আমার বক্তব্য শোনার জন্য আপনারা ভদ্রজন শ্রেণির অনেকে উপস্থিত হয়েছেন। আমার মতো একজন দলিত মহিলার বক্তব্য শোনার যে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, সেজন্য আমি গৌরবান্বিত অনুভব করছি।

প্রথমে আমি আপনাদের হতাশ করতে চাই। আমার যে-বইটি নিয়ে আপনাদের এতো মাতামাতি, বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় আলোচনা-সমালোচনা চলছে, আমার সাক্ষাৎকার-বক্তব্য ছাপা হচ্ছে, তারপর সুধী সমাবেশে আজকের এই আলোচনা, আপনারা আমার গল্প লেখার ইতিবৃত্ত শুনতে চেয়েছেন। প্রথমত, এটা কোনো গল্প নয়। আমি গল্প-উপন্যাস লেখক নই। বইটি আমার মায়ের জীবনসংগ্রামের এক কঠিন সত্য, যা আমাদের সমাজে অহরহ ঘটে থাকে। ভাগ্যের দোহাই দিয়ে সবাই মেনেও নেয়। আমার মা মেনে নেননি। তিনি রুখে দাঁড়িয়েছেন।

ভাষার আলোছায়ায় নির্দয় দুঃখ-করুণা মিশিয়ে পাঠকের সহানুভূতির কোনো চেষ্টা আমি করিনি। সুন্দর করে গোছানো, বানানো, আকর্ষণীয় রুদ্ধশ্বাস কোনো ফিকশন এটি নয়। আপনাদের কল্পনার বাইরে নিষ্ঠুর নির্মম প্রতারিত এক অমানবিক পশুর জীবন। আমি সেই ঘটনার, আমার মায়ের জীবনের  চালচিত্র এঁকেছি।

আজকের এই স্মরণীয় সন্ধ্যায় সাজানো আনন্দঘন পরিবেশে আমার বক্তব্য আপনাদের তৃষ্ণা কতটা মেটাবে কিংবা নির্মম বাস্তবতা আপনাদের অপমানিত করবে – সেদিকে কোনো দৃষ্টি দেব না। আমার বক্তব্যের প্রতিটি শব্দ-ঘটনা-দৃশ্য আমার জীবনের নোংরামি, ক্লেদ, ঘৃণা, রক্তাক্ত এক কুৎসিত ছবি, বংশপরম্পরায় যা আমরা বহন করে চলেছি। বিজ্ঞান এগিয়েছে, তার লেজ ধরে সভ্যতা এগিয়েছে। সমাজে চাকচিক্য মোহনীয় আবেশ তৈরি হয়েছে। কিন্তু সামাজিক ব্যবস্থা প্রগতির দিকে খুব কি এগিয়েছে? বাইরে সামাজিক প্রগতির কিছু প্রভাব পড়লেও, ভেতরে সেই আদি ধারাই বয়ে চলেছে। দাসত্বটুকু ভেতরে ভেতরে রয়ে গেছে ভিন্ন আঙ্গিকে, মার্জিত রূপে। জিজ্ঞাসাটি সকলের জন্য। আরেকটি বিষয়, আপনাদের ভদ্র-শিক্ষিত-মার্জিত পরিবেশে আমি বড় হইনি। আপনাদের মতো সুন্দর কথা বলার শিক্ষা আমার নেই। যে সমাজ ও পরিবেশে আমি বড় হয়েছি, আমি সেই সমাজের নির্মম নগ্ন ভাষায় কথা বলি। আমার কথা সুন্দর নয়, কিন্তু সত্য। আমার এই অমার্জিত প্রকাশ ক্ষমার চোখে দেখবেন।

দার্জিলিং পাহাড় এবং এর আশপাশ এলাকা ইংরেজ সরকার সিকিম রাজপরিবারের কাছ থেকে কেড়ে নিল। গ্রীষ্মনিবাস দার্জিলিং শহর যখন তৈরি শুরু করল, বেনিয়া ইংরেজ বুঝতে পারল এ-অঞ্চল চা উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। পানীয় হিসেবে ইউরোপে তখন চায়ের খুবই কদর। দার্জিলিংয়ের সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হলো আসাম ও সিলেটের এলাকা। জঙ্গল পরিষ্কার করে চায়ের বাগান তৈরি করার জন্য প্রচুর মানুষ দরকার। এই জঙ্গলে হিংস্র জীবজন্তু-সাপের হাতে মরতে কে আসবে? হতদরিদ্র দলিত শ্রেণি এতই অভিশপ্ত যে, তাদের ছায়া মারালে উচ্চ শ্রেণির হিন্দুদের দেহ ও আত্মার পবিত্রতা নষ্ট হয়। মন্দিরে প্রবেশের অধিকার তাদের নেই। ঈশ্বর যাদের মনুষ্য জাতির ক্রীতদাস রূপে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। আমরা সেই হতদরিদ্র অচ্ছুৎ দলিত শ্রেণি ইংরেজ বণিকের কাছে হয়ে উঠলাম রক্ষাকবচ।

ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে মিথ্যা প্রলোভন, ভাত-কাপড়-ঘর, উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে দার্জিলিং, আসাম, সিলেট নিয়ে এলো। যে-স্বপ্নের প্রলোভন দেখিয়ে আমাদের দলিত শ্রেণির পরিবারদের এখানে আনা হয়েছিল, তা কি আজো পূরণ হয়েছে? দুশো বছর পার হয়ে গেছে।

আমার মা ও বাবা দুজনেই চা শ্রমিক। যে যত কেজি চা-পাতা তুলতে পারবে সে তত টাকা পাবে। মা সূর্য ওঠার আগে ঝুড়িমাথায় বেরিয়ে পড়তো। বাবা মদ-নেশা-ভাং করে অনেক রাতে ঘরে ফিরতো। চা-বাগানে যেতে যেতে তার দশটা-এগারোটা হয়ে যেতো। বাবার চেয়ে মায়ের রোজগার ছিল বেশি। মা আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে নানা গোপন জায়গায় টাকা লুকিয়ে রাখতো। বাবা ঘরে ফিরেই মায়ের সারাদিনের রোজগার কেড়ে নিতো। বাবা রাগের সঙ্গে বলতো, তুই হামার মাগি আছিস। তুর সবকিছু হামার আছে। তোর কামাইবি হামার।

টাকা না দিলে বাবা মাকে মারধর করতো। একদিন কাজ থেকে ফিরে মা ক্লান্ত শরীরে বলল, আইজ হামার বিমার হইল। মাথা ঘুরিয়া পড়িয়া গিলাম। বেশি কাম করিতে পারি নাই। দশ রুপিয়া কামাই হইছে।

মায়ের চুলের মুঠি ধরে বাবা ক্রোধে চিৎকার করে উঠলো, তুরে না মারিলে তুই সাচ বাত নেহি বলেগা। কেরানিবাবু হামাকে বলিছে তু আইজ তিরিশ রুপিয়া কামাইছিস। হামাকে বুলছিস দশ রুপিয়া। তুই হামার রুপিয়া তুর কৌন পিয়ারের মরদকে দে দেও, আজ হামাকে জানতি হইবে।

আমরা দু-বোন এ অবস্থায় কান্নাকাটি করছি, বাপজি, মা-কো ছোড় দেও। মাৎ মারো …

তেরা মা খানকি মাগি হ্যায়। মেরা রুপিয়া উসকো পেয়ারের মরদ কো দেতা হ্যায়। রুপিয়া আজ বাহার করেঙ্গে তব মেরা নাম জাগু মাধব হ্যায়।

আমাদের সামনে মার শাড়ি খুলে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করল বাবা। মার যোনির ভেতর থেকে বাকি বিশ টাকা বের করে বাবা বিজয়ের আনন্দে হাসতে লাগল।

সপ্তাহের ছুটির দিনটি ছিল আমাদের দু-বোনের জন্য স্বাধীনতা। রাতে বাবা ঘরে ফিরত না। আমরা দু-বোন স্বাধীনভাবে উচ্চৈঃস্বরে কথা বলতাম, মাঝে মাঝে আনন্দে হেসে উঠতাম। মা তাঁর দুঃখের গল্প করত। বাবার আচরণে মা খুব উদ্বিগ্ন ছিল। মা রাগের সঙ্গে বলত, কোন্ঠে যায়েগা? ওই বেশ্যা মাগিটার কাছে যায়। আমার এত কষ্টের রুপিয়া সব ওই মাগিটার পেছনে শেষ করল।

মায়ের প্রতি বাবার নিষ্ঠুর আচরণ আমি মেনে নিতে পারি না। রাগের সঙ্গে বলি, উ হারামি হামার বাপ নেহি আছে। উ রাবণ রাক্ষস আছে।

মা আমার গালে চড় কষিয়ে বলল, ইয়ে বাত আউর মাত বোলো। উ হামার মরদ আছে। উর সাথ বুঝাপড়া হামার হবে।

পরদিন বেলা এগারোটা-বারোটার দিকে বাপ টলতে টলতে ঘরে এসে হাজির। বিছানায় শুয়ে চিৎকার করে বলল, ভুগ লাগা, খানা দে।

মা ঘরের বাইরে খোলা আঙিনায় ভাত চড়িয়ে দু-বোনের কুড়িয়ে আনা শাকপাতা রান্নার আয়োজন করছিল। রাগের সঙ্গে জবাব দিলো, ওই বেশ্যা মাগি তোকে খেতে দেয় নাই। এখানে মরতে আসিছ ক্যানে?

বাবা রাগ না করে বলল, ওই মাগি যা দেয় তা যদি তুই দিতে পারতি তাহলে কি ওই মাগির কাছে যাই।

বাবা ঘরে এলে ভয়ে-আতঙ্কে আমরা দু-বোন দিশেহারা হয়ে পড়তাম। মনে হতো ঘরে দানব ঢুকেছে। কখন কাকে চিবিয়ে খাবে কেউ জানি না। বাবা চিৎকার করে বলল, হারামজাদি দুইটা কই? গরম লাগছে। বাতাস কর।

আমরা দু-বোন পাখা হাতে ছুটে গিয়ে দুদিক থেকে শরীরে যতটুকু জোর আছে সেই জোরে বাতাস করতাম। ব্যথায় হাত অবশ হয়ে উঠত তবু থামতাম না। দৈত্য ঘুমাক, পাড়া জুড়াক। কিছুক্ষণের মধ্যে বাবার নাকডাকা শুনতাম।

বাবার খাওয়ার পর যেটুকু খাবার থাকত আমরা তিন নারী সেই খাবারটুকু খেতাম। বাবাকে আজ হাসিখুশি লাগছে। আমাদের সঙ্গে আদরের স্বরে কথা বলছে। এরকম পরিবেশ আমাদের ঘরে সাধারণত হয় না। আমাদের খাওয়া শেষ হয়েছে। হাঁড়ি-পাতিল-বাসন নিয়ে আমরা তিন নারী পুকুরঘাটে ধুতে যাবো, বাবা মায়ের হাত চেপে ধরে হাসিমুখে বলল, মাইরি, তোরে সোন্দর লাগিছে, সোয়াদ বি লাগিবে …

মা এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রাগের সঙ্গে বলল, এইটা বেশ্যাপাড়া না। উরা হামাদের বেটিয়া আছে। ছিঃ ছিঃ তুই মানুষ আছিস, না জানোয়ার আছিস?

তুর বেটিয়া জানে না তু আমার মাগি আছিস। মরদ তার মাগিরে ধরিবে ইহাতে দুষের কী আছে? আমাদের ধমক দিয়ে বলল, এই হারামজাদি, বাবা-মায়ের খেলা দেখছিস? ভাগ ইধার ছে। আমরা দৌড়ে পালিয়ে আসি। বাবা ঘরের খিল এঁটে দিলো।

এই ছিল আমাদের নিত্যজীবন। আমার বয়স তখন ছয়, ছোট বোনটার তিন। দুদিন ধরে বাবা ঘরে নেই। বন্ধুদের সঙ্গে পাশের থানায় ফুর্তি করতে চড়ক মেলায় গেছে। এবারো মায়ের মেয়ে হলো। নবজাতক ট্যাঁ ট্যাঁ করে কাঁদছে। অন্যদিকে মা যেন মৃত সন্তানের শোকে মাতম করছে। আমরা দু-বোনও কাঁদছি। বাচ্চাটার কান্না আমরা সহ্য করতে পারছি না। মাকে বারবার মিনতি করছি, মা, ওর মুখে দু-ফোঁটা দুধ দাও।

আমরা চার নারী অপেক্ষা করছি সেই দানবের। সে যখন জানবে এবারো মেয়ে হয়েছে কোন প্রলয় আমাদের ওপর নেমে আসবে কে জানে!

গভীর রাতে মা বলল, তোদের মরা বোন হয়েছে, বুঝেছিস।

মা নবজাতক বোনটিকে কোলে করে গভীর জঙ্গলে চলছে। আমরা পিছু পিছু ছুটছি আর কাঁদছি, ঘরমে চলো মাইজি। ইয়ে গুনাহ কাম মাৎ করো। ভগবান পাপ দিবে।

মা ক্রোধে চেঁচিয়ে ওঠে, কিধার ভগবান?

আমরা দু-বোন মায়ের দু-পা আঁকড়ে ধরি, ঘরমে চলো মাইজি। ইয়ে কাম মাৎ করো। ভগবান জো কোরেগা ওহি হোগা। ডরাও মাৎ।

তেরা বাপ খুন কোরেগা। হামলোগকো ছোড়কে চলা যায়েগা। দুশরা শাদি কোরেগা। এই বাচ্চা মর যায় তো কোই গোলমাল নেহি হোগা। সাব ঠিক থাকে গা।

জঙ্গলে একটি ডাল পড়েছিল, দু-হাতে সেই ডালটা আঁকড়ে ধরে মায়ের পথ রুখে দাঁড়ালাম। বাবার মতো ভয়ংকর চিৎকার করে বললাম, রোখ যাও। পুলিশ কো হাম সাচ বাত বলেগা। তোম দোনো মা-বাপ নেহি, খুনি হ্যায়।

দুদিন বন্ধুদের সঙ্গে চরক মেলায় মৌজ-ফুর্তি করে ঘরে ফিরে যখন বউয়ের তিন নম্বর মেয়ে হয়েছে শুনল, বাবার মাথা পুরোপুরি বিগড়ে গেল।

হা ভগবান, হামার কী পাপ ছিল, হামার ভাইগ্যে তিন লাড়কি দিলে। পরজনমে হামার মুক্তি হইবে না। আবার হামাকে হরিজন হইয়া জনম লিতে হইবে। এই মাগি হামাকে আবার নরকবাস পাঠাইল।

তারপর সব দায় মায়ের ওপর চাপিয়ে, যার কারণে পরজনমে বাবার উচ্চ জীবন পাওয়া হলো না, তার জীবনের সব আক্ষেপ-ক্রোধ নিয়ে মায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। মায়ের আর্তনাদে পাড়া-প্রতিবেশী নারী-পুরুষ-শিশু আমাদের ঘরের চারপাশে জড়ো হতে লাগল। কেউ বাধা দিচ্ছে না, আটকাচ্ছে না। সিনেমার কোনো দৃশ্য দেখছে যেন। নিজেরা নিজেরা আলোচনা করছে কার দোষ। যে মাগি তার মরদকে তিনটি মেয়ে দেয়, তার এমন শাস্তি হওয়াটা স্বাভাবিক। তিন মেয়ের বাবার এমন দুর্ভাগ্য কপাল দেখে বাবার পক্ষে সহানুভূতির পাল্লা ভারি। মাকে বেশি মারা ঠিক হবে না। হঠাৎ যদি মরে যায়, থানা পুলিশ নানা ঝামেলা হতে পারে। সর্দারকে ডেকে মিটমাট করে নেওয়া ভালো।

জঙ্গল থেকে যে-ডাল দিয়ে মাকে ঘরে ফিরিয়ে এনেছিলাম, সকলের অগোচরে সেই ডালটি আমি দু-হাতে আঁকড়ে ধরলাম। আমার ছয় বছর জীবনে যত শক্তি ঘৃণা ক্রোধ সঞ্চয় করেছি সব একত্রিত করে বাবার পিঠ বরাবর প্রচণ্ড আঘাত করলাম। মায়ের মতো বাবার আর্তনাদ শুনে আমার কী যে আনন্দ হলো! কয়েক মুহূর্ত মাত্র, আমি ছিটকে পড়লাম। তারপর আমার আর কিছু মনে নেই।

আমাদের গ্রামে খ্রিষ্টান মিশনারিদের একটি প্রাইমারি স্কুল ও প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র ছিল। খ্রিষ্টান মিশনারি কেন্দ্রে তিনদিন থেকে ঘরে ফিরে দেখি আমাদের গাই-গরুটা নেই। আমাদের মতো পরিবারে একটা গাই-গরুর গুরুত্ব কী আপনাদের বোঝানো আমার পক্ষে তা সম্ভব নয়। আমরা খেতে পাই বা না পাই গাই-গরুকে ঠিকমতো খাবার দিতে হয়। সংসারে মানুষের চেয়ে গাই-গরুর সেবাযত্ন বেশি, মূল্যও বেশি। রাতে গাই-গরুকে মশা যেন না কামড়ায় সেজন্য ধূপ-ধুনো দাও। শীতের সময় নিজের চটের বস্তা গরুকে দিই। গরু আমাদের সংসারে শ্রেষ্ঠ সম্পদ। গরু যদি গাই বাছুর বিয়ায়, বাড়ির মধ্যে আনন্দ বয়ে যায়। আর আমার মায়ের যখন মেয়েসন্তান হয়, তাকে গোপনে ফেলে দিতে নিয়ে যাই।

গাই-গরু না দেখে আমার দেহের শক্তি অসাড় হয়ে আসে। আমি গাই-গরুর খুঁটি ধরে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করি। আর্তস্বরে জিজ্ঞেস করি, গাই কাহা?

শান্ত হলে মা বলল, চা-বাগানের

 সর্দারজি সালিশ ডেকে মিটমাট করে দিয়েছে। আমাদের ঘরের জমি চা-বাগান থেকে তোর বাবার নামে লিজ ছিল। সে জমি এখন মায়ের নামে। এর বিনিময়ে গাই-গরু তোর বাবাকে দিতে হয়েছে। তোর বাবা আমার সঙ্গে থাকবে না। মাইয়া সে লিবে না। সব চুকেবুকে গেছে। তোর বাবা আবার শাদি করিছে। গাই-গরুটা ওর নতুন মাগিকে দিয়েছে। ও কত বেইমান মরদ আছে দুইদিন পর বুঝিবে।

জীবনে এই প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ পেলাম। আমাদের ঘরে কোনো দানব নেই। বন্দি ইচ্ছেগুলো একে একে ডানা মেলতে লাগল। আর ক-বছর পর আমি চা-বাগানের কুলি হতে পারব। মাকে আর এত পরিশ্রম করতে হবে না। হাসপাতালের দিদিমণিকে আমার খুব ভালো লাগত। আমি তাঁর স্কুলে ভর্তি হলাম। যতদিন কুলি হওয়ার বয়স না হচ্ছে ততদিন লেখাপড়া চালিয়ে যাই।

পড়তে গিয়ে আমার সর্বনাশ হয়ে গেল। আমার সামনে এক নতুন পৃথিবীর দরজা খুলে গেল। দিদির জীবনের গল্প আমার মায়ের গল্পের মতোই। সব মেয়ের জীবনের গল্প কি একই? নানা বর্ণের পরাধীনতা? ইচ্ছা-অনিচ্ছা-আনন্দের বালাই নেই, পুরুষের ইচ্ছা পূরণ করো। মানব জাতির বংশধারা টিকিয়ে রাখো। গাভি যেমন গরুর বংশ টিকিয়ে রাখে, তোমার কাজও তাই। স্বপ্ন দেখো না। সম্মান-অধিকার দাবি করো না। নারীর আবার ইচ্ছে কী, পুরুষের ইচ্ছে পূরণের জন্য নারীর সৃষ্টি। প্রকাশ্যে বা গোপনে নারী তুমি পুরুষের সেবাদাসী। তাকে মহামূল্যবান নান্দনিক রুচিশীলা দৃষ্টিনন্দন করতে মিলিয়ন ডলারের মণি-মাণিক্য সাজিয়ে সেলিব্রেটি করে তুলতে পারেন। এ-কাজে পুরুষ খুব আনন্দ পান। ঘনঘন ফ্লাশ জ্বলবে, পত্র-পত্রিকা-টিভিতে ছবি আসবে। অন্তরে-বাহিরে আপনি একজন সুশিক্ষিত পুরুষ, যে-স্বাধীনতা ভোগ করছেন তা কি আপনার স্ত্রীকে দিতে পেরেছেন?

আমার স্কুলের একটি ঘটনা দিয়ে আমার বক্তব্যের ইতি টানতে চাচ্ছি। আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। আমার পরের বোনটি দৌড়াতে দৌড়াতে আমার স্কুলে এলো। বাড়িতে পুলিশ এসেছে। মাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে।

মাকে একা পেয়ে আমার পূর্বতন বাবা জোর করে ঘরে ঢুকিয়ে দরজার খিল এঁটে দেয়। কোনোভাবে আটকাতে না পেরে আমার মা দানবের লিঙ্গ দু-টুকরো করে ফেলেছে। মাকে দেখে মনে হচ্ছে মা তার জীবনের খুব পছন্দের একটি কাজ করতে পেরেছে। মায়ের আনন্দিত মুখের দিকে তাকিয়ে আমি মৃদু হাসলাম। মা যে দানব-বধের কাজটি নিজেই করতে পেরেছে সেজন্য আমার খুব গর্ব হচ্ছিল।

মা ছাড়া পেল। দানবকে হাজত খাটতে হলো। এ-বই আমার চোখে মায়ের জীবন দেখা। কোনো ফিকশন নয়। জীবনকথা বলতে পারেন।

স্বাধীনতার অর্থ স্বামীর আদর-ভালোবাসা, দামি গিফট পাওয়া নয়। নারীর সাংবিধানিক যে অধিকার, আপনি তা ভোগ করতে পারছেন তো? জোর করে দেহ পাওয়া যায়, ভালোবাসা অর্জন করতে হয়। অধিকার-সম্মান অর্জন করতে হয়, কেউ আপনাকে গিফট করবে না। কখনো কখনো অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমার মায়ের মতো সাহসী হতে হয়। মাঝে মাঝে অন্তরে আলো ফেলে দেখে নেবেন আপনি স্বাধীন তো?