আয়তন। এই কথাটিকে এতরকমভাবে কাজে লাগিয়েছে বাঙালি যে, ভেবে কূল পাই না। বাংলা একাডেমির বিবর্তনমূলক বাংলা
অভিধানের প্রথম খণ্ড (ঢাকা, জ্যৈষ্ঠ ১৪২০) খুললাম। দেখি, সাত-সাতটি অর্থ আছে।
প্রথমত, বিস্তার। দ্বিতীয়ত, দেবালয়। তৃতীয়ত, ক্ষেত্রমান, যে অর্থে অংক কিংবা পদার্থবিজ্ঞানের বইয়ে আয়তনের ছড়াছড়ি। চতুর্থত, ঘনফল। পঞ্চমত, পরিসর। ষষ্ঠত, আকার, যে-অর্থের সঙ্গে হামেশাই মিশে যায় আয়তন। সপ্তমত, মাপ। সব অর্থে এখন আর আয়তন কথাটিকে আমরা ব্যবহার করি না। মূলত তৃতীয় ও পঞ্চম অর্থেই এর যেটুকু প্রয়োগ।
স্কুল-কলেজের বদলে শিক্ষায়তন লেখার চল হয়েছিল একসময়। এখন তা কমে এসেছে। আয়তনের আগে মিলন জুড়ে দিয়ে অডিটোরিয়ামের এক অত্যাশ্চর্য বাংলা বের হয়েছিল পাকিস্তান আমলে – মিলনায়তন। পশ্চিমবঙ্গ এটিকে শিরোধার্য করেনি, কিন্তু বাংলাদেশ করেছে। মহাসমারোহে করেছে। আহা! এতে করে শব্দটির বাচ্যার্থ অনেক দিক থেকে সম্প্রসারিত হয়েছে। বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধানের তৃতীয় খণ্ড (ঢাকা, বৈশাখ ১৪২১) খুলে দেখছি মিলনায়তনের অর্থ লেখা হয়েছে – ‘দর্শক-শ্রোতাদের বসা ও অনুষ্ঠান উপভোগের জন্য নির্মিত বিশেষ ভবন বা ভবনের অংশ।’ বেগম পত্রিকার ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের সংখ্যা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখানো আছে ‘কলেজ মিলনায়তনে জাতীয় সাক্ষরতা দিবস অনুষ্ঠানে …’-এর দৃষ্টান্ত। কিন্তু অচলায়তন? বোধকরি রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কেউ এত তীব্রভাবে এই কথাটির প্রয়োগ ঘটাননি। বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধানের প্রথম খণ্ডে এর অর্থ লেখা আছে – ‘রক্ষণশীল প্রতিষ্ঠান’। ঠিকই লিখেছে।
হলফ করে বলতে পারি না, তবে যতদূর ঠাহর হয় অচলায়তন নাটক লেখার কিছুকাল আগে এই কথাটি মাথা খাটিয়ে বের করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। লাগসই প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন শিক্ষা-সংক্রান্ত কোনো কোনো প্রবন্ধে।
অচলায়তন লেখা হয়েছিল ১৩১৮ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে, শিলাইদহে বসে। মাসের মাঝামাঝি প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের কলকাতার বাড়িতে সেটি পড়ে শুনিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সীতা দেবীর স্মৃতিকথায় পাওয়া যায়, ‘পাঠের ব্যবস্থা যে জায়গায় হইয়াছিল, লোক তাহার অতিরিক্ত হইয়া গিয়াছিল। ক্রমাগতই একজনের পর একজন নূতন শ্রোতা আসিতেছেন এবং রবীন্দ্রনাথ আবার গোড়া হইতে আরম্ভ করিতেছেন। ‘অচলায়তন’-এ অনেক গান, সবগুলি তিনি একাই গাহিয়া গেলেন, তবে গলা একটু ভার থাকায় নিচু গলায়ই গাহিলেন।’ ক’মাস বাদে প্রবাসী পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় (আশি^ন ১৩১৮) ছেপে বেরোয় অচলায়তন। বই হয়ে বেরোয় শ্রাবণ ১৩১৯-এ। প্রথম মঞ্চায়িত হয় আরো বছর দুয়েক বাদে, ১৩২০-এর ২৫শে বৈশাখ, শান্তিনিকেতনে, গরমের ছুটির জন্য শান্তিনিকেতনের লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার ঠিক আগে। আচার্য অদীনপুণ্যের (কী ব্যঞ্জনাময় নামকরণ!) ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। ঠাকুরদাদা ওরফে গুরু হয়েছিলেন অমর্ত্য সেনের ঠাকুরদাদা ক্ষিতিমোহন সেন। মহাপঞ্চক জগদানন্দ রায়, পঞ্চক জীবনময় রায়, সুভদ্র সুনীল মজুমদার। এঁদের মধ্যে সুভদ্র ছাড়া সকলেই বিশ্বভারতীতে শিক্ষকতা করতেন।
অচলায়তন যখন লেখা হয়, তখনো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজেনি। তা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমি তো মনে করি আজ য়ুরোপে যে যুদ্ধ বেধেছে সে ওই গুরু এসেছে বলে। তাঁকে অনেক দিনের টাকার প্রাচীর, মানের প্রাচীর, অহংকারের প্রাচীর ভাঙতে হচ্ছে।’ (সবুজপত্র, আশ্বিন-কার্তিক ১৩২৪)।
এই একই প্রসঙ্গে আরেক জায়গায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘দেশের মধ্যে এমন অনেক আবর্জনা স্তূপাকার হইয়া উঠিয়াছে যাহা আমাদের বুদ্ধিকে, শক্তিকে, ধর্মকে চারিদিকে আবদ্ধ করিয়াছে। সেই কৃত্রিম বন্ধন হইতে মুক্তি পাইবার জন্য এদেশে মানুষের আত্মা অহরহ কাঁদিতেছে। সেই কান্নাই ক্ষুধার কান্না, মারীর কান্না, অকালমৃত্যুর কান্না, অপমানের কান্না। সেই কান্নাই নানা নাম ধরিয়া আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে এমন একটা ব্যাকুলতার সঞ্চার করিয়াছে, সমস্ত দেশকে নিরানন্দ করিয়া রাখিয়াছে এবং বাহিরের সকল আঘাত সম্বন্ধেই তাহাকে এমন একান্তভাবে অসহায় করিয়া তুলিয়াছে। ইহার বেদনা কি প্রকাশ করিব না? কেবল মিথ্যা কথা বলিব এবং সেই বেদনার কারণকে দিনরাত্রি প্রশ্রয় দিতেই থাকিব?’
যে বিদ্রোহের সুর বাজছে এইসব উচ্চারণে, অচলায়তনের একেবারে গোড়াতেই তা খোলাসা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
মহাপঞ্চক ॥ গান! আবার গান।
পঞ্চক ॥ দাদা, তুমি তো দেখলে – তোমাদের এখানকার মন্ত্রতন্ত্র আচার-আচমন সূত্র-বৃত্তি কিছুই পারলুম না।
মহাপঞ্চক ॥ সে তো দেখতে বাকি নেই; কিন্তু সেটা কি খুব আনন্দ করবার বিষয়? তাই নিয়ে কি গলা ছেড়ে গান গাইতে হবে?
পঞ্চক ॥ একমাত্র ওইটেই যে পারি!
মহাপঞ্চক ॥ পারি! ভারি অহংকার। গান তো পাখিও গাইতে পারে। সেই যে বজ্রবিদারণ-মন্ত্রটা আজ সাত দিন ধরে তোমার মুখস্থ হলো না, আজ তার কী করলে?
পঞ্চক ॥ সাত দিন যেমন হয়েছে অষ্টম দিনেও অনেকটা সেইরকম। বরঞ্চ একটু খারাপ।
মহাপঞ্চক ॥ খারাপ! তার মানে কী হলো?
পঞ্চক ॥ জিনিসটা যত পুরোনো হচ্ছে মন ততই লাগছে না, ভুল ততই করছি, ভুল যতই বেশিবার করছি ততই সেইটেই পাকা হয়ে যাচ্ছে। তাই, গোড়ায় তোমরা যেটা বলে দিয়েছিলে আর আজ আমি যেটা আওড়াচ্ছি, দুটোর মধ্যে অনেকটা তফাৎ হয়ে গেছে। চেনা শক্ত।
মহাপঞ্চক ॥ সেই তফাৎটা ঘোচাতে হবে নির্বোধ।
পঞ্চক ॥ সহজেই ঘোচে যদি তোমাদেরটাকেই আমার মতো করে নাও। নইলে, আমি তো পারব না।
নাটকটি সমাদর পেয়েছিল। বিশেষ করে গ্রুপ থিয়েটারের প্রগতিশীল মহল্লায়। পঞ্চাশের দশকে কলকাতায় এ-নাটকের প্রযোজনা করেছিল লিটল থিয়েটার গ্রুপ, উৎপল দত্তের নির্দেশনায়। সেটি সার্থকতা পায়নি। বাংলাদেশের বুকে এ-নাটকের একটি স্মরণীয় রূপায়ণ ঘটিয়েছিল নাগরিক, ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে, আলী যাকেরের নির্দেশনায়। কেবল ৭০টি মঞ্চায়ন হয়েছিল বা দেশের বাইরে পা রেখেছিল বলে নয় (এই সমালোচক নাগরিকের অচলায়তন দেখেছিলেন ১৯৯৫-তে, কলকাতার একাডেমি অব ফাইন আর্টসে), নাগরিকের সেই প্রযোজনার একটি রাজনৈতিক গুরুত্বও ছিল। স্মারক পুস্তিকায় নাগরিক লিখেছিল, ‘নিষেধের বেড়ায় আবদ্ধ এক অচলায়তনে আমাদের বাস। আলো, হাওয়া এবং প্রাণস্পন্দন বিবর্জিত আরও নৃশংস এক অচলায়তন আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে।’ তৎকালীন বাংলাদেশকে ‘নৃশংস এক অচলায়তন’ বলে চিহ্নিত করার মধ্যে যে স্পর্ধা ও দার্হ্য ফুটে উঠেছিল তা ওই প্রযোজনার সবকটি শাখা-প্রশাখায় সঞ্চারিত হয়েছিল। ‘রবীন্দ্রনাথ-এর কাছে আমাদের অপরিশোধ্য ঋণ লাঘব করার অকিঞ্চিৎকর প্রচেষ্টায় নিবেদিত’ এই প্রযোজনা ‘আজকের অচলায়তনকে ধুলোয় লুটিয়ে দিয়ে এক মুক্ত, বিস্তৃত এবং কর্মময় পৃথিবী সৃষ্টিতে আমাদের আগ্রহী করুক’ – এই ছিল নাগরিকের কামনা। সামরিক শাসকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এমন মঞ্চায়ন বাংলাদেশের বুকে ছড়িয়ে পড়া গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের ভেতরে ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা বিপ্লববাসনারই স্বীকৃতি ছিল।
সহযোগী কোনো কোনো দল যে এই বিপ্লববাসনায় শরিক হয়েছিল তা বোঝা যায় ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা থিয়েটার প্রকাশিত মঞ্চপত্রের প্রথম সংখ্যায়, ‘হাসতে হাসতে দেয়াল ভাঙ্গে দাদাঠাকুর’ শিরোনামে একটি সংলাপে। তাতে নাসির উদ্দীন
ইউসুফ বলেছিলেন, ‘এখন সারাদেশে পেট্রো মুদ্রার শাসন। রাজনৈতিকভাবে রবীন্দ্রনাথকে হিন্দু লেখক বলে নির্বাসিত করার পাকিস্তানি রীতির চেষ্টা হচ্ছে। দেশের উগ্র সাম্প্রদায়িক আবহাওয়ার মধ্যে আমাদের ঐতিহ্য চেতনা আবার বিভ্রান্ত হতে চলেছে। অগ্রগামী জনসাধারণের মধ্যে মধ্যযুগীয় বর্বরতার বিষ ছড়ানো হচ্ছে। তাই এ মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথের নাটক মঞ্চায়ন মানেই একটি সুস্থ সামাজিক চেতনাসম্পন্ন জনগোষ্ঠীকে তাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের প্রতি বিশ্বাস ও ভালোবাসা জানাতে সাহায্য করা।’ ঢাকা থিয়েটার তখন ঔপনিবেশিক নাট্যনন্দনের কবল থেকে বেরিয়ে এসে জাতীয় নাট্য-আঙ্গিকের খোঁজ শুরু করেছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিকের অচলায়তনকে স্বাগত জানিয়েছিল তারা। কারো কারো মনে থাকতে পারে যে, রাবীন্দ্রিক বয়ান থেকে সরে এসে শোণপ্রাংশুদের মুখে সাঁওতালি জবান তুলে দিয়েছিলেন আলী যাকের। এটি আমাদের চমকে দিয়েছিল। নাখোশ ছিলেন সেলিম আল দীনও। বরং শোণপ্রাংশুদের মধ্যে নারী চরিত্র বুনে দিয়ে যে-অদলবদল ঘটিয়েছিল নাগরিক, সেটি ঢাকা থিয়েটারের পছন্দ হয়েছিল। নাগরিকের প্রযোজনার আসল সাফল্য কোথায়? নাসির উদ্দীন জবাব খুঁজেছিলেন ‘সমকালীন সমাজ ও সংস্কৃতির মধ্যে’। বলেছিলেন, ‘দাদাঠাকুর হাসতে হাসতে দেয়াল ভেঙেছেন। কিন্তু বাঙালি মুসলমানদের সৃষ্ট সমকালীন অচলায়তন কে ভাঙবে? তাদের ত শুধু একশ বছর লেগেছে বুঝতে যে তাদের আদত মাতৃভাষা কোনটি। এই বাংলাদেশে কত রঙ্গের মহাপঞ্চক এল আর গেল। একেকটি অচলায়তন ভেঙে ফেলে অস্থির ও রাগী পঞ্চকেরা। তারপর আবার গড়ে ওঠে। কিন্তু সময় এসেছে। শ্রাবণের গরুড় মেঘ পাখা মেলেছে, অচলায়তন আবার ভাঙবে। শেষ ভাঙা।’ খেয়াল করুন, ‘শেষ ভাঙা’ উচ্চারণের মধ্যেও সেই বিপ্লববাসনা বহ্নিমান ছিল।
তারপর, আরো চার দশক কেটে গেছে। বিপ্লব আসেনি। তা বরং সুদূরপরাহত।
তা সত্ত্বেও, সেই নাগরিকেরই (ও সহযোগী মঙ্গলদীপ ফাউন্ডেশনের) প্রণোদনা নিয়ে অচলায়তনের যে নবায়ন করেছেন প্রাচ্যনাট (উদ্বোধনী মঞ্চায়ন ২৬শে জানুয়ারি ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ), তারও মূলে সেই বিপ্লববাসনা এবং সমকাল নিয়ে খরশান এক মন্তব্য করার দায় টের পাওয়া গেল।
কেন অচলায়তন, এ নিয়ে প্রাচ্যনাটের নির্দেশক আজাদ আবুল কালাম এই প্রযোজনার স্মারক পুস্তিকায় লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তত্ত্বনাটক, প্রতীকী নাটক নিয়ে বড় বড় সমালোচকদের যে অস্পষ্টতার অভিযোগ তাকে খণ্ডন করে আমাদের অচলায়তন মঞ্চায়নের প্রয়াস স্পষ্ট এবং প্রতীকের ব্যবহার যথার্থ রূপে প্রকাশের ইচ্ছা কেবল।’ নজরটান দিই ‘স্পষ্ট’ কথাটিতে। প্রাচ্যনাট এর আগে, প্রায় দেড় দশক আগে, রবীন্দ্রনাথের আরেকটি তত্ত্বনাটক করেছিল – রাজা। তাতেও প্রতীকের আড়াল খসিয়ে দুনিয়া জুড়ে কায়েম হতে চাওয়া মার্কিন আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে জোরালো সওয়াল ছিল। এবারের প্রযোজনায় বিশ্বরাজনীতির বদলে ঝোঁক পড়েছে বাংলাদেশের অন্দরমহলে। আজাদ আরো বলেছেন, ‘অচলায়তন বিদ্যাপীঠকে আমরা কল্পনা করেছি একটি বালিকা বা নারী শিক্ষাগৃহ হিসেবে। আমাদের মতো পশ্চাৎপদ এবং ধর্মীয়-সামাজিক চিন্তায় অন্যতম প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী নারী।
নারীকে কুসংস্কার আর নানা বিধিনিষেধের মধ্যে আটকে রাখার নানান ষড়যন্ত্র বিদ্যমান এবং কখনো কখনো সেই ষড়যন্ত্রে নারী নিজেও যেন প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।’
২০২৩-এর ২৬শে জানুয়ারি সন্ধ্যায় জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে ঢুকে ডিপ সেন্টারস্টেজে জগদ্দল পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকা একটি দরজা আর তাকে ঘিরে থাকা ইটের দেয়াল দেখে মনে হয়েছিল, এই সেই লক্ষ্যবস্তু যাকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার মধ্যেই এই প্রযোজনার চাবিকাঠি।
নাটক শুরু হতেই দৈববাণীর মতো ভেসে এলো, ‘যদা যদা হি ধর্ম্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত’। তাতে যে সুরটি সংযোজিত সেটি আমাদের চেনা। আশির দশকের শেষদিকে ভারতের টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ও বি আর চোপড়া নির্দেশিত সিরিয়াল ‘মহাভারত’-এর টাইটেল ট্র্যাক ঠিক এইভাবেই গেয়েছিলেন মহেন্দ্র কাপুর। ঠিক ওইভাবেই বাজনা বেজেছিল। অধুনা এই উপমহাদেশজুড়ে ধর্মীয় জুজুর যে বাড়াবাড়ি তাতে ইন্ধন জুগিয়েছিল এই টেলিভিশন সিরিয়াল। আমাদের কপালে ভাঁজ পড়ল। শুধু ওই অনুষঙ্গ মাথায় খেলে গেল বলে নয়, এ তো গীতার চতুর্থ অধ্যায়ের সেই বহুচর্চিত শ্লোক, যাতে অবতারতত্ত্বের প্রবল প্রকাশ! শুধু তো শোনা নয়, আবছা আলোয় এক শক্তসমর্থ জোয়ানকে মঞ্চে দেখছি, যিনি সুদর্শন চক্র হাতে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন এবং সর্বোপরি ‘ধর্ম্মসংস্থাপনার্থায়’ প্রকট হয়েছেন। প্রমাদ গুনলাম। আজাদ আবুল কালাম কি আমাদের ‘সম্ভোবামি যুগে যুগে’র নিয়তিবাদী নিশ্চয়তার দিকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছেন? আলোর বদলে আরো অন্ধকার? তা কী করে হয়!
খানিক বাদে আলো ফুটল।
পশ্চিমি রক সংগীতের আদলে ঢালাই করে অচলায়তনের অচলামন্ত্র ‘তট তট তোতয় তোতয় স্ফট স্ফট স্ফোটয় স্ফোটয়’ শোনা গেল (স্মারক পুস্তিকায় দেখলাম এ-গান বেঁধেছেন গোপী দেবনাথ), আর তার সঙ্গে কতক তাসের দেশ-এর নাগরিকদের মতো আড়েঠারে নড়েচড়ে যাঁরা মঞ্চ জুড়ে নাচতে এলেন তাঁরা সবাই নারী (নৃত্যনির্মাতা হিসেবে নাম আছে স্নাতা শাহ্রিনের)। নর্তকীদের পরনে কালো পোশাক – কালো স্ন্যাকসের ওপর ঢিলেঢালা কালো কামিজ। স্বচ্ছ হিজাবে ঢাকা তাঁদের মুখ। ধর্মীয় কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী নাকি? আমাদের চটকা ভাঙল। পরমুহূর্তেই মালুম হলো যে নর্তকীদের গায়ে কালো ওড়নার বদলে জড়ানো আছে গেরুয়া উত্তরীয়। অর্থাৎ, সনাতনে-ইসলামে এক ধরনের মিলমিশ ঘটিয়ে দিয়েছেন এ প্রযোজনার পরিচ্ছদ পরিকল্পক আফসান আনোয়ার। এই নাচগানের মধ্যে দিয়ে আমরা ঢুকে পড়লাম অচলায়তনের দেশে। এমনিতে অচলায়তনের সঙ্গে ডাকঘর, ফাল্গুনী, মুক্তধারা, রক্তকরবী, রাজার অনেক মিল। ফারাক যা আছে তা ধর্মীয় সংস্কারের নিগড়ে বাঁধা ওই শিক্ষায়তনের আবহাওয়ায়। শান্তিনিকেতনের মতো স্কুল তৈরি করার পর রবীন্দ্রনাথ যে আরো তেড়েফুঁড়ে ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থাকে এক হাত নেবেন, তোতা কাহিনীর মধ্যে তার এক রকম হদ্দমুদ্দ দেখি আমরা। অচলায়তনে রবীন্দ্রনাথের চাঁদমারিতে আছে যে ধর্মশিক্ষা তাতে মঠ-মন্দিরের দিকে তির তাক করা থাকে। আজাদ আবুল কালাম সেই তিরের নিশানা যেন ঘুরিয়ে দিলেন ধর্মীয় ভাবধারাবাহী শিক্ষায়তনগুলির দিকে। এর মধ্যে কোনো প্রাক-ঔপনিবেশিক সূত্র রইল না, রইল দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতা, যেখানে রাজনীতি ও ধর্মব্যবসা হাত ধরাধরি করে চলতে চায়। শিক্ষায়তন ওই প্রতাপান্বিত অক্ষের অনুগামী তো বটেই, জোগানদারও বটে।
মিনিট খানেকের মধ্যে ফের রং বদলাল মঞ্চের।
বাঁশিতে ভেসে এলো পিলুর সুর। তাতে জুড়ে গেল খঞ্জনীর আওয়াজ। নীল কামরুলের সংগীত ভাবনায় সমবেত কণ্ঠের যে ঐকতান তৈরি হলো, তাতে ভর দিয়ে পাখির মতো উড়তে উড়তে মঞ্চের দখল নিল এ-নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র পঞ্চক (সানজিদা প্রীতি)। মুখের আঁচল খুলে ফেললেন অভিনেত্রীরা। হাতে তাদের লাল শালুতে মোড়া পুঁথি। উইংসের আড়াল থেকে নারীকণ্ঠে গান চলতে
থাকল – ‘তুমি ডাক দিয়েছ কোন সকালে/ কেউ তা জানে না’। গান যত এগোল, পঞ্চকের সঙ্গে অচলায়তনের আর-পাঁচজন ছাত্রীর তফাৎ বেড়ে চলল। বেড়েই চলল।
তিন-চার মিনিটের মধ্যে অচলায়তন-এর বিরোধাভাসকে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে চিনিয়ে দিলেন আজাদ আবুল কালাম। আমরা ভুলে গেলাম ‘সম্ভোবামি যুগে যুগে’র আধ্যাত্মিক ব্যঞ্জনার কথা। ৮০ মিনিটের এই নিপুণ নির্মাণে এমন অসংখ্য স্মরণীয় মুহূর্ত রচনা করেছেন নির্দেশক। নাটক যে প্রকৃত প্রস্তাবে দৃশ্যকাব্য, তাতে চিত্তপট আর দৃশ্যপট যে একে-অপরের পরিপূরক, সেই উপলব্ধি ক্রমে গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থেকেছে। এর পারফরম্যান্স স্ক্রিপ্ট কখনো আমাদের নাগালে এলে আরো নিবিড় পাঠের সুযোগ মিলবে। আপাতত এই নাটকের মোদ্দা কথার খেই ধরে দু-তিনটি প্রসঙ্গের অবতারণা করা যাক।
অচলায়তনে আছে তিনটি দেশের কথা। পড়শি তিন দেশ। একটির নাম স্থবিরপত্তন। নামেই বেবাক স্পষ্ট যে এ-দেশের প্রতি নাটককারের কোনো দরদ নেই। সে-দেশের রাজা (জাহাঙ্গীর আলম/ জগন্ময় পাল) কতক উত্তর রামায়ণ-এর রামের মতো। ব্রাহ্মণ্যবাদের ধামাধরা ক্ষত্র প্রতাপের প্রয়োগশালা এখানকার রাষ্ট্রব্যবস্থা। এই রাজারই অনুগ্রহে চলে অচলায়তন। তার মাথায় আছেন আচার্য (চেতনা রহমান ভাষা)। আচার্যের নিচের ধাপে আছেন উপাচার্য (তৌফিকুল ইসলাম ইমন/ শাহেদ আলী), উপাধ্যায় (সাহানা ইসলাম সুমি/ পারভীন পারু) এবং অচলায়তনের পণ্ডিতপ্রবর মহাপঞ্চক (সাখাওয়াত হোসেন রেজভী/ ফরহাদ হামিদ)। আছেন আরো অনেকে এবং শিক্ষার্থীকুল। শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমের জন্য বাঁধা এই নাটকে অচলায়তনে কেবল ছাত্রই রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আজাদ যে নবায়ন ঘটালেন তাতে ছাত্রের বদলে ছাত্রীদের পেলাম। জেন্ডার রিভার্সালের এই সচেতন প্রয়োগে নানা আচ্ছাদনে ঢাকা পড়ে যাওয়া শিক্ষার্থীর মুখ অসহায় ফুটে উঠল। আচার্যকে নারী চরিত্র করে (যে চরিত্রে খোদ রবীন্দ্রনাথ অভিনয় করতেন) মেয়েদের ধর্মীয় শিক্ষার আদল আরো প্রকট করে তুললেন আজাদ।
দ্বিতীয় দেশের কোনো আলাদা নাম নেই। আলাদা নাম নেই সেখানকার মানুষদের। সকলেই শোণপ্রাংশু। খুঁটিয়ে দেখলে ‘শোণ’-এর মধ্যে রক্তের সম্বন্ধ পাব আমরা। পাব শ্রমের সম্বন্ধ। এই শোণপ্রাংশুদের মধ্যে পাব কৃষিজীবী কর্মকার নিষাদ জাতিকে। অচলায়তনের সবাই এদের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলেন।
তৃতীয় দেশের নাম দর্ভকপল্লী। এখানেও শ্রমজীবীদের বাস। সামাজিকভাবে তাঁরা আরো পতিত। অন্ত্যজ। এই তিন দেশের নানান কিসিমের মুলাকাত আর মোকাবিলা নিয়েই অচলায়তন। এঁদের মধ্যে মিলেমিশে থাকে যে দুরন্ত প্রাণ তার নাম পঞ্চক। আর একজন আছেন (প্রদ্যুৎ কুমার ঘোষ, এ কে এম ইতমাম), তাঁকে কেউ গুরু বলে ডাকে, কেউ চেনে দাদাঠাকুর নামে, কারো কাছে তিনি গোঁসাই। পঞ্চকের ইন্ধন পেয়ে, গুরু-দাদাঠাকুর-গোঁসাইয়ের মদতে কীভাবে ভেঙে চুরমার হলো অচলায়তন, কীভাবে শুরু হলো ‘ভাঙা ভিতের উপর আবার’ গাঁথুনির কাজ, এই নিয়েই রবীন্দ্রনাথের নাটক।
জেন্ডার রিভার্সালের জায়গাটুকু বাদ দিলে মূল নাটক থেকে তেমন সরে যাননি আজাদ। দরকারমাফিক ছেঁটেকেটে নিয়েছেন মূল পাঠ। প্রথম অংক মোটের ওপর অকর্তিত আছে। আচার্য পঞ্চককে বলেছেন, ‘তোমাকে যখন দেখি আমি মুক্তিকে যেন দেখতে পাই। এত চাপেও যখন দেখলুম তোমার মধ্যে প্রাণ কিছুতেই মরতে চায় না তখনই আমি প্রথম বুঝতে পারলুম মানুষের মন মন্ত্রের চেয়ে সত্য, হাজার বছরের অতিপ্রাচীন আচারের চেয়ে সত্য।’ এই বাংলা আমাদের রোজকার বাংলার চেয়ে একটু হলেও আলাদা, অথচ সেকেলে নয়। এর থেকে যে আলো ঠিকরে বেরোয়, তা এখনো আমাদের চেতনার দরজায় নাড়া দেয়। তাই একটুও পালটানো হয়নি সংলাপ। নির্দেশকের প্রেরণা পেয়ে রবীন্দ্রসংলাপের এই আশ্চর্য দ্যুতি চিনেছেন প্রাচ্যনাটের অভিনেতৃ সঙ্ঘ, চিনিয়েছেন আমাদের।
অচলায়তনের যে কয়েকটি প্রযোজনা এই সমালোচক গত দু-তিন দশকে দেখেছেন (শান্তিপুর সাংস্কৃতিকের প্রযোজনা, কৌশিক চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশনায়; পঞ্চম বৈদিকের প্রযোজনা, অর্পিতা ঘোষের নির্দেশনায়), তাদেরও নির্ভরতা ছিল সংলাপের ওপর। কিন্তু তারা প্রায় বাদ দিয়েছিলেন গানের দিক, নাচের দিক। অথচ অচলায়তন সেই জাতের নাটক যা গীতিনাট্য আর সংলাপবহুল নাট্যরূপের মাঝ বরাবর পথ কাটার প্রয়াস পেয়েছিল। প্রাচ্যনাটের এই প্রযোজনা পেরেছে রবীন্দ্রনাট্যের ওই সামগ্রিক দর্শনকে আমাদের সামনে উপস্থাপন করতে। শান্তিনিকেতনের মাটিতে রবীন্দ্রনাটক দেখার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা দেখে বলতে পারি, নান্দনিকতার নিরিখে কোনো অংশে কমজোরি নন প্রাচ্যনাটের কুশীলবকুল। বরং পরম্পরার যে ভার বয়ে চলতে হয় সংগীতভবনের ইদানীংকালের সব প্রযোজনাকে, তার দায় চুকোনোর নেই বলে আধুনিকতার নানান মাত্রা জুড়তে জুড়তে গেছে প্রাচ্যনাটের অচলায়তন। দুটি উদাহরণ দেওয়া যাক। পঞ্চক-শোণপ্রাংশু সংবাদের মধ্যে ‘আমরা চাষ করি আনন্দে’ আর ‘কঠিন লোহা কঠিন ঘুমে ছিল অচেতন’ এই দুটি গান জুড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আজাদ এই দুটি গানকে কেবল শিরোধার্য করলেন না, অচলায়তনের তোলন-নামন-পিছন-সামন সংস্কৃতির একেবারে উল্টো খাতে বইয়ে দিলেন। শোণপ্রাংশুদের পায়ে লাগিয়ে দিলেন রোলার স্কেটস (সৌজন্যে স্কেটিং ৭১-এর জিহাদ হোসেন ও প্রশিক্ষক শামীম)। মঞ্চ জুড়ে প্রবল গতিতে ‘আমরা চাষ করি আনন্দে’র সঙ্গে নেচে বেড়ালেন তাঁরা। কতক হ্যারি পটারের ব্রুমস্টিকের মতো লম্বা হাতলওয়ালা ঝাঁটা হাতে মঞ্চ জুড়ে দাপিয়ে বেড়ালেন। ‘কঠিন লোহা কঠিন ঘুমে ছিল অচেতন’-এ ঝাঁটার বদলে তাঁদের হাতে উঠে এলো লোহার নল। নলে নলে ঠোকাঠুকি করে সে-গানের আবহ বানিয়ে দিলেন নীল কামরুলের দলবল। ‘দলবল’
কথাটি জরুরি, কারণ যাঁরা মঞ্চে দাপালেন, তাঁদের অনেকেই উইংসের আড়ালে দিয়ে মাইক্রোফোনের সামনে বৃন্দগানে গলা মেলালেন। নাটকের শেষের দিকে ‘আলো আমার আলো’ গানের সূত্রে যে স্মিগ্ধ উদার পরিমণ্ডল রচনা হলো তাতে কুশীলবকুল তো বটেই, মো. সাইফুল ইসলামের আলোক পরিকল্পনা ও নৃত্যনির্মাতা স্নাতা শাহ্রিনের যুগলবন্দি প্রবল সহযোগ দিলো। সবকিছুকে জড়িয়ে রইল এক অদম্য স্ফূর্তি, যাকে ‘এনার্জি’ বলে দায় সারবার চল হয়েছে আজকাল।
স্ফূর্তির সঙ্গে স্পর্ধার সমঝোতা চিরকালের। প্রাচ্যনাটের নির্দেশক এই সমঝোতা জানেন বিলক্ষণ। প্রাচ্যনাটের নানান প্রযোজনায় তার হরেক আন্দাজের স্ফুরণ দেখেছি আমরা। অচলায়তনের শেষে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া পাঁচিলের পটভূমিতে যে অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটালেন আজাদ, তা বিশদে না বললে অন্যায় হবে। এক হাতে রবীন্দ্রনাথের নাড়ি ধরে, অন্য হাতে পিঙ্ক ফ্লয়েডের ‘উই ডোন্ট নিড নো এডুকেশন’ (১৯৭৯)-এর খেই ধরলেন। গানটির মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে এক কথায় উড়িয়ে দেওয়ার হিম্মত ছিল, যে-শিক্ষা আদপে শিক্ষার্থীকে গলা টিপে মারে তাকে অগ্রাহ্য করার মুরোদ ছিল। সমবেত কণ্ঠে গানটি গাওয়া হতে থাকল। মঞ্চের দখল নিলেন তারুণ্যে ভরপুর এ-নাটকের কুশীলবকুল। তারপর? হঠাৎ ডাউনস্টেজে এসে ঝুঁঁকে লম্বাটে একটি ব্যানার হাতে তুলে দিলেন তাঁরা। তাতে রোমান হরফে লেখা – উই ডোন্ট নিড নো এডুকেশন। সমকালীন বাংলাদেশের শিক্ষানীতি, বিশেষ করে শিক্ষায়তনে মৌলবাদী অনুশাসনের নজরদারি নিয়ে শিল্পী-বুদ্ধিজীবী মহলে যে বিক্ষোভ জমা বেঁধেছে, তার এই আকস্মিক উদ্গিরণ আমাদের হকচকিত করে দিলো। ২৬শে জানুয়ারি সন্ধ্যায় টইটম্বুর জাতীয় নাট্যশালা যে উচ্ছ্বাস দেখাল এই দৃশ্যায়নে, তা বারুদের স্তূপের অস্তিত্ব জানান দিয়েছিল। এই সমালোচক এই প্রযোজনা দ্বিতীয়বার দেখেছিলেন ১১ই জুন সন্ধ্যায়, ওই একই মিলনায়তনে। সেদিন উচ্ছ্বাস কিছু কম ছিল বটে, তবে আরো ধারালো লেগেছিল প্রাচ্যনাটের উপস্থাপন।
এক বছরে ন’বার মঞ্চস্থ হয়েছে প্রাচ্যনাটের অচলায়তন। সংখ্যাটি উৎসাহব্যঞ্জক নয়। এমন উচ্চাশী প্রযোজনাকে বহন করে নিয়ে যাওয়ার কিছু বাস্তব অসুবিধা আছে, এও আমাদের অজানা নয়। তবু আমরা বিশ্বাস করি, এই প্রযোজনার নান্দনিক ও রাজনৈতিক সৌকর্য তার মঞ্চায়নের শিথিলতাকে আড়াল করে দেবে।
যূথবদ্ধতার যে অনায়াস প্রকাশ অচলায়তন-এ দেখেছি, তাতে করে কোনো একজনকে অবিস্মরণীয় বললে অন্যদের প্রতি খানিক অবিচার করা হয়। তবু বলতেই হবে শারমিন প্রীতির নাম। পঞ্চক চরিত্রে যে একবগ্গা ধরন আছে, যে প্রতিস্পর্ধী বুনোট আছে, তা যে-কোনো অভিনেতার জন্য ড্রিম রোল। রক্তকরবীর নন্দিনী বা তাসের দেশ-এর রাজপুত্রের সঙ্গে তুলনীয়। শারমিন প্রীতি এ-চরিত্রের সব দাবি-দাওয়া মিটিয়েছেন। চোখের তারার রুপোলি ঝিলিকে, কণ্ঠশীলনের সহজ অভিব্যক্তিতে তো বটেই, শরীরী ভাষার সুরম্য উপস্থাপনায়ও। নাহ, কোটি জন্মান্তরে এমন রূপায়ণ ভুলব না।
এই আলোচনা গুটিয়ে আনার আগে একটি কাগুজে খবরে চোখ রাখি। ২৬শে সেপ্টেম্বর, ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের আনন্দবাজার পত্রিকায় এই খবর বেরিয়েছিল। ‘রবীন্দ্রনাথের অচলায়তন’ – এই শিরোনাম এঁটে। খবরটি এরকম – গত ১২ই সেপ্টেম্বর শুক্রবার সন্ধ্যা ৬ ॥ ০টায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে ইডেন হিন্দু হোস্টেলের ছাত্রদের মিলনোৎসব সম্পন্ন হইয়া গিয়াছে। হোস্টেলের ভূতপূর্ব ছাত্রদের এবং অনেক সম্ভ্রান্ত ও সম্মানিত ব্যক্তিদের নিমন্ত্রণ করিয়া আনা হইয়াছিল। ৬-৩০ মিনিটে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ কালো জোব্বায় সর্ব্বাঙ্গ আবৃত করিয়া উৎসব মণ্ডপে উপস্থিত হন। কবীন্দ্রকে মাল্যভূষিত করিবার পর ৬-৪৫ মিনিটে উৎসবের কার্য্য আরম্ভ হয়। শ্রীযুক্ত দিলীপকুমার রায় ‘নীল আকাশের অসীম ছেয়ে ছড়িয়ে গেছে চাঁদের আলো’ এই গানটি গাহিয়া উৎসবের উদ্বোধন করেন। পরে ‘মিছে তুই ভাবিস মন – তুই গান গেয়ে যা অকারণ’ এই গানটিও গান। হোস্টেলের খেলাধুলার পুরস্কার বিতরণের পর রবীন্দ্রনাথ সভাপতির মন্তব্য উচ্চারণ করিতে দণ্ডায়মান হন। বক্তৃতার পরেই কবিগুরু সভামণ্ডপ পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যান এবং অচলায়তন অভিনয় আরম্ভ হয়।
স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি থেকে থিয়েটার যখন বিদায় নিয়েছে বলেই শোনা যায়, তখন একশ বছর আগে একটি কলেজ হোস্টেলে এই নাটকের মঞ্চায়ন হয়েছিল, এবং সেই অনুষ্ঠানে স্বয়ং নাটককার উপস্থিত ছিলেন, এমন খবর আমাদের যেমন উত্তেজিত করে, তেমন নৈরাশ্যও দেয়। শিক্ষায়তনের যে অচলাবস্থা কাটানোর লক্ষ্যে এই নাটক বেঁধেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তা আরো সর্বগ্রাসী চেহারা নিয়ে আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। প্রাচ্যনাটের এই প্রযোজনা যদি আমাদের সতর্ক না করে, সঠিক অবস্থান নিতে প্রণোদিত না করে, তবে বাঙালির ভাগ্যাকাশে ঘোরতর ঘনঘটা ঘনিয়ে আসবে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.