ছবি আঁকার তাড়না একজন সৃজনশিল্পীকে এগিয়ে নেয়, সৃজনকর্মপ্রয়াসে উদ্বুদ্ধ করে তাঁকে। সেই সৃজনের পেছনে যদি থাকে মুহূর্তের সহজ-সাবলীল ভালোলাগা আর উতল আবেগ তাহলে সৃজন হয় সুললিত, সুন্দর। শিল্পী সৈয়দ হাসান মাহমুদের চিত্রকলায় সেই সহজ-প্রাণবন্ত আবেগের সাংগীতিক মূর্ছনা দর্শককে আলোড়িত ও স্পন্দিত করে। আমাদের দেখা কাছের-দূরের নিসর্গ, গাছের সারি, কুয়াশাধূসর ভোরের শিশিরভেজা ঘাস, জানালার কাঁচ বেয়ে গড়িয়ে-পড়া শিশিরবিন্দু, শীতরাতের আলো-আঁধারির নিসর্গ সব যেন ছেনে তুলে এনেছেন তিনি। বেঙ্গল গ্যালারির দেয়ালে দেয়ালে সেই চেনা-অচেনা নিসর্গের রূপ।
গত ২৪ অক্টোবর, শুক্রবার থেকে বেঙ্গল শিল্পালয়ে ‘বিমূর্ত প্রশান্তি’ শিরোনামে শুরু হয় শিল্পী সৈয়দ হাসান মাহমুদের তৃতীয় একক চিত্র-প্রদর্শনী। এতে বিগত ১৮ বছর ধরে আঁকা শিল্পীর ৬৯টি চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হচ্ছে। তবে বেশিরভাগ কাজ ২০১০ থেকে ২০১৪ সময়কালের। ১৯৯৬ সালে জলরঙে আঁকা জ্যামিতিক ফর্ম নিয়ে নিরীক্ষাধর্মী কয়েকটি কাজ স্থান পেয়েছে। ব্যতিক্রমী ও সুচিন্তিত ডিসপ্লে এবং নিসর্গ-সৌন্দর্যের তাৎক্ষণিক রূপ অবলোকনের অনুভূতিপ্রবণ চিত্রকর্মের জন্য প্রদর্শনীটি আলোচিত হয়েছে।
সৈয়দ হাসান মাহমুদের সঙ্গে আমার চেনাজানার বয়স পঁয়ত্রিশ বছর। শান্তিপ্রিয়-চিন্তাশীল, নির্বিবাদী-সৃজনশীল একজন শিল্পী হিসেবে তাঁর বিশেষ সুনাম সেই সময় থেকেই। দিনে দিনে তাঁর কাজ আর সৃজনদক্ষতায় সেই সুনামের ব্যুৎপত্তি বেড়েছে বইকি, তবে এখন তাঁকে ঠিক নির্বিবাদী বোধকরি বলা যাবে না এজন্যে যে, তিনি নিজ বিবেচনায় যা কিছু ভালো বোঝেন, তা প্রতিষ্ঠায় প্রায় নাছোড়বান্দা। বেশ কিছু বই ও ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ এবং ডিজাইন করেছেন তিনি। এর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশের কৃতী স্থপতি রফিক আজমের কাজ নিয়ে ইতালির স্কিরা পাবলিকেশন্সের সহযোগিতায় বেঙ্গলের প্রকাশনা।
শিল্পী সৈয়দ হাসান মাহমুদের জন্ম ১৯৫৮ সালে ঢাকায়। সেকালের ঢাকা ছিল সবুজ, বৃক্ষশোভিত। তাঁর শৈশবের ঢাকা চোখের সামনে বদলাতে বদলাতে এখন হয়ে উঠেছে ইট-কাঠ-কংক্রিটের। তবে চারপাশে পুঁজির নখরাঘাত থাকলেও ধানমন্ডির পাঁচে হাসান-এ্যানি শিল্পীদম্পতির আবাস ও স্টুডিও এখনো গাছের ছায়ায় লতায়-পাতায় মায়াময়। হাসান মাহমুদ ১৯৮১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় থেকে চিত্রকলায় স্নাতক হন। এ পর্যন্ত তাঁর তিনটি একক প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছে এবং দেশে-বিদেশে বহু দলবদ্ধ প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন। তাঁর আরেকটি পরিচয় – তিনি মায়ের নামে গড়ে তোলা স্বনামধন্য ‘ঝাঁপি আর্ট স্কুলে’র প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। তাঁর ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই আজ চিত্রশিল্পী ও স্থপতি।
স্থাপত্যবিদ্যার সঙ্গে হাসান মাহমুদের সংযোগ অনেক দিনের। তাঁর চিত্রপটেও এই বিষয়টির বৈশিষ্ট্য ও ফর্মের আনাগোনা ছিল। রেখা ও রঙের সংবেদনশীলতা ছাপিয়ে স্থাপত্যের জ্যামিতি অবলীলায় চলে আসত চিত্রপটের কেন্দ্র থেকে এদিক-ওদিক, এর আশপাশ থাকত খালি। এরপর বর্তমান শতকের শূন্য দশকে আরো পরিবর্তন আসে। এবার তাঁর পুরো চিত্রপট ভরাট হয়। তবে কখনো দুভাগে, কখনো আবার চারভাগে বিভক্ত হয়ে। এর মধ্যে শিল্পী ব্যবহার করেন সূক্ষ্মরেখার সরল বিভাজক। মোটা ব্রাশে রং চুবিয়ে ক্যানভাসে ছোপ দিতে দিতে শিল্পী অগ্রসর হতেন। এভাবে নানা নিরীক্ষায় দাঁড়িয়ে যেত তাঁর চিত্রকর্ম। যেন ছাপচিত্রের মতো একই চিত্রপটে দু-তিনটি বুনটের রূপাঞ্জলি। সে-কাজে চোখ তৃপ্ত হলেও মন ঠিক ভরত না। টেকনিক যেখানে মুখ্য সৃষ্টির ফুল, সেখানে আবেগের মাধুর্যে ফোটে না। শিল্পী নিজেও বুঝেছেন এই সীমাবদ্ধতা, তা কাটিয়ে উঠতে চেষ্টাও করেছেন। আবারও বদলে গেছে তাঁর আঁকার ধরন।
২০১০ সালে বেঙ্গলের এক আর্ট ক্যাম্প আয়োজিত হয় ঢাকা বিমানবন্দরের কাছে প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ে। অংশগ্রহণকারী সতীর্থ শিল্পীরা সবাই আঁকছেন। হাসান দেখছেন আর ভাবছেন কী করে কোথা থেকে তিনি শুরু করবেন। হঠাৎ তাঁর চোখে ধরা পড়ল লম্বা সারিবদ্ধ গাছের ভেতরে আলোছায়ার কাঁপন। দেখা দৃশ্যের মধ্যেই অন্যরূপের আবিষ্কার! শিল্পীর মুগ্ধতা যেন তাঁকে স্থির করে দিলো ছবি আঁকার বিষয় আর প্রকরণ-কৌশল। ক্যানভাসে তিনি রং ছুড়তে শুরু করলেন, রংকে গড়িয়ে পড়তে দিলেন। তাতেও শিল্পীমন তৃপ্ত হয় না। আরো রং ছুড়তে ছুড়তে একসময় যেন দেখা দৃশ্যের যে-অনুভব তার কাছাকাছি আসা গেল। এভাবেই বদলে গেল হাসানের চিত্রপট।
২৯ অক্টোবর, বুধবার সন্ধ্যায় বেঙ্গল শিল্পালয়ের ভেতর একদল আগ্রহী নবীন দর্শক-শ্রোতাকে সামনে নিয়ে শিল্পী হাসান মাহমুদ বলছিলেন তাঁর কাজের ধরন, করণকৌশল আর গ্যালারি ডিসপ্লে নিয়ে। আমিও উপস্থিত সেখানে। হাসান নিজেই একজন ডিসপ্লে-বিশেষজ্ঞ। কাজ করেন খুব গুছিয়ে। নিজের পেইন্টিং ডিসপ্লের জন্য শিল্পী ফ্লোরপ্ল্যান নিয়েই গ্যালারিতে ঢুকেছিলেন। তবে কাজ করতে করতে বাস্তবিক প্রয়োজনে পূর্বপরিকল্পনার কিছু পরিবর্তনও ঘটেছে।
গ্যালারির প্রথম কক্ষের প্রথম দেয়ালে ১৯৯৬-এ আঁকা সমান আকারের চারটি জলরং কাজ দিয়ে একটি বর্গাকার জায়গা তৈরি হয়েছে। তার ঠিক বিপরীত দেয়ালেও একই সময়ের দুটি লম্বাটে ছবি মিলে আরেকটি বর্গাকার জমিন তৈরি হয়েছে। এর দুপাশের দুই দেয়ালে আয়তাকার চিত্রপটে ২০১০-১১ সালে করা চিত্রকর্মের সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি কাজ জায়গা পেয়েছে। দেয়ালের সাদাটে রঙের সঙ্গে এই কক্ষে রাখা চিত্রপটের ভেতরকার ব্যাপক শূন্য পরিসর সমতার চমৎকার এক ঐকতান তৈরি করেছে। এর একটির শিরোনাম ‘একাত্তর স্মরণে’। সাদা গড়ানো বর্ণজমিনের দুটি প্রান্তে রক্তাক্ত হাতের আভাস আমাদের হদয়ের রক্তক্ষরণ যেন বাড়িয়ে দেয়। মনে করিয়ে দেয় মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। এই দেয়ালের আর দুটি কাজের শিরোনাম – ‘অবগাহন’ ও ‘পরিত্যক্ত খাঁচা’।
বেঙ্গল চিত্রশালার বড় কক্ষটি ইংরেজি ‘টি’ অক্ষরের মতো। এর শুরুর দক্ষিণ দেয়ালে শীতের আমেজের দুটি ইমেজ। প্রথমটির শিরোনাম ‘শীতের কুয়াশা’, অন্যটি ‘শীতের রাত’। যেন কুয়াশা-কুজ্ঝটিকায় আক্রান্ত ধূসর চিত্রপটে কান পাতলেই দর্শক শিশির পতনের শব্দ শুনতে পাবেন – এমনই অনুভূতি জাগায় প্রথম কাজটি। পরের চিত্রকর্মটিতে শীতার্ত রাতের নৈঃশব্দ্যের ভেতর প্রকৃতির অবগাহনের ভাব ফুটে উঠেছে। সাদামাটা উপস্থাপনায় অসাধারণ দুটি কাজ। ইমেজের চেয়ে অনুভূতিই এতে প্রধান ভূমিকায়। শিল্পীর কৃতিত্ব এখানেই।
এই ঘরের দুই দেয়ালের কৌণিক জায়গাটুকু দারুণভাবে সাজিয়েছেন শিল্পী। ছোট-বড় অনেক ক্যানভাস ওপর-নিচে সাজিয়ে অনেকটা পাখির ডানার মতো চমৎকার একটা গঠন তৈরি করা হয়েছে এখানে। উত্তর দেয়ালে আনুভূমিক লম্বা এক ক্যানভাসে অম্ল-বৃষ্টির ছবি। তার নিচেই হাসানের স্টুডিও পরিবেশের নানা ছবি। কাছেই একটা ইজেল, তাতে কাজ শেষ করা একটা ক্যানভাস রাখা। নিচে রং, রঙের প্যালেট, নানারকম তুলি ও সরঞ্জাম রাখা। মেঝেতে ছড়ানো-ছিটানো রং। শিল্পী এখানে তুলে এনেছেন নিজ স্টুডিওর পরিবেশ। দর্শক যেন অনুভব করতে পারেন শিল্পরচনা-প্রক্রিয়ার পুরো বিষয়। গ্যালারি-অভ্যন্তরে শিল্পীর সঙ্গে পেইন্টিংয়ের দর্শকদের অংশগ্রহণমূলক এই প্রক্রিয়ার আন্তরিকতা দর্শকদের প্রাণিত করবে সন্দেহ নেই।
পূর্ব দেয়ালে চারটি রঙিন পেইন্টিং স্থান পেয়েছে। এগুলোর শিরোনাম – ‘দুপুর ১টায় গ্রীষ্ম’, ‘লালের আবরণ’, ‘নীল রাত’ ও ‘আলট্রামেরিন’। বেশিরভাগ ধূসর ও কালচে বর্ণের চিত্রকর্মের মধ্যে এই চারটি কাজ আলাদা হয়েছে রঙের জৌলুসে। গঠনপ্রক্রিয়া একই। তবে বর্ণব্যবস্থাপনার বহুমাত্রিকতার ভিন্নতায় এই কাজগুলো প্রদর্শনীকে বর্ণিল করেছে।
অনেকেই মেলাচ্ছেন আমেরিকান পপ-আর্ট আন্দোলনের শিল্পী জ্যাকসন পোলকের সঙ্গে। হাসান নিজেও একটি কাজের মাধ্যমে স্মৃতিচারণ করেছেন তাঁর। ওঁর কাজের ধারার সঙ্গে খানিক মিল তো আছেই, তবে হাসান নিজের কাজকে ঢাকার বদলে যাওয়া প্রকৃতির প্রতি তাঁর প্রণতির আকুল প্রকাশ মনে করেন। লক্ষণীয় যে, তাঁর সাম্প্রতিক প্রায় চিত্রকর্মে আমরা রংকে ওপর থেকে গড়াতে দেখি। চোখের জল যেমন গন্ডদেশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে, সেই ইমেজ বিপন্ন শিল্পীর অতীত-বর্তমান ভেদ-ভাবনারই প্রতিফলন। বর্ণপ্রয়োগের স্বতঃস্ফূর্ততায় শিল্পীর গভীর অভিনিবেশে বিষয়টি আরোপিত মনে হয়নি। সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত নিরীক্ষার নানা পর্যায় পার হয়ে এই বিশেষ রীতিটি রপ্ত করে নিজের অনুভবকে তুলে ধরেছেন শিল্পী।
এই পর্যায়টি ২০১০ থেকে ২০১৪ কালপর্বের। সামনে আরো কীভাবে তিনি অগ্রসর হবেন জানি না। তবে আমাদের বিমূর্তধারার চিত্রকলায় সৈয়দ হাসান মাহমুদ একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম হয়ে থাকবেন বলে আমার ধারণা। বেঙ্গল চিত্রশালা-আয়োজিত এ-প্রদর্শনী চলেছে ১৫ নভেম্বর, ২০১৪ পর্যন্ত।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.