জন্ম থেকেই শুনে আসছি মামা যুদ্ধে গেছেন। মামাকে দেখিনি অথচ আমি ছ’বছরের বালক। মা আর তাঁর দু’বোন – মামা একা। কিন্তু সবার বড়। ছবিতে দেখেছি ইংরেজ সোলজারদের মধ্যে। মামাকেও ইংরেজ মনে হতো। ছ’ফুট লম্বা, ফর্সা, মাথায় ফেল্ট হ্যাট। সেই গ্রুপ ছবিতে দেখে মামার পুরো চেহারা কল্পনা করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
মামা যুদ্ধে গেছেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে। শুরু ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ – সমাপ্ত ২রা সেপ্টেম্বর ১৯৪৫। একদিকে একা হের হিটলার – অন্যদিকে ব্রিটেন ও তার মিত্রশক্তি। ভারতবর্ষ ব্রিটেনের উপনিবেশ, তাই সুবিধা। ভারতীয়দের ফ্রন্ট লাইনে ঠেলে দাও। পেছনে ব্রিটিশ বাহিনী। প্রথম ধাক্কাটা যাবে এই কালা-আদমিদের ওপর দিয়ে। পেছানোর উপায় নেই। গোরা সেনারা আছে পেছনে। তাদের নির্দেশ ছাড়া পেছনে হটা যাবে না। সেই বাহিনীতে মামা যোগ দিয়েছেন। সুতরাং জীবন-মৃত্যু সবই ঝুলন্ত। যে-কোনো মুহূর্তে ঝরে পড়া। একটা বুলেট, একটা চিৎকার, তারপর স্তব্ধতা।
যুদ্ধ চলছে ১৯৩৯ সাল থেকে। দেখতে দেখতে ছ’বছর কেটে গেল … যুদ্ধ আর থামে না। মামা বেঁচে আছেন কি না তা-ও জানা যাচ্ছে না। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সংবাদ বা চিঠি আসা ছিল খুবই দুরূহ ব্যাপার। যুদ্ধ বলে কথা। মৃত্যু যেখানে প্রতিটি মুহূর্তে অপেক্ষা করছে। আমরা শুধু এটুকু জেনেছি যে, মামা আছেন সিঙ্গাপুরে। আর যুদ্ধ শেষের দিকে জাপানি সেনাদের প্রবল আক্রমণে মিত্রশক্তি পিছু হটতে শুরু করে।
১৯৪৫ সালের মাঝামাঝি যুদ্ধ শেষ হয়। সারা পৃথিবী স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।
এদিকে মামার কোনো খোঁজ নেই।
নানা জাতিসংঘের দপ্তরে প্রতিদিন ধরনা দিচ্ছেন। কোনো খবর মেলে কি না। দিন যায়। মাস যায়। একদিন খবর মিলল যে, মামা জাপানি সৈন্যদের হাতে বন্দি। যাক, সবাই হতাশামুক্ত হলো যে, প্রাণে বেঁচে আছে।
তারপর অপেক্ষা। বন্দিবিনিময় শুরু হয়েছে। প্রায় ছ’মাস লেগে গেল এসব প্রক্রিয়া শেষ হতে। তারপর একদিন খবর পাওয়া গেল, মামা শেখ আবদুল করিম মুক্ত হয়েছেন এবং কলকাতা আসছেন।
বাড়িতে আনন্দের বন্যা।
আমরা সবাই চিৎকার করছি – মামা আসছে … মামা আসছে … জন্মের পর ছ’টা বছর চলে গেল মামাকে দেখিনি। মামা আমাদের কাছে এক বিশাল পুরুষ। ব্রিটিশ সোলজার।
পরে আরো জানা গেল যে, মামার বাঁ পায়ে গুলি লাগে। এবং বন্দি হয়ে যান। অবশ্য পায়ের হাঁটুর নিচ দিয়ে গুলি বেরিয়ে গেছে। হাঁটতে অসুবিধা হয় না। তবে বাঁ পা একটু টেনে চলতে হয়। শুনলাম সেটা তেমন বোঝা যায় না। অর্থাৎ খোঁড়া বলা যাবে না। সে যাই হোক মামাকে আমরা ফেরত পেয়েছি, এর চেয়ে আনন্দের আর কী আছে। আমরা অধীর অপেক্ষায় – মামা কবে গ্রামের বাড়িতে আসবেন। মা আর নানিকে আমরা প্রায়ই জিজ্ঞেস করি, মামা কবে আসবে। এ-বাড়ির বড় ছেলে এবং একমাত্র পুরুষ সন্তান … তাকে ছাড়া বাড়িটা তো অভিভাবকহীন। এখন বসন্তকাল। আমরা ভাইরা বাকুলে দৌড়াদৌড়ি করছি। এই সময় মা আমাকে ডাকলেন।
এদিকে এসো।
কাছে যেতেই গায়ের গেঞ্জিটা খুলে ফেললেন। তাঁর হাতে একটা হালকা গোলাপি রঙের হাফহাতা জামা। সেটা পরিয়ে দিলেন। আর বললেন, মামা আসছে, যাও।
সবাই দৌড়াচ্ছে বাড়ির দক্ষিণ দিকে, যেখানে আমরা কড়ে-ডাং খেলি সেই মাঠের দিকে। এরই মধ্যে অনেক লোক জমে গেছে। দক্ষিণপাড়ার চেনাজানা সবাইকে দেখতে পেলাম। পুরুষ-নারী-কিশোর-কিশোরী কেউ বাদ নেই। এসেছে ঝামটিয়ার অন্যান্য মানুষও, যারা পেছনে থাকে। বিশেষ করে ধাড়াপাড়ার পুরুষ সবাই উপস্থিত। মানিকমামা, হারান, কুঞ্জদা … এরা সবাই উপস্থিত। গোটা গ্রাম জমায়েত হয়েছে মামাকে দেখবে বলে।
ঝামটিয়ায় নানা কওসর আলী জমি-জমার দিক দিয়ে এক নম্বর। সাহেব কোম্পানিতে মাইনেও ঈর্ষণীয়। সবাই তাঁকে বড় চাচা বা বড় দাদা বলে সম্বোধন করে। তিনিও সবার বিপদ-আপদে সঙ্গ দেন। জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। আর মামা যুবরাজ। সবার ওপরে তাঁর স্থান। গ্রামের গৌরব। ব্রিটিশ সোলজার। একটা পুরো মহাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। ভাবলেও গা শিউরে ওঠে। কোথায় ভারতবর্ষ আর কোথায় সিঙ্গাপুর। বিদেশবিভুঁই। অবশ্য সৈন্যদের জীবন এরকমই হয়। যুদ্ধ না বাধলে খুবই সুখের জীবন। আর যুদ্ধে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর সঙ্গে লুকোচুরি। মারো অথবা মরো। ভাগ্য ভালো যে, এরা হ্যান্ডসআপদের দলে পড়েছে। অস্ত্র ত্যাগ করে দু’হাত মাথার ওপর তুলে দাঁড়াও। নট নড়ন-চড়ন। নড়লেই গুলি।
গায়ে জামা দিয়েই দৌড়ে পৌঁছেছি জমায়েতে। পেছনে মা-মামি, নানি-মেজো খালারা।
মামা তখন মাত্র শ’পাঁচেক গজ দূরে – বাড়ি থেকে। একদল লোক তাঁকে ঘিরে এগোচ্ছে। হঠাৎ দেখি মামা হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। প্রায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন আর কী। কয়েকজন জোয়ান লোক তাঁকে ধরে রাখতে পারছেন না। তিনি আওয়াজ করে কাঁদছেন। সবার চোখ জলে ভেজা। মা-নানি ও মহিলারা সবাই কাঁদছেন।
আমি বুঝতে পারি না, কী হচ্ছে।
সব কিছু শান্ত হলে মামা ঘরে প্রবেশ করলেন। সনাতনবাড়ি হলে শঙ্খ বাজানো হতো। মঙ্গলধ্বনি দিয়ে বরণ করা হতো। আরো নানারকম অনুষ্ঠান হতো। আসত ধান-দূর্বা-চন্দনের ফোঁটা। পিদিমের আলোর তাপ … অনেক কিছু … সঙ্গে উলুধ্বনি…
সবকিছু থিতিয়ে এলে, লোকজন চলে গেলে, আমি মা’র কাছে নাটকীয়তার কারণ জানতে চাই। মা জানালেন, কে যেন ভিড়ের মধ্যে মন্তব্য করেছে যে, লোকটা যুদ্ধ থেকে ফিরে এলো, আর তার বড় ছেলেটাই মারা গেল। আর কথাটা মামার কানে যেতেই তিনি ডুকরে কেঁদে ওঠেন। দুই সন্তানের মধ্যে প্রথম পুত্রটিই পরলোকে।
আমার মনে হলো আমি যে নানিকে সোহরাব-রুস্তমের কাহিনি পড়ে শোনাতাম, আর নানি কাঁদত যখন সোহরাবকে হারিয়ে রুস্তমের হাহাকার … এখন সেই ঘটনা। শত্রুর হাত থেকে মানুষটা বেঁচে ফিরল, আর টাইফয়েড তার বড় ছেলে শেখ বজলুল করিমকে গ্রাস করল। তখন পর্যন্ত টাইফয়েডের ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। আজ আর টাইফয়েড কেন, যক্ষ্মাতেও কেউ মরে না। চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনেক উন্নতি হয়েছে। যদিও মারণাস্ত্র সে-তুলনায় যথেষ্ট এগিয়ে।
সন্ধ্যাবেলা আমরা মামাকে ঘিরে বললাম। নিচতলায় তক্তপোশে শীতলপাটি বিছানো। তার ওপর মামা বাবুকেটে বসে। আমরা দেখলাম মামার বাঁ পায়ের যেখান দিয়ে বুলেট বেরিয়ে গিয়েছিল। তিনি পড়ে যাওয়ার পর তাঁদের পুরো প্লাটুন জাপানি যোদ্ধাদের হাতে বন্দি হয়ে যান। জেনেভা চুক্তি অনুযায়ী তাঁদের চিকিৎসা করা হয়। তিনি অল্পদিনে ভালো হয়ে ওঠেন, কিন্তু যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছু করার ছিল না।
ভাইবোনদের মধ্যে মা ছিলেন মামার সবচেয়ে স্নেহের পাত্রী। তাঁর তিন সন্তান মামাকে ঘিরে বসেছে। মামা সবাইকে খুব ভালো করে দেখছেন। কে কেমন হয়েছে।
মামা একসময় আমার মেজোভাই মুজিবরকে জিজ্ঞেস করলেন, মুজিবর, বল তো বাঘ মানে কী?
ত্বরিত উত্তর মুজিবরের, বাঘ মানে টাইগার।
মামা মুচকি হাসছেন।
আমরাও হেসে উঠি।
পরবর্তী সময়ে আমরা মেজোভাই মুজিবরকে ক্ষ্যাপাতাম, বাঘ মানে টাইগার …
এ-উত্তরে মামা শুধু মুচকি হেসেছিলেন। কোনো কথা বলেননি।
মামা আসাতে ঘরটা ভরাট লাগতে লাগল। লোকজনও আসতে লাগল।
মামার কণ্ঠ ছিল জলদগম্ভীর। ব্রিটিশ সোলজার বলে কথা। অবয়বের সঙ্গে কণ্ঠের ছিল একটা চমৎকার সাযুজ্য।
যখন কাশি দিতেন সমস্ত ঘরে তার প্রতিধ্বনি হতো।
দেখতে দেখতে শোকের আবহাওয়া কেটে গেল। আমার খুব আবছা মনে পড়ে বজলুদাদাকে। কালো ছিলেন। আর মামার মতো ফর্সা নয়। উচ্চতাও মায়ের দিকে। মামি বেশ কম উচ্চতার মহিলা ছিলেন। গোলগাল চেহারা। পরতেন গোল্ডেন কালারের চশমা। মুখশ্রী মন্দ ছিল না। গলার স্বরও মিষ্টি ছিল। বউ-ঝি পাশাপাশি বাড়ি বলে চলাফেরায় ছিল খুব স্বাচ্ছন্দ্য। আমাকে একটু বেশি স্নেহ করতেন। কারণ জানি না। হয়তো নিরীহ ছিলাম বলে।
মামি হালিমা খাতুনকে মাঝে মাঝে বেলা ন’টার দিকে রান্নাঘরে বসে কাঁদতে দেখতাম। সে কান্না আমার কাছে একটা করুণরসের সংগীতের মতো মনে হতো। ও আমার বাছুররে … কতদিন থেকে দেখিনিরে… ও আমার নিধিরে … এভাবে তাঁর কান্না চলত। যতক্ষণ মা বা নানি এসে তাঁর পাশে বসে সহানুভূতি না জানাতেন।
দীর্ঘশ^াস ফেলে নানি বলতেন, কেঁদে আর কী করবে মা … আল্লাহ কপালে যা লিখে রেখেছেন তাই তো হবে … সবুর করা ছাড়া আর উপায় কী …
মাঝে মাঝে নানির বদলে আসতেন মা। বোঝাতেন। সান্ত্বনা দিতেন।
মামা আসার পর মামির আহাজারি আরো নতুন করে বেড়ে যায়। এক আনন্দ ডেকে আনে আরেক বিচ্ছেদের কথা। সংসার যে রঙ্গমঞ্চ তাতে আর প্রশ্ন ওঠে না। সুখ-দুঃখ, মিলন-বিরহ-সহগ। আজ আনন্দ কাল নিরানন্দ। আজ দুঃখ কাল সুখের ঢল। আবহমানকাল ধরে চলেছে মানবসমাজে। মানুষকে সব বিয়োগব্যথা ভুলে আবার দৈনন্দিন কাজে লিপ্ত হতে হয়। সংসার তার চাওয়া-পাওয়া আদায় করে নেয়।
মামা কয়েকদিন বিশ্রামে থাকলেন। মনের মধ্যে প্রথম পুত্র হারানোর পাষাণ চেপে আছে। গ্রামের অনেকে দেখা করতে আসে।
দেখতে দেখতে মামা কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠছেন।
একদিন সকালে বাড়িতে থাকা অব্যবহৃত দোনলা বন্দুকটা পরিষ্কার করতে বসলেন। বন্দুকের ঘাড় ভেঙে তার নলের ভেতর দিয়ে পরিষ্কার করার তুলোর পিণ্ডটা তার দিয়ে এদিক-ওদিক করলেন। সব ঠিকঠাক হয়ে গেলে তিনি নানিকে বললেন, মা টোটার বাক্সগুলো কই।
নানি দু’বাক্স বন্দুকের গুলি বের করে দিলেন। খুব যত্নে রাখা ছিল। মামা না থাকায় কোনো গুলি খরচ হয়নি।
এগুলো ছিল ছররা গুলি। সিসের ছোট ছোট গুলি একসঙ্গে থাকে। বন্দুকের ট্রিগার টিপলে গুড়ুম করে আওয়াজ করে ছুটে যায়।
বন্দুকের পরিচর্যা শেষ হলে মামা বললেন, চলো পাখি শিকারে বেরোই।
আমার তো উৎসাহের শেষ নেই।
ছোটভাইরা কিছুদূর সঙ্গ দিয়ে ফিরে গেল। আমি মামার চেলা হয়ে পিছু পিছু চলি। হাতে গুলির বাক্স একটা কাপড়ের থলিতে।
মামা ছোট বাগানের বাঁ পাশ ধরে এগিয়ে চলেন।
একটা গাছে একটা ঘুঘু দেখে তিনি দাঁড়ালেন। আমি গুলি সাপ্লাই দিই।
মামা বন্দুকের ঘাড় ভেঙে ঠিক করে গুলি ভরে তাক করেন। বন্দুকটা বুকের ওপর রাখা। গুলি বেরোনের সময় পেছনে ধাক্কা লাগে সেটা সামাল দিতে হয়। মামা সৈনিক মানুষ, তাঁর কাছে এটা ছেলেখেলা।
তাক করে এক মিনিট নিরীক্ষণ করলেন। তারপর ট্রিগারে চাপ। গুড়ুম করে গুলি বেরিয়ে গেল। কিন্তু ব্যর্থ হলো। পাখিটা দুরন্ত বেগে উড়ে চলল। ফড়ফড় আওয়াজটা সমস্ত আকাশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। মনে হয় যেন প্রকৃতি বিরক্ত হলো এই গুড়ুম শব্দে। অথচ আমার মনে দুঃখ। শিকার ব্যর্থ হলো বলে। আর মামা যে সৈনিক। তাঁর হাত ফস্কে গেল কী করে!
মনে মনে বলি, মামা এখনো হয়তো বজলুদাদার কথা কিছুতেই মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছেন না। তাই এই ব্যর্থতা। আর তিনি সৈনিক মানুষ, পাখি মারা তাঁর কাজ নয়।
ছোট বাগান ছেড়ে আমরা বড় বাগানে গেলাম। এখানে তেমন কোনো শিকার করার মতো পাখি পেলাম না। বড় বাগানের পাশে বিরাট পুকুর। মামা বললেন, দেখ, পুকুরে গুলি করি। পানি কেমন করে লাফিয়ে ওঠে দেখতে পাবি।
পুকুরের পাড়ে একজন লোক ঘাস কাটছিল, মামা তাকে সরে যেতে বললেন।
কয়েক মাস আগে একটা ঘটনা ঘটে। আমার এক মামা এমনি পুকুরের জলে গুলি চালিয়েছিল। আর একটা ছররা এক বালকের কপালে লাগে। কপাল ভালো যে চোখে লাগেনি।
মামা পুকুরের জলে গুলি ছুড়লেন। গুড়ুমের সঙ্গে সঙ্গে জল প্রায় তিন হাত সমান লাফিয়ে উঠল। আমার একটা নতুন অভিজ্ঞতা হলো। আর সেদিনের মতো আমাদের শিকারপর্বেরও সমাপ্তি।
আমাদের খালি হাতে ফিরতে দেখে নানি বললেন, শিকার কই?
পাখির দেখা পাইনি, বলি আমি। একটা পাখি যে মামা মিস করেছেন তা বলতে বাধল।
শিকার বলতে ঘুঘু আর বক ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না। শামুকখোল এদিকে আসে না। আর গ্রামে পাঁড়ঘুঘুও দেখা যায় না। শুধু ছোট ঘুঘুর রাজত্ব।
কয়েকদিন পর মামা কলকাতা চলে গেলেন। তাঁকে ধর্মতলা ডাকঘরের প্রধান পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আমরা সবাই খুব খুশি কলকাতায় পোস্টমাস্টার হিসেবে তাঁর নিয়োগ হওয়ায়। আর ধর্মতলা হলো কলকাতার প্রাণকেন্দ্র।
মামার একটা পোর্টেবল গ্রামোফোন ছিল। যুদ্ধে যাওয়ার আগে কেনা। দেড় ফুট বাই এক ফুট, উচ্চতা দশ ইঞ্চির মতো। এ থেকেই বুঝতাম মামা খুব সৌখিন লোক। মামা না থাকায় ওটা অযত্নে পড়ে ছিল। মামা আসায় ওর ওপর আমার নজর পড়ে। নতুন পিন এলো কলকাতা থেকে। মা বাজাতে পারতেন। আমাকে শিখিয়ে দিলেন। আমি যা রেকর্ড ছিল বাজাতে শুরু করি।
কাগজের ফ্ল্যাপে মোড়া রেকর্ডগুলো সব একেবারে নতুনই ছিল। হ্যান্ডেল মেরে দম দিয়ে পিন-হোল্ডারটা রেকর্ডে বসিয়ে দিলেই হলো। আমি এক এক করে রেকর্ড বাজিয়ে চলি। তখনো বিদ্যালয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি।
সব রেকর্ডের মধ্যে একটি কাহিনিমূলক রেকর্ড ছিল তিন খণ্ডে। অর্থাৎ তিনটি রেকর্ডে কাহিনি বেজে চলবে। এই কাহিনি ছিল ‘তাপসী রাবেয়া’র। এটা আমাকে প্রায় বাজাতে হতো নানির নির্দেশে। মনটা খুব খারাপ হয়ে যেত যখন এই মহীয়সী নারীর পা কাটার ব্যাপারটা ঘটত। রেকর্ড বাজছে আর নানির চোখে অশ্রুধারা। আমারও খুব খারাপ লাগত। যেমন খারাপ লাগত সোহরাব-রুস্তম গল্পের সোহরাবের মৃত্যুদৃশ্যের বর্ণনা পড়ার সময়।
মামা আসলে ছিলেন খুব সৌখিন মানুষ।
কিছুদিন পর ঘরে ফিরলেন। দেখি ছাদের ওপর দুটো বাঁশ বাঁধলেন। তারপর তাতে বাঁধলেন তার। ইনসুলিন করা অর্থাৎ ওপরে কোটিং দেওয়া।
আমরা জানতে চাই এটা কেন।
তিনি হেসে জানালেন, এখন বলবেন না।
পরে অবশ্য আমরা জানতে পারি যে, এটা হলো সেই তার যা রেডিও তরঙ্গ ধরবে। তার মানে বাড়িতে রেডিও আসবে। আমাদের আনন্দ আর ধরে না। রেডিও আসবে? তা-ও আবার গ্রামে! যেখানে বিদ্যুৎ নেই! চলবে কী করে?
আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি এই সপ্তাহটা কখন কাটবে।
দেখতে দেখতে শনিবার এসে গেলো। আর সন্ধ্যাবেলা মামা হাজির হলেন। সঙ্গে দুটো বাক্স।
প্রথমটায় রেডিও। কোম্পানির নাম মার্ফি। তিনটা ব্যান্ড আছে। মানে তিনটি তরঙ্গ যাবে এই রেডিওতে। মিডিয়াম, শর্ট ওয়ান ও সর্বশেষ শর্ট টু। এগুলো মামা আমাদের সব বুঝিয়ে দিলেন। আরো বললেন যে, আমরা যেন মিডিয়াম ওয়েভে রেখে দিই … যাতে কলকাতা ধরা থাকবে।
তিনতলায় চিলেঘরের কামরায় উত্তর দেয়ালের কোনায় ছিল একটা পাকা র্যাক। তার ওপর রেডিও রাখা হলো। আর দ্বিতীয় বক্সে ছিল ব্যাটারি। সেটা রেডিওর পাশে বসানো হলো।
রেডিওর দামটা জানা হয়নি। অন্তত দুশো টাকা তো হবেই। আর ব্যাটারির দাম তিরিশ টাকা। চলবে তিন মাস।
সবকিছু ঠিকঠাক করে মামা রেডিও অন করলেন। আটটার সময় খবর পাঠ। আমরা শুনতে পেলাম : আকাশবাণী কলকাতা, রাত আটটার সংবাদ পড়ছি বিজন বোস … আজকের বিশেষ বিশেষ খবর হলো …
মনে পড়ছে না প্রথম খবর শোনার কোনো স্মৃতি। কী তথ্য দিয়ে খবর শুরু হয়েছিল। শুধু বিজন বোস নামটি মনের মধ্যে চিরকালের জন্যে গেঁথে গেল।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.