বিদ্যাসাগরের প্রশ্নে

শহীদ ইকবাল

তখন আর এখনকার কাল এক নয়। দুশো বছর পেরুল। বিদ্যাসাগরের দ্বিশতজন্মবর্ষ, কাল গুনলে দিবস-রজনীর মাপে খুব বেশি সময় নয় হয়তো। কিন্তু মানবজীবনের হিসাবে তা নেহায়েত কম বলি কী করে! তবে প্রশ্ন, এতদিন পর কেন বিদ্যাসাগর? তাঁকে কী শ্রেষ্ঠ মানুষ ভেবে, একপ্রকার বিশাল দেবমূর্তি বানিয়ে, ভক্তির ভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য – নাকি তাঁর কর্মপরিধি, কর্মের ও পাণ্ডিত্যের মেলবন্ধন যাচাইপূর্বক, আধুনিক শিক্ষার দ্বীপ জ্বেলে তিনি যে অন্ধকার দূরীভূতকরণের দায়ে, সত্য-মিথ্যা, সংস্কার-কুসংস্কারের সীমানা অতিক্রম করে মানবজাতির জন্য এক বিক্ষত প্রতিজ্ঞার ভার কাঁধে নিয়েছিলেন – নিরন্তর তীব্র হয়ে উঠেছিলেন – সে-কারণে! তিনি তো এখনো আছেন প্রজন্মান্তরে, চলমান, কে না জানে বিদ্যাসাগর কে ছিলেন? স্কুল-পাঠ্যবইয়ে, উচ্চশিক্ষায় বিদ্যাসাগরের পঠন-পাঠন তো এখনো উবে যায়নি। তবে বরঞ্চ প্রশ্নের চেয়ে জিজ্ঞাসাটা এখন শক্তিশালী হতে পারে – তাঁর মতো চিন্তার দার্ঢ্য-দৃঢ়তা কিংবা কথা ও কাজের মিল – আর সেটি প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি যে বরাবর দুর্মর সাহস দেখিয়েছেন – সেটা কতটা সম্ভব, অন্তত একালে বা তা কজনের রয়েছে! আমরা কতটা তার চর্চা করতে পারছি? এমন সহজলভ্য সমাজে বিদ্যাসাগরের কাজ বা দৃষ্টি তো পরিপ্রেক্ষিত পাওয়ারই কথা। সেটা কতটা পাচ্ছে! বস্তুত, তিনি যে-সমাজে বেড়ে উঠেছিলেন, সেটা প্রচণ্ড স্ববিরোধী ও সদ্য বিকাশমান পুঁজির দাপটময় চঞ্চল সমাজ। মধ্যবিত্তের তখন গজাচ্ছিল ‘দাড়িগোঁফ’। তারা প্রায়শ তেতে উঠছিল, পরিবর্তনের তাড়নায়। আবার যখন দেখা যাচ্ছিল পরিবর্তনের ওপারে নিজের পরিবর্তন দরকার তখন সুযোগ বুঝে লেজ গুটিয়ে পালিয়েও যাচ্ছিল। বিদ্যাসাগরের জীবনাচরণের ভেতর দিয়ে এসব উঁকিঝুঁকি আমাদের চোখে পড়ে। আস্তিক-নাস্তিক, ঈশ্বরবাদী-নিরীশ্বর, ডিরোজিওপন্থা বা নিছক বস্তুবাদী, ভাববাদী, ধর্মরক্ষা, সমাজরক্ষা – এমন নামে-বেনামে অনেক প্রবণতা ওই সমাজে বিছানো ছিল। বিদ্যাসাগর ঘরে-বাইরে দেখছিলেন সব। কী করবেন তিনি? কী চান তিনি! এসবের মাঝে নিজেকে ঠিক কোন পরিমার্জনা দেবেন বুঝে ওঠা কঠিন ছিল। তিনিও যাদের ওপর ভরসা করেন, পান না তাদের সময়মতো, পেলেও পিছিয়ে যান, এগিয়ে চলেন, পিচ্ছিলতায় গড়ানো জীবন। বস্তুত, তিনি চলতি সমাজে দূরে বা কাছে কারোরই ভালো হতে পারেননি, আস্থাভাজনও হননি। দৈনন্দিন চলতি সমাজব্যবস্থার ভেতরে তিনি ছিলেন ‘জঞ্জাল’ – একক, আলাদা। ব্রিটিশ-শাসক বা এদেশের পণ্ডিতপ্রবর মহল তাঁকে কিছুতেই গ্রহণ করতে চায়নি। সেটি চাওয়ার কথাও নয়। কাজেই, লড়তে হয়েছে – এক অর্থে – একাই, এক হাতে, মুখোমুখি হতে হয়েছে সর্বপ্রকার শক্তির বিরুদ্ধে; সে-কারণে বিশ্বাস ও আস্থায় তাঁকে পরিষ্কার ও দৃঢ় হতে হয়েছে, কেউ যেন অযথা ভুল ধরতে না পারে, আর ভুল ধরলেও তা যুক্তিতে যেন ধরাশায়ী হয়। ফলত, যে-মতের পণ্ডিতই হোক, কেউ তাঁর কাছে দৃঢ় হতে পারেননি।

দুই

ওপরের ভূমিকার পেছনের কারণ কী? এই একুশ শতকের করপোরেট বিশ্বে আমাদের জীবনযাপন কেমন? আমরা কী কুসংস্কারমুক্ত? এ-সমাজে কী পুরাণাচ্ছন্নতা কেটেছে? সমাজ কী এখন প্রগতিশীল? প্রযুক্তির সহজলভ্যতায় সবকিছুই এখন তো চরম প্রগতিশীল হওয়ার কথা – কারণ, কলিযুগের কোনো বাসনাই আমরা তো আর লুকোতে পারছি না। মুঠোবন্দি সবটাই। পাওয়ার সংকট নেই কোথাও। শুধু চাওয়ারই সংকট সর্বত্র। বিদ্যাসাগর যা চেয়েছিলেন, যেমনটা ভেবেছিলেন, যার জন্য তিনি নিরন্তর পরিশ্রম করেছেন – তা তো একালে আর অপ্রতিষ্ঠিত থাকার কথা নয়। তবে কী সব প্রতিষ্ঠা পেয়েছে? কিছু উদ্ধৃতি এখন দিই – তাঁর কালে যার মুখোমুখি হয়েছিলেন বিদ্যাসাগর :

ক) নানা কারণে আমার মনে সম্পূর্ণ বৈরাগ্য জন্মিয়াছে, আর আমার ক্ষণকালের জন্যও সাংসারিক কোনো বিষয়ে লিপ্ত থাকিতে বা কাহারও সহিত কোনো সংশ্রব রাখিতে ইচ্ছা নাই। … এখন স্থির করিয়াছি যতদূর পারি নিশ্চিন্ত হইয়া জীবনের অবশিষ্ট ভাগ নিভৃতভাবে অতিবাহিত করিব।

খ) আমি বিধবাবিবাহের প্রবর্তক, আমরা উদ্যোগ করিয়া অনেকের বিবাহ দিয়াছি, এমন স্থলে আমার পুত্র বিধবাবিবাহ না করিয়া কুমারী বিবাহ করিলে আমি লোকের কাছে মুখ দেখাইতে পারিতাম না। নারায়ণ স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া এই বিবাহ করিয়া আমার মুখ উজ্জ্বল করিয়াছে।

গ) যে সকলকে সন্তুষ্ট করিতে চেষ্টা পায়, সে কাহাকেও সন্তুষ্ট করিতে পারে না, এই প্রাচীন কথা কোনোক্রমেই অযথা নহে। সংসারী লোক যে সকল ব্যক্তির কাছে দয়া ও স্নেহের আকাঙ্ক্ষা করে, তাঁহাদের একজনেরও অন্তঃকরণে যে আমার উপর দয়া ও স্নেহের লেশমাত্র নাই সে বিষয়ে আমার অণুমাত্র সংশয় নাই। এরূপ অবস্থায় সাংসারিক বিষয়ে লিপ্ত থাকিয়া ক্লেশ ভোগ করা নিরবচ্ছিন্ন মূর্খতার কর্ম।

স্বীয় পরিবার-পরিজনের নিকটও বিক্ষত হয়েছেন বিদ্যাসাগর। নিজের বীরসিংহ গ্রাম পরিত্যাগ করতে হলো। সেটি পরিবারের ব্যাপার, মা-স্ত্রী-ভ্রাতা-সন্তান সকলকে একপ্রকার ‘অপমানে’র ব্যাপারটি বুঝিয়েই বলেছেন। কিন্তু সমাজে? এ-নিয়ে জানা যায় ‘রামপ্রসাদ রায়ের ব্যবহারের পেছনে তিনি যদি দেখেছিলেন আন্তরিকতার অভাব ও বিশ্বাসহননের দৃষ্টান্ত, তবে বিজয়কৃষ্ণের ব্যবহারে বাগাড়ম্বর ও নৈতিক পৌরুষহীনতা এবং কেশব সেনের স্ববিরোধিতার মধ্যে ক্ষমতা এবং সামাজিক প্রতিপত্তির প্রতি লোভ তথা delusion of grandeur-এর পায়ে আত্মসমর্পণ।’ ঘরে-বাইরে এ কেন দার্ঢ্যহীনতা? সেটাই প্রশ্ন বিদ্যাসাগরের। বিদ্যাসাগরকে বিষয়টি ভাবিয়েছে। নতুন অভিজ্ঞতায় ক্রমশ নিজের দৃঢ়তার প্রতি আস্থা স্থাপন করেছেন। এমন ব্যাপার ঘটেছে নারীশিক্ষা বা বহুবিবাহ প্রচলনের ক্ষেত্রেও। সোমপ্রকাশ ১৮৮০-তে লেখা হচ্ছে : ‘যদি শিক্ষিতরা তৎকালে জড়বৎ ও উদাসীনবৎ ব্যবহার না করিয়া সজীবতা প্রদর্শনপূর্বক তাহার সহায়তা করিতেন এতদিন বিধবাবিবাহ প্রচলিত হইয়া উঠিত।’ উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বিদ্যাসাগর বেথুন বালিকা বিদ্যালয় থেকে শুরু করে প্রায় পঁয়ত্রিশটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। সবই তাঁর নিকট বন্ধু ও মিত্রদের সমর্থন ছাড়া।

১৮৪৭-এ বারাসাতে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কারিগর প্যারীচরণ সরকার, কালীকৃষ্ণ মিত্র, নবীনকৃষ্ণ মিত্রদের সমাজচ্যুতির ভয় চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে তেমন প্রতিক্রিয়া হয় না। শুধু তাই নয়, সামাজিক সন্ত্রাস, নির্যাতন, শোষণ ওই সমাজে রোরুদ্যমান ছিল – তা বুদ্ধিজীবীমহলে তেমন গুরুত্ব পায় না, তাঁদের উন্নাসিকতা ও পশ্চাদপসারণ ছিল, যা বিদ্যাসাগরের মনে আশাভঙ্গ আনে, একসময় সেটি বাস্তব সত্য বলেই মনে হয়, মেনেও নেন। কারণ, যে-সংস্কারমূলক কাজ তিনি হাতে নেন, তার পরিসর যত বাড়তে থাকে, ততই তিনি একাকী হন, বন্ধুহীন হয়ে পড়েন। আচ্ছন্ন হন বান্ধব-বিচ্ছেদে। ধর্মরক্ষার সংগঠন, কুলীন সম্প্রদায়ের পণ্ডিতগণ – দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ, তারানাথ তর্কবাচস্পতি কেউ তাঁকে কী ছেড়ে দিয়েছিলেন? দেননি। ছাড়েননি। ব্যঙ্গ, শ্লেষ-বিদ্রূপে কটাক্ষপাত করে ছেড়েছেন। সমাজের একজন হওয়ার ‘পাপ’ তিনি স্কন্ধে ধারণ করেছিলেন। তাঁর এই কমিটমেন্ট কোনো স্বার্থপরতা নয়। পরার্থের প্রশ্নে। এই পরার্থপরতার ভেতরে লুকিয়ে ছিল প্রগতির ধর্ম। যে-প্রগতি শ্রেণি-জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সংস্কারের ঊর্ধ্বে মানবতা সৃজন করে, সমস্ত অন্ধতা দূর করে, কূপমণ্ডূকতাকে পায়ে ঠেলে। তিনি প্রথাগত আচরণের বিরোধিতা করে হিতৈষণাকে অগ্রাধিকার দেন। যে-প্রশ্নে তিনি ক্রমশ দৃঢ় থেকেছেন, হয়েছেন – অকাতর ও অকপট। একটুও তাতে টাল খাননি।

লক্ষ্য-নির্দিষ্ট থাকেন। বস্তুত, এই সমুজ্জ্বল চেতনাই ছিল বিদ্যাসাগরের আদর্শ। সেখানে নিরাপস-ভাবাপন্নতাই একগুঁয়ে এবং অপ্রতিরোধ্য বলে বিবেচ্য হয়েছে। এখন আবার পূর্বের প্রশ্নে ফিরে যাই। প্রশ্ন করি, এই দুশো বছর পর সমাজের চলকগুলো কী পালটেছে? এমনকি প্রশ্ন করার অধিকার, সেটিও কী সমাজের চক্ষুকে অস্বীকার করে সম্মুখে চলেছে? কী দেখতে পাচ্ছি আমরা! শিক্ষালয়গুলোতে নারীর সংখ্যা বেড়েছে। নারীশিক্ষা বেড়েছে। অধিক সংখ্যক নারী ঘরে ও বাইরের কাজে যুক্ত হচ্ছে। প্রচুর কর্মসংস্থান এখন তাদের। তারা কী সংস্কারমুক্ত? মনের অক্ষয় শক্তি কী তাদের নিজস্ব ব্যক্তিত্বের তারে আঁটানো? গৃহে-পরিবারে-সমাজে তাদের আত্মসম্মান কতটুকু? মনের কোণে যে-আগ্রহের বাতি কায়মনোবাক্যে তার উজ্জ্বলতা সমাজ কতটুকু পায় – দিতেই বা তারা সমর্থ হয় কতটুকু? সর্বৈব প্রশ্ন, বিদ্যাসাগরের স্বপ্নের সমাজ যা চেয়েছিল নারীরা তা এখন কতটুকু দিতে পারছে? পঞ্চাশের দশকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কতজন নারী-শিক্ষার্থী ছিল আর এখন! বা সমাজে চলাফেরা করতে গিয়ে নারীর যে-অংশীদারিত্ব সেটা কী আমাদের আশ্বস্ত করে? হলফ করে বলা যায়, সমাজের আলোকপ্রাপ্তি হয়তো নানাভাবে ঘটেছে। আলোর তীব্রতা যেমনই হোক রকমফেরে তার তারতম্য যতই ধরা পড়ুক নারীর অংশীদারিত্ব অস্বীকার করা যায় না। তবে কর্মযোগে নারীর অংশগ্রহণই তো শুধু নয়, পুঁজি নিয়ন্ত্রণেও হয়তো তাদের লক্ষণীয় মাত্রায় উন্নতি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এটাই কী একটি সমাজের অগ্রগতির মাপকাঠি! এক্ষেত্রে একটা জিনিস মনে রাখা যায়, এখন বুঝি আগ্রাসী পুঁজির সময় চলছে। পুঁজি পণ্য করে ফেলছে অনেক কিছু। যে-নারী গৃহে ছিল সে এখন বাইরে – অংশীদারিত্বের মধ্যে এসে পড়েছে; কিন্তু পুরোদস্তুর কী মুক্তি ঘটেছে? সে কি বর্তমান বাজারব্যবস্থার পণ্য নয়? ফলে তাতে করে নারীর সত্তাসম্ভূত মানবিক বিষয়টি কী প্রতিষ্ঠার সুযোগ পাচ্ছে? নিছক ‘নাইভনেস’ থেকে হয়তো তাদের মুক্তি ঘটছে; কিন্তু তাতে সমাজ-প্রগতির স্তরকে তারা কী তেমন এগিয়ে নিতে পারছে? কোনো পর্যায়ের আর্থিক উন্নতি কিংবা বড় বড় অট্টালিকাই কী সভ্যতা বা প্রগতির বাহন? সেটি কী কোনো উন্নতির স্মারক? একুশ শতকের সমাজ আজো প্রগতির শর্তগুলোকে না ধর্মীয় রূপেই দেখা যাচ্ছে। মৌলিক চিন্তার বিরোধী তারা। অবাধ ও উন্মুক্ত সংস্কারমুক্ত জীবনের শর্ত তাদের পছন্দ নয়। বিদ্যাসাগর কেন সংস্কার চেয়েছিলেন – সে-সংস্কারে তো বিন্দুমাত্র অন্ধতা ছিল না; প্রাচ্য-পাশ্চাত্য যাই হোক, যা অন্ধকারের বিপরীত, যা মানুষকে পিছিয়ে দেয় কিংবা যেখানে মানুষ আটকে পড়ে – তার বিরুদ্ধে তো তিনি দাঁড়িয়েছিলেন। সেখানে কে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত বা ব্রাহ্ম-সমিতির কিংবা কোনটা ইউরোপ বা পাশ্চাত্য সেটা তো মনে রাখেননি। সামষ্টিক সমাজের প্রথাগত মূল্যবোধ যত কঠোর হোক, যত প্রতিরোধের মুখে পড়ুক, ক্ষমতার হুংকার যেভাবেই প্রদর্শিত হোক – তিনি তো পিছু হটেননি। বুঝে নিয়েছেন সঠিক পথটি। যা প্রগতি রুদ্ধ করবে তা গ্রহণ করেননি। আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে তিনি প্রথার বিরুদ্ধাচরণ করেছেন। এ-শক্তি পেয়েছিলেন কোথায়? অনেকটাই আত্মবিশ্বাস থেকে – এই তাঁর শক্তি। আর এ-আত্মবিশ্বাস অর্জনের জন্য তিনি পড়াশোনা করেছেন, উদারমনে নৈর্ব্যক্তিক বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন, অতীত-বর্তমান ঘেঁটে ভবিষ্যতের পথকে অবমুক্ত করার কথা ভেবেছেন। এবং শেষ পর্যন্ত লড়ে গেছেন। একাই হলেও লড়েছেন। দেখা গেছে, প্রতিরোধের মুখে তাঁর অনেক বন্ধু হোঁচট খেয়েছেন, আপাতবিরোধিতায় ক্ষুণ্ন হয়েছে, পিছু হটে গেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত শাস্ত্রের পক্ষেই দাঁড়িয়েছেন, থেকেছেন তিনি। তাঁর নিশ্চলতা, নিটোল আত্মবিশ্বাস – তাঁকে সম্মুখে টেনে নিয়ে গেছে। তাতে পরিবার, সমাজ; সমাজ থেকে রাষ্ট্রে তিনি আলাদা হয়ে গেছেন; কিন্তু একক দৃঢ়তায় সবলে আসীন থেকেছেন। তাই মনে রাখতে হবে বিদ্যাসাগরের শক্তিমত্ততার পেছনের বিশ্বাসটি! আমাদের এমন শক্তিসম্পন্ন মানুষ এখন কোথায়! চতুর্দিকে দুর্বল শক্তি আর নতজানু মাথা। মেরুদণ্ড-বিকল ব্যক্তি। ফলে প্রগতি পরাধীন থেকে যাচ্ছে। হয়ে পড়ছে পরহস্তের ধন। ফলে পরাশক্তির আগ্রাসন মাথা তুলছে। মানুষের দুর্বল দিকগুলো পুঁজি করছে। যেটি মার্কেন্টাইল পুঁজির মূল কথা। ফলে প্রগতি দূর-অস্ত।

বলছিলাম, নিখাদ প্রগতির কথা – যা স্বচ্ছ কাচের মতো টলটলে, হীরার টুকরোর মতো জ্বলজ্বলে। এই জাজ্বল্যমান বিকিরিত হীরকখণ্ডটি আমরা পাচ্ছি না। নাগালের মধ্যেও নেই। যতই বলি তা হস্তচ্যুতই রয়ে যাচ্ছে। সে একপ্রকার অধরা। এই পুঁজির বাজারে – আমরা নারীদের অবক্ষয়, অবক্ষিণ্নতার হাত থেকে বাঁচাতে পারছি না। অনেক শিক্ষিত হয়েও তারা কূপমণ্ডূক থেকে যাচ্ছে। তাদের হাত-পা অঙ্গ-সঞ্চালন বাধাগ্রস্ত, সীমিত। মস্তিষ্ক প্রথাগত আচরণের বেড়াজালে নিপতিত। পরিবার-সমাজ থেকে তাদের নিষ্কণ্টক মুক্তি ঘটছে না। আত্মার মুক্তি যেন শূন্যে মিলায়। উপার্জন আছে কিন্তু আত্মিক সাফল্য কই! আত্মিক সাফল্য না থাকলে পরিবারে বা সমাজে তাদের ভিত্তি কী দৃঢ় হয়? হয় না। সামগ্রিক সমাজের অবদানও তখন সেকেন্ডারি থেকে যাচ্ছে। ফলে পদ-পদবি থাকলেও পদমর্যাদার উচ্চতা নেই। সে সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে না। সেটি কখনো পুরুষতন্ত্র, ধর্মতন্ত্র, কখনো বা প্রথাগত রাষ্ট্রাদর্শ দ্বারা অনতিক্রান্ত থাকছে। যেটি বিদ্যাসাগরের সমাজেও ছিল। বিদ্যাসাগর যার বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম করেছেন। সকলকে ছেড়ে হলেও একাই সেই অভীষ্ট লক্ষ্যটিতে পৌঁছাতে চেয়েছিলেন। প্রগতির ভেতরশক্তির মুখ্য প্রতিপাদ্য হওয়া উচিত চলমান সংস্কৃতির নবায়ন। সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া, মুক্তির সপক্ষে যে-কোনো প্রথাকে অস্বীকার করে সম্মুখে এগোনোর শক্তি তৈরি করা। রক্ষণশীলরা নানা নামে প্রগতির বিপক্ষে অবস্থান নেয়। তাদের মূল কাজ প্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করা এবং সম্মুখগামী সমস্ত চলকগুলোকে আটকে দেওয়া। তাতে তাদের শোষণের পথ তৈরিতে সুবিধে হয়। চার্চে-মন্দিরে বা উপাসনালয়গুলোতে তাই হচ্ছে। অতীতে যা ছিল তাই চলছে। ধর্মান্ধ মানুষের সংখ্যাচিত্র যেভাবে ঊর্ধ্বগামী তাতে তাই বোঝা যায়। আজকে গণতন্ত্রের নামে যা হচ্ছে, তাও কি এর বাইরে? স্বার্থের বিরুদ্ধে, কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে, প্রথাগত যত সংস্কার আছে তার বিরুদ্ধে এই উপাসনালয়গুলো কিছু করে না। বরং বিরুদ্ধবাদিতাই জিইয়ে রাখে। ফলে প্রগতির লড়াইটা শেষ হয়নি। আর বিদ্যাসাগরের তাৎপর্যও ফুরোয়নি। তাই নিতান্তই কোনো স্লোগান নয়,

লোক-দেখানো কোনো ভাঁড়ামি নয়, আত্মশক্তির দৃঢ়তা ও প্রাচুর্যময় শিক্ষার দীক্ষাই প্রগতি – এ এক অনিরুদ্ধ আলোকশক্তি – যার কেন্দ্রে আছে আত্মসমালোচনা এবং অন্যের যুক্তিসিদ্ধ মতকে গ্রহণের অনিবার্য আকাক্সক্ষা। সেটি পরাস্ত হলে তো এই সমাজ অমানিশায় আক্রান্ত হবে। সমস্ত দীপশিখা চলে যাবে অস্তাচলে।

বিদ্যাসাগর কিন্তু সকলকে নিয়েই সম্মুখে এগোতে চেয়েছিলেন। যখন বিধবাবিবাহের মুখোমুখি হয়েছেন তখন নিজের ছেলের মতকেও গুরুত্ব দিয়েছেন, মন্দিরে যখন শাস্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন তখন শাস্ত্রের মতকে দিয়েই শাস্ত্রাচারকে আঘাত করেছেন। এমনকি ইউরোপীয় জনকল্যাণকর মতকেও তিনি শাশ্বত সমাজ-উপযোগী করে গ্রহণ করেছেন। ভারতবর্ষীয়কে ইউরোপীয় বানানো নয় আবার ইউরোপীয়কে ভারতীয় বানানো নয়। তিনি কোনো অন্ধ জাতীয়তাবাদের কথা বলেননি। অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে মানবহিতৈষী কাজের সীমানা তিনি নির্ধারণ করে নিয়েছিলেন। সেখানে বিদ্যাসাগর আত্মপরিচয়ের অভিব্যক্তি নিয়ে যেমন ভারতীয় তেমনি আন্তর্জাতিকও।  দৃষ্টিভঙ্গিতে পূর্ণাঙ্গ আধুনিক এবং সংস্কারমুক্ত নিরলস মানুষ ছিলেন বিদ্যাসাগর। তাই তো প্রশ্ন জাগে, এ-সমাজে এখন গ্লোবালাইজেশনের নামে কী চলছে? দেখা যাচ্ছে, লুটেরাদের গিনিপিগে পরিণত হচ্ছে ছোট ছোট রাষ্ট্র। প্রযুক্তির অত্যাচারে সর্বকূল প্লাবিত করে করপোরেট জায়ান্টরা শাসিয়ে চলছে চতুর্দিক। তাদের অনড় হুকুমের দাস যেন সবাই। কেউ তাদের বিপক্ষে ভিন্নমত পোষণ করতে পারবে না। হবে না বিন্দুমাত্র কোনো ন্যায্য প্রতিবাদ। বস্তুতন্ত্রের কৃত্রিম সার্বভৌমত্বে এখানে তারা মানুষকে যন্ত্রে পরিণত করেছে। ভোগ-বিলাসিতার সামগ্রী বানিয়েছে। মানুষের মনুষ্যত্ব বলে কিছু নেই। শোষণের নতুন দিক বা পথ খোলায় তা ব্যাপৃত। যেমনটা বলছিলাম, নারীশিক্ষার নামে এখন কী হচ্ছে কিংবা যে-নারীরা চাকরি পাচ্ছে তারা সমাজে কী অবদান রাখছে – সেই প্রতিরোধের সংস্কৃতি, প্রগতি-অভিমুখী সংস্কৃতি কী নারী-পুরুষ সামগ্রিক সমাজে তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে? পুরুষতন্ত্র নিপাত যাক, নারীপ্রগতি রক্ষা পাক – এমনটা বাস্তবে কতটা আছে? আজকে রাষ্ট্রের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা উন্নয়নের কথা বলেন, সাম্যের কথা বলেন – কতজন কাগজে-কলমে সার্টিফিকেট পেল আর কতজন পাবেন সে নিয়ে তপ্তকথা অনেক। কিন্তু বাস্তব সত্য কী? এই চাকরি প্রদানের শিক্ষা তো সমাজ উন্নয়নের শিক্ষা নয়! এমনকি মানবসম্পদও তা নয়। যদি পরিসংখ্যানগত সমৃদ্ধিজ্ঞাপক চিত্রে মানবহিতৈষণার কথা বলি, সেও কী তাই? অবশ্যই নয়। আমাদের দরকার প্রশ্নশীল সমাজ। জিজ্ঞাসু মানুষ দরকার। যারা প্রশ্ন-জিজ্ঞাসার ভেতর দিয়ে সমাজকে এগিয়ে নেবে – একটি প্রগতিশীল সংস্কৃতির বলয় তৈরি করবে। মনে রাখতে হবে, প্রশ্ন করার অর্থ বিরোধিতা নয়, কাউকে তুল্যমূল্য বিচার করা নয় – মর্যাদাহীন করা নয় বা পেছনে ফেলে নিজেকে বড় করার কথা নয়। এটাই প্রগতিমনস্ক চিহ্নিতকরণের ক্ষেত্র। জিজ্ঞাসু সমাজ জাতিকে কী দেবে? আমরা ইউরোপের রেনেসাঁস-উত্তর সময়ের কথা জানি। যে-আলোকবর্তিকা গোটা ইউরোপে প্রচুর দার্শনিক-বিজ্ঞানী-সমাজতাত্ত্বিক-সাহিত্যিক তৈরি করেছিল। তারাই তো এক পর্যায়ে অন্ধকার সরিয়ে আলো নিয়ে এসেছিল। একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজের কথা বলেছিল। চিন্তার স্বাধীনতা, মুক্তজ্ঞানের প্রসারতা কিংবা র‌্যাশনালিটির কথা বলেছিল। সেই চিন্তাধারার প্রাবল্যই তো আমরা দেখি দেশে দেশে। ঔপনিবেশিক শাসনের ভেতরে ‘বড় ইংরেজ’ (রবীন্দ্রনাথের ভাষায়) তৈরি হয়েছে। যাঁরা উদার ও মুক্তচিন্তায় প্রাচ্যতত্ত্বের প্রবক্তা ছিলেন। এই ইংরেজরা তো সাম্রাজ্যবাদের বশংবদ শক্তি নন। তাঁরা সর্বদৈশিক, সভ্যতাশীল, প্রগতিমনস্ক মানুষ। উইলিয়াম জোনস যেমন ছিলেন – তেমন। কিংবা গ্রিয়ার্সন কিংবা গিন্সবার্গ, কে.বি. সিলি! এঁরা কারা? গোটা বিশ্বই তাঁদের চারণভূমি। শুধু তকমা সাদা-কালোর এঁটে কারো বিরোধিতা করা ঠিক নয়। সেটিও প্রগতিমনস্কতার শিক্ষা। যা হোক, এরকমভাবে জিজ্ঞাসাশীল সমাজই একপ্রকার মানব-কল্যাণকর সংস্কৃতির অধঃক্ষেপ সমাজে বুনে দিয়েছিল। যেটি চেয়েছিলেন আমাদের বিদ্যাসাগর। যার জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছিলেন। তাই হয়তো বিক্ষত চিত্তে তিনি এমনটা বলতে বাধ্য হয়েছিলেন যে : ‘আমাদের  দেশের লোক এত অসার ও অপদার্থ বলিয়া পূর্বে জানিলে আমি কখনই বিধবা বিবাহ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতাম না। তৎকালে সকলে যেরূপ উৎসাহ প্রদান করিয়াছিলেন তাহাতেই আমি সাহস করিয়া এ বিষয়ে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম, নতুবা বিবাহ আইন প্রচার পর্যন্ত ক্ষান্ত থাকিতাম। দেশহিতৈষী সৎকর্ম্মোৎসাহী মহাশয়দিগের বাক্যে বিশ্বাস করিয়া ধনে প্রাণে মারা পড়িলাম।’ বস্তুত এ আক্ষেপ। এ-সমাজ থেকে এখনো তা মুছে যায়নি। রাষ্ট্রব্যবস্থা তো এখন সবকিছু কুক্ষিগত করে ফেলেছে। বিদ্যাসাগরের সময়ে রাষ্ট্রের চরিত্র ছিল ঔপনিবেশিক। ব্রিটিশ ভারতে রাষ্ট্র নানারকম কূটকৌশল করে গণবিরোধী শাসনব্যবস্থাকে দীর্ঘস্থায়ী করার চেষ্টায় নিরত ছিল। দমন-পীড়নও চালিয়েছে। তবে এমনটা সত্য যে, ব্রিটিশ উপনিবেশ নিয়েছে যেমন দিয়েছেও তেমনি। একপ্রকার ভাবাই যায় যে, আলোচ্য বিদ্যাসাগর তো এমন উপনিবেশিত সমাজেরই উপহার! পুরাণাশ্রিত ভারতবর্ষ যে সমৃদ্ধ প্রত্ন-ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার তা শিখিয়েছিল তো ওই ব্রিটিশরাই। আমাদের ভেতরে জাতীয়তাবাদী শেকড়ও বুনে দিয়েছিল তারাই। চিনিয়ে দিয়েছিল বিদ্রোহ-বিপ্লবের স্বরূপ বা যৌক্তিক বিরুদ্ধাচরণের অতুল শক্তির সম্ভাবনার সত্যটি। এই সত্য শক্তি যে ক্রমবিকাশমান উৎপাদনশীল সমাজে তখন সময়ের দ্বন্দ্বে রূপ পরিগ্রহণ করে – তখন ঔপনিবেশিক শক্তিই তাকে বিপদের সম্মুখীন করেছিল। তারা তখন কূটকৌশল পালটায়। এসব উপনিবেশ-রাষ্ট্রে হয়েছে। সেটি অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু রাষ্ট্র-ধারণাও তো এখন পুনর্গঠিত হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য কূপমণ্ডূকতা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়ে গেছে। এখনো ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রই বহমান। কখনো মনে হয় একালে তা আরো শক্তিশালী হয়েছে। ‘লাল ফিতে’র দৌরাত্ম্য দিব্যি আছে। বরঞ্চ প্যাঁচ-কষার সংস্কৃতি বাড়ছে। হয়ে উঠছে তা আরো আগ্রাসী। আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্রের জনকল্যাণের ধারণা বা ঘনবসতিপূর্ণ রাষ্ট্রে জনতার সেবা এখন বেশ দুর্মূল্য। তোষণ, স্তূতি, ভক্তির সংস্কারে সবকিছুই এখন আকণ্ঠ নিমজ্জমান। তাই দুর্নীতি বাড়ছে। উপাসনালয়গুলোর শক্তি অতুল হয়ে উঠছে। এই একুশ শতকে এসে মনে হয়, রাষ্ট্রের চরিত্র যদি প্রতিক্রিয়াশীল হয়, সেখানে সমাজ সামনে এগোনোর সম্মুখ-শক্তি কোথায় পাবে! ক্রমাগত ক্ষয় হয় তার অন্তরশক্তি। বিপর্যস্ত হয় মন। বিপরীতে ভোগ-ক্ষমতা, লোভ-কুসংস্কার, বাহ্যিক হুল্লোড় বেড়ে চলে। মনে রাখা সংগত যে, জৌলুস সব্বাইকে ভোগায়। অতিশয় লালসার আড়ালে ব্যক্তিস্বার্থ পরম হয়ে ওঠে। পণ্য বানায় সকলকে। বৈষম্যে ইন্ধন দেয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ পিছিয়ে থাকে। কোনো জনপ্রতিনিধিত্বশীল জাতি-রাষ্ট্রের বিষয়টি থাকে না।

ব্যক্তি-মানুষের মধ্যে পলায়নী মনোভাব গড়ে ওঠে। ব্যক্তি তুচ্ছ হয়। ভোগাচ্ছন্ন মন ক্লেদাক্ততায় ভরে ওঠে। আড়ালে চলে বিস্তর অবক্ষয় আর কূট-ষড়যন্ত্র। সবচেয়ে বড় রকমে যেটি প্রকাশমান হয় তা হলো – তীব্র শ্রেণি-সংকট। এটি মারাত্মক ও সর্বগ্রাসী। আর এ থেকে যে-মনস্তত্ত্ব তৈরি হয় – তা অন্ধকারের সংস্কৃতিতে সেঁধিয়ে থাকে। বাইরের চাকচিক্যে ঢাকা পড়ে ভেতরের নীল বাস্তবের বলকানি। অনাধুনিকতা ভেতরের প্রচ্ছদচিত্রে জেঁকে বসে। সেখান থেকেই অনাচার আর না-বোধক জীবনধারণা ছেয়ে যায় সর্বত্র। বস্তুত, তাই চলছে এখন। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি, সাম্প্রদায়িক গোত্র-বর্ণ প্রাধান্য, বৈষম্য – করপোরেট আকর্ষণে কী নেই! তাই সবকিছু পেরিয়ে এ-কালেও ফিরতে হয় বিদ্যাসাগরের কাছে – ওই মানবতার প্রশ্নে, মানুষের প্রশ্নে। যেখানে করপোরেট হাউসগুলো ভয়ে ভয়ে বলতে থাকে – বিদ্যাসাগর দিয়ে কী হবে কিংবা কেন বিদ্যাসাগর। এসব অলক্ষ্য প্রতি-উত্তরেই বিদ্যাসাগর সর্বগম্য হন, সকল মানুষের পক্ষে প্রোজ্জ্বল হয়ে ওঠেন।

তিন

মুখব্যাদান করে সেই প্রশ্ন : ‘বিদ্যাসাগর আজকাল কেউ পড়ে!’ – এভাবে সমাজশূন্য প্রশ্নজ্ঞাপক সমীকরণের ডানপার্শ্বে কী বসতে পারে? এ-সমাজে বিদ্যাসাগর কি তবে করুণার পাত্র? যদি তিনি করুণার পাত্র হন, তবে করুণানিধান কে?

উনিশ শতকের সমাজ ছিল উৎকণ্ঠিত। আর এখনকার সমাজ উগ্র ভোগ-বিলাসিতার নখরে বিলাসিতার গহ্বরে নিপতিত। এ-বিলাসিতার পেছনে আছে কদর্য নীতিহীনতার প্রহেলিকা। মূলত, এরাই সমাজের চালিকাশক্তি। বলছি, গত কয়েক দশকে পুঁজির প্রশ্রয়ে উঠে আসা অপরিশোধিত বাঙালি মধ্যবিত্তের কথা – যে-পুঁজির সংশ্রব এদের ভেতরকাঠামো রচনা করেছে। নিছক জৌলুস ও অক্ষম ক্ষমতার দাপুটে অহংকারে তার সবটা গড়া। সেটি খুব পিচ্ছিল। কাঠামোও দুর্বল। বিদ্যাসাগরের উনিশ শতকে দুটো বিষয় ছিল : এক. শাস্ত্রাচারী পণ্ডিতপ্রবরদের উৎপাত, দুই. সঞ্চালিত উপনিবেশ-পুঁজির মধ্য থেকে উঠে আসা নব্য-মুৎসুদ্দি পুঁজি শ্রেণি। এই পুঁজি শ্রেণি গোলমেলে দশায় সমাজের ভরকেন্দ্র রূপে অধিষ্ঠিত ছিল। মূলত, বিদ্যাসাগর উভয়ের কাছেই তাঁর মননশীল যুক্তিনির্ভর নীতি দ্বারা পরাস্ত ছিলেন। বলে নিই, বিদ্যাসাগর ‘অতিমানব’ নন। তিনি কোনো রাজনৈতিক প্রভাবপুষ্ট ব্যক্তিও ছিলেন না। উনিশ শতকী সমাজে ভাবাবেগের যে-প্রাবল্য সেখানে যুক্তির আঘাত এবং প্রতিরোধ ছিল খুব কঠিন। কারণ, সমাজ-কাঠামোটি ছিল এক ভাবাদর্শের মোড়কে আবদ্ধ। বিদ্যাসাগর সমাজ-কাঠামোর অভ্যন্তরীণ কাঠামোকে আঘাত করতে চেয়েও তেমন পারেননি। বরং প্রত্যাঘাত এসেছে, নানাভাবে। শাস্ত্রাচারী পণ্ডিতরা বেঁকে বসেছে, তারা অপবাদ দিয়েছে, স্বীয় ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও উপস্থিত মুহূর্তে সরে গেছেন – এ-কথা আগেই বলেছি। এমনকি পরিবারেও তাঁর সদ্ভাব বজায় থাকেনি। তিনি অভিমানে বীরসিংহ ছেড়ে এসেছেন, এক পর্যায়ে কলকাতা থেকেও সরে যান – আশ্রয় নেন সাঁওতালপল্লিতে। এই সরে যাওয়াটা কেন? বিদ্যাসাগর তো নীতিগতভাবে পরাস্ত হননি। নিজের জন্যও কিছু করেননি। আর কর্মক্ষেত্রে জয়-পরাজয়ের ঢেউ তো নানারকমের। বস্তুত, ভাবাদর্শের কাঠামোটি ভাঙার ক্ষেত্রে একক প্রচেষ্টা তাঁর তেমন না দাঁড়ালেও ঝাঁকুনি তো দিয়েছিলেন। এই সমাজ-অভিঘাতের বিপরীতে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ওই সময়ে যে-ভাবাবেগের অন্তঃস্রোতে উদার-মানবতার দৃষ্টিকোণ তৈরি করছিল তা সকলেই প্রায় মেনে নিয়েছিল এবং তাতে প্লাবনও আসে। কেন? এ-দুটোর পার্থক্য কী? এ তো এপিঠ-ওপিঠ। একটি আবেগপ্রসূত ভাবাবেগ – যেটা ধর্মাশ্রিত, রূপকল্পময় আর অন্যটি যুক্তিশীল, ধর্ম-নিরপেক্ষ। সমাজ প্রথমটি বিনা দ্বিধায় ব্যাপকভাবে গ্রহণ করে। ওই শাস্ত্রাচার-প্রলুব্ধ যুক্তিহীন, ক্ষমতাশালী লোভাতুর অংশটিও তাতে প্রবলভাবে সায় দেয়, প্রশ্রয়ও দেয়। কারণ, এর সঙ্গে রাজনৈতিক-পুঁজিও যুক্ত হতে দ্বিধা থাকে না। আমরা জানি, বিদ্যাসাগরের বিবাহ-সংস্কার এক পর্যায়ে ব্যর্থই হলো। তিনি ‘একক’ হয়ে পড়লেন। দার্ঢ্যশীল, অভিমানী বিদ্যাসাগর মনন ও যুক্তির সারার্থে শাস্ত্র দিয়ে শাস্ত্রকে প্রত্যাঘাত করেছিলেন কিন্তু অভ্যন্তরীণ সংস্কারগুলো ঠিক মুছে দিতে পারলেন না। যে তেজ ও বিক্রম ছিল তাঁর ব্যক্তিত্বে তা বাস্তবতার আঁচে গড়া; সেখানে মন্দিরের ব্রাহ্মণ্য-শাস্ত্রসাধকরা তাৎক্ষণিক পিছু হটেছেন, প্রশ্নশীল হয়েছেন, সমর্থনও দিয়েছেন; কিন্তু ক্রমবর্ধমান অনায়াসলব্ধ উৎপাদনশীল বেনিয়া পুঁজির আগ্রাসন তাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে – তা পরাস্ত হয়ে দীর্ঘ সংস্কারাশ্রিত ভাব-কাঠামোয় প্রত্যাবর্তন এনেছে; সেখানে ক্ষমতা, লোভ আর উটকো আবেগের জৌলুস প্রশ্রয়ও পায়, যুক্তি-বুদ্ধির জায়গার আবেগের শাসনই তখন বড় হয়ে ওঠে। ফলে তখনকার কলকাতার সমাজে এ এক ‘অসমর্থিত’ মানুষ ক্রমশ আত্মগ্লানিতে নুয়ে পড়ছে যেন। স্ববিরোধিতা আর সন্ত্রাসের যে-সমাজ তাঁকে প্রত্যাখ্যান করল – যা তাঁর সামনেই গড়ে উঠেছিল – সেখানে থেকে তিনি নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হন। আর এ-প্রত্যাহার তাঁর ব্যক্তিত্বের সৌম্য-সমাহিত চিন্তার নির্ণায়ক। এ এক নিয়তিও বটে। আবেগশীলতার কাছে যুক্তির পরাজয়; বৃহত্তর মানুষ গ্রহণ করেছে যুক্তির বদলে সহজ – অন্ধাশ্রয় ভক্তিকে; আর ওই সংস্কার-ভাবাবেগের ভেতর লেপ্টে গেছে অবরুদ্ধ পুঁজিশাসিত ঔপনিবেশিক সমাজের অন্তর্কাঠামো – সেখানে সমাজের উপহার কী? আর তাতে কী ধরনের চরিত্র জন্মলাভ করতে পারে – সেও তো অজানা নয়! তবে উনিশ শতকের সমাজে তো মধ্যযুগীয় কিছু তেমন ছিল না। সাম্রাজ্যবাদ নখর বিস্তার করে চলছিল, ‘নগর’ শব্দটি গৃহীত হচ্ছিল – তার কুটিলতা, ক্ষমতা, জাতীয়তাবাদের উদ্ভিন্ন চেতনা ছেয়ে যাচ্ছিল ব্যক্তির আবেগকাতর মনে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে আটকানো ভক্তির তৃষ্ণা আর স্বার্থ-আনুকূল্য ভোগ নির্ধারিত অন্তরীণ সমাজ-কাঠামোকেই সমর্থন দিয়েছিল – সেখানে বিদ্যাসাগরের যুক্তির আশ্রয় কে নেবে! এখন প্রশ্ন, এই অন্তরীণ সমাজ-কাঠামোর অন্ধকার স্তরগুলো আজকাল কী তবে কেটে গেছে? বণিকের শোষণ তো গেছে। পূর্ব বাংলা এখন স্বাধীন স্বতন্ত্র দেশ। উপর্যুক্ত সমাজব্যবস্থার কঠোর-কঠিন শৃঙ্খল আর যুক্তির ও আবেগের যুযুধান যে চলছে – সেখানে কে অগ্রবর্তী – এমন প্রশ্নের উত্তর দেবে কে? অভিমানী বিদ্যাসাগর তো শেষ পর্যন্ত সাঁওতালপল্লিতে গেছেন, সেই পল্লি কী এখন আছে? বা ওই আদিবাসীদের সরল মনের প্রক্ষেপণ এখন কেমন? সবকিছুই তো বদলায়। মনের ভেতরের চলতি অভিজ্ঞতার যে রেখাপাত সেটি একক তো নয় – অবশ্যই সামষ্টিক। সেই সামষ্টিক শর্তেই সমাজ বদলেছে। তার উপরিতল বা অন্তর্কাঠামোও রচিত হয়েছে। আমরা জানি, বাস্তবতার ভেতরে গড়ে ওঠে বিবর্তমান সমাজের নানা অভিমুখ। এই অভিমুখসমূহ দ্বন্দ্বসংকুল। এই দ্বন্দ্ব থেকে উনিশ শতকের চিন্তা-দর্শনের শক্তি সমাজে তৈরি হয়েছে। যেটি এই একুশ শতকে মানবিক অবক্ষয়ের প্রান্তমুখে দাঁড়িয়ে আছে। সে-কথা আর পুনর্ব্যক্ত করার প্রয়োজন নেই। বিদ্যাসাগর-চরিত্রের একটা প্রধান দিক তাঁর চিন্তার স্বচ্ছতা। সেখানে কোনো সংশয় ছিল না। দীর্ঘদিনের সমাজে গেঁথে থাকা শাস্ত্রের সংস্কারের জন্য জড়তামুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর কোনো পিছুটানও ছিল না, সেজন্য যে-উত্থিত পুঁজির উদ্ভিদ্যমান ব্যক্তির ভেতর-চালাকি, দোলাচলতা, চাতুরীপনা, গোঁড়ামি, ভয়াচ্ছন্ন আচরণের কূটকৌশল এসব মোকাবিলায় তিনি অপ্রস্তুত হয়েছেন, কুণ্ঠিত হয়েছেন, নানাভাবে মানসিক ও শারীরিক ক্লান্তিও এসেছে তাঁর মধ্যে কিন্তু ক্রমশ তিনি জীবন দিয়ে তা স্বীকারও করে নিয়েছেন, ফলত তাতে হয়তো নিয়ত একাকী হয়ে গেছেন; কিন্তু পরাস্ত হননি, তাবৎ বাস্তবতা মেনে প্রগতির কথাই বলে গেছেন। এ-প্রগতি মানুষ ও সমাজের পক্ষে, জড়তা কাটিয়ে সম্মুখগামী আলোর পথে। এতে বন্ধুহীন হয়েছেন হয়তো কিন্তু সম্পূর্ণ আত্মস্থ করেই সবটুকুতে নিজে হয়েছেন সমাহিত। দ্বিতীয়ত, পড়াশোনায় তাঁর নিখাদ পাণ্ডিত্য ছিল। এই পাণ্ডিত্য সংস্কারমুক্ত এবং আধুনিক। ফলে তা শাস্ত্রাচার বা উপাসনালয়ের ভজনায় আবদ্ধ ছিল না, সবকিছু বুঝিয়ে নিয়েছিলেন প্রখর মনোবল ও বুদ্ধির তীব্রতা দিয়ে। এই আলোর কণিকা ক্রমাগত আঁধার কাটিয়ে অপ্রতিরোধ্যতা মোকাবিলা করে সম্মুখের দিকে এগিয়ে গেছে। এ-পথটি কুসুমাস্তীর্ণ নয়। কখনো তা বিজনে হয়েছে ব্যতিক্রম কখনোবা স্বার্থবুদ্ধির রোষানলে প্রতিরোধের বৃত্ত পেরোতে গিয়ে হয়েছে বাধার সম্মুখীন। কখনোবা অগ্রবর্তী আশার আলোও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এ-আলোর উষ্ণতা বা শক্তি বিকিরিত হয়ে ক্রমপরিবর্তমান সমাজে এনেছে রূপান্তর। তাই ছড়িয়েছে দিকে দিকে। তার তাৎক্ষণিক ফল হয়তো সমাজের গভীরে তেমন উপ্ত হওয়ার অবকাশ পায়নি; কিন্তু উৎকণ্ঠিত জায়মান আভা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এক পর্যায়ে সার্থকতায় ভূষিত হয়েছে। এ পরিবর্তনের রূপরেখা এমন যে, এ-কালেও তা বিকশিত এবং অরুণ-আলোয় রঞ্জিত। কার্যত, উনিশ শতকের জায়মান অর্থনীতির ভেতর থেকেই বিদ্যাসাগরের অনন্যতার স্বরূপ চিহ্নিত হয়েছিল, সেটি আগ্রাসী অর্থনীতির চাপে হয়তো দুর্বিনীত; কিন্তু তার প্রকাশ চাপা পড়ে থাকেনি। এখনে জৌলুসটা বাইরের – কিন্তু অন্তরের অবরুদ্ধতায় জমাট অপচয় ঘিরে ফেলেছে পুরনো কৌলীন্যের কঠোর প্রাচীর – সেটা ভাঙতে হবে ওই প্রগতি দিয়েই। বিদ্যাসাগর যা অকপটে বলে গেছেন তা এবং তাঁর জীবৎকালের অভিজ্ঞতাকে আমাদের সাহস ও সত্য দিয়ে বুঝে নিতে হবে। তার কোনো বিকল্প নেই।