পাঁচ শিল্পীর জীবন ও মারণাস্ত্র ভাবনায় মৃত্যু পরোয়ানা

মারণাস্ত্রকে কেন্দ্র করে ‘ডেথ সেনটেন্স’ বা মৃত্যুদণ্ড নামে পাঁচজন চারুশিল্পীর এক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী সম্প্রতি শেষ হলো ঢাকায় বেঙ্গল শিল্পালয়ের শিল্পী কামরুল হাসান প্রদর্শনালয়ে। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের প্রয়াত পরিচালক ও বাংলাদেশের শিল্পচর্চার অগ্রযাত্রার অনলস কর্মী সুবীর চৌধুরীর নামে তাদের গ্র্যান্টের জন্য জুয়েল এ. রবের আবেদন করা কিউরেটিয়াল প্র্যাকটিস গ্র্যান্ট গবেষণা প্রস্তাব বিবেচিত হয়। যুদ্ধ, যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণ ও এসবের প্রয়োগে মানুষের অংশগ্রহণ এবং ইতিহাসজুড়ে চলমান বিতর্কিত বাস্তবতার প্রতি কিউরেটরের সংবেদনশীল দৃষ্টি ও প্রতিক্রিয়ার নিরিখে তৈরি হয়েছে ‘ডেথ সেনটেন্স’ প্রকল্পের মূল ভাবনা।

গত ১৫ই ফেব্রুয়ারি থেকে ৩০শে মার্চ, ২০২৪ সময়সীমায় এই প্রদর্শনীর আয়োজন। দেখতে গেলাম গত ২২শে মার্চ, শুক্রবার। প্রদর্শনালয়ে ঢুকতেই গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো অদ্ভুত এক শব্দ! যেন ঢুকে পড়েছি এক যুদ্ধ-জাদুঘরে!

চোখে পড়লো ইংরেজিতে লেখা কিউরেটরিয়াল নোট। তাতে মারণাস্ত্র, যুদ্ধ এসবের বিপরীতে শিল্পীদের সৃজনাদর্শের বয়ান তুলে ধরা হয়েছে। যুদ্ধাস্ত্র কি প্রকারে যুদ্ধাশ্রয় থেকে ইতিহাস ও ঐতিহ্য হয়ে ওঠে সে নিয়ে আনিসুজ্জামান সোহেল তাঁর ভাবনা ও এর প্রকাশ দেখালেন আমাকে।

পৃথিবীসেরা দশটি অস্ত্র-কোম্পানির ব্র্যান্ডিং-লোগো তিনি গোল্ডলিফ পেপারে এঁকে কেটে স্থাপন করেছেন দশটি মৃৎপাত্রের খোদাইকৃত গায়ে।

আফগান মৌলবাদীদের হাতে বিনষ্ট বামিয়ান বুদ্ধের বিশাল মূর্তি, আইএসআই-এর হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত সিরিয়ার পালমিরার স্থাপত্যকীর্তি বেলে মন্দির, ইরাকের নিনেভে গেট, ক্রোয়েশিয়ার প্রাচীন শহর দুব্রেভনিক, বসনিয়ার সারায়েভোর প্রায় বিনষ্ট প্রাচীন সিটি হল – যুদ্ধবাজদের হাতে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত এসব স্থাপনার ইমেজ তুলে ধরে এই ঐতিহ্যবিরোধী যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশ করেছেন আনিসুজ্জামান সোহেল। তিনি বড় ফেব্রিয়ানো কাগজে জলরঙে তিনটি কাজ করেছেন প্রকাশক দীপনের ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডকে রূপক করে। মানুষের সঙ্গে পশুর দেহ, হাড়গোড়, অস্থি-মজ্জাকে একাকার করে জঙ্গিদের নৃশংসতাকে নির্দেশ করেছেন। আবার ক্ষমতার বাহন মস্তক-কাটা এক ঘোড়ার পিঠে সওয়ার করেছেন মানবকংকালকে! এমন প্রতিবাদী ও শিল্পিত বক্তব্য উপস্থাপন করে তিনি শিল্পের জয়গান করলেন।

শিল্পী এমরান সোহেল তাঁর চারটি উপস্থাপনার তিনটির শিরোনাম দিয়েছেন ‘ফিউরেনাল অফ ডেস্ট্রাকশন’। অন্যটি ভিডিওচিত্র। এতে দেখা যাচ্ছে, শিল্পী একটি অভিধানের পৃষ্ঠায় মুদ্রিত কোনো এক শব্দার্থ কলমের কালি দিয়ে বুজিয়ে দিচ্ছেন। এটি প্রতীকী কাজ। এর নেপথ্যে থেমে থেমে গুলি ও বোমার ভীতিকর শব্দ। তিনি ঘরে বসে মুছে দিচ্ছেন অভিধানে থাকা সমরাস্ত্রের মানে ও এসবের অর্থ, প্রতিবাদের অনন্য এক শিল্পভাষা!

দুটি মগজের জটিল চেহারা গড়ে এমরান সোহেল এর প্রথমটি নির্মাণ করেছেন। আদি অস্ত্র – দা, ছুরি, তলোয়ার, রামদা খণ্ড-বিখণ্ড করে তিনি দেখিয়েছেন অস্ত্রই কীভাবে অন্য অস্ত্রের শিকার হয়ে যায়! বড় ক্যানভাসে তাঁর আঁকা দুটি চিত্রে উঠে এসেছে মাংসের বন্যতা! এসব কাজ দর্শক মননকে আঘাত করে।

সিলেটের আতিয়া ভিলায় জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানের সময়  জঙ্গিদের গুলিবর্ষণে শিল্পী প্রমথেশ দাস পুলকের এক বন্ধু আহত হন। শিল্পী সেই বুলেটের পরিত্যক্ত খোসা সংগ্রহ করে যুদ্ধবাজনায় ব্যবহৃত তিনটি বিউগল, গিটারের ভেতরকার যন্ত্র ইত্যাদির সমাহারে একটি চলন্ত শব্দযন্ত্র নির্মাণ করেছেন। প্রদর্শনী হলে ঢুকেই গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো যে মন্দ্রশব্দ পাওয়া যায় সেটি শিল্পী প্রমথেশ দাস পুলকের গড়া স্থাপনা দিয়েই আসছে! বিউগলের সঙ্গে একটি চাকতি জুড়ে বিদ্যুতের সাহায্যে এটি ঘোরানো হচ্ছে, সেই চাকতিতে বুলেটের খোসা ঘড়ির সংখ্যার মতো সাজানো। চাকতি ঘোরে, যুক্ত একটি ধাতব কাঠি গুলির খোসায় বাধা পেয়ে যে শব্দ করছে, সেটি প্রদর্শনালয়ে থাকা একাধিক বিউগল দিয়ে বেরিয়ে আসছে মন্দ্রধ্বনি হয়ে! এছাড়াও তিনি ছুরি, ভোজালি, তলোয়ার, বন্দুক ও পিস্তল, রিভলভারের ছবির সঙ্গে মিলিয়ে হাতলে শিল্পিত ও দৃষ্টিনন্দন নকশা এঁকে জীবনঘাতী অস্ত্রের গায়ে সৌন্দর্যের বৈপরীত্যকে তুলে ধরে দর্শকের মনে অন্যরকম এক অভিঘাত সৃষ্টি করেছেন।

এছাড়া রাজতন্ত্রের যুগের যুদ্ধ, যুদ্ধাস্ত্র, যুদ্ধের পোশাক ও আচারের প্রতীকী চিত্র তুলে ধরেছেন শিল্পী প্রমথেশ দাস পুলক।

নাজমুননাহার কেয়া গোল্ডলিফ পেপার কেটে কেটে নানাবিধ অস্ত্রের নকশা জমিয়েছেন, শিরস্ত্রাণের প্রতিরূপ তৈরি করেছেন। এমনকি শক্তির প্রতীক ঘোড়ার অবয়বের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ বন্দুকের নকশা গড়েছেন। মারণাস্ত্র কিংবা যুদ্ধসামগ্রীর এই সৌন্দর্যবিস্তারী রূপ দেখে তো হত্যা ও যুদ্ধের ইচ্ছের সমাপ্তি ঘটা উচিত হন্তারকের! অর্থাৎ ধ্বংসের সামগ্রীর অবয়বে এই যে সৌন্দর্য সে তো নিজেই এসব ধ্বংসের বিপক্ষে, সৃজনের পক্ষে!

প্রদর্শনালয়ের এক দেয়ালে মনীষীদের জীবনমুখী যেসব নীতিবাক্য তুলে ধরেছেন শিল্পী কেয়া, তার মধ্যে মেসোপটেমীয় সভ্যতাকালে ব্যাবিলনের প্রভাবশালী সম্রাট ও আইনশাস্ত্রের প্রথম লিখিত রূপের প্রণেতা হাম্মুরাব্বির কথাও উৎকীর্ণ হয়েছে।

ভাস্কর শিমুল দত্ত এঁকেছেন ও গড়েছেন দেশীয় ও পুরনো অস্ত্রের ছবি ও এসবের প্রতিরূপ। দেয়ালে ঝুলছে তাঁর আঁকা কুঠার, ছুরি, ধারালো চাকু, গাদা বন্দুক, বেয়নেট ইত্যাদি। আবার নিচেই লম্বাটে এক বাক্সের পেটে এসবের গড়া রেপ্লিকা সাজিয়ে রাখা আছে। যেন, এসে দেখো সবাই – কী সুন্দর সব মারণাস্ত্র! এই আপাত সুন্দর দিয়ে মানুষ যুগে যুগে রচনা করছে তারই মৃত্যু-পরোয়ানা!

‘ডেথ সেনটেন্স’ আমাদের মানুষের অমানবিকতার বিরুদ্ধে, যুদ্ধক্লান্ত পৃথিবীর মানুষকে বাঁচাতে এক সচেতন ও শিল্পিত প্রতিবাদ। চোখ বুজে বলা যায়, এই প্রদর্শনীর শিল্পকর্ম ও পরিবেশনা বিশ্বমানের। আন্তর্জাতিক পরিসরে এই প্রদর্শনীটি নিয়ে গেলে দেশের চারুশিল্প ও আমাদের শিল্পীদের সৃজনক্ষমতা সম্পর্কে অন্যদের শ্রদ্ধাভক্তি বাড়বে বলেই মনে করি।

অসামান্য এই কিউরেটরিয়াল প্রদর্শনী আয়োজনের জন্য কিউরেটর জুয়েল এ. রব, অংশগ্রহণকারী শিল্পীপঞ্চম ও বেঙ্গল ফাউন্ডেশনকে ধন্যবাদ।