পাশ্চাত্য সাহিত্য সমালোচনা : রূপরেখা-

দ্বিতীয় কিস্তি

২. লেখক-অভিমুখী সমালোচনা :

Writer oriented criticism

২.১ জীবনকেন্দ্রিক সমালোচনা

Life-centered criticism

জীবনকেন্দ্রিক সমালোচনা সাহিত্যের আড়ালে লুকানো রচয়িতার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে ধারণা করার চেষ্টা করা হয়। এই ধরনের সমালোচনায় এই ধারণা প্রাধান্য পায় যে, লেখক বা রচয়িতার ব্যক্তিজীবনের শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, ধারণা ইত্যাদির আলোকে তাঁর সৃষ্টিকর্মের বৈশিষ্ট্য গভীর ও ভালোভাবে নিরূপণ করা চলে। বিশেষ করে গীতিকবিতার আলোচনায় এই রীতির প্রয়োগ দেখা যায় বেশি। এর কারণ গীতিকবিতায় কবির মনোজগতের প্রভাব পড়ে অনেক বেশি। এক্ষেত্রে কবিতার তাৎপর্য বুঝতে হলে কবিমানসে আলোকপাত করতে হয়।

জীবনকেন্দ্রিক সমালোচনার প্রধানত তিনটি প্রসঙ্গ বিশেষ গুরুত্ব পায়। এগুলি হলো :

১. সাহিত্যকর্ম উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে রচয়িতার  জীবনের প্রাসঙ্গিক দিকের বিবরণ;

২. সাহিত্যকর্মে নিহিত রচয়িতার ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বৈশিষ্ট্য নিরূপণ;

৩. সাহিত্যকর্মে লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও সংশ্লিষ্টতার প্রতিফলন ঘটলে তার স্বরূপ উন্মোচন।

২.২ মনোবিশ্লেষণী সমালোচনা

Psychoanalytical criticism

সাহিত্য-সমালোচনার মনোবিশ্লেষণী রীতি অস্ট্রীয় মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড ও সুইস মনোবিশ্লেষক কার্ল ইয়ুং-এর তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত। মনোবিশ্লেষণী সমালোচক সাহিত্যকর্মকে অচেতন মনের অভিব্যক্তি হিসেবে দেখেন। এই অচেতনতা ব্যক্তি লেখকের মনোজগৎ হতে পারে, হতে পারে সমাজের সমষ্টিগত অচেতনা, কিংবা হতে পারে সমগ্র মানবজাতির অচেতনা। সাম্প্রতিককালে সাহিত্যকর্ম পাঠের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণে পাঠক প্রতিক্রিয়া সমালোচনা ও চেতনারীতির সমালোচনা প্রায়শ মনোবিশ্লেষণী সমালোচনার কৌশল প্রয়োগ করছে। এক্ষেত্রে পাঠকের মনোজগতের ওপর আলোকপাত করা হয়।

ফ্রয়েড-বর্ণিত অচেতনের ধারণা এবং স্বপ্ন, অবদমন ও আদিম প্রবৃত্তির মহৎ রূপান্তর ইত্যাদি ভাবধারণার সঙ্গে শিল্পের সম্পর্কের দিকটি বিশ শতকের প্রথম কয়েকটি দশকে বিকাশ লাভ করে। এর ফলে অনেক আধুনিক সাহিত্যিক ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত হন। অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে মানুষের আচরণের মনোবিশ্লেষণ সে-সময়ে অভিব্যক্তিবাদী ও পরাবাস্তববাদী আন্দোলনের মূল ভিত্তি হয়ে ওঠে। এর প্রভাব লক্ষ করা যায় আইরিশ ঔপন্যাসিক জেমস জয়েস, ইংরেজ লেখক ডি. এইচ. লরেন্স, জার্মান সাহিত্যিক টমাস মান, মার্কিন নাট্যকার ইউজিন ও’নিল প্রমুখের রচনায়।

তবে সাহিত্য-সমালোচনায় ফ্রয়েডের তত্ত্বের অতি প্রয়োগ করতে গিয়ে কোনো কোনো সমালোচক, বিশেষ করে মনস্তত্ত্ববিদদের হাতে সাহিত্যের গুরুত্ব ছাপিয়ে মনস্তত্ত্ব প্রধান হয়ে ওঠার প্রবণতা দেখা দেয়।

মনোবিশ্লেষণী সমালোচনার ক্ষেত্রে ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের প্রয়োগকে তিনটি বর্গে ভাগ করা চলে :

১. সাহিত্যকর্মে প্রতিফলিত লেখকের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের ওপর আলোকপাতকে গুরুত্ব দেওয়া;

২. সাহিত্যে চিত্রিত চরিত্রগুলিকে এমনভাবে বিশ্লেষণ করা যেন তারা সত্যিকারের মানুষ;

৩. পাঠকের মনোজগতের আবেগ ও অনুভূতির কাছে সাহিত্যের আবেদন ও প্রভাব বিচার।

প্রথম বর্গে মুখ্য হয়ে ওঠে লেখকের জীবন। এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ মার্কিন লেখক এডগার এলান পো’কে নিয়ে লেখা ফরাসি লেখক ও মনোবিশ্লেষক মারি বোনাপার্তের গ্রন্থ দ্য লাইফ অব এডগার এলান পো : আ সাইকোঅ্যানালিটিক ইন্টারপ্রিটেশন (১৯৩৩)। সাহিত্যিক চরিত্রের মনোবিশ্লেষণের দক্ষতার পরিচয় রয়েছে ওয়েলস-এর স্নায়ু-বিশারদ আরনেস্ট জোনসের হ্যামলেট অ্যান্ড ইডিপাস (১৯৪৯) গ্রন্থে। এতে ইডিপাসের মনোজাগতিক জটিলতার আলোকে হ্যামলেটের যন্ত্রণাকে তুলে ধরা হয়েছে। পাঠকের মনোবিশ্লেষণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন মার্কিন সাহিত্য-সমালোচক নরম্যান হল্যান্ড।
এ-ধরনের প্রয়োগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়াও অনেক সমালোচক নানাভাবে ফ্রয়েডীয় তত্ত্বকে প্রয়োজনমতো কাজে লাগিয়েছেন।

কার্ল ইয়ুং-এর সমালোচনা তত্ত্ব ইয়ুংগীয় সমালোচনা (Yungian criticism) নামে পরিচিতি লাভ করেছে। এ-ধরনের
সাহিত্য-সমালোচনার ভিত্তি মনস্তত্ত্ববিদ কার্ল ইয়ুং-এর তত্ত্বগুলি। মনস্তত্ত্ববিদ সিগমুন্ড ফ্রয়েডের শিষ্য ইয়ুং পরবর্তীকালে বিশ্লেষণমূলক মনস্তত্ত্ব বিষয়ে নিজস্ব তত্ত্ব গড়ে তোলেন। এই তত্ত্ব ফ্রয়েড-এর মনোবিশ্লেষণ তত্ত্ব থেকে লক্ষণীয়ভাবে আলাদা। ফ্রয়েড ব্যক্তিগত অচেতনতা ও এর অভিব্যক্তি সম্পর্কে আলোকপাত করেছিলেন। ইয়ুং যৌথ অচেতনতার তত্ত্বকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করেছেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর দাবি, সমস্ত সংস্কৃতির মানুষই বিশ্বজনীনভাবে যৌথ অচেতনতার অংশীদার। এর মধ্যেই নিহিত থাকে জাতিবৈশিষ্ট্যগত স্মৃতি এবং আদিরূপ (আর্কিটাইপ), আদিম বাকপ্রতিমা (ইমেজ) ও ধাঁচ (প্যাটার্ন), যা সেই আদিকাল থেকে মানুষের অভিজ্ঞতার উপাদানকে প্রতিফলিত করে আসছে।

ফ্রয়েডের মতোই ইয়ুং তাঁর মনোবিশ্লেষণী তত্ত্বকে সাহিত্যে প্রয়োগ করেন। তিনি এই অভিমত তুলে ধরেন যে, সাহিত্যকর্মে প্রতিফলিত আদিপ্রতিমা ও জাতিবৈশিষ্ট্যগত স্মৃতির মধ্যে যৌথ অচেতনতা নিহিত থাকে। যেসব সাহিত্যিক মানব মনোলোকের মৌল ভিত্তিভূমিতে করাঘাত করতে পারেন এবং তাকে পাঠকের কাছে তুলে ধরতে পারেন, তাঁরাই মহৎ সাহিত্যিক হয়ে ওঠেন। যেসব সাহিত্যকর্ম ধ্রুপদী রূপ নিয়েছে সেগুলির আবেদন বিশ্বজনীন। এগুলির বিশ্বজনীনতার মূলে এই সত্য প্রতীয়মান যে, সেগুলি সমষ্টিগত অচেতনাকে তেমনিভাবে কাজে লাগায়, যেমন করে মিথ স্বতন্ত্র সংস্কৃতিকে ছাপিয়ে ওঠে। ইয়ুংগীয় সমালোচনা ব্যাপকভাবে মিথাশ্রিত সমালোচনা ও আদিরূপগত সমালোচনাকে প্রভাবিত করেছে।

মনোবিশ্লেষণী সমালোচনায় নিম্নলিখিত দিকগুলি বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে :

১. কাহিনির চরিত্রগুলির সংলাপ, আচরণ, চিন্তাধারা ইত্যাদিতে সংশ্লিষ্ট মনস্তাত্ত্বিক উপাদান ও শক্তির পরিচিতি প্রদান;

২. সাহিত্যকর্মের চরিত্রে মনস্তাত্ত্বিক অসংগতি সৃষ্টিতে স্বপ্নের ভূমিকা নিরূপণ;

৩. সাহিত্যকর্মে লেখকের অভিজ্ঞতা ও মনস্তত্ত্বের প্রতিফলনের স্বরপ উন্মোচন।

২.৩ প্রকাশবাদী বা অভিব্যক্তিবাদী সমালোচনা

Expressive criticism

এ-ধরনের সমালোচনা সাহিত্যকর্মকে শিল্পকর্ম হিসেবে কিংবা পাঠকে প্রতিক্রিয়া হিসেবে আলোকপাত করার চেয়ে লেখকের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের অভিব্যক্তি হিসেবে বিচার করায় প্রয়াসী। ইংরেজি সাহিত্যে এর উদ্ভব রোমান্টিক সমালোচক স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজের হাতে। ইংরেজ কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের সমালোচনারীতির বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতে গিয়ে এম এইচ আব্রাম এ-সংজ্ঞার্থটি ব্যবহার করেছেন। আব্রাম এদের কথার রেশ ধরে বলেছেন, এ-ধরনের সমালোচনা সাহিত্যকর্মকে দেখে আবেগ বা অনুভূতির উচ্ছ্বাসের প্রগাঢ় অভিব্যক্তি হিসেবে। তা সাহিত্যকর্মে প্রতিফলিত লেখকের স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি, মানসিক অবস্থা, বাস্তব অভিজ্ঞতা, মেজাজের স্বাতন্ত্র্য, সৃষ্টির মৌলিকত্ব ইত্যাদি সন্ধানে সচেষ্ট হয়। অভিব্যক্তিবাদী সমালোচনাকে সাম্প্রতিককালে কাজে লাগানো হচ্ছে মনোবিশ্লেষণী ও চেতনাবাদী সমালোচনার ক্ষেত্রে।

২.৪ অস্তিত্ববাদী সমালোচনা

Existential criticism

অস্তিত্ববাদী সমালোচনায় সাহিত্যকে ব্যাখ্যা করা হয় অস্তিত্ববাদী দর্শনের আলোকে। সাহিত্য-সমালোচনার এই আধুনিক ঘরানার সঙ্গে ফরাসি নাট্যকার জাঁ পল সার্ত্রের নাম বিশেষভাবে জড়িত। এ-ধরনের সমালোচনা রীতিতে প্রচলিত
সমালোচনা-জিজ্ঞাসাকে উপেক্ষা করা হয়। এর পরিবর্তে অস্তিত্ববাদী দর্শনের আলোয় সাহিত্যকে বিচার করা হয়। এই অস্তিত্ববাদী দার্শনিক তত্ত্ব সত্তার ওপরে অস্তিত্বকে, পছন্দের ক্ষেত্রে স্বাধীন ইচ্ছাকে এবং অর্থহীন জগতের মুখোমুখি উৎকণ্ঠাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে।

অস্তিত্ববাদী দর্শনের মূল কথা হচ্ছে, প্রত্যেকের নিজের কাজের জন্য তার আপন ব্যক্তিসত্তাই দায়ী; ভাগ্য, নিয়তি, বা কোনো সামাজিক ব্যবস্থা নিরঙ্কুশভাবে মানুষের কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রক নয়। অস্তিত্ববাদী সমালোচনা এই যুক্তিকে প্রাধান্য দেয় যে, প্রতিটি ব্যক্তি আপন আপন অস্তিত্বের নির্মাতা। এদিক থেকে অস্তিত্ববাদীরা বিশেষভাবে আত্মকেন্দ্রিক।

অস্তিত্ববাদের মতে, নিজের ব্যক্তিসত্তা গড়ে তোলার প্রক্রিয়াটি উদ্বেগ ও ভোগান্তিতে পরিপূর্ণ হলেও নিজের স্বাধীন ইচ্ছা অনুযায়ী জীবন যাপন করতে হলে এ থেকে পরিত্রাণ নেই।

অস্তিত্ববাদী সমালোচনায় সাহিত্যকর্মের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে প্রতিকূল ও সহানুভূতিহীন সমাজে থাকা বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিসত্তার সংগ্রামকে তুলে ধরা হয়।

দিনেমার দার্শনিক সোরেন কিয়ের্কগার্ডকে অস্তিত্ববাদের জনক বলে গণ্য করা হয়। জার্মান দার্শনিক ফ্রিডরিখ নিৎশে, ফরাসি নাট্যকার জাঁ পল সার্ত্র, জার্মান দার্শনিক মার্টিন হাইডেগার, ফরাসি দার্শনিক আলবেয়ার কাম্যু প্রমুখ অস্তিত্ববাদী দার্শনিক হিসেবে সুপরিচিত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অস্তিত্ববাদী সমালোচকেরা প্রধানত দুটি ধারায় বিভক্ত হয়। একদল কিয়ের্কগার্ডের অনুসারী হন। অন্যদল হাইডেগার ও সার্ত্রের পক্ষ নেন। অস্তিত্ববাদী দর্শনের প্রধান লেখকদের মধ্যে রয়েছেন আলবেয়ার কাম্যু ও ফ্রাঞ্জ কাফকা। এছাড়া হাঙ্গেরীয় সাহিত্য-সমালোচক মার্টিন এসলিন অস্তিত্ববাদী সাহিত্য-সমালোচনার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য নাম।

২.৫ নৈতিকতাবাদী সমালোচনা

Moral criticism

এ-ধরনের সাহিত্য-সমালোচনায় সাহিত্যকর্মকে মূল্যায়ন করা হয় তাতে বিধৃত নৈতিক উপাদানের এবং ওই সময়ে গৃহীত নৈতিক মানদণ্ডের সঙ্গে কিংবা যে মূলনীতি দ্বারা মানবসমাজ চালিত হওয়া উচিত বলে সমালোচক মনে করেন তার সঙ্গে সাহিত্যকর্মে বর্ণিত নৈতিকতার সংগতি নিরূপণের ভিত্তিতে। আদর্শগতভাবে নৈতিক সমালোচক সাহিত্যকর্ম বিচারকালে সেই নৈতিক মানদণ্ডকেই প্রয়োগ করেন যেগুলি সাহিত্যকর্মে উপস্থাপিত হয়েছে। এর ব্যতিক্রম ঘটলে তিনি পাঠকের কাছে নিজের আপন বিশ্বাসকে স্পষ্ট করে তুলে ধরেন। নৈতিক সমালোচনার লক্ষ্য হচ্ছে নৈতিক শিক্ষার আলোকে সাহিত্যের মান বিচার। নৈতিক মানসম্মত হলে তার প্রশংসা আর না হলে তার নিন্দা।

প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লাতো (Plato) এই মত পোষণ করতেন যে, সাহিত্য (এবং শিল্প) নানাভাবে মানুষকে নীতিভ্রষ্ট বা প্রভাবিত করতে পারে। আরিস্তোতল ও হোরেসও বিশ্বাস করতেন যে, সাহিত্যকর্মের ভাববস্তু, বিষয়বস্তু ও চরিত্র মানুষের নীতিচ্যুতি ঘটাতে পারে। পরবর্তীকালে ইংরেজ লেখক স্যামুয়েল জনসন ও ইংরেজ কবি ম্যাথু আর্নল্ড এই ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হন। তাঁরা সাহিত্যকে নীতিশিক্ষা ও দার্শনিক চিন্তা প্রচারের মাধ্যম হিসেবে গণ্য করেন। এভাবেই সাহিত্যের নৈতিক ও ব্যবহারিক উপযোগিতার বিষয়টি বিবেচিত হতে থাকে।

অন্যদিকে, আধুনিকতা-উত্তর নৈতিক সমালোচনা দেখাতে চেষ্টা করে কোনো সাহিত্যকর্ম কীভাবে পাঠককে প্রভাবিত করে। এভাবে নৈতিক সমালোচনায় নব্য-মানবতাবাদী দার্শনিক ভাবধারার আবির্ভাব ঘটে, যা নৈতিকতা বিচারে উদ্যোগী হয়। ফলে, এই বিবেচনায় সাহিত্যে নৈতিক অবক্ষয় বা অধঃপতনের উপস্থাপনা ঘটলে তাকে মন্দ হিসেবে গণ্য করা হতে থাকে। আমেরিকান প্রাবন্ধিক ও সমালোচক পল এলমার মোর-এর মতে, ‘সাহিত্যকর্মের নৈতিক প্রবণতা নির্ধারণ এবং তার ভিত্তিতে সাহিত্যকর্ম বিচার সমালোচকের কাজ।’

নৈতিকতাবাদী সাহিত্য-সমালোচনায় সমালোচক কিছু দিক বিবেচনা করেন। যেমন,

১. সাহিত্যকর্মে রচয়িতার পরিপক্বতা, আন্তরিকতা, সততা, সংবেদনশীলতার ছাপ কতটুকু?

২. সাহিত্যকর্মটি পাঠককে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত বা নীতিভ্রষ্ট করে কি না?

৩. আখ্যান, ভাববস্তু বা চরিত্রের মাধ্যমে সাহিত্যকর্মটি কী ধরনের নৈতিক শিক্ষা দেয় ইত্যাদি।

৩. প্রসঙ্গ-অভিমুখী সমালোচনা

Contextual criticism

সাহিত্য-সমালোচনার এই ধারায় পাঠ (text) ও প্রসঙ্গ (context) বিচার করা হয়। প্রসঙ্গ-অভিমুখী

সাহিত্য-সমালোচনায় সাহিত্যকর্মের উৎস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উপাদানগুলি আলোচনা ও বিশ্লেষণ করা হয়।
প্রসঙ্গ-অভিমুখী সমালোচনা নব্য সমালোচনার বৈপ্লবিক শাখা। তা এর বর্তমান রূপের অন্তর্নিহিত দৃষ্টিভঙ্গি ও মৌলিক বিশ্লেষণপদ্ধতিকে যুক্ত ও পরিমার্জিত করেছে।

কলোম্বীয়-আমেরিকান দার্শনিক ও সাহিত্যতাত্ত্বিক এলিসেও ভিভাস এবং আমেরিকান সাহিত্য-সমালোচক মারে ক্রিগার সমালোচনার এই রীতি-পদ্ধতির সংজ্ঞার্থ ও রূপদান করেছেন। তা স্বতন্ত্র পাঠের ঘনিষ্ঠ পঠনের ওপর জোর দেয় এবং সেগুলির অভ্যন্তরীণ গঠনকাঠামো ও নান্দনিক প্রভাবের ওপর ভিত্তি করে পাঠের মূল্যায়ন করে। অবশ্য ষাটের দশকের শেষ দিকে প্রসঙ্গনির্ভর সমালোচনার জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। তবে এর কিছু কিছু ভাব-ধারণা, সমালোচনা ও বিশ্লেষণী পদ্ধতি ইত্যাদি সমালোচনামূলক দৃষ্টিকোণ এখনো বিদ্যমান। যেমন, বিনির্মাণবাদী সমালোচনা।

৩.১ অনুকরণবাদী সমালোচনা

Mimetic criticism

এ-ধরনের সাহিত্য-সমালোচনা সাহিত্যকর্মে বর্ণিত জগৎ, জীবন ও চরিত্রের বাস্তবতাকে ‘সত্যে’র আলোকে বিচার করে। সাহিত্য-সমালোচনার এই দৃষ্টিকোণ থেকে স্বতন্ত্র সাহিত্যকর্মকে দেখা হয় তাতে প্রতিফলিত জগৎ, মানবজীবন ও  
মানব-চরিত্রের বাস্তব প্রতিফলন কতটা সত্য তার নিরিখে। এই রীতির প্রবর্তক প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লাতো (প্লেটো)। সাহিত্যের ওপর প্লাতোর আক্রমণকে কেন্দ্র করে অনুকরণবাদী সমালোচনার সূত্রপাত। আরিস্তোতল (অ্যারিস্টটল) একে কাজে লাগিয়েছেন সাহিত্যের পক্ষে অবস্থান নিতে। তাঁর সময় থেকে অনুকরণ সাহিত্য ও নান্দনিক তত্ত্বের ক্ষেত্রে একটি কেন্দ্রীয় সংজ্ঞার্থ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। অনুকরণমূলক সমালোচনা সাধারণত এই জোরালো মতানুসারী যে, সাহিত্যকর্ম বাস্তবতার প্রতিফলন। এই রীতিতে সাহিত্য মূল্যায়নের মূল লক্ষ্য হলো, সাহিত্য জীবন ও জগৎকে সম্যক ও যথাযথভাবে প্রতিফলিত করেছে কি না। এক্ষেত্রে প্রতিফলনকে হতে হবে ‘সত্য’। এই দৃষ্টিভঙ্গিরই অধিকতর আধুনিক রূপশ্রেণি বস্তুনিষ্ঠ বা বাস্তবতাবাদী সমালোচনা।

৩.২ মিথাশ্রয়ী বা আদিরূপগত সমালোচনা

Mythic criticism

এ-ধরনের সাহিত্য-সমালোচনা সাহিত্যকর্মে ব্যবহৃত মিথ বা আদিরূপগত বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য আবিষ্কার করে। তাই এটি আদিরূপগত ধাঁচের আলোকে সাহিত্যবিচারের রীতি হিসেবে গণ্য। আদিরূপগত ধাঁচের উদাহরণ হিসেবে বলা যায় : জীবনের স্তর (যৌবনপ্রাপ্তি), চরিত্রবৈশিষ্ট্য (সন্দেহপ্রবণ প্রেমিক), প্লটের ধাঁচ (তরুণীর সঙ্গে তরুণের পরিচয় – তরুণের প্রেম নিবেদন – তরুণীর প্রত্যাখ্যান – তরুণীর মন জয় করে তরুণ), চিত্রকল্প ও প্রতীক (বিয়ের প্রতীক হিসেবে মালাবদল), থিম বা ভাববস্তু (জাগতিক আকাক্সক্ষা ও মানবভাগ্যের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব) ইত্যাদি। এ-ধরনের সমালোচনায়  আদিরূপগত এই সব ধাঁচের আলোয় কোনো সাহিত্যকর্মকে একই ধরনের অন্যান্য সাহিত্যকর্মের প্রেক্ষাপটে বর্ণনা, ব্যাখ্যা বা মূল্যায়ন করা হয়।

এই রীতির সমালোচনার উদ্ভব ত্রিশের দশকে। এ সমালোচনা রীতির শুরু বিশ্লেষণমূলক মনস্তÍত্ত্ববিদ কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং-এর সমষ্টিগত অচেতনা তত্ত্ব থেকে। ইয়ুং এই তত্ত্ব হাজির করেন যে, মানবজাতির মধ্যে একটা সামষ্টিক অচেতনা বিদ্যমান। তা আদিপ্রতিমার (আর্কিটাইপ) মাধ্যমে স্বপ্ন, পুরাণ (মিথ) ও সাহিত্যে অভিব্যক্ত হয়ে থাকে।

ক্যামব্রিজ বিশ^বিদ্যালয়ের একদল নৃতত্ত্ববিদের অধ্যয়ন দ্বারাও আদিরূপগত সমালোচনা প্রভাবিত হয়। এঁরা দেখান যে, কোনো কোনো মিথ বা আচারানুষ্ঠান বিভিন্ন সংস্কৃতিতে পুনরাবৃত্ত হয়ে থাকে।

ইংরেজ সাহিত্য-সমালোচক মোড বডকিনের আর্কিটাইপিক্যাল প্যাটার্ন ইন পোয়েট্রি (১৯৩৪) দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়ে পরবর্তীকালে আদিরূপগত সমালোচনা বিকশিত হয়। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তা প্রাধান্য বিস্তারকারী সমালোচনার ধারায় রূপ নেয়। প্রভাবশালী লেখক ও সাহিত্য-সমালোচক নরথ্রপ ফ্রাই তাঁর অ্যানাটমি অব ক্রিটিসিজম (১৯৫৭) গ্রন্থে আদিরূপগত সমালোচনাকে অনুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা ও পরিশীলিত করেন। আদিরূপগত সমালোচনার সঙ্গে বাইবেলের টাইপোলোজিক্যাল ব্যাখ্যা এবং স্বপ্নবিলাসী উইলিয়াম ব্লেকের কল্পনার ধারণাকে যুক্ত করে ফ্রাই সাহিত্য-সমালোচনা ও তত্ত্বের প্রচলিত ধারাকে চ্যালেঞ্জ করেন। তিনি চারটি সুঃযড়র (প্লটের ধরন)-এর অস্তিত্বের উল্লেখ করেন যেগুলি সাহিত্যের প্রধান চারটি রূপশ্রেণির ভিত্তি। পাশ্চাত্যের চারটি প্রধান ঋতুর এক-একটির সঙ্গে এগুলির আদিরূপগত অনুষঙ্গ রয়েছে। যেমন : কমেডি (বসন্ত), রোমান্স (গ্রীষ্ম), ট্র্যাজেডি (বর্ষা), প্রহসন (শীত)। স্বতন্ত্র সাহিত্যকর্মে অবশ্য অন্যান্য আদিপ্রতিমা থাকতে পারে।

৩.৩ ঐতিহাসিক সমালোচনা

Historical criticism

সাহিত্য-সমালোচনামূলক এই পদ্ধতিতে সাহিত্যকর্মের সমকালীন ঐতিহাসিক সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরা হয়। এ-ধরনের সাহিত্য-সমালোচনা সাহিত্যকর্মকে বিচার করে যে কালপর্বে সেটি রচিত হয়েছিল সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে। ঐতিহাসিক সমালোচক সাহিত্যকর্মের রচয়িতার কালের ভাবধারণা, বিশ্বাস এবং সামাজিক-সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ইত্যাদির কালিক আবহ পুনর্নির্মাণ করতে চান। ঐতিহাসিক সমালোচক সাহিত্যকর্মকে ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবেও দেখে থাকেন। এর ফলে যে সময়ে তা রচিত হয় সেই কালের ছবি আমাদের মনের চোখে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। এই পদ্ধতিতে সাহিত্যকর্ম মূল্যায়নে ফরাসি সাহিত্য-সমালোচক হিপ্পোলাইত তেইন তাঁর হিস্টি অব ইংলিশ লিটারেচার (১৮৬৪) গ্রন্থে জাতি, দেশ, কালের প্রভাব সন্ধান করেছিলেন। 

ঐতিহাসিক সমালোচনা পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। সেজন্যে বিদ্যায়তনিক পণ্ডিতরা এটা পছন্দ করেন। যাঁরা সাহিত্যকে যুগবৈশিষ্ট্য প্রকাশক লক্ষণ হিসেবে দেখেন ঐতিহাসিক সমালোচনা তাঁদের কাছে প্রকাশবাদী বা অভিব্যক্তিবাদী সমালোচনার সম্প্রসারণ ও ব্যাপ্তি হিসেবে বিবেচ্য। এ ধরনের সমালোচনায় লেখকজীবনী কখনো কখনো সমালোচকের বিবেচনা পায়।

ঐতিহাসিক সমালোচনায় কয়েকটি প্রসঙ্গ বিশেষ গুরুত্ব পায়। সেগুলি হলো :

১. সাহিত্যকর্মে প্রতিফলিত ঐতিহাসিক পর্ব বা ঘটনার যথাযথতা বিচার;

২. যে ঐতিহাসিক পর্ব বা ঘটনা লেখককে প্রভাবিত করেছে তার বিবরণ;

৩. সাহিত্যকর্মে বর্ণিত ঐতিহাসিক প্রসঙ্গ সংশ্লিষ্ট রচনার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা মূল্যায়ন;

৪. সাহিত্যকর্মে বর্ণিত ইতিহাসের মাধ্যমে তৎকালিক সময় ও সংস্কৃতির যে প্রতিফলন ঘটেছে তার স্বরূপ নির্ণয়।

নব্য সমালোচনার যুগে ঐতিহাসিক সমালোচনার গুরুত্ব হ্রাস পায়। এর কারণ, নব্য সমালোচকদের ধারণা, ঐতিহাসিক ঐক্য সাহিত্যকে ইতিহাসের স্তরে নামিয়ে আনে। তবে ঐতিহাসিক সমালোচনা পুনরুভ্যুদয়ের অভিজ্ঞতা লাভ করেছে মার্কসবাদী রূপে।

৩.৪ মার্কসবাদী সমালোচনা

Marxist criticism

মার্কসবাদী সাহিত্য-সমালোচনায় সাহিত্যকর্মকে নিরূপণ করা হয় জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্কস, ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস এবং তাঁদের উত্তরসূরিদের তত্ত্বের প্রয়োগ ঘটিয়ে – এই তত্ত্বের মূল প্রতিপাদ্য। শ্রেণি-শোষণের ভিত্তি হচ্ছে উদ্বৃত্তমূল্য, সব সামাজিক প্রাতিষ্ঠানিক কাজের নির্ধারক অর্থনীতি, ইতিহাসের মৌলিক প্রক্রিয়া হলো শ্রেণিসংগ্রাম আর শ্রেণিসংগ্রাম ও বিপ্লবের মাধ্যমে সর্বহারাদের ক্ষমতা দখল ও শ্রেণিহীন সমাজ গঠন হচ্ছে ইতিহাসের নিয়তি। এই ধারায় সমালোচকদের মতে, সাহিত্যকে বুঝতে হবে সমাজের নির্ধারক শক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত করে। এগুলির মধ্যে রয়েছে ইতিহাস, অর্থনীতি, শ্রেণি ও ভাবাদর্শ। এভাবে মার্কসবাদী সমালোচকেরা দুটি প্রধান ভূমিকা পালন করেন : প্রথমত, সাহিত্যের সঙ্গে সমাজের অন্তর্নিহিত সম্পর্ক উন্মোচন এবং দ্বিতীয়ত, সেই ধরনের সাহিত্যের পক্ষে ব্যবস্থাপত্র দেওয়া যা বিপ্লবের স্বার্থে কাজে আসবে। অবশ্য সাম্প্রতিককালে বহু মার্কসবাদী সমালোচক দ্বিতীয়টি বিবেচনা করেন না।

মার্কসবাদী সাহিত্য-সমালোচনার বিপ্লব অভিমুখী একটি সূত্রায়ন হচ্ছে, সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাবাদের (socialist realism) তত্ত্ব। তা সোভিয়েত ইউনিয়নে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সমালোচনার কট্টর নীতি হিসেবে গৃহীত হয়। স্তালিনের সময়ে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাবাদ বহুলাংশে নিয়ন্ত্রক ভূমিকা পালন করে। তবে জার্মান নাট্যকার বের্টল্ট ব্রেখটের এপিক থিয়েটারে ব্যবহৃত বিচ্ছিন্নতার তত্ত্বে তা তাত্ত্বিকভাবে গৃহীত হয়। একই বিষয় লক্ষ করা যায় উনিশ শতকের উপন্যাস সমালোচনায় হাঙ্গেরীয় সমালোচক গেয়র্গ লুকাসের সমালোচনা রীতিতে।

ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে ফ্রাংকফুর্ট বিদ্যাশাখা মার্কসবাদী সমালোচনাকে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাবাদে সংকুচিত করার প্রয়াসকে প্রত্যাখ্যান করে। আধুনিকতাবাদী ও নিরীক্ষামূলক শিল্পরূপের পক্ষাবলম্বন করে (কমিউনিস্টরা তখন একে অবক্ষয়ী বলে অবজ্ঞা করেন)। এই বিদ্যাধারার মার্কসবাদী সমালোচকেরা পুঁজিবাদের সর্বগ্রাসী পদ্ধতিসহ আভাঁ গার্দকে (Avant-Garde) সর্বগ্রাসিতার বিরুদ্ধ শক্তি হিসেবে গণ্য করেন। তাঁরা বিচ্ছিন্নতা ও হতাশাকে আধুনিক সমাজের বাস্তবতা হিসেবে বর্ণনা করেন। আপাতদৃষ্টিতে রাজনীতি-উদাসীন লেখক যেমন স্যামুয়েল বেকেট আধুনিক পুঁজিবাদী  সংস্কৃতির কেন্দ্রে যে শূন্যতা রয়েছে তা তুলে ধরেন।

ষাটের দশকে অবয়ববাদের আবির্ভাবের পর তা মার্কসবাদী সমালোচনায় ব্যাপক প্রভাব ফেলে। অবয়ববাদী ও মার্কসবাদীরা এই বিশ্বাসে অংশ নেন যে, মুক্ত ব্যক্তিত্বের ধারণা নিতান্তই কল্পকথা। কারণ তা সেই পদ্ধতিকে আড়াল করে রাখে যা ব্যক্তির চিন্তা ও আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। মার্কসবাদ ও অবয়ববাদের একীভবনের প্রথম দিককার উদাহরণ হচ্ছে ফরাসি তাত্ত্বিক লুই আলথুসার। ভাবাদর্শগত রাষ্ট্রযন্ত্র সম্পর্কে তাঁর ধারণায় এই যুক্তি প্রদর্শন করা হয়েছে যে, ভাবাদর্শ কেবল একগুচ্ছ ভাবধারণা নয়, বরং তা সামাজিক রীতি-পদ্ধতি, যাতে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা অন্তর্ভুক্ত। এসবই ব্যক্তির সত্তাকে গড়ে তোলে।

ইংরেজ মার্কসবাদী তাত্ত্বিক টেরি ইগলটনের মতে, সমালোচনার কাজ হচ্ছে সাহিত্যকর্মের গভীরে গিয়ে আপাত সঙ্গতির অন্তরালের অসঙ্গতি ও বৈপরীত্য উন্মোচন করা। এবং এভাবে মুক্তমনে বিনির্মিত চরিত্র উন্মোচন করা। সাহিত্যের পাঠের বাহ্যিক ঐক্যভূত অবস্থা এক্ষেত্রে ভাবাদর্শের প্রতিভূ হিসেবে কাজ করে। ভঙ্গুর, কেন্দ্রবিচ্যুৎ মর্মস্থলে তা ভাবাদর্শকে ধ্বংস করে দেয়।

মার্কসবাদী চিন্তাধারার ওপর অবয়ববাদী প্রভাব বিচার করা হয়েছে মার্কিন সাহিত্য-সমালোচক ফ্রিডরিক জেমসনের দ্য প্রিজন হাউস অব ল্যাংগুয়েজ (১৯৮২) গ্রন্থে। তাতে যুক্তি উত্থাপন করে দেখানো হয়েছে যে, অবয়ববাদী মডেলের ঘাটতি নিহিত সমাজ-বাস্তবতার ইতিহাস-উদাসীন বিশ্লেষণে। দ্য পলিটিক্যাল আনকনসাস (১৯৮১) গ্রন্থে জেমসন মার্কসীয় কাঠামোতে
উত্তর-অবয়ববাদী ও প্রচলিত সমালোচনার ধারাকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। জেমসনের বিবিধগ্রাহী দৃষ্টিভঙ্গি মার্কসবাদী সমালোচনার স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য হয়েছে। এর কারণ তিনি সাংস্কৃতিক বিদ্যা, নারীবাদী সমালোচনা, মনোবিশ্লেষণী সমালোচনা, উত্তর-অবয়ববাদ ইত্যাদি ঘরানার সঙ্গে স্থিতাবস্থা বজায় রেখে মার্কসবাদী সমালোচনাকে যুক্ত করেছেন। তাঁর সমালোচনা রীতিকে ইগলটন অভিহিত করেছেন ‘রাজনৈতিক সমালোচনা’ বলে।

সমসাময়িক মার্কসবাদী সমালোচনার উল্লেখযোগ্য নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে : লুই আলথুসেরের আইডোলোজিক্যাল স্টেট আ্যাপারেটাস (১৯৭০) ও লেনিন অ্যান্ড ফিলোজফি অ্যান্ড আদার এসেজ (১৯৬৮), ফ্রিডরিক জেমসনের মার্কসিজম অ্যান্ড ফর্ম (১৯৭১), টেরি ইগলটনের মার্কসিজম অ্যান্ড লিটারারি ক্রিটিসিজম (১৯৭৬) ও লিটারারি থিওরি (১৯৮৩), গেয়র্গ লুকাসের দ্য হিস্টোরিক্যাল নভেল (১৯৮১) ইত্যাদি।

৩.৫ নারীবাদী সমালোচনা

Feminist criticism

নারীবাদী সমালোচনা হচ্ছে, সাহিত্য বিচারে নারীবাদী তত্ত্বের প্রয়োগ যার কেন্দ্রীভূত ধারণা-মৌল হচ্ছে : পুরুষ শাসিত ও নিয়ন্ত্রিত সমাজের পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো। এ-ধরনের সমালোচনা  সাধারণভাবে নারীবাদী সামাজিক, রাজনৈতিক লক্ষ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। সাহিত্যে নারীর রূপায়ণ এবং সমাজে নারীর পরিবর্তিত অবস্থানের প্রেক্ষাপটে সাহিত্য বিচার করতে গিয়ে এবং সমসাময়িক বিশে^ নারীর সম-অধিকার ও ক্ষমতায়নের বৃহত্তর আন্দোলনের অংশ হিসেবে নারীবাদী সমালোচনার উদ্ভব। সাহিত্যকর্মে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে নারীবাদী সমালোচনা লিঙ্গবৈষম্যের ওপর প্রধানত গুরুত্ব আরোপ করে।

নারীবাদী সাহিত্য-সমালোচনা বহুমুখী ও বিচিত্র ধারায় প্রবাহিত। বিশ্লেষণের বিষয়বস্তু, পদ্ধতি, লক্ষ্য ইত্যাদির ভিত্তিতে তা নানা ধারায় বিকশিত হয়েছে। এক্ষেত্রে তর্ক-বিতর্কও হচ্ছে প্রচুর। তবে সাধারণভাবে নারীবাদী সমালোচনার মুখ্য বিবেচ্য দিকগুলিকে এভাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে :

১. নারী লেখকদের সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার ও পুনর্মূল্যায়ন;

২. পুরুষ লেখকদের হাতে অঙ্কিত নারীর ভাবমূর্তি প্রতিফলনের ধরন পর্যালোচনা এবং নারী সম্পর্কে পুরুষ লেখকদের দৃষ্টিভঙ্গি মূল্যায়ন;

৩. সাহিত্যে নারীর চরিত্র ও অবস্থা প্রতিফলনে নারী লেখকদের ভূমিকা;

৪. সাহিত্যে যেসব ক্ষেত্রে নারীর প্রাধান্য দেখা যায় সেসব ক্ষেত্রে প্রাধান্যের কারণ ও তাৎপর্য বিচার;

৫. নারী চরিত্র সমালোচনায় পুরুষদের উদ্ভাবিত সমালোচনা পদ্ধতি ও সমালোচকদের দৃষ্টিভঙ্গির মূল্যায়ন;

৬. যৌনবাদ বিশ্লেষণ ও ভাষায় লিঙ্গ-সুবিধার প্রকৃতি বিচার;

৭. নারী সচেতনতার দৃষ্টিকোণ থেকে সাহিত্য-সমালোচনার রূপ বিকশিত করা;

৮. পাঠিকা হিসেবে নারীর পছন্দ ও ভূমিকার মনস্তাত্ত্বিক বিচার (এ-ধরনের সমালোচনা পাঠককেন্দ্রিক সমালোচনার অনুরূপ); এবং

৯. পাঠ বা টেক্সটের মধ্যে নারীত্ব বা নারীসুলভ বৈশিষ্ট্য নিহিত থাকলে তার স্বরূপ উদ্ঘাটন (উত্তর-আধুনিক সমালোচনা  এক্ষেত্রে অগ্রসর হয়েছে)।

নারীবাদী সমালোচনার ক্ষেত্রে উল্লেখ্য অন্যান্য দিক হচ্ছে :

১. সাহিত্যকর্মে নারীর জীবনকে যেভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে তার স্বরূপ বর্ণনা;

২. নারী চরিত্র রূপায়ণের বৈশিষ্ট্য আলোচনা;

৩. নারী ও পুরুষের মধ্যেকার সম্পর্ক নিরূপণ;

৪. নারী ও পুরুষের মধ্যেকার যৌন সম্পর্ক প্রথাবদ্ধ না চ্যালেঞ্জ-অভিমুখী তার স্বরূপ নির্ণয়;

৫. সাহিত্যকর্মের ভাষায় নারী-পুরুষের সম্পর্কের দিকটি কীভাবে চিহ্নিত হয়েছে তা তুলে ধরা।

আধুনিক যুগের প্রথম নারীবাদী সমালোচক হলেন আঠারো শতকের ইংরেজ লেখিকা মেরি উলস্টোনক্রাফট। পরবর্তীকালে নারীবাদী সমালোচনার ক্ষেত্রে যাঁরা প্রথমেই এগিয়ে এসেছেন তাঁদের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো ফরাসি অস্তিত্ববাদী নারী দার্শনিক সিমোন দ্য বোভোয়ারের দ্বিতীয় লিঙ্গ (দ্য সেকেন্ড সেক্স) (১৯৪৯), আমেরিকান লেখিকা মেরি এলম্যান-এর থিংকিং অ্যাবাউট উইম্যান (১৯৬৮) ও আমেরিকান নারীবাদী লেখিকা কেট মিলেটের সেকচুয়াল পলিটিকস (১৯৭০)। আমেরিকান নারীবাদী লেখিকা মার্গারেট ফুলারের উইম্যান ইন দ্য নাইনটিন্থ সেনচুরি (১৮৪৫), জন স্টুয়ার্ট মিলের দ্য সাবজেকশন অব উইম্যান (১৮৬৯) ইত্যাদি নারীবাদের আকর গ্রন্থ হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে।

এসব গ্রন্থে সাহিত্যে নারীদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রচলিত বিশ্বাসের স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে। এসব রচনাকে আধুনিক নারীবাদী আন্দোলনের মাইলফলক বলা চলে। নারীবাদী সমালোচনা বৃদ্ধি পায় সত্তরের দশকের নারীবাদী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে। আশির দশকের মধ্যে নারীবাদী সমালোচনা নারীর অভিজ্ঞতাকে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছাতে সাহায্য করে।

নারীবাদী সমালোচনার বয়স প্রায় দুশো বছর। তা বিচিত্র ও বহুমুখী। এ-ধরনের সমালোচনার সঙ্গে মিশেছে মার্কসবাদ, ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্ব, অবয়ববাদ, উত্তর-আধুনিকতাবাদ, অস্তিত্ববাদ ও আরো নানা সাহিত্যতত্ত্ব। প্রচলিত সমালোচনার ধারার বাইরে নারীবাদী সমালোচনা স্বতন্ত্র অবস্থান নিয়েছে।

৩.৬ সাংস্কৃতিক সমালোচনা

Cultural criticism

সাংস্কৃতিক সমালোচনায় সাহিত্যকে দেখা হয় সুনির্দিষ্ট জাতীয় বা সামগ্রিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আলোকে। প্রচলিত সাহিত্য অধ্যয়নে সংস্কৃতিকে বিবেচনা করা হয় সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে। পাঠ-এর অনুষঙ্গ হলেও তা গুরুত্বপূর্ণ। সাংস্কৃতিক সমালোচনার মূল লক্ষ্য পাঠ ও পাঠ-প্রসঙ্গের পার্থক্যকে সামনে এনে এটা দেখানো যে, পাঠ ও পাঠ-প্রসঙ্গ পরস্পর ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। একই সঙ্গে সংস্কৃতির উপাদান সম্পর্কে প্রচলিত ধারণার সমালোচনা করাও এর লক্ষ্য।

সাংস্কৃতিক সমালোচনা তাৎপর্যপূর্ণভাবে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তত্ত্বকে ছাপিয়ে যায়। এই ধরনের সমালোচনার বৈশিষ্ট্য তৈরি হয় সমালোচকের ব্যক্তিগত সামাজিক স্তর ও অবস্থানের ওপর।

সংস্কৃতি বলতে বোঝায় মানুষের জীবন-সংগ্রামের সমস্ত বাস্তব ও মনোজাগতিক সৃষ্টি বা কৃতি। সাংস্কৃতিক সমালোচনায় তাই পাশ্চাত্যে ‘কালচারাল স্টাডিজ’কে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে সাংস্কৃতিক সমালোচনা অগ্রসর হয়েছে। বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলো :

১. বৈচিত্র্যপূর্ণ, সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় রাখা;

২. ব্যক্তিগত মনন থেকে ক্রমশ সমাজের সামষ্টিক মননকে গুরুত্ব দেওয়া;

৩. উঁচু, নিচু বা প্রাজ্ঞজনের সংস্কৃতি কিংবা জনপ্রিয়

সংস্কৃতির মধ্যে ভেদরেখা না টানা।

সাংস্কৃতিক সমালোচনার সঙ্গে যুক্ত আছে বহুসাংস্কৃতিকবাদ, যার ভিত্তি মার্কিন বহুসংস্কৃতির বাস্তবতা। সাংস্কৃতিক সমালোচনা মূলত কেন্দ্রীভূত থাকে কোনো সংস্কৃতির বিশেষ বা সামগ্রিক পরিসরে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তত্ত্বের সঙ্গে এই সমালোচনা পদ্ধতি গভীরভাবে সম্পর্কিত। তবে এই দুটি তত্ত্বকে তা ছাপিয়ে ওঠে। এ-ধরনের সমালোচনায় সমালোচক তাঁর নিজস্ব

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ধারা সম্পর্কে যথেষ্ট আত্মসচেতন থাকেন। একই সঙ্গে এ-ধরনের সমালোচনার তাৎপর্য বহুলাংশে সংশ্লিষ্ট থাকে সমালোচকের সামাজিক অবস্থানের ওপর।

‘সাংস্কৃতিক সমালোচনা’ পরিভাষাটির স্রষ্টা মার্কিন ঐতিহাসিক জ্যাক বারজুঁ (Jacques Barzum)। ১৯৩৪ সালে
সাহিত্য-সমালোচনার ব্যাপক ব্যাপ্তিকালে এই পরিভাষা প্রচার লাভ করে। পরবর্তীকালে তা অ্যাকাডেমিক বা বিদ্যায়তনিক সমালোচনার রূপ নেয়।

অ্যালন ট্র্যাচেনবার্গ ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত তাঁর ক্রিটিকস অব কালচার গ্রন্থে বিশের দশকের মার্কিন বুদ্ধিজীবীদের বিষয়ে লেখেন। অন্যদিকে মার্কিন ইতিহাসকার রিচার্ড ওলিনের দ্য টার্মস অফ কালচারাল ক্রিটিসিজম (১৯৯২) গ্রন্থে ফ্রাংকফুর্ট বিদ্যাশাখা, অস্তিত্ববাদ, বিনির্মাণবাদ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় সাংস্কৃতিক সমালোচনার দিগন্তের বিস্তার ঘটে। বিশ শতকের উল্লেখযোগ্য মুখ্য সাংস্কৃতিক সমালোচক হলেন মার্কিন সাহিত্য-সমালোচক আয়ারভিং ব্যাবিট ও জার্মান দার্শনিক ওয়াল্টার বেঞ্জামিন।

৩.৭ উত্তর-ঔপনিবেশিক সমালোচনা

Post-colonial criticism

উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্য-সমালোচনা প্রায়শ ঔপনিবেশক শক্তি ও উপনিবেশায়িত মানুষের মধ্যেকার সম্পর্ক তুলে ধরে। উপরন্তু এ-ধরনের সমালোচনার মাধ্যমে কোনো পাঠ ঔপনিবেশিক আদর্শকে সমুন্নত করার পক্ষে না তার স্বরূপ তুলে ধরায় সচেষ্ট তা বিচার ও বিশ্লেষণ করে।

ইউরোপকেন্দ্রিক বা ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপট থেকে গড়ে ওঠা সাহিত্য-সমালোচনার ধারার বিরুদ্ধে প্রতিব্যাখ্যান হিসেবে এই ধরনের সমালোচনার আবির্ভাব। দুই বিশ্বযুদ্ধের পর উপনিবেশগুলি থেকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি তাদের শাসনক্ষমতা থেকে পিছু হটলে সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শোষণের বিষময় ফল সম্পর্কে উপনিবেশায়িত কণ্ঠ ক্রমেই জোরদার হয়ে ওঠে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে উত্তর-ঔপনিবেশিক তাত্ত্বিকেরা এবং লেখকরা তাঁদের তত্ত্বে ও সাহিত্যকর্মে এর প্রকাশ ঘটায়।

এ-ধরনের সমালোচনা উপনিবেশবাদের ঐতিহাসিক পটভূমি তুলে ধরে এবং উপনিবেশায়িত জনগণের শিল্প, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের ওপর ঔপনিবেশিক শাসনের বিরূপ প্রভাব নিরূপণ করে।

উত্তর-ঔপনিবেশিক সমালোচনা বলতে প্রধানত বোঝায় একসময় ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির কবল থেকে জেগে ওঠা উপনিবেশগুলির সাহিত্যকর্মের মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ। এ-ধরনের সমালোচনার অন্যতম লক্ষ্য উপনিবেশ ব্যবস্থার ন্যায্যতার পক্ষে অবস্থান নেওয়া সুপরিকল্পিত অপব্যাখ্যার স্বরূপ উন্মোচন।

উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্বের বিকাশে ব্যাপক প্রভাব পড়ে এইমে সিজেয়ার (Aime cesaire)-এর প্রবন্ধ ‘ডিসকোর্স অন কলোনিয়ালিজম’ (১৯৫০) প্রকাশের পর। এক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে ফরাসি উপনিবেশ মার্তিনিকের মনোবিজ্ঞানী রাজনৈতিক দার্শনিক ফ্রঁৎস ফানোঁর (Frantz Fanon) গ্রন্থ ব্ল্যাক স্কিন, হোয়াইট মাস্ক (১৯৫২) গ্রন্থটি।

উত্তর-ঔপনিবেশিক সমালোচনার ক্ষেত্রে পুরোধা কর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয় ফিলিস্তিনি-মার্কিন অধ্যাপক এডওয়ার্ড সাঈদের ওরিয়েন্টালিজমকে (১৯৭৮)। ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির শাসন-শোষণকে ন্যায্যতা দেওয়ার লক্ষ্যে যেসব গৎবাঁধা ইমেজ ও মিথ প্রচলিত ছিল এই গ্রন্থে তার স্বরূপ উন্মোচন করা হয়।

উত্তর-ঔপনিবেশিক সমালোচনায় যেসব দিক গুরুত্ব পায় সেগুলির মধ্যে রয়েছে :

১. কাহিনি, ভাষা, চরিত্রায়ণের মাধ্যমে সাহিত্যকর্মে ঔপনিবেশিক নিপীড়ন ও বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গির যে-প্রকাশ ঘটেছে তা তুলে ধরা;

২. কোন গোষ্ঠী বা স্তরের লোককে আগন্তুক, বহিরাগত, বিদেশি, বিজাতীয় ইত্যাদি বলে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং আখ্যানে তাদের চিহ্নিত করার ধরন নিরূপণ;

৩. সাহিত্যকর্মে উপনিবেশিকায়িত ও উপনিবেশকার – এই দুই ধরনের লোককে মনস্তাত্ত্বিকভাবে যেভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে তার স্বরূপ উদ্ঘাটন;

৪. সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে উপনিবেশবাদী ভাষাদর্শকে সমর্থন বা বিরোধিতার (সক্রিয়ভাবে বা নিষ্ক্রিয়ভাবে) প্রকৃতি বিচার করা।

৪. পাঠক-অভিমুখী সমালোচনা

Reader oriented criticism

পাঠক-অভিমুখী হচ্ছে সাহিত্য-সমালোচনার সেই বৃহত্তর শাখা যা কোনো সাহিত্যকর্ম আলোচনায় পাঠক ও তাঁর পাঠের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আলোকপাত করে। এই ধারার সাহিত্য-সমালোচনায় লেখক, বিষয়বস্তু ও গঠনরূপ আলোচনাকে পরিহার করা হয়।

পাঠক-অভিমুখী সমালোচনার সূত্রপাত ষাট ও সত্তরের দশকে বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিতে। এই আন্দোলনের ফলে সমালোচনার দৃষ্টিকোণ পাঠবস্তু থেকে পাঠকের দিকে কেন্দ্রীভূত হয়।

পাঠক-অভিমুখী সমালোচনার পুরোধা হলেন মার্কিন সাহিত্য-সমালোচক নরম্যান হল্যান্ড ও স্ট্যানলি ফিশ, জার্মান সাহিত্য-সমালোচক ভলফগ্যাং ইসার ও ফরাসি প্রাবন্ধিক রোঁলা বার্থেস প্রমুখ।

৪.১ পাঠক প্রতিক্রিয়াভিত্তিক সমালোচনা

Reader Resposnse Criticism

সাহিত্যকর্মের পাঠ বস্তু এবং পাঠকের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সমালোচনাভাষ্য পাঠক-প্রতিক্রিয়া সমালোচনা নামে পরিচিতি পেয়েছে। এ-ধরনের সমালোচনা সাহিত্যকর্মের অর্থের উৎস নিরূপণে মূল পাঠের চেয়ে পাঠকের প্রতিক্রিয়ার ওপরই আলোকপাত করতে সচেষ্ট। পাঠক প্রতিক্রিয়ামূলক সমালোচনায় সাহিত্যকর্মকে একক ‘সঠিক’ অর্থবিশিষ্ট অনড় ও সুস্থিত সত্তা হিসেবে দেখার চেয়ে পাঠকের মনে প্রবাহিত ক্রিয়াকলাপ বা প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা হয়।

এক অর্থে সাহিত্যকর্ম অস্তিত্ব পায় পাঠকের মনে, ছাপানো পৃষ্ঠায় নয় এবং এতে করে পাঠকও এর সৃষ্টিতে অংশ নেয়। সাহিত্যকর্ম পাঠের ফলে পাঠকের মনে যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয় পাঠক প্রতিক্রিয়া সমালোচনার মাধ্যমে তা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা হয়। পাঠক প্রতিক্রিয়াভিত্তিক সমালোচকরা মনে করেন, পাঠকের মনের উপলব্ধির বাইরে সাহিত্যকর্মের কার্যকর  কোনো অস্তিত্ব নেই। তাঁদের মতে, কোনো পাঠের কিংবা তার ভাষাতাত্ত্বিক অংশের কোনো নির্দিষ্ট নির্ভুল অর্থ নেই। বিভিন্ন মাত্রার পাঠের অর্থ তৈরি বা নির্মাণ করে ব্যক্তি পাঠক। এই ধরনের সমালোচনার পরিসর সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন মার্কিন সাহিত্য-সমালোচক জেন টমকিনস। তাতে বিভিন্ন ধরনের পাঠের নিহিত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পাঠকের শ্রেণিকরণ, সাহিত্যের অর্থ নির্ধারণে প্রকৃত পাঠকের ভূমিকা, সাহিত্যপাঠের প্রচলিত রীতির সঙ্গে পাঠগত ব্যাখ্যার সম্পর্ক, পাঠকের স্বকীয় অবস্থান ইত্যাদি সূত্রায়িত হয়েছে।

আধুনিক পাঠক-প্রতিক্রিয়া আন্দোলনের সূচনা সত্তরের দশকে। ১৯৭০ সালে জার্মান সমালোচক হানস রবার্ট জস্ পাঠের অর্থ নির্ধারণে পাঠকের প্রতিক্রিয়ার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন। তিনি এই অভিমত তুলে ধরেন যে, পাঠকের ভূমিকা ছাড়া সাহিত্যকর্মের পাঠ অর্থসম্পূর্ণতা পায় না। তা পাঠ পূর্ণতা পায় পাঠকের উপলব্ধির মাধ্যমে। সত্তরের দশকে পাঠক-প্রতিক্রিয়া সমালোচনার সূচনা হলেও তা আলংকারিক সমালোচনার দীর্ঘ ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং এরই ফসল। সাহিত্য পাঠকের মনে কী ধরনের প্রভাব ফেলে আলংকারিক সমালোচনায় সেদিকটি গুরুত্ব পায়।

পাঠক-প্রতিক্রিয়া সমালোচনা মূলত পাঠক-অভিমুখী। এই সমালোচনা রীতিতে মুখ্য ভূমিকা হচ্ছে পাঠক পরিভাষাটির সংজ্ঞার্থের। অনেকের কাছে পাঠক কথাটিতে নিহিত আছে সাহিত্যকর্মের সম্ভাব্য সব পাঠক। অন্যেরা মনে করেন, পাঠক মানে সাহিত্যকর্ম পড়েছেন এমন সত্যিকারের পাঠক। তাঁরা পাঠের সঙ্গে সম্পৃক্ত পাঠকের মনস্তত্ত্বের ওপর জোর দেন। অন্যেরা গুরুত্ব দেন সাংস্কৃতিক, সামাজিক, ঐতিহাসিক যে পরিবেশে পঠনের ব্যাপার ঘটে তার ওপর। নারীবাদী সমালোচকেরা দৃষ্টি আকর্ষণ করেন নারী পাঠকদের দিকে।

পাঠক প্রতিক্রিয়া তত্ত্বে পাঠকে বাস্তব সত্তা হিসেবে দেখার প্রশ্নেও মতপার্থক্য দেখা যায়। বইয়ে যে-শব্দ থাকে তাকে নিঃসন্দেহে পাঠক-নিরপেক্ষ স্বাধীন সত্তা হিসেবে দেখা চলে। কিন্তু সাহিত্যকর্মে লিপিবদ্ধ শব্দসম্ভারের অর্থ সক্রিয় হয়ে ওঠে পাঠকের পঠন-প্রক্রিয়ার কালে। তখন পাঠের সঙ্গে পাঠবস্তুর যে মিথস্ক্রিয়া ঘটে তাতে পাঠ আর আলাদা সত্তা থাকে না, তা পরস্পরের ওপর ক্রিয়াশীল প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে দাঁড়ায়। এক্ষেত্রে সাহিত্যের পাঠ আর কোনো বস্তু বা শিল্পকর্ম থাকে না, তা ঘটনায় পর্যবসিত হয়। প্রচলিত ধারায় পাঠ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয় : এর অর্থ কী? নব্য সমালোচনায় এ-প্রশ্নটি বদলে যায় এভাবে : কীভাবে এটা বোঝা যায়? আর পাঠক প্রতিক্রিয়া সমালোচনায় প্রশ্নটি হয়ে দাঁড়ায় এরকম : যৌথভাবে অর্থ সৃষ্টিতে পাঠক কী ভূমিকা রাখেন?

পাঠক প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে যে-কোনো পাঠক একই পাঠের ইচ্ছেমতো যে-কোনো অর্থ বোঝাতে পারেন। তাই এই ধরনের সমালোচনাতত্ত্বের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে, এটি নৈরাজ্যকর আপেক্ষিকতার জন্ম দেয়। এর জবাবে এই ধারার সমালোচকেরা যুক্তি তুলে ধরেন যে, লেখক ও পাঠক দুজনেই অভিন্ন ব্যাকরণের সূত্র দ্বারা চালিত হয়ে থাকেন। ভাষাপদ্ধতির যে নিয়ম ও সম্পর্ক তাতে অর্থের বড় ধরনের হেরফের করা মুশকিল। রিসেপশন তত্ত্ব নামে আর একটি ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গি অন্য একটি উত্তর সামনে এনেছে। এই তত্ত্ব পাঠের দীর্ঘকাল প্রচলিত অর্থ বিবেচনা করাকে গুরুত্ব দেয়। এছাড়াও আরো একটি দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। তা সমালোচক স্ট্যানলি ফিশ গ্রহণ করেছেন। তাতে একদল পাঠক পাঠ পড়ে আলোচনার মাধ্যমে যে-অর্থ নির্ধারণ করেন তা-ই গ্রাহ্য। এই পাঠকদের তিনি অভিহিত করেছেন ‘ব্যাখ্যাকারী সম্প্রদায়’ হিসেবে। 

পাঠক প্রতিক্রিয়া বিষয়ক প্রতিনিধিত্বশীল সংকলন হচ্ছে জেন টমপকিনসের রিডার রেসপনস ক্রিটিসিজম (১৯৮০)। স্ট্যানলি ফিশের ইজ দেয়ার এ টেক্সট ইন দিস ক্লাস? (১৯৮০) গ্রন্থে ব্যাখ্যাকারী সম্প্রদায় সম্পর্কে যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে। পাঠক প্রতিক্রিয়াভিত্তিক তত্ত্বের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সমালোচকরা হলেন – জার্মান সাহিত্যতাত্ত্বিক ভলফগ্যাং ইসার, মার্কিন সাহিত্য-সমালোচক জোনাথান কুলার, নরম্যান হল্যান্ড, হ্যারন্ড ব্লুম ও অধ্যাপক লুইস রোজেন ব্ল্যাট।

৫. অন্যান্য রূপশ্রেণির সমালোচনা

৫.১ তাত্ত্বিক সমালোচনা

Theoretical criticism

 সাহিত্য-সমালোচনা একটি দৃষ্টিকোণ থেকে সাধারণত ব্যবহারিক সমালোচনার মতো স্বতন্ত্র সাহিত্যকর্ম পর্যালোচনা করা হয় না। বরং এর উদ্দেশ্য সাহিত্যের উৎকর্ষ বিচারের সাধারণ মূলনীতি ও মানদণ্ড সূত্রায়িত করা এবং সাহিত্য বিশ্লেষণ, ব্যাখ্যা কিংবা মূল্যায়নের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করা। সাহিত্যকর্ম বিচারে সাধারণভাবে প্রয়োগের লক্ষ্যে তাত্ত্বিক সমালোচকেরা এক প্রস্থ নান্দনিক মূলনীতিকে প্রয়োজনীয় ও আবশ্যিক শর্ত হিসেবে গ্রহণ করেন। তবে স্বতন্ত্র সাহিত্যকর্মে প্রয়োগের বেলায় এক্ষেত্রে একটি পদ্ধতি  (মেথোডোলজি) অনুসরণ করা হয়।

আরিস্তোতলের পোয়েটিকস (খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে রচিত) হচ্ছে তাত্ত্বিক সমালোচনার সর্বাধিক পরিচিত প্রাচীন নিদর্শন। আই এ রিচার্ডসের প্রিন্সিপলস অব লিটারারি ক্রিটিসিজম (১৯২৪) এবং কানাডীয় সাহিত্য-সমালোচক নরথ্রপ ফ্রাইয়ের অ্যানাটমি অব ক্রিটিসিজম (১৯৫৭) তাত্ত্বিক সমালোচনার আধুনিক নিদর্শন।

বিশ শতকের প্রথমার্ধে মার্কিন সমালোচকেরা ব্যবহারিক সমালোচনা লিখে আত্মপ্রসাদ লাভ করতেন। পঞ্চাশের দশকে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সমালোচকদের হাতে তাত্ত্বিক সমালোচনা মার্কিন সমালোচক মহলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। তখন থেকেই তাত্ত্বিক সামালোচনা লিখে আসছেন রূপবাদী, মার্কসবাদী, অবয়ববাদী, উত্তর-অবয়ববাদী, নারীবাদী, নব্য ইতিহাসতত্ত্ববাদী প্রমুখ সমালোচকরা।

৫.২ ব্যবহারিক/ প্রায়োগিক সমালোচনা

Practical/ applied criticism

সাহিত্যতত্ত্ব থেকে আলাদা কিন্তু বিশেষভাবে সম্পর্কিত হচ্ছে ব্যবহারিক সমালোচনা (practical criticism)। তা প্রায়োগিক বা ফলিত সমালোচনা (applied criticism) নামেও পরিচিত। এ-ধরনের সাহিত্য-সমালোচনায় শিল্পের নীতি ও তাত্ত্বিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে কোনো সুনির্দিষ্ট সাহিত্যকর্ম বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়। ব্যবহারিক সমালোচনা তাত্ত্বিক সমালোচনার বিপরীত। তাত্ত্বিক সমালোচনার লক্ষ্য শিল্প বিচারের সাধারণ মূলনীতি চিহ্নিত ও প্রণালিবদ্ধ করা এবং নান্দনিক ও সমালোচনার তত্ত্ব সূত্রায়িত করা। তাত্ত্বিক সমালোচক তত্ত্ব, অন্তর্দৃষ্টি ও পদ্ধতি উপস্থাপন করেন। অন্যদিকে ব্যবহারিক সমালোচকরা তা ব্যবহার করে থাকেন।

ব্যবহারিক সমালোচনা সংজ্ঞার্থটির সঙ্গে যুক্ত আই. এ. রিচার্ডসের প্র্যাকটিক্যাল ক্রিটিসিজম (১৯২৯) গ্রন্থটি। ১৯৩০ থেকে ষাটের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ও ব্রিটেনে সাহিত্য-সমালোচনায় এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে।

ব্যবহারিক সমালোচকদের দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। এঁদের একদল হচ্ছেন গ্রন্থ, চলচ্চিত্র ও নাটকের সমালোচক। এঁরা খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন ইত্যাদিতে সমালোচনা লিখে থাকেন। এঁদের মূল উদ্দেশ্য সাম্প্রতিককালের কাজের বৈশিষ্ট্য নিরূপণ ও মূল্যায়ন এবং সেগুলির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ।

দ্বিতীয় ধরনের ব্যবহারিক সমালোচকদের মধ্যে পড়েন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জ্ঞানসাধক ও পণ্ডিত। এঁরা সমালোচনা গ্রন্থ রচনা করেন এবং বিশেষায়িত জার্নালে গবেষণা-প্রবন্ধ লেখন। তাঁদের লেখার পাঠক সাধারণত অন্য বিশেষজ্ঞরা। এঁদের সমালোচনায় মূল্যায়নের চেয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অধিকতর গুরুত্ব পায়।

ব্যবহারিক সমালোচনাকে তিনটি উপ-শ্রেণিতে বিভক্ত করা যেতে পারে। এগুলি হচ্ছে : ১. প্রতীতীবাদী সমালোচনা (impressionistic criticism), ২. বিশ্লেষণাত্মক সমালোচনা (analytical criticism) এবং ৩. যুক্তিবিচারিক সমালোচনা (judicial criticism)।

৫.২.১ প্রতীতিবাদী সমালোচনা

Impressionistic criticism

প্রতীতিবাদী সমালোচনা প্রধানত আত্মগত মনোভাব, মনোভঙ্গি ও ব্যক্তিগত অনুভূতি নির্ভর। তা কেন্দ্রীভূত হয় সমালোচকের মন্ময় প্রতীতির ওপর। সাহিত্যকর্ম পাঠের পর সমালোচকের মনে যেসব অনুভব ও ভাবতরঙ্গ জাগে এবং যেসব অনুষঙ্গ অন্তর্লোকে চাঙা হয়ে ওঠে এ-ধরনের সমালোচনায় সেগুলিই গুরুত্ব পায়। উপরন্তু সাহিত্যকর্মের দ্বারা তিনি কীভাবে প্রভাবিত হন সেসব জ্ঞাপন করাই এ-ধরনের সমালোচনার ভিত্তি। এ-ধরনের সমালোচনায় সমালোচকের ব্যক্তিগত ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রধান হয়ে ওঠে। সাহিত্যকর্মের মননশীল বিশ্লেষণজাত ভাবনা এক্ষেত্রে গ্রাহ্য হয় না। আনাতোল ফ্রাঁস এ-ধরনের সমালোচনাকে সেরা গ্রন্থলোকে অনুভূতিপ্রবণ চিত্তের অভিযান বলে উল্লেখ করেছেন।

এ-ধরনের সমালোচনায় সমালোচক গ্রন্থপাঠগত প্রতীতি (ইমপ্রেশন) প্রকাশ করে থাকেন। এতে সমালোচকের ব্যক্তিত্ববোধ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তিগত উপলব্ধির প্রকাশ ঘটে। এ-ধরনের সমালোচনায় এক এক সমালোচকের কাছে সাহিত্যকর্ম এক এক ভাবে মূল্যায়িত হয়। ফলে তা সর্বজনগ্রাহ্য সমালোচনা হিসেবে বিবেচিত হয় না। প্রতীতিবাদী সমালোচনা ব্যক্তির প্রতিক্রিয়া থেকে উদ্ভূত। এদিক থেকে সমালোচকের প্রতীতিই এ-ধরনের সমালোচনার মূল কথা।

৫.২.২ বিশ্লেষণাত্মক সমালোচনা

Analytical criticism

বিশ্লেষণাত্মক সমালোচনা প্রধানত বস্তুনিষ্ঠ হয়ে থাকে। সাহিত্যকর্মের উপাদানগুলির ব্যাপক বিশ্লেষণ এবং সেগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক নিরূপণ  করাই এ-ধরনের সমালোচনার মূল লক্ষ্য। এই পদ্ধতিতে সাহিত্যকর্মের সমগ্র রূপ বিচার করতে গিয়ে তার অঙ্গ-উপাদানগুলিকে অনুপুঙ্খ বর্ণনা, বিচার ও মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে।

বিশ্লেষণের প্রকৃতি নানা রকম হতে পারে। তা নির্ভর করে সমগ্রের সঙ্গে অংশের কী ধরনের সম্পর্ক নিরূপণ করা হয় তার ওপর। বিশ্লেষণের আগে সমগ্রকে উপলব্ধি করা হলে তার ওপরও এ-ধরনের সমালোচনা নির্ভরশীল। নব্য সমালোচকদের কাজকে বিশ্লেষণী সমালোচনা বলে অভিহিত করা যায়। তাঁরা যে পাঠভিত্তিক  বিশ্লেষণ করেন তা এই ধারণার ভিত্তিতে যে, প্রতিটি রচনার স্বকীয় সমগ্রতা থাকে (‘জৈবিক ঐক্য’ নামে অভিহিত), এবং এর অঙ্গ-উপাদানগুলি (চিত্রকল্প, মর্মবস্তু ইত্যাদি নিরূপণ এবং অর্থ ও ব্যঞ্জনা ব্যাখ্যা ইত্যাদি) ওই সমগ্রের অর্থ, বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্যের অনুষঙ্গী হয়ে থাকে। তাঁরা সাহিত্যকর্মের সংগঠন বিচারে কঠোর যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ পদ্ধতি কাজে লাগান।

বিশ্লেষণী সমালোচনার ঐতিহ্য চলে আসছে প্রাচীনকাল থেকে। আঠারো শতক থেকে তা নতুন ও বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে।

৫.২.৩ যুক্তিবিচারিক বা বৈধী সমালোচনা

Judicial criticism

এই ধরনের সমালোচনায় বিশেষ থেকে নির্বিশেষে, উদাহরণ থেকে তত্ত্বে, পরীক্ষা থেকে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার প্রচেষ্টা থাকে। বাইরের নীতি-নিয়ম নয়, সাহিত্যকর্ম পাঠ করে তার বৈশিষ্ট্য নিরূপণই এ-ধরনের সমালোচনার লক্ষ্য। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গ্রিক ট্র্যাজেডির আদর্শে না দেখে রবীন্দ্রনাথের নাটক পাঠ করে তার আলোকে সেই নাটকের বৈশিষ্ট্য নিরূপণই এ-ধরনের সমালোচনার কাজ। যুক্তিবিচারিক সমালোচনার লক্ষ্য সাহিত্যকর্মের বৈশিষ্ট্য নিরূপণ। নৈতিক মূল্যমান বা ব্যবহারিক উপযোগিতা বিচার এর কাজ নয়। এ-ধরনের সমালোচনায় সাহিত্যকর্মকে সাধারণভাবে এবং একেবারে পুরোপুরি না হলেও মোটামুটিভাবে বস্তুনিষ্ঠ কিছু মানের ভিত্তিতে বিচার করা হয়ে থাকে।

এ-ধরনের সমালোচনায় সাহিত্য সংক্রান্ত বিধিবিধানকে চূড়ান্ত বলে ধরে নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে নিয়মের ব্যত্যয়কে মান্য করা হয় না। বৈধী সমালোচক দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত নিয়মকানুনকে অলঙ্ঘনীয় বলে মনে করেন। এঁরা পুরাতনী সমালোচনার আদর্শের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনকে আদর্শ বলে গণ্য করেন। যেমন, বেন জনসন মনে করতেন, সাহিত্য-শিল্প বিচারে আরিস্তোতলকে ছাড়িয়ে যাওয়া আত্মহত্যার শামিল।

আত্মগত ও বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনার মাঝামাঝি কোথাও যুক্তিবিচারিক সমালোচনার স্থান। সাহিত্যিক উৎকর্ষের সাধারণ মানদণ্ডের ভিত্তিতে এ-ধরনের সমালোচনায় স্বতন্ত্র কোনো উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প কিংবা কবিতার মূল বিষয়বস্তু, সাংগঠনিক প্রকরণ ও শৈলী বিচার করা হয়। এ-ধরনের  সমালোচনায় সাহিত্যকর্মের বিচারে সমালোচকের ব্যক্তিগত মূল্যায়ন ও প্রতিক্রিয়া সন্নিবেশিত হয়। এক্ষেত্রে সমালোচক, লেখকের সাধারণ শৈলী, রচনাকৌশল, বিষয় নির্বাচন ইত্যাদির আলোকে সেগুলির ব্যাখ্যাও করে থাকেন।

স্যামুয়েল জনসন এবং আঠারো শতকীয় অন্যান্য ইংরেজ সমালোচক যুক্তিবিচারিক সমালোচনার চর্চা করেছেন। তাঁদের মানদণ্ড ছিল গ্রিস ও রোমের ধ্রুপদী ঐতিহ্য।

৫.৩ অভিজ্ঞতাবাদী সমালোচনা

Pragmatic criticism

অভিজ্ঞতাবাদী সমালোচনা পাঠকের চিত্তে সাহিত্যকর্মের আবেগিক ও নৈতিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির ক্ষমতার এবং কীভাবে এই প্রভাব সৃষ্টি করা হয় সেই দিকটি সম্পর্কে আলোকপাত করে। এ-ধরনের সমালোচনার চর্চা হয়ে আসছে সেই ধ্রুপদী যুগ থেকেই। অভিজ্ঞতাবাদী সমালোচনার আদিরূপ লক্ষণীয় রোমক কবি হোরেসের রচনায়। হোরেস তাঁর রচিত আর্টস অফ পোয়েট্রি (খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতক) গ্রন্থে পাঠকের মধ্যে সাহিত্যকর্মের প্রভাবের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি এই অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন যে, কবির উদ্দেশ্য পাঠককে হয় আনন্দ দেওয়া, না-হয় শিক্ষা দেওয়া এবং ভালো হয় দুটো হলেই। আঠারো শতকে সমালোচনার ক্ষেত্রে এই ধারা প্রাধান্য বিস্তার করে। তা বিশ শতকের শেষার্ধে নতুন শক্তি পায়।

অভিজ্ঞতাবাদী সমালোচকরা বিশ্বাস করেন, লেখকের কাঠামো এমনভাবে কাজ করে যেন তা পাঠক বা তার শ্রোতার মনে সুনির্দিষ্ট প্রভাব ফেলে। এবং তাদের কাছ থেকে কোনো না কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। এই সব লক্ষ্য কতটা অর্জিত হলো তার আলোকেই এই ধারার সমালোচকরা সাহিত্যকর্মের মূল্যায়ন করেন। সাহিত্যকর্ম বা রচয়িতা পাঠকের ওপর কতটা প্রভাব ফেলতে পারে, কীভাবে এবং কতটা ভালোভাবে তা পারে – সেসব দিকে জোর দিতে গিয়ে অভিজ্ঞতাবাদী সমালোচনা ক্ষেত্রবিশেষে অলংকারবাদী সমালোচনার অনুরূপ হয়ে পড়ে। অলংকারবাদী সমালোচনার মতোই অভিজ্ঞতাবাদী সমালোচনার চর্চা চলে আসছে ধ্রুপদী কাল থেকে। আঠারো শতক পর্যন্ত অব্যাহত থাকার পর এর জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। সে-জায়গায় স্থান করে নেয় অভিজ্ঞতাবাদী সমালোচনা, যা রচয়িতার চিন্তাভাবনা ও আবেগ-অনুভূতির আলোকে সাহিত্যকর্মকে বিচার করে থাকে। অভিজ্ঞতাবাদী সমালোচনা উনিশ শতকে আরো দুরূহতার কবলে পড়ে বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনার আবির্ভাব ঘটলে।

সহায়ক রচনাপঞ্জি

১.        অমিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, সমালোচনার কথা, তৃতীয় পুনর্মুদ্রণ, কলকাতা, ১৯৭১।

২.       ধীমান দাশগুপ্ত-সম্পাদিত পরিভাষা কোষ, কলকাতা, ২০১৩।

৩.       বিমলকুমার মুখোপাধ্যায়, সাহিত্য-বিচার : তত্ত্ব ও প্রয়োগ, কলকাতা, ২০০৬।

৪.       সত্যপ্রসাদ সেনগুপ্ত, পাশ্চাত্য সাহিত্যের সমালোচনার ধারা, কলকাতা, ১৯৬৬।

৫.  Jhon Peck and Martin Coyle, Literary Terms and criticcism, new edition, 1993.

6.   M. H. Abrams and Geoffrey Galt Harpham, A Glossary of Literary Terms, first Indian Print, 2012.

7.   Bullock Alan and others, The Fontana Dictionary of Modern Thought, second edition, 1988.

8.   Piyas Chakrabarti, Anthem Dictionary of Literary Term and Theory, Anthem Press, 

      second edition, 2010.

9.   Peter Childs and Roger Flower, The Routledge Dictonary of Literary Terms, second Indian print, 2009.

10. Chris Baldick, Oxford Concise Dictionary of Literary Terms, Oxford university Press,

      1996.

11.  Martin Coyle and others, Encyclopedia of Literature and Criticsim, Routledge, London, 1990.

12.  J. A. Cuddon, The Dictionary of Literary Terms and Literary Theory, 1999.

13. J. A. Cuddon, The Penguin Dictionary of Literary Terms and Literary Theory, Penguin Books,1995.

14.  William Harmon and C. H. Holman, A Handbook of Literature, Prentice-Hall, 7th

      edition, 1995.

15. C. Hugh Holman, A Handbook to Literature, Macmillan Publishing Co, New York, fifth edition, 1986.

16.  Barbara Johnson, The Critical Difference : Essays in the Contemporary Rhetoricc of

      Reading, 1980.

17. Vincent B. Leitch, general editor, The Norton Anthology of Theory and Criticism, W. W. Norton of Company, lnc, New York – London, 2001.

18. David Macey, The Penguin Dictionary of Critical Theory, Penguin Books, 2000.

19.  Ross Murfin and Supryia M. Ray, The Bedford Glossary of Critical and Literary

      Terms, Second Edition, 2003.

20. Joseph Shipley (edited), Dictionary of Literary Terms, first Indian print, 1993.

21.  Julie Rivkin and Michel Rayan (edited), Literary Thory : an Anthology, Oxford,

      Blackwell Publishers, 1998.

22.  Lois Tyson, Critical Theory Today, Routledge, 2008.

24.        Patrica Waugh, Literay Theory and Criticism, Oxford University Press, 2006.