মনীষী আবুল  হুসেন : জীবনী ও অন্যান্য বিষয়ে কিছু নতুন ভাবনা

১৯৩৮ সালে মনীষী, সমাজ সংস্কারক ও চিন্তক আবুল হুসেনের অকাল প্রয়াণের পর বিগত পঁচাশি বছরে তাঁকে নিয়ে, তাঁর প্রবন্ধভাবনা বিশ্লেষণে, তাঁর চিন্তার দর্শনের খোঁজে বিস্তর লেখা হয়েছে – এমনটা বলা যাবে না। তবে কমবেশি গুণীজন, বিদগ্ধজন লিখেছেন। বাংলা একাডেমিও বিভিন্ন মনীষীর রচনা গ্রন্থমালাতে আবুল হুসেন রচনাবলী-১ম খণ্ড স্থান দিয়েছে। তবে আবুল হুসেনের রচনা কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়ায় পরবর্তী খণ্ড প্রকাশের আর সুযোগ হয়নি। তাঁর অসাধারণ সব প্রবন্ধ ও রচনা সেই সময়ের সমাজে প্রচণ্ড তোলপাড় তুললেও পরে শিখাগোষ্ঠী ভেঙে যাওয়ায়, বিশেষ করে আবুল হুসেনের মৃত্যু ও কাজী আব্দুল ওদুদের দেশান্তর গমনে সমাজের ঈপ্সিত পরিবর্তনের ঢেউ থমকে যায়। ইতোমধ্যে এদেশের বাঙালি মুসলমান সমাজ দুটো রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কাঠামো-পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে কাল অতিক্রম করেছে। এই সময়ে আস্তে আস্তে সমাজের রন্ধ্রে ধর্মীয় মৌলবাদ ঘুণপোকার মতো ঢুকে ভেতর থেকে ঝাঁঝরা করে সমাজকে আবুল হুসেনদের বিপরীত স্রোতে ডুবিয়ে দিয়েছে। তাই আবুল হুসেন এখনো প্রাসঙ্গিক এবং আরাধ্য।

‘শিখাগোষ্ঠী’, আবুল হুসেন ও কাজী আব্দুল ওদুদ এখনো আমাদের চর্চার কেন্দ্রে বিরাজমান। বাজারে প্রচলিত, বাংলা একাডেমিসহ আবুল হুসেন-সম্পর্কিত যেসব গ্রন্থ ও রচনা বিদ্যমান, সেখানে কিছু তথ্যগত বিভ্রান্তি দেখা যায়। সম্প্রতি তাঁর স্বজনের কাছে রাখা আবুল হুসেনের ছাত্রজীবনের ডায়েরি (১৯১৬-১৯) পড়ে ও গবেষণায় তাঁর জীবন এবং কাজ সম্পর্কিত পরিবর্তিত উপলব্ধি জেগেছে, যা সকলের গোচরে আনা প্রয়োজন।

বিগত ২৩শে পৌষ ১৪৩০ বাংলা, রোববার (৭ই জানুয়ারি ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ) ছিল সমাজসংস্কারক ও চিন্তক আবুল হুসেনের ১২৭তম জন্মদিন। এই ক্ষণজন্মা পুরুষ বিভিন্ন তথ্যমতে বাংলা ১৩০৩ সনে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার নিভৃত পানিসারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মসাল নিয়ে মৃদু বিতর্ক থাকলেও বাংলা মাসের তারিখ নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ দেখি না। বাংলা একাডেমিসহ বিভিন্ন গ্রন্থে লেখা জন্মতারিখ ২৩শে পৌষ ১৩০৩ বাংলা, ৬ই জানুয়ারি ১৮৯৭ খিষ্টাব্দ, বুধবার।

মনীষী আবুল হুসেন ১৯১৮ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে বিএ ক্লাসে অধ্যয়নকালে তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘২৪শে পৌষ মঙ্গলবার – ৮ই জানুয়ারি ১৯১৮। গতকল্য আমি রাত্রি ৯টার সময় আমার দ্বাবিংশ জন্মদিন উপলক্ষে একটা ছোট মজলিস আয়োজন করেছিলাম।’ এর অর্থ হতে পারে, তিনি যেদিন ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন সেটাকে প্রথম ধরলে ১৯১৮ সালে দ্বাবিংশতম জন্মদিন। আর জন্মের পরবর্তী বছরপূর্তিকে ধরলে তাঁর জন্মবৎসর হয় ১৮৯৬ সাল। এক গবেষকের অভিসন্দর্ভে এমনই ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। আবার তিনি ১৯৩৮ সালের ১৫ই অক্টোবর সকাল সাড়ে ৮টায় কলকাতায় নিজ বাসায় মৃত্যুবরণ করলে তাঁর এক নিকটাত্মীয় নোট লেখেন – আবুল হুসেন ভাই ৪২ বছর ৮ মাস ১৮ দিন বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন। কিন্তু বাংলা একাডেমিসহ বিভিন্ন গ্রন্থে ৪১ বছর ৯ মাস বয়সে সকাল সাড়ে ৭টায় মৃত্যুবরণ উল্লিখিত হয়েছে।

একশ বছরেরও পুরনো আবুল হুসেনের ডায়েরির পাতা পাঠোদ্ধারে এ-রচনা। এ-রচনাতে নতুন তথ্য সন্নিবেশিত হলো। আজ থেকে ১২৭ বছর (মতান্তরে ১২৮) আগে জন্ম নেওয়া এই মনীষীর সমাজভাবনা এখনো প্রাসঙ্গিক। বর্তমান অশান্ত সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে উন্নয়ন ও প্রশান্তির বাতাবরণ প্রত্যাশায় আগের যে-কোনো সময়ের চেয়ে তাঁর সংস্কারভাবনা বাঙালি মুসলমান সমাজে যেন আরো বেশি জরুরি। আবুল হুসেনের ভাবনাকে বুঝতে, উপলব্ধি করতে হলে তাঁর রচনাসমূহ পাঠের বিকল্প নেই। সামান্য কথায় বা অল্পকথায় তা বোঝাতে গেলে কোনো কোনো পাঠক অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়ে হয়তো বিব্রত হবেন।

বিগত শতকের বিশ থেকে চল্লিশের দশক – প্রায় কুড়ি বৎসর – নিরলস নিজের একক লিখন-বক্তৃতায়, পরে গোষ্ঠীগত (ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের মুসলিম সাহিত্য সমাজ ও শিখাগোষ্ঠী)  লেখালেখি ও বক্তৃতায় বাঙালি মুসলমান সমাজকে নিজ বলে বলীয়ান ও ধর্মীয় কুসংস্কারমুক্ত করতে এবং শিক্ষাসহ নারী জাগরণে যে ভাবান্দোলন করেন, তার ফলস্বরূপ ১৯৪৭-এর দেশভাগ এবং ১৯৫২-এর ভাষা-আন্দোলন সংঘটিত বলে পরবর্তীকালে বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন। আর ভাষা-আন্দোলন একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের আঁতুড়ঘর হলে, আবুল হুসেন ও শিখাগোষ্ঠীর অবদানকে কিভাবে মূল্যায়ন করা হবে?

দেখা যাক বিশিষ্ট ব্যক্তিরা কে কী বলেছেন। ১৯৫৭ সালে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. মাহমুদ হোসেন (পরবর্তীকালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী) এক প্রবন্ধে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-এর অবদান সম্পর্কে লিখেছেন, ‘Kazi Abdul Wadud had a daringly original mode of thinking …, Mr. Abul Hussain was a man of will and action. The man of thought and the man of action combined to found Dacca Muslim Sahitya Samaj, which came to be regarded as a new school of thought. I was also one of them, we preached through our writings the ideal of emancipation of intellect… But it is also a fact that the purging flame of truth did help to destroy a number of social evils. Prejudice against music and over-adherence to the Purdah are cases in point… These fundamental questions are by no means new to the world, nor even to the Muslim world. But this was the first time such questions were openly and perhaps, unbiasedly sought to be thrashed out in the Bengali language in the teeth of opposition from the orthodox’

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সন্তোষ হালদার লিখেছেন, ‘দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হলো। এর পরপর শুরু হলো ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন; ১৯৫২ সালে যা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেল। বাঙালি মুসলমান মানসে চিৎপ্রকর্ষের এ এক অদ্ভূত অধ্যায় যা ছিল মূলত দ্বিজাতিতত্ত্বের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর। আন্তঃশক্তির এ বহিঃপ্রকাশ বিশের দশকে ঢাকা কেন্দ্রিক শিখা গোষ্ঠীর আবির্ভাব না ঘটলে বাঙালির এ জাগরণ এতোখানি বেগবান হতে পারতো কি না তা আজ গবেষণার বিষয়।’ তিনি আরো লেখেন, ‘শিখায় প্রকাশিত প্রবন্ধাবলি শুধুমাত্র মুসলিম সমাজের সমস্যা ও তার সমাধানের বিষয়ের মধ্যেই সীমিত ছিল না। বরং, সেই দুর্যোগের দিনে সমগ্র ভারতবাসীর ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্যই ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’

আবুল হুসেনকে বুঝতে হলে তাঁর বেড়ে-ওঠার সমাজ, সময়কাল ও প্রতিবেশকে বুঝতে হবে। হুসেন পানিসারার নিজ বাড়িতে সংস্কারমুক্ত শিক্ষিত পিতা মৌলভি মুছার কাছে বাংলা, আরবি, ফার্সি শিক্ষা গ্রহণ করেন। একটু বড় হলে শিশুকালেই কাছের টাওরা গ্রামে পণ্ডিত সীতানাথ সরকারের টোল বা পাঠশালায় লেখাপড়া আরম্ভ করেন (ডায়েরি)। তাঁর দশজন সহপাঠীর মধ্যে তিনি ছাড়া সকলেই সনাতন ধর্মাবলম্বী। পিতা ১৯০৬ সালে যশোরের ঝিকরগাছার এম ই স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে তাঁকে ভর্তি করান। পৈতৃক নিবাস কাউরিয়া গ্রামের অবস্থানে থেকে ১৯০৯ সালে ঝিকরগাছা স্কুলের পাঠ চুকিয়ে ১৯১০ সালে যশোর জেলা স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। অধিক-সন্তান-জন্ম-পরিবারের সদস্য হওয়ায় গরিব ও মেধাবী আবুল হুসেন কিশোরকালে সপ্তম শ্রেণিতে থাকাকালে যশোরের খোলাডাঙ্গায় যশোর সিভিল কোর্টের নাজির নজীর উদ্দীনের বাসায় জায়গীর গ্রহণ করেন। সেখানে গরুর বিচালি (জাউনা) কাটা, বাজার করাসহ মনিবের দুই ছেলে লুৎফর রহমান ও শামসুর রহমানকে পড়াতেন। এখানে যশোর জিলা স্কুলের প্রভাবশালী শিক্ষক কাজী আনোয়ারুল কাদিরের নজরে পড়েন প্রতিভাবান আবুল হুসেন। জায়গীরের অবস্থান দূরবর্তী এবং সেখানে বেশ পরিশ্রম হওয়াতে কাদির স্যারের সহায়তায় তিনি ১৯১২ সালে জিলা স্কুলে নবপ্রতিষ্ঠিত মুসলিম হোস্টেলে চলে আসেন এবং অর্থের সংস্থানে যশোরের কিরণ চিরুণীকলে খণ্ডখালীন শ্রমিকের কাজ নেন। ১৯১৪ সালে ১০ টাকা বৃত্তিসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ শেষে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে যাওয়ার আগের চার বছর যশোরে অবস্থানকাল ছিল তাঁর জন্য ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ – একদিকে জীবনসংগ্রামের টানাপড়েন, অন্যদিকে দেশীয় রাজনীতিতে উত্তাপের আঁচ তাঁকেও ছুঁয়ে যায়।

বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তুমুল স্বদেশি আন্দোলন ধীরে ধীরে বাঙালি হিন্দু এলিট সমাজের হিন্দুত্বের দর্শনঘোরের বাইরে অসহযোগ মোড়কে বাঁধা থাকলেও ভেতরে যুগান্তর ও অনুশীলন সমিতির আড়ালে স্বরাজ কায়েম প্রতিষ্ঠার উগ্রবাদী স্বপ্ন সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময়ের যুগান্তর-প্রধান ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত, যশোরের ঠাকুরপুর বাড়ি, যশোর-খুলনার দায়িত্বপ্রাপ্ত। নড়াইলের সন্তান অত্যন্ত মেধাবী সশস্ত্র বিপ্লবী শৈলেন্দ্রনাথের প্রভাবও যশোরের তরুণ সমাজকে প্রভাবিত করে। এতে যুক্ত হতে মুসলমানদের ওপর পরোক্ষ চাপ থাকলেও গুপ্তসংগঠনের সংস্কৃতির অনেক কিছু সচেতন মুসলমানদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। আবুল হুসেনও তাঁর স্কুলবন্ধুদের মাধ্যমে স্বদেশ চেতনায় প্রভাবিত হন। তার নমুনা দেখি পরবর্তী জীবনে, তিনি কোনোদিনই ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে যুক্ত বিপ্লবীদের সমালোচনা করেননি। বরং বিপ্লবীদের সংগ্রাম ও জীবন উৎসর্গের মাধ্যমে একজাতি তত্ত্বে মুসলমান সমাজের উন্নতির আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তাদের সহায়তা কামনার মাধ্যমে নিরক্ষর পতিত মুসলমানের আত্মোন্নয়ন ও মুক্তির পথ খুঁজেছেন।

যশোরে আবুল হুসেনকে মানসিক, আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে আগলে রাখেন তাঁর পিতৃসম শিক্ষক কাজী আনোয়ারুল কাদির (তাঁকে আবুল হুসেন বাবা ডাকতেন)। পরবর্তীকালে কাদির সাহেব ঢাকায় ১৯২২-২৭ সাল পর্যন্ত তাঁর সন্তানসম আবুল হুসেন, কাজী আব্দুল ওদুদ ও কাজী মোতাহার হোসেনের মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানের বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণের প্লাটফরম ‘শিখাগোষ্ঠী’ তৈরিতে ভূমিকা রাখেন। যদিও প্রচলিত ধারায় ঢাকার মুসলিম সাহিত্য সমাজ গঠন ও শিখাগোষ্ঠী সংগঠনের প্রাণপুরুষ কাজী আব্দুল ওদুদ ও আবুল হুসেনকে ধরা হয়, তবুও বিভিন্ন তথ্যে বেরিয়ে এসেছে যে, শিক্ষক কাজী আনোয়ারুল কাদির ছিলেন এঁদের প্রাণভোমরা। ষাট-সত্তর ও আশির দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে ঘিরে ইনটেলেকচুয়ালদের আড্ডা হতো। ১৯২১ থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত কাদিরের বাসায় জমতো ইনটেলেকচুয়াল আড্ডা, ওদুদ-হুসেন-মোতাহারের সঙ্গে সমমনা আরো অনেকে থাকতেন সেখানে। এটা মুসলিম সাহিত্য সমাজ ও শিখাগোষ্ঠীর বিকাশে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের সময়কাল। তাই আনোয়ারুল কাদির বলে গেছেন, ‘আমি এখনকার সক্রেটিস, সক্রেটিস কিছু লিখে যায়নি, অনুসারী রেখে গেছেন, আমিও অনুসারী তৈরী করে গেলাম।’

আবুল হুসেনের চিন্তার বিকাশে দুটো পর্যায় খুঁজে পাওয়া যায়। দুটো পর্যায়েই তিনি বাঙালি মুসলমানের জাগরণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। কোনোটিকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। যশোর স্কুলের রচনা প্রতিযোগিতা বাদ দিলে মুসলমান সমাজের মৌলিক সমস্যা ও ক্ষতিপূরণে এককভাবে মেধাস্ফূরণের পরিশ্রমী লেখালেখিতে ১৯১৬ থেকে তিনি নিয়োজিত এবং সেটি ১৯২১ পর্যন্ত লক্ষ করা যায়। এগুলি হলো সামাজিক সমস্যা, সমস্ত ভারতের সমস্যা, হিন্দু-মুসলমান মিলনের আকাঙ্ক্ষা, মুসলমানদের সামাজিক সংস্কার ইত্যাদি। তিনি এ-সময়ে দূর থেকে সমাজকে অবলোকন করতে থাকেন। এই সময়ে কলকাতায় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতিতে সুদপ্রথা চালুর দাবিতে প্রবন্ধ পাঠে মুসলমানদের রোষানলে পড়ে অপদস্থ হন। আবুল হুসেন এই প্রতিক্রিয়াশীল সমাজকে চিনে রাখেন, ছাত্রাবস্থাতেই ডায়েরিতে এই মূর্খতা সংস্কারে তাঁর প্রতিজ্ঞা দেখি যেন বজ্রকঠিন। তিনি ছাত্রাবস্থাতেই কলকাতায় পারিবারিক পদবি ‘সৈয়দ’ পরিহার করেন। ডায়েরিতে মুসলমানদের তথাকথিত আশরাফ বনে যাওয়াকে কঠোর সমালোচনা করেন। পরবর্তী জীবনে তাঁর সন্তানদের নামেও এই পারিবারিক পদবি ব্যবহার করেননি।

এ-সময় তিনি কলকাতার ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরিতে নিবিষ্টমনে পড়াশোনা করেছেন আর প্রচুর বই কিনেছেন (ডায়েরিমতে)। একশ বছর আগে বিচারপতি সৈয়দ আমীর আলীর বিখ্যাত গ্রন্থ দ্য স্পিরিট অব ইসলাম অনেক মুসলমান মেধাবীর মাথা ঘুরিয়ে দেয়। এতে আমীর আলীকে বাঙলার ইসলামি আলেম ও চিন্তাবিদরা কাফির ঘোষণা করেন। সেই প্যারাডক্স ভাবনায় আবুল হুসেনও সিক্ত হন, ছাত্রাবস্থায়ই আমীর আলীর মতো বয়ান তিনি শিক্ষক গুরু যশোরে কাদিরের কাছে শুনেছিলেন। যুগের ডাকে সমাজ পরিবর্তনের পরিক্রমায় হুসেনের মেধামননে নিজের মুসলমান সমাজ পরিবর্তনের যে নেশা চাপে, সেখানে আরেক দিশা যোগ হয়, সেটা ইসলামের জ্ঞানবিজ্ঞানের সোনালি যুগ। নবম শতাব্দীতে বাগদাদের বিখ্যাত খলিফা হারুন-অর-রশিদের পুত্র খলিফা আল-মামুনের শাসনকালে জ্ঞানবিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসা, সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধনে মুসলমানদের চূড়ান্তে ওঠার সময়ই হলো মোতাজিলা যুগ। হুসেন মোতাজিলা মতবাদকে শুধু ধারণই করেননি, মতবাদ লালনকারী খলিফা আল-মামুনের নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে ‘আল-মামুন ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনাও করেছেন। নারী জাগরণে উদ্যোগী হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের মাঝে ‘অ্যান্টি পর্দা লীগ’ গঠন করেন।

আমরা লক্ষ করি, আবুল হুসেন ১৯১৯ সাল থেকে ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়েছেন। সেই পরিবর্তন জীবনের ডাকে, বাস্তবতার কষাঘাতে। শতপ্রচেষ্টা সত্ত্বেও দারিদ্র্যের বেড় তাঁকে ছাড়েনি। বৃত্তি, টিউশনি, পিতার অনিয়মিত স্বল্প অর্থ জোগানের অসচ্ছলতায় ছাত্রজীবন হুমকির মুখে পড়লে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ ক্লাসে অধ্যয়নের প্রথমদিকেই অনন্যোপায় হয়ে তিনি ১৮ এপ্রিল ১৯১৯ সালে রোজ শুক্রবার (হুসেনের ডায়েরি অনুসারে) রংপুরের গাইবান্ধায় উপস্থিত হয়ে শেখ বশিরউদ্দীনের একমাত্র কন্যা মোসাম্মৎ মৌলুদা খাতুনকে বিয়ে করেন। কিন্তু বাংলা একাডেমিসহ দেশের প্রচলিত গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে যে, তিনি ১৯২১ সালে সাতক্ষীরার সুলতানপুরে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় নিযুক্ত হওয়ার পর ১৯২১ সালের শেষে স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকার আগা মসিহ লেনের ভাড়া বাসায় সংসার আরম্ভ করেন।

এরপর আবুল হুসেনের লেখা ও চিন্তার বাঁক কিছুটা ঘুরে যেতে থাকে। তবে ছাত্রজীবনে তাঁর যেসব লেখা মানুষকে ভাবিয়েছে, আবার বিতর্কে বিঁধেছেন, তার মধ্যে ‘সুদ বা রেবা ও ধনজ’, ‘বাংলার বলশী’ অন্যতম। ছাত্রজীবনে হুসেন ইসলামি জীবনধারায় যেভাবে অনুরক্ত ছিলেন, এমনকি ওয়াক্ত নামাজের জামাতে ইমামতি করতেন (ডায়েরি), পরে তিনি সেই অবস্থান থেকে সরে আসেন। ১৯১৯ সালের পর ধর্মপালনে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে জোর দিয়ে কড়াকড়ি অপছন্দ করতে থাকেন। তিনি বেগম রোকেয়ার লেখনী দ্বারাও প্রভাবিত হন, পরবর্তীকালে তার প্রকাশ দেখি।

আবুল হুসেন ১৯২১ সালের শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে এসে ১৯২২ থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত নিজের মাঝে লালিত মুসলমান জাগরণের প্রস্তুতির ঘাটতিগুলি অনুধাবন করেন এবং ইনটেলেকচুয়াল অংশসমূহ, যেমন অন্যান্য বিষয়ের মতো ধর্মের আলোচনাতেও যুক্তিকে চূড়ান্ত মানদণ্ডরূপে গ্রহণে প্রত্যয়ী হয়ে ওঠার বিষয়গুলি ওদুদ ও শিক্ষক কাদিরের মাধ্যমে পূরণ করেন। এ সময়ে তাঁর কলম বসে থাকেনি, লিখেছেন অন্য বিষয়ে – যেমন শিল্পোৎপাদন, ইউরোপের শিল্পবিপ্লবের সমস্যা ইত্যাদি। ১৯২৫ সালে তাঁর নিজস্ব উদ্যোগ ও পরিকল্পনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে প্রকাশিত হয় মাসিক তরুণপত্র। এখানে আমরা জন্মপালকঝরা পরিবর্তিত যুক্তিবাদী সুবর্ণভূমির ভূমিপুত্র আবুল হুসেনকে খুঁজে পাই। পরে মূলত তাঁর হাতে শিখা পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করে। আরেকটি সহযোগী পত্রিকা সবুজপত্রেও হুসেন দু-হাতে লিখতে থাকেন। এখন তাঁর বিচরণক্ষেত্র যুক্তিবাদিতায় গড়া বস্তনিষ্ঠ লিবারেল হিউমিনিজম ও বুদ্ধির মুক্তি।

এখন তিনি খনিগর্ভের হাজার বছরের পৃথিবীর ভূগর্ভস্থ চাপ-তাপে গড়া মাণিক্য হীরা। এটা হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় ওদুদসহ তিনি সমমনা সঙ্গীদের সঙ্গে কাদির স্যারের বাসার আড্ডায় যেমন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছেন, তেমনি সমসাময়িক শিল্প-সংস্কৃতি হৃদয়ে ধারণ করতে বাইরের আড্ডায় যোগও কম না; সবাই মিলে ঢাকায় নিয়মিত যাত্রাগান, পালাগান দেখেছেন, ব্রাহ্মসমাজের অনুষ্ঠানে গিয়েছেন এবং তাঁদের গান উপভোগ করেছেন। ঢাকার অনতিদূরের নদীমাতৃক অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলি, জনমানুষের হাতেগড়া বাংলার কুটিরশিল্প ও গ্রামীণ সাধারণ মানুষের পীড়িত করুণ অবস্থা স্বচক্ষে দেখতে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তিনি বুঝতে পারেন, বাঙালি মুসলমানের শোষিত হওয়ার পেছনের গল্প, তা হলো, নিজেদের অশিক্ষা, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা আর পুঁজির প্রকট অভাব। তাদের বেড় দিয়ে আছে ধর্মীয় গোঁড়ামির আগল।

তিনি কলকাতায় থাকতে বিষয়টি উপলব্ধি করেন, কুসংস্কার, শোষণ ও অনিয়ম রুখতে ছাত্রাবস্থায় লিখেও ছিলেন। কিন্তু ঢাকায় এসে তিনি ধর্মের কুসংস্কার-ধ্বজাধারীদের বিরুদ্ধে রণডঙ্কা হাঁকলেন, এ যেন কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জাগরণ। তাঁর উইলো থেকে বেরিয়ে এলো ‘নিষেধের বিড়ম্বনা’, ‘আদেশের নিগ্রহ’, ‘তরুণের সাধনা’, ‘মুসলিম কালচার’, ‘The Helots of Bengal’ প্রভৃতি নামক ঝড়-তোলা প্রবন্ধ। তিনি ও ওদুদ বিচারের সম্মুখীন হলেন, প্রাণের সংশয়ে হুসেন ভীত হননি। কাজী আব্দুল ওদুদ তাত্ত্বিক ঘরানার, বয়সে আবুল হুসেনের তিন বছরের বড়। কিন্তু আবুল হুসেন তত্ত্বকে প্রায়োগিক রূপ দিয়ে সংঘটনে চৌকস। তাই বেলাশেষে দেখি হুসেনের রচনা ও কর্মকাণ্ড এবং সমাজের প্রতি প্রায়োগিক দায়বদ্ধতা ওদুদকে ছাড়িয়ে গেছে।

এই ঢাকার আবুল হুসেন সেই আবুল হুসেন নন, যিনি কলকাতার ইলিয়ট হোস্টেলের সুপার মৌলভি কাশিমের বদন্যাতায় গরিব ছাত্রের ফ্রি-সিটে সংশয়ে থাকেন, যাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হলে শেষ বছর বেকার হোস্টেলে পেইড-সিটে কষ্ট ও মনোযাতনায় থাকতে বাধ্য হন, ভুল বুঝে যাঁকে প্রিয়বন্ধু লুৎফর রহমান পরিত্যাগ করে চলে যান (ডায়েরিমতে)। যিনি কলকাতা বিশ^বিদ্যালয়ের কারমাইকেল হোস্টেলে এসে অসাম্প্রদায়িকতা চর্চার সুযোগ পান। এখানে আসার পর তরুণ কাজী নজরুল ইসলাম, বামপন্থী সন্দ্বীপের মুজাফ্ফর আহমদের (পরে কমরেড) সঙ্গে যোগাযোগ ও আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

এমন কোনো বিষয় নেই যে-বিষয়ে আবুল হুসেন লেখেননি। সে-সময়ের বাঙালি মুসলমান সমাজের কোনো  সমস্যা তাঁকে  এড়িয়ে যেতে পারেনি। এটা বুঝতে পারার জন্য প্রথমেই তাঁর কষ্টের জীবন সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। সারাজীবন তিনি কৃষকদের উন্নয়ন ভাবনায় বিভিন্নধারায় লিখে গেছেন। বাঙালি মুসলমানের জীবনমান উন্নয়ন, আপন মহিমায় প্রতিষ্ঠাকরণ, রাজনৈতিক সামর্থ্য অর্জনের উদ্দিষ্ট ভাবনায় নিজের জীবন বিলিয়ে গেছেন। আবুল হুসেনের ভাবনা ও তাঁর সমাজসংস্কারের গণ্ডি মহাবিস্তৃত, বলা যায় সাগরসম। তাঁকে নিয়ে বহুধা বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করা যায়। এতে হয়তো বৃহৎ আয়তনের গ্রন্থ রচনাও সম্ভব বলে মনে করি।

এই আলোচনা শেষ করার আগে দেখতে চাই আবুল হুসেন সেই সময়কার চলমান রাজনৈতিক ধারার কোন অংশে ছিলেন। হুসেনের সমকালে ভারতবর্ষের আকাশে রাজনীতির বৈশাখী মেঘ কুণ্ডলী পাকিয়েছে, ঝড় উঠেছে, সেই ঝড়ে নতুন মানচিত্র বিকশিত হয়েছে। তবে তিনি বর্ষণস্নাত নতুন মানচিত্র দেখে যেতে পারেননি। হুসেনের জীবদ্দশায় দেখা যায়; বঙ্গভঙ্গ, তার জেরে স্বদেশি ও অসহযোগ আন্দোলন, বঙ্গভঙ্গ রদ, স্বরাজ কায়েমে সহিংস আন্দোলন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও অর্থনৈতিক মন্দা, উসমানিয়া সাম্রাজ্যের পতন ও খেলাফত আন্দোলন। এসবের মাঝে ইংরেজদের কূটচালে হিন্দু ও মুসলমানের জাতীয়তাবাদের বিকাশ সামনে চলে আসে। তারা ক্রমান্বয়ে মুখোমুখি অবস্থানে চলে যায়। আবুল হুসেন ছাত্রাবস্থাতেই হিন্দু-মুসলমানের মিলনস্বপ্নে সোচ্চার, ‘মিলনে’ নামের প্রবন্ধ ১৯১৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সাহিত্য সমিতিতে পাঠ করেন (ডায়েরিমতে)। এ-সময়ের জটিল ও অনিশ্চিত সামাজিক বিন্যাসে বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের মিলেমিশে (নিবন্ধ ‘মিলমিশ’) পাশাপাশি চলার আহ্বান করেন। হুসেনের চাওয়া কি ছিল? তিনি চেয়েছিলেন, মাটির মুক্তির আগে মানুষের মুক্তি। দুর্বল মুসলমান শক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে সারাভারতের জনগণের সামাজিক-অর্থনৈতিক মুক্তি কামনা করেছেন।

আবুল হুসেন রচনাবলী এবং অধুনা তাঁর ডায়েরি পাঠে ছাত্রাবস্থার মানসপট বিবেচনা করলে তাঁর মনের অবস্থা আঁচ করা যায়। ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়, কংগ্রেস তারও আগে ১৮৮৫ সালে। হুসেন মুসলিম লীগারদের মোটেও পছন্দ করতেন না, তাঁদের অতীতমুখী নীতির প্রকাশ্য বিরোধিতা করতেন। এর অন্যতম কারণ মুসলিম লীগের পশ্চাদমুখিনতা, তাদের খেলাফত আন্দোলন (১৯১৯-২৪) হুসেনের মতো মেধাবী ও বিবেকবানের কাছে ‘নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর’ মতো, অথচ ভারতের অশিক্ষিত, পিছিয়েপড়া মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নিয়ে তাদের সামাজিক-অর্থনৈতিক কর্মসূচি নেই, শুধু ক্ষমতা দখলের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা। কংগ্রেসের বিষয়ে কোনো প্রকাশ্য বিরোধিতা লক্ষ করা যায় না, কারণ সেখানে জ্ঞানীদের উপস্থিতি এবং বর্তমান বিষয়ভিত্তিক সমস্যাকে প্রাধান্য দেওয়া কারণ হতে পারে। লক্ষণীয় বিষয়, ১৯১৭ সালের অক্টোবরে রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লব মহামতি লেনিনের কমিউনিস্ট পার্টির কাছে সমর্পিত হয়ে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের বলশেভিক বিপ্লবের প্রতি আবুল হুসেন এতো অনুরক্ত হয়ে পড়েন যে, সারাজীবন বাংলার মুসলিম জাগরণের, বিশেষ করে কৃষক জাগরণের স্বপ্ন দেখে গেছেন। ছাত্রাবস্থায় ও পরবর্তীতালে লিখেছেন ‘বাংলার বলশী’, ‘কৃষকের আর্তনাদ’, ‘কৃষি বিপ্লবের সূচনা’, ‘কৃষকের দুর্দশা’ ইত্যাদি প্রবন্ধ। সেই ছাত্রাবস্থায় এবং পরে কলকাতার আইনপেশার জীবনে (১৯৩২-৩৮) সিনিয়র বন্ধু কমরেড মুজাফ্ফর আহমদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয় ১৯২০, মতান্তরে ১৯২৫ সালে, কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ প্রমুখের নেতৃত্বে। আবুল হুসেন যেমন আরবের ইসলামি সংস্কৃতিকে পুরনো ও অচল সেমিটিক সভ্যতার অংশ হিসেবে বর্তমানের যুক্তিবাদী মন দিয়ে গ্রহণ করতে পারেননি, তেমনি রাশিয়ার বিপ্লবী পার্টির রেপ্লিকা ভারতে গ্রহণে তাঁর আগ্রহে ঘাটতি লক্ষ করা যায়। কারণ বাংলা তথা ভারতের মুসলমানরা এত পিছিয়ে যে, কমিউনিস্ট পার্টির আদর্শ মানতে গেলে কম্বলের লোম বাছার মতো হয়ে মুসলমানরা ধর্মহীন হয়ে পড়বে এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে আবার তাদের অন্ধকারে নিয়ে যাবে। তাই হয়তো তিনি ইসলাম ধর্মের মৌলিক কাঠামো নয়, আইনকানুন ও বিধিবিধানের সময়োপযোগী সংস্কার চেয়েছিলেন।

তিনি মুসলিম লীগ, কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হওয়ার প্রয়োজনয়ীতা অনুভব করেননি। তার পরেও তাঁর হৃদয়কোটরে মুসলমান জাগরণ, চাষিমুক্তির ভাবনা মুছে যায়নি। ১৯৩৫ সালে তিনি ইউনাইটেড মুসলিম পার্টি নামে রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং যশোর ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের সরাসরি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এই পার্টি গড়তে আবুল হুসেন যারপরনাই শ্রম দেন। তিনি সেই সময় গ্রামের বাড়িতে আগমন উপলক্ষে গাড়ি বা ট্রেনে না চড়ে কলকাতা থেকে পায়ে হেঁটে ৭০-৭৫ মাইল সংকুল-পথ কয়েকদিনে ভ্রমণ করতেন। পথে পথে তিনি সাধারণ মানুষের জীবনমান, শিক্ষা, কৃষি সমস্যার বিষয়ে আলোচনা করতেন। এটাই তাঁর পীড়িত হওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়।

আবুল হুসেনের ডায়েরির (১৯১৬-১৯) অংশবিশেষ পাঠের পর তাঁকে নিয়ে রচিত আগের অনেক তথ্য সংশোধনযোগ্য বলে মনে করি। মনশ্চক্ষে এক মেধাবী গরিব ছাত্রের জীবনের প্রতিজ্ঞা নতুনভাবে উদ্ভাসিত হলো – সুকঠিন ধাতুতে মোড়া, অথচ কী অপরূপ ও মায়াবী! মাত্র ৪২ বছরের স্বল্পায়ু জীবন ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত জাতিগঠনে কি অপরিসীম অবদান রেখেছিলেন তার খোঁজ কেউ নেয়নি – এটাই সত্য। তাই বলে তিনি এখনো ফুরিয়ে যাননি। কারণ আবুল হুসেনের মনোজগৎ ও দৃষ্টিনিবদ্ধতা তাঁর সময় ছাড়িয়ে আগামীর দিনে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সমৃদ্ধির পানে; হয়তো একশ, দুশো বা ততোধিককালের অগ্রিম স্বপ্ন তিনি ভারতবর্ষের সকল ধর্মের জনগণকে, বিশেষভাবে বাঙালি মুসলমানকে দেখিয়ে গেছেন। তাঁর জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ, রচনা ও প্রচারণা এখনো বাংলাদেশের পশ্চাৎপদ সমাজকে এগিয়ে নিতে খুবই প্রয়োজন।

সূত্র

১। আবুল হুসেন রচনাবলী, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।

২। শিখা সমগ্র, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।

৩। বুদ্ধির মুক্তি শিখা ও আবুল হুসেন, সংবেদ প্রকাশনী, ঢাকা।

৪। আবুল হুসেনের ডায়েরি (১৯১৬-১৯)।