সমকালীন ও নান্দনিক দ্রোহী শব্দাবলি

আহমেদ বাসার তরুণ কবি। তারুণ্যের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ আর সবকিছু তছনছ করে দেওয়ার একটা প্রবল মনোভঙ্গি তাঁর কাব্যচিন্তায় তীব্রভাবে ক্রিয়াশীল। জীবন ও জগৎকে ভিন্নভাবে দেখার অদম্য আকাক্সক্ষা আহমেদ বাসারকে এই সময়ের মধ্যেই চিহ্নিত করতে সহায়ক হয়েছে। তিনি বাংলা বর্ণের নানা অভিঘাত আত্মস্থ করে শব্দের গায়ে নতুন পোশাক পরাতে সচেষ্ট। বয়ঃসন্ধিতে কবি হওয়া আর পূর্ণজীবনে কবি হওয়ার মধ্যে এক আকাশ ব্যবধান। আহমেদের কবিতা বেশ নির্মেদ। সবচেয়ে বড় কথা, বাসার নিজের অনুভবকে সর্বজনীন করতে উদগ্রীব। এই মাতৃভূমি, এই স্বদেশ আর প্রিয় এই শহরে নবজাতকের জন্য কী পরিণাম, কী ভয়ংকর দৃশ্য অপেক্ষা করছে, আহমেদ বাসার তা বলছেন দারুণ দক্ষতায় –

ওহ! এসে গেছো? পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যানজটের

শহরে তোমাকে স্বাগত হে ভ্রƒণশিশু

যতদ্রুত পেরিয়ে এসেছো জরায়ুমুখ

ততোটাই মন্থর তোমার জন্মশহর

তোমার জন্য অপেক্ষা করছে হা-মুখো ম্যানহোল

যত্রতত্র আবর্জনাস্তূপ আর শব্দদূষণের মহোৎসব

প্রত্যহ কাক আর মানুষের ময়লা ছোঁড়ার

প্রতিযোগিতা দেখে তুমি সত্যিই খুব মজা পাবে

(‘স্বাগত হে ভ্রƒণশিশু’)

জসীমউদ্দীন ত্রিশের দশকে শহরের মানুষকে গ্রামবাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তাঁর ‘নিমন্ত্রণ’ কবিতায়। প্রায় আশি বছর পরে আহমেদ বাসার নাগরিক জীবনের ক্লেদ দেখতে নিমন্ত্রণ করছেন অনাগতকে। সুকান্ত আশীর্বাদ করেছিলেন ভূমিষ্ঠ নবজাতককে। আহমেদ বাসার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হানতে ব্যবহার করেন একে ফোরটি সেভেন। ব্লেডের তীক্ষèতায় হেঁটে বেড়ানো গেরিলারা শত্রুর অপেক্ষায় ওত পেতে থাকে তাঁর কবিতায়। অতি ব্যবহারে ক্লিশে শব্দগুলি ইমেজের নতুন পোশাকে চমকে দিতে চায় পাঠককে। তাঁর আরো কটা লাইন –

ধ্বনি প্রতিধ্বনির জগতে বধিরের আয়ু নিয়ে বাঁচি

পড়ি মুখ – পড়ি মুখোশ

অক্ষম শব্দের ঝরে পড়া অহমের

দৃশ্যাবলি বিস্ময়ে গেঁথে রাখি রোজ

মানুষের মহত্তম বাক্যের ধ্বনি

প্রতিধ্বনি হতে যতটা দূরবর্তী

তার চেয়ে দূরে বাজে সত্যসুর

(‘বধিরের আয়ু’)

কবির জগৎ দৃশ্যমান হলেও এক অনুপস্থিত বাস্তবতায় পরিবৃত তাঁর অন্বেষণ। আহমেদ বাসার অধিবাস্তব জীবনকে বিশ্বাস্য করে তুলতে যত বেশি ইঙ্গিত তৈরি করতে পারবেন, তত বেশি সার্থকতা আসবে তাঁর কবিতায়। পৃথিবীর কবিতা এখন নানা বিষয় নিয়ে বিভাজিত। কেউ লিখছেন প্রেম, কেউ প্রকৃতি, কেউ ভ্রমণকে উপজীব্য করে। কিন্তু বিষয়ভিত্তিক কবিতার সীমাবদ্ধতা আছে। বরং আমরা বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকতে চাই।

এই স্বাধীনতা কবি নিতে পারেন তাঁর দক্ষতায়। আমাদের মতো তৃতীয় দুনিয়ার দেশগুলিতে নয়া-ঔপনিবেশিক শক্তির সহযোগী সংস্কৃতিজনরা ‘ললিপপ মার্কা’ কবি ও কবিতার পৃষ্ঠপোষক। আহমেদ বাসার ওই ধরনের কবিতাকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করছেন – এটা আশার কথা। এখন কবিতা কেমন হবে? শুধুই প্রতিবাদ, সেøাগান, চিৎকার লড়কে লেঙ্গে মার্কা বাক্যবন্ধ? না, এখন কবিতা হবে অন্তর্গত সত্যের উপলব্ধি, একে ফোরটি সেভেনের মতো লক্ষ্যভেদী, ব্লেডের মতো ধারালো ও তীক্ষè। মতো দিয়ে উপমা তৈরির দিন শেষ। উপমা-উৎপ্রেক্ষা এখন একীভূত হয়ে নতুন মাত্রায় নান্দনিকতা তৈরি করে। এসব এখন কবিতার টেকনিক্যাল সফটওয়্যার। এই প্রজন্মের কবিরা কবিতার আধুনিকতম প্রকৌশল প্রয়োগ করে কবিতাকে আন্তর্জাতিক করে তুলবেন – এটাই আমাদের আকাক্সক্ষা। বাংলা ভাষার যে অপরিসীম শক্তি তাকে আবিষ্কার এবং প্রায়োগিকভাবে উজ্জীবন ঘটানো দরকার। এখন উত্তরাধুনিক, আধুনিক, জাদুবাস্তবতা, পরাস্বপ্ন, অধিবিদ্যক নানা মতবাদে কবিতার স্রোত তৈরি করা যাবে; কিন্তু কবিতা যেন মানুষের বোধগম্য হয়, মুখের ভাষার কাছের হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। এ-গ্রন্থের কবিতাগুলি সমকালীন ও নান্দনিক।  আহমেদ বাসারের স¦কীয় ভাষাভঙ্গি আরো লক্ষ্যভেদী হয়ে উঠুক। কবিতা তাঁর হাতে আরো অগ্রণী হোক – প্রত্যাশা করি।