শুদ্ধাচারী কবি ও সম্পাদক আহসান হাবীব

সাহিত্য চর্চা করতে এসে গত প্রায় অর্ধশতাব্দী কালের পরিক্রমায় কত বিচিত্র মানুষের সান্নিধ্যে এসেছি, চোখ বন্ধ করে যখন পেছনের কথা ভাবি তখন কত প্রিয় মুখ স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে! তাঁদের অনেকেই স্বনামে খ্যাত কিংবদন্তিতুল্য সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। জীবনের অমোঘ সত্য মৃত্যুর হাত ধরে তাঁরা চিরকালের জন্য চোখের আড়ালে চলে গেছেন। এমন অসংখ্য মুখের ভিড়ে একটি মুখ আমার স্মৃতিতে চিরভাস্বর হয়ে আছে – তিনি আহসান হাবীব (২রা জানুয়ারি ১৯১৭-১০ই জুলাই ১৯৮৫)। বিশ শতকের চল্লিশ দশকের প্রখ্যাত কবি ও কিংবদন্তিতুল্য সাহিত্য সম্পাদক আহসান হাবীব ব্যক্তি মানুষ হিসেবে অসামান্য সৎ, সুরুচিশীল একজন নির্মোহ ব্যক্তিত্ববান মানুষ। পরম সৌভাগ্যই বলতে হবে, এই অসামান্য কবি-ব্যক্তিত্বের সঙ্গে দৈনিক বাংলায় প্রায় একটানা ছয়-সাত বছর তাঁর সহকারী হিসেবে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল আমার তরুণ বয়সেই।

সত্যি বলতে কবি আহসান হাবীবই আমার জীবনের গতি বদলে দিয়েছেন। তাঁর সান্নিধ্যে না এলে এই আমি হয়তো অন্য কিছু হতাম। সরকারি ব্যাংকে জনসংযোগ বিভাগে কাজ করার আমন্ত্রণ পেয়েও শেষ পর্যন্ত সাহিত্য আর সাংবাদিকতার অঙ্গনে থেকে গিয়েছিলাম শুধু কবি হাসান হাবীবের আকর্ষণেই।

আজ থেকে ৪৫ বছর আগে সরকারি চাকরির এত ক্রাইসিস ছিল না। অফিসপ্রধান চাইলেই নিয়োগ দিতে পারতেন। সেভাবেই আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম প্রখ্যাত ব্যাংকার লুৎফর রহমান সরকারের কাছ থেকে।

কবি আহসান হাবীবের সঙ্গে যাঁরা মেশেননি অথবা সেই সুযোগ হয়নি, তাঁরা দূর থেকে যেভাবে তাঁকে জানেন, আহসান হাবীব ছিলেন ঠিক তার বিপরীত মেরুর মানুষ। আপাতদৃষ্টে মনে হতো তিনি গম্ভীর প্রকৃতির রাশভারী মানুষ, কিন্তু দূরত্বের দেয়াল ভেঙে কাছে যেতে পারলে জানা যেত তাঁর প্রকৃত স্বরূপ। মিতবাক হলেও অত্যন্ত আন্তরিক এবং মিশুক মানুষও ছিলেন তিনি। বিশুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলা, পোশাকে-আশাকে এবং আচরণে অত্যন্ত উন্নত পরিমার্জিত রুচির একজন আধুনিক মানুষ ছিলেন তিনি।

এই আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আহসান হাবীবের কবিতায় এবং সম্পাদনাতেও। তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ ছিল পরিমিতিবোধ এবং মোহমুক্ত থাকার  আশ্চর্য ক্ষমতা। এটা সবার থাকে না। কবিতা লেখার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন শুদ্ধতাপিয়াসী। পুনরাবৃত্তিমুক্ত কবিতা রচনায় যেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ! সাহিত্য সম্পাদনার ক্ষেত্রেও ছিলেন গুণমান বিচারে আপসহীন সততার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অনেক ক্ষেত্রে নির্মমও মনে হয়েছে তাঁকে। প্রতিষ্ঠিত লেখকদের গতানুগতিক লেখার চেয়ে নতুন লেখকের লেখা একটু কাটছাঁট করে ছাপতে তাঁর আগ্রহ ছিল। কারণ নতুন লেখক সৃষ্টিতেই তাঁর আগ্রহ ছিল বেশি।

কবি হিসেবে আহসান হাবীব কোন উচ্চতায় নিজেকে উন্নীত করেছিলেন, তা তাঁর কবিতার নিবিষ্ট পাঠক ছাড়া কারো পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।

বহুলপ্রজ কবি তিনি ছিলেন না, যে-কারণে তাঁর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা খুব বেশি নয়, মাত্র আটটি মৌলিক কাব্যগ্রন্থ। কিন্তু আটটিই গুণগত উৎকর্ষে এতটাই উজ্জ্বল, যা একজন কবিকে গুরুত্বপূর্ণ কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্ট। শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত রাত্রি শেষ দিয়ে আর শেষ হয়েছে ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত বিদীর্ণ দর্পণে মুখ কাব্যগ্রন্থ দিয়ে। কিন্তু যা লিখেছেন তা বাংলা কবিতার ইতিহাসে তাৎপর্যপূর্ণ সৃষ্টি হিসেবে আজও অম্লান।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অস্থির বিশ্ববাস্তবতায় বাংলা কবিতার এক ক্রান্তিকালে চল্লিশ দশকের কবিদের আবির্ভাব। একদিকে ইউরোপীয় আধুনিকতার জোয়ারে ভাসমান তিরিশি কবিদের নাগরিক যন্ত্রণাবিদ্ধ নিঃসঙ্গতার হাহাকার আর এলিয়টীয় দুঃস্বপ্নের পোড়োজমিতে পরিভ্রমণ, অন্যদিকে আহসান হাবীবের মতো হাতেগোনা দু-একজন কবির মৃত্তিকাসংলগ্ন থাকার মতো বিপরীত স্রোতে যাত্রার  সচেতন প্রয়াস।

শিউলি ফুলের মতো শুভ্র পুত-পবিত্র বাংলা কবিতাকে যদি সাদা ভাতের খোলা প্লেটের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে বলতে হবে, সেই শুভ্রতার ওপরে উড়ে এসে পড়ছিল ভিনদেশি ছাই, ধুলোবালি। আহসান হাবীব মাতৃমমতায় সেই ভাতের থালাটি ঢেকে রাখতে চেয়েছিলেন আজীবন। দেশজ ঐতিহ্যের মধ্যেই তিনি বুনে দিয়েছিলেন আধুনিকতার বীজ।

প্রতিবছর ২রা জানুয়ারি এবং ১০ই জুলাই নীরবে আসে এবং প্রায় নীরবেই চলে যায়। সরকারি-বেসরকারি গণমাধ্যমের তেমন কোনো আয়োজন যেমন চোখে পড়ে না, তেমনি চোখে পড়ে না তরুণ প্রজন্মের কবিদের মধ্যেও তাঁকে কিংবা তাঁর কবিতা নিয়ে কোনো উচ্ছ্বাস।

অথচ কত বড় অবদান তিনি বাংলাদেশের কবিতায় রেখে গেছেন তা অনুধাবন করতে পারলে কৃতজ্ঞ থাকার কথা ছিল আমাদের উত্তরপ্রজন্মের সবারই।

কবি আহসান হাবীব স্মরণে জুলাই মাসে লিখতে বসে এ ধরনের অপ্রিয় কথা লেখার ইচ্ছে ছিল না। তারপরও মনোবেদনায় এভাবেই লিখতে হচ্ছে। ঐতিহ্য অস্বীকার করে আধুনিকতার ভিত্তি যে রচনা করা যায় না – এই চিরন্তন সত্য বোধ হয় সমকালীন সাহিত্যযশোপ্রার্থীদের অনেকেই ভুলে গেছেন।

আহসান হাবীবের সম্পাদনাবিষয়ক সততার দু-একটি দৃষ্টান্ত দেব এবং তাঁর কবিতা প্রসঙ্গে একটি উদ্ধৃতির আশ্রয় নেব এবং তা তাঁর অবস্থান নির্ণয়ের প্রয়োজনেই।

কবি আহসান হাবীবের শ্রেষ্ঠ কবিতার একটি সংকলন বেরিয়েছিল ১৯৯৯ সালে প্রকাশনা সংস্থা ‘অনন্যা’ থেকে। কবি মাহবুব সাদিক ও কবি আবিদ আনোয়ার বাছাই করেছিলেন সেই সংকলনের কবিতাগুলি। সেখানে এই দুই কবি আহসান হাবীবের কবিতার মূল্যায়নধর্মী যে ভূমিকা-প্রবন্ধটি লিখেছেন (শিরোনাম : ‘আহসান হাবীব : তাঁর কবিতা ও কাব্যচিন্তন’) তা বাংলা কবিতায় কবি আহসান হাবীবের অবদান এবং তাঁর কবিতা সম্পর্কে ধারণা পেতে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করি।

একটি অংশ উদ্ধৃত করা যাক :

তিরিশোত্তর কবিতার ধারায় কবি আহসান হাবীব আমাদের আদি পিতৃপুরুষ, এ-কথা আজ সর্বজনস্বীকৃত। বোদলেয়রীয়  আধুনিকতার যে উদ্বোধন ঘটে বাংলা কবিতায় তিরিশি কবিকুলের রচনাকর্মে, এ-বাংলায় আহসান হাবীব ছাড়া তাঁর সমকালের শক্তিমান কবিদের অন্য কেউ এত ব্যাপকভাবে তাকে আত্মস্থ ও আলিঙ্গন করতে পারেননি। চল্লিশের দশকে আহসান হাবীব তিরিশোত্তর আধুনিকতাকে কেবল আত্মস্থ করেননি – তিরিশি কবিরা তাঁদের কাব্যতত্ত্বে নৈরাশ্যবাদ, স্বকালের বন্ধ্যাত্ব, বিমানবিকীকরণ তথা জনজীবন বিচ্ছিন্নতার যেসব সীমাবদ্ধতার দেয়াল তৈরি করেছিলেন, তিনি তা ভেঙে দিয়ে আধুনিকতার সংজ্ঞা করে তুললেন সম্প্রসারিত ও মুক্ত। আহসান হাবীবোত্তর আমাদের আধুনিক কবিতা তাই এসব ইজমের দাসত্ব করেনি।

আশাবাদ ও স্বদেশ সংলগ্নতাকে ধারণ করেও কবিতার আধুনিকতা ক্ষুণ্ন হয় না, আহসান হাবীব তাঁর রচনাকর্মের মাধ্যমে তা আমাদের দেখিয়েছেন।

কবি হিসেবে আহসান হাবীব আমাদের কাছে বরেণ্য কেবল এই ঐতিহাসিক সত্যটুকুর জন্যই নন – তিরিশোত্তর কালে আমাদের শ্রেষ্ঠ কবিদেরও একজন তিনি।

শামসুর রাহমানের কবিতা নিয়ে হুমায়ূন আজাদের প্রবন্ধের বই শামসুর রাহমান : নিঃসঙ্গ শেরপায় শামসুর রহমানের সমসময়ের এবং পূর্ববর্তী কবিদের ওপর আলোকপাত করা হয়েছিল বইটির ভূমিকায়। হুমায়ূন আজাদের সেই ভূমিকার উদ্ধৃতি নিয়েছেন আহসান হাবীবের শ্রেষ্ঠ কবিতার সংকলক মাহবুব সাদিক ও আবিদ আনোয়ার। চল্লিশের দশকের কবিতা প্রসঙ্গে হুমায়ূন আজাদের মন্তব্য  কবি হিসেবে আহসান হাবীবের বিশেষত্ব বোঝার জন্য তাৎপর্যপূর্ণ।

হুমায়ূন আজাদ লিখেছেন :

চল্লিশের দশকে যখন আধুনিক কবিতার প্রতিষ্ঠা পাকা হয়ে গেছে, তখন যাঁরা বাঙলা কবিতার অঙ্গনে আসেন তাঁদের এক গোত্র ফররুখ আহমদ, আহসান হাবীব, সিকান্দার আবু জাফর, আবুল হোসেন, সৈয়দ আলী আহসান, গোলাম কুদ্দুস, মতিউল ইসলাম, আজিজুর রহমান, তালিম হোসেন … এঁদের মধ্যে মনোযোগ আকর্ষণ করেন মাত্র চারজন : ফররুখ আহমদ, আহসান হাবীব, আবুল হোসেন ও সৈয়দ আলী আহসান … ফররুখ আহমদের ‘সাত সাগরের মাঝি’ (১৯৪৪) কতিপয় স্মরণীয় কবিতাখচিত হওয়া সত্ত্বেও আধুনিক চেতনার শস্য নয়। উচ্চকণ্ঠ-এ কবি নজরুল ইসলামের পরিশীলিত উত্তরাধিকারী : জীবনবোধ কাব্যভাবনা, আঙ্গিক চেতনা ও সংবেদনশীলতায় তাঁর কবিতা আধুনিকতার স্পর্শরহিত … আবুল হোসেনের ‘নববসন্ত’ (১৯৪০) ও ‘বিরস সংলাপ’-এর (১৯৬৯) চল্লিশ দশকে রচিত কবিতাগুচ্ছ সাক্ষ্য দেয় যে এ-কবির বুকে অগভীর এবং অব্যাপকভাবে হলেও, আধুনিক জীবন ও কবিতা চেতনা প্রকাশ পেয়েছিল, যদিও তাঁর হাতে একটিও তৃপ্তিকর গভীর সম্পূর্ণ কবিতা রচিত হয়নি … আহসান হাবীবের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাত্রি শেষ’ বেরোয় ১৯৪৭-এ; এবং এ কাব্যেই সর্বপ্রথম একজন মুসলমান কবি ব্যাপক বিংশ শতকী চেতনাসহ আত্মপ্রকাশ করেন…।

হুমায়ূন আজাদের এই মন্তব্য থেকেই অনুধাবন করা সম্ভব বিশ শতকের চল্লিশের দশকের কবিদের মধ্যে শুরু থেকেই প্রকৃত আধুনিক চেতনায় আহসান হাবীব ছিলেন অগ্রগামী।

তাঁর কবিতা প্রতীক, চিত্রকল্প আর প্রগাঢ় দার্শনিক চেতনায় ঋদ্ধ। বিশেষ করে তৃণমূল সংলগ্ন মানুষ এবং বাঙালির লোকায়ত জীবনের ঘনিষ্ঠ রূপকার তিনি। কৃষিজীবী সমাজবাস্তবতার মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন আহসান হাবীব। বিভাগপূর্বকালের কলকাতা এবং বিভাগ পরবর্তীকালে ঢাকাকেন্দ্রিক তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় নগরে কাটলেও, তিনি ভুলে যাননি অস্তিত্বের শিকড়ের কথা। আবহমান বাংলার গ্রামীণ জীবন এবং গ্রামীণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট তাঁর কবিতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে। থেকেছেন কলকাতায়, অস্তিত্বে ছিল পূর্ববঙ্গ। মধ্যযৌবন থেকে অন্তিম দিন পর্যন্ত বাস করেছেন ঢাকায়, কিন্তু তাঁর ভাবনা এবং কবিতা জুড়ে ছিল শোষিত বঞ্চিত কৃষিজীবী সমাজ।

অস্তিত্বের শেকড় বিস্মৃত যারা, সেই নাগরিক-জীবনের কৃত্রিমতাকে ব্যঙ্গ করেছেন বারবার। ‘ফিরে আসবে বলে গিয়েছিলে’ এই আক্ষেপে আর গ্রামে না ফিরতে চাওয়া তরুণের জন্য যখন গ্রামের স্বজনের মনে যে সুপ্ত হাহাকার, আহসান হাবীবের কবিতায় সেই হাহাকার বাক্সময় হয়ে উঠেছে বারবার।

বাংলাদেশের কবিতায় শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, ওমর আলী প্রমুখ কবি বহুল আলোচিত কবিতায় আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহারের কারণে। অথচ আহসান হাবীব এক্ষেত্রেও পূর্ববঙ্গের কবিদের পথিকৃৎ। ‘হকনাম ভরসা’ শিরোনামে আহসান হাবীবের একটি কবিতার দৃষ্টান্ত :

… আমাতে ও আপনাতে আসমান জমিন /

ফারাগ; কেননা আমি মূর্খ দীনহীন।/

যদিও আমার ঘরে দুই মুঠো চাল/

ছিল না, সেও তো ছিল ভাল। এ-কপাল/

পুড়েছে পুড়ুক, তবু আপনার চালে/

নাজেহাল হবো কেন? যা থাকে কপালে/

এই ভেবে শেষতক ফিরেছি আবার/

হুজুর আপনার/

মেহমানদারী বড় অদ্ভুত ব্যাপার।

…      …      …

এখন/

আমরা ক’জন,/

পুরনো মরাই কাটা সরাবো এবং/

পুরনো লাঙ্গল এনে দিতে হবে রং/

সং সেজে বসে থাকা সাজে না, কারণ বেলাশেষ/

আর কি বিশেষ/

লিখিব। কুশলে আছি আর যথারীতি/

কুশল-সংবাদ চাই, আদাবান্তে ইতি।/

মহম্মদ তালেব আলী, আমানির পাড়/

তেরো শ’ একান্ন সাল, বারোই আষাঢ়।

‘ছহি জঙ্গনামা’ শিরোনামের কবিতা থেকে একটি উদ্ধৃতি :

… জ্বি হুজুর, আমি সেই হুজ্জত সরদার।/

জান নিয়ে বেঁচে আছি পাক-পরোয়ার/

খোদাওন্দ  করিমের পরম ফজলে।/

তবে কিনা এলাহীর লানতের ফলে/

হয়েছে এমন হাল! হাড়-মাংশহীন/

আমি সেই খাকছার হুজ্জত কমিন।/

…         …          …

হুজ্জত সরদার আমি মানুন একিন/

ফকর করি না কিছু ছিল একদিন/

যেদিন নেজার কোপ ফিরেছে এ-বুকে/

মওতের সামনেতে গেছি তাল ঠুকে/

দু চার বাঘের বল ছিল কব্জায়/

ডর-ভয় বলে কিছু ছিল না ছিনায়।/

…         …        …

তারপর জিন্দেগীর নতুন সবক/

যবর খবর এক শুনি আচানক।/

ইংরেজ জার্মান নাকি লেগেছে লড়াই/

ঢাল তরোয়াল কারো কমি কিছু নাই,/

দুই পক্ষ তেজিয়ান সমানে সমান/

কাতারে কাতারে নাকি কাটিছে গর্দান…।

                          (‘ছহি জঙ্গনামা’)

আঞ্চলিক ভাষার এমন সার্থক ব্যবহার তাঁর একাধিক কবিতায় রয়েছে, যা রচিত হয়েছিল তাঁর পরবর্তী কালের কবিদের অনেক আগেই (১৯৪৬ সালে)।

কবিতায় প্রতীক-চিত্রকল্প নির্মাণেও অসামান্য সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন কবি আহসান হাবীব।

একটি উদাহরণ :

এখন অসুখী কোনো বালকের কাছে নীল প্রজাপতি নেই/

ফুলমতির ময়াজালে মাছ নেই, চুপচাপ বসে থেকে এই/

পৃথিবীর ছায়া দেখে, ছায়ার ভেতরে দেখে মুণ্ডুহীন পাখি উড়াল/

বৃক্ষের শাখায় দেখে কেবলই ফুরিয়ে যাচ্ছে পাখিদের কাল।/

পাখিহীন সব শাখার কী গভীর দুঃখে লীন নত হয়ে আছে/

নদী কী নিশ্চল, দেখো সব নদী স্তব্ধতার কাছে/

কী রকম নতজানু!…

(‘উল্টোপাল্টা এইসব’, দু’হাতে দুই আদিম পাথর)

ষাটোর্ধ্ব বয়সে লিখেছিলেন তিনি এরকম ভয়ংকর প্রতীকী চিত্রকল্পময় স্বকালদগ্ধ বাস্তবতার কবিতা। বয়সে আহসান হাবীব প্রবীণ হয়েছিলেন, কিন্তু কবিতায় ছিলেন যুগসচেতন চিরনবীন। যথার্থই ছিলেন ‘তরুণের প্রতিযোগী’।

কিন্তু জীবদ্দশায় তাঁকে তাঁর প্রাপ্য সেই সম্মান দেওয়া হয়নি অনেক ক্ষেত্রেই। এ নিয়ে তাঁর ক্ষোভও যে ছিল না তা নয়। একাধিক কবিতায় সেই অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে। তা না হলে তাঁকে কেন পরিণত বয়সে, জীবন সায়াহ্নে এসে কসম করে বলতে হবে যে, তিনি ভিনদেশি আগন্তুক বা পথিক নন! তিনি এই মাটিরই সন্তান?

যাঁরা কবির খুব কাছে থেকে তাঁকে দেখছেন, ঘনিষ্ঠ হয়েছেন, তাঁরা জানেন কেন তাঁকে ‘আমি কোনো আগন্তুক নই’ দাবি করতে হয়েছিল। আরো পরিষ্কার করে বলেছিলেন :

সময় ফুরিয়ে গেছে বলে, তোমরাই

কাফন সদৃশ এক সাদা জামা দিয়েছো পরিয়ে …।

(এই তোমরা কারা? সে উত্তর সচেতন পাঠকের অজানা থাকার কথা নয়।)

এমন ক্ষুব্ধ চেতনা নানা প্রতীকে প্রকাশিত হয়েছে কোনো কোনো কবিতায়। কবিতার রাজনীতির শিকার হয়েছিলেন সকল ডামাডোলের বাইরে থাকা নিভৃতচারী সুরুচিশীল আত্মমর্যাদাবান কবি আহসান হাবীব।

যা-ই হোক এই স্মরণাঞ্জলি শেষ করার আগে তাঁর সম্পাদকীয় সততার দু-একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যেতে পারে। তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই কবি আহসান হাবীব তাঁর সহকারী হিসেবে দৈনিক বাংলায় কাজ করবো কি না জানতে চাইলে আমি সানন্দে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। তিনি আমার কাছ থেকে একটি আবেদনপত্র নিলেন। আবেদনটি সঙ্গে সঙ্গেই সম্পাদকের দপ্তরে পাঠিয়ে দিলেন। পাশে কী যেন মন্তব্যও লিখেছিলেন।

দিন যায়, মাস যায়, কিন্তু তাঁর সহকারীর নিয়োগপত্র আসে না। একদিন তিনি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানালেন দৈনিক বাংলা কর্তৃপক্ষকে। এর কিছুদিন পর নিয়োগপত্রটি আসে একদিন। সেদিন তিনি রহস্যের হাসি হেসে বললেন : ‘তোমার জন্য একটি সুসংবাদ এবং একটি দুঃসংবাদ।’ ডান পাশের ড্রয়ার থেকে একটি হলুদরঙা অফিসিয়াল খাম বের করে দিয়ে বললেন : ‘এই নাও তোমার সুসংবাদ। এখন থেকে আমার সঙ্গে অফিশিয়ালি কাজ করবে। আর দুঃসংবাদ হল তোমার অনেক কবিতা, অনেক গদ্য ছাপা হয়েছে সাহিত্য পাতায়। আজ থেকে আর ছাপা হবে না। বই পরিচিতি লিখবে, কিন্তু একটা ছদ্মনাম আমি দিয়ে দেব। প্রতি সপ্তাহে ওই নামে ছাপা হবে। আর যদি তুমি ভালো কবিতা লিখে থাকো তাহলে অন্যান্য পত্রিকা ছাপবে নিশ্চয়ই। আর বিশেষ সংখ্যা যেহেতু সালেহ চৌধুরী দেখেন, তাঁকে লেখা দিলে দিতে পারো, যদি তিনি মনে করেন, ছাপবেন।’

তাঁর অনুজ মুস্তাফা জামাল কবিতা লিখতেন। তিনি কবিতা  দিয়ে যেতেন মাঝে মধ্যে, স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন না হাবীব ভাই। বছরে দু-একটি লেখা ছাপা হতো।

একবার একটি ঘটনায় চমকে গিয়েছিলাম আমি। কবি কাজী নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সুফী জুলফিকার হায়দার। হাবীব ভাইয়ের অনেক সিনিয়র তিনি। খুব সম্ভবত ১৯৮৩ অথবা ’৮৪ সালের কথা। নজরুলের মৃত্যু অথবা জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তিনি একটি লেখা দিয়েছেন।  হাবীব ভাই বললেন, ‘লেখাটি ধীরে ধীরে টেনে টেনে পড়ো।’ পড়লাম। শোনার পর তিনি গম্ভীর হয়ে গেলেন।

ঘণ্টাখানেক পরে বললেন, ‘লেখাটি আবার পড়ো।’ পড়লাম। শোনার পর তিনি উঠে গেলেন। দৈনিক বাংলার চারতলায় তাঁর রুমের বাইরে প্রায় ৪০-৪৫ ফুট লম্বা টানা বারান্দা। একটার পর একটা সিগারেট ধরাচ্ছেন আর পায়চারি করছেন বারান্দার এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে।

সহকারী সম্পাদক কবি-প্রাবন্ধিক মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ বসতেন হাবীব ভাইয়ের পাশের ঘরেই। তাঁর ঘরে নিয়ে তাঁকে দিয়েও পড়ালেন একবার। ফিরে এলেন। আমাকে বললেন, ‘না, ছাপা যায় না এরকম লেখা। খুব অগোছালো, এলোমেলো না নাসির?’ আমি বললাম, ‘জি।’

পরদিন আবার সেই লেখা ড্রয়ার থেকে বের করলেন। আবারো পড়তে বললেন এবং কিছু কিছু জায়গায় আমাকে থামিয়ে সংশোধন করলেন। তারপরও কিছু দাঁড়ায় না। মন খারাপ করে বললেন, ‘ফাইলে রেখে দাও।’

স্বগতোক্তির মতো বললেন, ‘এই বয়সে কেন যে লিখতে গেলেন। এখন কি স্মৃতিশক্তি আছে, না ভাবনার সংহতি আছে!’

একদিন খুব বিনীতভাবে জানতে চাইলাম কেন এই লেখাটি এতবার পড়লেন এবং ছাপতে চাইলেন। হাবীব ভাই বললেন, ‘কলকাতা জীবনের প্রথম দিকে তাঁর অনেক স্নেহ পেয়েছি। তিনি আমার অভিভাবকতুল্য। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের একজন ঘনিষ্ঠ সহচর। তাঁর লেখাটির গুরুত্বও তো আছে। যদি ছাপা হতো, নজরুল সংখ্যার মান বাড়তো।’

এই একটি ঘটনা থেকেই বোঝা যায় কি নিষ্ঠাবান ছিলেন তিনি সাহিত্য পাতা সম্পাদনার ক্ষেত্রে।

তরুণ প্রজন্মের লেখক-কবিদের লেখা ছাপার ব্যাপারেও তাঁর বেশ আগ্রহ ছিল। সম্ভাবনাময় নতুন লেখক, কিছুটা কেটেছেঁটে এডিট করে হলেও ছাপতে চাইতেন। তাঁর সম্পাদিত সাহিত্য পাতায় যেখানে ডক্টর আবু হেনা মোস্তফা কামালের মতো ডাকসাইটে কবি এবং প্রাবন্ধিক-গবেষক নিয়মিত কলাম লিখতেন, সেখানে আজ থেকে ৪৩ বছর আগে তখনকার তরুণ অথচ প্রতিভাবান কবি আবিদ আনোয়ারকে দিয়ে তিনি নিয়মিত কলাম লেখাতেন। যতদূর মনে পড়ে, কলাম-এর শিরোনাম ছিল ‘মধ্যদিনের জানালা’।

ঢাকার বাইরের লেখকদের লেখা আলাদা ফাইলে রাখতেন। নারী লেখকদের লেখাও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতেন। আজকের স্বনামখ্যাত কথাসাহিত্যিক ঝর্না রহমান, নাসরীন জাহান অতি তরুণ বয়সেই লেখক হিসেবে আহসান হাবীবের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন এবং তাঁদের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগেই। যথেষ্ট কাভারেজও পেয়েছেন। প্রতি সপ্তাহে প্রেসে লেখা দেওয়ার আগে সবুজ লাল চিহ্নিত দুটি পৃথক ‘ম’ লেখা ফাইল থেকে লেখা বের করে দেখতেন, দেওয়া যায় কি না। কারণ তারা ঢাকার বাইরে থাকেন, ঢাকার লেখকদের মতো টেবিলে এসে তাগিদ দেওয়ার সুযোগ নেই। অনেককে চিঠিতেও লেখার অবস্থান জানাতেন। চোখের সমস্যার কারণে লিখতে গেলে হাবিব ভাইয়ের হাতের লেখা শেষ জীবনে বাঁকা হয়ে যেত, কারো কারো চিঠি তাই আমার হাতেই লেখা, তিনি ডিকটেশন দিয়ে লিখিয়ে নিচে স্বাক্ষর করে দিতেন।

১৯৮৫ সালের ১০ই জুলাই তিনি চিরবিদায় নিয়েছেন। হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও আমাকে নির্দেশনা দিয়েছিলেন কীভাবে পরবর্তী সপ্তাহের সাহিত্যের পাতাটা বের হবে। দুজন স্বনামখ্যাত লেখকের নাম বলেছিলেন যেন আমি তাঁদের কাছ থেকে প্রবন্ধ সংগ্রহ করি। কিন্তু পরের সপ্তাহের সাহিত্য পাতা বেরিয়েছিল হাবীব ভাইকে নিয়ে শামসুর রাহমান, আহমেদ হুমায়ুনসহ স্বনামখ্যাত অনেকের লেখা নিয়ে।

আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে আজ কবি-সম্পাদক আহসান হাবীব নেই। কিন্তু আছেন প্রতিদিন আমাদের চেতনায়, সেই আমরা যারা তাঁর মহান ব্যক্তিত্বের ছায়ায় গিয়েছিলাম, তাঁর চিরআধুনিক অনেক কবিতার প্রথম পাঠক হিসেবে পড়েছি এবং এখনো চির আধুনিক কবিতা পড়ছি।

তরুণ কবিদের বলি – আহসান হাবীবকে জানতে হবে, পড়তে হবে। কারণ চল্লিশের এই প্রধান কবি বিভাগোত্তর কালের আমাদের কবিতায় নব্য আধুনিকতার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আবার আজীবন সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন সূত্রেও এ-দেশের সাহিত্যাঙ্গনে অভিভাবকের ভূমিকা রেখেছেন তিনি।

অর্থনৈতিকভাবে তিনি বিত্তবান ছিলেন না বটে, কিন্তু চিত্তের বৈভবে তিনি ছিলেন অনেকের চেয়ে বেশি ধনী। সারাজীবন আর্থিক টানাপড়েন অতিক্রম করেছেন; কিন্তু নৈতিকভাবে ছিলেন সৎ এবং নির্লোভ। বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ১৯৬১ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৭৮ সালে একুশে পদক এবং ১৯৯৪ সালে মরণোত্তর সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন।

এত কথা যাঁকে নিয়ে, তাঁর সৃষ্টিশীলতার কিছু তথ্য প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করি। কাব্যগ্রন্থ,  উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, ছোটদের ছড়া ও কবিতার বই মিলিয়ে আহসান হাবীবের গ্রন্থের সংখ্যা ২৫টি। এর মধ্যে কাব্যগ্রন্থ : রাত্রিশেষ (১৯৪৭), ছায়াহরিণ (১৯৬২), সারা দুপুর (১৯৬৪), আশায় বসতি (১৯৭৪), মেঘ বলে চৈত্রে যাবো (১৯৭৬), দু’হাতে দুই আদিম পাথর (১৯৮০), প্রেমের কবিতা (১৯৮১) এবং শেষ কাব্যগ্রন্থ বিদীর্ণ দর্পণে মুখ (১৯৮৫)।

উপন্যাস : আরণ্য নীলিমা (১৯৬২), কিশোর পাঠ্য : রানী খালের সাঁকো ( ১৯৬৫), জাফরানী রং পায়রা।

শিশুসাহিত্য : জোছনা রাতের গল্প

কিশোর কবিতা ছুটির দিন দুপুরে, বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, রেলগাড়ি ঝমাঝম। ছোট মামা দি গ্রেট, পাখিরা ফিরে আসে। ট্রেজার আইল্যান্ডের সংক্ষিপ্ত অনুবাদ রত্নদ্বীপ। হাজীবাবা। প্রবাল দ্বীপে অভিযান (কোরাল আইল্যান্ডের সংক্ষিপ্ত অনুবাদ)। এ ছাড়া শাহেদ সোহরাওয়ার্দির কবিতাসহ বেশ কিছু কবিতাও তিনি অনুবাদ করেছিলেন।

আমাদের অভিভাবক কবি আহসান হাবীবের স্মৃতির উদ্দেশে নিবেদন করি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।