শব্দের ডানা ও আসমা সুলতানার উপস্থাপনা

আসমা সুলতানা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত একজন  ব্রিটিশ শিল্পী, এখন কানাডায় বাস করছেন। শিল্পীর জীবনবৃত্তান্তসূত্রে জানা হলো, তিনি ঢাকা, লন্ডন ও টরন্টো থেকে চারুকলা এবং শিল্পকলার ইতিহাস বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়েছেন ছবি আঁকায় এবং তাঁর সৃজন নিয়ে সম্প্রতি প্রদর্শনীর আয়োজন  করছেন নানা  দেশে।

‘শব্দের ডানা আছে’ শিরোনামে তাঁর একটি একক চিত্রপ্রদর্শনী হয়েছে ঢাকায় ইএমকে সেন্টারে, গত ৫ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ পর্যন্ত।

আসমা বেশ কয়েকটি একক প্রদর্শনীর আয়োজন এবং কানাডা, ইংল্যান্ড, ভারত ও বাংলাদেশে কতগুলি গ্রুপ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন।

শিল্পে নিউমিডিয়া যুক্ত হওয়ায় সৃজনপ্রক্রিয়ার নতুন নতুন দুয়ার গেছে খুলে। নিউমিডিয়ায়  অনেকেই প্রয়োগ করছেন শারীরিক পারফরম্যান্স – এর ফটোগ্রাফির মধ্যে শিল্পীর রেখাংকন ও বর্ণপ্রয়োগকে ফ্রেমবদ্ধ করে কিংবা অডিও-ভিডিওতে। আসমা নিউমিডিয়ার এই সূত্রকে নিজের অনুভূতি প্রকাশের আকর করেছেন।

নিজের সৃজনকর্ম নিয়ে আসমা সুলতানার ভাষ্য – ‘আমার কাজ হলো স্মৃতি খুঁড়ে খুঁড়ে আত্মপরিচয়কে ভিত্তি করে জীবনের অভিজ্ঞতার ব্যবচ্ছেদ ও সেগুলোকে বিচ্ছিন্ন করে পুনরায় একত্রিতকরণের পর গোটা ঘটনার পুনর্ব্যাখ্যা তৈরি করা।’

শিল্পী মনে করেন, জন্মের পর সামাজিক-

সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তাঁর যে-পরিচয় তৈরি হয়েছিল তা একেবার ভেঙে গেছে এবং নির্বাসিত ও যাযাবর হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতা ও নীতিকে নতুন আরেক পরিচয়ে পুনরায় তৈরি করতে হয়েছে। তাঁর শিল্পকর্মগুলি এইভাবে একটি স্বগতোক্তির মতো, চেতনার একটি প্রবাহকে উপস্থাপন করে ও যেগুলি একই সঙ্গে মানবসমাজে সমষ্টিগত অভিজ্ঞতায় সচেতনভাবে রয়ে গেছে, শিল্পী যেসব কথা বলতে চান, সেই কাহিনিকে ধারণ করে।

শিল্পী তাঁর কাজ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ‘সমষ্টিগত পরিচয়ের বিশাল শক্তিকে সংহত করতে আমি আমার কাজের সঙ্গে শারীরিক সংযোগের সেতু তৈরি করি। কাগজে বা বিভিন্ন চিত্রপটে কালি দিয়ে আঁকার জন্য আমি ব্রাশ বা পেন্সিলের পরিবর্তে বৃদ্ধাঙ্গুল এবং আঙুল ব্যবহার করি। এছাড়া আমি সুতা ব্যবহার করার পরিবর্তে আমার চুল ব্যবহার করি এমব্রয়ডারি বা সুইয়ের কাজ, পোশাক তৈরি, প্যাটার্ন ইত্যাদিতে। আমি আমার দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত জিনিসগুলি ব্যবহার করি এবং সেগুলিকে আমার ফেলে দেওয়া এবং উপড়ে যাওয়া চুল দিয়ে সংশোধন করি, যা আমি যত্নসহকারে সংরক্ষণ করেছি। আমি তাদের আমার শিল্পে স্থান দিতে চেয়েছিলাম। এক এক করে চুল সংগ্রহ, পরিষ্কার এবং সংরক্ষণ করার প্রক্রিয়াটি আমার জন্য একটি নিয়মের মতো, একটি শিশুর যত্ন নেওয়ার মতো যত্নসহকারে সাজানো কার্যক্রম। এটি নিজের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গড়ে তোলারও একটি উপায়, আমিই আমার মা এবং আমিই আমার সন্তান।

শিল্পী আসমা সুলতানার শিল্পকর্ম নির্জনতা এবং স্থানচ্যুতির অভিজ্ঞতা দিয়ে পরিবেষ্টিত। তিনি ট্যাপেস্ট্রির মতো বুননের মাধ্যমে এসব যন্ত্রণাকে তাঁর কাজের মধ্যে ফুটিয়ে তোলার  চেষ্টা করেন। এসব যেন হারিয়ে-যাওয়া সময় এবং নিজের ঠিকানা ও দেশত্যাগের স্মৃতিচিহ্ন। বৃহত্তর জীবনধারায় শিল্পীর  পরিচয় পুনরায়  তৈরি করার জন্য তাঁর কাজগুলো দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে সহায়ক হয়েছে। এ-প্রসঙ্গে শিল্পীর অভিমত এমন – ‘বিচ্ছিন্নতা, নির্বাসন, স্থানান্তর, শূন্যতা এবং শূন্যতায় হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন এবং পুনরাবৃত্ত দুঃস্বপ্নের দ্বারা তাড়িত হওয়ায় আমার ভাবনা ও কাজ অন্যদের থেকে ভিন্নতর। নিজস্বতার এই প্রক্রিয়া আমার শৈল্পিক অভিব্যক্তিতে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছি।’

তাঁর উপস্থাপিত কয়েকটি শিল্পকর্ম নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। তাঁর বেশিরভাগ কাজ ফ্রেমবদ্ধ নয়, বরং মুক্তভাবে উপস্থাপন করার কৃৎকৌশলে তিনি গ্যালারির দেয়ালপৃষ্ঠকে কাজে লাগিয়েছেন। প্রচলিত অর্থে শিল্পকর্ম বলতে আমরা যেমনটা বুঝি, তাঁর কাজ সেরকম নয়। যেমন – মাস্কিং টেপ দিয়ে দেয়ালে অর্ধবৃত্তাকারে, অনেকটা মালার মতো, ফর্ম তৈরি করে এর গায়ে শৈশবে মায়ের কাছে শোনা ঘুমপাড়ানি গানের কলি লিখেছেন – ‘ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি মোদের বাড়ি এসো…।’ এই ছড়াকাটা সুর আমাদের নিয়ে যায় হৃদয়ের অন্দরে থাকা স্মৃতিময় শৈশবে।

বাংলা বর্ণমালার দুই বিভাগ স্বর ও ব্যঞ্জনবর্ণকে সাজিয়ে চিত্রপটে তুলে ধরে শৈশব স্মৃতিকে এখানেও মেলে ধরেছেন আসমা। দেয়ালে ঝুলিয়ে দিয়েছেন দড়িদড়া, চুল দিয়ে কাপড়ের বুকে সেলাই করেছেন, ফটোগ্রাফিকে রেখা ও রঙে রঞ্জিত করেছেন।

ভাস্কর্য স্থাপনার দৃষ্টান্তও গড়েছেন তিনি। যেমন – মুদ্রিত কাগজ ও তার দিয়ে তৈরি লতার মাথায় পাতাবাহারসহ কয়েকটি ক্ষুদ্রকায় গাছের পাতা ও সেগুলি উপস্থাপনের জন্য টুকরো টুকরো কাগজের স্তূপ ও কাচের গ্লাস প্রয়োগ করেছেন। কালার প্যালেটের বুকে কালি ও কলমে অসংখ্য আঁচড় কেটে  যন্ত্রণাক্লিষ্ট সময়ের ভাষ্য তুলে ধরেছেন। আবার কার্পেটের মতো পুরু একটি পটে সাদা-কালো বর্ণের আলো-আঁধারি অনুভূতির একটি ব্যঞ্জনা সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছেন।

শিল্পসৃজনের দক্ষতা নয়, মস্তিষ্কের মধ্যে বাসা বাঁধা নানা চিন্তাকে রূপকের সঙ্গে প্রয়োগ করে স্থানীয় উপকরণ ব্যবহারে নিজের সৃজনপ্রক্রিয়াকে সহজ ও সাদামাটাভাবে তুলে ধরেন শিল্পী। উত্তরাধুনিক এই শিল্পরীতির সঙ্গে সৃজনশিল্পের সুদক্ষ প্রয়োগ ও মিশ্রণ প্রয়োজন বলে মনে করি। আসমার উপস্থাপিত কাজ দৃশ্যকলাবিমুখ। তবে তাঁর স্থাপনাধর্মী শিল্পযাপনে চর্চার সীমাবদ্ধতা দর্শক অনুভূতিকে যথার্থ শব্দের পাখা মেলতে দেয়নি বলেই মনে হয়েছে। এসব সীমাবদ্ধতা অতিক্রমের তাঁর সুযোগ রয়েছে। ভবিষ্যতে

তিনি তার সদ্ব্যবহার করবেন বলে প্রত্যাশা।