বাণভট্ট

স্থাণ্বীশ্বর নগর ।

বাণভট্ট  দেখছে – শুধু চোখে-ঠোঁটে নয়, নগরের সকল অঙ্গে ছড়িয়ে আছে রেখা-রেখা আলোর হাসি। প্রশস্ত রাস্তা। মনে হয় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা একাধিক মহিষের পিঠ।

 বড় শোভাযাত্রা বেরিয়েছে। এতে নারীর সংখ্যাই বেশি। রাজবধূরা যাচ্ছেন দামি পালকিতে চড়ে। সঙ্গে পরিচারিকারা যাচ্ছে পায়ে হেঁটে। তাদের নূপুর ক্বণনে চারপাশ মুখর। পথ চলতে, ভুজলতা তোলার সময় মণিময় চুড়িগুলি কেমন চঞ্চল হয়ে উঠছে। মেঘলায় ঝিলিমিলি মাছের সাঁতার। যখন ওপর দিকে হাত তুলছে, যেন আকাশে ফোটা ফুল, বাতাস বেয়ে নিচে নেমে আসছে। এক-একটা ভিড় এসে ধাক্কা লাগছে অন্য কোনো ভিড়ের সঙ্গে। কারো কেয়ূর কারো উত্তরীয়ে লাগছে, চলায় ঘটছে সাময়িক ছন্দপতন। ঘামে ভিজে ওঠায় নারীদের প্রসাধনী অনাবশ্যক রঙিন করে তুলছে তাদের দামি পরিধেয়। শোভাযাত্রায় আছে একদল নাচের মেয়ে। তাদের সমবেত হাসি-তামাশা – যেন হেঁটে যাচ্ছে ফুলে-ভরা বাগানের হাসি। গলার হার নেচে নেচে বুকে পড়ছে। খোলা চুল স্পর্শ ছড়াচ্ছে সিঁদুরের ফোঁটায়। আবীর ও রং অনবরত উড়তে থাকায় নারীদের চুল অনেকটাই পিঙ্গল। গানের তরঙ্গ আছড়ে পড়ছে রাজপথের পরতে পরতে।

বাণভট্ট একটা চার-রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে এইসব দৃশ্য দেখছে। তার মুগ্ধতার কোনো শেষ নেই। এত দৃশ্য! এসবের মধ্যে সবথেকে কৌতুককর হচ্ছে – রাজপুরের বামন, কুব্জ, খোঁড়া এবং বোবাদের উচ্ছ্বাস। এরা বিহ্বল – নাচের পিছু পিছু যথাসাধ্য দৌড়াচ্ছে। এক হাড়চর্মসার বৃদ্ধের দশা করুণ হয়ে উঠল। কোনো নাচের মেয়ের উড়ন্ত উত্তরীয় তার গলায় আটকে গেছে। এমন বিপদ থেকে কোথায় তাকে উদ্ধার করবে, সবাই মজা কুড়াচ্ছে।

রাজকন্যাদের স্থান শোভাযাত্রার মধ্যভাগে। সেখানে নাচ-গান সংযত, গভীর, মুগ্ধকর। একদিকে ভেরী, মৃদঙ্গ, পটহ, কাহল ও শঙ্খের আওয়াজে আকাশ হেসে পড়ছে। অন্যদিকে রাজকন্যাদের গানের গরিমা এবং নিপুণ নিক্কণ নান্দনিক আবহ তৈরি করছে। শোভাযাত্রার শেষ অংশে আছে রাজার চারণ এবং বন্দিরা। তাদের মধ্যে কয়েকজন বেশ আন্দোলিত। চিৎকারে উল্লাসে এমন করছে, যেন ওরা নিজেরাই এক-একটা বিরল বাদ্যযন্ত্র। 

শোভাযাত্রা পার হয়েছে। বাণভট্ট বজ্রপোড়া গাছের মতো দাঁড়িয়ে আছে। সম্বিত ফিরলে মনে হলো – এইমাত্র সরেছে তার দীর্ঘ ঘুমের আবরণ।

রাজা হর্ষদেবের ভাই কৃষ্ণবর্ধনের ছেলে হয়েছে, আজ তার নাম রাখা হবে। নগরবাসীর কাছ থেকে এসব কথা জানার পর বাণভট্ট একটু অন্যমনস্ক। কোথায় যেন একটা রোদনরেখা পাথর ঠেলে বেরিয়ে আসছে। মনে এলো নিজের বর্তমান অবস্থার কথা। একজন এমনই ভাগ্যবান, তার জন্মের পর থেকে উৎসব আয়োজন হচ্ছে, আর সে খড়কুটোর মতো দেশ-বিদেশ ভেসে চলেছে। কার্যকলাপ দেখে লোকে তাকে বিষধর ভুজঙ্গ মনে করে। কিন্তু সে কখনো বাজে স্বভাবের নয়।

শৈশবটা খুব মনে এলো। এর পিছু পিছু এলো অনেক কথা, শাখাকথা। জন্মের ক-বছরের মাথায় বাণভট্টের মা রাজদেবী মারা যান। পিতার তখন অস্তমিত বয়স। তারপরও তাঁর স্নেহ, মমতায় ভট্টের বেঁচে থাকা বড় হয়েছে। সেই পিতাও গত হলেন। বাণভট্ট তখন চৌদ্দ বছরের যুবক। পিতার মৃত্যু ভট্টের মনে গভীর বেদনার ক্ষতচিহ্ন সৃষ্টি করেছে। ভাবনার এক অদ্ভুত কুয়াশা তাকে খুব করে পেয়ে বসেছে। মনে আলো ফোটে, তবে অস্বচ্ছ। সে কিছুটা অসংযতও। অস্থির, চপল, যথেচ্ছ। তবে পিতার রেখে যাওয়া স্নেহের আলো-ছায়াটাই তার জীবনের সারশক্তি। এই জোরেই বাণভট্ট বিগড়াল, আবার দাঁড়ালও।

ঝরা পাতার মতো উড়ে উড়ে বাণভট্টের মনে এলো তাদের প্রাসাদের মতো বাড়িটার কথা। সপ্তম শতাব্দীর গোড়ার দিকে এটি নির্মিত হয়েছিল শোন নদীর পারে। নদীটির প্রাচীন নাম হিরণ্যবাহু। বিন্ধ্য পর্বতের পাদদেশে, ভট্টের জন্মগ্রামটির নাম প্রীতিকূট। বিরাট পরিবার। অনেকের কথাই ভাবনার এক-একটা ঢেউয়ে মনে ভাসছে, আবার তলিয়েও যাচ্ছে। উড়ুপতি – বয়সে কিছুটা বড়, তার এক খুড়তুতো ভাই। সেই যুগের প্রসিদ্ধ তার্কিক। তিনি, বসুভূতি নামক এক পণ্ডিত বৌদ্ধভিক্ষুকে শাস্ত্রবিচারে পরাজিত করেছিলেন। এ-প্রসঙ্গে ভট্টের মনে এলো সম্রাট  হর্ষবর্ধনের কথা। তাঁর সঙ্গে বাণভট্টের যোগাযোগ হয়েছিল উড়ুপতির মাধ্যমে।

আজ, ভট্ট যে শোভাযাত্রার আনন্দ-কোলাহল দেখল, এটা যেন একটা ঝাঁকুনি। এই ঝাঁকুনিটাই তাকে প্রয়াত পিতার কোলে বসিয়ে দিলো। দুঃখের ভেতর থেকে মাথা তুলে থাকা কত আনন্দের স্মৃতি! সে একবার আকাশের দিকে তাকাল। মনে হলো, পূর্বপুরুষেরা তার জন্য আক্ষেপের অশ্রুপাত করছেন। একজন ব্রাহ্মণের জীবন স্বাচ্ছন্দ্যে কাটবে – এমন বিত্তবৈভব বাণভট্টের

পিতা-ঠাকুরদা রেখে গেছেন। বিদ্যাগোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ – তারও কমতি ছিল না। সব ছেড়ে ভট্ট পথকেই সঙ্গী করেছে। মনে দেশ দেখার তাড়না, মানুষ দেখার প্রেম।

বাণভট্ট পা লম্বা করে হাঁটছে। চোখে  ঝলমলে স্বপ্ন, চারপাশে তাকাবে যে, এমন সময় কোথায়! ভট্টের চিন্তা সোজা পথেই চলছিল। গতকালের শোভাযাত্রাটা সব জট পাকিয়ে দিলো। ভট্ট ভাবছে,  আচ্ছা, কুমার কৃষ্ণবর্ধনের জন্মাবার উপলক্ষে একবার তাকে আশীর্বাদ করে এলে কেমন হয়! আর আশীর্বাদ করা তো ব্রাহ্মণের ধর্ম, কর্তব্য, বৃত্তি।

একটা চাপা উত্তেজনা। সারারাত বাণভট্ট এক ফোঁটাও ঘুমায়নি। বলা তো যায় না, এই উছিলায়, রাজবাড়ির সঙ্গে তার সহজ একটা সম্পর্ক হয়েও যেতে পারে। তখন, ভাগ্য ফিরতে আর কতক্ষণ!  

সকাল থেকে শুরু হয়েছে ব্যাপক প্রস্তুতি। বাণভট্ট খুব উৎসাহ নিয়ে স্নান করেছে। সাদা যে কত বর্ণাঢ্য! ফুলের মালা, গোড়ালি-ছোঁয়া ধুতি, ঝলমলে উত্তরীয় – সবই ধবধবে সাদা। শরীরে কোনো ক্লান্তি নেই। মন যেন তুলো – ইচ্ছের হালকা বাতাসেই উড়ছে। বাণভট্ট আজ খুব-একটা শক্ত প্রতিজ্ঞা করেছে – নিজের চরিত্রগত দুর্নামগুলি চিরদিনের মতো মুছে ফেলবে।

এখন, বাণভট্টের হাঁটাটা দৌড়ে পরিণত হয়েছে। চোখ প্রায় বন্ধ। শুধু অবিশ্বাস্য নয়, অসম্ভবও – ক্ষীণ, কোমল কণ্ঠের একটি ডাক তার কানে এলো, ‘ভট্ট, ও ভট্ট, এদিকে তাকাও।’

বাণভট্টের স্বগত উচ্চারণ, ‘এদিকে! মানে কোন দিকে?’

ছোট্ট এই ধ্বনিটা ভট্টের বুকের মধ্যে সমুদ্রের বিশাল ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ল। কে! কে ডাকছে? এই সুদূর স্থাণ্বীশ্বরে তাকে চিনতে পারে, এমন কেউ আছে! ঝোড়োগতির ঘোড়াকে আলগা দিয়ে থামিয়ে দেওয়ার মতো বাণভট্ট নিজের চিন্তার রাশ টানল। পেছনে ফিরে দেখে এক উচ্ছলিত নারী, দু-হাত নাচিয়ে তাকে ডাকছে। নদী মরে গেলেও রেখা রেখে যায়। নারীটির মুখের তারুণ্য মজে গেছে, দীপ্তিচিহ্ন আছে। তার চোখ বিকেলের আলোয় সামান্য চিকচিক করছে।

নারীটি বসে আছে শিশুর ঔৎসুক্যের মতো উঁকি দিয়ে থাকা একটা পানের দোকানে। মনে হচ্ছে, পান সামান্যই বিক্রি করছে, বেশি বিক্রি করছে তার ছোট ছোট হাসি।

লোক চিনতে ভুল হয় না – এমন একটা ধারালো গর্ববোধ বাণভট্টের মনে স্থায়ী হয়ে আছে। সে হাসির মধ্যে কান্না, কান্নার মধ্যে হাসি চেনায় পাকা। কিন্তু এই নারীটির হাসি অদ্ভুত! এতে আকর্ষণ আছে, আসক্তি নেই। মোহ ডিঙিয়ে ছড়িয়ে আছে মমতার ছায়া। বাণভট্ট দোকানের কছে গেল, চেষ্টা করল নারীটিকে চেনার।

‘ভট্ট, তুমি আমাকে চিনতে পারোনি!’

আরে, এ তো নিপুণিকা!

বাণভট্ট কয়েক মুহূর্ত উন্মনা, বিমূঢ়, বিচলিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরে চিৎকার করে উঠল, ‘আরে, নিউনিয়া!’

নিউনিয়া নিপুণিকার প্রাকৃত নাম। বাণভট্ট একদিন তার প্রাকৃত রূপেই আকৃষ্ট হয়েছিল।

নিপুণিকা বড় বড় চোখ করে তাকাল। পুরনো দিনের মতোই অধিকারের ছোট্ট একটা ধমক দিয়ে বলল, ‘এত চিল্লাচ্ছ কেন! একটু মায়া করে ডাকো।’

নিপুণিকা একটা নড়বড়ে আসন ঠেলে দিলো, ‘বসো, পান তো খাও।’

বাণভট্ট বসল।

দুই

নিপুণিকা এমন এক জাতের মেয়ে,  একসময় তারা ছিল অস্পৃশ্য। সৌভাগ্যই বলা যায়, তার পূর্বপুরুষ গুপ্তসম্রাটের অধীনে কাজ করতো। সেই সুবাদে তাদের সামাজিক মর্যাদা বেড়েছিল। নিজেদের মনে করত পবিত্র বৈশ্যবংশে জন্ম।
ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়দের মধ্যে প্রচলিত প্রথাই ছিল তাদের প্রথা। পরে বন্ধ হলেও একসময় তারা বিধবা-বিয়ের সমর্থক ছিল।

নিপুণিকার বিয়ে হয় কন্দবংশের এক বৈশ্যের সঙ্গে – সে দরিদ্র অবস্থা থেকে উঠে আসা শেঠ। বছর না-ঘুরতেই নিপুণিকা বিধবা হলো। ঘরে মনে শত শূন্যতা। একসময় সে ঘর ছাড়ল।

বাণভট্ট তখন উজ্জয়িনীর বাসিন্দা। এখানে সে একটা নাটকদলের সূত্রধর। নিপুণিকা এই নাটকদলের সদস্য। আগে থেকে কিছুটা জানাশোনা থাকায় বাণভট্ট তাকে তাদের নাটকদলে নিয়ে নেয়।

সুন্দরী বলতে যা বোঝায়, নিপুণিকা এর তেমন কিছু না। অবশ্য, তার শরীরের রং শেফালি ফুলের বোঁটার সঙ্গে মিলে যায়। সৌন্দর্যের জৌলুস না-থাকলেও তার চোখ আর হাতের আঙুল যথেষ্ট আকর্ষণীয়। বাণভট্ট যে নিপুণিকাকে নাটকদলে নিল, এর বিশেষ কারণটিও তার চোখ আর আঙুলের সৌন্দর্য। নাটকে, চরিত্রের অভিব্যক্তি প্রকাশে চোখের ভূমিকাই প্রধান। আর নটীর প্রণামাঞ্জলি ও পতাকা-মুদ্রা সফল করতে সরু আঙুলের থাকে আশ্চর্য প্রভাব।

একবার, উজ্জয়িনীতে বাণভট্টের লেখা একটি প্রকরণ অভিনীত হবে। পরমভট্টারক উপস্থিত থাকার কথা। বাণভট্ট যথাশক্তি আয়োজন করেছে। শিল্পীদের শ্রেষ্ঠ কলাকৌশল প্রদর্শন ও অভিনয় যথাযথ আড়ম্বরপূর্ণ হবে, তা-ই হয়েছে।

সন্ধ্যার পরপর প্রেক্ষাগৃহে নগরীর সম্ভ্রান্ত নাগরিক এসেছেন। নাগরা বেজে উঠল। যথেষ্ট জৌলুস আড়ম্বরে বাণভট্ট পূর্বরঙ্গের নানা আচার শেষ করল। গায়ক-বাদকেরা নির্দিষ্ট জায়গায় বসে গেছে। নাচের মেয়েদের নূপুর মুখর হচ্ছে। চঞ্চল হয়ে উঠেছে বীণা বেণু মুরজ মৃদঙ্গ। বাণভট্ট ভৃঙ্গাগার ধর ও জর্জর ধরের সঙ্গে জর্জর স্থাপনার জন্য মঞ্চে এলে দর্শক-শ্রোতা নানা
ধ্বনি-উল্লাসে মুখর। জর্জর ওঠানোর পর বাণভট্ট যথেষ্ট আনন্দিত। তার ইঙ্গিতে আবারো নাগারা মুখর হলো। নিপুণিকা মঞ্চে উপস্থিত। যবনিকার পেছন থেকে বাণভট্ট তার নাচ দেখছে। বীণা বেণু মুরজের সঙ্গে কাংস্যতাল বাজছে। নিপুণিকার নূপুরক্বণন এখন আরো গভীর, আরো মগ্ন।

নিপুণিকার নাচ-গান আজ শুদ্ধতার বড় উঁচুতে পৌঁছেছে। শুধু মুগ্ধ নয়, বাণভট্ট আজ নিজেকে নিয়েও সামান্য শ্লাঘা বোধ করছে। নিপুণিকার শিল্পসত্তাটি চিনতে সে ভুল করেনি!

নিপুণিকাও আজ আনন্দিত। তার নাচ-গান, অভিনয় ভালো হয়েছে। দর্শকের উল্লাস আর সহশিল্পীদের অভিনন্দন, সব মিলিয়ে সে আজ নিজেকে নতুন করে শনাক্ত করতে পারছে। এই সাফল্যের আলো যে গভীর করে জ্বালিয়েছে তাকে তো অঞ্জলি দিতে হয়। অনেক দিনের উড়ন্ত ইচ্ছে গুরু বাণভট্টকে আলিঙ্গনে জড়িয়ে নিজের হৃদয়-উত্তাপটা তাকে বোঝাবে। নাটকে, অভিনয়ের আলিঙ্গন তো হয়ই। তেমন নয়। মন বাড়িয়ে মন ছোঁয়ার আলিঙ্গন। আজ সেই সুযোগ এসেছে।

কাঁচা বেলির মালা, দু-হাতে তুলে তীব্র আবেগে নিপুণিকা এগিয়ে গেল বাণভট্টের দিকে। বাণভট্ট মালাটি হাতে নিল, তবে কৌশলে ফিরিয়ে দিলো নিপুণিকার আলিঙ্গন-আকাক্সক্ষা। সে হাসল অর্থহীন, অনাবশ্যক এক কাঠফাটা হাসি। নিপুণিকা যথেষ্ট ধাক্কা খেল। সামলেও নিল দ্রুত।

মৃদু নূপুর-ক্বণন। সব উপহার দেবতার উদ্দেশে অর্পণ করে নিপুণিকা নেপথ্যশালায় একটা আসনে বসল। তার বসে থাকার ভঙ্গিটিও অপূর্ব – পূর্ণতা এবং শূন্যতায় ভরা। অনেকদিনের জমে ওঠা প্রশ্ন, ভুল বা শুদ্ধ হোক, একটা জবাব তো সে আজ পেয়ে গেল!

বাণভট্টের মনে বেদনার সূক্ষ্ম একটা ঢেউ, বয়ে বয়ে আবার থেমে গেছে। নিজেকে সহজে সংবরণ করা, এটা বাণভট্টের সহজাত গুণ। তার বেদনা এখন অভিমান হয়ে উঠেছে। খুব ভেজা কণ্ঠে একবার ডাকল, ‘নিউনিয়া!’

নিপুণিকা উঠে দাঁড়াল। তার বাঁ হাত কটি ছুঁয়ে আছে, শিথিল কংকন। ডান হাত শিকড়ছেঁড়া লতার মতো ঝুলছে। শরীর সামান্য বাঁকা। কপালে অহরহ ঘাম।

নিপুণিকার এলোমেলো খোঁপা থেকে একটা মল্লিকাফুল খসে পড়ল। এতে সে বিরক্ত! পায়ে পিষে মল্লিকাটিকে উপযুক্ত শাস্তি দিলো।

বাণভট্ট মধ্য-উঁচু কণ্ঠে থেমে থেমে হাসছে। নিপুণিকা নিশ্চয় তার হাসির অর্থ বুঝবে। নিপুণিকা চোখ তুলল। জলরেখা কাঁপছে। সে বাণভট্টের পাশ থেকে অদূরে সরে গেল।

সেদিন  নাটক শুরু হয়ে চলেছে টানা পাঁচ ঘণ্টা। দর্শকের উচ্ছ্বাস আর পরমভট্টারকের আনন্দপ্রসন্ন মুখ দেখে বাণভট্ট পুলকিত। পরমভট্টারক পরের দিন বাণভট্টকে রাজসভায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। ভট্ট স্পষ্টই বুঝে গেল, অনেক পুরস্কার মিলবে। সেদিনের মতো কাজ শেষ করে বাণভট্ট ঘরে ফিরে এলো।

নিপুণিকার কথা বারবার মনে আসছে। ওর কলানৈপুণ্যে আজকের অনুষ্ঠান এতটা সফল হয়েছে। আনন্দের ক্লান্তিতে চোখ একটু লেগে এসেছে। কে যেন একজন এসে খবর দিলো –  নিপুণিকাকে পাওয়া যাচ্ছে না। ধড়ফড়িয়ে উঠে বাণভট্ট নিপুণিকার সন্ধানে বেরিয়ে গেল। সারা রাত, দ্বিতীয় দিন, তৃতীয়-চতুর্থ দিন গেল, নিপুণিকার সন্ধান মেলেনি।

ভাঙা মন নিয়ে বাণভট্টের আর রাজসভায় যাওয়া হলো না। হঠাৎ ঝড়ে উপড়ে পড়া গাছের মতো বাণভট্ট অসাড় হয়ে পড়েছে। চোখের পাতা এক করলেই নিপুণিকার ভেজা চোখ ভেসে ওঠে। কী হবে নাটক করে! মানুষের প্রশংসায় কি আর মন হাসবে!? নিপুণিকা চলে যাওয়ার পাঁচ দিনের মাথায় বাণভট্ট তাদের নাটকের দল ভেঙে দিলো। তার লেখা প্রকরণটি, চোখের জলে ভিজিয়ে, ভাসিয়ে দিলো শিপ্রা নদীর স্রোতে।

সেই হতে ছয় বছর। বাণভট্ট কত দেশ, কত জনপদ ঘুরেছে। মনে ছোট্ট আশা, আহা রে, একবার যদি নিপুণিকার দেখা মিলতো!

বাণভট্ট কিছু সময়ের জন্য গভীর ভাবনায় তলিয়ে গেল। একেই বলে নিয়তি। একবার, নিপুণিকার না-থাকাটার জন্য রাজসভার পুরস্কার নেওয়া হলো না। আবার আজ, পুরস্কারের আশায়  রাজসভার দিকে যাচ্ছে, সামনে নিপুণিকা। তাকে ফেলে যাওয়া কী করে সম্ভব!

যেন ফেনার ঘূর্ণিরেখা-তোলা স্রোত, সময় যাচ্ছে। বাণভট্টের মুখে কথা আটকে আছে। অপলক দৃষ্টি। বাণভট্ট নিপুণিকাকে দেখছে। জমে আছে কত দিনের না-দেখাগুলি! নিপুণিকা পান সাজাচ্ছে। ক্ষীণবোধের লোকও ধরতে পারবে, নারীটির মনে কোনো ঝড় বয়ে চলেছে। অনেকদিন পর, পান সাজাতে ব্যস্ত নিপুণিকার শিথিল আঙুল দেখে বাণভট্টের মনে আহ্লাদের ঢেউ নেচে উঠল। নিপুণিকার ঠোঁটচাপা হাসি আর চোখে চিকন জল দেখে বাণভট্টের মনে চিনচিনে অস্থিরতা। মুখে কথা নেই। একখিলি পান সাজাতে নিপুণিকা ঘণ্টা পার করে দিচ্ছে। যখন মুখ তুলল, চোখের জল আর বাঁধ মানছে না। ঝরছে। ঝরছে। ঝরছেই। আর সম্ভব হয়নি। বাণভট্ট চিৎকার করে উঠল, ‘নিউনিয়া, কেঁদো না।’

বাণভট্টের এ উঁচু কথাও যথেষ্ট করুণ শোনাচ্ছে। নিপুণিকা ফোঁপাচ্ছে। বাণভট্ট ধড়ফড় করে ওঠে – নিপুণিকার চোখ মোছাতে এগিয়ে আসে। ততক্ষণে নিপুণিকা নিজেকে সংযত করে তুলেছে। ছদ্মরাগ করে বলল, ‘এসব কী করছ! দেখ না আমরা ভরা বাজারে বসে আছি।’

কথার প্যাঁচ কষে বাণভট্ট এখন শক্ত অবস্থানে। বলল, ‘আমি কোথায় আছি তা গ্রাহ্য করি না। আমি তোমাকে কাঁদতে দেব না। অভাগী, সেদিন তুমি পালালে কেন?’

‘কাঁদার সব আয়োজন করে এখন কান্না থামাতে চাচ্ছ! থাক এসব কথা। এখন পান খাও।’

পাখিদের মন্থর উড়ালের মতো নানা বিষয় বাণভট্টের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তার একটা অসতর্ক, অর্থহীন হাসির জন্য নিপুণিকার জীবন এমন এলোমেলো হয়ে গেল! এখনো ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। বহুদিন পর নারীটির মনের গভীর ক্ষত সারিয়ে তোলার একটা সুযোগ এসেছে। আবার ভাবে, নাকি পুরনো ক্ষত আবার রক্তাক্ত হয়ে ওঠে! ছয় বছর নারীটি কোন দুর্ভাগ্যে ডুবে আছে, এসব না জেনে বাণভট্ট তো কোথাও যেতে পারে না! আশ্চর্য এক সহানুভূতির তাড়া বাণভট্টকে ঘরছাড়া করেছে। একটা হাসির পাপ আজ চোখের জলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। আর এটাই তো সত্য, কোনো চোখের জলের দাগ মুছে দিতে প্রয়োজন অন্য কারো চক্ষুঝরা জল।

বাণভট্ট অদূরে বসে নিপুণিকার পান সাজানো আর বিক্রির ধরনটা দেখছে। যারা ক্রেতা, প্রায় সবাই বাড়তি রঙ্গ করছে। তাদের ভাষা লাগামছাড়া। কেউ কেউ ওর শরীরের দিকে আচম্বিত হাত বাড়াচ্ছে। নিপুণিকা তির্যক হাসির ছটায় তাদের এড়িয়ে থাকছে।

বাণভট্ট, সারা জীবন মনে করেছে – নারীর শরীর অজ্ঞাত কোনো দেবতার মন্দির। নিপুণিকাকে সেই ধারণাবশত দূরে রেখেছে। আজ সেই দেবমন্দির আবর্জনায় ঢেকে আছে। এই পাপ, পাঁকের স্তূপ না-সরিয়ে চলে যাবে, বাণভট্ট এতটা কাপুরুষ নয়!

লোকের গিজগিজে ভিড়টা এখন কম।  বাণভট্ট দোকানে নিপুণিকার কাছে এসে বসেছে। খুব মায়া করে জিজ্ঞেস করছে, ‘সেদিন, এমন করে চলে গেলে কেন? কোথায় কোথায় ছিলে, কী করেছ? আজ তোমাকে খুব বিষণ্ন দেখছি।’

নিপুণিকা কোনো কথা বলছে না। মুখ গুঁজে পানের খিলি সাজাচ্ছে।

বাণভট্ট আবারো বলল, ‘আমার কোন অপরাধে তুমি পালিয়েছিলে?’

এখনো নিপুণিকা নীরব। কপালে ছড়িয়ে থাকা চুল সরাতে সরাতে একবার মৃদু করে তাকাল। বাণভট্ট দেখছে, মেঘের ফাঁক থেকে উঁকি দিয়েছে একফালি সোনালি রেখার চাঁদ। বাণভট্টের ভেজা কণ্ঠ। একটু থেমে থেমে বলছে, ‘ছয়টা বছর অপরাধবোধের একটা উন্মাদ কুকুর যেন আমাকে তাড়া করছে। এখন মনে হয়, আমিই তোমার সকল দুঃখের মূল। একবার তুমি নিজের মুখে সে ‘কথা বলো।’

নিপুণিকা একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলতে থাকল, ‘হ্যাঁ ভট্ট, তুমিই আমার পালানোর কারণ। তোমার ওপর আমার মায়া এবং ভালোবাসা – দুটোই ছিল। সেই অভিনয়ের রাতে, ধরে নিয়েছিলাম, আমার জয় হবেই। কিন্তু হলো উল্টো। তুমি আমার আকাক্সক্ষার শেষ বাতিটা এক ফুঁয়ে নিবিয়ে দিলে। তোমার সেই গৎবাঁধা মুখস্থ কথা – নারীর শরীর দেবমন্দির। আহা রে নিষ্ঠুর, একবারও ভাবোনি, এই মন্দির ইট-সুরকিতে গড়া নয়। হাড়-মাংস আছে। রক্ত আছে। কামনা-বাসনা জেগে ওঠে।’

একটু থেমে নিপুণিকা আবার বলতে থাকল, ‘যখন আমার সর্বস্ব দিয়ে তোমার দিকে হাত বাড়ালাম, তুমি ফিরিয়ে দিলে। বুঝে গেলাম, জড় পাথরখণ্ডের কাছে কিছু প্রত্যাশা করা ভুল।’

‘পাষাণের ফাঁক গলে কখনো কখনো কোনো চারা মুখ তোলে। নিজে নিজে বেঁচে থাকা সেই চারা গাছ হয়, ফুলও ফোটে।’

‘তোমার নির্দয় প্রত্যাখ্যান আমি সহ্য করতে পারিনি। সব ছেড়েছুড়ে পালিয়ে এলাম। ছয়টা বছর এই কুটিল সংসারে কত অবজ্ঞা-অপমানের ভেতরে কেটেছে। সেদিন, তোমার দেওয়া আঘাতের কষ্ট কখনো ভুলতে পারিনি। অবশ্য আমি সেটা চাইওনি।

থাকুক-না আঘাতের চিহ্নটা মনের সমস্ত জুড়ে। এতে, আর কিছু না-হোক, তোমাকে তো অনুভব করা হবে।’

বাণভট্ট বিড়বিড় করে কী যেন বলছে। নিপুণিকা তা কানে তোলেনি। তার এতদিনের জমানো কথা আজ বুঝি  বিজলীরেখার মতো বারবার ঝলকে উঠছে।

‘আমার মনে যে মোহের আবরণ ছিল, তা সরে তৈরি হয়েছে ভক্তির এক সীমাহীন আকাশ। পাখি একবার উড়ে ফেললে আর সমস্যা থাকে না। পথ নিজে পাখির কাছে চলে আসে। ডানা নেই, তবু আমি উড়তে পারছি।

‘তোমাদের রেখে চলে তো এলাম। কোথায় যাব, কী করব – সব অনিশ্চিত। দেখেছি অনেক দেখা। হায় রে নারীজন্ম!
পথে-বিপথে ছড়িয়ে আছে পুরুষের লোভ আর লালসা। এসব ছুড়ে ফেলেছি। তবু পায়ে কিছু কাদা লেগেছে।

 ‘আজকাল আমি পান বিক্রি করি, ছোট রাজপরিবারের ভিতরঘরে পান পৌঁছে দিই। আমার দোকানে যারা আসে, তারা কিন্তু নারীশরীরকে দেবমন্দির মনে করে না।’

নিপুণিকার শেষ বাক্যের খোঁচাটা বাণভট্টকে কিছুটা বিষণ্ন করেছে। একটু ধাতস্থ হয়ে বলল, ‘একই খোঁটা বারবার দিচ্ছ। নারীশরীর দেবমন্দির – এই কথাটাই শুধু মনে ধরে রেখেছো। পরের কথাটা তো কখনো বলার সুযোগ পেলাম না।’

‘কী তোমার পরের কথা?’

‘সেই মন্দিরে তো অর্ঘ্য দিতে হয়!’

‘মুখ বাঁচানোর চেষ্টা করছ? এসবের আর দরকার নেই ভট্ট। আমার যা  বিধিলিপি, তা-ই হয়েছে। নদীর সঙ্গে থাকলে মানুষের মনও নদী হয়ে ওঠে – স্রোত, ঢেউয়ের নাচ-গান। আর সেই নদী বিষের হলে, মানুষ বিষের কুণ্ডই হয়। ভট্ট, তুমি এখানে বেশি সময় থেকো না। এই শহরে থাকলে হয়তো দেখা হবে।’

‘একবার দেখা যখন হয়েছে, তোমাকে এই নরকজীবনে রেখে আমি কোথাও যাব না।’

‘কী করবে?’

‘এই নগর ছেড়ে আমরা নতুন

কোথাও চলে যাব। সেখানে আমাদের অতীত কেউ জানবে না।’

‘আমি তোমার সঙ্গে কেন যাব?’

‘আমি চাইছি, তাই যাবে।’

‘খুব সাহস দেখাচ্ছ!’   

‘বাণভট্ট কখনো ভীরু ছিল না।’

নিপুণিকা ঠোঁট চেপে হাসছে। পানে খদির রাগ লাগাচ্ছে, বলছে, ‘ভট্ট, শোনো, পাগলামি করো না। আমার কোনো খেদ নেই। সামান্য হোক, রোজগারের একটা পথ আছে, একজন একটা আশ্রয় দিয়েছে। দিন কাটছে তো।’

‘আয়ের কী পথ, সে তো দেখলামই। আশ্রয়টা দিলো কে?’

‘একজন ভয়ংকর পুরুষ।’

মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লেও এতটা অবাক হতো না। নিপুণিকার শেষ

কথাটায় বাণভট্ট যথেষ্ট ম্লান হয়ে পড়ল।

‘দোকান বন্ধ করব, ভট্ট, আমি এখন উঠব। তুমি কোথায় যাবে?’

‘তোমার সঙ্গে। ভয়ংকর পুরুষটাকে দেখত চাই।’

তিন

বাণভট্ট আর নিপুণিকা নীরবে পথ চলছে। নারীবেশ বাণভট্টকে মানিয়ে গেছে। নিপুণিকা পেছনে তাকিয়ে হাসতে হাসতে ডাকল, ‘সুদক্ষিণে!’ বাণভট্ট চমকিত, নিজের দিকে তাকাল। দক্ষ ভট্টের বর্তমান নারীসংস্করণ প্রথম সম্বোধনেই গ্রহণযোগ্যতা পেল। বাণভট্ট ক্ষীণ কণ্ঠে  উত্তর দিলো, ‘হলা নিপুণিকা!’

নিপুণিকার চোখে বিকশিত পদ্মফুলের হাসি। রাজহাঁসের মতো গ্রীবা সামান্য বাঁকা করে বলল, ‘তোমার অভিনয় উত্তম হচ্ছে।’ তাকে আরো মুগ্ধ করার জন্য নারীর ব্রীড়ানত চোখের মতো করে বাণভট্ট তাকাল। তার এমন অভিনয় দেখে নিপুণিকার সারা শরীরেই যেন নাচের দোলা। বাণভট্ট নারীকণ্ঠ করে বলল, ‘হলা, লজ্জা তো নারীর  অলংকার।’

নিপুণিকা এমন কথার রসে ভিজে উঠে বলল, ‘লজ্জার এমন অভিনয় না করলেও চলবে। আজ তরুণীদের মদিরা মৃদঙ্গের উন্মত্ত বিলাসের দিন।’

নামেই ছোট রাজবাড়ি। কাছে এসে বাণভট্টের চোখ কপালে। লোহার আগলযুক্ত বিরাট কপাট। ভেতরে-বাইরে বিস্তীর্ণ এলাকায় অশোক, পুন্নাগ, অরিষ্ট, শিরীষ গাছের সারি। পাহারায় সশস্ত্র রক্ষী। এ-সব না থাকলে এলাকাটাকে  ঘন জঙ্গলই মনে হতো।

দ্বারী নিপুণাকে চেনে। সে হেসে হেসে দ্বারীর হাতে কয়েক খিলি পান গুঁজে দিয়ে বলল, ‘নাগ, খবর কী?’ দ্বারী বিগলিত। হাসতে হাসতে বলল, ‘চাঁদনীর দেখা পেলাম, এখন আর কী করে খারাপ থাকি!’

বাণভট্ট আর নিপুণিকা বিনা বাধায় ভেতরে ঢুকে গেল। কয়েকটা বাঁকের পর অন্তঃপুর। এখানে একজন দ্বাররক্ষিণী। তার হাতে খোলা তরবারি, বাম দিকে কোষবদ্ধ কৃপাণ ঝুলছে। খুব সুঠামদেহী নয়। তার ভাব-বেশ দেখে মনে হয়, চন্দন গাছে জড়িয়ে আছে একটা লিকলিকে বিষধর সাপ। বাণভট্টের বুক ধড়াস করে উঠল। তবে দ্বাররক্ষিণীর কঠিনকান্ত রূপে বাণভট্টের মনে ভয়ের থেকে কৌতূহলই বেশি এলো। তাকে অতিক্রমের সময় বাণভট্ট আঁচ করতে পারল, দ্বাররক্ষিণী মদিরার প্রভাবে আচ্ছন্ন। শিথিল বাক্যে সে নিপুণিকাকে কী যেন জিজ্ঞেস করল। উত্তর শোনার আগেই সে একদিকে সামান্য হেলে বসে পড়ল।

মূল অন্তঃপুরে ঢোকায় বাণভট্ট নিপুণিকার কোনো সমস্যা হয়নি।

মৃদঙ্গ, কাহল শঙ্খের ধ্বনি এখন যথেষ্ট স্পষ্ট। বোঝা গেল, এই পুরীতে কুমারী আর যুবতীদের আনন্দখেলার উৎসব পুরোদমে চলছে। যেতে যেতে দেখা গেল, দুই নারী দ্বিপণ্ডীখণ্ড গানের সঙ্গে তুমুল নেচে বাণভট্ট, নিপুণিকার দিকে আসছে। এদের একজন নিপুণিকার শরীর ঘেঁষে দাঁড়াল। নারীটির পা টলছে। বাণভট্ট ভয় পেয়ে উত্তরীয়র খুঁট লম্বা করে নিপুণিকার পেছনে দাঁড়াল। নারীটি জড়ানো কণ্ঠে বলল, ‘মিত্তিয়া, এই নতুন পাখি কোথা থেকে ধরে আনলে!’

নিপুণিকা ওর কথার উত্তর না দিয়ে বাণভট্টের দিকে মুখ ফেরাল। কানে কানে বলল, ‘এ ক্ষীবা।’

‘ক্ষীবা’ শব্দটির অর্থ মদ্যপায়ী নারী। বানভট্ট বুঝেছে, নারীটির নামও হয়তো নিপুণিকা। এজন্য নিপুণিকাকে সে ‘মিত্তিয়া’ সম্বোধন করছে। পরিচয় করতে নারীটি বাণভট্টের পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল। তার মুখ থেকে ভক ভক দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে। বাণভট্ট বাধ্য হয়ে অন্যদিকে মুখ ফেরাল। নিপুণিকা সুযোগ পেয়ে বলল, ‘মিত্তিয়া, ওর দোষ নিয়ো না। গ্রাম থেকে নতুন এসেছে, এখানকার ধরন-ধারণ কিছু জানে না।’

মিত্তিয়া হেসে যেন ভেঙে পড়ছে।

নিপুণিকা মিত্তিয়ার হাসির জবাবে বলল, ‘দুই দিনে শিখে নেবে। ভাই, তখন কতজন ওর চোখে চোখে নেচে বেড়াবে।’

নারীটি সখীর সঙ্গে হেসে ঢলে পা বাড়াল। প্রথমে কিছুটা ভড়কে গেলেও বাণভট্ট স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। নিপুণিকা তাকে সাহস দিয়ে বলল, ‘সব ক্ষীবা, বন্ধু, সকলেই ক্ষীবা।’

 কিছু সময় কাটিয়ে নিপুণিকা বাণভট্ট ছোট রাজবাড়ির অন্তঃপুর ছাড়াল। তখনো উৎসব-আনন্দ চলছে।

চার

সামান্য দূর হেঁটে, নিপুণিকা আর বাণভট্ট যে জায়গায় পৌঁছাল, এটা একটা দেবী মন্দিরের পাশে ছোট জরাজীর্ণ কোঠা। নিপুণিকা যথেষ্ট সতর্ক। কোঠার দরজা খুলল। গা ছমছম করা অন্ধকার। হাতড়ে হাতড়ে প্রদীপ জ্বালাল। এই সামান্য আলোয় কোঠার ভেতরটা যথেষ্ট  রহস্যময় দেখাচ্ছে। নিপুণিকা কিছু সময় এটা-ওটা কাজ করতে থাকল। একসময় বাণভট্টের কাছে এলো, আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে বলল, ‘তোমার কষ্ট হবে জানি, এর থেকে ভালো ব্যবস্থা করতে পারিনি।’

বাণভট্ট স্তব্ধ। নিপুণিকা বলতে লাগল, ‘ভাগ্য ভালো, এখানকার বৃদ্ধ পূজারিকে হাত করে এই কোঠাটি পেয়েছি।’

বাণভট্টের মনে চনমনে কৌতূহল। জানতে চায়, ‘পূজারিই কি তোমার সেই ভয়ংকর লোক?’

‘ঠিক ধরেছ। এই ভয়ংকর লোকটার জন্য আমার রক্ষা। কম লোকই এই মন্দিরে আসে। পূজারির ভয়ে কেউ আমার দিকে তাকায় না।’

‘তাহলে তো এই ভয়ংকর পূজারিকে দেখতে হয়।’

‘এ কথা মুখে এনো না। লোকটা ভয়ংকর তো বটেই, অতি অদ্ভুতও।’

‘তা কেমন?’

এরপর নিপুণিকা পূজারির একটা দীর্ঘ  বিবরণ দিলো :

পূজারি একজন বৃদ্ধ দ্রাবিড় সাধু। তার হাতের শিরাগুলি কালো, যেন গিরগিটি চড়ে আছে। সারা শরীরে অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন। বৃদ্ধ হলেও সে যথেষ্ট সৌখিন। দুই কানে রক্তজবা ঝুলিয়ে রাখে। চণ্ডী মন্দিরের চৌকাঠে ঠুকে ঠুকে কপালে উৎকট দাগ পড়ে গেছে। সে তান্ত্রিক। বৃদ্ধ তীর্থযাত্রিনীদের ওপর বশীকরণচূর্ণ ছিটিয়ে দেয়। একবার, গুপ্তস্থানের নিধি দেখার কাজল পরে একটা চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। বেঁচে যাওয়া চোখে সে চিকন শলা দিয়ে কাজল লাগাতে কখনো ভুল করে না। নিজের বিশ্রী উঁচু দাঁত সমান করতে গিয়ে কয়েকটা দাঁত হারিয়েছে। মায়া-বশীকরণে তার ঘন বিশ্বাস। তালপাতার পুথির ওপর আবির দিয়ে এক লক্ষবার ‘হুংফট্’ লেখে, সেটি সুবাসিত করে গুগ্গুল ধূপের ধোঁয়ায়। সে বিশ্বাস করে, এই পুথি দেখে যুবতীরা তার দাসী হয়ে যাবে। বানরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে একটি পা হারিয়েছে। কিন্তু দু-পায়ের জুতাই সে সংগ্রহে রাখে। লোকটি রাতকানা। এরপরও অপ্সরারা আসবে, এ-আশায় ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালিয়ে সারা রাত অপেক্ষা করে।

নিপুণিকার মুখে পূজারির এমন বর্ণনা শুনে বাণভট্ট সম্ভব-অসম্ভব নানাকিছু অনুমান করতে থাকে।

কোঠার কাছেই একটা কূপ। নিপুণিকা বালতিতে জল তুলে স্নান সেরে এলো। তেল শেষ হওয়ায় ঘরের প্রদীপ নিবে গেছে। পশ্চিম আকাশে চাঁদ হেলে আছে। জানলা খোলা পেয়ে ওর আলো ঘর ভাসিয়ে দিচ্ছে। নিপুণিকা গন্ধরাজ ফুলের মতো সাদা শাড়ি পরেছে, চুল খোলা। কপালে চন্দনফোঁটা – আর কোনো প্রসাধন নেই। এসবের মধ্যে বাণভট্টের চোখ থেমে আছে। কয়লার ভেতর থেকে যেন ঠিকরে বেরুচ্ছে পবিত্র কোনো আগুনের আলো। তার মনে পড়ল, কালিদাসের ‘মালবিকাগ্নিমিত্র’র মালবিকার কথা। বিদিশার রাজা অগ্নিমিত্র মালবিকার  কোন রূপে এমন মজে ছিল!

বাণভট্ট একটা থামে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো। নিপুণিকা বাণভট্টের কাছে এলো।

‘নিউরিনা, অর্ঘ্য দিলেই না একটা ঘর মন্দির হয়ে ওঠে।’

‘হৃদয় কামনা করে অন্য কোনো হৃদয়ের তুমুল আগুন।’

দুজনের কণ্ঠই স্বচ্ছ, ঢেউ-ঢেউ।

পাঁচ

এমন এক মুহূর্ত এলো – জগৎ-সংসারে আর কোনো দৃশ্য নেই। নরছায়া, নারীছায়া – একাকার এখন অভিন্ন ছায়ায়।