বাংলা কাব্য-রূপান্তর : অসীম সাহা
চতুর্থ পর্ব
সপ্তম সর্গ
তাহার মনে চাঁদের হইলো উদয়।
তাহার আলোতে জ্যোৎস্না নির্মল হয় ॥
তা দেখে বেশ্যার মন মানে না প্রবোধ।
নিজের ভেতরে তার হলো পাপবোধ ॥
দেহের কলঙ্ক তার স্পষ্ট দেখা যায়।
আকাশমণ্ডলী তাতে সুন্দর দেখায় ॥
দিকচক্রবাল যেন সিঁদুরের ফোঁটা।
তেমনি সম্পূর্ণ হইলো চন্দ্রের ওঠা ॥
বৃন্দাবনমাঝে ফুটলো আলোকমালা।
দেখে রাধার দেহে উঠলো কামজ্বালা ॥
যখনি এভাবে হলো চাঁদের উদয়।
কৃষ্ণের দেরি দেখে রাধার চিন্তা হয় ॥
নানাভাবে আর্তনাদ করে রাধিকায়।
পরিতাপ করে কাঁদে, খুব জোরে হায় ॥
গীত
রাগ : তাল :
এবার যাবো আমি, কার নেবো আশ্রয়।
নেবো না সখির কথা, কেহ যদি কয় ॥
সময় করিয়া তুমি, কেন নাহি এলে।
এমন যৌবন তুমি ব্যর্থ করে দিলে ॥
রাত্রে যাহার জন্যে বেছে নিলাম বন।
সে-কারণে কামরসে ভরে ছিলো মন ॥
এরচেয়ে ছিলো ভালো আমার মরণ।
বিরহ-আগুন-জ্বালা যায় কি সহন ॥
কী দুঃখে কাঁকন পরে আর অলংকার।
হরির বিরহানলে সব গেলো তার ॥
আমার জীবনে আর সেই মধুরাত।
হলো না তো হায়, কৃষ্ণ দিলো অন্যে সাথ ॥
আমার গলার মালা হয়ে কামবাণ।
অঙ্গ মোর বিদ্ধ করে, বিদ্ধ করে প্রাণ ॥
তাহার জন্যে আমি ঘোর অরণ্যে থাকি।
হরি তো আমায় শুধু দিতে চায় ফাঁকি ॥
জয়দেব বলে, রাধা করো না বিলাপ।
তুমিহীন কানুমনে আছে পরিতাপ ॥
কেন তবে এলো না সে নিকটে আমার।
হয়তো কোনো সংকট হয়েছে তাহার ॥
নাকি অন্য কামিনীর সাথে গেছে চলে।
নাকি খেলা বন্ধ তাঁর, যতো সখিদলে ॥
অতিশয় অন্ধকারে বটে এই বন।
পথ ভুলে অন্য পথে করো হে ভ্রমণ ॥
এই কুঞ্জবনে আমি আসি সোজা পথে।
এই মন বিষণ্ন হতো না কোনোমতে ॥
বেতগাছ দিয়ে তৈরি অপরূপ বনে।
ইঙ্গিত করে কানু মিলতো মোর সনে ॥
আমাকে কৃষ্ণের আর পড়ে না তো মনে।
এ-কারণে কৃষ্ণ কি আর আসলো না বনে ॥
এইসব ভাবনায় মরে চন্দ্রমুখী।
এ-সময়ে মোর কাছে এলো এক সুখী ॥
কৃষ্ণকে আনার জন্যে যারা গিয়েছিলো।
সখি ছাড়া কৃষ্ণকে দেখতে নাহি পেলো ॥
কিছুই হলো না তাই, বিষণ্ন বদন।
বলতে পারে না তারা প্রকৃত কারণ ॥
রাধিকাকে দেখে ফের সেই সখিমুখ।
তাকে মনে করে রাধা পায় খুব দুখ্ ॥
কৃষ্ণ অন্য সখিসনে খুব করে রতি।
আমাকে অবজ্ঞা করে খুব, সে সম্প্রতি ॥
সেই নারী ভাগ্যবতী, পুণ্য তার কতো।
আমাকে ছাড়িয়া কৃষ্ণ তার অনুগত ॥
সখি, কী গো দেখে এলে নিজে দুই চোখে।
তাহার কারণে সখি, আমি মরি শোকে ॥
কৃষ্ণের ভক্ত যতো কামিনীগণ আছে।
তাঁর প্রশংসা করে মোর দূতির কাছে ॥
যে নারীর সাথে কৃষ্ণ করেছে রমণ।
তাদের তো রূপ-গুণ করে সে বর্ণন ॥
অষ্টম সর্গ
কোনোমতে রাত্রি পার করে।
পরাভূত হয়ে কাম-জ্বরে।
সকালে দেখিলো সেথা বন্ধু বলে মিছে কথা
উপেক্ষিয়া সে-মিনতি-প্রণতি,
হিংসায় বলে কথা সেই শ্রীমতী।
গীত
রাগ : ভৈরব। তাল : যতি
তন্দ্রাবিহীন রাত কেটে গেলো জাগরণে
তোমার অলস চোখ দেখি।
প্রিয়া-প্রেমে রসে-বশে প্রসারিত দুই চোখ
এ-ভুবনে এলে তুমি এ কী?
মাধব ফিরে যাও বাজে কথায় ফল পাও?
যাকে পেয়ে তুমি প্রীত তার গৃহে তুমি যাও।
কাজলেতে দাও চুমু, রাঙা ঠোঁট হয় নীল
কানুর দেহের সাথে তুমি পাও তার মিল।
তোমার দেহেতে দেখি নখরের রেখা।
পাথরেতে সোনা দিয়ে ‘রতিজয়’ লেখা।
পায়ের আলতা-দাগ বুকে আছে প্রিয়।
পদ্মবৃক্ষে কিশলয় অতি শোভনীয়।
দুই ঠোঁটে দাগ দেখে মনে জাগে খেদ।
মিছে ভাবি, দুইজনে নাই কোনো ভেদ।
দেহের বরণ মøান, নেই তার ফল।
অনুগতজনে কেন করো তবে ছল?
বনে বনে ঘোরো তাকে খেতে অবিরত।
চরিত্রটা যেন তার পূতনার মতো ॥
রাধিকার এ-বিলাপ শুনে জয়দেব।
মধুগীতি রচনায় করে হস্তক্ষেপ ॥
প্রিয়াপদ-আলতায়, বুকে স্রোতোধারা।
হৃদয়ের প্রীতি যেন দেয় তাকে নাড়া ॥
জানি, নাই ভালোবাসা দুঃখ তাতে নাই।
প্রতারক তুমি বলে আমি লজ্জা পাই ॥
বাঁশির সুরেতে সব আছে সুখলোকে।
মন্ত্রমোহিত যেন হরিণী দুই চোখে ॥
ঘুরে যায় মাথা, চায় আনন্দের ভরে।
খোঁপা খুলে পড়ে যায় ফুলগুচ্ছ ’পরে ॥
দানব-দলনে দেব খুব সুখী হয়।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.