সীমান্তের ‘অন্যদিকে’, বাংলাদেশে যখন জাতীয় সংগীত-প্রণেতা রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন উদ্যাপিত হচ্ছে সেই সকালেই চিরবিদায় নিলেন সমরেশ মজুমদার, দুই বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক। প্রথমবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে সমরেশ মজুমদার লিখেছিলেন স্মৃতিজাগানিয়া নভেলেট বুকের ভেতর বাংলাদেশ, ২০০৪-এ। একটি রহস্য উপন্যাসের গড়নে লেখা এই ১১২ পৃষ্ঠার বইটিতে জড়িয়ে আছে তাঁর ভেতরে থেকে যাওয়া দেশভাগের অনুভূতি, যন্ত্রণা, আক্ষেপ, প্রত্যাশা। গল্পের থেকে বেরিয়ে গিয়ে অনুভূতির কথা টেনে এনেছেন, সূচনাপর্বে পঁচাত্তর বছর বয়সী প্রশান্ত মুখার্জী বলছেন – ‘আমার জন্মভূমি দেখতে চাই। পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার আগে এটাই আমার শেষ ইচ্ছে।’ এই ইচ্ছাটা এখনো এই খণ্ডিত বাংলার লাখ লাখ মানুষের অন্তরে উচ্চারিত হয়। সমরেশ মজুমদার বাংলাদেশ দেখে আসার অনুভব এই রহস্যোপন্যাসে স্বপন দত্তের বয়ানে লিখে রাখেন – ‘হিন্দু-মুসলমান ব্যাপারটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। আমি একজন হিন্দু। আর পাঁচজনের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করি। আমার বেশিরভাগ বন্ধুই মুসলমান। কিন্তু আমাদের কথা বলার এত বিষয় আছে যে ধর্ম নিয়ে কথা বলি না। এখানে দুর্গা পুজোর সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। রোজার সময় ইফতারের নেমন্তন্ন খেতে খেতে পেট ভরে যায়। … আপনি হয়তো জানেন না, বাংলাদেশের মানুষ রবীন্দ্রনাথকে যে পরিমাণ শ্রদ্ধা করে, তাঁকে যেভাবে স্মরণ করে, আপনারা তার শতকরা দশভাগও করেন না। অথচ দুই দেশের জাতীয় সঙ্গীত তাঁর রচনা।’ সমরেশ মজুমদার প্রয়াত হলেন ওপারের ২৫শে বৈশাখ, শেষ যাত্রা হলো এপারের ২৫শে বৈশাখ।
ডুয়ার্সের গয়েরকাটা চা-বাগান থেকে যে-জীবন যাত্রা শুরু করেছিল সেই গোটা জীবন ডুয়ার্সের স্মৃতি বহন করে অক্ষরের বুননে সেই কথা রেখে গিয়ে কথোয়ালের যাত্রা শেষ হলো নগর কলকাতায়। ২৫শে এপ্রিল থেকে কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে। সোমবার বিকেল ৬টা নাগাদ তাঁর প্রয়াণ ঘটে। ১৯৪৪-এর ১০ই মার্চ, বাংলার ২৬শে ফাল্গুন ১৩৪৮ সনে জন্মেছিলেন, তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী সংঘাতে বিশ্ব তোলপাড়। দেশজুড়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের জোয়ার। সমরেশ মজুমদারের শৈশব কাটে জলপাইগুড়ি জেলার চা-বাগান অঞ্চল ডুয়ার্সের গয়েরকাটা চা-বাগানে, ডুডুয়া নদী, আংরাভাষায় গিলান্ডি নদী, আধো পাহাড় আধো অরণ্যের সবুজে। দাদু পূর্ণচন্দ্র মজুমদার ছিলেন
চা-বাগানের বড়বাবু, এই দাদুর ভূমিকা তাঁর জীবনে অসীম। বাবা কৃষ্ণদাস মজুমদার ছিলেন গয়েরকাটা চা-বাগানের গুদামবাবু। এই বাগানের কোয়ার্টারেই জন্মেছিলেন সমরেশ মজুমদার। পরবর্তীকালে ছাত্রজীবন জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে। তখন তাঁর বাবা কৃষ্ণদাস মজুমদার জলপাইগুড়ি শহরের তিস্তা পারের হাকিমপাড়ায় বসত গেড়েছেন। এরপর ‘উচ্চশিক্ষার্থে কলকাতা গমন’, স্কটিশ চার্চ কলেজে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা। লেখালেখি চলছে। আত্মকথায়, আলাপচারিতায় বলেছেন যে, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের লেখা থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন যে – ‘শুরু করা উচিৎ চূড়া থেকে।’ তাই তাঁর অভীষ্ট ‘চূড়া’ দেশ-এই গল্প পাঠান। কিন্তু পিয়নের ভুলে সেটি মনোনীত হয়েও ফিরে আসে। ১৯৬৭ সালে সেই গল্প – ‘অন্তর আত্মা’ – দেশ-এ প্রকাশিত হয়। এরপর ক্রমশ গল্প লেখার নেশা তাঁকে চেপে ধরে। যদিও শুরুতে চেয়েছিলেন নাটক লিখতে, কিন্তু চারপাশের চরিত্র ও ঘটনাগুলির কথা বলার নেশায় হয়ে উঠলেন গল্পকার। কলকাতার নাগরিক জীবনে ক্রমশ অভ্যস্ত হতে থাকা সমরেশের বুকের ভেতর জেগে থাকা শৈশব ও কৈশোরের ডুয়ার্স, জলপাইগুড়ি, নকশালবাড়ি, ডুয়ার্সের নদী, চা-বাগানের মানুষজন, তিস্তা তাঁর গল্পে রসদ জোগাতে থাকে। গল্প বলার জাদুকরি কলম নিয়ে একের পর এক গল্প লিখে যেতে থাকেন, একদিন সেই কলমই তাঁকে ‘পেশাদার’ সর্বক্ষণের লেখক করে তোলে। সমরেশ মজুমদারের এই প্রবল জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ ছিল তাঁর অসাধারণ গল্প বলার দক্ষতা। প্রেম বা রহস্যোপন্যাস, সবটাই নিখুঁত সম্মোহনী ভাষায় বলে যেতেন তিনি। এক্ষেত্রে তিনি ছিলেন যথার্থই শরৎচন্দ্রের উত্তরাধিকারী। গল্প থেকে উপন্যাসে চলে আসতে খুব একটা সময় লাগে না তাঁর। ১৯৭৫-এ সেই দেশ পত্রিকায় তাঁর প্রথম উপন্যাস দৌড় প্রকাশিত হয়। এরপর একের পর এক উপন্যাস এখানেই প্রকাশিত হতে থাকে। সত্তরের উত্তাল সময়কে তিনি উপকরণ হিসেবে বেছে নেন। ‘ট্রিলজি’ লিখতে শুরু করেন – প্রথমে উত্তরাধিকার, এরপর কালবেলা, কালপুরুষ।
ডুয়ার্সের শান্ত ও সবুজ নিরিবিলি জনপদ থেকে নগর কলকাতায় পদার্পণের স্মৃতি ও কষ্ট কোথাও তিনি যত্নে রেখে দিয়েছিলেন। দেশ পত্রিকায় উত্তরাধিকার ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসের শুরুর কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, সাগরময় ঘোষ তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘নিজেকে নিয়ে লেখো। তোমার জীবনী নিয়ে ইন্টারেস্টেড নই, জীবনে যাঁদের দেখেছো, তাঁদের নিয়ে গপ্পো তৈরি করো।’ এই ‘ট্রিলজি’তে আমরা সমরেশ মজুমদার ও তাঁর দেখা মানুষদের, ঘটনাগুলিকে তাঁর মতো করে দেখতে পাই। উত্তরাধিকার-এ যেমন পাই অনিমেষ কলকাতায় পড়তে এসেছে, সমরেশও তাই। শৈশবের আংরাভাষা নদী, জলপাইগুড়ি শহর, গয়েরকাটা চা-বাগান (গয়ের – স্বর্গ। স্বর্গছেঁড়া), খুট্টিমারি জঙ্গল, বাস্তবের ডুয়ার্স তাঁর লেখা দখল করে থাকে।
দৌড়-এর উৎসর্গে তিনি লিখেছিলেন, ‘… মাছেরা কি ঝরণার কাছে ঘুরে ফিরে কৃতজ্ঞতা জানায়?/ কি জানি। শুধু জানি/ ওদের জলজ বলা হয়ে থাকে …’। সমরেশ মজুমদার নেই এই খবরটা শোনার পর থেকে এই কথাগুলিই মনের মধ্যে, কানের পাশে, জিহ্বার ওপর ঘুরঘুর করছে। মনে ভেসে উঠছে ছয় বছর আগের কিছু স্মৃতি, ওই তাঁর শেষবার নিজের শহরে নিজের মর্জিমতো ঘুরে বেড়ানো। উপলক্ষ ছিল ফণীন্দ্রদেব বিদ্যালয়ের শতবর্ষ। তিনি, সমরেশ মজুমদার, ছিলেন ফণীন্দ্রদেব বিদ্যালয়ের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী জিলা স্কুলের ছাত্র। কিন্তু নিজের শহরের আহ্বান ফেলতে পারেননি। এর কিছুদিন আগেই তিনি মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তবু এলেন, আমি মজা করে তাঁকে বলেছিলাম – ‘আমরা ঝরণার জলের কলতান শুনতে চাই, আমরা জলজ।’ তিনি রাজি হলেন তাঁর কৈশোরের শহরে আসতে। ফণীন্দ্রদেব বিদ্যালয় তার শতবর্ষ উদ্যাপনের অঙ্গ হিসেবে বইমেলার আয়োজন করেছিল, তিনি সেই মেলার উদ্বোধক ছিলেন। আমরা অবাক হয়ে দেখেছিলাম – কিছুদিন আগেই মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আসা, স্মৃতি হারিয়ে যাওয়া মানুষটা তাঁর যাবতীয় অসুস্থতা কীভাবে ঝেড়ে ফেলেছেন। এই প্রবল জীবনীশক্তির মানুষটা অবশেষে হেরে গেলেন মৃত্যুর কাছে, ১৯৪৪ থেকে ২০২৩ – ৭৯ বছরের রঙিন যাত্রা শেষ হলো।
গয়েরকাটার বন্ধু বিকাশ, তাঁর কনিষ্কের মাথা জলপাইগুড়ি থেকে প্রকাশিত হয়, তখনো সে ও আমি স্কুলছাত্র। একদিন বিকাশের গয়েরকাটার বাসায় হাজির হলাম। অনেক টানের একটা ছিল সমরেশ মজুমদারের শৈশবের, তাঁর আখ্যানের মাটির গন্ধ নেওয়া। বিকাশ তখনই দুর্দান্ত কবি ও সম্পাদক। আমাদেরও মাথায় সাহিত্যের ভূত চেপেছিল, তখন সমরেশ মজুমদার কলকাতা নিবাসী, কিন্তু মাঝে মাঝেই আসেন গয়েরকাটা, জলপাইগুড়ি। তাঁদের হাকিমপাড়ার বাড়িতেও বছরে দুই-তিনবার আসতেন, বিশেষ করে পুজোর সময়। সমরেশ মজুমদার এই বাড়ির কথা প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘… আমাদের বাড়ি ছিল তিস্তা নদী থেকে বড়জোর দেড়শো গজ দূরে। বন্যা না হলেও নদীতে জল বাড়লেই তা ঢুকে পড়ত আমাদের বাগানে। একটা মজা হত তখন, সেই জলে সাঁতরে আসতো বোরলি আর ট্যাংরা মাছ। এই ট্যাংরা মাছগুলোকে আমি এখন পর্যন্ত জলপাইগুড়ির বাইরে দেখিনি। আর বোরলি তো জলপাইগুড়ির গর্বের মাছ। যেই তিস্তার জল কমতো অমনি আমরা নেমে পড়তাম বাগানে। ঘাসের, গাছের গোড়ায় থাকত কখনও বোরলি আর ট্যাংরাগুলো। … শুধু বাগানের ধরা মাছ নয়, তিস্তার জল বাড়লে বাজার থেকে মাছ কেনা হত না। এসবের পেছনে ছিল ওই খাটা পায়খানার ভূমিকা। এখন ভাবি, যেসব কর্মীরা মলের টিন বয়ে নিয়ে যেতেন, তাঁরা যদি নারাজ হতেন তাহলে শহরের মানুষদের কি অবস্থা হত? নাকে গামছা বেঁধে ওই মানুষগুলো কাজ করেছেন বলে শহরটা রক্ষা পেয়ে গিয়েছিল। অভাব কতটা তীব্র ছিল যে তার মোকাবিলা করতে মানুষকে অমন ভয়ঙ্কর কাজ করতে হয়েছে।’
আমার সেই কিশোরকালে অনিমেষ মাধবীলতার প্রেমে পড়া অনেক কিশোরের মতো আমার কাছে সমরেশ মজুমদার এক উজ্জ্বলতর তারকা। পুজোর লেখালেখি শেষ করে এই উত্তরভূমিই ছিল তাঁর বিশ্রামকাল। ১৯৭৮-৭৯, আমি তখনো স্কুলের ছাত্র, সদ্য একটা লিটল ম্যাগাজিন বের করি আর কবিতা যাপনের নেশায় আক্রান্ত হয়ে বুঁদ হয়ে আছি। জানি না কেন সেই স্কুলছাত্রটিকে স্নেহ করতেন তিনি, রাকেশ-অনিমেষ-মাধবীলতা-অর্জুনের স্রষ্টা। টাউনক্লাব স্টেডিয়ামের উত্তরের সাদা রঙের সেই বাড়িটার বারান্দায় একটা বেতের ‘ইজি চেয়ার’ ছিল। তিনি এসে চায়ের কাপ নিয়ে বসতেন, একের পর এক জিজ্ঞাসা ছুড়ে দিতাম তাঁকে। তিনি হাসতে হাসতে উত্তর দিতেন। অনেকটা জায়গা নিয়ে ছিল উত্তরাধিকার-এর চরিত্ররা। অনিমেষ, তার প্রেম, সাইকেলের ঘণ্টি থেকে স্বর্গছেঁড়া চা-বাগান। একদিন সকালে হাঁটতে হাঁটতে জিলা স্কুলের সামনের বাঁকটা পার হয়ে একটা বাড়ির সামনেটা দেখিয়ে বললেন, ‘ধরো এই পথ দিয়েই অনিমেষ সাইকেল নিয়ে ঘুরছে, ওখানে বিরাম করের বাড়ি, ওইখানে সেই মেয়েটির বাসা।’ কথায় কথায় গয়েরকাটা চা-বাগানের কথা উঠে আসতো, স্বর্গছেঁড়া তো তাঁর গয়েরকাটাই। ডুয়ার্স, চা-বাগান তাঁর চেতনার গভীরে ঢুকে ছিল। উত্তরাধিকার-এর নানা জায়গায় তার চিহ্ন রয়ে গেছে। শুরুতেই তিনি টেনে নিয়ে যান তাঁর ‘জায়গা জমিনে’। ‘শেষ বিকেলটা অন্ধকারে ভরে আসছিল। যেন কাছাকাছি কোথাও বৃষ্টি হয়ে গেছে, বাতাসে একটা ঠান্ডা আমেজ টের পাওয়া যাচ্ছিল। অবশ্য কদিন থেকেই আকাশের চেহারাটা দেখবার মতো ছিল। চাপ-চাপ কুয়াশার দঙ্গল বাদশাহী মেজাজে গড়িয়ে যাচ্ছিল সবুজ গালচের মত বিছানো চা-গাছের ওপর দিয়ে খুটিমারীর জঙ্গলের দিকে। বিচ্ছিরি, মন খারাপ করে দেওয়া দুপুরগুলো গোটানো সুতোর মতো টেনে টেনে নিয়ে আসছিল স্যাঁতসেঁতে বিকেল – ঘষা সেটের মতো হয়েছিল সারাদিনের আকাশ। বৃষ্টির আশঙ্কায় প্রতিটি দিন যেন সূচের ডগায় বসে থাকতো এই পাহাড়ি জায়গায়, কেবল বৃষ্টিটাই যা হচ্ছিল না।’ আসলে ডুয়ার্স, চা-বাগান, ডুয়ার্সের নদী তাঁর মজ্জায় ঢুকে ছিল। তাই তার প্রকাশ গোটা ‘সমরেশ সাহিত্য’জুড়ে। তাই ‘নদী বন্ধ হয়ে যাওয়া’র কথা পাই, ডুডুয়া, কালবোস মাছ তাঁর সাহিত্যে ঢুকে পড়ে। তিস্তা সেতুর আগে, ১৯৬৮-এর বন্যার আগে তিস্তার চর দিয়ে পারাপারের ভরসা ছিল চর ট্যাক্সি । সেই চর ট্যাক্সির কথা তিনি ভোলেননি। আজীবন তিনি স্মৃতি নিয়েই তো গল্প বলে গেছেন, গল্প বলাটাই ছিল মুখ্য, সাহিত্য কতটা ধ্রুপদী হলো তা নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা ছিল না। দৌড় তাঁর প্রথম উপন্যাস, সেখানে কেবলই নাগরিক জীবনের আর্তনাদ, কিন্তু তিনি যখন ‘নিজের দেখা মানুষগুলো ও ঘটনা’র আখ্যান লিখতে বসলেন তখন তাঁর যাপন জুড়ে থাকা ডুয়ার্স, জলপাইগুড়ি কথার মাঝে স্থায়ী আস্থান করে নিল। উত্তরাধিকার-এ আমরা বারংবার দেখি গয়েরকাটা-জলপাগুড়ি-তিস্তা-ডুডুয়া। ‘শীতকালে জলপাইগুড়িতে হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি আসে। এসে ঠান্ডাটাকে বাড়িয়ে দিয়ে যায়। যে সমস্ত মানুষ জরায় থিতোচ্ছিল তারা টুপটাপ চলে যায় এ সময়। তিস্তার তখন টানের সময়। শীতের দাপটে ক্রমশ কুঁকড়ে যাচ্ছে নদীটা । তবুও জল এখনও টলটলে। স্রোতের ধার নেই, যৌবন ফুরিয়ে যাওয়া মহিলার মত শুধু জাবর কেটে যাওয়া। বাঁধ প্রায় সম্পূর্ণ। ওপাশে সেনপাড়া ছাড়িয়ে তিস্তার বুকের ওপর পুল বানাবার কথাবার্তা চলছে। কলকাতা থেকে সরাসরি ট্রেনে বাসেয়াসাম যাওয়া যাবে। পক্ষিরাজ ট্যাক্সিগুলো গা-গতর ঝেড়ে মুছে এই কটা বছর কিছু কামিয়ে নেবার জন্য কিংসাহেবের ঘাটের দিকে আসবো আসবো করছে। এই সময় সন্ধে থেকেই আকাশ কাঁপিয়ে বৃষ্টি নামল।’ (পৃ ২০৬) বুকের গভীরে একটু স্মৃতি ও ভালোবাসা না থাকলে এভাবে লেখা যায় না। যে বুক অনন্ত রোমান্টিক।
‘সমরেশ মজুমদার আর নেই’ – এই খবর পেয়ে কিছুক্ষণের জন্য সেই এলাকাটা ঘুরে আসার ইচ্ছে করছিল, যেখানে তাঁদের বাসা ছিল, এখন আমারই এক বন্ধু তিনতলা বাড়ি করেছেন। সেখানে দাঁড়িয়ে যেন চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই উত্তরাধিকার – ‘তারপর আঁচল দিয়ে জিমির লালা বুক থেকে মুছে বললেন, ‘তোমরা কোথায় থাকো?’ ‘টাউনক্লাবের কাছে।’ অনিমেষ বলল। ‘ওমা তাই নাকি! একই পাড়ায় আছি এতদিন তোমাকে দেখিনি! তোমরা কয় ভাই বোন?’ ‘আমার ভাই বোন নেই, দাদু পিসীমার কাছে থাকি।’ ‘কেন, তোমার বাবা মা?’ ‘বাবা স্বর্গছেড়া চা-বাগানে আছেন।’ …’ এরপর অনিমেষের মন উথালপাথাল করা ‘দর্শন’।
সমরেশের পাঠককুলের একটা বড় অংশ ছিল তরুণ-তরুণী, যারা এই ভালোবাসার গল্পের টানে তাঁকে বাণিজ্যিকভাবেও সাফল্য এনে দিয়েছিল।
সমরেশ মজুমদারকে নিছক সাহিত্যিক হিসেবে দেখলে তাঁর গোটা ছবিটা পাওয়া যাবে না। অনেকেই বলেন যে, ডুয়ার্সের বাতাসে ‘রোমান্টিক আলো’ ঘুরে বেড়ায়, এখানে যাঁরা বড় হন তাঁদের গায়ে সেই আলো মাখামাখি হয়ে থাকে। এই রোমান্টিসিজমে সামাজিক শোষণের থেকে বেরিয়ে আসার বার্তা থাকে, বিপ্লবের গল্পকথা থাকে। সমরেশ মজুমদার একজন যুবকের স্মৃতি নিয়ে দেখেছেন সত্তরের নকশাল আন্দোলন। তাঁর সেই দেখা তাঁর মতো করে – তীব্র এক রোমান্টিকতায় এঁকেছেন। এই আখ্যান তাঁর অন্তর থেকে আসা।
পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি-পাল্টা যুক্তিকে পাশ কাটিয়ে যাননি। অনেকবার এই নিয়ে খোলামেলা কথা হয়েছে। বিপ্লবের ওই পথকে বিশ^াস করতেন না, কিন্তু সামাজিক পরিবর্তনের প্রয়োজনকে বিশ্বাস করতেন।
জলপাইগুড়ি শহরে সমরেশ মজুমদারের আপনজন, প্রিয় বন্ধুরা ছিলেন – অশোক গঙ্গোপাধ্যায়, অনুপ ঘোষ, কল্যাণ সিকদার। সেই সময় এঁরা বের করতেন উত্তপ্তদেশ। উত্তরদেশ-এর সাহিত্য আড্ডায় তিনি হাজির থাকতেন এই শহরে এলে। কিন্তু জলপাইগুড়ির সাহিত্য ইতিহাসে সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনাটি ঘটে ১৯৮৩-র শীতে। সেবার ‘শক্তি সঙ্ঘ’ একটি বড় আকারে সাহিত্যানুষ্ঠান আয়োজন করেছিল। রবীন্দ্রভবনে আয়োজিত সেই সাহিত্যানুষ্ঠানের পেছনে সমরেশ মজুমদার ছিলেন প্রধান পুরুষ। এসেছিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব গুহ, সঞ্জীব চট্টোপাধায়, দিব্যেন্দু পালিত, বিমল দেব প্রমুখ। টিকিট বিক্রি করে সাহিত্যানুষ্ঠান এই শহরে হয়েছিল, সফল আয়োজন। এরপর আবার এমন আয়োজনের কথা ভেবেছিলেন তিনি, কিন্তু দ্বিপাক্ষিক ব্যস্ততা, তাঁর অসুস্থতায় আর হয়ে ওঠেনি।
২০১৩ সালে দ্যোতনা’র ভাষাচর্চা সংকলনের প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। সেদিন আলাপচারিতায় বলেছিলেন – ‘প্রবন্ধ খুব একটা পড়ি না, লিখিও না, লিখলে নিজের লেখা ক্ষতিগ্রস্ত হতো। তবে এই কাজ আমার শহরে বসে তুমি করছো, এটা আমাকে অবাক করেছে। কলকাতায় এসো, আমি যথাসাধ্য সহযোগিতা করবো তোমাদের।’ কিন্তু সেই যাওয়াটাই আর হয়ে ওঠেনি।
কয়েকদিন তিনি মৃত্যুর সঙ্গে লড়েছেন। আমাদের আফসোস তাঁর অন্তিম ইচ্ছা পূরণ হওয়ার আগেই তিনি চলে গেলেন। তাঁর খুব ইচ্ছে ছিল, এই জলপাইগুড়ি শহরে এসে সাইকেল রিকশায় ঘুরে বেড়াবেন, যেমন শেষবার এসে ঘুরেছিলেন, বা আগেও এলে ঘুরে বেড়াতেন – রামদার চৌধুরী মেডিক্যাল, গ্রন্থভারতী, রামঘোষের মিষ্টির দোকান, একবার অবশ্যই তাঁর ঘুরে যেতে হতো অন্তরের বন্ধু অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ের কদমতলার বাসায়। সময় করে ঘুরে আসতেন বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গল, তিস্তা নদীর পার। গত মাসে একবার ফোনে তাঁর সঙ্গে কথা হলো, বারে বারে বলছিলেন – এই ডিসেম্বরে আসবেন তিনি। কদিন নিরিবিলিতে ডুয়ার্সে কাটাবেন, এরপর দুদিন জলপাইগুড়ি শহরে। দিন পনেরো আগে অশোক বাবুকেও টেলিফোনে সেই কথা জানান বলে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে জানালেন সমরেশ মজুমদারের অশীতিপর এই প্রিয় বন্ধুটি। আমাদের যাবতীয় স্বপ্ন ও ইচ্ছেগুলিকে নিয়ে তিনি চলে গেলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.