শিল্পের শরীরে নতুন রক্ত সঞ্চারের কর্তব্যটি প্রধানত সম্পাদন করে থাকেন তরুণ শিল্পীরা। নতুন কিছু করার প্রবল আগ্রহে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে স্পর্ধিত তারুণ্য শিল্পের শরীরে যোগ করে নতুন নতুন মাত্রা। নতুন ধ্যানে ও ধারণায় তৈরি হয় শিল্পের বিচিত্রপথ। প্রচলিত ধ্যান-ধারণার ভেতর থেকে নতুন কিছু বের করে আনার প্রয়াসই তো তারুণ্যের শক্তি।
গেল মাসে ‘আনুগত্য’ শিরোনামে তরুণ শিল্পীদের দলগত একটি চিত্র-প্রদর্শনীর আয়োজন হয়েছিল ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের জুম গ্যালারিতে। শিল্পের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ তরুণদের আনুগত্য ফুটে উঠেছে এ-শিল্পায়োজনে। এই দলে আছেন – চারুশিল্পের তরুণ শিক্ষক, মুক্তশিল্পী ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী-শিল্পী। প্রদর্শনীর উদ্যোক্তা লেকি আর্ট ফাউন্ডেশন। পোলিশ এই শব্দের অর্থ হলো – অগ্রসরমান, প্রগতিশীল, স্পষ্টবাদী ও স্বাধীনচেতা। শিল্পচর্চা ও তার প্রসারের মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টি ও উন্নত রুচির বিকাশ ঘটানোর প্রয়াসে গত এক বছর ধরে সংগঠনটি কাজ করে চলেছে।
পনেরো জন তরুণ শিল্পীর এই দলটির কাজগুলো ভিন্ন ধরনের, যেখানে একে অপরকে অতিক্রম করে বিভিন্ন হয়ে ওঠার আগ্রহ পরিলক্ষেত হয়েছে। প্রায় পরিণত শিল্পভাবনা ও বোধের সঙ্গে তুলনামূলক নবীন শিল্পীর বিকাশমান চৈতন্যের বোঝাপড়ার ক্ষেত্র তৈরি করেছে এই যূথবদ্ধতা। শিল্পীরা হলেন – মাহবুব আলম, ইকবাল বাহার চৌধুরী, এসএম এহসান, কুন্তল বাড়ৈ, পারভেজ হাসান রিগান, প্রদীপ সাহা, নাবিলা নবী, নবরাজ রায়, শারমিন আক্তার লীনা, বাপ্পি লিংকন রায়, প্রিতম প্রিতু, রাজিন মুসত্মাফা দীপ্র, জাকিয়া আফরোজ, সাজিয়া রহমান সন্ধ্যা ও নাসরিন জাহান অনিকা। প্রদর্শনীতে সব শিল্পীর দুটি করে মোট ত্রিশটি চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে।
প্রদর্শনীর চিত্রকর্মগুলো ছোট ও মাঝারি আকৃতির। মাধ্যমও ভিন্নভিন্ন। কাগজে-ক্যানভাসের চিত্রপটে জলরং, তেলরং, অ্যাক্রিলিক ও মিশ্রমাধ্যমে ছবি এঁকেছেন শিল্পীরা। ট্যাপেস্ট্রি মাধ্যমের কাজও আছে। সমকালীন চিত্রকলার নানা প্রবণতা এসবে। অবয়বিক চিত্রের পাশাপাশি নিসর্গনির্ভর কাজও এখানে ঠাঁই পেয়েছে। বাস্তবানুগ কাজের পাশে প্রকাশবাদী বিমূর্ততারও দেখা মিলেছে। তেমনি কারো কারো চিত্রকর্মে নানা নিরীক্ষার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। আমাদের
সংস্কৃতি ও কৃষ্টির ভাবদর্শনও প্রতিফলিত হয়েছে কতক শিল্পীর চিত্রপটে।
শিল্পী মাহবুব আলম কাগজের চিত্রপটে কালো কালিতে স্বচ্ছন্দ ও গতিময় তুলি চালনায় বৃক্ষশোভিত দুটি ভূদৃশ্য এঁকেছেন। সাধারণ উপকরণ অর্থাৎ সাদাটে কাগজে কালো কালিতে নানা টোন প্রয়োগ করায় চিত্র-দুটি দর্শকের চোখকে তৃপ্তি দিয়েছে। এর ১-সংখ্যক চিত্রটির প্রায় মাঝখানে উলস্নম্ব গাছটির গোড়ায় লম্বা ঘাসে, গাছের পাতায়, দূর দিগন্তে হাওয়ার কাঁপন টের পাওয়া যায়। মাহবুব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউডার চারুকলা অনুষদের সহযোগী অধ্যাপক।
অ্যাক্রিলিক রংকে পাতলা করে চিত্রপটে জলরঙের মতো প্রয়োগ করেন অনেকেই। শিল্পী ইকবাল বাহার চৌধুরী শিরোনামহীন ছবি এঁকেছেন। চিত্রপটের উপরিভাগে একটি অবয়বের সংকেত পেয়ে যাই; সেই অবয়বের নাক-মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। অসুস্থ সময়ের প্রতীক হিসেবে শিল্পী এটিকে তুলে ধরেছেন বলে মনে হয়েছে।
শিল্পী এসএম এহসান কলোগ্রাফ মাধ্যমে যে-ছাপচিত্র এঁকেছেন, সেটির শিরোনাম – ‘অভিব্যক্তি’। এর ৩-সংখ্যক চিত্রপট জুড়ে প্রায় গোলাকার একটি অবয়ব-রূপের মাঝে অনেকগুলো সুতোর সরলরেখা চিত্রপটে বৈচিত্র্য এনেছে। এহসান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউডার চারুকলা অনুষদের প্রভাষক।
অর্ধ-ডানামেলা এক ময়ূরীর ছবি এঁকেছেন শিল্পী কুন্তল বাড়ৈ। ভারি করে অ্যাক্রিলিক রং চাপিয়ে ময়ূরীর চঞ্চল, ছন্দিত রূপটি আলোছায়াময় বর্ণের সৌকর্যে নন্দিতভাবে তুলে ধরেছেন। একজন মুক্তশিল্পী হিসেবে সক্রিয় থেকে তিনি তরুণ ও নবীন শিল্পীদের সৃজনকর্মে প্রাণিত করেন। তিনি লেকি আর্ট ফাউন্ডেশনের একজন উদ্যোক্তা।
বাস্তবানুগভাবে প্রতিকৃতি এঁকে বর্ণপর্দায় তাতে কিছুটা আড়াল করার প্রয়াস নিয়ে চিত্র-নির্মিতিতে এক ধরনের রহস্যময়তা প্রকাশ পায়। নিজের চিত্রকর্মে সেই ঝোঁক দেখিয়েছেন শিল্পী পারভেজ হাসান রিগান। চায়ের দোকানে দেখা শ্মশ্রম্নম–ত এক বর্ষীয়ান লোকের চিমিত্মত অবয়ব দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন তিনি।
নিসর্গ চিত্র এঁকে সাদা রঙের হালকা পর্দায় তাকে খানিকটা মুছে দিয়ে সাধারণ রূপকে অপরূপ করে তুলে ধরেছেন শিল্পী প্রদীপ সাহা। প্রকৃতির রূপ আঁকেন প্রায় সব শিল্পী। প্রদীপ সেটি জানেন, মানেন। কিন্তু নিজের কাজকে অন্যের থেকে আলাদা করতে বর্ণপর্দা নিয়ে তাঁর এই প্রচেষ্টা।
নাবিলা নবী প্রকৃতি ও ফুলকে ট্যাপেস্ট্রি মাধ্যমে তুলে ধরেন। অকালপ্রয়াত গুণী চিত্রকর রশীদ চৌধুরী বাংলাদেশে এই মাধ্যমটিকে পরিচিত করেছেন। নাবিলা ট্যাপেস্ট্রিতে গোলাপ ফুলের রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন আলোছায়ার সুষম প্রয়োগে।
আমাদের লোকজ শিল্প-ঐতিহ্য নিয়ে ছবি এঁকেছেন শিল্পী নবরাজ রায়। গ্রামীণ মেলায় দেখা-মেলে যে হাতি-ঘোড়া-মাছ এসব নিয়ে দুটি ছবি এঁকেছেন তিনি; শিরোনাম – ‘বাংলাদেশের ঐতিহ্য’। নবীন শিল্পী প্রিতম প্রিতু ‘লোকশিল্পের শব্দ’ নামে দুটি চিত্রকর্ম উপস্থাপন করেছেন। বাপ্পি লিংকন রায় প্রকৃতির রেখা ও রং নিয়ে ছবি এঁকেছেন। ‘নিসর্গ-১’ ও ‘নিসর্গ-২’ তাঁর কাজের শিরোনাম।
শিল্পী শারমিন আক্তার লীনা বাস্তবানুগ ছবিতে পরাবাস্তবতার আবহ নির্মাণ করেন। প্রদর্শনীতে থাকা তাঁর দুটি চিত্রকর্মের একটির শিরোনাম ‘পাখি হাতে তরুণী’। চোখ বন্ধ নারীর প্রোফাইল অবয়ব, বুকের কাছে স্পর্শ করা তার হাতের ওপর বসে আছে পাখি। সালংকারা এই নারীর অবয়ব এমনকি পাখির গায়ে প্রকৃতির বর্ণ আলিম্পন; বৃক্ষ থেকে ঝরে যাচ্ছে সবুজ পাতা। সব মিলিয়ে বেশ দৃষ্টিনন্দন কাজ।
শিরোনামহীন দুটি ছবিতে নবীন শিল্পী রাজিন মুসত্মাফা গৃহকোণের জ্যামিতি এঁকেছেন। এর একটিতে জীর্ণ জানালা ও অন্যটিতে পুরনো-ভাঙা দরজার গঠন। আলোছায়ায় মেটে রঙের দেয়ালে নানা বর্ণের উপাদানের উপস্থিতি দুটি কাজকে আকর্ষণীয় করেছে।
বৃষ্টির পদাবলি এঁকেছেন নবীন শিল্পী সাজিয়া রহমান সন্ধ্যা। চিত্রপটে কবিতার পঙ্ক্তি সাজিয়ে কালচে মেঘ ও বর্ষণের ভাব সার্থকতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। আরেক নবীন চিত্রকর জাকিয়া আফরোজের চিত্রকর্মের শিরোনাম – ‘ভেতরের ঢেউ’। গামছার টুকরোয় অ্যাক্রিলিক রং ভারি করে প্রয়োগ করে ছবি এঁকেছেন তিনি।
জলধোয়া এচিং মাধ্যমে দুটি ছাপচিত্র করেছেন নবীন শিল্পী নাসরিন জাহান অনিকা। আদুরে বিড়ালের শিকারি অবয়ব তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন কতক রেখা ও আলোছায়ার টোনে। চিত্রপটে তৈরি হওয়া সফট গ্রাউন্ড ও আলোছায়া প্রয়োগের পরিমিতি এই ছাপচিত্রকে নন্দিত করেছে।
একদল তরুণ চিত্রকরের সম্মিলিত প্রদর্শনী সাধারণত দর্শক ও শিল্পবোদ্ধাদের নতুন কিছুর সন্ধান দেয়। এ-প্রদর্শনীও তার ইঙ্গিত বহন করেছে।
তরুণ চিত্রকরদের এই শিল্পায়োজন গত ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে ৫ অক্টোবর ২০১৯ পর্যন্ত চলেছে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.