্দ করতো। তাদের সহযোগিতা না পেলে আমি হয়তো সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে পারতাম না। শাহাবুদ্দিন সাহেব যখন এমডির দায়িত্বে ছিলেন তখন আমি তাঁর অনেক সমর্থন পেয়েছি। তিনি ছিলেন আমার বন্ধুর বর নুরুল ইসলাম মোল্লার বন্ধু। তাছাড়া অজয় রায়ের স্ত্রী হওয়ায় আমাকে সবাই অন্য চোখে দেখতো। অজয় রায় নামটিই ছিল আমার জন্য বড় সহায়।

আমি যখন চাকরি থেকে অবসর নিই তখন জীবন বীমা করপোরেশনের এমডি ছিলেন আমাদের পূর্বপরিচিত ইকরাম আহমেদ। তিনি তাঁর চাকরি জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। সবশেষে তিনি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান পদেও ছিলেন। ইকরাম আহমেদ একসময় উদীচীর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অফিসে আমার ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠানে ইকরাম আহমেদ সভাপ্রধান ছিলেন।

জীবনে কত মানুষের সঙ্গে পরিচয়, কতজনের সঙ্গে কত স্মৃতি – তার সব কি আর মনে আছে? তবে যা মনে আছে তা থেকেই কিছু তুলে ধরতে পেরে তৃপ্তি বোধ করছি।