বিশ্বশিল্প-ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীন বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পচর্চার ইতিহাস খুব স্বল্প সময় অতিক্রম করেছে। কিন্তু ইতোমধ্যে বাংলাদেশ জন্ম দিয়েছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক শিল্পীকে। তিনি এস এম সুলতান। সুলতানের নির্লোভ স্বভাব, বোহেমিয়ান জীবন – এ সবকিছুই একেবারে আলাদা সুশীল সমাজের প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পবলয় থেকে। যে-শিল্পচর্চার আঙ্গিক গঠিত হয়েছিল দুশো বছর আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পনির শাসন শুরুর মধ্য দিয়ে, সুলতান প্রত্যাখ্যান করেছেন এই ঔপনিবেশিক দাসত্ব। তিনি আপাদমস্তক প্রগতিশীল মননের শিল্পী, এ-কথা নিঃসন্দেহ।
শেখ মোহাম্মদ সুলতান, যাঁর আসল নাম লাল মিয়া, নিজেও এই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়েছেন কিছুদিন। বিভিন্ন লেখা পত্র থেকে জানা যায়, তাঁর বিচিত্র জীবনের খন্ডিত কিছু অংশ সম্পর্কে। বাংলাদেশের আর কোনো শিল্পীকে নিয়ে, তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে, এতো তোলপাড় করা ইতিবাচক ও নেতিবাচক তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা হয়নি। গভীরতর রহস্যের ধূম্রজাল যাঁকে নিয়ে, তিনি আসলে একজন সহজ মানুষ ছিলেন। নিজের মতো, সযতনে অন্যের আরোপিত সংস্কৃতিকে পাশ কাটিয়ে গেছেন আর ছবি এঁকেছেন।
কখনো রাধা, কখনো কৃষ্ণ সেজে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেরিয়েছেন। অর্থাৎ পারফর্মিং আর্ট, যা একবিংশ শতকে বাংলাদেশে অনেক শিল্পীই চর্চা করেন, সুলতান বহু আগেই তা শুরু করেছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-ছায়াতল থেকে ভারত ভ্রমণ এবং সিমলা, কাশ্মির হয়ে পাকিস্তানের করাচিতে প্রদর্শনী করেছেন। পাকিস্তানভিত্তিক একটি পত্রিকায় পাওয়া যায় এর প্রমাণ। অতঃপর মার্কিন সরকারের আমন্ত্রণে আমেরিকা। এবং শুরু হলো ইউরোপ-ভ্রমণ। ১৯৫০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর একক প্রদর্শনী হয়। পরবর্তীকালে লন্ডনের হ্যামস্টিভ ভিক্টোরিয়া এমব্যাংকমেন্টে সে-সময়ের এমনকি বর্তমান সময়ের প্রতিভাধর-ক্ষমতাধর পাবলো পিকাসো, দালি, ব্রাক, ক্লি প্রমুখ শিল্পীর সঙ্গে সুলতান প্রদর্শনী করলেন। দেশে ফিরেও কিছু প্রদর্শনী করলেন জার্মান কালচারাল সেন্টার, শিল্পকলা প্রভৃতি গ্যালারিতে। সফল প্রদর্শনী; কিন্তু কোনো সফলতাই সুলতানকে বাঁধতে পারল না। তিনি চাইলেই বিত্তশ্রেণিতে চলাচল করতে পারতেন। বরং চলে গেলেন নড়াইলে। লাল মিয়ার নড়াইলে সুলতান গড়লেন শিশুস্বর্গ। চিড়িয়াখানা এবং একটা পুরো অঞ্চলের মানুষের চেতনাগত শিল্পবোধে ঘটে গেল আশ্চর্য বিপ্লব। সুলতান ছবি এঁকে, শিল্পের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সে-অঞ্চলের কৃষক-শ্রমিককের মধ্যে শ্রেণিবিপ্লব ঘটিয়ে ফেললেন চেতনাগত পরিমন্ডলে। জাতির শেকড় এবং ভবিষ্যৎ অর্থাৎ কৃষক ও শিশুরা ছিল তাঁর মূল মনোযোগ ও সকল দায়িত্বশীলতায়। সুলতানের বৈচিত্র্যময় জীবন, প্রজ্ঞা, রহস্যময়তা এবং জীবনদর্শন সে-সময়ে অনেক অনুরাগী তৈরি করল। অধিকাংশ অনুরাগী ছিলেন চারুকলাজগতের বাইরের মানুষ। কারণ, তাঁর যথেচ্ছচারী জীবন সুশীল নগরের শিল্পীদের অনেকের জন্যই বিরক্তির কারণ ছিল। অধ্যাপক আবুল কাসেম জোয়ার্দারের সঙ্গে ১৯৫০-৫১ সালের প্রথম দিকে, মানে প্রায় ৬৪ বছর আগে সুলতানের পরিচয়। এখন শতবর্ষ ছুঁইছুঁই এই মানুষটি সুলতানের সঙ্গে প্রায় ৩০ বছর সাপ-খোপের নির্জন ঝোপ-জঙ্গলের ঘরে একত্রে কাটিয়েছেন। তখন কাসেম সাহেব যশোরে মাইকেল মধুসূদন দত্ত কলেজের ভূগোলের অধ্যাপক। বেঙ্গল গ্যালারি অব্ ফাইন আর্টসে ‘Unseen Splendour’ (অদেখা সুষমা) শিরোনামে যে ড্রইং-প্রদর্শনীটি গত ২১ সেপ্টেম্বর শুরু হয়, সেটি আবুল কাসেম জোয়ার্দারের কাছে থেকে যাওয়া সুলতানের ড্রইং খাতায় অাঁকা শিল্পকর্ম।
সুলতানের ড্রইংগুলো শক্তিশালী রেখা এবং রেখার গতিতে। এগুলো দ্রুত আঁকা। নারী ও পুরুষ চরিত্র, প্রাকৃতিক দৃশ্য, ফুল-লতাপাতা ও পশুর ড্রইংগুলো অধিকাংশ চারকোল মাধ্যমে অাঁকা। কিছু জলরং, কলমের টোনের কাজ ও কিছু পেনসিলে করা ছবি আছে। ছবিগুলোতে সুলতানের পেইন্টিংয়ের পেশিবহুল নারী-পুরুষ নেই। কিন্তু রয়েছে ‘পেশিবহুল’ আঙ্গিকের উৎস। ড্রইংগুলো অনেক ক্ষেত্রেই কোনো পূর্ণাঙ্গরূপ নেয়নি। কুইক ড্রইংয়ের এমন বৈশিষ্ট্য স্বীকৃত। কিন্তু এই ড্রইংগুলোতেও মৌলিকত্ব দৃশ্যমান। ভারতীয় অঞ্চলের কলা ব্যাকরণের সঙ্গে এর সাযুজ্য বিদ্যমান। এসব ড্রইংয়ের অন্তর্গত বস্ত্তগুলোর গঠন, মহিলাদের সুগঠিত শারীরিক গঠন, রেখার ছন্দ, অসম্পূর্ণতাও রহস্যময়ভাবে দেখা যায়।
আমাদের জন্য কষ্টকর এই যে, সুলতান শিল্পকর্ম সযতনে রাখার ব্যাপারে কখনোই মনোযোগী ছিলেন না। তাই তাঁর জীবনের একটা বড় সময়ের (চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের দশকের) শিল্পকর্মের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। এ-প্রদর্শনীটি বাংলাদেশের জন্যে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। কারণ প্রদর্শনীর ছবিগুলো প্রথমবার প্রদর্শিত হচ্ছে এবং পঞ্চাশের দশকের সুলতানের সঙ্গে এগুলোর কথোপকথন ঘটে।
এস এম সুলতানকে নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক। সুলতানকে অনেকে প্রান্তিক শিল্পী ও অনেকে তাঁর শিল্পকর্মের গুণ বিচার করেন তাঁকে নেইভ (বন্য) বলে। আবার সুলতানের মৌলিকত্ব নিয়ে আহমদ ছফা বলেন, ‘তবু তাদের কোনো পূর্বসূরি নেই, নেই কোনো উত্তরসূরি। আচমকা জলতল থেকে সুবর্ণস্তম্ভের মতো উত্থিত হয়ে দন্ডায়মান হয়ে রয়েছে।’ নানা মুনির নানা মত থাকবেই। কিন্তু প্রদর্শনী উদ্বোধনীর দিন গ্যালারি উপচেপড়া মানুষের ঢল বলে দেয় সুলতানের গুরুত্ব। সুলতান যখন বেঁচে ছিলেন, তখনো মোহগ্রস্ত করে ফেলতেন। এখনো দর্শক সুলতানকে শুনে, দেখে, শিল্প বোঝার প্রচেষ্টায় মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যায়। তাই সুলতানের জীবন ও কর্ম নিয়ে আরো চুলচেরা গবেষণা প্রয়োজন।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.