মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিভাষায় অপত্য প্রত্যয়

সারসংক্ষেপ

মধুসূদন কবি ও বিদ্রোহী কবি। বহুভাষাবিদ এবং সেই সুবাদে সংস্কৃত ভাষায় ও ব্যাকরণে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য থেকে তিনি কাব্যের ভাষা ও ছন্দের প্রয়োজনে ব্যবহার করেছেন ‘অপত্য প্রত্যয়’। ‘অপত্য’ শব্দের অর্থ সন্তান বা কোনো দেশ থেকে আগত কোনো ব্যক্তিবিশেষকে বোঝায়। এই প্রত্যয়ের সাহায্যে যুগপৎ পুত্র ও গোত্রাপত্য অর্থাৎ গোত্রের পৌত্রাদি বংশধরকে বোঝায়। শাস্ত্রে আছে, পুত্র পিতা-মাতাকে ‘পুত’ নামক নরক থেকে উদ্ধার করে। মাইকেল তাঁর মেঘনাদবধ কাব্যে অপত্য প্রত্যয়ের ব্যবহারের ফলে কবিভাষা গাঢ়, পরিমিত, দৃঢ় এবং অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রত্যেক পঙ্ক্তিতে চৌদ্দ অক্ষরের সমন্বয় হতে অসুবিধে হয়নি, অসুবিধে হয়নি ছন্দের মধুরতায় শান্তি ও সংহতি আনার ক্ষেত্রে। এ-জাতীয় ব্যাকরণিক প্রয়োগের ফলে পয়ারের কবিত্বহীন মাধ্যাকর্ষণীয় প্রভাবমুক্ত হয়ে সৃষ্টি হয়েছে অমিত্রাক্ষর ছন্দ। পয়ারের অন্ত্যমিল তুলে দিলেই কিন্তু অমিত্রাক্ষর ছন্দ হয় না। অমিত্রাক্ষর ছন্দ এক পঙ্ক্তি থেকে অন্য পঙ্ক্তিতে প্রবহমান। মধুসূদন কবিভাষার প্রয়োজনে সরাসরি রাম, লক্ষ্মণ, সীতা, মেঘনাদ, রাবণ, গরুড় নামগুলোকে ব্যাকরণিক নিয়মে অপত্যজাত শব্দের সাহায্যে তাঁর পিতা, মাতা, দেশ ও বংশের নামের সঙ্গে জড়িয়ে ভিন্ন নামে নতুনত্ব প্রদানের চেষ্টা করেছেন। ফলে বৃদ্ধি পেয়েছে কাব্যসৌন্দর্য। শুধু তাই নয়, মাইকেলের অভিধানবহির্ভূত ‘নব সৃষ্ট’ শব্দ, বহু সমাসের একত্রীকরণ, তৎসম শব্দে ব্যবহার ছাড়া উপসর্গ, মাইকেলি নাম ধাতু ও আর্যপ্রয়োগ কবিভাষাকে অনন্যতা দিয়েছে। এসবের প্রয়োগসহ মাইকেলের মেঘনাদবধ কাব্যে অপত্য প্রত্যয়ের ব্যবহার সম্পর্কে আলোকপাত করাই এ-প্রবন্ধের উদ্দেশ্য।

মধুসূদন (১৮২৪-৭৩) কবি এবং বিদ্রোহী, মানবতাবাদী এবং যুক্তিবাদী, স্বদেশি ও বিদেশি প্রভাবপুষ্ট, কিন্তু মৌলিক। নবজাগরণের দূত, তাই নারীর প্রতিও শ্রদ্ধাশীল। বহুভাষাবিদ, কিন্তু ভাষাতাত্ত্বিক নন। ভাষা নিয়ে খেলা করেছেন, কিন্তু ব্যাকরণের নিয়ম মেনে, আবার নিয়মকে ছাড়িয়েও গেছেন বারবার। খ্রিষ্ট ধর্মে দীক্ষিত, কিন্তু প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসের পরিপন্থী। রামায়ণ ও মহাভারত আত্মসাৎ করে কাব্য ও মহাকাব্যে নতুন ভাবনা এনেছেন, তাই অলৌকিকতা ও ঐশী ভাবনা হয়েছে বর্জিত। কিন্তু বর্জিত নয় কল্পনা। কল্পনা তাঁর ‘মাধুকরী’, তবে আধুনিক কবিতার বিরুদ্ধ প্রক্রিয়া। তাঁর তিলোত্তমাসম্ভব, মেঘনাদবধ কাব্য ও বীরাঙ্গনা শুধু অমিত্রাক্ষর ছন্দের জন্যে নয়, ভাষা ও ভাবরসের জন্যেও শ্রেষ্ঠ এবং পরিবর্তিত। এই পরিবর্তনই তাঁর দ্রোহ। স্পর্দ্ধাভরে ভেঙেছেন প্রচলিত সংস্কার ও আজন্মলালিত বিশ্বাস, আর কবিতায় পয়ারের বিধিবদ্ধ বেড়ি। নবজাগরণের পূর্বশর্তও দ্রোহ। তবে সেটি মধ্যযুগীয় বিবর থেকে মুক্তির – কখনো প্রাচীন ক্লাসিক্যাল সাহিত্য ও শিল্প থেকে নয়। প্রাচীন সাহিত্যের সঙ্গে আছে আধুনিকতার সম্পর্ক। রেনেসাঁস দিব্য চেতনার নয়, যতখানি মানবিক চেতনার, ব্রহ্মজ্ঞানের নয় বস্তুজ্ঞানের, অলৌকিকতার নয় লৌকিকতার, ভক্তিবাদের নয় যুক্তিবাদের, আপ্তবাক্যের নয় প্রমাণসিদ্ধ বাক্যের, অথরিটির নয় লিবার্টির। মাইকেল এ-লিবার্টি নিয়ে প্রাচীন গ্রন্থাবলির পুনর্বিচার, দেবতা, শাস্ত্র, পুরোহিত, রাজা, কুসংস্কার, কুপ্রথা ও অসাম্য থেকে মুক্তির প্রত্যাশায় বুদ্ধি, কল্পনা ও নতুন শৈলী এবং ভাবনার প্রয়োজনে বাল্মীকি, হোমার, ব্যাস, ত্যাসো, ভার্জিল, দান্তের থেকে নিয়েছেন উপাদান এবং সূচনা করেন অভিনবত্বের, সেই অভিনব শৈলী ও কবিভাষা তাঁকে করেছে কালোত্তীর্ণ। তিনি এর মধ্যে এনেছেন নাটকীয়তা এবং অন্তর্গত শক্তি সিঞ্চন করে কাহিনিকে করেছেন পুনর্নির্মাণ। রাবণ তাই হয়ে উঠেছেন স্বদেশপ্রেমিক রাজা, আর রামচন্দ্র পরদেশ আক্রমণকারী তস্কর।

ভাষা শুধু কবিতার নয়, রচনা মাত্রেরই প্রাণ। ভাষা আছে বলেই অনুভূতির কিংবা মননের প্রকাশ আছে। প্রবন্ধের ভাষা ও কবিতার ভাষা দুই প্রান্তের, তবু একই রকম প্রাণসত্তার অধিকারী, অর্থাৎ মনোরঞ্জক। সব কবির মতো মাইকেলের কাব্যের প্রাণ কবিভাষা হলেও এই ‘কবিভাষা শুধু কবিতার বহিরবয়ব নয়, এর অন্তরলোকে আছে কমলহীরের দ্যুতি ও দীপ্তি।’ কেননা, তিনি ছিলেন ‘গ্রিক-জার্মান-হিব্রু-ল্যাটিন-ইংরেজি ও সংস্কৃত সাহিত্যের অধীতবিদ্য পুরুষ।’ শুধু কবিভাষায় নয়, কাব্য ও মহাকাব্যের প্রয়োজনে অপ্রচলিত শব্দের সঙ্গে ওজঃগুণসম্পন্ন ধ্রুপদী শব্দের মিশ্রণ হয়েছে কাঙ্ক্ষিত; প্রচলিত শব্দকে নতুন অর্থে প্রযুক্ত; নতুন শব্দের সৃষ্টি করেছেন এবং বিস্মৃতপ্রায় শব্দকে নতুন করে ব্যবহার করা ছাড়া নামধাতুর ব্যবহার, ব্যাকরণগত অশুদ্ধি ও আর্যপ্রয়োগ ছাড়াও ব্যাকরণের বিধিসম্মত উপায়ে অপত্য প্রত্যয়ের ব্যবহার, কবিভাষাকে গাঢ়তা, ছন্দগত সংহতির প্রশ্নে সংহত বাক্যের কারুকাজে এনে দিয়েছে অভিনবত্ব। এই অভিনবত্ব, আমাদের চোখ এড়িয়ে গেলেও, অপত্য প্রত্যয়ের বেলায় নিঃসন্দেহে একটি অনিবার্য প্রসঙ্গ। তাঁর কবিভাষা নিয়ে নিক্তি ধরে বিশ্লেষণ করেছেন ড. দীপালি রায়,১০ কিন্তু অপত্য প্রত্যয় সম্পর্কে নয়। কিছুই বলেননি সৌরভ সিকদার মধুসূদনের ভাষা ও শৈলী গ্রন্থে।১১ মধুসূদনের কবিভাষায় অপত্য প্রত্যয়ের ব্যবহারের গুণে কবিতা কতখানি সুন্দর, সংহত, পরিমিত হয়ে উঠতে পারে তার দৃষ্টান্ত মাইকেলের মহাকাব্য মেঘনাদবধ কাব্য।

কবিভাষা : মেঘনাদবধ কাব্য

ভারতচন্দ্র রায়গুণকর কবিভাষা সম্পর্কে বলেছিলেন :

না রবে প্রসাদ গুণ না হবে রসাল

অতএব কহি ভাষা যাবনি মিশাল।

ভাষা কাব্যের মৌল। ভাষার দ্বারাই কবি যেমন তাঁর কবিতাকে প্রকাশ করেন, তেমনি পাঠকও ভাষার মাধ্যমে কবির সহৃদয় হৃদয়-সংবেদী অনুভূতির তীব্রতা অনুভব করেন। সেক্ষেত্রে কবিতায় যাবনি মিশালজনিত কারণে জাত গেল কি না তাতে পাঠকের কিছুই আসে-যায় না। তাঁরা শুধু আনন্দপ্রত্যাশী। তবে বেথুন সোসাইটির (প্রতিষ্ঠিত : ১১ই ডিসেম্বর ১৮৫১) অন্যতম সদস্য হরচন্দ্র দত্ত ‘One Bengali Poetry’ শিরোনামে ‘ভারতচন্দ্রীয় কুরুচিকে আক্রমণ করে সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক বিতর্কের সূত্রপাত’ করলে কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮২৭-৮৭) ১৮৫২ সালের ১৩ই মে ‘বাঙ্গালা কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ’-এ মোক্ষম জবাব দিয়েছিলেন।১২ তাঁর প্রবন্ধের প্রশংসা করে কালীচন্দ্র রায়চৌধুরী লেখেন :

আধুনিক যুবাগণে                 স্বদেশীয় কবিগণে

              ঘৃণা করে নাহি সহে প্রাণে।

বাঙ্গালীর মন-পদ্ম                 কবিতা সুধার সদ্ম                                           এই মাত্র রাখ হে প্রমাণে।১৩

যুগ-প্রতিনিধি ভারতচন্দ্র বাংলাসাহিত্যের নদীতে জোয়ার এনেছিলেন বলেই তো ড. সুশীল দে তাঁকে ‘true poet’

আর প্রমথ চৌধুরী ‘জাতকবি’ বলে উল্লেখ করেন।১৪ ভারতচন্দ্রের কাব্য আরবি, ফারসি, সংস্কৃত, ব্রজবুলি, হিন্দি ও যাবনিক শব্দের ব্যবহারগুণে অলংকৃত করে তুলেছিল বলেই ‘রুচির দরবার পেরিয়ে’ আধুনিক মানস-তৃপ্তিকর হয়ে উঠেছিল এবং কাব্যের প্রসাদগুণ মধুসূদনকে করেছিল আকৃষ্ট।

১৮০০ থেকে ১৮১৩ সাল সময়কে বাংলা সাহিত্যের ‘ব্রাহ্মমুহূর্ত’ বলার কারণ ‘ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ শুধু কয়েকজন পণ্ডিত ও মুন্সি এবং কয়েকখানা গ্রন্থ রচনা করিয়া কাজ শেষ করেনি’,১৫ বাংলা গদ্যেরও বিবর্তন এনেছিল। তখন থেকেই বাংলা গদ্যসাহিত্যের মধ্যে পাওয়া গেল সংস্কৃত, তদ্ভব, দেশি, বিদেশি শব্দ। এই রীতিকে প্রমথনাথ বিশী একইভাবে বাংলা গদ্যে ‘শব্দ সম্ভারের বৈচিত্র্য ও বৈষম্য’ এবং ‘ঐশ্বর্য ও প্রধান সংকট’ বলে চিহ্নিত করেন।১৬ ঐশ্বর্য ও সংকট যা-ই হোক না কেন, উনিশ শতকের গদ্যসাহিত্যে সংস্কৃত শব্দানুরাগ ছিল একটি বড় বিষয়। মধুসূদনের মহাকাব্যিক শব্দানুসন্ধানে এ-প্রভাব যে ক্রিয়াশীল ছিল না তা হলফ করে বলা যাবে না।

 তৎকালীন সময়ে বাংলা গদ্যসাহিত্যের একটি বড় বাধা ছিল মধ্যযুগীয় পয়ার। যা গদ্যে রচিত হতে পারত, তা রচিত হলো পয়ারের মাধ্যমে। আজকের দিনে ‘প্রবন্ধ’ বলতে আমরা যা বুঝি সেদিন পাঁচালি প্রবন্ধে তাই-ই রচিত হতো।১৭ এ-ছন্দের মধ্য দিয়ে ‘লেখকের বক্তব্য ও মনোভাবের সহিত ইহার এমন একটা চেষ্টাহীন সামঞ্জস্য গড়িয়া উঠিয়াছিল যে সমস্ত কাব্য প্রচেষ্টা অতীতের এই কারুকার্যহীন সাধারণ ছাঁচে, যেন একটা অনিবার্য মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে অনুপ্রবিষ্ট হইতে চাহিত।’১৮ মধুসূদন পয়ারের কবিত্বহীন (a pedestrian measure) এ মাধ্যাকর্ষণীয় প্রভাবমুক্ত হয়ে মিলটনের Blank Verse অবলম্বনে সৃষ্টি করলেন অমিত্রাক্ষর  ছন্দ। মনে রাখতে হবে, পয়ারের অন্ত্যমিল তুলে দিলেই কিন্তু অমিত্রাক্ষর ছন্দ হয় না। এর ভাবধারা ও প্রবহমানতা এক পঙ্ক্তি থেকে অন্য পঙ্ক্তিতে প্রবাহিত। উদাহরণস্বরূপ মেঘনাদবধ কাব্যের সূচনাংশ থেকে উদ্ধৃত করা যেতে পারে।

সম্মুখ সমরে পড়ি, বীর-চূড়ামণি

বীরবাহু, চলি যবে গেলা যমপুরে

অকালে, কহ হে দেবী, অমৃতভাষিণী,

কোন্ বীরবরে বরি সেনাপতি-পদে

পাঠাইলা রণে পুনঃ রক্ষঃকুলনিধি

রাঘবারি?

‘সম্মুখ সমরে পড়ি, বীর-চূড়ামণি/ বীরবাহু’তে অর্ধযতি ও ‘চলি যবে গেলা যমপুরে আকালে’তে পূর্ণ যতি বসিয়েছেন। মাইকেলের এই ছন্দ বাংলা কাব্যের গতিপ্রকৃতিকে শুধু অধিকার করেনি, বাংলা কবিতার ছন্দের দেশ অধিকার করে আছে একজাতীয় অজেয় প্রভাবে। ছন্দ, তা সে যে রকমেরই হোক না কেন, কবিতার ক্ষেত্রে Noblest measure in the language। যে-অমিত্রাক্ষর ছন্দে মধুসূদন সংস্কৃত যুক্তাক্ষর শব্দের প্রায়োগিক কুশলতা দেখিছেন সে-সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১) বলেন১৯ :

একে বাংলা ছন্দে স্বরের দীর্ঘ হ্রস্বতা নাই, তার উপরে যদি যুক্ত অক্ষর বাদ পড়ে তবে ছন্দ নিতান্তই অস্থিবিহীন সুললিত শব্দপিণ্ড হইয়া পড়ে। … সংস্কৃত ছন্দে যে বিচিত্র সংগীত তরঙ্গিত হইতে থাকে তাহার প্রধান কারণ স্বরের দীর্ঘহ্রস্বতা এবং যুক্ত অক্ষরের বাহুল্য। মাইকেল মধুসূদন ছন্দের এই নিগূঢ় তত্ত্বটি অবগত ছিলেন, সেইজন্য তাহার অমিত্রাক্ষরে এমন পরিপূর্ণ ধ্বনি এবং তরঙ্গিত গতি অনুভব করা যায়।২০

কবিতা বিচারে শব্দার্থ জ্ঞান অপরিহার্য। বিষয়টি কবি ও পাঠক উভয়ের বেলায়ই প্রযোজ্য। মাইকেল ছিলেন এর ঊর্ধ্বে। তাঁর শব্দভাণ্ডার ছিল লোকাতীত। তাঁর কাব্যে ব্যবহৃত শব্দ মাত্রই যে আভিধানিক তা নয়; অভিধান বহির্ভূত – মধুসূদনসৃষ্ট ‘নব শব্দ’র সংখ্যাও কম নয়। এসব শব্দ সমন্বয়ে যে-কবিভাষা সৃষ্টি হয়েছে তা লোকোত্তর। এবং সেটি সম্ভব হয়েছে প্রযুক্ত style-এর জন্যে। এই style-টা যেমন ভাষার, তেমনি বুদ্ধিমত্তারও। এটা মাইকেলের ‘শৈল্পিক আত্মপ্রকাশ’২১ হলেও তাঁর কবিভাষা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ২২, বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-৭৪) ও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-৬০)। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘ভাষাকে কৃত্রিম ও দুরূহ করিবার জন্য যত প্রকার পরিশ্রম করা মানুষের সাধ্যায়ত্ত তাহা তিনি করিয়াছেন।’২৩ এছাড়া, ১২৮৪ সনে ১৬ বছর বয়সে ভারতীতে ছয় দফায় প্রকাশিত হয় মেঘনাদবধ কাব্যের সমালোচনা। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কোনো বাঙালি এ-কাব্য সম্পর্কে এত তীর্যক মন্তব্য করেননি।২৪ এ-সম্পর্কে বিদেশি কবি ও গবেষক উইলিয়াম রাদিচে কিছু ভিন্ন কথা শুনিয়েছেন। তিনি মাইকেলের শব্দের কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাষা নিয়েও কথা বলেছেন। তাঁর জবানিতে :

Madhusudan’s language may be remote from normal Bengali – a highly artificial poetic diction with a much parodied fondness for turning nouns into verbs (rather than simply combining a noun with the verb kara, to do or make) – but it is often formulaic and the vocabulary is quite limited. Tagor’s vocabulary is endless – I never stop having to look up words; and his sentence structures are much more complex than Madhusudan’s.২৫

মাইকেল মহাভারতের আদিপর্বের ‘সুন্দ-উপসুন্দের’ কাহিনি নিয়ে চার সর্গে তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য (১৮৬০) রচনা করেন। অমিত্রাক্ষর ছন্দের পরীক্ষামূলক আয়োজন ছিল সেটি। মাইকেল তাঁর কবিভাষা নিয়ে বন্ধু রাজনারায়ণকে লেখেন (২৪শে এপ্রিল ১৯৬০, ৬নং লেয়ার চিৎপুর রোড) :

আমার ভয় হচ্ছে, তুমি মনে কর আমার রচনাশৈলী দুরূহ; কিন্তু বিশ্বাস কর, আজকার দিনে সাহিত্যিক উত্তেজনার মধ্যে যে সকল অধিকাংশ সাহিত্যিক – যাদের বুদ্ধিমান বদমাশ বলা যায় – লিখে থাকে তাদের মতো বাগাড়ম্বরপূর্ণ হবার জন্য আমি অধ্যয়ন করিনে। প্রেরণাবশতঃ শব্দগুলো ঝর্ণার মধ্যে ভেসে অনায়াসে এসে যায়, (আমার মনে হয়, এভাবেই আমার বলা উচিত)। ভাল অমিত্রাক্ষর ছন্দ সুনাদ হওয়া উচিত এবং ইংরেজি সাহিত্যে সব চাইতে ভাল অমিত্রাক্ষর ছন্দ রচয়িতা সকল কবির মধ্যে বলিষ্ঠ – আমি বৃদ্ধ জন মিল্টনের কথা বলছি। এবং ভার্জিল ও হোমার আর যাই হোক সহজ নয়। … খেলাচ্ছলে আমি কাব্যটি লিখতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু দেখছি যে, আমি সত্যি আমাদের জাতীয় কাব্যের উন্নতি বিধানের জন্য কিছু করতে পেরেছি।২৬

এই কিছু করতে পারাটার প্রতি বিশ্বাস মাইকেলকে বাংলা সাহিত্যে অনেক দূর নিয়ে এসেছে। এ-কাব্যে যে কবিভাষার সূচনা হয়েছিল তার পূর্ণ প্রকাশ হয়েছে মেঘনাদবধ কাব্যে, আর পরিপূর্ণতা পেয়েছে বীরাঙ্গনায়। চর্যাপদ থেকে বাংলা কবিতার ভাষা ও ছন্দ ছিল বৈচিত্র্যহীন। ভারতচন্দ্রের পর ঈশ্বর গুপ্ত (১৮১২-৫৯) ও রঙ্গলাল কবিতায় অভিনবত্ব আনতে পারেননি। কিন্তু মধুসূদন ‘ভাষারীতি, বর্ণনাভঙ্গি ও অলংকার প্রয়োগে … প্রচলিত বিধিনিষেধ চূর্ণ করে নিজের পথ নিজেই কেটে নিয়েছেন।’২৭ সে-পথ করে নিতে শিল্পী মধুসূদনের অন্তরাত্মার প্রতিফলন অমিত্রাক্ষর ছন্দ এবং কবিতার ভাবানুসারে বিরাম চিহ্নের ব্যবহার ও বহুমাত্রিক শব্দ প্রয়োগসহ অপত্য প্রত্যয়ের শব্দগত ও প্রায়োগিক দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা হলো।

মাইকেলের অভিধানবহির্ভূত ‘নব সৃষ্ট’ শব্দ

একটা কথা সর্বজনবিদিত যে, ব্যাকরণে দখল থাকলে, ব্যাকরণের নিয়ম ভেঙে নতুন নিয়ম তৈরি করা যায়, বা নিয়মকে অতিক্রম করেও নতুন শব্দ সৃষ্টি করা যায়। মাইকেলের শব্দনির্মাণের ক্ষেত্রেও এ-কথা প্রযুক্ত হতে পারে। প্রদত্ত শব্দের ক্ষেত্রে ব্যাকরণের নিয়ম মানা না হলেও, শব্দার্থ বুঝে নিতে আমাদের কোনো প্রকার অসুবিধার মুখোমুখি হতে হয়নি। সেই নিরিখে অভিধানবহির্ভূত শব্দের দু-একটা উদাহরণ দেখা যেতে পারে। যেমন, আকাশ-সম্ভবা, আলোক-মণ্ডল, আশ্রম-আশা, কনক-উৎপল, কনক-পুষ্পক, কনক-মৃণাল, কুসুম-আসন, ঘনপ্রিয়া; কয়েকটি শব্দের প্রয়োগ, যেমন, ঘনপতি – ‘গম্ভীর নির্ঘোষে যথা ঘোরে ঘনপতি’, চন্দ্রক-কলাপ – ‘প্রকাশিত শিখী চারু চন্দ্রক-কলাপ’, চিত্ত-বিনোদিনী – ‘যথা শুনি চিত্ত-বিনোদিনী বীণাধ্বনি’, তরঙ্গ-নিকর – ‘তরঙ্গ-নিকরে রঙ্গে করি অবহেলা’ ইত্যাদি।

সমাসনিষ্পন্ন পদের ব্যবহার

ভাষা সংক্ষেপণের রীতিই সমাস। ভাষাকে সংক্ষেপ, দৃঢ়, সংহত, গাম্ভীর্য রূপ প্রদান এবং ছন্দের জন্যে মাইকেলের কাছে সমাসবদ্ধ পদ অপরিহার্য হয়ে ওঠে। সেই প্রয়োজন থেকে তিনি দীর্ঘ সমাসবদ্ধ পদ ব্যবহার করেন। কখনো একই সমাসবদ্ধ পদের মধ্যে দু-রকম সমাসের দেখা মেলে। যেমন, তুঙ্গ-গিরি-শৃঙ্গোপরি = তুঙ্গ যে গিরি (কর্মধারয় সমাস), তুঙ্গ-গিরিশৃঙ্গের উপরি (ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস)।

তিমির-সাগর-তীরে = তিমির যে সাগর (কর্মধারয়) তার তীরে (ষষ্ঠী তৎপুরুষ)। দেবকুল-আশালতা = দেবের কুল (ষষ্ঠী তৎপুরুষ), তার আশালতা (ষষ্ঠী তৎপুরুষ), আবার, আশারূপ লতা (রূপক কর্মধারয়), কর-রত্ন-দান = কর রত্ন সদৃশ (উপমিত কর্মধারয়) তাকে দান (চতুর্থী তৎপুরুষ) ইত্যাদি।

তৎসম শব্দের ব্যবহার

মাইকেল সংস্কৃত বা তৎসম শব্দ তাঁর কাব্যগুলোতে এত বেশি ব্যবহার করেন যে, তার উদাহরণ দিতে গেলে রীতিমতো শব্দ বিশারদ হওয়া দরকার। অর্ধতৎসম, তদ্ভব শব্দের তুলনায় দেশি শব্দের ব্যবহারও কম নয়। আমরা যাকে লোকজ শব্দ বলি তারও ব্যবহার হয়েছে মাইকেলের কবিতায়। এবং তা স্রেফ ছন্দ ও ধ্বনিগাম্ভীর্য সৃষ্টির লক্ষ্যে। তাঁর প্রযুক্ত কয়েকটি তৎসম শব্দের ব্যবহার, যেমন, অকিঞ্চন – ‘কৃপা প্রভু কর অকিঞ্চনে’ (মেঘনাদবধ); অচল – ‘অটল, অচল যথা দাঁড়াইলা বলী’ (মেঘনাদবধ); অর্ণব – ‘রক্ষোবর মহিমা অর্ণব জগতে’ (মেঘনাদবধ); আকৃতি – ‘দূতীর আকৃতি দেখি ডরিনু হৃদয়ে’ (মেঘনাদবধ); আভরণ – ‘সাজাই ও বরবপুঃ আনি নানা আভরণ’ (মেঘনাদবধ) ও কল্লোলিনী – ‘ভোগবতী, স্রোতস্বতী পাতালে যেমতি কল্লোলিনী’ (মেঘনাদবধ)। এছাড়া, মাইকেল তৎসম শব্দের সঙ্গে অর্ধ-তৎসম শব্দ (‘মরতে স্বরগ-ভোগ ভোগিতে সোহাগে’, ‘স্বর্ণ-ফুল শ্রেণী শোভে তাহে’), তৎসম ও তদ্ভবের মিশ্র শব্দ (‘ঘোরে রণে রাঘব-বিক্রমে/ লাঘব-গরব সই) ব্যবহার করেন।

উপসর্গ, মাইকেলি নামধাতু ও আর্ষপ্রয়োগ

উপসর্গের, বিশেষ করে ‘সু’ উপসর্গ দিয়ে তিনি ব্যবহার করেন সুকমল-করে, সুকেতু, সুচন্দ্রাননে, সুবাসিত, সুভগে, সুমধুর, সুলোচনা প্রভৃতি শব্দ। এছাড়া, নামধাতুর ব্যবহারে তাঁর একাধিপত্য স্বীকৃত। বলা যায় এটি তাঁর ‘দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা’।২৮ যেমন, অতিক্রমি, আরম্ভিল, উত্তরিলা, চমকিল, প্রবেশিলা, আক্রমিলা, আমোদি, ইচ্ছি (হে পিতৃব্য, তব বাক্যে ইচ্ছি মরিবারে), নাচিলা, ভুলিলা প্রভৃতি। এ রকম নামধাতুর আনকোরা প্রয়োগের জন্যে ব্যাকরণবিদগণ নাম দিয়েছেন ‘মাইকেলী নামধাতু জাত ক্রিয়া’।২৯ এই শব্দের যথার্থ ব্যবহার ছাড়াও আছে ভ্রান্তিপূর্ণ ব্যবহার। ব্যাকরণের পরিভাষায় যাকে বলা হয় আর্ষপ্রয়োগ। ‘আর্ষ’ শব্দের অর্থ ব্যাকরণবিরুদ্ধ।৩০ রাজশেখর বসু অর্থ করেন, ‘ঋষিপ্রোক্ত কিন্তু ব্যাকরণবিরুদ্ধ।’৩১ মধুসূদন অনেক বেশি সে-কাজ করেছেন। বাংলা ভাষার প্রাথমিক পর্যায়ে ঈশ্বর গুপ্ত, রঙ্গলাল ও হেমচন্দ্র (১৮৩৮-১৯০৩) এ-জাতীয় আর্ষপ্রয়োগ করলেও, অনেক দিক থেকে শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে মধুসূদনই সবার ওপরে। কালিক বিচারে তো বটেই, এমনকি ধ্বনি, পদগঠন, বাক্যসৃজন, অর্থ সন্নিবেশ তাঁর কবিভাষার উৎসমূল। ভাষা ঈশ্বরসৃষ্ট নয়, মানুষই নিজের প্রয়োজনে ভাষা সৃষ্টি করেছে, – কিন্তু ব্যাকরণের নিয়ম মেনে নয়। ব্যাকরণ সৃষ্টির অনেক আগেই ভাষার সৃষ্টি। ভাব প্রকাশের জন্যেই হোক, বা কিছুর লেখার জন্যেই হোক, ভাষা সৃষ্টি করতেই হতো। মধুসূদন ভাব প্রকাশের জন্যে যথেষ্ট ঋদ্ধ শব্দভাণ্ডার পাননি বলেই তাঁর শব্দতৃষ্ণা বা অতৃপ্ততা ছিল প্রবল; তাই ব্যাকরণের নিয়ম ভেঙে শব্দ তৈরি করেছিলেন। একজন কবি, মহাকবি, নাট্যকার, সনেট রচয়িতা, গীতিকবিতা রচনার ক্ষেত্রে শব্দ নির্মাণের যে-দক্ষতা দেখিয়েছেন তাও একটি অসাধারণ বিষয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও লেখার প্রয়োজনে এ-কাজটি অনেক বেশি করতে হয়েছিল। 

ভাষা কবিতার মৌল। সেই ভাষা মাইকেল শুধু নিপুণভাবে অমিত্রাক্ষর ছন্দে ব্যবহার করেননি; উপমা, উৎপ্রেক্ষা, অনুপ্রাস, চিত্রকল্প ছাড়াও কথ্য, সাধু, প্রাকৃত ও সংস্কৃত শব্দের মিশ্রিত রূপের সঙ্গে দেশজ শব্দের মিশ্রণে নতুন রূপ দিয়েছেন। কেননা, ‘ইংরাজি সাহিত্যের মুক্তবায়ুতে তাহার ফুসফুস এবং হৃদপিণ্ড ভবিষ্যৎ পালোয়ানের উপযোগী ক্রিয়াশক্তি এবং প্রসার লাভ করিয়াছিল’৩২ বলেই পশ্চিমের জ্ঞানের ভুবন থেকে তিনি ফিরে এলেন দেশজ শিকড়ের কাছে। সেখান থেকে দেশজ ভাষা ও বুলি নিয়ে বিশেষ কাব্যরীতিতে ভরিয়ে দিলেন সাংগীতিক ঐশ^র্যে। একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।

আইলা তারাকুন্তলা, শশীসহ হাসি

শর্বরী, সুগন্ধবহ বহিল চৌদিকে –

যশোরের আঞ্চলিক শব্দ ‘আইলা’র সঙ্গে গেঁথে দিয়েছেন সাহিত্যের শব্দ ‘তারাকুন্তলা’। ফলে আইলার তরঙ্গায়িত ধ্বনি মিলেছে তারাকুন্তলার চিত্রময়তায়। যেন জীবন্ত মানুষের বাকরীতি, যে-রীতিতে মানুষের জীবন যাপন, মাইকেল এই জীবন্ত বাকরীতিকে সুকৌশলে বারবার ব্যবহার করেছেন তাঁর কাব্যে।৩৩ এ-প্রসঙ্গে টি.এস. এলিয়ট ‘The Social Function of Poetry’  প্রবন্ধে বলেন : ‘We may say the duty of the poet, as poet, is only indirectly to his people; his direct duty is to his language, first to preserve, and second to extend and improve.’৩৪ মাইকেলও তাই করেছেন।

মাইকেলের কবিভাষায় অপত্য প্রত্যয়

‘অপত্য’ [অ + √পত্ + য] শব্দের অর্থ সন্তান, পুত্র বা কন্যা।৩৫ ভট্টজিদীক্ষিতের সিদ্ধান্ত কৌমুদীর আলোকে ‘ন পতন্তি নরকে পিতরো যেন তদপত্যম।’ বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায়, যার জন্মের কারণে পিতৃপুরুষেরা নরকে যান না, তাকে বলা হয়েছে অপত্য। শাস্ত্রে আছে, পুত্র ‘পুত’ নামক নরক থেকে পিতাকে উদ্ধার করে। সে-সুবাদে অপত্য প্রত্যয়ের গুরুত্ব অনেকখানি। অপত্য দুরকম – পুত্র ও গোত্রাপত্য অর্থাৎ গোত্রের পৌত্র প্রভৃতি বংশধরকে বোঝায়। গোত্রাপত্যকে ‘বৃদ্ধ’ ও ‘যুবা’ দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই ভাগের মধ্যে শ্রাদ্ধে পিণ্ডদানের বিষয়টি যুক্ত। অর্থাৎ গোত্রের যারা পিণ্ড দান করতে পারবে তারা এ-প্রত্যয়ের মধ্যে গণ্য হবে। হিন্দুশাস্ত্রীয় বিধান সম্পৃক্ত অপত্য প্রত্যয় যুগপৎ ব্যাকরণের ও সামাজিক ক্রিয়াকর্মের মধ্যে শ্রাদ্ধাদির অধিকার সংশ্লিষ্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে গণ্য হয়। বহুধা বিভক্ত এই প্রত্যয়ের মধ্যে মাইকেল ‘অপত্যাধিকার’ ও ‘চাতুরর্থিক’ প্রকরণকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। চাতুরর্থিকপ্রকরণ দেশের নাম বোঝাতে, বিশেষত কোনো দেশ থেকে আগমন, দেশের নাগরিক প্রভৃতি অর্থে এই প্রত্যয় নিষ্পন্ন হয়। বাংলা ব্যাকরণ সংস্কৃতানুসারী বলে কোনো কোনো ব্যাকরণে বিষয়টি অল্প-বিস্তর জায়গা পেয়েছে। তবে বিশেষ প্রতিপাদ্য হিসেবে গৃহীত হয়েছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর-প্রণীত ও বাসন্তীকুমার ভট্টাচার্য-সম্পাদিত সমগ্রব্যাকরণ-কৌমুদী গ্রন্থে এবং ড. দিলীপকুমার ভট্টাচার্যের ভট্টজিদীক্ষিতের সিদ্ধান্ত কৌমুদী গ্রন্থে।৩৬ সমগ্রব্যাকরণ-কৌমুদী গ্রন্থে কোন কোন নিয়মে অপত্য প্রত্যয় হয় তার বিধান আছে ৪৯৩ থেকে ৫৩০ – মোট ৩৮টি; এছাড়া, অন্য যে-নিয়মে তদ্ধিত প্রত্যয়ের অপত্য প্রত্যয় হয় তার সংখ্যা ৫৩১-৫৮৭ – মোট ৫৭টি।৩৭ ভট্টজিদীক্ষিত পাণিনির অষ্টাধ্যয়ী ব্যাকরণের প্রায় চার হাজার সূত্রকে সংজ্ঞা, পরিভাষা, সন্ধি, কারক, সমাস ও প্রত্যয় এবং তদ্ধিত (তদ্ ও হিত) প্রত্যয়ের এক হাজার সূত্রকে ১৬টি অধ্যায়ে ভাগ করেন।৩৮

প্রাচীনকালে নয় শুধু, বর্তমান কালে বাবা-মায়ের সঙ্গে মিলিয়ে ছেলে বা মেয়ের নাম রাখা হয়। সে-নামে থাকে বর্ণগত মিল। তা দ্বারা কখনো বোঝা যায় না অমুক অমুকের সন্তান। প্রাচীনকালে পুত্রের নামের মধ্যে বাবার বা মায়ের পরিচয় পাওয়া যেত, কিন্তু কোনো পদবি যুক্ত হতো না। যেমন, উদ্দালক আরুণি, ঔপমন্যব; আরুণি অর্থ অরুণের পুত্র, ঔপমন্যব উপমন্যুর পুত্র। এ-নিয়ম দক্ষিণ ভারতে আজো প্রচলিত।৩৯ এছাড়া, নামের তিনটি অংশের মধ্যে প্রথমটি পারিবারিক বা পদবি কিংবা অঞ্চলের নাম, দ্বিতীয় অংশে থাকে পিতার নাম এবং তৃতীয় অংশই হলো ব্যক্তির আসল নাম। যেমন, সর্বপল্লী রামস্বামী ভেঙ্কটরমন। তামিলনাড়ুর লোকেরা চারটি শব্দে নাম রাখে। প্রথমটি আদি বাসস্থান, দ্বিতীয়টি পিতার নাম, তৃতীয়টি নিজের নাম, আর চতুর্থটি পদবি। যেমন, কুম্ভকোলম্ রঙ্গস্বামী পদ্মনাভ আয়েঙ্গার।৪০ এ-প্রসঙ্গে ধরা যেতে পারে গঙ্গাধর তিলকের (১৮৫৬-১৯২০) নাম। তাঁর পুরো নাম বলবন্ত রাও গঙ্গাধর তিলক। এর মধ্যে ‘বলবন্ত রাও’ তাঁর আসল নাম। ‘গঙ্গাধর’ তাঁর বাবার নাম। আর, ‘তিলক’ আদিবংশ প্রবর্তিতার নাম।৪১ সেমীয় রীতিতে প্রযুক্ত এ-নিয়ম শুধু আরবে নয়, বাংলাদেশেও বহাল আছে। সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুযায়ী অষ্টাধ্যয়ী ব্যাকরণ প্রণেতা পাণিনির কথাই ধরা যাক। তাঁর নামটিও অপত্য প্রত্যয়জাত। তাঁর জন্মসাল নিয়ে (কেউ বলেন খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ, কেউ পঞ্চম শতাব্দী) যেমন, তেমনি জন্মস্থান নিয়েও মতান্তর আছে। ইউরোপীয় মনীষীদের মতে, তাঁর জন্ম হয়েছিল বর্তমান পাকিস্তানের রাওয়ালপিণ্ডি অঞ্চলের ‘শালাতুরীয়’ গ্রামে। সে সুবাদে শালাতুরীয় (এটিও অপত্য প্রত্যয়ের দৃষ্টান্ত) নামে তাঁকে অভিহিত করা হয়। পাণিনির পিতা ছিলেন ‘পণী’ নামে এক মুনি। পাণিন নামে তাঁর এই পুত্র হয়। তাঁর বিয়ে হয় দক্ষকন্যা দাক্ষীর (এটিও অপত্য প্রত্যয়জাত) সঙ্গে। দাক্ষীর গর্ভে পাণিনি (পাণিনস্য অপত্যং পুমান = পাণিন + ইঞ = পাণিনি)-র জন্ম হয়। দণ্ডী স্বামীর এ-কথার প্রমাণ না মিললেও দাক্ষী সম্পর্কে সকল মনীষীই একমত। দাক্ষীর পুত্র বলে তাঁকে ‘দাক্ষেয়’ (দাক্ষী + ঢক্ = দাক্ষেয়) বলা হয়।৪২ সংস্কৃত ব্যাকরণে ত্রিমুনির মধ্যে কাত্যায়ন কাত্য-এর সন্তান হিসেবে অপত্য প্রত্যয় জাত শব্দ। পতঞ্জলিও অপত্য প্রত্যয় বাচক শব্দ (পতৎ + অঞ্জলি = পতঞ্জলি)। তাঁর পিতৃপরিচয় অজ্ঞাত। মা গণিকাৎ সূর্যদেবকে অঞ্জলি দিয়ে তাঁকে লাভ করেছিলেন বলে পুত্রের এরকম নাম হয়েছে।৪৩ রামায়ণ, মহাভারত ও অন্যান্য পুরাণে পিতা-মাতার নাম থেকে জাত অপত্য প্রত্যয়ের অনেক দৃষ্টান্ত আছে।৪৪

প্রাচীন ভারতে পুত্রেষ্টি যজ্ঞের মাধ্যমে পুত্রলাভের প্রমাণ আছে। কাত্যায়ন শ্রৌতসূত্রানুসারে যজ্ঞ হলো ‘দ্রব্যং দেবতা ত্যাগঃ’। প্রকৃতপক্ষে দেবলোকের সঙ্গে মনুষ্যলোকের যোগস্থাপনই যজ্ঞ। পাঁচ প্রকার যজ্ঞের৪৫ মধ্যে ‘ইষ্টিযাগ’-এর একটি হলো পুত্রেষ্টি যজ্ঞ। এই পুত্রেষ্টি যজ্ঞের মাধ্যমে রাম (মাতা কৌশল্যা), ভরত (কৈকেয়ী),৪৬ লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্ন (সুমিত্রা)-র জন্ম হয়। পিতৃপরিচয়ের দিক থেকে এঁদের প্রত্যেককে ‘দাশরথি’ বলা হলেও, মাইকেল মেঘনাদবধ কাব্যে দাশরথি বলতে রামচন্দ্রকে বুঝিয়েছেন; আর ভরতকে ‘কৈকেয়’ ও লক্ষ্মণকে ‘সৌমিত্রি’ বা ‘সৌমিত্রী’ বলে উল্লেখ করেন। ভরতের মা কৈকেয়ী ছিলেন কেকয় রাজ্যের মেয়ে।৪৭ সে-হিসেবে কৈকেয়ী একটি অপত্য প্রত্যয়জাত শব্দ।

মাইকেল তাঁর কাব্যে রাম, সীতা, লক্ষ্মণ, রাবণ, মেঘনাদ, ইন্দ্রজিৎ, গরুড় প্রমুখের নামকে অপত্য প্রত্যয় জাত শব্দের মধ্যে এনে যেমন পিতা-মাতার নামের সঙ্গে জড়িয়ে এঁদের অন্য নাম দিয়েছেন, তেমনি স্ত্রীর সঙ্গে জড়িয়েও ভিন্ন নামে নতুনত্ব প্রদানের চেষ্টা করেছেন। কখনো কোনো দেশের মেয়ে, বা দেশাগত বুঝিয়েছেন, কখনো গোত্রকে। ফলে একদিকে যেমন কাব্য সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়েছে, অন্যদিকে ছন্দের ক্ষেত্রে এসেছে শ্রুতিমধুরতায় শান্তি ও সংহতি। তিনি অপত্য জাত শব্দ ব্যবহার করেন ২৭৭টিরও বেশি। অনেক শব্দের একই রূপ ব্যবহৃত হয়েছে বারবার, অনেক বাক্যেরও, আবার অনেক ক্ষেত্রে এসেছে বৈচিত্র্য। যেমন, আদিতেয় = অদিতি + এয়, অদিতির ছেলে ইন্দ্র (৩ বার); কৈকেয়ী = কেকয় + ই, কেকয় রাজার বা রাজ্যের কন্যা (২ বার); কোশল রাজকন্যা কৌশল্যা, জানকী = জনক + অ (অণ্) = জানক + ঈ (ঙীপ্), সীতা (৩ বার), জানকি (৩ বার); দাশরথি = দশরথ + ই, রামচন্দ্র (১৪ বার); পৌরব = পুরু + অ, পুরু বংশের, বিশেষ করে অর্জুনদের বোঝানো হয়েছে (১ বার); পৌলমী = পুলোমা + ই, পুলোমার কন্যা; বৈদেহী = বিদেহ + অ = বিদেহ + ঈ, বিদেহ রাজার কন্যা সীতা (৮ বার); রামচন্দ্রকে বোঝাতে ‘বৈদেহী’ শব্দের সঙ্গে নাথ (১০ বার), পতি (৩ বার), বিলাস (১ বার), রঞ্জন (২ বার), আর রাবণকে বোঝাতে হর (১ বার) ব্যবহৃত হয়েছে। মৈথিলি (৫ বার)/ মৈথিলী (৭ বার) = মিথিলা + অ + ই/ঈ, সীতা; রামচন্দ্রকে বোঝাতে ‘মৈথিলী’ শব্দের পরে নাথ (৮ বার), পতি (২ বার) ব্যবহৃত হয়েছে। মৈনাক = মেনকা + অ (অণ্) বলতে হিমালয় ও মেনকার পুত্র একটি পর্বতকে বোঝানো হয়েছে। রঘু হলেন সূর্যবংশীয় রাজা দিলীপের পুত্র। রঘুর পুত্র অজ, অজের পুত্র দশরথ ও দশরথের পুত্র রামচন্দ্র। রঘু থেকে এ-বংশের নাম হয়েছে রঘুবংশ। তাই রামকে রাঘব = রঘু + অ (৬৪ বার)। আর, রামচন্দ্রকে বোঝাতে ‘রঘু’ প্রাতিপাদিকের পরে কুলচূড় (১ বার), কুলচূড়ামণি (১ বার), কুলোদ্ভব?

(১ বার), কুলপতি (১ বার), কুলমণি (৩ বার), কুল-রাজা (১ বার), নাথ (৫ বার), পতি (৮ বার), বর (৫ বার), মণি (৫ বার), রাজ (২ বার), রথী (২ বার), শ্রেষ্ঠ (১ বার); এছাড়া, রামচন্দ্রকে বহুমাত্রিকভাবে উপস্থাপনের উদ্দেশ্যে রাঘবচন্দ্র (১ বার), রাঘবেন্দ্র (৯ বার), রাঘবেশ^র (১ বার), রাঘব-বিলাসী (১ বার), রাঘবেন্দ্র (৯ বার) রাঘব ভিখারী (১ বার), রাঘবীয় (১ বার) ব্যবহার করা হয়েছে। রাঘব শব্দের সঙ্গে অরি সন্ধি করে হয়েছে রাঘবারি (৩ বার) অর্থাৎ রাবণ। সীতাকে বোঝাতে রাঘব-রমণী (১ বার), রাঘব-বাঞ্ছা (১ বার), রাঘব-বাসনা (১ বার) ‘রঘু’ প্রাতিপাদিকের সঙ্গে সীতাকে বোঝাতে নন্দনেরধন (১ বার), বধূ (৪ বার) ব্যবহৃত হয়েছে। লক্ষ্মণকে বোঝাতে রাঘবানুজ (১ বার)। আবার সুমিত্রা প্রাতিপাদিকের পরে  অ প্রত্যয়  বসিয়ে (সুমিত্রা + অ + ই) = সৌমিত্রি (৩৬ বার) অর্থাৎ সুমিত্রার ছেলে। এভাবে সৌমিত্রি-র পরে কেশরী (১৮ বার) ও শূর (৫ বার) বসিয়ে লক্ষ্মণকে বোঝানো হয়েছে। এ তো গেল অপত্য প্রত্যয় ও তার সঙ্গে বিভিন্ন প্রকার পদ বসিয়ে অপত্য প্রত্যয়জাত পদের দৃষ্টান্ত। এবার এ-শব্দগুলো কবিভাষায় কেমনভাবে প্রযুক্ত হয়েছে তা দেখা যেতে পারে।

আদিতেয়

উত্তরিলা মায়াময়ী, “যাই, আদিতেয়,

লঙ্কাপুরে; মনোরথ তোমার পূরিব;

রক্ষঃকুল-চূড়ামণি চূর্ণিব কৌশলে

আজি।”                                      [৫ সর্গ/৬১ পঙ্ক্তি]

কৈকেয়ী

হায়, সখে, মন্থরার কুপন্থায় যবে

চলিলা কৈকেয়ী মাতা, মম ভাগ্যদোষে

নির্দ্দয়; ত্যজিনু যবে রাজভোগ আমি

পিতৃসত্যরক্ষা হেতু, স্বেচ্ছায় ত্যজিল

রাজ্যভোগ প্রিয়তম ভ্রাতৃ-প্রেম-বশে!               [৬ সর্গ /১২৮ পঙ্ক্তি]

গাঙ্গেয়

বিবিধ ভূষণ, বস্ত্র, চন্দন, কস্তুরী,

কেশর, কুম্কুম, পুষ্প বহে রক্ষোবধূ

স্বর্ণপাত্রে; স্বর্ণকুম্ভে পুত অম্ভোরাশি

গাঙ্গেয়।                                [৯ সর্গ /২৯৪ পঙ্ক্তি]

জানকী

যথা গোমুখীর মুখ হইতে সুস্বনে

ঝরে পূত, বারি-ধারা, কহিলা জানকী,

মধুরভাষিণী সতী, আদরে সম্ভাষি

সরমারে,                             [৪ সর্গ /১১৩ পঙ্ক্তি]

দাশরথি

দাশরথি পশ্চিম দুয়ারে –

হায় রে বিষণ্ন এবে জানকী-বিহনে,

কৌমুদী বিহনে যথা কুমুদরঞ্জন

শশাঙ্ক!                               [১ সর্গ /২৩৪ পঙ্ক্তি]

নৈকষেয়

এ দূতের মুখে শুনি সুতের নিধন,

হায়, শোকাকুল আজি রাজকুলমণি

নৈকষেয়!

পৌরব

কি ছার ইহার কাছে, হে দানবপতি

ময়, মণিময় সভা, ইন্দ্রপ্রস্থে যাহা

স্বহস্তে গড়িলা তুমি তুষিতে পৌরবে?              [১ সর্গ /৬১ পঙ্ক্তি]

পৌরজন

পৌরজন যত –

কত যে সাধিল সবে কি আর কহিব? [৬সর্গ /১৩৩ পঙ্ক্তি]

পৌলস্তেয়

হে রাঘবকুলচূড়া, তব কুলবধূ,

রাখে বাঁধি পৌলস্তেয়?                  [৮ সর্গ /৩৭ পঙ্ক্তি]

পৌলোমী

কহিলা পৌলোমী

অনন্ত যৌবনা,                                             [৫ সর্গ /২১ পঙ্ক্তি]

বৈদেহী

বৈদেহীর হেতু রাম রাবণে বিগ্রহ।    [১ সর্গ /৪৭৪ পঙ্ক্তি]

বৈনতেয়

           বিহঙ্গকুলে বৈনতেয় যথা

বল-জ্যেষ্ঠ, রক্ষঃ-কুল-শ্রেষ্ঠ শূরমণি!                [২ সর্গ /৬৮ পঙ্ক্তি]

মৈথিলী

                    আহা মরি, সুবর্ণ-দেউটী

দশ দিশ! মৃদু স্বরে কহিলা মৈথিলী;  [৪ সর্গ /৯২ পঙ্ক্তি]

রাবণিরে

কিন্তু হেন বীর নাহি এ তিন ভুবনে,

দেব কি মানব, ন্যায়যুদ্ধে যে বধিবে

রাবণিরে!                                   [২ সর্গ /৫১৬ পঙ্ক্তি]

সৌমিত্রি

উত্তরিলা দেবপতি – “শিবের আদেশে,

মহামায়া, আসিয়াছি তোমার সদনে।

কহ দাসে, কি কৌশলে সৌমিত্রি জিনিবে

দশানন-পুত্রে কালি?”                   [২ সর্গ /৪৮৭ পঙ্ক্তি]

অপত্য প্রত্যয়ের ব্যবহারজনিত কারণে মেঘনাদবধ কাব্য পরিমিত, জুতসই, সংহত ও সুন্দরভাবে ১৪ অক্ষর সমন্বিত হয়ে অমিত্রাক্ষর ছন্দ রক্ষিত হয়েছে। এই অপত্য প্রত্যয় জাত শব্দ ছাড়া অন্য শব্দের প্রয়োগে ১৪ অক্ষরের গরমিলসহ ছন্দের লালিত্য বিঘ্নিত হতো। ঠিক এ-কারণে মাইকেলের অপত্য প্রত্যয়ের প্রয়োগ কাব্যসৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে অনেকখানি। একজন সমালোচক অমিত্রাক্ষর ছন্দ সম্পর্কে বলেন :

মধুসূদন উদ্ভাবিত অমিত্রাক্ষর ছন্দ শুধু নবাগত ও অভিনবই নয়, আধুনিক কবিতার পথ নির্মিতি এবং শিল্পী মধুসূদনের অন্তরাত্মার প্রতিফলন এই ছন্দের দ্বারা ঘটেছে। ভাবানুসারে বিরামস্থানে দম নেয়ার যে রীতি অমিত্রাক্ষর ধারণ করে তা শুধু কবিতাকে পাঠকের অনায়াস উচ্চারণের সীমানায় এনে দেয় না, কবিতা আবৃত্তির ক্ষেত্রেও দিকনির্দেশনা দান করে।৪৮

শুধু তাই নয়, অপত্য প্রত্যয়ও এর মূলে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে এবং প্রযুক্ত শব্দ হিসেবে হয়ে উঠেছে আলংকারিকদের মতে কাব্যের আত্মাস্বরূপ। এ-আত্মা বলতে শুধু একটি বিশেষ উপাদানকেই বোঝায় না, এর সঙ্গে থাকতে হবে অলংকার, রীতি বা স্টাইল, ‘অতিরিক্ত বস্তু,’ হিসেবে কাব্যের বাচ্য বা বক্তব্য। কিন্তু এটাই সব নয়। শব্দার্থ ও বাচ্যার্থের জ্ঞানকে ছাড়িয়ে বিষয়ান্তরে ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করাটাই আসল। আলংকারিকরা এই অভিব্যঞ্জনার নাম দিয়েছেন ‘ধ্বনি’। এই ধ্বনিকে যাঁরা আত্মা বলতে চেয়েছেন, তাঁরাই বিষয়টির উপসংহার টেনেছেন ‘বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম’ বলে।৪৯ কিন্তু রস কাব্যের প্রাণ নয় – অন্যতম একটি উপাদান। এরপর আছে বিভাব, অনুভাব ও সঞ্চারী। আমরা জানি, কবির কাজ পাঠকের চিত্তে রসের উদ্বোধন। কিন্তু রস কবির মন থেকে পাঠকের মনে সোজাসুজি উপায়নিরপেক্ষ সঞ্চারিত হয় না। শব্দ ও অর্থের, বাচক ও বাচ্যের উপায়কে আশ্রয় করেই কবি এই উদ্দেশ্য সাধন করেন সুতরাং যদিও কবির চরম লক্ষ্য পাঠকের মনের ভাবকে রসে রূপান্তরিত করা, তাঁর কাব্য-সৃষ্টি হচ্ছে এই উপায়ের সৃষ্টি –

আলোকার্থী যথা দীপশিখায়াং যত্নবান্ জনঃ।

তদুপায়তয়া তদ্বদর্থে বাচ্যে তদাদৃতঃ॥ (ধ্বন্যালোক, ১।৯)

লোকে আলো চায়, কিন্তু তাকে জ্বালাতে হয় দীপশিখা। কবির লক্ষ্য রস, কিন্তু তাঁকে সৃষ্টি করতে হয় কাব্যের শব্দার্থময় কথাবস্তু।৫০

এত কথা বলার পর খানিকটা নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে : কাব্যের উদ্দেশ্য রসসৃষ্টি; শব্দ, বাচ্য, রীতি, অলংকার, ছন্দ তার উপায়। এই উদ্দেশ্য ও উপায়ের সঙ্গে যুক্ত হয় বুদ্ধিমত্তা, যা কবিতাকে আর এক পর্যায়ে উন্নীত করে। এছাড়া থাকতে পারে ভাষার কাঠিন্য, কবিত্বশক্তিহীনতা, অসংগতি, অনৌচিত্যতা, ছন্দের লালিত্যহীনতা, রসসৃষ্টি অর্থাৎ কাব্যের কাহিনির সব কিছু একটি বিশেষ রসে অভিসিক্ত হয়েছে কি না – সেসব ‘ধরা পড়ে বীক্ষণে নয়, অণুবীক্ষণে।’ বিশ্বনাথ বলেছেন, ‘নির্দোষ না হলে যদি কাব্য না হত, তবে কাব্যপদার্থটি হত অতি বিরল, এমনকি নির্বিষয়; কারণ সর্বরকমের নির্দোষ কাব্য একান্ত অসম্ভব।৫১ মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্য সেরকম একটি কাব্যগ্রন্থ।

তথ্যসূত্র

১.             মধুসূদন ১৮৪২ সালে হিন্দু কলেজের সিনিয়র বিভাগের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র থাকার সময় স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ে রচনা করেন : On the importance of educating Hindu Females প্রবন্ধটি। এ-প্রবন্ধের জন্য শুধু প্রথম পুরস্কার নয়, নারী ও নারীশিক্ষা সম্পর্কে মধুসূদনের যে অভিব্যক্তির প্রকাশ হয়েছে, তা অসাধারণ। ক্ষেত্র গুপ্ত-সম্পাদিত, মধুসূদন রচনাবলী, কলকাতা, সাহিত্য সংসদ, পুনর্মুদ্রণ ১৯৮৪, পৃ ৬২২-২৪।

 ২.            ক্ষেত্র গুপ্ত-সম্পাদিত, মধুসূদন রচনাবলী, পৃ ৩৫।

 ৩.           অশ্রুকুমার সিকদার, আধুনিক কবিতার দিগ্বলয়, কলকাতা, অরুণা প্রকাশনী, নবম মুদ্রণ, ১৪১৯, পৃ ১।

 ৪.            রাজীব সরকার, রবীন্দ্রনাথের চোখে মাইকেল, আমাদের সময়, ৪ঠা নভেম্বর ২০২২।

 ৫.            এটা করেছেন পেত্রার্কা (১৩০৪-১৩৭৪), বোক্কাচিও (১৩১৩-১৩৭৫), ম্যানুয়েল   ক্রাইসোলরস (১৩৬৪-১৪৩৭), সালুতাতির (১৩৩১-১৪০৬), ব্রুনি (১৩৭০-১৪৪৪), গেমিস্তোস প্লেতোন (১৩৫৬-১৪৬০), অ্যাগারিপৌলস, ট্রেপজানসিয়ান (১৩৯৫-১৪৩৪), গুয়ারিনো (১৩৭০-১৪৬০), ভিত্তোরিনো দ্য ফেলতর (১৩৭৮-১৪৪৬),  কোসিমো দ্য মেদিচির (১৩৮৯-১৪৬৪) প্রমুখ পণ্ডিত গ্রিকবিদ্যার সঙ্গে ইতালি ও প্রাচীন রোমবিদ্যার দিকে মনোযোগী হয়েছিলেন।  কেউ কেউ বলেন, ‘The literature of Renaissance both in and out of Italy, is four-fifths of it Latinistic – Vergilian, Ciceronian, Senecan, occationally Horatian, very heavily Ovidian।’ মাইকেলও এ-কাজটি করেছিলেন। শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায়, রেনেসাঁসের আলোয় বঙ্গ দর্শন, ঢাকা, কথা প্রকাশ, ২০১৩, পৃ ১৮-২১।

 ৬.           অন্নদাশঙ্কর রায়, বাংলার রেনেসাঁস, কলকাতা, বাণীশিল্প, ২০০৪, পৃ ১০।

 ৭.            গোলাম মুরশিদ, আশার ছলনে ভুলি, কলকাতা, আনন্দ পাবলিশার্স, তৃতীয় সংস্করণ, ২০০৬।

 ৮.            দীপালি রায়, মধুসূদনের কবিভাষা, বারুইপুর, মহাদিগন্ত, ১৯৯৯, পৃ প্রাক-কথন ৯।

 ৯.            দীপালি রায়, মধুসূদনের কবিভাষা, পৃ প্রাক-কথন ৯। 

১০.           দীপালি রায়, মধুসূদনের কবিভাষা, বারুইপুর, মহাদিগন্ত, ১৯৯৯। প্রথম অধ্যায়ের শিরোনাম :

ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা কবিতার উদ্ভব ও মধুসূদন (২১-১২৪), দ্বিতীয় অধ্যায় : মধুসূদনের শব্দভাণ্ডার  (১২৫-২৬৫), তৃতীয় অধ্যায় : বাংলা ভাষার রূপরীতি ও মধুসূদন (২৬৬-২৯২), চতুর্থ অধ্যায় : অলংকার (২৯৩-৩৩০), পঞ্চম অধ্যায় : ছন্দ (৩৩১-৩৪৩) ও ষষ্ঠ অধ্যায় : মধুসূদনের রূপকল্প (৩৪৪-৩৭৭)।

১১.           সৌরভ সিকদার, মধুসূদনের ভাষা ও শৈলী, ঢাকা, বাংলা একাডেমি, ২০০১।

১২.           সুদীপ সেন-সম্পাদিত, বাঙ্গালা কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ, কলকাতা, বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ, ২০০৯, পৃ ১০।

১৩.          সুদীপ সেন-সম্পাদিত, বাঙ্গালা কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ, পাদটীকা ৫, পৃ ৩০।

১৪.           প্রমথ চৌধুরী, প্রবন্ধসংগ্রহ, ১ম খণ্ড, ১৯৫৯, পৃ ২৫০।

১৫.           উইলিয়াম কেরীর কথোপকথন (১৮০১) ও ইতিহাসমালা (১৮১২), রামরাম বসুর রাজা প্রতাপাদিত চরিত্র (১৮০১) ও লিপিমালা (১৮০২), গোলোকনাথ শর্মার অনুবাদ গ্রন্থ হিতোপদেশ (১৮০২), রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়ের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়স চরিত্রং (১৮০৫), চণ্ডীচরণ মুনশীর তোতা ইতিহাস (১৮০৫), মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের বত্রিস সিংহাসন (১৮০২), হিতোপদেশ (১৮০৮), রাজাবলী (১৮০৮)। মুহম্মদ আবদুল হাই ও সৈয়দ আলী আহ্সান, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, চট্টগ্রাম, বইঘর, চতুর্থ সংস্করণ ১৩৮১, পৃ ৪৫-৪৭।

১৬.          প্রমথনাথ বিশী ও বিজিতকুমার দত্ত-সম্পাদিত, বাংলা গদ্যের পদাঙ্ক, কলকাতা, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রা. লি., তৃতীয় মুদ্রণ, ১৪১৪, পৃ ৯-১০।

১৭.           রামায়ণ, মহাভারত, চৈতন্যচরিতামৃত প্রভৃতি মহাকাব্য ও জীবনচরিত গদ্যের পরিবর্তে পদ্যে পয়ার ছন্দে রচিত হয়েছে। সুবোধ চৌধুরী, সাহিত্য-শিল্প ও নন্দনতত্ত্ব, কলকাতা, জয়দুর্গা লাইব্রেরি, ১৯৯৯, পৃ ২৪৬।

১৮.           শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গ সাহিত্যে গদ্যের উদ্ভব, বাঙ্গালা সাহিত্যের কথা, পৃ ২৬৪-৬৫, উদ্ধৃত : প্রমথনাথ বিশী ও বিজিতকুমার দত্ত-সম্পাদিত, বাংলা গদ্যের পদাঙ্ক, পৃ ১৩।

১৯.           দীপালি রায়, মধুসূদনের কবিভাষা, পৃ ৫০।

২০.           রবীন্দ্র-রচনাবলী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কলকাতা, বিশ^ভারতী সংস্করণ ১৩৫৮, নবম খণ্ড, পৃ ৪২০।

২১.           দীপালি রায়, মধুসূদনের কবিভাষা, ভূমিকা, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, পৃ ১৮।

২২.           ÔHe was nothing of a Bengali Scholar’, said Rabindranath once, when we were discussing the Meghanada, ‘he just got a dictionary and looked out all the sounding words. He had great power over words. But his style has not been repeated. It isn’t Bengali.’ Rabindranath Tagore by Edward Tompson, 2nd Ed. 1948, p 16. উদ্ধৃত : বুদ্ধদেব বসু, সাহিত্যচর্চা, কলকাতা, দে’জ পাবলিশিং, ১৯৮১, পৃ ৩১।

২৩.          রবীন্দ্র-রচনাবলী, পঞ্চদশ খণ্ড, ঐতিহ্য সংস্করণ, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ২০০৪, পৃ ৭৪।

২৪.           মাইকেলের মেঘনাদবধ কাব্যের সমালোচনা করে রবীন্দ্রনাথ যে ভুল করেছিলেন সেটি তিনি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমার বয়স তখন ঠিক ষোলো। কিন্তু ভারতীর সম্পাদকচক্রের বাহিরে ছিলাম না। ইতিপূর্বেই আমি অল্পবয়সের স্পর্ধার বেগে মেঘনাদবধের একটি তীব্র সমালোচনা লিখিয়াছিলাম। কাঁচা আমের রসটা অমøরস – কাঁচা সমালোচনাও গালিগালাজ। অন্য ক্ষমতা যখন কম থাকে তখন খোঁচা দিবার ক্ষমতাটা খুব তীক্ষ্ণ হইয়া উঠে। আমিও এই অমর কাব্যের উপর নখরাঘাত করিয়া নিজেকে অমর করিয়া তুলিবার সর্বাপেক্ষা সুলভ উপায় অন্বেষণ করিতেছিলাম। এই দাম্ভিক সমালোচনাটা দিয়া আমি ভারতীতে প্রথম লেখা আরম্ভ করিলাম।’ রবীন্দ্র-রচনাবলী, সপ্তদশ খণ্ড, ঐতিহ্য সংস্করণ, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ২০০৪, পৃ ১১১৯।

২৫.           William Radice, ‘A Bengali Iliad : Michael Madhusudan Dutt’s Meghnadbadh Kabya,’ প্রীতিকুমার মিত্র স্মারকগ্রন্থ, পৃ ২২২।

২৬.          মোবাশে^র আলী, মাইকেল মধুসূদন দত্ত : ইংরেজি গদ্য রচনা ও স্মৃতিকথা, ঢাকা, বাংলা একাডেমি, ১৯৯৮,

পৃ ১১০।

২৭.           মহম্মদ দানীউল হক, সাহিত্যকথা, ঢাকা, প্রথম সংস্করণ, পৃ ৫৫।

২৮.           ‘বিশেষ্য বিশেষণাদি শব্দের ধাতুরূপে ব্যবহারকে বলা হয় নামধাতু। রামগতি ন্যায়রত্ন ‘বাঙ্গালাভাষা ও বাঙ্গালাসাহিত্যবিষয়ক প্রস্তাবে’ নববিধ ক্রিয়াপদকে ত্যাগ করে বলেন, ‘ভূষেণ, অস্থিরি, কান্তিল, কেলিনু প্রভৃতি মাইকেলি নূতনবিধ ক্রিয়াপদ, ব্যাকরণদোষ প্রভৃতি কণ্টকাবৃত কঠিন ত্বকে এরূপ আচ্ছাদিত যে, তাহা ভেদ করিয়া স্বাদ গ্রহণ করিতে সকলের পক্ষে পরিশ্রম পোষায় না।’ দীপালি রায়, মধুসূদনের কবিভাষা, পৃ ২৬৬।

২৯.           রচনা/ সম্পাদনায়, শহীদ মুনীর চৌধুরী, শহীদ মোফাজ্জল হায়দার, মরহুম ইব্রাহীম খলিল, ডক্টর কাজী দীন মুহম্মদ ও শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী, বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, পুনর্মুদ্রণ, ১৯৯৩, পৃ ১১৫।

৩০.          পি আচার্য, বাংলা বানান বিচিন্তা, প্রথম খণ্ড, কলকাতা, বিকাশ গ্রন্থ ভাবন, ১৯৯৬, পৃ ২৫১।

৩১.          রাজশেখর বসু সংকলিত, চলন্তিকা আধুনিক বঙ্গভাষার অভিধান, ঢাকা, জিজ্ঞাসা, পৃ ৫৯।

৩২.          শশাঙ্কমোহন সেন, মধুসূদন, ঢাকা, কথাকলি, ১৩৭৭, পৃ ৩৪।

৩৩.          বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, মাইকেলের জাগরণ ও অন্যান্য প্রবন্ধ, ঢাকা, ১৯৮৩, পৃ ১১।

৩৪.          দীপালি রায়, মধুসূদনের কবিভাষা, উদ্ধৃত পৃ ২৬০।

৩৫           বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, ঢাকা, সপ্তদশ পুনর্মুদ্রণ, জানুয়ারি ২০১৪, পৃ ৩৯।

৩৬.          দিলীপকুমার ভট্টাচার্যের ভট্টজিদীক্ষিতের সিদ্ধান্ত কৌমুদী, ঢাকা, বাংলা একাডেমি, ১৯৯৪।

৩৭.          বাসন্তীকুমার ভট্টাচার্য-সম্পাদিত সমগ্রব্যাকরণ-কৌমুদী, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর-প্রণীত, ঢাকা, প্রেসিডেন্সি লাইব্রেরী, পৃ ৫৭৮-৬০০।

৩৮.          অধ্যায়গুলো : ১. অপত্যাধিকার, ২. চাতুরর্থিকপ্রকরণ, ৩. শৈষিকপ্রকরণ, ৪. প্রাগ্দীব্যতীয়প্রকরণ, ৫. প্রাগ্বহতীয়প্রকরণ, ৬. প্রাগ্ঘিতীয়প্রকরণ, ৭. ছ-যদ্বিধিপ্রকরণ, ৮. আর্হীয়প্রকরণ, ৯. ঠঞধিকারে কালাধিকারপ্রকরণ, ১০. ঠঞবিধিপ্রকরণ, ১১. ভাবকর্মার্থ প্রত্যয়প্রকরণ, ১২. পাঞ্চমিকপ্রকরণ, ১৩. মত্বর্থীয়প্রকরণ, ১৪. প্রাগদিশীয়প্রকরণ, ১৫. প্রাগিবীয়প্রকরণ ও ১৬. স্বার্থিকপ্রকরণ। দিলীপকুমার ভট্টাচার্যের ভট্টজিদীক্ষিতের সিদ্ধান্ত কৌমুদী, পৃ ভূমিকা।

৩৯.          লোকেশ্বর বসু, আমাদের পদবীর ইতিহাস, কলকাতা, পৃ ১৪।

৪০.           খগেন্দ্রনাথ ভৌমিক, পদবীর উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস, কলকাতা, সঞ্চয়ন প্রকাশনী, ২০০৪, পৃ ২।

৪১.           উমেশচন্দ্র বিদ্যারত্ন, জাতিতত্ত্ব-বারিধি, কলকাতা, দাশগুপ্ত অ্যান্ড কোং প্রাইভেট লিমিটেড, ১৪২৬, পৃ ১৪৩।

৪২.           প্রমথ মিস্ত্রী, ‘ত্রিমুনি ও তাঁদের ব্যাকরণচর্চা,’ প্রাচ্য বিদ্যা পত্রিকা, পঞ্চম সংখ্যা জুন ২০১৫, পৃ ৯৬-৯৭।

৪৩.          প্রমথ মিস্ত্রী, ‘ত্রিমুনি ও তাঁদের ব্যাকরণচর্চা’, পৃ ১০১, ১০৪।

৪৪.           যেমন, দ্রুপদ থেকে দ্রৌপদী, যজ্ঞ থেকে উৎপন্ন তাই যাজ্ঞসেনী (দ্রৌপদী), জবালার পুত্র জাবালি (সত্যকাম), কুন্তীর পুত্রকে কৌন্তেয়, বসুদেবের পুত্রকে বাসুদেব (শ্রীকৃষ্ণ), সুভদ্রার ছেলে সৌভদ্রেয় (অভিমন্যু), কুরুর পুত্রেরা কৌরব, গান্ধার রাজদুহিতা গান্ধারী, যদু বংশের লোককে যাদব, ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র বা বংশকে বলা হয় ধার্ত্তরাষ্ট্র ইত্যাদি।

৪৫.           ১. হোমযাগ, ২. ইষ্টিযাগ, ৩. পশুযাগ, ৪. সোমযাগ ও ৫. সত্রযাগ। রথীন্দ্র সরকার, ‘প্রাচীন ভারতে পুত্রেষ্টি যজ্ঞ : একটি পর্যালোচনা,’ প্রাচ্য বিদ্যা পত্রিকা, ৫ম সংখ্যা জুন ২০১৫, পৃ ৭৮।

৪৬.          কৈকেয়ী ছিলেন ধর্মরাজ অশ্বপতির কন্যা। রাজশেখর বসু সারানুবাদকৃত, বাল্মীকি রামায়ণ, কলকাতা, এম. সি. সরকার অ্যান্ড সন্স প্রা. লিমিটেড, নবম মুদ্রণ, ১৩৯০, পৃ ১২৩। অন্য একটি সূত্র থেকে জানা যায়, ককেশাস অঞ্চলকে বলা হতো কেকয়। সেই রাজ্যের রাজা অশ্বপতির মেয়ে কৈকেয়ী। আর্মেনিয়া ও এশিয়া মাইনর ছিল কেকয়ের অধিভুক্ত। ত্রেতাযুগে ভারত ও আর্মেনিয়ার সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ ছিল। মহাভারতের ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু ও বিদুর বৈবাহিক সূত্রে ইরানের সঙ্গে আবদ্ধ  হয়েছিলেন। যেমন, ধৃতরাষ্ট্রের স্ত্রী গান্ধারী (কান্দাহার)। স্বপত্নী মাদ্রীকে কালহিকি/ ব্যাকট্রিয়ান বলে উল্লেখ করেন পাণ্ডব স্ত্রী কুন্তী। আসলে ইরানের মেদিয়া (Media) ও কাহলিক দুটি ‘Sister province’ ছিল। বিদুরের সহধর্মিণীর নাম পারশবীর (পারস্যজাত) সঙ্গে ইরান নিবিড়ভাবে যুক্ত। (মহাভারত, আদিপর্ব ১১১-১২) ড. বেলা দত্তগুপ্ত, ‘বেদান্ত, তন্ত্র ও ইতিহাসের আলোকে বর্ণ-ব্যবস্থা ও জাতিভেদ প্রথার সমীক্ষা,’ আচার্য বীরেশ্বর গঙ্গোপাধ্যায়, বেদান্ত, তন্ত্র ও ইতিহাসের আলোকে বর্ণ-ব্যবস্থা ও জাতিভেদ প্রথা, কলকাতা, রক্তকরবী, তৃতীয় মুদ্রণ ২০১৭, পৃ জ।

৪৭.           ‘যারা ভরতকে আনতে কেকয়রাজ্যে যাত্রা করল ‘তারা পাঞ্চালদেশ হয়ে হস্তিনাপুরে গঙ্গা পার হয়ে পশ্চিমমুখে কুরুজাঙ্গলের মধ্য দিয়ে … আরও বহুদূর গিয়ে ইক্ষুমতী নদী পার হয়ে বাহ্মীক দেশের মধ্য দিয়ে সুদামা পর্বতে উপস্থিত হ’ল। তার পর বিপাশা ও শাল্মলী নামক দুই নদী অতিক্রম ক’রে অতিশয় ক্লান্ত হয়ে গিরিব্রজ নগরে উপস্থিত হ’ল।’ এই গিরিব্রজ পাঞ্জাবের উত্তরপশ্চিমে (মতান্তরে কাশ্মীরে) অবস্থিত কেকয়রাজ্যের প্রধান নগর। রাজশেখর বসু সারানুবাদকৃত, বাল্মীকি রামায়ণ, পৃ ১২০।

৪৮.           সৌরভ সিকদার, মধুসূদনের ভাষা ও শৈলী, পৃ ৪।

৪৯.           অতুল গুপ্ত, কাব্যজিজ্ঞাসা, কলকাতা, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, তৃতীয় সংস্করণ, ১৩৮০, পৃ ৯-২৩।

৫০.           অতুল গুপ্ত, কাব্যজিজ্ঞাসা, পৃ ৪৬।

৫১.           ‘এবং কাব্যং প্রবিরলবিষয়ং বা স্যাৎ। সর্বথা নির্দোষস্যৈকান্তমসম্ভবাৎ।’ – সাহিত্যদর্পণ, ১। ২, বৃত্তি অতুল গুপ্ত, কাব্যজিজ্ঞাসা, পৃ ৫৮।