ফারজানা সিদ্দিকা
১৮৫০-এ সর্ব্বশুভকরী পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় বিদ্যাসাগরের ‘বাল্যবিবাহের দোষ’। সেখানে সৃষ্টিকর্তা যে জগতের সকল প্রাণীর মধ্যেই নারী ও পুরুষ সৃষ্টি করে সমতা বিধান করেছেন এবং মানুষ সৃষ্টির শুরু থেকেই যে বিবাহের প্রচলন ছিল না, সে-বিষয়ে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। বিবাহের উৎস সম্পর্কে লিখেছেন, ‘জগৎসৃষ্টির কত কাল পরে মনুষ্যজাতির এই বিবাহসম্বন্ধের নিয়ম চলিত হইয়াছে, যদ্যপি তদ্বিশেষ নির্দেশ করা অতি দুরূহ, তথাপি এইমাত্র উল্লেখ করা যাইতে পারে, যখন মনুষ্যমণ্ডলীতে বৈষয়িক জ্ঞানের কিঞ্চিৎ নির্মলতা ও রাজনীতির কিঞ্চিৎ প্রবলতা হইতে আরম্ভ হইল এবং যখন আত্মপরবিবেক, স্নেহ, দয়া, বাৎসল্য, মমতাভিমান ব্যতিরেকে সংসারযাত্রার সুনির্বাহ হয় না, বিবাহসম্বন্ধই ঐ সকলের প্রধান কারণ, ইত্যাকার বোধ সকলের অন্তঃকরণে উদয় হইতে লাগিল, তখনি দাম্পত্য সম্বন্ধ অর্থাৎ বিবাহের নিয়ম সংস্থাপিত হইয়াছিল সন্দেহ নাই।’ লক্ষ করা যেতে পারে, ‘মনুষ্যমণ্ডলীতে বৈষয়িক জ্ঞানের কিঞ্চিৎ নির্মলতা ও রাজনীতির কিঞ্চিৎ প্রবলতা’ – এ দুটি দিক নিয়ে। এই প্রবন্ধের ৩৪ বছর পর ১৮৮৪-এ প্রকাশ পেয়েছে ফ্রেডরিখ অ্যাঙ্গেলসের পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি – সমাজতান্ত্রিক নারীবাদের গোড়াপত্তন হয়েছে যে গ্রন্থের আলোকে – সেখানেও ব্যক্তিগত মালিকানাতে পরিবার ও রাষ্ট্রের উৎস সন্ধানে নারীর বিশ্ব-ঐতিহাসিক পরাজয়ের পেছনে সম্পদ বা সম্পত্তি বিষয়ে মানুষের, মূলত পুরুষের, বৈষয়িক জ্ঞান ও পুরুষ-আধিপত্যের রাজনীতিকেই চিহ্নিত করা হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, বিদ্যাসাগর এবং অ্যাঙ্গেলস – দুজনেরই জন্ম ১৮২০ সালে! সতীদাহপ্রথা, বাল্যবিবাহপ্রথা বা বিধবাবিবাহের ক্ষেত্রে যে তুমুল বাধা তার সবকিছুর পেছনেই এই সম্পদের অধিকার ও পুরুষ-আধিপত্যের রাজনীতিই যে বিদ্যমান সেটি স্পষ্টতই বুঝেছিলেন ভারতবর্ষের নারীদের দুই উদ্ধারকর্তা রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
ইতিহাস পর্যালোচনা করে বিদ্যাসাগর দেখিয়েছেন, পূর্বে সব জাতির মধ্যেই বেশি বয়সে বিয়ের প্রথা চালু ছিল। শাস্ত্রে আট প্রকার বিয়ের রীতি মানা হতো, তার মধ্যে গান্ধর্ব, আসুর, রাক্ষস, পৈশাচ – এই চার প্রকার বিয়ের রীতি বেশি প্রচলিত ছিল – এই বিয়েগুলো ‘অধিকবয়োনিষ্পন্ন’ হতো অর্থাৎ নারীর অধিক বা যথাযথ বয়সেই নিষ্পন্ন হতো। এছাড়া স্বয়ম্বর প্রথাও চালু ছিল – অধিক বয়সের নারীরাই সেই বিয়ের অধিকার পেত। ফলে, আট বছরের কন্যা বিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে পিতামাতার ‘গৌরীদানজন্য পুণ্যোদয়’, নয় বছরের কন্যার বিয়ের ফলে ‘পৃথ্বীদানের ফল লাভ’ এবং দশ বছরের কন্যার বিয়ের ফলে ‘পরত্র পবিত্রলোকপ্রাপ্তি’ হয় – এসবই যে কল্পিত এবং ‘পরিণাম-বিবেচনা-পরিশূন্য’ তা ইতিহাস-শাস্ত্র-যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন তিনি সেই প্রবন্ধে।
দেশ-কাল-পাত্রভেদে নারীবাদের কোনো একক সংজ্ঞা আজো তৈরি হয়নি। তবে, দেশ-কাল-পাত্রভেদেই এর চর্চা নিজস্ব আদলে চলেছে এবং চলছে। আজকের নারীবাদের বীজ পশ্চিম ইউরোপে বুর্জোয়া শ্রেণির অভ্যুত্থানের মধ্যেই নিহিত। ধনতান্ত্রিক উৎপাদনব্যবস্থার ওপরে যে বুর্জোয়া শ্রেণি প্রতিষ্ঠিত সেখানে ছিল লিঙ্গভিত্তিক শ্রমবিভাজনের চর্চা। বুর্জোয়া ব্যবস্থায় পুরুষ পেল বাইরের জগতের উৎপাদনমুখী কাজের অবাধ সুযোগ – পুরুষের এই ভূমিকাই মুখ্য হিসেবে গণ্য হলো। অন্যদিকে নারীর জন্য বরাদ্দ হলো অন্দরমহল এবং প্রজনন সংশ্লিষ্ট কাজকর্ম। সন্তান ধারণ, পালন-পরিচর্যা, রান্না, পারিবারিক পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থায় নারীর সামাজিক সংশ্লিষ্টতা বা অবদান হিসেবে গণ্য হলো। বাইরের জগতে পুরুষের উৎপাদনব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার তুলনায় অন্দরে নারীর প্রজনন সংশ্লিষ্টতা বিশেষভাবেই গৌণ হয়ে রইলো। অবশ্য এই সমস্তকিছুর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদী উচ্চারণটিও এসেছে বুর্জোয়া চিন্তাবিদদের মধ্য থেকেই। আঠারো শতকের বুদ্ধিজীবী মেরি উলস্টোনক্রাফট এবং উনিশ শতকে জন স্টুয়ার্ট মিল প্রথম চিহ্নিত করলেন যে, শিক্ষা এবং জ্ঞান থেকে নারীকে বঞ্চিত করার মধ্য দিয়েই তাদের অন্দরমহলে বন্দি রাখার সুব্যবস্থা করা হয়। আরো পরে, ১৯৪৯ সালে ফরাসি দার্শনিক সিমোন দ্য বোভায়া তাঁর সেকেন্ড সেক্স বইয়ে সামাজিক অবস্থানে নারীর ভূমিকাকে বিস্তৃত ব্যাখ্যা করে দেখান যে, মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে নারী মূলত দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত! নারীবাদ বিষয়ে এসব খবর বিদ্যাসাগরের জানার কথা নয়। নারীমুক্তি আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী মেরি কার্পেন্টার ভারতবর্ষে পৌঁছানোর বহু আগে থেকেই বিদ্যাসাগর নিজস্ব বিবেচনায় এক বিশেষ নারীবাদের চর্চা শুরু করেছিলেন। তাঁর সেই বিশেষ নারীবাদের সূচনায় ছিল অদম্য যৌক্তিক মানবতাবাদ। এখানে উল্লেখ করা জরুরি যে, মেরি কার্পেন্টারের সঙ্গেও যৌথভাবে মেয়েদের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজে তিনি যুক্ত ছিলেন। এখানে উল্লেখ করা জরুরি যে, ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ প্রবন্ধে নারী এবং পুরুষ উভয়ের জন্যই বাল্যবিবাহ শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির কী কী কারণ হয়ে ওঠে তা প্রমাণের জন্য যেসব যুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন সেসব যুক্তি আজো সমানভাবে প্রযোজ্য।
কলাবিদ্যার ছাত্র, শরীরতত্ত্বের শিক্ষক এবং মনোবিজ্ঞানের গবেষক উইলিয়ম জেমস (১৮৪২-১৯১০) তাঁর ১৮৯০-এ প্রকাশিত The Principles of Psychology বইয়ে উল্লেখ করেন, ‘ব্যক্তিসত্তা এক অখণ্ড অবিভাজ্য চৈতন্যের বহিঃপ্রকাশ নয়; তার মধ্যে অগণন ব্যক্তি, অসংখ্য সত্তা, লক্ষ চৈতন্যবিন্দুর গোপন সঞ্চরণশীলতা বিদ্যমান। সময়ের কোনো এক মুহূর্তে সেই বিন্দুগুলো অকস্মাৎ জেগে ওঠে, কখনো দল বেঁধে, কখনো স্রোতের মতো পরপর।’ বিদ্যাসাগরের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে অন্তত তাঁর জীবনচরিতের আলোকে গোপন চৈতন্যবিন্দুগুলোকে চিহ্নিত করা যায়। তিনি নিজে যে জীবনচরিত লিখেছেন সেখানে সেইসব বিন্দুর কথাই লিখেছেন যা তাঁর ব্যক্তিসত্তা গঠনে বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। তাঁর ভাই শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন প্রণীত বিদ্যাসাগরজীবনচরিত থেকেও একইরকম সূত্র মেলে। অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করার শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন পিতামহের কাছ থেকে। পিতার কাছ থেকে পেয়েছিলেন পরিশ্রমী হওয়ার মন্ত্র। সে-সময় দরিদ্র পরিবারে শিক্ষার কদর ছিল কেবল চাকরি পাওয়ার জন্যে। সেরকম দারিদ্র্য ছিল বিদ্যাসাগরের পরিবারেও। অথচ ১৮৩৯ সালে হিন্দু ল’ কমিটির পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করে যখন প্রায় নিশ্চিত ছিল তাঁর আদালতে জজ পণ্ডিতের চাকরি পাওয়া – পিতা ঠাকুরদাস তাঁকে সেই চাকরি করতে দিলেন না। কারণ সেই পরীক্ষার ফলাফলের জন্যেই ঈশ্বরচন্দ্র পেয়েছিলেন ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি। পিতার কাছে সেই উপাধিই অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল। বিত্তের চেয়ে বিদ্যার দাম দিতে চেয়েছিলেন তিনি। পুত্রের মধ্যে দেখেছিলেন বিদ্যাচর্চার অপার সম্ভাবনা। ফলে প্রবল দারিদ্র্য সত্ত্বেও পিতার নির্দেশে পুনরায় লেখাপড়া শুরু করেছিলেন বিদ্যাসাগর।
নিজের যে সংক্ষিপ্ত জীবনী বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন সেখানে দুটো ঘটনা উল্লেখের পর তিনি নারী বা স্ত্রীজাতি সম্পর্কে তাঁর অবস্থান প্রকাশ করেছেন। প্রথম ঘটনাটি তাঁর পিতা ঠাকুরদাসের মুখে শোনা। লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে ঠাকুরদাস কলকাতায় গিয়ে যাঁর আশ্রয়ে ছিলেন তাঁর আর্থিক অবস্থাও খুব একটা ভালো ছিল না। প্রায় দিনই তাঁকে উপবাস করতে হতো। এমনি এক ক্ষুধায় জর্জরিত দিনে একমাত্র সম্পদ পিতলের থালাটি বেচার উদ্দেশ্যে ঠাকুরদাস পথে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু থালা বিক্রি করতে ব্যর্থ হলেন। ক্ষুধার যন্ত্রণা তখন সহনাতীত। এমনি সময়ে এক মধ্যবয়স্কা বিধবা নারী তাঁকে মুড়ি-মুড়কি-দই খাইয়ে প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন। শুধু সেদিনের জন্যে নয়, পরবর্তী যে-কোনো অনাহারের দিনেও তিনি খাবারের নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন ঠাকুরদাসকে। বিদ্যাসাগর লিখেছেন, ‘পিতৃদেবের মুখে এই হৃদয়বিদারক উপাখ্যান শুনিয়া, আমার অন্তঃকরণে যেমন দুঃসহ দুঃখানল প্রজ্বলিত হইয়াছিল, স্ত্রীজাতির উপর তেমনই প্রগাঢ় ভক্তি জন্মিয়াছিল।’ তাঁর ধারণা হয়েছিল, কোনো পুরুষের পক্ষে এমন দয়া ও বাৎসল্য প্রকাশ সম্ভব নয়। দ্বিতীয় ঘটনাটি তাঁর নিজের জীবনেই ঘটেছিল। শৈশবে পিতার সঙ্গে কলকাতায় পড়তে এসে যে-বাড়িতে তিনি আশ্রিত ছিলেন সেই বাড়ির বিধবা কন্যা রাইমণির কাছে পেয়েছিলেন মাতৃসম স্নেহ। রাইমণির পুত্র বিদ্যাসাগরেরই সমবয়সী ছিল। নিজের পুত্র এবং বিদ্যাসাগরকে একইভাবে যত্ন করতেন তিনি। রাইমণির স্মৃতিচারণ করতে গেলেই চোখে জল জমে যেত তাঁর। এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘আমি স্ত্রীজাতির পক্ষপাতী বলিয়া, অনেকে নির্দেশ করিয়া থাকেন। আমার বোধ হয়, সে নির্দেশ অসঙ্গত নহে। যে ব্যক্তি রাইমণির স্নেহ, দয়া, সৌজন্য প্রভৃতি প্রত্যক্ষ করিয়াছে, এবং ঐ সমস্ত সদ্গুণের ফলভোগী হইয়াছে, সে যদি স্ত্রীজাতির পক্ষপাতী না হয়, তাহা হইলে, তাহার তুল্য কৃতঘ্ন পামর ভূমণ্ডলে নাই।’ পরবর্তীকালে, ১৮৭২ সালের জুন মাসে হিন্দু বিধবাদের সাহায্যার্থে ‘হিন্দু ফ্যামিলি অ্যান্যুইটি ফান্ড’ গড়ে তুলেছিলেন তিনি। কেননা, স্বামীর মৃত্যুর পর হিন্দু নারীর আর্থিক অনটনের দৈন্যদশা প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে তাঁকে। তখন পিতা বা স্বামীর সম্পত্তিতে হিন্দু নারীর অধিকার ছিল না। দেশভাগের পর নানা অন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভারতে এ-বিষয়ে হিন্দু আইনের সংস্কার করা হলেও বাংলাদেশে অতিসম্প্রতি (২০২০ সালে) পাশ হয় স্বামীর সম্পত্তিতে হিন্দু বিধবা নারীর অধিকার। বিদ্যাসাগরের দ্বিশতজন্মবর্ষে এই আইন পাশ হওয়া – হয়তো এ-ঘটনাটি কাকতালীয়!
নিজের লেখা জীবনচরিত তিনি সমাপ্ত করেননি। হয়তো প্রয়োজনও বোধ করেননি। কেননা ততদিনে তাঁকে নিতে হয়েছে গোটা বাংলার রাইমণিদের দুঃখ মোচনের, তাদের অমর্যাদা থেকে বাঁচিয়ে শিক্ষার আলোয় নতুন জীবন দেওয়ার দুর্লভ দায়িত্ব। তখন তাঁর জানার কথা নয় যে, তাঁর অসমাপ্ত জীবনচরিত পূর্ণ করার জন্যে জন্মের দুশো বছর পরেও কলম হাতে নেবে অসংখ্যজন।
উইলিয়ম জেমসের মত অনুযায়ী, বিদ্যাসাগরের জীবনে ‘লক্ষ চৈতন্যবিন্দুর গোপন সঞ্চরণশীলতা’র প্রভাববিস্তারকারী আরেকজন ব্যক্তি হলেন বিদ্যাসাগরের মা ভগবতী দেবী। সংস্কৃত কলেজে চাকরি করার সময় একবার বীরসিংহর বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপে পিতার সঙ্গে গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। এমন সময় সেখানে তাঁর মা কাঁদতে কাঁদতে উপস্থিত হয়ে গ্রামের এক বিধবা বালিকার বৈধব্যজনিত দুর্দশার কথা উল্লেখ করে বিদ্যাসাগরকে এক আশ্চর্য প্রশ্ন করলেন, – ‘তুই এতদিন এত শাস্ত্র পড়িলি, তাহাতে বিধবার কি কোন উপায় নাই?’ পুত্রের প্রতি এটা কি মায়ের প্রশ্ন, নাকি উপায়-অন্বেষণেরই পরোক্ষ নির্দেশ ছিল? সেই থেকে তাঁর পুত্র উপায় খুঁজতে শুরু করেছিলেন।
১৮৫৩ সালের শেষের দিকে এক রাতে পরাশর-সংহিতা পড়তে পড়তে ‘পাইয়াছি, পাইয়াছি’ বলে আনন্দে চিৎকার করে উঠেছিলেন বিদ্যাসাগর। সে-রাতে পেয়েছিলেন সেই আকাক্সিক্ষত শ্লোক, ‘নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।/ পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতিরন্যো বিধিয়তে।’ আরো দু-বছর এ-বিষয়ে অধ্যয়ন করে এর স্বপক্ষে নানা উদ্ধৃতি সংগ্রহ করেন। ১৮৫৫ সালে ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা – এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ প্রকাশের পূর্বে পুনরায় গ্রামের বাড়ি যান। বিদ্যাসাগর জীবিত থাকাকালেই চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় এ-ঘটনার পরবর্তী অংশ সম্পর্কে লিখেছিলেন। প্রথমে পিতা ঠাকুরদাসকে বিদ্যাসাগর পড়ে শুনিয়েছিলেন সেই প্রস্তাববিষয়ক পুস্তিকা। তারপর তাঁর মত জানতে চেয়েছেন। মত দেওয়ার পূর্বে পিতা জানতে চেয়েছেন, যদি তিনি মত না দেন তবে বিদ্যাসাগর কী করবেন? বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, তবে তিনি পিতার মৃত্যুর পর এই প্রস্তাব প্রকাশ করবেন। প্রস্তাব প্রকাশে সম্মতিসূচক মত দিয়েছিলেন পিতা। এরপর বিদ্যাসাগর মায়ের কাছে জানালেন, শাস্ত্রে বিধবা বিবাহের বিধি পেয়েছেন এবং সে-বিষয়ে একটি প্রস্তাব লিখেছেন। মায়ের অনুমতি পেলেই সেই প্রস্তাব প্রকাশ করবেন। সেদিন ভগবতী দেবী বলেছিলেন, ‘কিছুমাত্র আপত্তি নাই, লোকের চক্ষুশূল, – মঙ্গল কর্ম্মে অমঙ্গল চিহ্ন, – ঘরের বালাই হইয়া নিরন্তর চক্ষের জলে ভাসিতে ভাসিতে যাহার দিন কাটিতেছে, তাহাকে সংসারে সুখী করিবার জন্য উপায় করিবে, আমার সম্পূর্ণ মত আছে।’ পিতামাতার সম্মতি নিয়েই ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা – এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ প্রকাশ করেছিলেন তিনি।
একবার গ্রামের বাড়িতে শীতের কষ্ট নিবারণে মায়ের জন্য একটা নতুন কম্বল কিনে পাঠিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। ভগবতী দেবী সেই কম্বল ফেরত পাঠিয়েছিলেন। কারণ, গ্রামের সকল দরিদ্রের জন্য পুত্র যেদিন কম্বল পাঠাতে সমর্থ হবে, কেবল সেদিনই তিনি কম্বল ব্যবহার করবেন।
গ্রামে স্কুল পরিদর্শনে কোনো ইংরেজ কর্মকর্তা এলে ভগবতী দেবী নিজে খাবার পরিবেশন করতেন। অথচ সে-সময় অপরিচিত পুরুষদের সামনে যাওয়া বাঙালি নারীদের জন্য প্রায় নিষিদ্ধ ছিল। যেসব বিধবা বালিকার বিয়ে হতো, তিনি তাদের নিমন্ত্রণ করে একসঙ্গে খেতেন।
মায়ের কাছেই বিদ্যাসাগর পেয়েছিলেন মানবিকবোধসম্পন্ন ও যৌক্তিক মানুষ হওয়ার শিক্ষা। কেবল নিজের উন্নতি নয়, সকলের উন্নতি নিয়ে বাঁচাটাই জীবনের আসল উদ্দেশ্য। প্রতিবছর দুর্গাপূজার আয়োজনে অধিক টাকা খরচ করা উচিত নাকি সেই টাকায় সারাবছর গ্রামের দরিদ্র পরিবারগুলোকে সাহায্য করা উচিত – মায়ের কাছে বিদ্যাসাগর এ-প্রশ্ন করেছিলেন। ভগবতী দেবী বলেছিলেন, পূজার জন্য খরচের চেয়ে গ্রামের মানুষকে আর্থিকভাবে সাহায্য করাটাই জরুরি।
আমার জীবন গ্রন্থে নবীনচন্দ্র সেন জানিয়েছেন কীভাবে ‘দরিদ্রের ভগবান’ হয়ে উঠেছিলেন বিদ্যাসাগর। প্রবল দারিদ্র্যের সময় তাঁর পাশে ছিলেন তিনি। নবীনচন্দ্রের বোনের বিয়ের খরচের জন্য ধার করে টাকা জোগাড় করেছিলেন।
‘মেট্রপলিটন কলেজ ও বিদ্যাসাগর মহাশয়’ প্রবন্ধে ওই কলেজের শিক্ষক কালীকৃষ্ণ ভট্টাচার্য বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর কর্মজীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। কলেজের বেতনের টাকায় তাঁর সংসারের খরচ মিটতো না। তাই আরো কিছু টিউশনি করে প্রায়ই ক্লান্ত হয়ে পড়তেন তিনি। মাঝে মাঝে ক্লান্তিতে দিনের বেলাতেই ঝিমুনি আসতো তাঁর। একদিন তাঁর কাছে এমন ক্লান্তির কারণ জানতে চেয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। কেননা, দিবানিদ্রাকে ঘৃণা করতেন তিনি। কিন্তু যখন কালীকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের অর্থকষ্টের কথা জানলেন তখনই কলেজের বেতন বাড়িয়ে দিয়ে তাঁকে টিউশনি ছাড়তে নির্দেশ দিলেন। অর্থের জোগান না থাকায় কালীকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের মা দুর্গাপূজার আয়োজন করতে পারছিলেন না। পূজার জন্য সেই অর্থেরও জোগান দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর।
কালীকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের এই প্রবন্ধেই মেলে ‘মিথ্যুক’ বিদ্যাসাগরের পরিচয়। একবার এক অপরিচিত বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় কান্নার আওয়াজ পেয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। প্রতিবেশীদের কাছ থেকে জানলেন, বাড়ির কর্তা দীর্ঘদিন রোগশয্যায় থেকে মৃত্যুবরণ করেছে। তার চিকিৎসার জন্যে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে পরিবারটি। সদ্যবিধবা স্ত্রী তাই সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দিশেহারা হয়েই কাঁদছিলেন। সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে বিদ্যাসাগর সেই বাড়িতে প্রবেশ করলেন এবং সম্পূর্ণ অপরিচিত সেই বিধবাকে জানালেন একটি আশ্চর্য মিথ্যে তথ্য! বললেন, তাঁর স্বামী কিছু টাকা গচ্ছিত রেখে গেছেন বিদ্যাসাগরের কাছে। সেই টাকা থেকেই এখন থেকে প্রতিমাসে খরচ পাঠাবেন তিনি। সেদিন মৃতদেহের সৎকারের খরচসহ কয়েকদিনের বাজার খরচ দিয়ে বিদায় নিয়েছিলেন অপরিচিত সেই বাড়ি থেকে।
মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত (শ্রীম) বিদ্যাসাগরের বাড়ির যে-বর্ণনা দিয়েছিলেন তাতে যে- ঘরটিতে বিদ্যাসাগর থাকতেন তার বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে। বিশেষ করে বিদ্যাসাগরের টেবিলটা তাঁকে আকর্ষণ করেছিল, – ‘টেবিলের উপর যে পত্রগুলি চাপা রহিয়াছে – তাহাতে কি লেখা রহিয়াছে? কোন বিধবা হয়ত লিখিয়াছে – আমার অপোগণ্ড শিশু অনাথ, দেখিবার কেহ নাই, আপনাকে দেখিতে হইবে। কেহ লিখিয়াছেন, আপনি খরমাতার (কর্মাটাঁড়) চলিয়া গিয়াছিলেন, তাই আমরা মাসোহারা ঠিক সময়ে পাই নাই, বড় কষ্ট হইয়াছে। কোন গরীব লিখিয়াছে, আপনার স্কুলে ফ্রি ভর্তি হইয়াছি, কিন্তু আমার বই কিনিবার ক্ষমতা নাই। কেহ লিখিয়াছেন, আমার পরিবারবর্গ খেতে পাচ্ছে না – আমাকে একটি চাকরি করিয়া দিতে হবে। তার স্কুলের কোন শিক্ষক লিখিয়াছেন – আমার ভগিনী বিধবা হইয়াছে, তাহার সমস্ত ভার আমাকে লইতে হইয়াছে। এ বেতনে আমার চলে না। হয়ত, কেহ বিলাত হইতে লিখিয়াছেন আমি এখানে বিপদগ্রস্ত, আপনি দীনের বন্ধু, কিছু-টাকা পাঠাইয়া আসন্ন বিপদ হইতে আমাকে রক্ষা করুন। কেহ বা লিখিয়াছেন, অমুক তারিখে সালিসির দিন নির্ধারিত, আপনি সেদিন আসিয়া আমাদের বিবাদ মিটাইয়া দিবেন।’ – সমাধানের উপায়সহ সমস্ত চিঠির উত্তর দিতেন তিনি।
কিন্তু এভাবে কতজনকে রক্ষা করা যায়! অন্যের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিতে গিয়ে একের পর এক আয়ের উৎস খুঁজতে হয়েছে তাঁকে। বই লেখার কাজ করতেন রাত জেগে যেন সেই বই বিক্রির টাকায় পোষ্যদের খরচ মেটাতে পারেন। খরচ কমানোর জন্য গাড়িতে উঠতেন না, দীর্ঘ পথ পায়ে হাঁটতেন। শহর থেকে দূরের বাজার থেকে সস্তায় তরকারি কিনে আনতেন। কখনো নিজের অক্ষমতায় ক্ষেপে উঠতেন। একবার এক বিধবার ওপর নিপীড়নের খবর পেয়ে একইসঙ্গে রাগে কাঁপছিলেন আর কাঁদছিলেন। সেদিনের সেই অভিজ্ঞতার প্রত্যক্ষদর্শী শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছেন, “এমন কি ক্ষোভে দুঃখে ঈশ্বরকে গালাগালি দিতেন। … ‘এই জগতের মালিককে যদি পাই, তাহলে একবার দেখি। এই জগতের মালিক থাকলে কি এত অত্যাচার সহ্য করে?”
শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্নের লেখা থেকে জানা যায়, ‘অন্নসত্রে ভোজনকারিণী স্ত্রীলোকদের মস্তকের কেশগুলি তৈলাভাবে বিরূপ দেখাইত। অগ্রজ মহাশয় তাহা অবলোকন করিয়া দুঃখিত হইয়া তৈলের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, প্রত্যেককে দুই পলা করিয়া তৈল দেওয়া হইত। যাহারা তৈল বিতরণ করিত, তাহারা, পাছে মুচি, হাড়ি, ডোম প্রভৃতি অপকৃষ্ট জাতীয় স্ত্রীলোক স্পর্শ করে, এই আশঙ্কায় তফাৎ হইতে তৈল দিত, ইহা দেখিয়া অগ্রজ মহাশয় স্বয়ং উক্ত অপকৃষ্ট ও অস্পৃশ্য জাতীয় স্ত্রীলোকদের মস্তকে তৈল মাখাইয়া দিতেন।’ এরকম আরো ঘটনার উল্লেখ করেছেন চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও। কর্মাটাঁড়ে এক মেথরজাতীয় নারী ওলাওঠা রোগে আক্রান্ত হলে বিদ্যাসাগর তার ঘরে ঢুকে ওষুধপথ্য খাইয়ে সেবা করেছেন। সেখানকার অল্পকিছু বাঙালি পরিবারের শিশুদের জন্যে মাছের জোগান দিতেন। বাঙালি মায়েরা শিশুদের আশ্বাস দিয়ে বলতেন, – ‘ঈশ্বরে জেলে’ মাছ দিয়ে গেলে পেট ভরে ভাত খেতে পারবে। রমেশচন্দ্র দত্ত হয়তো যথার্থই বলেছিলেন, ‘যেটি কর্তব্য সেটি অনুষ্ঠান করিব; যেটি অনুষ্ঠান করিব সেটি সাধন করিব, এই ঈশ্বরচন্দ্রের হৃদয়ের সঙ্কল্প।’ এই শিক্ষার পাঠ তিনি পেয়েছিলেন মায়ের কাছ থেকেই।
বীরসিংহ গ্রামে যে-স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই স্কুলটিকেই ১৮৮৯ সালে ‘ভগবতী বিদ্যালয়’ নামে নামকরণ করেছিলেন তিনি। প্রথাগত ধর্মীয় আচার পালনে অনিচ্ছুক বিদ্যাসাগর আজীবন নিজের ঘরে পিতামাতার ছবি বাঁধাই করে রেখেছিলেন। অপরিচিত কেউ সেই দুই ছবির পরিচয় জানতে চাইলে অকপটে বলতেন, – ওনারা আমার ভগবান।
মৃত্যুর ষোলো বছর আগেই যে উইল করেছিলেন তিনি সেখানে প্রতিষ্ঠান/ সংগঠন বাদেই পঁয়তাল্লিশ জন পোষ্যের তালিকা ছিল। কয়েকটি পরিবারের ভাতাসহ সেই তালিকার তেত্রিশজনই নারী! নিজের শাশুড়ি এবং কন্যাদের শাশুড়ি-ননদদের নামও রয়েছে তাতে। অজ্ঞাত কারণে বন্ধুত্বের সম্পর্কে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়া মদনমোহন তর্কালঙ্কারের মা এবং বোনদের জন্যও ভাতা বরাদ্দ করেছিলেন তিনি। বাদ যায়নি তাঁর চাকরেরাও।
নারী ও পুরুষ তাঁর কাছে আলাদা বা পৃথক কোনো সত্তা নয়। তবে, তাঁর সমকাল তাঁকে এ-দৃষ্টিভঙ্গির মূল্যায়নে বারবার বাধা দিয়েছে। শিক্ষাই যে একটা জাতির উন্নয়নের প্রধান অবলম্বন সেই সত্য তাঁর চেয়ে বোধকরি আর কেউ এমনভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি। অর্থ না বুঝে সংস্কৃত ব্যাকরণ ও গণিতের সূত্র মুখস্থ করা, ইংরেজি ভাষা না জানা, শিক্ষায় দর্শনের চর্চা না থাকা, সাহিত্যের মধ্য দিয়ে ভাষা শিক্ষা এবং মাতৃভাষায় শিক্ষা পদ্ধতি কার্যকর না হলে যে শিক্ষার প্রকৃত ফল পাওয়া যায় না তা যুক্তি দিয়ে কেবল ইংরেজ সরকারকে বোঝাতেই সমর্থ হননি, ক্ষমতা পেয়ে করেছিলেন শিক্ষাব্যবস্থার যুগান্তকারী সংস্কার। সরকারি উদ্যোগে স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজে যুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু দেশের এক অংশকে অন্ধকারে রেখে যে সামগ্রিক উন্নতি ঘটানো সম্ভব নয় সেই সত্যও তিনিই প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন। জানতেন, বাধা আসবেই, তাই কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো শাস্ত্রই ছিল তাঁর প্রধান হাতিয়ার। মেয়েদের স্কুলের কাঠামো না হয় গড়ে তোলা যায় ইংরেজ সরকারের সাহায্য নিয়ে, কিন্তু ভারতবর্ষের প্রাচীন কুসংস্কার ভেঙে সেই স্কুলে মেয়েদের আনার জন্য শাস্ত্রবচনই খুঁজতে হয়েছে তাঁকে। স্কুলে মেয়েদের আনার জন্য ব্যবহৃত পালকির দুই পাশে লিখিয়ে দিতে হয়েছে, ‘কন্যাপেবং পালনীয় শিক্ষণীয়াতিযত্নতঃ’। অবৈতনিক সম্পাদক হিসেবে যুক্ত ছিলেন বেথুন স্কুলের সঙ্গে। ১৮৮৪ সালে বেথুন কলেজের ছাত্রী চন্দ্রমুখী বসু যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম ছাত্রী হিসেবে এমএ পাশ করেন তখন বিদ্যাসাগর কেবল অভিনন্দনই জানাননি, তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন এক সেট শেক্সপিয়রের রচনাবলি। যেসব বিধবা বালিকা তাঁর বাড়িতে নিশ্চিত আশ্রয় পেয়েছিল তাদের তিনি নিজে লেখাপড়া শেখাতেন।
স্কুল পরিদর্শকের দায়িত্বে থাকাকালে ১৮৫৭-৫৮এ তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন চারটি জেলায় ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরে, ১৮৫৮-এর জুন মাসে জনশিক্ষা পরিচালকের এক চিঠি আসে, সেখানে জানানো হয় যে, নারীশিক্ষার অগ্রসরের জন্য সরকারি অর্থ সাহায্য প্রত্যাহার করা হয়েছে। বিদ্যাসাগর কিছুতেই এ-সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি। স্কুলগুলো পরিচালনার জন্য নিজের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে অর্থ জোগান দিতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। অন্যদিকে, অর্থ প্রত্যাহারের চিঠির বিরুদ্ধে জনশিক্ষা দফতরে নিয়মিত আবেদনও করতে থাকেন। তাঁর একাধিক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শেষ পর্যন্ত সরকার কিছু অর্থ পুনরায় বরাদ্দ দেয়।
ব্যক্তিগত দারিদ্র্যজয়ের মধ্য দিয়ে যে-লড়াই শুরু হয়েছিল তাঁর সেই লড়াই ছড়িয়ে পড়েছিল সবখানে – ‘একদিকে স্বার্থপরতা, জড়তা, মূর্খতা ও গুণ্ডামি, – অন্যদিকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। একদিকে বিধবাদিগের উপর সমাজের অত্যাচার, পুরুষের হৃদয়-শূন্যতা, নির্জীব জাতির নিশ্চলতা, – অন্যদিকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। একদিকে শত শত বৎসরের কুসংস্কার ও কুরীতির বল, উপধর্মের উৎপীড়ন, অপ্রকৃত হিন্দু ধর্মের গণ্ডমূর্খ ও স্বার্থপর ভট্টাচার্যদিগের মত, অন্যদিকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। একদিকে নির্জীব, নিশ্চল তেজোহীন বঙ্গসমাজ, অন্যদিকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।’ বিধবাবিবাহের আন্দোলনে নেমে একে একে বন্ধু হারালেন তিনি। যাঁরা তাঁকে সমর্থন করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই পিছু হটলেন। এমনকি, বিধবাবিবাহের খরচ বহনের জন্য যে-ফান্ড গঠন করা হয়েছিল সেই ফান্ডে টাকা দেবার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েও টাকা দিলেন না অনেকেই। কিন্তু অটল ছিলেন বিদ্যাসাগর। বিধবাবিবাহের খরচ মেটাতে ঋণে জর্জরিত হলেন। প্রেসের অর্ধেক মালিকানা বিক্রি করতে বাধ্য হলেন। দুর্গামোহন দাসকে লেখা তাঁর তারিখবিহীন এক চিঠি থেকে জানা যায়, বিধবাবিবাহের ব্যয় নির্বাহের জন্য যে-ফান্ড গঠন করা হয়েছিল সেখানে অনেকেই সাহায্য প্রদানের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেও শেষ পর্যন্ত কথা রাখেননি। এ-কাজের জন্য দুর্গামোহন দাসের অর্থ সংক্রান্ত কিছু কাগজপত্র বিদ্যাসাগরের কাছে জমা ছিল। সেসব কাগজপত্র দিতে দেরি হওয়ার কারণ এবং ফান্ড বিষয়ে তাঁর তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা লেখা আছে চিঠিতে, লিখেছেন, ‘তুমি বিলক্ষণ অবগত আছ আমি নিজ প্রয়োজনের নিমিত্ত তোমার কাগজ লই নাই। বিধবাবিবাহের ব্যয়নির্বাহার্থে লইয়াছিলাম, কেবল তোমার নিকট নহে অন্যান্য লোকের নিকট হইতেও লইয়াছি। এ সকল কাগজ এই ভরসায় লইয়াছিলাম যে, বিধবাবিবাহপক্ষীয় ব্যক্তিরা যে সাহায্যদান অঙ্গীকার করিয়াছেন, তদ্দ্বারা অনায়াসে পরিশোধ করিতে পারিব। কিন্তু তাঁহাদের অধিকাংশ ব্যক্তিই অঙ্গীকৃত সাহায্য দানে পরাঙ্কমুখ হইয়াছেন। উত্তরোত্তর এ বিষয়ের ব্যয়বৃদ্ধি হইতেছে, কিন্তু আয় ক্রমে খর্ব হইয়া উঠিয়াছে সুতরাং আমি বিপদগ্রস্ত হইয়া পড়িয়াছি। সেই সকল ব্যক্তি অঙ্গীকার প্রতিপালন করিলে, আমাকে এরূপ সঙ্কটে পড়িতে হইত না। কেহ মাসিক, কেহ এককালীন, কেহ বা উভয় এইরূপ নিয়মে অনেকে দিতে অঙ্গীকার করিয়াছিলেন; তন্মধ্যে কেহ কোন হেতু দেখাইয়া, কেহ বা তাহা না করিয়াও, দিতেছেন না। অন্যান্য ব্যক্তিদের ন্যায় তুমিও মাসিক ও এককালীন সাহায্যদান স্বাক্ষর কর। এককালীনের অর্ধমাত্র দিয়াছ, অবশিষ্টার্ধ এ পর্যন্ত দাও নাই এবং কিছুদিন হইল মাসিক দান রহিত করিয়াছ। এইরূপে আয়ের অনেক খর্বতা হইয়া আসিয়াছে কিন্তু ব্যয় পূর্বাপেক্ষা অধিক হইয়া উঠিয়াছে সুতরাং এই বিষয় উপলক্ষ্যে যে ঋণ হইয়াছে তাহার সহসা পরিশোধ করা কঠিন হইয়া পড়িয়াছে। যাহা হউক, আমি এই ঋণ পরিশোধের সম্পূর্ণ চেষ্টা দেখিতেছি। অন্য উপায়ে তাহা না করিতে পারি, অবশেষে আপন সর্বস্ব বিক্রয় করিয়াও পরিশোধ করিব, তাহার কোন সন্দেহ নাই। … আমাদের দেশের লোক এত অসার ও অপদার্থ বলিয়া পূর্বে জানিলে, আমি কখনই বিধবাবিবাহ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতাম না। তৎকালে সকলে যেরূপ উৎসাহ প্রদান করিয়াছিলেন তাহাতেই আমি সাহস করিয়া এ বিষয়ে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম নতুবা বিবাহ ও আইন প্রচার পর্যন্ত করিয়া ক্ষান্ত থাকিতাম। দেশহিতৈষী সৎকর্মোৎসাহী মহাশয়দিগের বাক্যে বিশ্বাস করিয়া ধনে প্রাণে মারা পড়িলাম।’ এছাড়া, তারিখবিহীন মহারানী স্বর্ণময়ীকে লেখা চিঠিতে জানা যায়, সুদবিহীন যে সাত হাজার পাঁচশো টাকা ধার করেছিলেন তা পরিশোধের তথ্য। প্রথম অনুষ্ঠিত বিধবাবিবাহের পাত্রপাত্রী শ্রীশচন্দ্র ও কালীমতিকে নিজের ব্যক্তিগত ফান্ড থেকে উপহার দিয়েছিলেন দশ হাজার টাকা। অথচ সে-সময় তাঁর নামে বিধবাবিবাহের ফান্ড থেকে অর্থ উৎকোচের অভিযোগ করছিল তাঁর বিরোধীপক্ষ। আরো ভয়ানক ছিল বিধবা নারীদের জড়িয়ে তাঁকে নিয়ে গড়া মুখরোচক অশ্লীল গালগপ্পের আয়োজন। এ-বিষয়ে ‘শিবমোহিনী ও বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গ’ প্রবন্ধে কল্যাণী দত্ত শিবমোহিনী নামে নিজের বিধবা পিসিমার বিয়ের অভিজ্ঞতায় লিখেছেন, – ‘১৮৫৬ সালে বিধবা-বিবাহ আইন প্রচলিত হওয়ার পরে বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে বহু বিধবার বিবাহ হয়েছিল। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সেসব বিবাহের পরবর্তী অভিজ্ঞতা বিদ্যাসাগরকে বিব্রত ও বিপন্ন করে। বর্ণহিন্দু সমাজে বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধতা খুব কিছু হ্রাস পায়নি। আর বহু অর্থব্যয়ে বিদ্যাসাগর যাঁদের বিবাহ দিতে পেরেছিলেন, তাঁরাও অনেকেই ঠিক নিরাপদ দাম্পত্য জীবনে প্রতিষ্ঠিত হননি। পাত্ররা অনেক সময় এমন ভয় দেখাতেন যে বিদ্যাসাগর আরো টাকা না দিলে তাঁরা স্ত্রীকে পরিত্যাগ করবেন। এমন ঘটনাও বিরল নয় যে, একাধিক পত্নী বর্তমানে তাদের স্বামী বিদ্যাসাগরকে ঠকিয়ে তাঁর দেওয়া যৌতুক নিয়ে বিধবা বিবাহ করেছিলেন।’ অনেক বিধবা মেয়ের বাবাও বিয়ের নাম করে বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে টাকা নিতেন কিন্তু মেয়েকে বিয়ে দিতেন না। এমনকি, একমাত্র পুত্র বিধবাবিবাহ করায় স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর দাম্পত্য সংকটজনিত দূরত্ব হয়েছিল। এইসব ঘটনা বিদ্যাসাগরকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করেছিল। ফলে, এত তিক্ত অভিজ্ঞতায় স্নাত মানুষটির পক্ষে সুখী হওয়া সম্ভব ছিল না। চূড়ান্ত অসুখী মানুষটির আত্মযন্ত্রণা অনুভব করেই রবীন্দ্রনাথ মনে করেছিলেন, কাকের বাসায় ভুল করে যেমন কোকিল ডিম পেড়ে যায় তেমনি হয়তো বিধাতাও ভুল করে বাঙালিকে ‘মানুষ করিবার ভার’ দিয়ে বিদ্যাসাগরকে পাঠিয়েছিলেন। সেই ভার কাঁধে নিয়ে – ‘তিনি নিজের মধ্যে যে অকৃত্রিম মনুষ্যত্ব সর্বদাই অনুভব করিতেন, চারি দিকের জনমণ্ডলীর মধ্যে তাহার আভাস দেখিতে পান নাই। তিনি উপকার করিয়া কৃতঘ্নতা পাইয়াছেন, কার্যকালে সহায়তাপ্রাপ্ত হন নাই। তিনি প্রতিদিন দেখিয়াছেন – আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না; যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না; ভূরিপরিমাণ বাক্যরচনা করিতে পারি, তিল পরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না; আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতালাভের চেষ্টা করি না; আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি, অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি; পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধূলিনিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিকস, এবং নিজের বাকচাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহ্বল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য।’ ফলে, জীবনের শেষ সময়ে কলকাতা ছেড়ে কর্মাটাঁড়ে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে বসবাস করার সিদ্ধান্ত আসলে ‘এই দুর্বল, ক্ষুদ্র, হৃদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক, তার্কিক জাতির প্রতি বিদ্যাসাগরের এক সুগভীর ধিক্কার ছিল।’ কিন্তু এ ধিক্কার কেবল তথাকথিত শিক্ষিত নাগরিক ভদ্রসমাজের প্রতি। কেননা, মানুষের মানবিক মর্যাদার লড়াইয়ে তিনি কর্মাটাঁড়ের জীবনেও সচল ছিলেন। মেরি উলস্টোনক্রাফট এবং জন স্টুয়ার্ট মিল শিক্ষা এবং জ্ঞান থেকে নারীকে বঞ্চিত করার মধ্য দিয়েই তাদের অন্দরমহলে বন্দি রাখার যে-সংকটকে চিহ্নিত করেছিলেন, কিংবা ভার্জিনিয়া উলফ যেভাবে চেয়েছিলেন নারীর জন্য নিজস্ব একটা ঘর বা আর্থিক নিশ্চয়তা, কিংবা রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন যেমন করে সুলতানার স্বপ্নে পেয়েছিলেন নারীর প্রতি মানবিক ও নিরাপদ এক রাষ্ট্রের ধারণা – আরো পরে, সিমোন দ্য বোভায়া সামাজিক অবস্থানে নারীর ভূমিকাকে বিস্তৃত ব্যাখ্যা করে মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্তির পরিচয়ের জাল ছিন্ন করার আহ্বান জানিয়েছেন – বিদ্যাসাগর হয়তো আদতে এঁদের কারো মতোই নন। বিদ্যাসাগর তাঁর মানবিক ও যৌক্তিক হৃদয় দিয়ে নারীর জন্যে গড়ে তুলেছিলেন একটা নিজস্ব কর্তব্য-কর্মজগৎ – হয়তো তাঁর সেই নিজস্ব জগতের সূত্রগুলোই অন্যরকম ‘বিদ্যাসাগরীয় নারীবাদ’ রচনা করেছে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.