বনলতা সেনের সন্ধানে

আজিজুর রহমান খান

ড. আকবর আলি খানের চাবিকাঠির খোঁজে : নতুন আলোকে জীবনানন্দের বনলতা সেন (প্রথমা প্রকাশন, ফেব্রুয়ারি ২০১৪) গ্রন্থটির একটি বিশেষ সিদ্ধান্ত আমার এই ক্ষুদ্র নিবন্ধের মূল আলোচ্য বিষয়। ড. খানের বহুমুখী সৃজনকর্মের সঙ্গে আমার সীমিত পরিচয় তাঁর ইতিহাস, সমাজ ও অর্থনীতি বিষয়ক রচনায় সীমাবদ্ধ ছিল। সাহিত্য-সমালোচনার ক্ষেত্রে তাঁর রচনার সঙ্গে আমার পরিচয় এই বইটির সূত্রে।

ড. খান তাঁর বইটিতে জীবনানন্দের কবিতার বিশ্লেষণ করেছেন ‘চাবিকাঠির’ সহায়তায়। ‘এ চাবিকাঠি হচ্ছে তাঁর আপাত-দুর্বোধ্য কবিতায় ব্যবহৃত দুই-একটি বিশেষ শব্দ। এসব শব্দ হচ্ছে সাংকেতিক বার্তায় দুর্বোধ্যতার সমাধান’ (পৃ ১৪)। জীবনানন্দের বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থের নাম কবিতাটির অর্থ খোঁজার ক্ষেত্রেও তিনি চাবিকাঠি হিসেবে নির্বাচন করেছেন কবিতায় ব্যবহৃত ‘নাটোরের বনলতা সেন’, ‘দুদন্ড শান্তি’, ‘অন্ধকার’, ‘হাজার বছর ধরে পথ হাঁটিতেছি’, ‘বিদিশার নিশা’ ইত্যাদি শব্দ বা শব্দসমষ্টিকে (পৃ ৮৩)। কবিতাটির ২২ পৃষ্ঠাব্যাপী ‘নিবিড় বিশ্লেষণে’ তিনি যা আলোচনা করেছেন তা থেকে দুটি স্বতন্ত্র বিষয়কে প্রশ্নরূপে চিহ্নিত করা যায় : প্রথমত, কবি বনলতা সেন নামটি কোথা থেকে পেয়েছেন? দ্বিতীয়ত, কবিতাটিতে জীবনানন্দ বনলতা সেনকে নারী চরিত্র হিসেবে কীভাবে কল্পনা করেছেন? কবিতার বক্তা বা নায়কের সঙ্গে তার সম্পর্ক সম্বন্ধে জীবনানন্দের ভাবনা কী ছিল? আপাতদৃষ্টিতে প্রশ্নদুটি স্বতন্ত্র যদিও তাদের মধ্যে সম্বন্ধ থাকা অসম্ভব নয়।

ড. খান প্রথম প্রশ্নটির কোনো সুনির্দিষ্ট উত্তর খুঁজে পাননি। এ-প্রসঙ্গে তিনি বিভিন্ন সম্ভাবনা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত করেছেন যে, নামটি কবি কোথা থেকে সংগ্রহ করেছিলেন তা জানা সম্ভব নয়। তিনি দ্বিতীয় প্রশ্নটির যে উত্তর দিয়েছেন তা এই যে, চাবিকাঠিগুলো সুস্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে যে, কবিতার বনলতা সেনকে কবি চিহ্নিত করেছেন একজন গণিকা রূপে। এই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণভাবে ড. খানের ‘চাবিকাঠি’ নির্ধারণ এবং নির্ধারিত চাবিকাঠিগুলোর অর্থ নিরূপণের ওপর নির্ভরশীল।

ড. খান ‘নাটোর’কে একটি চাবিকাঠি হিসেবে গণ্য করেছেন এবং (তাঁর তথ্য অনুযায়ী) নাটোর সে-সময়ের একটি প্রধান গণিকা-অধ্যুষিত এলাকা, এই যুক্তিতে এবং অন্যান্য কয়েকটি চাবিকাঠির সমর্থনে কবিতার বনলতা সেনের গণিকাবৃত্তির সম্ভাব্যতা নির্ণয় করেছেন। নিছক বনলতা সেন নামটি থেকে তিনি এই অনুমান বা সিদ্ধান্তের সমর্থন খুঁজে পেয়েছেন এমন দাবি তিনি করেননি। এক্ষেত্রে জীবনানন্দ কোন বিশেষ অনুষঙ্গে বনলতা সেন নামটি পেয়েছিলেন এমন তথ্য পাওয়া গেলে ড. খান তাঁর নিজস্ব পদ্ধতি প্রয়োগ করে বিবেচনা করে দেখতে পারেন যে, সেই বিশেষ অনুষঙ্গে বনলতা সেন নামটি চাবিকাঠি হিসেবে চরিত্রটির অন্য কোনো পরিচয় নির্দেশ করে কিনা।

ড. খানের বইটি পড়ার বেশ কিছুকাল আগেই জীবনানন্দ কোন অনুষঙ্গে নামটি পেয়েছিলেন সে-সম্বন্ধে আমি একটি তথ্য জানতে পারি অশোক মিত্রের একটি প্রবন্ধ থেকে। ‘বনলতা সেন’ কবিতাটির প্রথম প্রকাশের পর ৭৫ বছর অতিক্রান্ত হওয়া উপলক্ষে ২১ ডিসেম্বর ২০১০ তারিখের আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘রাজশাহি জেলে বন্দি ছিলেন এক বনলতা সেন’ শিরোনামে অশোক মিত্রের যে প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় তা থেকে উদ্ধৃত করছি :

এক নিভৃত সন্ধ্যায় জীবনানন্দের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম, বনলতা সেন নামটি কবিতায় ব্যবহারের জন্য তাঁর কী করে মনে এলো; সেইসঙ্গে এটা জিজ্ঞেস করেছিলাম, কবিতাটির অন্তঃস্থিত অন্ধকারের প্রসঙ্গ তাঁর কি আগে থেকেই ভাবা ছিল, নাকি বনলতা সেন নামটি বেছে নেওয়ার পর কবিতাটি নিজের নিয়তি নির্ধারণ করেছে। দ্বিতীয় প্রশ্নের কোনো জবাব পাইনি। জীবনানন্দ শুধু জানিয়েছিলেন, সেই সময় আনন্দবাজার পত্রিকায় মাঝে মাঝে নিবর্তক আইনে বন্দিরা কে কোন কারাগারে আছেন, বা কোন জেল থেকে কোন জেলে স্থানান্তরিত হলেন, সে-সমস্ত খবর বেরোত। হয়তো ১৯৩২ সাল হবে, নয়তো তার পরের বছর, বনলতা সেন নাম্নী এক রাজবন্দি রাজশাহি জেলে আছেন, খবরটা তাঁর চোখে পড়েছিল, রাজশাহি থেকে নাটোর তো একচিলতে পথ। ইতিবৃত্তের এখানেই শেষ। প্রাক্স্বাধীনতা যুগে রাজবন্দিনী সেই মহিলা পরে গণিতের অধ্যাপিকা হয়েছিলেন, কলকাতার কলেজেও পড়িয়েছেন। বিবাহোত্তর পর্বে অন্য পদবী ব্যবহার করতেন, তাঁর সঙ্গে সামান্য আলাপ হয়েছিল। ভব্যতাবশতই জিজ্ঞেস করা হয়নি তিনি কবিতাটির সঙ্গে আদৌ পরিচিত কিনা। কিছু কিছু রহস্যকে অন্ধকারে ঢেকে রাখাই সম্ভবত শ্রেয়।

এই প্রবন্ধটি পরে অশোক মিত্রের বিক্ষিপ্ত অর্ধশতক (আনন্দ পাবলিশার্স, জানুয়ারি ২০১৪) নামে প্রবন্ধ সংকলনে ‘বনলতা সেন’ নামে অন্তর্ভুক্ত হয়।

অশোক মিত্র বাংলাদেশে সুপরিচিত। স্বাধীনতাযুদ্ধে বাংলাদেশের বিদেশি বান্ধবদের একজন হিসেবে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সম্মানিত করেছে। জীবনের ন্যূনাধিক প্রথম দুই দশক তিনি ঢাকাবাসী ছিলেন। অর্থনীতিবিদ হিসেবে তিনি খ্যাতিমান, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করেছেন। বেশ কিছুদিন তিনি ভারত সরকারের অর্থ-মন্ত্রকে প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে ১৯৭৭-এ মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন বামপন্থী সরকারে তিনি অর্থমন্ত্রী হন এবং দশ বছর সেই পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। পরে ভারতের রাজ্যসভার সদস্য হয়েছিলেন।

পেশাগত এবং রাজনৈতিক কর্মের পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর আশৈশব ঘনিষ্ঠ যোগ। কবিতা-সম্পাদক বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে তাঁর দীর্ঘকালীন নৈকট্য ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, কবিতার প্রথম বছরের দ্বিতীয় সংখ্যায়, ১৩৪২ বঙ্গাব্দের পৌষ, ‘বনলতা সেন’ কবিতার প্রথম প্রকাশ। জীবনানন্দ এবং তাঁর পরিবারকে অশোক মিত্র ঘনিষ্ঠভাবে চিনতেন। বাংলার বাইরে পাঠরত এবং কর্মরত থাকার সময় ছুটিতে তিনি যখন কলকাতায় বাবা-মার কাছে যেতেন, তখন তাঁদের বাসা থেকে অনতিদূরবর্তী জীবনানন্দের বাসাতেও তাঁর যাতায়াত ছিল। তিনি সাম্প্রতিককালের বাংলা ভাষার শক্তিমান প্রাবন্ধিকদের অন্যতম।

ড. খানের বইটি পড়ার পর গত বছর আমি অশোক মিত্রের সঙ্গে পত্রালাপে বাস্তবের বনলতা সেন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করি। এ-বছর ২০১৫-র ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতায় আমি তাঁর সঙ্গে দুবার দেখা করে এ-সম্বন্ধে আরো আলোচনা করি। জানতে পারি যে, তিনি অর্থমন্ত্রী থাকার সময় বনলতা (ইতিপূর্বে যার পদবি, বিবাহের পর, সেন থেকে চক্রবর্তীতে পরিবর্তিত হয়েছে এবং যিনি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন) কার্যোপলক্ষে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। অশোক মিত্রের কাছে আমি এই বনলতা সেনের কন্যা, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপিকা, সুস্মিতা রক্ষিতের কথা জানতে পারি। এই বনলতার সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয় ছিল এমন আরো লোকের সন্ধান করে খ্যাতিমান কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এবং তাঁর স্ত্রী সুষমা চক্রবর্তীর খোঁজ পাই। সুষমা চক্রবর্তী বনলতার অনুশীলনোত্তর রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে সুপরিচিত। তাঁরা একই সময়ে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন এবং প্রেসিডেন্সি জেলে তিন বছর কারারুদ্ধ ছিলেন। আমি সম্প্রতি এঁদের সবার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছি। সুস্মিতা রক্ষিত তাঁর মা সম্বন্ধে কিছু তথ্য জানিয়েছেন। সুষমা এবং নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁদের ‘বনদি’ সম্বন্ধে কিছু স্মৃতি রোমন্থন করেছেন। কিন্তু তাঁরা কেউ জীবনানন্দ কোন সূত্রে বনলতা সেন নামটি পেয়েছিলেন              সে-সম্বন্ধে কোনো স্বতন্ত্র তথ্য জানেন না। এ-বিষয়ে তাঁরা অশোক মিত্রের প্রবন্ধটিকে তথ্যসূত্র হিসেবে জানেন।

বনলতা সেন সম্পর্কে আমি আরো কিছু তথ্য পেয়েছি Marxist Indiana নামে একটি Encyclopedia থেকে উদ্ধৃত একটি রচনা থেকে। এই সমস্ত তথ্যের ভিত্তিতে আমি বনলতা সেনের নিম্নোক্ত সংক্ষিপ্ত জীবনকথা সংকলন করেছি।

 

বনলতার জন্ম হয় ১৯১৫ সালে ফরিদপুরে। অল্প বয়সে তিনি অনুশীলন সমিতি নামে বিপ্লবী (ইংরেজের ভাষায় সন্ত্রাসবাদী) দলে যোগ দেন। তিনি ১৯৩৩-৩৫-এর ‘আন্তঃপ্রাদেশিক ষড়যন্ত্র মামলা’য় জড়িত হয়েছিলেন। আমার অনুমান, এর ফলে তিনি কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। সম্ভবত এই কারাবাস স্বল্পকালীন ছিল। সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৩৯-এ কংগ্রেস ত্যাগ করলে তিনি তাঁর সঙ্গে যোগ দেন। ১৯৪২ সালে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের সময় মিছিলের পুরোভাগে তিনি পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হন এবং প্রেসিডেন্সি জেলে তিন বছর কারাবাস করেন। জেল থেকে পরীক্ষা দিয়ে তিনি অর্থনীতি শাস্ত্রে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৪৫ সালে মুক্তিলাভের পর তিনি অনুশীলন সমিতির কাল থেকে তাঁর সহকর্মী সরোজ কুমার চক্রবর্তীকে বিয়ে করেন। তাঁরা Revolutionary Socialist Party-তে যোগ দেন। পরবর্তীকালে বনলতা মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। কর্মজীবনে তিনি ঠাকুরপুকুর বিবেকানন্দ কলেজে অর্থনীতিতে অধ্যাপনা করেছেন (অশোক মিত্র ভুলক্রমে তাঁকে গণিতের অধ্যাপিকা বলেছেন)। ১৯৮৮ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।

আলোচিত তথ্যগুলোর ভিত্তিতে উপনীত মূল সিদ্ধান্তগুলোর সংক্ষিপ্তসার উপস্থাপন করছি :

প্রথমত, অশোক মিত্রের প্রবন্ধের তথ্যটিই আমার জানা একমাত্র সাক্ষ্য যে, জীবনানন্দ রাজশাহী-জেলে-আটক জনৈকা রাজবন্দিনীর নাম থেকে ‘বনলতা সেন’ নামটি সংগ্রহ করেন। অন্য যাঁরা এ-তথ্যটি সম্পর্কে অবহিত তাঁরা এর সপক্ষে কোনো স্বতন্ত্র সাক্ষ্য সম্বন্ধে পরিজ্ঞাত নন। অবশ্য এটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। জীবনানন্দের মৃত্যুর পর ষাট বছরের বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। জীবৎকালে কবি হিসেবে তাঁর স্বীকৃতি সীমিত ছিল। তাঁর কবিতার নামকরণ সম্বন্ধে এ-ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে লিপিবদ্ধ করার তাগিদ যে বিশেষ কেউ উপলব্ধি করেননি তাতে বিস্মিত হওয়ার কারণ নেই।

দ্বিতীয়ত, এই একমাত্র প্রত্যক্ষ সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ‘বনলতা সেন’ কবিতার নামের উৎস নির্ধারণে আমার কোনো দ্বিধা নেই। জীবনানন্দের মৃত্যুর সময় অশোক মিত্রের বয়স ছিল সাতাশ বছর। প্রবন্ধটিতে উল্লিখিত কথোপকথনটির সময় তাঁর বয়স ন্যূনাধিক পঁচিশ বছর। প্রবন্ধটির ঝকঝকে বুদ্ধিদীপ্ত ভাষা,  গভীর-অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন বাক্যবিচার কোনোপ্রকার স্মৃতিবিভ্রমের সম্ভাবনা সংক্রান্ত সন্দেহ অনায়াসে উৎপাটন করে। প্রবন্ধটি সাড়ে চার বছর আগে একটি বহুপঠিত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সেকালের সঙ্গে পরিচিত অনেকেই প্রবন্ধটি পড়েছেন। কেউ এ-সম্বন্ধে কোনো বিস্ময়, সংশয় বা প্রতিবাদ প্রকাশ করেছেন বলে আমার জানা নেই। তথ্যবিচারের প্রচলিত এবং স্বীকৃত মানদন্ডে এই সাক্ষ্য অনায়াসে গ্রহণযোগ্য। সাক্ষ্যটির প্রকৃত মূল্য এই যে, এর মধ্য দিয়ে ‘বনলতা সেন’ নামটির উৎস সম্পর্কে জীবনানন্দের নিজস্ব বিশ্বাস ব্যক্ত হয়েছে যে, নামটি তিনি রাজশাহী জেলে নিবর্তক আইনে বন্দিনীর নাম থেকে পেয়েছেন। কবিতাটি রচনার প্রায় দু-দশক পর নিভৃত আলোচনায় অশোক মিত্রকে তিনি এ-কথা বলেছিলেন।

তৃতীয়ত, ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের সময় – ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত – তিন বছর জেলবাস অতিবাহিত করেছিলেন বাস্তবের বনলতা সেন প্রেসিডেন্সি জেলে। জীবনানন্দ যে বনলতা সেনের নাম ব্যবহার করেছিলেন তিনি রাজশাহী জেলে রাজবন্দিনী ছিলেন ১৯৩২ বা ১৯৩৩ সালে। আমার মতে এই আপাতবিরোধের ব্যাখ্যা এই যে, অনুশীলন সমিতির কর্মী হিসেবে আন্তঃপ্রাদেশিক ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার ফলে তিনি ১৯৩৩ সালে প্রথমবার জেলবাস করেছিলেন। বস্ত্তত এ-ধরনের মামলায় অভিযুক্ত আসামির পক্ষে সে-সময় কারারুদ্ধ না হওয়া নিতান্ত অস্বাভাবিক হতো।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, Marxist Indiana-র তথ্য অনুযায়ী সে-সময়ের বিপ্লবী আন্দোলনে বনলতা দাশগুপ্ত নাম্নী অন্য এক কর্মীও যুক্ত ছিলেন। তাঁর জন্ম ১৯১৫ সালে ঢাকায়। তাঁর স্বল্পকালীন জীবন ছিল বর্ণাঢ্য। তিনি ১৯৩৩ সালে বেঙ্গল ফ্লাইং ক্লাবে শিক্ষানবিশ ছিলেন। হোস্টেলে তাঁর ঘরে পিস্তল রাখার অপরাধে তিনি হিজলি এবং প্রেসিডেন্সি জেলে কারারুদ্ধ থাকেন। অসুস্থ অবস্থায় কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১৯৩৬ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।

ঠিক কেমন করে জীবনানন্দ-বর্ণিত রাজবন্দিনী এবং আমাদের বাস্তবের বনলতা সেন/ চক্রবর্তী যে একই ব্যক্তি নিরূপিত হয়েছে তা জানার উদ্দেশ্যেই আমি বনলতা সেন/ চক্রবর্তীর পরিচিত কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। আগেই বলেছি, আমি এ বিষয়ে কোনো তথ্য পাইনি। একজন দ্বিতীয় বনলতার উপস্থিতি শনাক্ত করার সমস্যাকে জটিল করেছে, এমন মনে করা অসংগত নয়। এ দুজনের মধ্যে ‘আমাদের বনলতা সেন’ জীবনানন্দের কবিতার নামকরণের উৎস, এই লোকবিশ্বাসের কারণ প্রথমত তাঁর ‘সেন’ পদবি এবং দ্বিতীয়ত বনলতা দাশগুপ্তের কারাবাসের সুস্পষ্ট ঠিকানা হিজলি এবং প্রেসিডেন্সি জেল। বনলতা সেনের প্রথম কারাবাসের তথ্য অস্পষ্ট এবং জীবনানন্দের উক্তির সঙ্গে প্রত্যক্ষ-অসংগতিমুক্ত। এ বিষয়ে সুস্পষ্ট প্রমাণের জন্য আনন্দবাজার পত্রিকায় ছাপানো খবরটির সন্ধান করা প্রয়োজন। সেটা আজ দুঃসাধ্য।

কিন্তু এই বিতর্ক একান্ত অপ্রয়োজনীয়। ঠিক কোন মানবী জীবনানন্দ-বর্ণিত রাজবন্দিনী তা প্রমাণ করার চেষ্টা অর্থহীন। এ-বিষয়ে একমাত্র প্রয়োজনীয় তথ্য এই যে, জীবনানন্দ ১৯৩২ বা ১৯৩৩ সালে রাজশাহী জেলে আটক এক বন্দিনীর নামকে একটি বিমূর্ত নাম হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, বাস্তব নামধারিণী সম্বন্ধে তাঁর কোনো ধারণা বা আগ্রহ ছিল না। প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে যে, বাস্তবের বনলতা সেন/ চক্রবর্তী নিজেও সম্ভবত এ-বিষয়ে সচেতন ছিলেন। তাঁর সঙ্গে পরিচিত ছিলেন এমন একাধিক ব্যক্তি উল্লেখ করেছেন যে, বাংলা ভাষার একটি মহৎ কবিতা তাঁর নামাঙ্কিত এ-বিষয়ে তিনি নির্লিপ্ত ছিলেন, কখনো কোনোরকমের শ্লাঘা প্রকাশ করতেন না।

এই নিবন্ধের মূল বক্তব্য ‘বনলতা সেন’ নামটির উৎসসন্ধান। সে-বক্তব্যের এখানেই সমাপ্তি হতে পারত, কিন্তু নাম নির্ধারণ এবং নামধারিণীর চরিত্রচিত্রণ স্বতন্ত্র বিষয় হলেও তাদের মধ্যে সম্বন্ধ থাকা সম্ভব। ড. আকবর আলি খান স্বয়ং জীবনানন্দকে উদ্ধৃত করেছেন : ‘সাহিত্যে যখন কোনো চরিত্রের নাম দেওয়া হয়, তখন সে নামের সঙ্গেও রূপের একটি ভাবনা থাকে না কি?’ (পৃ ৭২) ড. খান তাঁর চাবিকাঠি পদ্ধতি প্রয়োগ করে নির্ধারণ করেছেন যে, বনলতা সেন সম্বন্ধে এইরূপ ভাবনাটি ছিল যে, সে একজন গণিকা। ড. খান তাঁর নিবিড় বিশ্লেষণে কবিতাটির নিম্নোক্ত অর্থ নিরূপণ করেছেন : নায়ক বৌদ্ধধর্ম-নির্দেশিত নির্বাণের অন্বেষণে দীর্ঘ যাত্রায় ক্লান্ত। পথে ‘নাটোরের বনলতা সেন’ নামের গণিকার সান্নিধ্যে দুদন্ড শান্তি পেলেন। কিন্তু গণিকা তার সঙ্গে স্থায়ী প্রেম সম্পর্ক প্রত্যাখ্যান করল। গণিকা-সংসর্গের পাপে নায়কের নির্বাণ অন্বেষণ ব্যর্থ হলো। ব্যর্থ যাত্রার শেষে জীবনসায়াহ্নে ক্লান্ত নায়কের অন্তরে গণিকা বনলতার স্মৃতি অম্লান।’

বৌদ্ধ-দর্শনের সঙ্গে এই ব্যাখ্যার সংগতি অথবা এর নন্দনতাত্ত্বিক মূল্যায়ন আমার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু ড. খানের ব্যাখ্যার একটি প্রয়োজনীয় ভিত্তি এই যে, তাঁর চাবিকাঠি পদ্ধতি নির্দেশ করে যে, বনলতা সেন একজন বারাঙ্গনা। এটা মোটামুটি স্পষ্ট যে, অশোক মিত্রের প্রবন্ধটি তাঁর নজরে পড়েনি। প্রবন্ধটির সঙ্গে তাঁর পরিচয় থাকলে তিনি নিশ্চয়ই তথ্যটি উপেক্ষা করতেন না। সেক্ষেত্রে তিনি নিশ্চয়ই ‘বনলতা সেন’ নামটিকে একটি স্বতন্ত্র চাবিকাঠি হিসেবে গণ্য করতেন। আমার সবিনয় প্রশ্ন, যে-নারীকে কবি গণিকারূপে কল্পনা করেছেন তার জন্য নাম নির্বাচন করেছেন জনৈকা রাজবন্দিনীর নামে, এই যুক্তি কি গ্রহণযোগ্য হতো? বস্ত্তত ড. খান কবিতার বনলতা সেনকে গণিকারূপে চিত্রিত করার জন্য বিভিন্ন শব্দের এবং বাক্যের যে-ব্যাখ্যা দিয়েছেন তার সঙ্গে অনেকেই ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন। ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’ প্রশ্নটিকে তিনি প্রত্যাখ্যান বলে বর্ণনা করেছেন। আমি বাক্যটিকে সানন্দ অভ্যর্থনা বলে মনে করি। যার আসার পথ চেয়ে ছিলাম, কিন্তু যার আসা অনিশ্চিত ছিল, তার আকস্মিক আবির্ভাবে আমরা সানন্দ বিস্ময়ে অভ্যর্থনা করি : ‘এসো, এসো, কোথায় ছিলে এতদিন?’ এ-কথাটি কবিতার বনলতা – বিংশ শতাব্দীর চতুর্থ দশকে আমাদের নগরবাসিনী পড়শিনী – তাঁর মার্জিত ভাষায়, সম্মানসূচক সর্বনাম ব্যবহার করে কবিতার বক্তাকে স্বাগত জানানোর জন্য উচ্চারণ করেছেন। প্রত্যাখ্যাত জন প্রত্যাখ্যানকারীর ‘পাখীর নীড়ের মতো’ স্বস্তিদায়ক চোখ দেখতে পায় না। এ-ধরনের আরো উদাহরণ অনায়াসে দেওয়া যায়। কাব্যবিচারের যোগ্যতা আমার নেই। কিন্তু আমি কবিতার অনুরাগী পাঠক। কবিতাপাঠের ক্ষেত্রে আমি চাবিকাঠি পদ্ধতির কোনো উপযোগিতা খুঁজে পাই না। পদ্ধতিটির ত্রুটি সুস্পষ্ট : প্রথমত, চাবিকাঠি নির্ধারণের কোনো নির্দিষ্ট ব্যাকরণ নেই, বিভিন্ন পাঠক/ বিশ্লেষক ভিন্ন ভিন্ন শব্দ বা বাক্যাংশকে চাবিকাঠি হিসেবে নির্বাচন করতে পারেন। দ্বিতীয়ত, কোনো একটি চাবিকাঠিকে বিভিন্ন বিশ্লেষক বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন। কবিতা উপলব্ধি করতে, কবিতাতে আবিষ্ট হতে এই পদ্ধতি কেবল অপ্রয়োজনীয় নয়, প্রত্যক্ষ বাধাস্বরূপ।

মহৎ কবিতার বৈশিষ্ট্য এই যে তা বিভিন্ন পাঠককে, বিভিন্ন কালের পাঠককে, বিভিন্ন উপলব্ধিতে অনুপ্রাণিত করে। ‘বনলতা সেন’ কবিতা সম্বন্ধে আমার নিজের উপলব্ধি অশোক মিত্রের ব্যাখ্যার সমার্থক। আমি তাঁর অননুকরণীয় ভাষার আশ্রয় নিলাম :

এমন করে তো এর আগে কোনো কবি তার অন্বেষণের কথা, অনাদি-অনন্ত কাল-বলয়জুড়ে তার বিপর্যস্ত সভার যতিহীন বিহারের, তার বিপন্নতার কথা, দুঃসহ নিঃসঙ্গতার কথা বাংলা কাব্যের কোনো অধ্যায়েই ব্যক্ত করেননি। প্রতিটি পঙ্ক্তিতে, প্রতিটি শব্দগুচ্ছের বিন্যাসে মানব সভ্যতার ইতিহাস যেন বিধৃত হয়ে আছে। সেই ইতিহাসের রহস্য অনুদ্ঘাটিত, তার অন্ধকার পেরিয়ে ফের অন্ধকার, আরো ঢের অন্ধকার। এই অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ এক নারীর প্রসঙ্গ। সমান রহস্যে আবৃতা সেই নারী।… অথচ এই রহস্যাবৃতাই পর্যুদস্ত পথশ্রান্ত পরিব্রাজককে দুদন্ড শান্তি বিলোতে সমর্থ।… মহাকালের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মহাসমুদ্রের পরিব্যাপ্ত অন্ধকার। হঠাৎ এই নারী। চুল তার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য, অর্থাৎ তারও অবয়বজুড়ে সুদূর অতীতের অন্ধকার ঐশ্বর্য। কিন্তু পাঠকবৃন্দ স্তম্ভিত, হকচকিত। এই নারী তাদের চেনা পরিবৃত্তের, নাটোরের বনলতা সেন। ইতিহাসের রূপকথার সঙ্গে ঝট করে আধুনিক সমাজ যুক্ত হয়ে গেল। হোঁচট খেতে খেতেও পাঠককুল সামলে নেন তাঁদেরও আবিষ্কারের আনন্দ, ইতিহাসের অন্ধকারের ঐতিহ্য – রহস্যের ঐতিহ্য – বহন করছে আধুনিক সমাজজীবন, এই নারী, বনলতা সেন। তিনি তো এ-পাড়ারই মহিলা, নয়তো পাশের পাড়ার। কবিতা এক মুহূর্তে সান্নিধ্যে  চলে এলো, পাখির নীড়ের মতো। চোখ উন্মীলন করে বনলতা সেন বাংলা কবিতাকে আধুনিকতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিলো।’

তা হলেও জীবনানন্দের যন্ত্রণাকাতরতার সমাপ্তি নেই, যে-রহস্য কবিকে কুরে খাচ্ছে, তা ঘোচবার নয়, অন্ধকার অপরাজেয়। সন্ধ্যা নামে। পৃথিবীর দেনা-পাওনার নিবৃত্তি, সব পাখি ঘরে ফিরে আসে, পুঞ্জীভূত অন্ধকার, সেই রহস্যলগ্নার সঙ্গে মুখোমুখি। তবু স্রেফ দুদন্ড শান্তি কেন, সেই আশ্রয়দাত্রীর ভূমিকা কেন চিরন্তন নয়? কবি নিজেও উত্তর জানেন না। সন্ধ্যা নামলে সব পাখি ঘরে ফেরে, কিন্তু সব নদী? অন্ধকার জমাট হয়ে অবতরণ করলে নদীদের গন্তব্যের তো হেরফের হয় না। নদীদের উৎসে ফেরার উপায় নেই, তাদের মহাসমুদ্রের গভীরতর অন্ধকারের দিকে অভিযাত্রা অব্যাহত। ক্ষণিক মুহূর্তের শান্তি বিতরণের বেশি কিছু দিতে তাই নাটোরের বনলতা সেন অপারগ। ফের হাজার বছর ধরে পৃথিবীর পথে না হেঁটে পরিব্রাজকের পরিত্রাণ নেই, ইতিহাসের অন্ধকার তাকে গ্রাস করতেই থাকবে।