ভাত-বন্দনা

প্রণমিয়া পাটনী কহিছে জোড় হাতে।

আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে॥

তথাস্তু বলিয়া দেবী দিলা বরদান।

দুধেভাতে থাকিবেক তোমার সন্তান॥

                     – ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর

ভাত চিরকালই বাঙালির প্রধান খাদ্য। তাই  ‘ভেতো বাঙালি’ বলে বিশে^ আমাদের বদনাম আছে। আমরা ‘ভেতো’ বটে কিন্তু ভীতু তো নই – মহান মুক্তিযুদ্ধ সেই বদনাম ঘুচিয়েছে! নুনভাতই বলি আর পোলাও-পায়েসই বলি – মূল উপাদান ভাতই। উপকরণ যা-ই থাক,  নুন-লংকা, শাক-শুঁটকি, ভর্তা-ডাল, ঘি-দুধ কিংবা বাদশাহি মোগলাই – ফোটানো তণ্ডুলের প্রাধান্যই সর্বত্র। অন্ন বা ভাত মানে তো সিদ্ধ করা তণ্ডুল বা চালই। বাঙালি যেমন রসনাবিলাসী, তেমন অতিথিপরায়ণ এবং আপ্যায়ন-বিলাসীও। তাই ঘরে রাজকীয় খাদ্যোপাদান যতই থাকুক, বিনয়ের আতিশয্যে আমরা সবাই বলি – ‘দুটো ডালভাত খেয়ে যাবেন।’ এই খানাপিনার পর দেহে আসে মদালস্য, চোখে আসে ঘুমের ভাব। একে বলে ‘ভাতঘুম’। দুপুরে খাবার পর ভাতঘুম আসে না বা দেয় না – এমন বাঙালি খুব কমই আছে! সত্যি, বাঙালির জীবন ও সংস্কৃতিতে ভাতের মহিমা অন্তহীন।

 চাল আকারে-প্রকারে ও নামে-জাতে অনেক রকম।

মোটা-সরু, আতপ-সিদ্ধ-সুগন্ধি, আউশ-আমন-বোরো – আরো কত কী! মধ্যযুগের কবি ভারতচন্দ্র অন্নদামঙ্গলে ভাত রান্নার সুদীর্ঘ বর্ণনা দিয়েছেন এ রকম :

অতুলিত অগণিত রান্ধিয়া ব্যঞ্জন।

অন্ন রান্ধে রাশি রাশি অন্নদামোহন॥

মোটা সরু ধানের তণ্ডুল তরতমে।

আশু বোরো আমন রান্ধিলা ক্রমে ক্রমে॥

এদেশে ভাতভক্ষণ ও ধানচাষের ইতিহাস সুপ্রাচীন। ইতিহাসবিদ ড. নীহাররঞ্জন রায় তাঁর বাঙালির ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন : ‘ইতিহাসের ঊষাকাল হইতেই ধান্য যে দেশের প্রথম ও প্রধান উৎপন্ন বস্তু, সেদেশে প্রধান খাদ্যই হইবে ভাত তাহাতে আশ্চর্য হইবার কিছুই নাই। ভাতভক্ষণের এই অভ্যাস ও সংস্কার অস্ট্রিক ভাষাভাষী আদি অস্ট্রেলীয় জনগোষ্ঠীর সভ্যতা ও সংস্কৃতির দান। উচ্চকোটির লোক হইতে আরম্ভ করিয়া নিম্নতম কোটির লোক পর্যন্ত সকলেরই প্রধান ভোগ্যবস্তু ভাত।’

স্বামী বিবেকানন্দের ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত বাঙালির ভাত খাওয়া সম্পর্কে লিখেছেন : ‘তখনকার দিনে অধিকাংশ লোক ভাত খাইত। শহরের লোকেরা আড়াই পোয়া চালের ভাত, রাত্রে আধসের চালের ও তদুপযুক্ত তরকারী।’ ভাতের বর্ণনা ও বৈচিত্র্যের বিবরণ দিতে গিয়ে কৌশিক মজুমদার লিখেছেন : ‘হাঁড়ি ধুয়ে আধফোটা জলে চাল দিয়ে ঝরঝরে ভাত, রোগীর জন্য নরম ভাত, নামাবার আগে গন্ধরাজ লেবুপাতা দিয়ে সুগন্ধী ভাত কিংবা মাড় গালার পরেই অল্প ঘি দিয়ে ঘি-ভাত। বাসি ভাতকেও সুস্বাদু করতে তাতে জল ঢেলে কাঁচা লঙ্কা/ মরিচ, পেঁয়াজ, কাঁসুন্দি, ভাজা আর চচ্চড়ি দিয়ে পান্তা খাওয়া হতো …। কৃত্তিবাসী রামায়ণে কবি হনুমানকেও ভাত খাইয়ে ছেড়েছেন।’ (নুনেতে ভাতেতে)

বাঙালির প্রাণে ও শরীরে পান্তাভাত মৃতসঞ্জীবনীর মতো প্রাণদায়ী এবং শক্তিসঞ্চারী। তাই লোকগাথা, গান ও ছড়ায় পান্তাভাতের জয়জয়কার। লৌকিক বাংলার কৃষিসমাজে প্রাতরাশ মানেই সাধারণত পান্তা। বরিশালে একে বলে ‘পসুতি’। পেট ঠান্ডা রাখে বলে পশ্চিমবঙ্গে বলে ‘পোস্টাই’। পান্তাভাত পৌরাণিক  ঐতিহ্যের সঙ্গেও যুক্ত। দুর্গাপূজার দশমীর দিন সকালে পতিগৃহে যাত্রার সময় পান্তাভাত আর কচুশাক খাইয়ে দেবীকে বিদায় জানানো হয়। বাপের বাড়িতে তিনদিন নানা মুখরোচক ব্যঞ্জন খেয়ে স্বামী শিবের কাছে সে-কথা গোপন রাখতেই দেবী শেষ দিন কচুশাক আর পান্তা খান। স্বামী প্রশ্ন করলে যেন বলতে পারেন, দরিদ্র পিতা এর বেশি কিছু আর খাওয়াতে পারেননি। কপটতা থাকলেও বাঙালির দীন অর্থনৈতিক অবস্থা এখানে ফুটে উঠেছে।

বাঙালি-শিশুর জন্মের পর প্রথম সামাজিক অনুষ্ঠানের নাম মুখেভাত – তৎসম শব্দে তাকে বলে ‘অন্নপ্রাশন’। শব্দটি বিশিষ্ট অর্থবোধক বলে সমাস-বিচারে ‘মুখেভাত’ বহুব্রীহি – মুখেভাত দেওয়া হয় যে-অনুষ্ঠানে। শিশুর প্রথম ভাত খাওয়ার অনুষ্ঠান। বাঙালি হিন্দুদের বিবাহ-সংস্কৃতির অনুষ্ঠানাদিও অনেকটা অন্ননির্ভর। ‘আইবুড়ো ভাত’ নামে একটি অনুষ্ঠান আছে। আইবুড়ো শব্দটির অর্থ যা-ই হোক – আয়ুতে বুড়ো বা দীর্ঘদিন বিয়ে না-হওয়া পাত্রপাত্রী – অনুষ্ঠানটি আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-পড়শীর মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন সুদৃঢ় করে। বিয়ের আগে বিশেষত পাত্রীকে প্রতিবেশী ও স্বজন নিমন্ত্রণ দিয়ে খাওয়ায়। তাতে সম্প্রীতির বন্ধনের ও ভোজন-বিনোদনের সঙ্গে থাকে শ^শুরবাড়ি গমনের সম্ভাব্য বিদায়ের সুর। বাঙালি সমাজে বিয়ের পর হয় ‘বউভাত’। বিক্রমপুরে একে বলে ‘পাকস্পর্শ’। নতুন বউ স্বয়ং রান্না করে স্বামী-শ^শুর ও আত্মীয়স্বজনকে পরিবেশন করে। তারপর হয় ‘ভাত-কাপড়’ দেওয়ার অনুষ্ঠান। তাতে একটি বড়ো থালায় ভাত, সপ্ত ব্যঞ্জন এবং নতুন বস্ত্র দিয়ে স্বামীকে স্ত্রীর হাতে তুলে দিতে হয়। শপথ নিতে হয় আমৃত্যু স্ত্রীকে ভাত-কাপড়ের নিশ্চয়তা দানের। এসব শব্দবন্ধে এবং অনুষ্ঠানে লক্ষ করা যায় ভাতেরই প্রাধান্য। তাই বলা যায়, বাঙালির সংস্কৃতি ও সংস্কার অনেকটাই ভাতনির্ভর।

 এই ভাত নিয়ে বাঙালির লৌকিক জীবনে প্রবাদ-প্রবচনও কম নয়! ‘উনা ভাতে দুনা বল/ অতি ভাতে রসাতল।’ ‘হাতে না-হয় ভাতে মারব।’ ‘ভাত দেওয়ার ভাতার না, কিল মারার গোসাই।’ ‘মাছে-ভাতে বাঙালি।’ মধ্যযুগের কবি ভারতচন্দ্রের প্রবচনবাণী : ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে।’ তার আগে চর্যাপদেও পাই ভাতের কথা : ‘হাঁড়িত ভাত নাই নিতি আবেশী।’ সহস্র বছর আগের সাহিত্যে যখন নিত্য উপবাসের কথা জানা যায় তখন ‘হাভাতে’ শব্দটিও আমাদের প্রাচীন জাতিসত্তা অভাব-অনটনের সঙ্গে যুক্ত। খনার বচনেও আছে : ‘কলা রুয়ে না কেটো পাত/ তাতেই কাপড়, তাতেই ভাত।’ ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষকালে রচিত কবি রফিক আজাদের নিন্দিত ও নন্দিত কাব্য-পঙ্ক্তিও মনে পড়ে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের একটি বিখ্যাত গল্পগ্রন্থের নাম দুধভাতে উৎপাত নিশ্চয়ই অনেকে পড়েছেন। বাঙালির পূর্বাপর খাদ্য-সংস্কৃতি নিয়ে নুনেতে ভাতেতে নামে তিন খণ্ডে একটি বৈচিত্র্যমণ্ডিত বই সম্পাদনা করেছেন কলকাতার রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যাল ও অনার্য তাপস। তাতেও ভাতের প্রাধান্য। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু যখন পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করতে গিয়ে বলেন – ‘আমরা তোমাদের ভাতে মারব, পানিতে মারব’ – তখন ‘ভাত’ শত্রুর বিরুদ্ধে অবিনাশী অস্ত্র হয়েই ঝলসে ওঠে। এমন আরো কত কী! তাই ভাত নিয়েও রচিত হতে পারে মহাভারত বা সপ্তকাণ্ড রামায়ণ! বিশে^র সকল রাষ্ট্রে ও রাজনীতিতে একালে স্বীকৃত মানুষের যে পাঁচটি মৌলিক অধিকার – অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসা ও শিক্ষা – এর প্রথমটিই ক্ষুধা নিবারণের খাদ্য। তাই অপ্রিয় হলেও সত্য, আমাদের মতো দরিদ্র ও শ্রেণিবৈষম্যের দেশে ভাতের প্রসঙ্গ যুক্ত হয়েছে মিছিলে, সেøাগানে ও রাজনীতিতে। কবি মহাদেব সাহার  ভাষায় : ‘জুঁইফুলের চেয়ে ভাত সুন্দর’ কিংবা মায়ের মুক্তাখচিত নাকফুলের মতো সাদা ভাত। এসব কাব্যিকতার সঙ্গে নিশ্চয়ই নিরন্ন মানুষের ক্ষুধাগ্নিতে দু-মুঠো ভাতের তুলনা হয় না – তা বাসি-পান্তা যা-ই হোক! তাই মিছিলে-সেøøাগান ওঠে – ভোটের আগে ভাত চাই; অন্ন চাই, বস্ত্র চাই; ভাত দে, কাপড় দে/ নইলে গদি ছাইড়া দে ইত্যাদি।

ভাত নিয়ে কুসংস্কারও কম নেই বাঙালি হিন্দুসমাজে! ‘যত্রতত্র খেলে ভাত/ না-থাকে ধর্ম, না-থাকে জাত।’ লালন ফকির থেকে একালের হরিশংকর জলদাসের জীবন ও আত্মজৈবনিক রচনা এর সাক্ষ্য বহন করে। প্রাচীনকালে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে অন্নগ্রহণ নিয়ে প্রবল বিধিনিষেধ ছিল। বাংলার প্রথম ও অন্যতম প্রধান স্মৃতিকার ভবদেব ভট্টের প্রায়শ্চিত্তপ্রকরণ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ব্রাহ্মণদের জন্য শূদ্রের হাতে ভাত খাওয়া সীমাবদ্ধ ছিল। ব্রাহ্মণের জন্য নিষিদ্ধ ছিল শূদ্র, চণ্ডাল, ডোম, মেথর, নর্তকী ইত্যাদি অন্ত্যজ শ্রেণির হাতের রান্না খাওয়া। ব্রাহ্মণ বৈশ্যের স্পর্শিত ভাত খেলে প্রায়শ্চিত্ত এক-চতুর্থাংশ এবং ক্ষত্রিয়ের ক্ষেত্রে অর্ধেক কম। লক্ষ করা যায়, প্রাচীন ভারতীয় বর্ণাশ্রম প্রথা ভাত এবং স্পর্শদোষের অলীক ভাইরাসেই আক্রান্ত। সেই ছোঁয়াচে সংস্কারে ব্রাহ্মণের দোষ কম – যদিও নিম্নবর্গের ছায়ার স্পর্শেও তারা স্নান করত। যত দোষ ওই নন্দ ঘোষের মতো অন্ত্যজদের ক্ষেত্রে। তখন জাতের বড়াই ভাতের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। হ্রাস পেলেও এর আলামত এখনো কম নেই! ভাত তাই বাঙালি সমাজে কুসংস্কারের অন্যতম অনুষঙ্গ। জাতধর্ম যখন থেকে ভাতের হাঁড়িতে ঢুকেছে তখন থেকেই মনুষ্যত্বের অবমাননা এবং সামাজিক অবক্ষয়ের সূচনা।

ভাত শর্করাজাতীয় খাদ্য। তবে খাদ্য হিসেবে এ-অঞ্চলে ভাতের প্রচলন কখন থেকে তা বলা মুশকিল – নিশ্চয়ই কৃষিসভ্যতা বিকাশের পর। সমাজবিজ্ঞানীদের গবেষণা থেকে জানা যায়, বাঙালির ভাতের ঐতিহ্য অস্ট্রিকভাষী আদি অস্ট্রেলীয় জনগোষ্ঠীর সভ্যতা ও সংস্কৃতির দান। তবে চর্যাপদের পর মঙ্গলকাব্য ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে ‘ভাত’ শব্দের বেশ ব্যবহার লক্ষ করা যায়। ভাতের গুণ ও সৌন্দর্য বর্ণনা করে আনুমানিক চতুর্দশ শতকের প্রাকৃত পৈঙ্গল গ্রন্থে বলা হয়েছে : ‘ওগগর ভত্তা রম্ভা পত্তা গাইক ঘিত্তা দুগ্ধ সজুত্তা।’ প্রাচীনকালে ভাত পরিবেশনের আরেক বর্ণনায় পাওয়া যায় : ‘বর্তিসা কলার এক আঙ্গুটিয়া পাত,/ উণ্ডারিল তিন মান তণ্ডুলের ভাত।/ পীত সুগন্ধী ঘৃতে অন্ন সিক্ত কৈল,/ চারিদিকে পাতে ঘৃত বহিয়া চলিল।’ কলাপাতায় ধোঁয়া-ওঠা গরম ভাত গাওয়া-ঘি দিয়ে খাওয়ার রীতি বাঙালির প্রাচীন ঐতিহ্য। শ্রীহর্ষের ‘নৈষধচরিত’-এ ভাতের বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে : ‘পরিবেশিত অন্ন থেকে ধোঁয়া উঠছে, তার প্রতিটি কণা অভগ্ন, একটা থেকে আরেকটা বিচ্ছিন্ন (ঝরঝরে ভাত), সে-অন্ন সুসিদ্ধ ও শুভ্রবর্ণ, সরু এবং সৌরভময়।’ অথর্ব বেদ, প্রাচীন সাহিত্য ও ভারতীয় পুরাণে ভাতের প্রচুর পরিচয় ও প্রার্থনা পাওয়া যায়। ‘তোমরা সৎকার্যকারীকে অন্নে ভরিয়া দাও।’ ‘ইন্দ্র ঊর্ধ্বে অন্নের দাতা।’ ‘ইন্দ্র ও অগ্নি, তোমাদের কাছে অন্ন প্রার্থনা করি। অন্নলাভের পথ দেখিয়ে দাও।’

‘পুত্রপৌত্রাদিক্রমে যেন অন্ন ভোগ করি।’ ঋগে¦দ জুড়ে আছে আরো প্রার্থনা : ‘অন্ন যেন লাভ করতে পারি’, ‘যেন অন্নের ওপরে অধিকার থাকে’, ‘যেন অন্নের সবচেয়ে নিকটে থাকতে পারি’, ‘ইন্দ্রের স্তব কর, প্রশংসা কর, স্তাবকের জন্য যেন স্ফীত নদীর মতো অন্ন দান করেন।’ এসব প্রার্থনাই তো সর্বস্তরের বাঙালির, ধনী-দরিদ্র, আমির-ফকির সকলের – স্বাস্থ্য, পুষ্টি, বল, জীবন, সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য।

কেবল ঋগে¦দেই ভাতের প্রতিশব্দ আছে চোদ্দোটি – অন্ন, অন্ধস্, ইষ, বাজ, পৃক্ষ, পৃতু, ভক্ত, শ্রবস্, স্বধা, ঊর্জ, ইলা, চান, নমস্ ও বয়স্। একমাত্র অন্ন ছাড়া বাকি সবই এখন বাংলায় অপ্রচলিত সংস্কৃত শব্দ এবং অভিধানবন্দি। তবে ভাষাবিজ্ঞানীরা বলেন, ‘ভক্ত’ শব্দ থেকে ভাত শব্দের উৎপত্তি – ভক্ত > ভত্ত > ভাত। এর শব্দমূলের অর্থ যা-ই হোক ধনী-দরিদ্র ও আশরাফ-আতরাফ নির্বিশেষে বাঙালিমাত্রেই ভাতের ভক্ত। তবে মনে রাখতে হবে, ভাত থেকে ‘আ’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে ‘ভাতা’ শব্দের উৎপত্তি হলেও উৎসের বিচারে ভাতের সঙ্গে স্বামী অর্থে ‘ভাতার’ শব্দের কোনো মিতালি নেই! সংস্কৃত ‘ভর্ক্তৃ’ থেকে বিবর্তিত হয়ে এসেছে ভাতার। এর অর্থ কোনো নারীর সমাজস্বীকৃত দাম্পত্যসঙ্গী হিসেবে স্বামী। শব্দটি নিন্দার্থে লৌকিক জীবনে ব্যবহৃত হয়। ‘ভাতারখাগি’, ‘বারোভাতারি’ এই শব্দদুটি এর সাক্ষ্য। তবু এই পুরুষতান্ত্রিক বাঙালি সমাজে ভাতের সঙ্গে ভাতারের একটি অদৃশ্য আত্মিক সম্পর্ক আছে। কেননা, নারীরা এখনো রোজগেরে নয়, আত্মনির্ভরশীল নয়, অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন নয়।

সংস্কৃত ‘ভাত’ শব্দের অর্থ – দীপ্তি, কিরণ, আলো, জ্বলা, প্রকাশ পাওয়া, শোভা পাওয়া, আলোকিত হওয়া, দীপ্ত হওয়া ইত্যাদি। এর উচ্চারণ ভাৎ নয়, ‘ভাতো’। একদা এই শব্দটি কবিতা ও গানে বেশি প্রয়োগ হতো। মান্না দে-র সেই মনকাড়া প্রেমের গান তো অনেকেই শুনেছেন – ‘আমি যামিনী তুমি শশী হে, ভাতিছ গগনমাঝে।’ স্কুুলজীবনে আমরা ভাবসম্প্রসারণে পেয়েছি : ‘যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি/ আশু গৃহে তার দেখিবে না আর নিশীথে প্রদীপ ভাতি।’ এই ভাতিকে তখন আমরা অনেকেই ছাপার ভুল ভেবে ‘বাতি’ মনে করেছি। মাইকেলের মেঘনাদবধ মহাকাব্যে পাই : ‘ভাতে যবে স্বাতী সতী গগনমণ্ডলে।’ সংস্কৃত ‘ভাত’ শব্দটি বাংলায় এখন প্রায় অপ্রচলিত হলেও উপসর্গযুক্ত ‘প্রভাত’ সুপ্রচলিত। যমক কাব্যালংকারে এর চমৎকার উদাহরণ আছে : ‘একদা প্রভাতে ভানুর প্রভাতে ফুটিল কমলগুলি।’ এখানে বিভক্তিযুক্ত দুই প্রভাতের অর্থ দুরকম।  প্রথমটি সকালে (প্রভাত + এ) আর পরেরটি আলোতে (প্রভা + তে)। দুটো শব্দই দুরকম প্রত্যয় যুক্ত হয়ে প্রভাতে। এখানেই বাংলা শব্দের জাদুকরী চমক! শব্দ যে-ভাষারই হোক, আত্তীকরণে বাংলা ভাষা উদার। আমরা খাদ্য অর্থে বাংলা ‘ভাত’ চাই – কিরণ অর্থে সংস্কৃত ‘ভাত’ও চাই। একটি বৈষয়িক, অন্যটি আত্মিক। খাদ্য চাই জীবন বাঁচাতে আর আলো জীবন সাজাতে, মুক্তবুদ্ধি ও চেতনা-বিকাশে। তবে সাধারণ্যে খাদ্য ভাতেরই অগ্রাধিকার। এক্ষেত্রে বাঙালি নিরাপস – ভাত চাই-ই চাই – লড়াই করে বা ভিক্ষা মেগে। ভেতো বাঙালির এই আপসহীনতা নিয়ে একটি গল্প বলে এ-পর্ব শেষে করি : গুরুতর এক ডায়াবেটিস রোগী ডাক্তারের কাছে গেছেন চিকিৎসার জন্য। ডাক্তার তাঁকে ওষুধের সঙ্গে পথ্য হিসেবে খাবার মেন্যু দিলেন – সকালে দুটো রুটি, দুপুরে এক কাপ ভাত এবং রাতে দুটো রুটি। এ-কথা শুনে রোগী ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলেন – দুটো রুটি কি ভাত খাওয়ার আগে খাব, নাকি পরে!

Published :


Comments

Leave a Reply