ত্রিশজন শিল্পীর ছাপচিত্র প্রয়াস

ভিজুয়াল আর্টের আধুনিক সৃজন প্রক্রিয়ার কলাকৌশল পেরিয়ে, কৈবল্য এড়িয়ে ছাপচিত্র শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ একটি নান্দনিক প্রকাশ মাধ্যম। বিশেষত আমাদের উপমহাদেশের শিল্পের সমকালীনতায় দেয়ালে ঝোলানো চিত্রকর্ম শিল্পী, দর্শক ও সমঝদারদের কাছে বেশ আদরণীয়। এক্ষেত্রে ছাপচিত্র অনেকের পছন্দের তালিকার অগ্রভাগে – তুলনামূলক ছোট আকৃতি, স্বল্পমূল্য ও একই কাজের সংখ্যাধিক্যে সহজলভ্যতার জন্য।

মাধ্যমটি যে দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে সেটি অনুভব করতে পারছি – ছাপচিত্রশিল্পীদের অধিক তৎপরতায়। ছাপাই মেশিনসহ তাঁরা স্টুডিও গড়ে তুলছেন, অন্যদের সম্পৃক্ত করছেন, প্রদর্শনী আয়োজন করছেন, জাতীয় প্রদর্শনীগুলোয় বেশি সংখ্যায় অংশ নিচ্ছেন এবং এজন্য দেশে-বিদেশে সাফল্য এবং স্বীকৃতিও মিলছে!

গত বছর ঢাকায় শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদ চিত্রশালা ও প্রিন্ট স্টুডিওর যাত্রা শুরু হয়েছে তাঁর শিল্পীপুত্র আহমেদ নাজিরের উদ্যোগে। এটি ইতোমধ্যে শিল্পী ও সমঝদারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

এই চিত্রশালাটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে সামনে রেখে অপেক্ষাকৃত তরুণ ত্রিশজন ছাপচিত্রশিল্পীর সাম্প্রতিক চিত্রকর্ম নিয়ে বিশেষ একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল। প্রদর্শনীর ওই ত্রিশজন শিল্পী-দর্শকসহ সংশ্লিষ্টদের জন্য শ্লাঘার বিষয় হলো, এ-আয়োজনে ভাষা-আন্দোলন স্মরণে ১৯৮৭ সালে এচিং মাধ্যমে আঁকা শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদের ‘ক্রুদ্ধ চোখ’-এর প্রদর্শনী। তাঁর চিত্রকর্মের এই উৎসাহব্যঞ্জক অংশগ্রহণের পেছনে আছে অমর একুশে ফেব্রুয়ারিকে মাতৃভাষা দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এ-বছর জুনে তাঁর জন্মশতবর্ষ। এই গৌরবকে স্পর্শ করা আমাদের জন্য পরম সৌভাগ্যের!

ত্রিশজনের তালিকা ঘেঁটে দেখা গেল, এ-দলে অগ্রজশিল্পী তিনজন, তাঁরা হলেন – জ্যোৎস্না মাহবুবা, মুসলিম মিয়া ও আনিসুজ্জামান। জ্যোৎস্না অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, মুসলিম গাজীপুর টাকশালের প্রধান নকশাবিদ এবং শেষোক্তজন চারুকলা অনুষদের ছাপচিত্র বিভাগের অধ্যাপক।

পরিচিত প্রিন্টমেকারদের মধ্যে আছেন – রুজভেল্ট বেঞ্জামিন ডি রোজারিও, এ এইচ ঢালী তমাল, ফারজানা রহমান ববি, সালমা জাকিয়া বৃষ্টি, রুহুল করিম রুমি, ফখরুল ইসলাম মজুমদার শাকিল, কামরুজ্জামান, মোয়াজ্জেম হোসেন ও মিশকাতুল আবীর। উঠতি তরুণ ও নবীন ছাপচিত্রশিল্পীরাও এ-দলে আছেন, যেমন – স্বপন কুমার সানা, সুস্মিতা বড়ুয়া, সামিয়া আহমেদ, আনজুম নাহার পর্ণা, জেবা ফারিয়া মিতি ও নাফিয়া তাবাসসুম কৃষ্টি।

ছাপচিত্রের নানা করণকৌশল ও বিভিন্ন মাধ্যম আশ্রয় করে – কাঠখোদাই, লিথোগ্রাফ, এচিং, এচিং-অ্যাকুয়াটিন্টে এসব কাজ করেছেন শিল্পীরা। এ-প্রদর্শনীতে অন্তর্ভুক্ত বেশিরভাগ তরুণের চিত্রকর্ম বাস্তবানুগ ও অ্যাকাডেমিক অনুশীলনধর্মী। তবে অগ্রজ ছাপচিত্রীদের কর্মপ্রয়াসও বিষয়ভিত্তিক। যেমন আনিসুজ্জামান কাজ করেন প্রধানত উডকাটে নগরায়ণের নির্মাণ জটিলতাকে আশ্রয় করে এসবের ইমেজ নিয়ে। তাঁর ঝুলিতে দেশ-বিদেশের অজস্র সাফল্যের সনদ।

মুসলিম মিয়া উডকাটে সাদা-কালোয় প্রাচ্য ঘরানার অংকনরীতিতে প্রেমিক-প্রেমিকার অন্তরঙ্গতাকে তুলে ধরেছেন। জ্যোৎস্না মাহবুবাও অনুরূপ, তবে তাঁর উডকাট চিত্রকর্মে দুটি মোরগ-মুরগি রঙিন আবহে চিত্রিত হয়েছে।

এ এইচ ঢালী তমাল প্রাণী ও পাখি নিয়ে ছাপচিত্রে নানাবিধ নিরীক্ষা করেন। পরিশ্রমী কাজ ও এর শিল্পিত প্রকাশ এবং চিত্রকর্মের চমকপ্রদ গঠনবিন্যাসের জন্য বারকয়েক পুরস্কৃতও হয়েছেন তিনি। এবারে তিনি কাকের ইমেজকে কাছে এনেছেন ও পরিপ্রেক্ষিতের পরিমাপে কাকের অবয়বকে ধূসরতার ধ্যানে ছায়ার মতো স্থাপন করেছেন। তবে তা ছায়া নয়, সাদা-কালোর মায়া জড়ানো।

রুহুল করিম রুমির উডকাট ছাপচিত্রে মানব অবয়বকে ঘিরে বাংলা বর্ণমালার বিস্তার দেখে অনুভব করি বাঙালির ভাষাসংগ্রাম ও আমাদের পূর্বপ্রজন্মের আত্মত্যাগের অনন্য ইতিহাসকে।

ফখরুল ইসলাম মজুমদার শাকিল এচিং-অ্যাকুয়াটিন্টে মানুষের অবয়ব ও তার আবরণনির্ভর ছবি আঁকেন আলোছায়ার নাটকীয়তা সৃজন করে। এতে তাঁর কাজ দৃষ্টিনন্দন হয়ে ওঠে। মিশকাতুল আবীর লিথোগ্রাফ মাধ্যমে ওপর দিকে তাকানো এক পুরুষ অবয়ব ও তার ঊর্ধ্ব সমান্তরালে দুটি প্রস্তরখণ্ড, উভয় পাথরে অঙ্কুরোদ্গমের বারতা দিচ্ছে একটি কুঁড়ি। অ্যাকুয়াটিন্টে আঁকা ফারজানা ববির চিত্রকর্ম জলজ আবহে জন্ম নেওয়া ফুলকলি মাতৃজঠরের অনুভূতির প্রতীক হয়ে উঠেছে যেন। তাঁর আরেকটি চিত্রকর্মের আবহে বাংলা বর্ণমালার প্রয়োগ মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের স্মৃতিকে সশ্রদ্ধায় তুলে ধরে।

কামরুজ্জামান-অংকিত ‘রক্তপাখি’ শীর্ষক দুটি চিত্রকর্ম অসহিষ্ণু সময়ের হানাহানি ও রক্তপাতকে প্রতীকী রূপে তুলে ধরেছে। কামরুননাহার মীম কোভিড অতিমারিতে মানবসম্পর্কের স্বাভাবিক রসায়ন থেকে বঞ্চিত হওয়ার যন্ত্রণাকে ধরেছেন তাঁর চিত্রকর্মে। তানজুম নাহারও প্রতীকাশ্রিত। ঋতুশ্রী দাস একটি টেবিলকে কেন্দ্র করে বসা তিনসঙ্গীর ঊর্ধ্বাঙ্গ ও তাঁদের পায়ের বিপরীত অবস্থান নিয়ে এঁকেছেন ‘আয়না’। উডকাটে সহজ-সাবলীল ভঙ্গিতে পুরনো বাড়ির কাঠামো ও রোয়াক তুলে ধরেছেন ফাইয়াজ হোসেন। শাশ্বতী দে ও নাফিয়া তাবাসসুম উডকাটে দরজা ও সিংহদরজার ইমেজের মধ্য দিয়ে ঐতিহ্যকে তুলে ধরেছেন। রিফাত আল আসিফের চিত্রকর্মে আমরা প্রত্যক্ষ করি দুর্ঘটনায় পতিত একটি বাহনের ক্ষতিগ্রস্ত অবয়ব। এটি যেন চলমান সময়ের অসংলগ্নতার প্রতীক। তেমনই মো. রবিনের সুতাজড়ানো এক উল্টো অবয়ব, নুসরাত জাহানের চিত্রকর্মে জমির দলিলের বুকে কাঁচি ও চশমার ইমেজ এবং অস্তিত্ব প্রকাশে নিত্যানন্দ গাইনের নানা ইমেজ ও প্রতীক চলমান সময়ের অস্থিরতার ইঙ্গিত বহন করছে।

বিপরীতে শান্ত, স্নিগ্ধ জীবনের রূপময়তা, মানুষ ও নিসর্গের আত্মিক বন্ধন প্রতিফলিত হয়েছে রফিকুল ইসলাম, রুবাইয়া জামান, ফাহমিদা সুমনা প্রমুখের বাস্তবানুগধর্মী কাজে।

বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের সংগ্রামে ভাষা-আন্দোলনের ভূমিকা অসামান্য! শিল্পীদের অনেকই সযত্নে নিজেদের অধিকারবোধকে মেলে ধরেছেন তাঁদের সৃজনে, চিত্রপটের বুকে। পলাশবরণ বিশ্বাসের দ্রোহী ষাঁড় যেন সেই ইতিহাসকেই মনে করায়।

গত ১৮ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়েছে এ-প্রদর্শনী। সবমিলিয়ে সার্থক এ-আয়োজনের জন্য সফিউদ্দীন আহমেদ গ্যালারি ও প্রিন্ট স্টুডিওকে অভিবাদন।