এখন বড়ো দুঃসময়!
মৃত্যুর কাছে মানুষ ক্রমাগত হেরে যাচ্ছে, লাশের সারি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে আর প্রাণবন্ত ও সাহসী মানুষেরা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। প্রাণবন্ত মানুষ চোখে পড়ে না, সবাই যেন নিস্তেজ, প্রাণহীন। এক মুহূর্তের জন্যও জীবনের ভরসা নেই, নেই বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। চারদিকে মৃত্যুদূত থাবা প্রসারিত করে আছে।
শ্রাবণের মাঝামাঝিতে পুরনো জীর্ণ-শীর্ণ ছেঁড়া কাঁথার মতো ছাই রঙের আকাশকে দুমড়ানো-মুচড়ানো মনে হয়। এক ফালি চাঁদ মেঘের রাজ্যে পানকৌড়ির মতো ডুবসাঁতার খেলে যাচ্ছে। এমন মনকাড়া জোড়াতালির জোছনা এবং হিমেল বাতাস যদিও মনোরম ও দৃষ্টিগ্রাহী, তারপরও আকাশের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টিসুখ পাওয়ার মানুষ এই শহরে কেন, সারা দেশেই নেই। নৈঃশব্দ্যের প্রাচীরে ঢাকা পুরো শহর মৃত্যুপুরীর মতো থমথমে। ফাঁকা রাস্তাগুলি নির্জীব কালো সাপের মতো, ভিড়হীন, জনমানুষহীন চৈত্রের দুপুরের খাঁ-খাঁ করা প্রান্তরের মতো নিঃসঙ্গ। যে-শহরের প্রতিটি মহল্লারই বাড়িগুলির দ্বার রুদ্ধ,
সে-শহরে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, প্রতিটি বাড়িতে স্তব্ধতার দুঃশাসনে বাসিন্দারা মূক-বধির, বালিতে চোখ-মুখ গুঁজে উটপাখির মতো নিঃশব্দে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।
মহল্লার ভেতরে মাঝে মাঝে দু-একটি অ্যাম্বুলেন্স থেকে করুণ সাইরেনের শব্দ ধ্বনিত হলে উৎকণ্ঠিত ঘরবন্দি মানুষগুলির বুকের প্রাচীরে আতঙ্কের তরঙ্গ আছড়ে পড়ে। বড্ড বিভীষিকাময় ও করুণ সাইরেনের শব্দ। তখন মহল্লার মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে, কার লাশ এলো? অনুচ্চারে বলে, করোনায় কাকে নিল, আহা মৃত্যু এত সহজ, ইত্যাদি নানারকম ভয়ার্ত আর্তস্বর বাতাসে মৃদু তরঙ্গ তোলে। অদৃশ্য প্রাণঘাতী ভাইরাস বাতাসে ভেসে বেড়ানোর কারণে অনেক বাসার বাসিন্দারা আতঙ্কে জানালাও খোলে না। কয়েদির মতো দিন গোনে, দিনের পর মাস। অনাগত ভবিষ্যৎ যেন মৃত্যুর অন্তহীন প্রহর। রুদ্ধদ্বার ভেঙে মুক্ত আঙিনায় বের হওয়ার ব্যাকুলতায় তাদের মনোজগৎ ভেঙে চুরমার; অনাদরে পোষে বধির কান্না।
বধির কান্না কী শুধু মৃত্যুর ভয়ে? কর্মহীনতার ভয়ও তো কম নয়।
রুটি-রুজি বেহাল দশায় মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত মানুষের নাকাল অবস্থা। বিধ্বস্ত হয়ে গেছে নিয়মতান্ত্রিক সংসারজীবনের যাবতীয় হিসাব-নিকাশ।
বেসরকারি চাকরিজীবীদের মাসোহারা কমিয়ে অর্ধেক। কর্মী ছাঁটাইয়ের কবলেও অর্ধেকের কাছাকাছি। প্রায় সব অফিস বন্ধ। অনলাইনে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ নতুন বিধানের প্রচলন শুরু। কর্মহীনরা শহর ছেড়ে গ্রামের অভিমুখে। বাড়িওয়ালাদের মাথায় হাত। অর্ধেক ভাড়াতেও ভাড়াটিয়া নেই। গলিতে গলিতে অসংখ্য টু-লেট ঝুলছে। বাড়িওয়ালাদের দীর্ঘশ্বাসের বাম্পার ফলন। তাদের সঞ্চয়ের অংক ক্রমে হিমাঙ্কের দিকে গড়াচ্ছে।
শহরের অনেক এলাকায় লকডাউন চলছে। অপেক্ষাকৃত কম আক্রান্ত এলাকায় কিছুটা শিথিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সতর্কবার্তা, সরকারের বার্তা, প্রজ্ঞাপন ও নানা রকম স্ট্র্যাটেজির কসরত অবিরাম আবির্ভূত হচ্ছে। মৃত্যুভয়ে ভীত মানুষের চোখ টিভির পর্দায় আটকা।
ইমার্জেন্সি প্রমাণসাপেক্ষে কিছু মানুষকে রাস্তায় বের হতে দেখা যায়। পুলিশ, ডাক্তার ও মিডিয়ার লোকজন ছাড়া ঘর থেকে বের হতে চায় কে? নিষেধও আছে।
পথচারীকেও আজকাল গৃহবন্দি মানুষের কাছে ভৌতিক বলে ভ্রম হয়।
তাই বলে কি জীবন থেমে থাকে? যারা মরার তারা মরবে।
এই গলিতে আইসোলেশনে আদিল। আদিলের করোনা পজিটিভ।
সিঙ্গল ফ্যামিলিতে আর কেউ নেই যে লিমার পাশে দাঁড়াবে। এমনই দুঃসময় এখন – কে কার কাছে যায়? কে কার বাসায় যায়? ত্রাসের রুদ্র চাবুকাঘাতে সমস্ত জাগতিক মোহ মৃত্যুভয়ে সংকুচিত, মানবতা ও মানবিক গুণাবলি নিরুদ্দেশ।
চারতলা ফ্ল্যাটের তেতলার বাসিন্দা আদিল-লিমা দম্পতি। দোতলায় থাকে রুবি-জামিল। চারতলা ও নিচতলার বাসিন্দারা কর্মহীন হওয়াতে গ্রামে অন্তর্হিত। ফাঁকা। সন্ধ্যার পর এই বাড়িটিকে ভূতের বাড়ি মনে হয়। ওরা নতুন দম্পতি। সিঙ্গল ফ্যামিলি। পাশের ফ্ল্যাটের লিমার প্রিয় দুই বান্ধবী মুখ ঘুরিয়ে নিলেও রুবি অন্তত ফোনে প্রতিদিন খোঁজখবর নেয় লিমার। আদিল পজিটিভ, অন্তঃসত্ত্বা লিমার ভারী শরীর নিয়ে দু-বেলা রান্না করার সামর্থ্য নেই বলে অনুস্যূত সখ্যের বান্ধবী নিচতলার রুবি দুপুর ও রাতের খাবার রান্না করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিধান অনুযায়ী শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে দরজার পাশে রেখে যায়।
আজ ব্যতিক্রম। লিমার হাতে রাতের খাবার তুলে দেয় মনমরা রুবি। তাকে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন ভাবি?
রুবির অধরোষ্ঠে স্ফুরিত মৃদু হাসি কষ্টের নাকি আনন্দের বুঝতে পারে না রুবি। সন্দেহের ঘোর কাটিয়ে লিমা বলল, ভালো আছি। সময় তো ঘনিয়ে আসছে। কখন কী হয় জানি না।
– আদিল ভাইয়া কেমন আছেন?
– গতকাল থেকে কাশিটা বেড়ে গেছে। জানি না কী হয় রুবি। খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে।
– অক্সিজেন সেচুরেশন ঠিক আছে?
– না, ঠিক নেই। ওঠানামা করছে। নব্বইয়ের নিচেও মাঝে মাঝে নেমে যাচ্ছে।
– চিন্তা করবেন না ভাবি। সব ঠিক হয়ে যাবে। তরুণ বয়সীদের করোনা ঘায়েল করতে পারে না।
– দোয়া করো রুবি। এদিকে আমার এই অবস্থা। নড়তে-চড়তে পারি না। আদিলও আইসোলেশনে।
– কোনো চিন্তা করবেন না। আমরা তো আছি।
– তুমিই এখন আমার শেষ ভরসা। নইলে না-খেয়েই মরতে হতো।
– এরকম ভাববেন না ভাবি। এই দুঃসময়ে আপনার সন্তান ভালোয় ভালোয় জন্ম নিক, তা চাই।
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে চিন্তাচ্ছন্ন রুবি অনুচ্চারে বলল, বিপদ যখন আসে সব দিক থেকেই আসে। ডেলিভারির সময় লকডাউনে কোনো হাসপাতালে ভর্তি হতে পারবে কি না কে জানে? হাসপাতালে ভর্তি হতে পারা এখন পরম ভাগ্যের ব্যাপার। কয়েকজন নার্স ও ডাক্তার মারা যাওয়াতে প্রতিটি হাসপাতালে ডাক্তার ও নার্সের উপস্থিতি কমে গেছে। সরকারি নির্দেশে একদিন পরপর ডিউটি করে। পার্সোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্ট (পিপিই) পর্যাপ্ত নেই – এই অভিযোগ প্রতিটি হাসপাতাল থেকে উত্থাপিত হচ্ছে। একটি কোম্পানি পিপিই দেওয়ার পর নকল ও মানসম্মত নয় বলে সরকার প্রত্যাখ্যান করেছে। লিমাকে কে নিয়ে যাবে হাসপাতালে? কোথায় পাওয়া যাবে অ্যাম্বুলেন্স? অ্যাম্বুলেন্স ডাকলেই কি আসবে? তাদেরও তো মৃত্যুভয় আছে!
এলোমেলো ভাবনায় রুবির মনোজগৎ বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
বিষাদের নিস্তরঙ্গ নীল নদীতে আকণ্ঠ ডুবে আছে ভৌতিক শহর। দু-একটা বাড়ির জানালা গলিয়ে আলো ছিটকে পড়েছে সড়কে। মানুষের যাপিত জীবনের রুটিন বিধ্বস্ত। কে কখন খায়, ঘুমায় তা বলা মুশকিল।
গভীর রাতে রুবি-জামিল ইউটিউবে সিনেমা দেখছিল এবং তখন রুবির ফোনে রিং হয়, স্ক্রিনে ভেসে ওঠে লিমার নাম। অযাচিত ও অপ্রত্যাশিত, বিশেষ করে, এই অসময়ে ফোন পেয়ে উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ে রুবি। বিচলিত জামিল রুবির দিকে তাকায়।
স্পিকার অন করে রুবি কথা বলে।
অস্পষ্ট ও ক্ষীণ কণ্ঠে লিমা বলল, একটু আসতে পারবে রুবি? আমার ভীষণ ব্যথা শুরু হয়েছে।
রুবি অনুমান করতে পারে লিমা ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে এবং এই মুহূর্তে কী করা উচিত সে ভেবে স্থির করতে না পেরে জামিলের দিকে তাকায়। লিমার কথা শুনে জামিলের চোখের আয়তন বেড়ে যায়। এখন কী করা উচিত সেও ভাবতে পারছে না। যে-বাসায় পজিটিভ রোগী সে বাসায় যাওয়া মানে যমদূতকে অভ্যর্থনা জানিয়ে ঘরে নিয়ে আসা। রুবির নীরবতা মানে এই সময় ওদের বাসায় যাওয়ার অসম্মতি তা লিমার বুঝতে অসুবিধা হয়নি। অনুপায় লিমা আবার অনুনয় করে বলল, রুবি, আমার অবস্থা খুব খারাপ। যদি পারো একটু আসো বোন, প্লিজ। একটু দয়া করো।
লিমার কণ্ঠস্বরে কাতরতা প্রকাশ পায়। রুবির মন গলে জল, বলল, আমি আসছি ভাবি। জামিলের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে জামিল বলল, জীবন-মৃত্যু আল্লাহর হাতে। যাও।
– তুমিও এসো। যদি অ্যাম্বুলেন্সে ডাকতে হয়!
– চলো।
রুমে তালা লাগিয়ে ওরা লিমার বাসার কলবেল টিপলে প্রসবব্যথায় কুঁকড়ে যাওয়া লিমা প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ভেতর থেকে এসে গেট খুলে অস্পষ্ট কণ্ঠে বলল, আমাকে একটা হাসপাতালে নিয়ে যাবে রুবি? আমার অবস্থা খুব খারাপ রুবি। মনে হয় বাঁচব না। লিমার চোখে পানির ঢল।
গাউন পরা লিমাকে জামিলের মনে হয় মৎস্যকন্যা, ব্যথায় কুঁকড়ে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে বাসার গেট পর্যন্ত আসার কারণে গাউনের ওপর দিক থেকে পরিপুষ্ট বুক আরো ফেঁপে ওঠায় ওর শরীরে যেন সোনালি বিভার মধুর তরঙ্গ জেগে ওঠে। মিষ্টি চেহারায় গোধূম-গাত্রবর্ণা লিমার দাঁতগুলি দেখে জামিলের মনে হলো, ডেন্টিস্টদের রুমে সাজানো পাথরের সাদা ঝকঝকে পরিপাটি দুই পাটি দাঁত যেন। লিমাকে কাছাকাছি থেকে আগে কখনোই দেখেনি সে। ডাগর ডাগর মায়াবী চোখ যেন স্বপ্নের রাজকন্যা। ওর রূপ-লাবণ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়, ফলে কিছুক্ষণের জন্য চোখ ফেরাতে পারেনি জামিল। এই লাবণ্য কি মাতৃত্বের, নাকি যৌবনের! হয়তো মাতৃত্বের অথবা যৌবনের। জামিল দ্বিধাগ্রস্ত। ক্ষণকালের জন্য ভাবিত হয়ে পরক্ষণেই লিমার করুণ চোখদুটি দেখে তাকে সহযোগিতা করার জন্য অপার মায়ায় বুক ভরে যায় ওর। অনাগত এক শিশুর আগমনের ক্ষণে এমন দুষ্ট ভাবাবেগ বড্ড বেমানান ও জঘন্য। মুহূর্তেই ভুলে যায় মৃত্যুভয়ও।
লিমার আর্তস্বর ও করুণ চোখ দেখে রুবির চোখ থেকে জলের ফোঁটা টপটপ করে পড়ে। সে জামিলের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে জামিল দ্বিধাহীনভাবে দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, আমি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করছি। তোমরা তৈরি হও।
তৈরি হওয়ার মতো অবস্থায় নেই লিমা। মা ছাড়া কেউ বুঝতে পারবে না প্রসবব্যথা কতটা যন্ত্রণার, কতটা কষ্টের!
ভেতরের রুম থেকে আদিলের অবিরাম খকখক কাশির শব্দ বাতাসে ভাসছে। কাশতে কাশতে হয়তো বেচারা কাহিল হয়ে গেছে, ভাবে রুবি।
ডাবল মাস্ক লাগিয়ে ছোট একটি ভ্যানিটি ব্যাগে মোবাইল ফোন ও বিশ হাজার টাকা এবং একটি স্যানিটাইজার নিয়ে পরনের কাপড়েই রওনা হয়ে লিমা অস্ফুট উচ্চারণে আদিলকে বলল, তুমি দরজাটা বন্ধ করো। আমি হাসপাতালে যাচ্ছি। সাবধানে থাকবে। অনলাইনে খাবার আনিয়ে খেয়ো। কারণ রুবিও আমার সঙ্গে যাচ্ছে।
রাস্তা ফাঁকা থাকার কারণে কল দেওয়ার কিছুক্ষণ পরেই একটি রংচটা অ্যাম্বুলেন্স বাসার সামনে হাজির।
জামিল বলল, ভাবি, আপনি বাসার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেন। এই দিকটা আমি সামলাব। আপনি আর রুবি হাসপাতালের চিন্তা করুন। আপনার সন্তান ভালোয় ভালোয় যেন … কথাটি শেষ করতে পারেনি জামিল। কেন যেন ওর কণ্ঠ ভারী হয়ে ওঠে।
নিচে অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ শুনে আশেপাশের বাসার অসংখ্য মানুষ জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে। বয়স্করা দোয়া-দরুদ পড়ছে আর ভাবছে – কার লাশ নিয়ে এলো! অথবা কেউ যদি হাসপাতালে যায় লাশ হয়ে ফিরবে। মৃত্যুর হিসাব এখন এমনই।
আদিল দূর থেকে লিমাকে বিদায় দিলে সে রুবির কাঁধে ভর করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে।
অ্যাম্বুলেন্সে ওঠার পর রুবি জামিলের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে জামিল বলল, আমিও যাচ্ছি।
– বাসায় তালা লাগিয়েছো?
– হুম।
রুবি ও জামিলও ক্যাজুয়েল পোশাকেই বের হয়। বাড়তি আয়োজনের মধ্যে দুটি মাস্ক আর রুবির কপালে একটি লাল টিপ। একটি স্যানিটাইজারের বোতল সঙ্গে নিল। আটপৌরে জীবনে অতি সাধারণ জীবনযাপনের সরলা রুবির পোশাকের শখের মধ্যে একটিই আর সেটি হলো, কৈশোর বয়স থেকে বাসা থেকে বের হলে কপালে একটি টিপ চাই, তা যে রঙেরই হোক না কেন। নানা রকম টিপের পাতাও থাকে তার একচিলতে ড্রেসিং টেবিলের পাশে। রুবির কপালের টিপ জামিলেরও বেশ পছন্দ।
অ্যাম্বুলেন্সে ওঠার সময় রুবির চোখে পড়ে গলির শেষ মাথায় একটি কুকুর বিদ্ঘুটে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এবং তখনই সেটি করুণ স্বরে প্রলম্বিত লয়ে ঘেউ ঘেউ ঘেউ করে উঠল।
রুবির বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। মায়ের কাছে শ্রুত, কুকুরের এমন করুণ আর প্রলম্বিত ডাক মহাবিপদের লক্ষণ। মানুষের মৃত্যু হয়। মা কয়েকটি প্রমাণ দিয়েছিল। আশু বিপদমুক্ত হওয়ার জন্য রুবি মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়তে শুরু করে।
ব্যথায় কাতরাচ্ছে লিমা।
রুবি পায়ের দিকে বসে লিমার গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। লিমার শরীর ঘেমে একাকার। গায়ের গাউনটি ভিজে গেছে। রুবি জামিলকে বলল, তুমি মাথায় হাত বুলিয়ে দাও। প্রায় অচেতন লিমার মাথাটি দুই ঊরুর ওপর রেখে জামিল মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে নিঃসংকোচে। ব্যথায় নীল হয়ে যাওয়া লিমার মতো দুর্ভাবনার ছোবলে কাতর হয়ে ওঠে রুবি এবং জামিলও। মহামারিকালে অনেক হাসপাতালে সাধারণ রোগী ভর্তি করছে না – এই খবর সারা দেশে চাউর হয়ে আছে। মরণঘাতী ভাইরাসের ভয়ে অনেক স্ট্রোকের রোগীও বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার খবর মিডিয়াতে প্রচার পাচ্ছে। অনেকেই অ্যাম্বুলেন্সে এই হাসপাতাল থেকে ওই হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে কোথাও ভর্তি হতে না পেরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে।
অ্যাম্বুলেন্সটি জামিলের নির্দেশমতো চলল মাদার অ্যান্ড চাইল্ড হ্যাভেন হাসপাতালের দিকে। দুর্ভাগ্য যে, হাসপাতালে গেট তো গেটই, হাসপাতালই বন্ধ, রোগী ভর্তি করার কোনো সুযোগ নেই। মাদার অ্যান্ড চাইল্ড হ্যাভেন হাসপাতালের গেট থেকে ফিরে আরো দুটি হাসপাতালের একই অবস্থা দেখে রুবি আর জামিলের শরীর ভয়াতঙ্কে কাঁপতে শুরু করে।
রুবি অস্ফুট উচ্চারণে জামিলকে জিজ্ঞেস করে, এখন কী করবে?
– অস্থির হয়ো না। একটা ব্যবস্থা তো হবেই। নিশ্চয়ই আল্লাহ বিপদমুক্ত করবে।
সর্বশেষ, মাতৃসদনে গেলে ওরা ভর্তি নিয়ে লিমাকে সরাসরি লেবাররুমে পাঠিয়ে দেয়।
পূর্বদিগন্ত আলোকিত করে সূর্য ওঠার প্রাক্কালেই লিমার কোল আলোকিত করে একটি ফুটফুটে ছেলেশিশু। প্রায় অচেতন লিমা একবার চোখ খুলে ছেলেটিকে দেখে, জড়িয়ে ধরে আবার চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকে। বিনিদ্র রাতের ধকলে ক্লান্তি আর নিন্দ্রাচ্ছন্নতায় লেবাররুমের বারান্দায় একটি বেঞ্চিতে বসে ঝিমুচ্ছে রুবি আর জামিল। কিছুক্ষণ পর নার্স এসে বলল, দশটায় প্রসূতিকে কেবিনে দেওয়া হবে। মা খুব ক্লান্ত ও দুর্বল। অ্যানিমিয়া আছে। ব্লিডিং হয়েছে প্রচুর। করোনা টেস্ট করানো হয়েছিল?
রুবি বলল, ঠিক জানি না। তবে ওর হ্যাজবেন্ডের পজিটিভ।
নার্স যেন আকাশ থেকে পড়ল, চমকে উঠল এবং রুবির কাছ থেকে দু-কদম পেছনে গিয়ে বলল, বলেন কী? তাহলে আপনারা কে হন?
জামিল বলল, আমরা একই ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকি। সে হিসেবে ফ্ল্যাট-প্রতিবেশী।
– ওহ আচ্ছা। ওনার স্বামী কি হাসপাতালে?
– না। বাসায়।
নার্স আর কোনো কথা না বলে ম্লান মুখে লেবাররুমের দিকে চলে যায়।
সকাল দশটায় লিমাকে লেবাররুম থেকে স্থানান্তর করা হলে ওর চৈতন্য স্বাভাবিক না হলেও সবকিছুই আবছা আবছা বুঝতে পারছে এবং অত্যন্ত ক্ষীণ স্বরে দু-একটি কথা বলতে পারছে। রুবির হাত ধরে চোখ থেকে পানিও ঝরিয়েছে। ছেলের দিকে তাকিয়ে মাতৃত্বের মোহনময়ী হাসি দিয়ে কেবিনটিকে আলোকিতও করেছে। লিমার হাসি দেখে রুবি-জামিল দম্পতির মনে প্রশান্তির সুবাতাস বয়ে যায়।
জামিল বলল, এখন আমি তাহলে বাসায় যাই। ওদিকে আপনার স্বামীর কী অবস্থা গিয়ে দেখি। খবরও জানাতে হবে। আপনি মোবাইল ফোন আনেননি?
লিমা অস্পষ্ট ভাষায় উত্তর দিলো, হ্যাঁ। আমার ভ্যানিটি ব্যাগে আছে।
– আচ্ছা। ওটা আপনার কাছে থাক। আমিই খবর দেব। উনি সকালে কী নাশতা করবে?
লিমার কথা যেন আরো অস্পষ্ট হয়ে আসছে। সে যা বলল তা পরিষ্কার বোঝা না গেলেও জামিল ঠোঁটের নড়াচড়া দেখে এবং ভাঙা ভাঙা অস্পষ্ট শব্দগুলি মিলিয়ে বুঝে নেয়, নাশতার ব্যবস্থা আছে। দুধ আর কর্নফ্লেক্স দিয়ে নাশতা করবে। ফলও আছে। আপনি খেয়াল রাখবেন দুপুরের খাবারটা অনলাইনে আনিয়েছে কি না। আর বেশি ঝামেলা করতে যাবেন না জামিল ভাই। এই দুঃসময়ে আপনারা যা করেছেন …
বাক্যটি শেষ করার আগেই লিমার চোখ থেকে আবার পানি ঝরে।
সকাল গড়িয়ে দুপুর। রুবিকে নার্স জানাল, বাচ্চা মায়ের দুধ পাচ্ছে না। মায়ের দুধ ছাড়া আটচল্লিশ ঘণ্টা অন্য কোনো কিছু মুখে দেওয়া যাবে না। আপনি মায়ের ব্রেস্ট পাঞ্চ করে দেখেন কিছু দুধ বের করতে পারেন কি না। আমি কায়দাটা শিখিয়ে দিচ্ছি।
নার্স একটি ফিডারজাতীয় বোতল, কিন্তু ফিডারও না, সেটি রুবির হাতে দিয়ে ব্রেস্ট পাঞ্চ করার কৌশল দেখিয়ে বলল, একটু চেষ্টা করে দেখুন। মায়ের বুকে দুধ নেই। কোনো কোনো মায়ের দুধ আসতে দেরি হয়। বাচ্চা সাক করতে শুরু করলেই দুধ আসবে। চিন্তার কিছু নেই।
নার্স রুম থেকে বের হয়ে আবার ফিরে এসে বলল, মায়ের করোনা ভাইরাস টেস্ট করতে হবে।
রুবি বলল, প্রয়োজন হলে করবেন।
– আমাদের এখানে করলে রিপোর্ট পেতে দেরি হবে। বাইরের বিশেষ ব্যবস্থায় করালে বারো ঘণ্টায় পাবেন। টাকা লাগবে সাড়ে তিন হাজার। কোনটা করবেন?
– আপনি যা ভালো মনে করেন তাই করেন। এখন টাকার চিন্তা করলে চলবে না। মা-ছেলের সুস্থতাই আগে বিবেচ্য।
লিমা নিস্তেজ। আচ্ছন্ন। ওর স্তন টিপে বারবার ব্যর্থ হয় রুবি। এক ফোঁটা দুধও বের করতে পারছে না। মায়ের পাশে ঘুমন্ত শিশুটি মাঝে মাঝে কঁকিয়ে উঠছে। কাঁদে। মরার ওপর হাতির পা। ফুটফুটে শিশুটিকে কোলে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করে রুবি। নতুনভাবে দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত হয় সে। ভাবতে থাকে, বাচ্চাকে কী খাওয়াবে?
আদিলের দুপুরের খাবার নিশ্চিত করে রুবি আর লিমার জন্য খাবার নিয়ে এসে লিমাকে দেখে জামিলের চোখও কপালে। লিমার এই অবস্থা কেন? এত নিস্তেজ কেন? শরীরটা আরো হলুদ দেখাচ্ছে। এ কি সৌন্দর্য, নাকি রক্তস্বল্পতা! সে দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত হয়, দীর্ঘশ^াস ফেলে মনে মনে প্রার্থনা করে, হে আল্লাহ! মা-ছেলেকে রক্ষা করো। তুমিই শেষ ভরসা।
মুখে খাওয়ার মতো অবস্থায় না থাকাতে লিমাকে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে।
বাচ্চার দুধের ব্যাপারে রুবি উদ্বেগ প্রকাশ করলে জামিল বলল, হাসপাতালে আর কোনো মা আছে কি না দেখো, যারা বাচ্চাটিকে একটু দুধ দিতে পারে।
রুবি বলল, ভালো কথা মনে করেছ তো। আমার মাথায় এই চিন্তাটা আসেনি। মনে হয় পাশের রুমে একজন আছে। ওখানে একটা বাচ্চার কান্না শুনেছি।
– তাহলে চেষ্টা করে দেখো। যেভাবেই হোক বাচ্চাকে তো বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
একজন স্যাম্পল কালেক্টরকে নিয়ে এই সময় নার্স রুমে ঢোকে করোনা টেস্টের স্যাম্পল কালেকশনের জন্য।
শিশুটির দুধের জন্য জামিল পূর্বের কথাটি জানালে নার্স বলল, হ্যাঁ পাশের কেবিনের প্রসূতির বুকে প্রচুর দুধ। রুবির দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি এই বোতলটা নিয়ে যান, গিয়ে বলেন পাঞ্চ করে একটু দুধ দিতে। বললেই দেবে।
স্যাম্পল নিয়ে নার্স চলে গেলে রুবির মনে হয় খরস্রোতা নদীতে ভাসমান ভাঙা তরীর যাত্রী যেন ডাঙার সন্ধান পেল। বোতলটি নিয়ে রুবি কেবিনের দরজায় নক করলে প্রসূতির অ্যাটেনডেন্ট দরজা খুলে রুবিকে দেখে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তাকিয়ে মুখ বিকৃত করল। রুবির মনে হয়েছিল গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে। কিন্তু লিমার নবজাতকের জন্য সে যে-কোনো অপমান সহ্য করতে রাজি। তাই বেহায়ার মতো রুমের ভেতরে ঢুকে দেখতে পায় মা শিশুকে দুধ খাওয়াচ্ছে এবং শিশুর মুখের পাশ দিয়ে দুধ বেয়ে পড়ছে। অনাকাঙ্ক্ষিত আগন্তুককে দেখে মা বুকের ওপর ওড়নাটা টেনে দিয়ে রুবির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী চান?
রুবি বলল, কিছু মনে করবেন না, আমি পাশের কেবিন থেকে এসেছি। আমার (সহানুভূতি পাওয়ার জন্য মিথ্যা বলে) বোনের একটি ছেলে হয়েছে আজ সকালে। কিন্তু বুকের দুধ পাচ্ছে না। আপনারা যদি একটু দুধ দিয়ে সহযোগিতা করতেন, বেবিটা বাঁচত। প্রায় দশ ঘণ্টা হয়ে যাচ্ছে বেবির মুখে এখনো কিছু পড়েনি।
রুবি এই আর্জি প্রসূতির কাছে প্রকাশ করলে তাচ্ছিল্যের স্বরে সে বলল, আমরা কোনো হিন্দুকে দুধ দেবো না।
রুবি অবাক হয়ে বলল, আমরা হিন্দু কে বলল?
ক্রোধান্বিত প্রসূতি শ্লেষের সঙ্গে মুখ বক্র করে বলল, আপনার কপালে অতলা মারা বড় লাল টিপ লাগাইয়া কইতে চান আপনে হিন্দু না। মিছা কথা কওয়ার জায়গা পান না, না? যত্তোসব। আপনে যান। আম্মা দরজাটা বন্ধ করে দাও।
রুবি বলল, দেখুন, আমরা মুসলমান। আমি টিপ পরেছি বলে কি হিন্দু হয়ে গেলাম? আপনি বিশ্বাস করুন।
প্রসূতি কটাক্ষ করে বলল, হুম। যত্তোসব। প্রসূতির মাও বলল, যান। এসব ভাজিভুজি আমরা বুঝি। আপনে যান।
এখানে আর দাঁড়ানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব না করে রুবি রুম থেকে বের হয়ে এলে প্রসূতির মা উদ্ধত ভঙ্গিতে খটাস করে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আরেক দফা অপমান করল। এভাবে দরজা বন্ধ করা মানে অপমান করা। করিডরে এসে রুবি পাথরের মূর্তির মতো স্তব্ধ হয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মনে মনে বলল, একটি শিশুর জীবনের চাইতে একটা টিপ বড়ো হয়ে গেল? টিপের জন্য বাচ্চাটা দুধ পাবে না? এই আচরণ কি ধর্মের, না অধর্মের? ওদের অপমান, লিমার নিস্তেজতা, বাচ্চাকে দুধ দিতে না পারা এবং আদিলের বাসায় করোনার সঙ্গে ফাইট করা – প্রতিটি ঘটনা রুবির মনে পড়াতে অকস্মাৎ ওর শরীরে অসাড়তা নেমে আসে। এই মুহূর্তে কেবিন দুটি পাশাপাশি হলেও এক কেবিন থেকে আরেক কেবিনের দূরত্ব মনে হয় হাজার বছরের পথ। সে মন্থর গতিতে নিজেদের কেবিনে ফেরে।
রুবির মুখ দেখেই জামিল বুঝতে পারে ওরা দুধ দেয়নি। কিছু জিজ্ঞেস করতে হয়নি। রুবির মুখের বিষণ্নতার কালো ছায়াটি জামিলের মুখেও প্রতিস্থাপিত হয়।
জামিলকে রুবি বলল, তুমি একটু বাইরে যাও। আমি ভাবির ব্রেস্ট পাঞ্চ করে আবার দেখি একটু দুধ পাওয়া যায় কি না।
দোতলার রুম থেকে বের হয়ে জামিল নিচে গিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানে। রাস্তা ফাঁকা। এমন জনবহুল শহরটি যেন প্রেতপুরিতে পরিণত হয়েছে। সাহসী কিছু রিকশাচালক পেটের দায়ে রিকশা নিয়ে বের হয়েছে। যাত্রীবিহীন,
এদিক-ওদিক তাকিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরছে। পেটের দায় বড়ো দায়।
রুবি অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও এক ফোঁটা দুধ বের করতে পারেনি। লিমাকে আরো নিস্তেজ মনে হচ্ছে। তার কোনো অনুভূতি আছে কি না রুবি বুঝতে পারছে না। রুবির শরীরটা ঝিমঝিম করছে, অজানা আতঙ্কের কারণে পা থেকে একটা হিমধারা বেয়ে মাথায় গিয়ে থামে। ক্ষণকাল নিজেকেও নিস্তেজ মনে হয়।
সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পর জনৈক ডাক্তার রুবি ও জামিলকে বারান্দায় ডেকে নিয়ে জানাল, রোগীর অবস্থা খুব খারাপ। প্রার্থনা করেন যেন বেঁচে থাকে। বর্তমানে প্যানডেমিক সিচুয়েশনে … বুঝতেই পারছেন সারা পৃথিবীতেই চিকিৎসাব্যবস্থার মারাত্মকভাবে অবনতি হয়েছে। সাংঘাতিকভাবে বিপর্যস্ত। আমরা সাধ্যাতীত চেষ্টা করছি ও করব পেশেন্টকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য। কিন্তু এরপরও … ডাক্তার কথাটি শেষ করতে পারেননি।
ম্রিয়মাণ ডাক্তার অন্তর্হিত হলে নার্স বলল, পেশেন্টের অবস্থা ভালো না। খোদা যদি রক্ষা না করে তাহলে আমাদের পক্ষে কিছু করার নেই।
নির্বাক রুবির চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে।
ঝড়ো বাতাসে অকস্মাৎ নিভে যাওয়া প্রদীপের মতো জামিলও মনে হয় নিভে গেল। সে অস্ফুট উচ্চারণে বলল, তোমাকে বলা হয়নি রুবি। আদিল ভাইয়ের অবস্থাও ভয়ানক খারাপ। সংকটাপন্ন। দুপুরে দেখে এলাম শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেছে। আর জানোই তো … কোভিড পেশেন্টের মুহূর্তের মধ্যে ভয়ানক কিছু ঘটে যায়। লিমা ভাবির অবস্থাও সংকটাপন্ন। কী যে করব কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার মাথা তব্দা হয়ে গেছে রুবি। কিছুই ভাবতে পারছি না। কিছুই না।
রুবি আর জামিল যখন স্থাণুর মতো করিডরে দাঁড়িয়েছিল তখন ওই কেবিনের প্রসূতি রিলিজ নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। শিশুটি নানির কোলে। উপচেপড়া বুকের দুধে মায়ের বুকের ওপরের কাপড় সিক্ত। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ওরা দুজনই ট্যাঁরা চোখে দেখে রুবি ও জামিলকে। ঠোঁট নাড়িয়ে কী যেন বলল, যা জামিল ও রুবির কাছে অশ্রুত রয়ে গেল।
দৃষ্টির আড়াল না হওয়া পর্যন্ত রুবি নিষ্পলক দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ধার্মিক হওয়া সহজ কিন্তু মানুষ হওয়া খুব কঠিন।
রুবির চোখ দুটি ছলছল করছে। সে জামিলের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার মনে হচ্ছে মাথার রগ ছিঁড়ে যাবে। আমি আর স্ট্রেস নিতে পারছি না জামিল। লিমার যদি কিছু হয় … যদি আদিল ভাইয়ের কিছু হয় … তুমি কি ভাবতে পারছ এই বেবিটার কী হবে? একটি পরিবার পৃথিবীর অতল গহিনে হারিয়ে যেতে বসেছে। এদিকে এখানে ভালো ডাক্তারও আসে না। কোনোক্রমে কাজ চালানোর জন্য দু-একজন
ডাক্তার-নার্স আসে মাত্র। না, আমি আর ভাবতে পারছি না জামিল। রুবির চোখের কোণ থেকে আবারো অশ্রু নির্গত হয়।
রাতে বাসায় ফেরেনি জামিল; ওদের সঙ্গে কেবিনেই থেকে যায়। হাসপাতালের সামনে থেকে একটা পাউরুটি আর এক হালি কলা এনে রুবি আর জামিল ভাগাভাগি করে খায়। ওদের দৃষ্টি, সমস্ত মনোযোগ লিমা ও শিশুটির দিকে। শিশু কাঁদতে শুরু করলে রুবি বা জামিল দুজনে ভাগাভাগি করে কোলে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করে। কেঁদেকুটে ক্লান্ত হলে শিশুটি কান্না বন্ধ করে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ক্রমধারায় বাড়তে থাকে।
গভীর রাতে জামিল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে নিচে রাস্তার দিকে দৃষ্টি রাখে। কী ভয়ানক মনে হয় এই ভৌতিক শহরটিকে। রাস্তায় রাস্তায় যেন সাদা কাফনের কাপড় পরে মানুষ মিছিল করছে। এই চেনা শহরটা আজ এত অচেনা কেন? কেন এত রহস্যময় মনে হয়? পথগুলি অচেনা, দালানকোঠা অচেনা, মানুষ অচেনা। এটি কোন জগৎ? নিকষ অন্ধকারে নিতল কৃষ্ণবর্ণের পাথরের বাটির মতো আকাশে অগণিত গ্রহ-নক্ষত্রের ফুটকির দিকে বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে জামিল ভাবে, একটি অদৃশ্য ভাইরাস সমস্ত পৃথিবী বিধ্বস্ত করে দিলো! বিপর্যস্ত করে দিলো মানুষের জীবনব্যবস্থা। রুদ্ধ করে দিলো জীবিকার পথ। জাগতিক রহস্য কোথায়? কোথায় জাগতিক শক্তির উৎস? অ্যাটম, হাইড্রোজেন, ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন, জীবাণু-অস্ত্র সবই একটি অদৃশ্য ভাইরাসের কাছে শক্তিহীন, অর্থহীন। হা হা-হা করে হাসে জামিল, ওইসবও তো মানুষকে বধ করার জন্য। এই জগতে মানুষের এত শত্রু কেন? তাহলে কি মানুষ খুব শিগগির ডাইনোসরের মতো বিলুপ্ত হয়ে যাবে? সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট! কারা থাকবে? জামিলের চিন্তার স্ফুলিঙ্গগুলি সহসাই নিভে যায়। আনমনে পকেট থেকে সিগারেট বের করে অগ্নিসংযোগ করে ধীরে ধীরে টানতে থাকে। হিউম্যান বিইংস আর দ্য ফিটেস্ট, হিউম্যান বিইংস উইল সার্ভাইভ আনটিল দ্য আর্থ ইজ ডেস্ট্রয়েড।
ছয়তলা ভবনের হাসপাতালটিকেও ভূতের আস্তানা মনে হচ্ছে। কোনো রোগী নেই। হয়তো একজন নার্স জেগে আছে। ডিউটি ডাক্তার হয়তো জেগে আছে অথবা ঘুমিয়ে পড়েছে। কেমন নিস্তব্ধতা! কেমন জমানো অন্ধকার! জামিলের মনে হয় স্তব্ধতার গহিনে ভয়ের ভ্রƒণ জন্মায়। না, এখন কোনো ভয় নয়। চাই প্রাণচাঞ্চল্য। চাই কোলাহলমুখর পৃথিবী।
আটচল্লিশ ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পর জামিল-রুবির মনে হলো, সমস্ত পৃথিবী ওলটপালট হয়ে গেল। তছনছ হয়ে গেছে এই সামান্য সময়ের মধ্যে। কীভাবে কী হয়? জীবন-মৃত্যুর খেলা এত সহজ! এত সহজ!
সন্ধ্যায় বাসায় জামিল কোনো অবস্থাতেই আদিলের সাড়া না পেয়ে বাধ্য হয়ে ট্রিপল নাইনে ফোন করে সহযোগিতা চাইলে কয়েকজন রেসকিউয়ারকে পাঠানো হয়। আগত ব্যক্তিদের সহযোগিতায় আদিলের বাসার গেট ভেঙে দেখা গেল আদিলের নিথর দেহ পড়ে আছে ওর রুমে।
আদিলের ফোনসেট থেকে বিভিন্ন নাম্বারে ফোন করে শেষ পর্যন্ত গ্রামের বাড়ির একটি নাম্বারে আদিলের বড়ভাইকে পাওয়া গেল। আদিলের মৃত্যুসংবাদ দেওয়ার পর তিনি লাশ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বললেন, ওখানে লাশের সৎকারের ব্যবস্থা করুন। গ্রামের মানুষেরা কোনো করোনা রোগীর লাশ গ্রামে ঢুকতে দেবে না। ঢাকায় কোথাও দাফন-কাফন করার ব্যবস্থা করুন।
নিরুপায় আদিল কোভিডের মৃতদের সৎকারের জন্য স্বেচ্ছাসেবী একটি সংগঠনের কাছে লাশ হস্তান্তর করে হাসপাতালে গিয়ে দেখে লিমার অবস্থাও সংকটাপন্ন। নাকের ডগায় দম।
মাঝরাতে লিমাও পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যায় অনন্তলোকে। এমন অভাবনীয় ঘটনা ঘটে গেল যে, রুবি-জামিল দম্পতি সামলে উঠতে না পেরে অনেকক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে রইল। হয়তো রুবির টসটসে অশ্রুগ্রন্থি শুকিয়ে কিসমিস, তাই হয়তো অশ্রু বিগলতি হয়নি। শোকের গভীরে শোক বিলীন।
এরকমই কি হওয়ার কথা ছিল?
হতভম্ব ও শোকে বিহ্বল জামিল-রুবি লিমার লাশ মর্গে রাখার ব্যবস্থা করে। আগে শিশুটাকে বাঁচানোর একটা উপায় বের করে লিমার লাশের সৎকারের ব্যবস্থা করবে।
বেবিকে নিয়ে কী করবে রুবি-জামিল দম্পতি? কীভাবে বাঁচাবে? কিন্তু তাকে যে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে।
হঠাৎ রুবির মনে পড়ে প্রতিমার কথা। প্রতিমার এক বছরের একটি বাচ্চা আছে। রুবি ফোন করে লিমা ও জামিলের করুণ পরিণতির কথা সংক্ষেপে জানালে প্রতিমা কতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকে। সে ভাবছে হাসপাতাল থেকে কাউকে বাসায় ঢুকতে দেওয়া মানে যমদূতকে দাওয়াত দিয়ে বাসায় আনা। আমার পরিবারের কী হবে?
প্রতিমার নীরবতা দেখে রুবি আবার বলল, প্রতিমা, একটা কিছু বল। হয় হ্যাঁ, নয় না। এভাবে চুপ মেরে আছিস কেন? একটা কিছু বল প্রতিমা। একটা কিছু বল।
রুবি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।
রুবির কান্না শুনে প্রতিমাও স্থির থাকতে পারেনি। ভুলে যায় মৃত্যুভয়। দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, জীবনমৃত্যু ভগবানের হাতে। বেবিকে নিয়ে সোজা আমার বাসায় চলে আয়। আমার ছেলে বাঁচলে ওই বেবিও বাঁচবে।
রুবি শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে হাসপাতালের নিচে নামে, জামিল অনুগামী। অনাগত ভবিষ্যতের অসীম শূন্যতা সামনে নিয়ে ওরা ধীর পদক্ষেপে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.