মানবতন্ত্রী শিবনারায়ণ রায়

বিংশ শতাব্দীর কীর্তিমান বাঙালি মনীষী শিবনারায়ণ রায়ের জন্মশতবার্ষিকী অতিক্রান্ত হয়েছে গত ২০ জানুয়ারি। তাঁর রচিত অন্যতম বই স্রোতের বিরুদ্ধের নামকরণ দিয়ে শিবনারায়ণ রায়ের বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করা যায়। অধ্যাপনা, গবেষণা, সাহিত্যচর্চা, মননচর্চা, শিল্পবোধ – সবকিছুতেই তিনি ছিলেন উলটো হাওয়ার পন্থী। স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কেটেছেন আমৃত্যু। কোনো প্রলোভন, ভীতির সামনে নিজেকে নত করেননি। মনুষ্যত্বকে সবার ওপরে ঠাঁই দিয়েছেন এবং মানুষের অসীম সম্ভাবনায় আস্থা রেখেছেন নিরন্তর। তাঁর চিন্তা ও কর্মের কেন্দ্রে ছিল মানবতন্ত্র। রেনেসাঁসের আলোকবর্তিকা যে মানবমুখিনতার জন্ম দিয়েছিল তিনি ছিলেন সেই আলোকবর্তিকার অন্যতম ধারক। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজনীতি, দর্শনসহ মানববিদ্যার বহুবিধ ক্ষেত্র নিয়ে তিনি প্রতিনিয়ত ভেবেছেন ও লিখেছেন। জিজ্ঞাসা নামক উচ্চমানের মননশীল ত্রৈমাসিক সম্পাদনা করে বাংলা প্রবন্ধসাহিত্যের উৎকর্ষ ঘটিয়েছেন। বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই তিনি মননশীল রচনা লিখেছেন। কবি হিসেবেও তাঁর সাফল্য প্রশ্নাতীত। তবে তাঁর প্রতিভার সর্বোত্তম প্রকাশ ঘটেছে চিন্তক ও প্রাবন্ধিক হিসেবে।

ইংরেজি সাহিত্যের কৃতী ছাত্র শিবনারায়ণ যৌবনের শুরুতেই মানবতাবাদী বিপ্লবী মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সান্নিধ্য লাভ করেন। তাঁর প্রভাবেই শিবনারায়ণ র‌্যাডিক্যাল হিউম্যানিজমের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং পরবর্তী সময়ে মানবতন্ত্রী হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেন। আক্ষরিক অর্থেই ইহজাগতিকতাবাদী ছিলেন তিনি। যে-জগৎ জীবন ও মৃত্যুর সীমায় আবদ্ধ এবং যে-জগৎ ইন্দ্রিয়গোচর ও যুক্তিগ্রাহ্য সেই জগৎকেন্দ্রিক মানবজীবনের সাধনাই ইহজাগতিকতা। পরকাল, আত্মা বা অতিপ্রাকৃত, অলৌকিক কোনো চিন্তা-ভাবনা ইহজাগতিকতার কাছে মূল্যহীন। মনুষ্যকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা ও ধ্যানধারণাই ইহজাগতিকতার প্রধান লক্ষণ। এই দৃষ্টিভঙ্গি অর্জিত হয়েছিল ইতালীয় রেনেসাঁসের আবির্ভাবের কারণে। ‘মানুষ’ শব্দটির নতুন তাৎপর্য বোঝা গিয়েছিল পঞ্চদশ শতাব্দীর  রেনেসাঁসের সময়ে। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ভাষায় – ‘প্রকৃতিজগৎ এবং বাস্তবজগতের মধ্য দিয়ে প্রকৃতিজগতের নিয়ম দিয়ে, বিজ্ঞান দিয়ে বুঝতে হবে এই ‘মানুষ’কে। ফুটিয়ে তুলতে হবে, ‘মানুষ’ – এই বাস্তবটিকে – ফুলের মতো করে তার সমস্ত দিক পরিব্যাপ্ত করে।’ রেনেসাঁসের এটিই প্রথম প্রকাশ যার মূল প্রত্যয় ছিল মানুষকে ‘মানুষ’ করে তোলা। সভ্যতার অগ্রযাত্রায় ইতিহাসের একটি বিশেষ স্তরে পৌঁছে নতুন যুগের আদর্শ হিসেবে রেনেসাঁসের উদ্ভব ঘটে যা অলৌকিক ও দৈবের হাত থেকে মানুষকে মুক্ত করে তাকে ‘মানুষ’ করে তুলল।

ইউরোপীয় রেনেসাঁসের একজন যথার্থ অনুরাগী ছিলেন শিবনারায়ণ রায়। বাংলার রেনেসাঁস সম্পর্কেও মূল্যবান  বক্তৃতা ও রচনা রয়েছে তাঁর। যেসব সমালোচক বাংলার রেনেসাঁসকে স্বীকৃতি দিতে নারাজ তাদের মতামতকে শিবনারায়ণ বলিষ্ঠ যুক্তিসহকারে খণ্ডন করেছেন। শিবনারায়ণ দেখিয়েছেন, বাংলার জাগরণকে বাংলার রেনেসাঁস বলে না মেনে উপায় নেই এর ব্যাপ্তি যতই সীমাবদ্ধ হোক না কেন। পশ্চিমী সভ্যতার অভিঘাত হলেও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের যে-সূচনা হয়েছিল উনিশ শতকে, তার ক্রমবিস্তারের ফলেই বাঙালির চিন্তাজগৎ প্রগতিমুখী হয়েছে। রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো কর্মী, বঙ্কিমচন্দ্রের মতো ভাবুক, রবীন্দ্রনাথের মতো কবি-ভাবুক-কর্মী সবাই হবেন এমন ভাবনা অবান্তর। কিন্তু তাঁরা পরিবর্তিত চেতনার সর্বোত্তম প্রকাশ এবং এই চেতনাই সাধারণের মধ্যে ক্রমসঞ্চারিত হয়ে চলেছে। একথা অবশ্যই সত্য যে, এখনো সমাজের নানা স্তরে অশিক্ষা, কূপমণ্ডুকতা ও অন্ধবিশ্বাস ছড়িয়ে আছে, এমনকি উচ্চতর স্তরেও যে এই মানসিকতা দূর হয়েছে তা বলা যাবে না। তবুও বাংলার যে প্রগতি এখনো অব্যাহত তা এই রেনেসাঁসেরই ফল। ইউরোপের রেনেসাঁসের সঙ্গে একে অক্ষরে অক্ষরে মেলানো যাবে না। ইউরোপেও ধর্মের শাসন বিলীন হয়নি। অশুভ প্রবণতা সেই দেশগুলোর রাষ্ট্রনীতি ও সমাজনীতিতে রয়েছে। এজন্য রেনেসাঁসকে ব্যর্থতার তকমা দেওয়া অযৌক্তিক।

রেনেসাঁসের পরিচয় পেতে হলে ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, সাহিত্য ও শিল্পের সর্বব্যাপী জ্ঞানের অধিকার থাকা প্রয়োজন। এ-বিষয়ে শিবনারায়ণের পাণ্ডিত্য অসামান্য। তাঁর ইতিহাসজ্ঞান গভীর, সমাজতত্ত্বে-দর্শনে-সাহিত্যে তাঁর দৃষ্টি সুদূরপ্রসারী। সেই প্রজ্ঞাতেই তিনি বাংলার রেনেসাঁসের বিবরণ রচনা করেছেন। এই রেনেসাঁসের উত্তরাধিকার বহন করেছিলেন তিনি যোগ্যতার সঙ্গে। রেনেসাঁসের মূল নির্যাস ছিল মানবমুখিনতা। ইহজাগতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথিবীকে চেনার এক নতুন পথের সন্ধান দিয়েছে রেনেসাঁস। মানবকেন্দ্রিক ইহজাগতিকতাই ছিল শিবনারায়ণ রায়ের জীবনব্যাপী সাধনার মূলমন্ত্র। ধর্মমোহ থেকে মুক্ত ছিলেন তিনি। মুক্তবিবেক ও অসামান্য মনস্বিতার অধিকারী ছিলেন। স্পষ্টভাবে নিজেকে নাস্তিক পরিচয় দিতে দ্বিধা করতেন না। অসাধারণ পাণ্ডিত্যের কারণে দেশে-বিদেশে খ্যাতিমান ব্যক্তিদের সান্নিধ্য অর্জন করেন তিনি। এঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বার্ট্রান্ড রাসেল, জুলিয়ান হাক্সলি, টিএস এলিয়ট, জ্যঁ পল সার্ত্র, সিমোন দ্য বোভোয়ার, আলবেয়ার কামু ও আঁদ্রে মালরো।

বিশ্বসাহিত্যের বা বাঙালির শিল্প-সাহিত্যের প্রত্যেক স্মরণীয় স্রষ্টা সম্পর্কেই শিবনারায়ণ মূল্যায়ন করেছেন। এই মূল্যায়ন প্রশ্নহীন আনুগত্য নয়, নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণে ঋদ্ধ। শেকসপিয়র, মিল্টন, গে্যঁটে, মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল থেকে পরবর্তী সময়ে এলিয়ট, স্পেন্ডার, অডেন, জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, সুভাষ, শঙ্খ, শক্তি, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ পর্যন্ত কেউই তাঁর তীক্ষè দৃষ্টি এড়িয়ে যাননি। বহুগ্রাহীর মতোই শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির যে-কোনো শাখায় অবলীলায় বিচরণ করেছেন তিনি। কবিতা, কথাসাহিত্য, মহাকাব্য, নাটক, সংগীত, চিত্রকলা, ভাস্কর্য প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিপুণ রসগ্রাহী তিনি। বিস্তৃত অধ্যয়ন এবং অন্তর্নিহিত আন্তর্জাতিকতা তাঁর মধ্যে বাঙালিত্ব ও বিশ্বনাগরিকত্বের বিরল মেলবন্ধন ঘটিয়েছে।

স্বদেশ ও স্বকালকে চূড়ান্ত মনে করতেন না শিবনারায়ণ। ‘স্বদেশ, স্বকাল, স্বজন’ প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি দিলে জীবন সম্পর্কে তাঁর সর্বাত্মক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায় –

সহস্র সহস্র বৎসর ধরে মানুষের বিচিত্র সাধনার আমি কি উত্তরাধিকারী নই? আলতামিরার গুহাগাত্রে যে অপরূপ চিত্রাঙ্কন দেখে মুগ্ধ হয়েছি তা তো আঁকা হয়েছিল পঁচিশ হাজার বছর আগে। পাহাড়ের শরীরে নিপুণ ছেনিতে কাটা কার্লি, অজন্তা, ইলোরার স্থাপত্য ও ভাস্কর্য; বেঠোফেন, মোট্সার্টের সোনাটা ও সিম্ফনি; সফক্লেস ও শেক্সপীয়রের নাটক থেকে কালিদাস, লিপো, দান্তে, ওমর খৈয়াম, বিদ্যাপতির কবিতা; প্লেটো, অ্যারিস্টটল থেকে দেকার্ত, হিউম, কান্টের দর্শন – এরা সকলেই কি দূরকাল থেকে ক্রমে ক্রমে আমার চেতনায় প্রবাহিত হয়নি, আমার ইন্দ্রিয়গ্রাম, মেধা এবং হৃদয়বৃত্তিকে পুষ্ট করেনি? আমি কি শুধুই সমকালের বাসিন্দা? পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্ত্রীপুরুষদের বহু সহস্রব্যাপী সে সব মহাকীর্তি তা কি আমার স্বকালেরও অংশ নয়? বর্তমানে বিশ শতকের কলকাতায় আমার বাস বটে, আমার জীবনযাত্রার টানাপোড়েনে তা প্রত্যক্ষ, তবু এটাও সত্য যে পেরিক্লিসের আথেন্স, কালিদাসের উজ্জয়িনী, বত্তিচেলির ফ্লোরেন্স, গোয়েটের হ্বাইমার, ডিকেন্সের লন্ডন, বোদল্যের-এর প্যারিস, ডস্টয়েভস্কির রাশিয়া, হুইটম্যানের আমেরিকা কলকাতাবাসী আমার হাড়েমজ্জায় মিশে আছে।

একথা চিন্তাশীল ব্যক্তিমাত্রই স্বীকার করবেন যে, বাংলা সৃজনশীল সাহিত্যের তুলনায় মননশীল সাহিত্য দুর্বল। নিজে সৃজনশীল না হলেও অন্যের সৃজনশীলতার রস আস্বাদন করা যায়; কিন্তু নিজে মননশীল না হলে অন্যের মননশীলতা উপলব্ধি করা যায় না। আমাদের সাহিত্যের মননবিমুখতা ব্যথিত করেছে শিবনারায়ণকে। এই বেদনা থেকেই তিনি বাংলা মননসাহিত্যের অনটন ঘোচাতে ব্রতী হয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি দুভাবে ভূমিকা পালন করেছেন – লেখক হিসেবে ও সম্পাদক হিসেবে। শিবনারায়ণ রায় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক। স্বচ্ছ, ঋজু ও ধ্রুপদী তাঁর ভাষা, বাক্যগঠন বিন্যস্ত ইটের গাঁথুনির মতো, যুক্তিপরম্পরায় দৃঢ়সংবদ্ধ। প্রতিটি প্রবন্ধে একাধিক নতুন শব্দ উপহার দেন তিনি। তাঁর আবিষ্কৃত শব্দগুলোর অর্থ বোঝার জন্য অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁকে ‘শিবনারায়ণী ভাষার অভিধান’ প্রণয়নের পরামর্শ দিয়েছিলেন। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, যুক্তিবাদ ও মানবতন্ত্র তাঁর চিন্তার কেন্দ্রে স্থান করে নিয়েছিল। মার্কস, ফ্রয়েড ও রাসেলের যৌথ প্রভাবে গঠিত হয়েছিল তাঁর চিন্তাবিশ্ব।

দীর্ঘ দেড় যুগ অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ভারতবিদ্যা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ছিলেন। এ-সময় বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তিনি গবেষণা ও বক্তৃতার আয়োজন করেন। এর পাশাপাশি জিজ্ঞাসা নামে একটি চিন্তামূলক ত্রৈমাসিক প্রতিষ্ঠা করেন। জিজ্ঞাসার সম্পাদক হিসেবে তিনি বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ মননশীল লেখকদের প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসারে এই পত্রিকাটি অসাধারণ ভূমিকা পালন করে।

বিদ্যাব্রতী শিবনারায়ণ শুধু জ্ঞান আহরণ ও প্রচার করেননি, অনুসন্ধানের বিভিন্ন ক্ষেত্র সম্পর্কে শিক্ষিতজনকে সচেতন করেছেন। চিন্তা ও আচরণে যুক্তিশীলতাকে প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং অন্বেষণবৃত্তিকে জাগিয়ে তুলেছেন। সাহিত্যচিন্তা,  মৌমাছিতন্ত্র, কবির নির্বাসন ও অন্যান্য ভাবনা, রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপিয়র ও নক্ষত্রসংকেত, স্রোতের বিরুদ্ধে, খাড়াইয়ের দিকে, বিবেকী বিদ্রোহের পরম্পরার মতো বই বাংলা প্রবন্ধসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। কবি হিসেবেও শিবনারায়ণ রায় আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেন। কথারা তোমার মন, অভিজ্ঞান, মাইকেল! মাইকেল! তাঁর স্মরণীয় কাব্যগ্রন্থ। বিভিন্ন ভাষার কবিতা অনুবাদেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। নিসর্গচেতনা, সৌন্দর্যবোধ, দার্শনিকতা, আন্তর্জাতিকতা ও মানবতাবোধের দীপ্তিতে ভাস্বর তাঁর কবিতা। মানবেন্দ্রনাথ রায়ের রচনাবলীসহ নানা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন তিনি।

সাহিত্যের স্মরণীয় স্রষ্টাদের মূল্যায়নে তাঁর বৈদগ্ধ্য ও যুক্তিবিন্যাসের দৃঢ়তা আমাদের মুগ্ধ না করে পারে না। তিরিশের প্রতিভাবান কবি-সাহিত্যিকদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করেও বুদ্ধদেব বসুর অতুলনীয় প্রতিভা সম্পর্কে তিনি বলেন –

জীবনানন্দের মহত্ত্ব নিয়ে সংশয়ের কোনো কারণ নেই; বস্তুত তাঁকে একজন বিশিষ্ট কবি হিসেবে আবিষ্কার এবং প্রতিষ্ঠাদান বুদ্ধদেবের অন্যতম কীর্তি। জীবনানন্দ খাঁটি কবি ছিলেন; তাঁকে আমি দু’ একবার মাত্র দেখেছি; কিন্তু তাঁর রচনা পড়ে আমার মনে হয়েছে যেন তিনি এক নক্ষত্র-বিম্বিত জলাশয়, যেখানে গভীর অন্ধকারের স্তরে স্তরে নানা অনুভব ও ভাবনার ওঠাপড়া আছে, কিন্তু কোনও বহমানতা নেই। অপরপক্ষে বুদ্ধদেব যেন কোনও তুষারাবৃত শৈলশিখর থেকে উৎক্ষিপ্ত একটি নির্ঝর, ধাপে ধাপে বহমান, ক্রমে নদী এবং তার শাখাপ্রশাখায় প্রসারিত হয়ে মহাসমুদ্রের দিকে নিয়ত প্রবাহী। রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা ভাষায় বুদ্ধদেবের মতো এত বহুমুখী এবং নিয়ত গতিশীল প্রতিভা আর একটিও দেখতে পাই না।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্কে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরে বাংলা ভাষার সবচেয়ে মৌলিক ও প্রতিভাবান ঔপন্যাসিক হিসেবে উল্লেখ করে তাঁর মূল্যায়ন –

জীবনের অনিশ্চয়তাজাত ভয় এবং অলৌকিকে বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে বিত্তসম্বলহীন কিন্তু অভিনয়দক্ষ ও চতুর উদ্যোগীজন যে কীভাবে প্রতিষ্ঠা অর্জন করে, খোদার কালাম যে তার ব্যবসায়ে কতবড় পুঁজি হয়ে উঠতে পারে, বাঙালি ঔপন্যাসিকদের মধ্যে ওয়ালীউল্লাহ্-র আগে আর কেউ কাহিনীর ভিতর দিয়ে এত অনাবিদ্ধ দুঃসাহসে সেটি ফুটিয়ে তুলেছেন বলে আমার অন্তত জানা নেই। হিন্দু সাধুবাবা এবং ধর্মীয় আশ্রমপ্রতিষ্ঠানের ভিতরকার চেহারা নিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য লিখেছিলেন, কিন্তু ‘অহিংসা’ উপন্যাসের (১৯৪১) উৎকর্ষ লক্ষ্য করবার পরও আমার মনে হয় ‘লালসালু’র দীপ্রদীপ্ত, অনন্যতন্ত্র সাহসিকতার তুলনা সেখানেও মেলে না। আসলে হিন্দু আশ্রমগুরুদের চরিত্র বিশ্লেষণের চাইতে মুসলিম পীরমোল্লাদের চরিত্র বিশ্লেষণ যে কোনও বাঙালি লেখকের পক্ষে বেশি বিপজ্জনক। শুধু সার্থক উপন্যাস হিসেবে নয়, শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানের সমকালীন মানসমুক্তির প্রচেষ্টার ইতিহাসেও ‘লালসালু’ বিশেষভাবে উল্লেখনীয়।

অস্ট্রেলিয়ার দীর্ঘ প্রবাস শিবনারায়ণ রায়ের মানবমুখিন দৃষ্টিভঙ্গিকে আরো শাণিত করে তুলেছে। ‘শেক্সপীয়রের তিন বেগানা’ প্রবন্ধে এই দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন ঘটেছে –

আগ্রাসী পশ্চিমী সভ্যতার দেরাজ টানলে কঙ্কাল বেরিয়ে পড়ে তাদেরই প্রতিনিধি ক্যালিবান। তার সন্তানদেরই তো আমি দেখেছি অস্ট্রেলিয়ার সর্বহারা আদিবাসীদের মধ্যে। ক্যালিবানের অস্তিত্ব পাঠক ও দর্শকদের অপ্রস্তুত মনে যে বিবেকদংশন ঘটায় তার তীব্রতাকে হ্রাস করার জন্যই সম্ভবত পশ্চিমী আলোচকরা ক্যালিবানের নানাবিধ রূপকার্থ কল্পনা করেছেন।

শিবনারায়ণ লক্ষ করেছেন, অস্ট্রেলিয়ার ঔপনিবেশিক শ্বেতাঙ্গ বিজেতারা সেখানকার কৃষ্ণকায় আদিম অধিবাসীদের কাছ থেকে তাদের নিজ বাসভূমি শুধু কেড়েই নেয়নি, তাদের স্থানান্তর করেছে আধা মরুভূমি অঞ্চলে। শ্বেতাঙ্গ সভ্যতা থেকে তারা পেয়েছে অত্যাচার, ব্যাধি, মৃত্যু ও হীনম্মন্যতাবোধ। শেকসপিয়রের টেম্পেস্ট নাটকের ‘ক্যালিবান’ রূপক নয়, সমকালীন অস্ট্রেলিয়ায় সে এবং তার জাতিগোষ্ঠী আজো ‘বেগানা’।

শিবনারায়ণ রায়ের চিন্তার গতি বরাবরই ছিল স্রোতের বিরুদ্ধে। তাঁর বিবেকী বিদ্রোহের পরম্পরা গ্রন্থে স্পষ্ট করে ‘স্রোতের বিরুদ্ধে’ কথাটির মর্মার্থ বিশ্লেষণ করেছেন। জীবনের শেষ প্রান্তে উপনীত হয়ে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন দুই বাংলার শিক্ষিত সমাজে তিনটি প্রবণতা-স্রোত প্রবল – প্রথমটির নাম ধর্মপরায়ণতা, দ্বিতীয়টির নাম স্বজাতিপরায়ণতা এবং

তৃতীয়টি মার্কসপরায়ণতা। এই তিন ধারার বিরুদ্ধে নিজেকে দাঁড় করিয়ে শিবনারায়ণ তাঁর মুক্তমনা ও বিদ্রোহী বিবেকের সত্য অন্বেষণের প্রক্রিয়াকে সদাজাগ্রত রেখেছেন।

নির্ভীক ও দৃঢ়চেতা শিবনারায়ণ রায় বিশ্বাস করতেন, মানুষই তার ইতিহাসের রচয়িতা, কোনো অলৌকিক শক্তি নয়। ‘মানবতন্ত্র’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন –

মানবতন্ত্র মানুষকে ইতিহাসের রচয়িতা হিসেবে দেখে, ভাগ্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অথবা অবতার, গুরু বা সন্তের দ্বারা পরিত্রাণ-প্রতিশ্রুত অসহায় জীব হিসেবে দেখে না। মানুষ যেহেতু জড়জগতের অংশ সেহেতু জড়জগতের নিয়ম মানুষের ক্ষেত্রেও খাটে; এবং মানুষ যেহেতু প্রাণীজগতের সদস্য জৈববৃত্তি মানুষকেও পরিচালিত করে। কিন্তু মানুষের দেহের গঠন, বিশেষ করে তার গুরুমস্তিষ্ক, তাকে অতুলনীয় সামর্থ্যাবলীর অধিকারী করেছে; এবং এই বিশিষ্টভাবে মানবীয় সামর্থ্যাবলীর বাস্তবায়ন, অনুশীলন ও বিকাশের ভিতর দিয়েই মানুষ তার ইতিহাসের রচয়িতা হয়ে ওঠে। মানবতন্ত্রী শিবনারায়ণ রায় মনুষ্যত্বকে সবার ওপরে স্থান দিয়েছেন। তিনি ছিলেন বাংলার রেনেসাঁসের সর্বশেষ দীপ। সমাজের রূপান্তরকামী ছিলেন তিনি। মানবতন্ত্র ও রেনেসাঁসের চেতনাকে প্রতিষ্ঠা করতে তিনি লড়াই করেছেন আমৃত্যু। অমানবিকতা, সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় উগ্রবাদ যখন উপমহাদেশজুড়ে কালো মেঘের শঙ্কা তৈরি করেছে তখন শিবনারায়ণের তিমিরবিনাশী চেতনা আমাদের জন্য অফুরান প্রেরণার উৎস।