মামা-২য় পর্ব

কয়েকদিন িবাড়িতে থেকে মামা কলকাতা চলে গেলেন। এর মধ্যে বালক হিসেবে আমি মামার নিত্যসঙ্গী হয়ে গেলাম। বাগান ও খালপাড়ে দূরে দূরে যাওয়া ছোটদের পক্ষে সম্ভব নয়, তাই আমি একা মামার সঙ্গী। আর মাত্র যুদ্ধফেরত এক সোলজারের একজন ব্যাটম্যান তো চাই। তাই আমি সেই জায়গাটা পূরণ করে ফেলি। মামাকে বুঝতে না দিয়ে লেফট রাইট করে পা মেলাই।

মামা সকালে চা খেতেন টিনের মগ ভরে। প্রায় আধ সের জল হবে। আজকে যা পাঁচশো এমএল। ব্যারাকে সোলজাররা এরকমই মগে চা পান করত। সকাল-বিকেল। ছোটদের তখন চা খাওয়া নিষেধ ছিল। এখন যা পাল্টে গেছে। কোনো বাধা নেই। চা হলো পাতার রস। চাঙ্গাকারী। কফি হলো বীজগুঁড়ো। চায়ের চেয়ে উত্তেজক বেশি। এখন এতো ধরনের সফট-ড্রিঙ্ক বেরিয়েছে যে, ছোটরা চায়ে তেমন আর আসক্ত হয় না। সফট-ড্রিঙ্ক খেয়ে খেয়ে চেহারার শ্রীহানি করছে।

বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে গোলগাল, কুমড়োসদৃশ। সুকুমার রায়ের কুমড়ো পটাশের সঙ্গে এদের খুব মিল।

ছোটবেলা থেকেই আমি ছিলাম তালপাতার সেপাই। টিংটিঙে। তবে দৌড়ঝাঁপে, গাছে ওঠায় ও পুকুরে সাঁতারে পিছিয়ে থাকতাম না। পরবর্তী জীবনে এসব আমাকে খুব সাহায্য করেছে। এর মধ্যে আমার সবচেয়ে দক্ষতা ছিল সাঁতারে। তারপর গাছে চড়া।

নানিদের ঘরের পেছনে একটা দিশি কুলগাছ ছিল। হেলানো। ভিটের গায়ে বেড়ে উঠেছে। হেলে থাকায় গাছে উঠতে সুবিধে। কিন্তু অসুবিধে হলো, ভালো কুল বা বরইগুলো থাকত নিচুডালে ঝুলে। বাধাত বিপত্তি। আঁকশি দিয়ে টানলে ভিটের ঢালে পড়ে রাস্তা পার হয়ে গিয়ে পড়বে ডোবায়। আর হদিস করা যাবে না। তাছাড়া ওখান দিয়ে কেউ যাওয়ার ফলে চোখে পড়লে তার পেটে যাবে। একটা কুল নিয়ে তো আর ঝগড়া-ঝাঁটি করা যায় না। তাছাড়া কথায় আছে, পড়ে পাওয়া ষোলো আনা বা হালাল। যেমন পরবর্তী সময়ে রাজশাহীতে দেখেছি, আমগাছে কেউ ঢিল মারে না। এমনকি হাতের কাছে আম ঝুলে থাকলেও কেউ হাত লাগায় না। অবশ্য আমের বাগান সব বিক্রি হয়ে যায়। ফলে থাকে পাহারাদার। তবে একটা জিনিসের ফরমান আছে, বাগান বাদে অন্যান্য ব্যক্তিগত গাছের আম ঝরে পড়লে যে-কেউ কুড়িয়ে নিতে পারে। সেক্ষেত্রে মালিকানার বিবাদ নেই। যে পাবে আম তার।

মজার ব্যাপার হলো, ঝামটিয়া গ্রামজুড়ে কোনো আমগাছ ছিল না। বেনো জায়গা। হয়তো তাই কেউ আমগাছ লাগাত না। ব্যাপারটা নিয়ে কখনো মনে প্রশ্ন জাগেনি। অথচ বড়খালার শ্বশুরবাড়ি খাজুরদহে বড় বড় সব আমগাছ দেখেছি। ওদের পুকুরপাড় অবশ্য বেশ উঁচু বাঁধ দিয়ে ঘেরা। বান ওদের কাবু করতে পারে না।

খাজুরদহে খালার শ্বশুরবাড়িতে একটা অঘটন ঘটেছিল। বড় খালুর ছোট ভাই ছিল বেশ জোয়ান তাগড়া মানুষ। তাদের পাশের জাতিভাইদের সঙ্গে ছিল বিবাদ। একদিন প্রতিবেশী জাতিভাইরা বড় খালুর ছোট ভাইকে পুকুরপাড়ে বল্লম ছুড়ে আঘাত করে। বল্লম বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে বিদ্ধ হয়। খালুর ভাই পুকুরে পড়ে যান। তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য শত্রুপক্ষ মাথায় লাঠির আঘাতও করে।

বড়খালু বাড়িতে ছিলেন। তিনি মেয়েদের মতো শাড়ি পরে পুকুরপাড়ে এসে ভাইয়ের বুকের বল্লম মুক্ত করেন। কিন্তু প্রাণবায়ু তখন চলে গেছে। মামলা-মোকদ্দমা হয়। চারজনের বারো বছর জেল হয়। প্রতিপক্ষের দুজনের নাম মনে আছে : তসু ও মুসা। চারজন আসামির মধ্যে একজন ছিল ঝামটিয়া গ্রামের জামাই। আমার সেই খালার দু’ছেলে। আখতারভাই আমার চেয়ে বড়। ছোট কাঞ্চন আমার সঙ্গে ঝামটিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ত। এই খালা ও তাঁর দু’সন্তান তখন থেকে ঝামটিয়ার বাসিন্দা হয়ে গেলো। বারো বছর তো কম সময় নয়!

আখতারভাই ফর্সা। কাঞ্চন শ্যামলা। কাঞ্চন আমাদের সঙ্গে কড়ে ড্যাং বা ডাংগুলি খেলোয়াড় হিসেবে খুব ভালো ছিল। আমিও এই খেলাটায় বেশ ভালো ছিলাম। দুই পার্টি হওয়ার সময় আমাদের নিয়ে টানাটানি চলত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুজন পড়তাম বিপরীত দলে।

আমাদের খেলার মাঠ ছিল পুকুরপাড়ের দক্ষিণ দিকে কয়েকটা বাঁশঝাড়ঘেরা ফাঁকা জায়গায়। এই খেলার মাঠের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ছিল একটা ঢিবি। ঘাসাবৃত। এখানে আমরা বসে বিশ্রাম নিতাম। ভালো বাতাস পাওয়া যেত – দক্ষিণ খোলা বলে। ঢিবিটা ঢালু হয়ে নিচে একটা চাতাল তৈরি করেছে। এখানে শীতকালে চিকে খেলা বা দাড়িয়াবান্ধা খেলা হতো। তার পরের ধাপ আরো নিচু। বর্ষায় ডুবে থাকত। কখনো কেউ ধান চাষও করত। সম্ভবত জমিটা ছিল এজমালি বা যৌথ মালিকানার।

ঢিবির তিনদিকে তিনটি তালগাছ। তবে সবগুলোই পুরুষ গাছ। শুকনো মোচা ঝুলে থাকত। পুরো মোচাটা সময়ে পড়ে গেলে অনেকে কুড়িয়ে নিয়ে যেত – জানুন বা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করবে বলে। যেখানেই বাঁশঝাড়-এর আশপাশে কাউকে না কাউকে দেখা যেত বাঁশপাতা ঝাড়ু দিচ্ছে। এক এক জায়গায় স্তূপ করে রাখত। পরে পুরত চটের থলিতে। তখন পলিব্যাগ এদেশে আবিষ্কৃত হয়নি। তখন জ্বালানি মানেই গাছের পাতা, ডালপালা, গুঁড়ি, ফাড়াই করে কাঠ বা লাকড়ি। মণ দরে বিক্রি হতো। গ্রামে কেউ চেরাইকাঠ ব্যবহার করত না। সবাই গাছের পাতা, ডাল আর গোবর শুকিয়ে ঘুঁটে করা বা একটা মোটা কাঠির গায়ে গোবর চেপে চেপে মোটা লাঠির মতো করে শুকিয়ে নিত। মাটির ঘরের গায়ে হাতে নিয়ে থ্যাবড়া মেরে গোবর বসানো হতো। এগুলো শুকিয়ে গেলে ঘরের গায়ে নকশা তৈরি হতো। অনেকে মাঠ থেকে ছোট ছোট ঘুঁটের ডেলা সংগ্রহ করত। বিশেষ করে দরিদ্র ঘরের ন-দশ বছরের মেয়েরাই এ-কাজগুলো করত। তাই এদের নাম হয়ে যেত কুড়ানি। যেমন বর্তমানে তৈরি হয়েছে টোকাই। মানে কুড়িয়ে নেওয়া।

তো সপ্তাহখানেক পর মামা বাড়িতে এলেন। আমাদের জন্য ফল আর বিস্কুট। তারপর গোল চাকার মতো দেখতে কাগজে মোড়া একটা জিনিস ব্যাগ থেকে বের করলেন।

আমাদের মধ্যে কে যেন জিজ্ঞেস করে বলল, মামা, এর মধ্যে কী আছে?

কাল সকালে দেখবি, ভারি গলায় বললেন মামা।

মামা আসায় তিনতলা বাড়িটা গমগম করে উঠল। আসলে বড় বাড়িতে লোকজন হলো শোভা। না হয় মনে হয় ভুতুড়ে বাড়ি। সব চুপচাপ। বিদ্যুৎ ছিল না। সন্ধ্যা মানে আঁধারের রাজত্ব। মামার গলা-খাঁকারি গোটা বাড়িকে কাঁপিয়ে দিত। ফ্রন্টে যুদ্ধ করা সোলজার মানুষ। প্রতিটি পদক্ষেপে তাঁর ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পেত।

আমরা ছোটরা ছাড়া বাড়িতে সবাই মামাকে খুব সমীহ করে চলতাম। ছোটদের কাছে মামা মামাই।

পরদিন সকালে মামা মানিক মামাকে ডেকে আনতে নির্দেশ দিলেন, মানিক মামা পৌঁছলে দুটো বাঁশ জোগাড় করতে বললেন। তার আগে মামা মানিক মামাকে নিয়ে ছাদে গেলেন। বললেন, দেখ মানিক, দশ-বারো ফুট উঁচু হলেই হবে। খুব মোটা না হলেও চলবে। ছাদের এই পশ্চিম কোনায় একটা বাঁশ বাঁধতে হবে, আর এই জানালার রডে একটা। দুটোই এক মাপের দরকার। ছোট-বড় হলেও চলবে। তবে সমান সমান হওয়াই ভালো।

মানিক মামা বললেন, ঠিক আছে। আমি বুঝেছি দাদা।

ছাদের অদূরে পশ্চিমদিকে একটা বাঁশঝাড়, ছাদ ছাপিয়ে উঁকি দিচ্ছে।

পুরোনো বাঁশ না পেলে ঝাড় থেকে একটা বাঁশ কেটে নিলেই হবে, বলে নিচে নেমে গেলেন মানিক মামা।

আমরাও নামলাম। কিন্তু রহস্য এখনো রয়ে গেছে। কী হতে যাচ্ছে আমরা জানতে পারিনি।

মানিক মামা পুরোনো দুটো লগি জোগাড় করে ফেললেন। বাঁশ নয়।

মামা বললেন, এতেই হবে।

ছাদে গিয়ে লগি দুটো বাঁধা হলো।

কিন্তু তার আগেই থলের বেড়াল বেরিয়ে এলো। চটে মোড়া ছিল তার। কালো সুতোয় মোড়া তার। তার বাঁধা হলে তিনতলার চিলেঘরে ঢুকে মামা উত্তর দেয়ালে রাখা তাকটা দেখলেন। আর দুই বাঁশে বাঁধা তারের বাড়তি অংশটা পেঁচিয়ে তাকে রেখে দিলেন।

আমরা তখনো বুঝতে পারিনি তার দিয়ে কী হবে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা।

মামা এবার আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোরা জানতে চাইলি না, তার কেন বাঁধলাম?

আমরা সব চুপ।

আগামী শনিবার রেডিও আনব। এই তারটাকে বলে অ্যানটেনা। এই তার না থাকলে রেডিওর আওয়াজ ভালো শোনা যাবে না। এটা যত ওপরে দেওয়া যায়, তত আওয়াজ জোর হয়। পরিষ্কার হয়। তোরা কলকাতা রেডিও স্টেশনের গান, খবর … সব প্রোগ্রাম শুনতে পাবি। তবে সেটা তোরা পারবি না। কলকাতার সেন্টার আমি ধরে দিয়ে যাব। তোরা শুধু খুলবি আর বন্ধ করবি। দায়িত্বটা আমার ওপরই বর্তাল। বড়দের চেয়ে আমার প্রতি মামার আস্থা।

রেডিও! আমরা সবাই অবাক।

পাড়ার মধ্যে কারো রেডিও নেই … শুধু আমাদের ঘরে! মনে মনে আমরা সবাই পাড়ার অন্যদের চেয়ে বড় হয়ে গেলাম। ফুর্তি আর ধরে না।

আমরা দৌড়ে সিঁড়ি ভাঙি। আর চেঁচাতে থাকি … মামা রেডিও আনবে … মামা রেডিও আনবে … মামা রেডিও আনবে … সারা বাড়ি আমাদের চিৎকারে তোলপাড়। সেই ১৯৪৬ সালে ঝামটিয়ায় রেডিও স্থাপিত হলো। আর মামা শেখ আবদুল করিম হলেন পাইওনিয়ার বা পথপ্রদর্শক। তবে আমি ঝামটিয়া ছাড়া পর্যন্ত কারো বাড়িতে রেডিও দেখিনি। মামা হলেন একমেবাদ্বিতীয়ম। এই সংস্কৃত বাক্যাংশটি আমি শান্তিনিকেতনে শিখি। রবীন্দ্রনাথের বাড়ির উত্তরায়ণ অংশে প্রবেশমুখে। সেও  জীবনের প্রায় অর্ধেকাংশ পার করে। রবি ঠাকুরের জোড়াসাঁকোর বাড়ি ছিল ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম কেন্দ্র। একেশ্বরবাদ যাদের মূলমন্ত্র। যারা বহু ঈশ্বরবাদের বিপরীত।

রেডিও বাড়ির মাথায় স্থাপিত হওয়ায় নিচের কথা বলতে ভুলে গেছি। মামা যে কতো সৌখিন ছিলেন তার অন্যতম প্রমাণ যুদ্ধে যাওয়ার আগে তাঁর বক্স গ্রামোফোন। রেকর্ডের ভাণ্ডারও কম ছিল না। কাননবালা, ইন্দুবালা থেকে শুরু করে কুন্দনলাল সায়গল পর্যন্ত। তাছাড়া ছিল তাপসী রাবেয়ার জীবনকাহিনি নিয়ে তিনটি রেকর্ড – যা আগেই বলেছি। এই রেকর্ডে সবচেয়ে নাটকীয় অংশ ছিল যখন বাড়ির কর্তার বন্ধুদের সঙ্গে মানুষের পায়ের অস্থি পাখির পায়ের হাড়ের চেয়ে সরু বা চিকন এরকম একটা বাদ-বিতণ্ডাকে কেন্দ্র করে। বোঝাই যাচ্ছে সবাই ছিল মাতাল। তো একজন বলে বসে, এটা পরীক্ষা করা হোক। তখন পরীক্ষার জন্যে দাসী রাবেয়াকে ধরে পা কেটে পরীক্ষা চালানো হয়।  রাবেয়ার সেই করুণ আর্তি : আমার পা কেটো না … আমার পা কেটো না … কারো মনে কোনো আবেদন জাগায়নি। তারা কসাইয়ের মতো রাবেয়াকে চেপে ধরে পা কাটে। এই করুণ দৃশ্যটি সবাইকে কাঁদিয়ে ছাড়ে। আমার নানি কাঁদতেন। কলের গানে দম দিতে দিতে আমারও চোখ ভিজে যেত। যদিও জানি এটা ধ্বনি-নাটক বিশেষ –  তবু সবকিছু সত্যি বলে মনে হতো। এটাই শিল্পকলার গুরুত্ব। তা মায়া সৃষ্টি করে এবং মানুষকে জগৎ থেকে পৃথক করে দেয়। যেমন জয়নুলের দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা, বা খাদে পড়া গরুরগাড়ির চাকা তোলার গাড়োয়ানের প্রাণপণ চেষ্টার চিত্র। বা ‘মই’ দেয়ার ছবি। বা ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে বসে থাকা পিতা-পুত্রের অপেক্ষা, কখন ঘাটে লঞ্চ আসবে।

শিল্পকলায় অদ্ভুত এক মায়াজাল আছে। মনে পড়ে মেজো নানির বহুরূপীর সাজ। আমরা ছোটরা কেউ ধরতে পারিনি যে বহুরূপী আর কেউ নয়, আমাদের অতি কাছের মেজো নানি। এ যেন ম্যাজিক। আর সত্যি বলতে কী, এই জাদুবিশ্বাস থেকেই সব শিল্পের জন্ম। ম্যাজিশিয়ানের গিলি গিলি আর জাদুদণ্ড কত কি-না করে বসে। মানুষকে করাত দিয়ে কেটে ফেলে … আবার শূন্যে ভাসায় … আবার বাক্সবন্দি হয়ে জলের মাঝখান থেকে এক মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে আসে … আর জ্যান্ত জাদু হলো সার্কাস। সার্কাসের ট্রাপিজ থেকে ভাঁড় বা জোকার … আর বাঘকে দিয়ে নানা ভঙ্গি করিয়ে নেওয়া … সবই লোমহর্ষক … এসবই এক ধরনের জাদু বা মায়া। জার্মানির গোটা রেলস্টেশন গায়েব করে দেয়া … সব ঘটনা ভাবলেও গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। পৃথিবীতে জাদুকর পি. সি. সরকার … হুডিনি… এদের নাম কে না জানে।

তো মামার গ্রামোফোন। এর কথা আগেও বলেছি। রেডিও আসার সঙ্গে এটা বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা; কিন্তু ব্যাপারটা হলো উল্টো। মামা গ্রামোফোনের কথা জানতে চাইলেন। তাঁর নির্দেশে বের করা হলো। মামা রেকর্ড কভার থেকে খুলে খুলে দেখলেন। সব একদম আগের মতো ঝকঝকে। মামা একটু অবাক হলেন। মাঝে সাত-আট বছর কেটে গেছে অথচ কণামাত্র মালিন্য নিই।

মামা ধরতে পারেননি কেন এই নতুন চেহারা। আমি রহস্যটা মা-র কাছ থেকে জানতে পারি। আমার বড়খালু পাশের গ্রামের শেখ তাজম্মল হোসেন – তাঁর গ্রামোফোন ছিল। তিনিও ছিলেন খুব সৌখিন। তাঁর গ্রামোফোনটা বেশ দামি। চৌকো। প্রায় আধমণ ওজন হবে। আর চোঙা লাগানো। এর জন্যে আওয়াজ গমগম করত। অনেক দূর থেকে শোনা যেত।

একবার বড় খালু মামার সব রেকর্ড নিয়ে গিয়েছিলেন। বেশ কয়েক মাস পর বিকেলের দিকে ফেরত দিতে আসছিলেন। ঝামটিয়া ঢোকার মুখে একটা জমির আঁটনে, অর্থাৎ আলে পা ধাক্কা লাগে। হাত থেকে সব রেকর্ড পড়ে যায়। আর একটিও আস্ত থাকেনি। তিনি মনে মনে ভাবছিলেন শ্বশুরবাড়ি গিয়ে বলবেন, নাও তোমাদের রেকর্ড। সব ঠিক আছে কি-না দেখে নাও।

সেই জায়গায় এই অবস্থা।

তিনি আর সামনে পা বাড়াননি। সব টুকরো রেকর্ড নিয়ে ফিরে যান। এবং পরের সপ্তায় কলকাতা থেকে সব রেকর্ড কিনে শ্বশুরবাড়ি। এই ঘটনা তিনি মাকে বলেছিলেন। ছোট শালি তো, বলা যায়।

ছোট বলে খালু মা-কে খুব স্নেহ করতেন। আমরাও অনেক আদর পেয়েছি। খালু ছোটখাটো মানুষটি। কিন্তু কণ্ঠটি চেরা এবং কিছুটা ভারি। মুখ চাপা। সুদর্শন বলা যাবে না, কিন্তু নিপাট ভদ্রলোক। কথা বলতেন খুব যুক্তিপূর্ণ। তিনি বড় মেয়ে মমতাজ বেগমকে সবচেয়ে ভালোবাসতেন। থেকে থেকেই হাঁক দিতেন, মা মমতাজ …

বড় খালার সংসার ছিল ভরাট। সুখেই ছিলেন তাঁরা। শুধু একটা কাঁটা বিঁধেছিল খালা-খালুর মনে : প্রথম সন্তান শেখ জাহিদুল হোসেনের মৃত্যু। দশ বছর বয়সে সম্ভবত টিটেনাসে মারা গিয়েছিলেন। এর অল্পদিন পরই মামার প্রথম সন্তান শেখ বজলুল করিম টাইফয়েডে মারা যান। দুটি পরিবারে এই দুটি মৃত্যু সবাইকে খুব আহত করেছিল। এরা দুজনই ছিল সমবয়সী এবং বয়স দশ বছর। আর প্রথম সন্তান এবং পুত্রসন্তান। তাই আমি পুত্রসন্তান এবং দশ তখনো পার হইনি … আমাকে নিয়ে পরিবারে খুব চিন্তা ছিল।

এদিকে মেজোখালার সন্তান প্রসবের পরই মারা যেত। প্রায় এভাবে দু-তিনজন মারা যাওয়ার পর আসে মেয়েসন্তান। নাম রাখা হয় আল্লারাখি। আল্লারাখি বেঁচে যাওয়ায় সবার খুব আদরের ছিল। ফর্সা, পাতলা … মাথাভরা ববকাট চুল, চৌকো মুখ – ওকে খুব সুন্দর লাগত। ও মেয়ে আর বাড়িতে একাই, তাই ছোট হাঁড়ি সাজিয়ে ও নিজের মতো খেলত। আর কাদা দিয়ে সাপ বানিয়ে দুলে দুলে বলত : সাপ পন্না তুলেছে … সাপ ফন্না তুলেছে … ওর সেই কথা আমাদের খুব আনন্দ দিত। আর আমরা সব ভাই কোরাসে গান জুড়তাম : সাপ ফন্না তুলেছে … সাপ ফন্না তুলেছে … গোটা বাকুল আর বাড়ি সে-গানে মুখরিত হতো। তিনতলার ছাদে গিয়েও আমাদের কোরাস থামত না : সাপ ফন্না তুলেছে … সাপ ফন্না তুলেছে …

এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে পড়ে গেল। সেই যে ঘর চুনকাম করার সময় কাকতো এসেছিল। আমাকে আর আল্লারাখিকে দেখিয়ে বলেছিল : এই ছেলেটা আর ওই মেয়েটার বিয়ে দিলে খুব ভালো জুটি হবে। সুন্দর মানাবে।

এই কথা শুনে নানি বলেছিলেন : ওদের আগে বাঁচতে দাও মা … তার মুখটা মলিন। একে তো মেজোখালার বাচ্চারা জন্মেই মরে যায়, আর আমার সামনে ঝুলছে দশ বছর পার করার ফাঁড়া।

আজ সব মনে পড়লে হাসি পায়। গ্রামের মহিলারা ছেলেমেয়ে জন্মাবার আগেই সন্তানের বিয়ের কথা ভাবে। এরা বাস করে এক রূপকথার জগতে। গ্রামীণ জীবনটাই এমন। নিজের পরিবারের বাইরের জগৎ সম্বন্ধে ধারণা করতে পারে না। কী ছোট একটা গণ্ডি। বাকি সবই প্রশ্নের বাইরে। অনেকে বাবাবাড়ি ও শ্বশুরবাড়ি ছাড়া আর কোনো গ্রাম চেনে না। আর যাদের ঘরে ঘরে বা এক পাড়ায় তারা তো আরো ছোট গণ্ডির মধ্যে রয়ে গেল।

 তো মামার গ্রামোফোনের রেকর্ড – কে. এল. সায়গলের গান। সায়গলের রেকর্ড ছিল দু-তিনটি। তার মধ্যে একটি রেকর্ড আমাকে খুব টানত। এই গানটির শুরুতে যে অর্কেস্ট্রেশন ছিল তা ছিল খুব উত্তেজনাময়। একসঙ্গে যেন হাজার ড্রাম আর ক্লারিওনেট বাজছে। প্রায় আধ মিনিটতক এই বাজনার পর শুরু সংগীত।

পুরো মনে নেই … শুধু মনে আছে শুরুটা … শুনি ডাকে মোরে ডাকে … এটা হলো স্থায়ী … অস্থায়ী মনে হয় … কেন ডাকে … অন্তরা … আবার ডাকিছে পাখি, জীবনের শাখে শাখে …  কেন ডাকে … শুনি ডাকে, মোরে ডাকে … মায়া শব্দটা আছে … এরপর মনে পড়ে … ঘিরে আসে কালো ছায়া … আর স্মরণে আসছে না। লয় ছিল দ্রুত। আর গাওয়া মনে হয় সি শার্পে … সুর উঠছে … ন্যাচারাল বি হলে এতো উত্তেজনা আসত না। আমি তারস্বরে গেয়ে যেতাম। শুনি ডাকে … মোরে ডাকে … ঠিকই … আমাকে আমার মামাবাড়ি, মামা, ঝামটিয়া … সবই ডাকছে। শুধু জীবনের শাখে শাখে পাখি আর ডাকছে না।

পরবর্তী জীবনে জানতে পারি, এই পাঞ্জাবি সংগীতশিল্পী সিনেমায় প্রচুর প্লেব্যাক গেয়েছেন। গজল, ভজন … এসবও গাইতেন। শুনেছি ১৯৩০-এর দিকে শাস্ত্রীয় সংগীতজ্ঞ ও সংগীত পরিচালক হরিশচন্দ্র বালি কে. এল. সায়গলকে কলকাতায় নিয়ে আসেন এবং আর সি বোরালের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি বি এন সরকারের কলকাতাভিত্তিক ফিল্ম স্টুডিও নিউ থিয়েটার্সে মাসিক ২০০ রুপি চুক্তিতে রাখেন। এখানেই সায়গল পঙ্কজ মল্লিক, কে সি দে এবং পাহাড়ি স্যান্যালের সঙ্গে পরিচিত হন এবং শিল্পীমহলে জায়গা করে নেন। তাঁর মোট গানের সংখ্যা ১৮৫টি। ১৪২টি ছিল চলচ্চিত্রের জন্যে। ৪৩টি এর বাইরে। হিন্দি ছবির গান ১১০টি। বাংলায় ৩০টি। তামিল ভাষায় দুটি। নন-ফিল্মি গান হিন্দিতে ৩৭টি। বাংলা, পশতু, হিন্দি, পাঞ্জাবি ছাড়া ফার্সি ভাষায়ও দুটি গান গেয়েছেন। গালিব, জাউক সীমার প্রভৃতি কবির গান গেয়ে কবিদেরও জনগণের কাছে জনপ্রিয় করেছেন। মনে পড়ছে একটি রবীন্দ্রসংগীতের কথা। গানটি হলো :

আমি তোমায় যত

       শুনিয়েছিলাম গান …

তার বদলে …

ভরাট কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীতের সে আর এক রূপ। আজো কানে বাজে। ভোলা যায় না। যেমন আজকে আমরা ভুলতে পারি না শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাসের ভরাট কণ্ঠ ও ভিন্ন গায়কি।

আকাশ ভরা … সূর্য তারা …

আকাশ ভরা … এই ভরা শব্দটিকে যেভাবে গলা খুলে ভরাট কণ্ঠে গাইতেন, আমরা ভরা একটা মহাশূন্যে বিলীন হয়ে যাই। ভরা শব্দের দ্যোতনা উচ্চারণে কী অদ্ভুত কেরামতি। ভরা ধ্বনিটি দিগন্ত ছাড়িয়ে মহাশূন্য পরিক্রমা করে চলেছে। অন্তহীনভাবে। কারণ তার মাঝে সূর্য-তারাকে স্থান দিতে হবে। সুতরাং ভরাকে অনেক বড় মহাশূন্য নির্মাণ করতে হবে। সেই কাজটাই এঁকে গেছেন দেবব্রত বিশ্বাস। ধ্বনি দিয়ে মহাশূন্যের অবয়ব।

মামা দুই বাক্স নতুন পিন এনেছেন। পুরোনোগুলো জং ধরে গেছে। সব বাতিল হয়ে গেল। মামার অনুপস্থিতির কালের প্রলেপ পড়ে গেছে পিনগুলোতে। ওরা এখন বাতিল। নতুন পিন লাগিয়ে আবার চালু হলো কলের গান।

শুনি ডাকে … মোরে ডাকে …

কেন ডাকে …

তখন থেকে শুরু হয়েছে বাংলা আধুনিক গান। রবি, নজরুল, দ্বিজেন্দ্র, অতুল এঁরা সবাই বাংলা আধুনিক গানের এক একটি শাখা।

কলের গান এখন পিছিয়ে গেল।

বাড়িতে এসেছে রেডিও। তা-ও গ্রামে।

কম কথা!

সকালে : খবর পড়ছি বিজন বোস শুনলেই রেডিওর ভ্যলুম বাড়িয়ে দিতাম। নিচে রান্নাঘর থেকেও শোনা যেত। তা-ও অর্ধেক ভ্যলুমে। পুরো দিলে ছোটবাগান পর্যন্ত আওয়াজ পৌঁছত। সামনে কোনো বাধা নেই। ফাঁকা সবকিছু। তাই অনেক দূর থেকে শোনা যেত।

খবরের পর সোয়া আটটায় শুরু হতো রবীন্দ্রসংগীত। আমি রোজ শুনতাম। আর ধীরে ধীরে আমার কান তৈরি হয়ে গেল। রবীন্দ্রসংগীত শুনলেই আমি ওই বয়সে বলে দিতে পারতাম এটা রবীন্দ্রসংগীত। মামার রেডিও আমার গানের কান তৈরি করে দেয়।

প্রত্যেক রোববার সকালে হতো সংগীত-শিক্ষার আসর। পরিচালনা করতেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক। আমি শুনতাম। শেখার বিদ্যে হয়নি। তবু মনোযোগ দিতাম। খুব একটা বোঝার কথা নয়।

তবে রোববার বিকেলে হতো গল্পদাদুর আসর। এটা উপভোগ করতাম। আর সবচেয়ে ভালো লাগত তোমাদের ইন্দিরাদি বলছি … শিশুমহল খুব উপভোগ করতাম। ইন্দিরাদি শুরুটা করতেন : তোমাদের ইন্দিরাদি বলছি। ছোট সোনামণিরা আদর ও ভালোবাসা নাও। তারপর প্রোগ্রামে কী কী থাকবে এসবের পরিচয় দিতেন। সবশেষে ছোটদের লেখা চিঠির উত্তর দিতেন। তাঁর কণ্ঠে এমন একটি আপন করা সুর ছিল যে অল্পদিনেই আমি তাঁর ভক্ত হয়ে গেলাম। এখনো কানে বাজে :  তোমাদের ইন্দিরাদি বলছি, আদর আর ভালোবাসা নাও …

আর একটা প্রোগ্রাম ছিল খুব প্রিয় – সেটা অনুরোধের আসর। বেলা আড়াইটা থেকে তিনটে পর্যন্ত। বিভিন্ন সব বড় বড় সংগীতশিল্পীর নাম যাঁরা অনুরোধ করতেন তাঁদের অনুরোধে ওই শিল্পীর গান শোনান।

খেয়ে-দেয়ে সবাই আড়াইটার মধ্যে তিনতলার চিলেঘরে হাজির। আধঘণ্টা সবাই নীরব শ্রোতা। একটা সিঙ্গেল খাট ছিল কামরায়। তাছাড়া শীতলপাটি ফেলেও বসে যাওয়া হতো।

শীত-গ্রীষ্ম কোনো ঋতু বাদ যেত না আমাদের এই অনুষ্ঠান।

আর একটা এরচেয়ে প্রিয় অনুষ্ঠান ছিল রেডিও-নাটক। প্রতি শুক্রবার রাত সাড়ে আটটা থেকে শুরু হতো। সম্ভবত ন’টা বা সাড়ে ন’টা পর্যন্ত চলত। সময়ের বিস্তারটা ঠিক মনে করতে পারছি না। সম্ভবত এক ঘণ্টা হবে।

রাত এগারোটায় শুরু হতো উচ্চাঙ্গ সংগীত। খেয়াল বা বাদ্যযন্ত্র। ফলে সেদিনের মতো রেডিওর দায়িত্ব শেষ।

সারা বছরের মধ্যে রেডিওর সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল আশ্বিন মাসে মহালয়ার সকাল। প্রোগ্রাম শুরু হতো ভোর পাঁচটায়। সারা বাংলার রেডিও ঘিরে সবার অবস্থান। হিন্দু-মুসলিম, নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে।

ভোর সাড়ে চারটার মধ্যে আমাদের সবাইকে জাগিয়ে দিতেন নানি। চোখ কচলে কচলে আমরা উঠে পড়তাম। একেবারে ছোটদের জাগানো হতো না।

পাঁচটা বাজার পাঁচ মিনিট আগেই রেডিও খোলা হতো। তখন প্রারম্ভিক টিউন বাজত … টি … টি টি … টিউনটা বড় সুন্দর ছিল। শুরুটা : অলইন্ডিয়া রেডিও কলকাতা – আজ এতই … বাংলা মাসের নাম, ইংরেজি মাসের নাম-তারিখ বলে দিনের কার্যক্রম শুরু হতো। দিনের কার্যক্রম ঘোষণার পরেই শুরু হতো শ্রী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সেই কিছুটা ন্যাজাল, কিছুটা ভাঙা একটা অপূর্ব কণ্ঠ : আশ্বিনের শারদপ্রাতে … তারপর চলত স্তোত্রপাঠ। কখনো উঠছে, কখনো নামছে অবিকল বয়ে চলা ঝর্ণাধারায়।

আমার মন তিনতলার চিলেঘর থেকে উড়ে চলত কোনো সুদূরে – যার কোনো হদিস মিলত না। কামরায় পিনপতন নীরবতা। শুরু একটাই … সুর ও স্বর ভেসে চলেছে অনন্ত পানে।

আমার জীবনে চারটি মহালয়ার প্রোগ্রাম শোনার অভিজ্ঞতা হয়। তারপর দেশভাগের ফলে আমি একা কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম পাড়ি দিই। সে আর এক কাহিনি।

মামা আমাকে কলকাতা নিয়ে যাবেন। শুনে আমি আনন্দে আটখানা। সোমবার বেলা ন’টার দিকে রওনা দিলাম খালনার উদ্দেশে। ওখান থেকে মোটর পাওয়া যাবে। গন্তব্য বাগনান স্টেশন। এই লাইনে যে রেলগাড়ি চলত সংক্ষিপ্ত নাম বি. এন. আর। অর্থাৎ বেঙ্গল-নাগপুর রেলওয়ে।

আমাদের সঙ্গে সম্ভবত হারান ছিল। খালনা পর্যন্ত সুটকেসটা নিয়ে আসবে।

খালনায় বড় খাল পার হয়ে আমরা ট্যাক্সিতে উঠলাম না। মামা দেখি ডানের রাস্তা ধরলেন।

আমি জিজ্ঞেস করি, মামা এদিকে কোথা যাব?

মামা বললেন, কোড়ে।

কোড়ে গ্রামে নানার ছোটবোনের বিয়ে হয়েছে। অর্থাৎ ছোট নানির বাড়ি।

অল্প দূরেই নানির বাড়ি।

পৌঁছে যেতেই বাড়ির সবাই দৌড়ে আসে। মামা তাদের সবার কাছে দেখার বস্তু বটে। আমিও। এই আমার প্রথম আসা।

নানি খুব ছোট চেহারার মানুষ, রং চাপা শ্যামলা। মামা শাহজাহান ও সালেমা খালা দৌড়ে এলেন। সালেমা খালা আমার খালাদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী। ফর্সা, পাতলা গড়ন, লম্বাটে মুখ … কণ্ঠটা একটু চেরা। এটা খুঁত বটে … দশম শ্রেণির ছাত্রী।

একতলা পাকা বাড়ি। বসার ঘরে বইয়ের কাচঘেরা আলমারি। তার মধ্যে রেক্সিন বাঁধানো বঙ্কিমচন্দ্রের বই দেখলাম। আর রবীন্দ্র রচনাবলি তো আছেই। আমি অবাক হয়ে যাই তাদের পরিবারের রুচির কথা ভেবে। জানাশোনা কারো বাড়িতে বই খুব কম দেখেছি। তাও ইসলামি ভাবধারার বই।

প্রথম দর্শনের উষ্ণতা কাটলে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষে মামা বিশ্রাম নিতে বিছানায় গেলেন। আর আমি দুপুরজাগা স্বভাব নিয়ে সালেমা খালার সঙ্গে বাড়ির চারদিক ঘুরে দেখতে লাগলাম। কেন জানি অন্য খালা বা মাসিদের চেয়ে সালেমা খালা আমাকে বেশি আদর করতে লাগলেন।

পরদিন সকালে আমরা বাগনান স্টেশন থেকে হাওড়ায় পৌঁছাই। তখন কয়লার জোরে ইঞ্জিন চলত। তাই দু-ঘণ্টা লাগল। বর্তমানে বিদ্যুৎচালিত রেলগাড়ি, তাই সময় লাগে এক ঘণ্টা দশ মিনিট। তারপর ট্যাক্সি ধরে কলকাতার তালতলায় ২৫ নং সারোদ লেনে পৌঁছই। একটি দোতলা বাড়ি। পাঁচিল ঘেরা। ফটকের মাথায় দুদিকে চেয়ে দুটি সিংহ। আসলে একে বলা যায় সিংহদ্বার। মামা আমাকে নিয়ে দোতলায় উঠলেন। এখানে নানাও থাকেন।

পরদিন নিয়ে গেলেন অফিসে। তাঁকে দেখে সবাই সালাম দিতে থাকল।

বুঝলাম মামাকে সবাই খুব সমীহ করে। ব্রিটিশ চেহারার মানুষটিকে সমীহ না করে উপায় নেই।

বসতে না বসতে রসগোল্লা, শিঙাড়া আর লেমনেড এসে গেল।

কলকাতা আমাদের কাছে ছিল স্বপ্নের শহর। যুদ্ধের সময় আমরা ছিলাম হাওড়া শহরে। বাবার সঙ্গে। জায়গাটার নাম হার্ড কোর্ট লেন।

থাকতাম তিনতলা বাড়ির সবার ওপরের তলায়। তখন এতো ছোট ছিলাম যে, বাড়ির নম্বর আর অঞ্চলটার নামও মনে নেই।

ধর্মতলা কলকাতার বিখ্যাত জায়গা। মধ্য কলকাতা। সবচেয়ে মজার ছিল ট্রামের চলাচল। ট্রামের ঘণ্টাও খুব ভালো লাগত। আর জমাতাম টিকিট। রঙিন লম্বাটে টিকিট। ট্রামের সংস্থাকে সংক্ষেপে বলে মিটিসি।

দুদিন পর নানার সঙ্গে গ্রামে ফিরে আসি। মনে হলো যেন বিদেশ ঘুরে এলাম।

সবাই আমাকে ঘিরে ধরে। কী কী দেখলাম।

আমার অনেকবার দেখা হাওড়া ব্রিজের কথাই মনে পড়ল।

বললাম, হাওড়া ব্রিজ।

সবাই ভেবেছিল আমি চিড়িয়াখানার কথা বলব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লোহা-লক্কড় ভরা এক ব্রিজের কথা। কারো মনে হয় মনঃপুত হলো না।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫) চলাকালীন আমরা যখন হাওড়ায় হার্ড কোর্ট লেনে থাকতাম, বিকেলে প্রায়ই বাবার সঙ্গে ব্রিজে গঙ্গার হাওয়া খেতে আসতাম, এটা ছিল প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।

এই সময়ের একটা মজার ঘটনার কথা এখনো মনে আছে। সেই সময় তো আর দেশে এতো লোকসংখ্যা ছিল না। প্রস্রাব পাওয়ায় বাবা একটা লোহার পিলারের পাশে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করলেন। কোথাও কেউ ছিল না। হঠাৎ এক পুলিশ হাজির। এখানে প্রস্রাব করা নিষেধ। এই ব্যাপারের ফয়সালা হলো এক মজার পদ্ধতিতে। দেখলাম বাবা পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে একটা নতুন চকচকে চৌআনি বের করলেন। তারপর দিলেন পুলিশের হাতে। পুলিশের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আর কোনো কিছু দেখেনি – এমন ভাব করে চলে গেল।

বাড়িতে আমরা কথাটা চাউর করতে ছাড়িনি। তা নিয়ে বেশ হাসাহাসি হতো। পুলিশের সেই আচরণ আজো খুব একটা বদল হয়নি। তবে ভালো মানুষ পুলিশ বিভাগে নেই – সে-কথা বলতে চাই না। সমস্ত মানব-সমাজ ভালোয়-মন্দয় গড়া।