হাসনাতমঙ্গল

বহুবার ভেবেছি, লিখতে বসবো – কিন্তু হয়ে ওঠেনি। আজও কি হবে? আমি তো এখনো বিশ্বাস করি না আবুল হাসনাত, আমাদের হাসনাতভাই আর নেই আমাদের মাঝে। ধানমণ্ডির ৫ নম্বর সড়ক, মেগাডোরি আর বেঙ্গল অফিসের দিকে তাকালে আমি তো শুধু দেখি হাসনাতভাইয়ের মুখ, কালি ও কলম-এর নতুন কোনো সংখ্যা বের হলেই তো দেখি হাসি-ভরা মুখের হাসনাতভাইকে। তিনি আছেন আমাদের সঙ্গে, আমাদের মাঝে – প্রতিদিন প্রতিপল প্রতিমুহূর্তের বন্ধনে জড়িয়ে আছেন তিনি। কখনো মনে হয়, হয়তো এখনই ফোন বেজে উঠবে – ও-প্রান্ত থেকে ভেসে আসবে হাসনাতভাইয়ের কণ্ঠ – ‘শীঘ্র একটা লেখা দিতে হবে। এখনই বসে পড়ুন।’ এখন লিখতে হচ্ছে তাঁকে নিয়ে – এ কেমন কথা? তাই বুঝি আগায় না আমার লেখা।

আবুল হাসনাত ছিলেন আমাদের কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সজ্জন মানুষ। জীবনে তিনি হতে পারতেন অনেক কিছু – কিন্তু হতে চাননি কিছুই, কেবল লেখক-সম্পাদক হওয়া, এটুকুই ছিল তাঁর বাসনা। নিজেকে সবসময় লুকিয়ে রাখতে তাঁর প্রাণান্তকর চেষ্টা কার না নজরে পড়েছে! আবুল হাসনাত ছিলেন সাহিত্য ও চিত্রকলার সমঝদার। ভালো কোনো বই প্রকাশিত হলে সে-খবর আবুল হাসনাতের কাছে চলে আসত খুব দ্রুত, এবং ততোধিক দ্রুততায় তিনি সংগ্রহ করে নিতেন সে-বই। তাঁর কাছ থেকে এনে কত বই যে আমি পড়েছি। তিনিও আমার কাছ থেকে বই নিতেন, আবার সময়মতো ফেরত পাঠাতেন। কেন জানি, আমার প্রতি ছিল তাঁর একটা গভীর টান – অনুমান করি তাঁর ভালো লাগত আমার সঙ্গ। বেঙ্গলের উদ্যোগে সিলেটে যে সাহিত্য-সম্মেলন হলো ২০১৭ সালে, সেখানে গিয়েছিলাম আমি। হোটেলে পৌঁছার পর হাসনাতভাই আমাকে কাছে নিয়ে বললেন, ‘একা থাকতে ভরসা পাচ্ছি না, আমরা দুজন এক কক্ষে থাকব। আপনার অসুবিধা হবে না তো?’ তিন দিন তিন রাত হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে ছিলাম আমি।

‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার’ প্রক্রিয়ায় হাসনাতভাই অবধারিতভাবে আমাকে সংশ্লিষ্ট করে নিয়েছিলেন। হাসনাতভাইয়ের আন্তরিকতায় আমরা চেষ্টা করতাম সব কাজ সময়মতো শেষ করতে। বহু বছর ধরে আছি এই প্রতিযোগিতার সঙ্গে। কিন্তু আবুল হাসনাতের কাছ থেকে কোনো দিন কোনো কথা আমাদের শুনতে হয়নি – যেন তিনি কিছুই জানেন না এ-বিষয়ে। অদ্ভুত এক নিরাসক্তি দেখেছি তাঁর এ-সময়ে। যে-কোনো অনুষ্ঠানের সময় হাসনাতভাই থাকতেন খুব উদ্বিগ্ন। ডেকে বলতেন, ‘একটু খেয়াল রাখবেন। আমাকে যেন লজ্জায় পড়তে না হয়।’ বছর-দুয়েক আগে বিশেষ কাজে তাঁর ব্যক্তিগত কিছু তথ্য জানতে চেয়েছিলাম। উদ্দেশ্য শোনার পর বললেন, ‘এসবের দরকার কী?’ এভাবেই আমাদের হাসনাতভাই সবসময় নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন। কালি ও কলম অফিসে কিংবা তাঁর বাসায় অনেক আড্ডায় আমরা মিলিত হয়েছি। ভূমেন্দ্র গুহ, পার্থ বসু – এঁদের সঙ্গে হাসনাতভাইয়ের বাসা কিংবা আম্বালা ইনের আড্ডার কথা ভুলি কীভাবে!

হাসনাতভাই ছিলেন একজন নিষ্ঠ ও ব্যতিক্রমী সম্পাদক। সংবাদ-এর সাহিত্য পাতা, গণসাহিত্য, কালি ও কলম – এসব সম্পাদনায় তাঁর অনন্য মেধা ও সৃষ্টিশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। একসময় সংবাদ-এর সাহিত্য পাতা ছিল দেশের সেরা সাহিত্যসম্ভার। কালি ও কলম-এর সম্পাদক আবুল হাসনাতের খ্যাতি তো উভয় বাংলায় আকাশছোঁয়া। বাংলা ভাষার লেখকদের সঙ্গে আবুল হাসনাতের সম্পর্ক ছিল খুবই নিবিড়। কালি ও কলম পত্রিকায় কত লেখকের রচনা তিনি ছাপিয়েছেন, কত নতুন লেখককে তিনি শনাক্ত করেছেন! নতুন লেখক সৃষ্টি করাও ছিল হাসনাতভাইয়ের মূল একটা উদ্দেশ্য। কালি ও কলম-এর ‘বিদ্যাসাগর সংখ্যা’র লেখা সংগ্রহের দায়িত্ব তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন আমার হাতে। অনেক লেখা সংগ্রহ করে দিয়েছি। একদিন বললেন, ‘দু-একজন নতুন লেখক পেলে ভালো হয়।’ নতুন লেখক সৃষ্টিতে এভাবেই কাজ করে গেছেন আবুল হাসনাত। প্রসঙ্গত মনে পড়ে কবি বিষ্ণু দে-র জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে আবুল হাসনাত ও আমার সম্পাদনায় বিষ্ণু দে : কবিতায় ও শিল্পে গ্রন্থ প্রকাশের কথা। সে-সময়ও হাসনাতভাই নবীন লেখকদের রচনা সংকলনে বিশেষ মনোযোগী ছিলেন।

আবুল হাসনাত মাহমুদ আল জামান নামে কবিতা লিখেছেন, গদ্য-রচনাতেও কখনো কখনো ব্যবহার করেছেন মাহমুদ আল জামান নাম; তবে তাঁর অধিকাংশ গদ্যই প্রকাশিত হয়েছে আবুল হাসনাত লেখক-নামে। কবিতায় আবুল হাসনাত নাম ব্যবহার না করে এই যে ছদ্মনাম গ্রহণ – এও কি নিজেকে আড়াল করার এক সচেতন প্রয়াস? জীবনে নিষ্ঠ সাম্যবাদী আবুল হাসনাত কবিতায় কিন্তু তুমুল রোমান্টিক। জগৎ ও জীবন স্বতন্ত্র এক পরিচয় নিয়ে ধরা দিয়েছে আবুল হাসনাত কিংবা কবি মাহমুদ আল জামানের কবিতায়। আবুল হাসনাত তাঁর কবিতায় ভুবনডাঙার যে-ছবি এঁকেছেন, তা যেন তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশ। আবুল হাসনাতের কবিতায় শিল্পিতা পেয়েছে বিচিত্র ভাব, যা কবি নিজেই শনাক্ত করেছেন এভাবে :

হৃদয়, মন, মস্তিষ্ক, কখনো সখনো দিন যাপনের দুঃখ, বেদনা, কষ্ট, গ্লানি, আনন্দ কবিতা লিখতে প্রেরণা দেয়। কখনো অঙ্গীকারের তাগিদে, কখনো ভাবাবেগে তাড়িত হয়ে। কখনো সুদূর অতীতে দেখা কোনো এক হেমন্ত শীত সকালের কথা ভেবে। স্মৃতি কখনো মিছিলে উত্তোলিত কোনো নারীর রণক্লান্ত হাত বড়ই উদ্বেল করে। মিছিলে দেখা সেই নারীর মুখ, ঘামে ভেজা শরীর, স্বপ্নের দুটি চোখ আমার ক্লান্তি আর নৈরাশ্যে পঙ্ক্তির পর পঙ্ক্তি রচনায় উদ্দীপিত করে। কিন্তু হৃদয়ে তা গুঞ্জরিত হলেও লেখা আর হয়ে ওঠে না। আর ঘুরেফিরে মনে পড়ে, ভুবনডাঙার মেঘ, নৃত্যরত সাঁওতাল মেয়ের সহাস্য মুখ, প্রান্তিকের উদার প্রান্তর, শালবীথি, মহুয়া বৃক্ষ আর প্রান্তরে জ্যোৎস্নার প্লাবন।

মানববন্দনা আবুল হাসনাতের কবিতার একটি বিশিষ্ট লক্ষণ। কবিতায়, দীর্ঘ ষাট বছর ধরে, তিনি সন্ধান করেছেন শুদ্ধ মানুষকে, যে-মানুষ হয়ে উঠবে পরম মুক্তির উপাসক। কিন্তু, তেমন মানুষ খুঁজে পাননি কবি। শুদ্ধ আর সৎ মানুষের অভাব কবিকে ব্যথিত করেছে, তবে থেমে যায়নি তাঁর সন্ধান। তাই নক্ষত্রসম্ভবা মানুষের জন্য আবুল হাসনাত উচ্চারণ করেন হৃদয়মথিত এই পঙ্ক্তিমালা :

আমি

একজনও

সৎ মানুষের খোঁজ পেলুম না, যে বৃক্ষের কাছে যাবে;

ঝরিয়ে দেবে পাপ; ভিন্ন স্পর্শে

যে সুন্দর মানুষের উপাসনায়

নীলিমার সৌন্দর্যকে

বুকে ধারণ করবে –

তারপর দ্যুতিময় হবে।

একজনও সৎ মানুষ পেলাম না, যে

নিজের ছায়ায় লীন হয়ে

দুঃখের নৈঃশব্দ্যেও

নিজেকে বদলে নেবে

আমি একজনও সৎ মানুষ পেলুম না, যে

স্ফটিক জলের

হৃদয়ে, প্রসন্ন উচ্চারণে

একটি নক্ষত্র হবে।    

                (‘খুঁজে ফিরি’)

গদ্য-রচনায় আবুল হাসনাত সংহত, পরিমিত-বাক এবং একান্তই ব্যতিক্রমী। তিনি শব্দ-ব্যবহার করেন ভেবে-চিন্তে, ব্যাখ্যায় থাকেন নিষ্ঠ ও নিরাসক্ত। প্রত্যয়ী স্মৃতি ও অন্যান্য গ্রন্থ পাঠ করলে একজন ব্যতিক্রমী গদ্য-লেখক হিসেবে সহজেই আবুল হাসনাতকে শনাক্ত করতে পারবেন সচেতন পাঠক। প্রসঙ্গত উদ্ধৃত করি শম্ভু মিত্র বিষয়ে আবুল হাসনাতের এই ভাষ্য : ‘বাংলা নাটকে আধুনিকতার পথ নির্মাণ ও সৃজনে বহুমাত্রিকতা ও ঐতিহ্যভাবনার কথা যখন ওঠে তখন খুব শ্রদ্ধাভরে আমরা শম্ভু মিত্রকে … স্মরণ করি। কতভাবেই না তিনি বাংলা নাট্যমঞ্চকে করে তুলেছিলেন ঐতিহ্যিক প্রবাহের সঙ্গে ঐশ্বর্যবান ও আধুনিক। মঞ্চে প্রাণশক্তি সঞ্চারে নবধারার প্রবর্তক তিনি। বহুরূপী ও তাঁর নির্দেশিত নাটক বোধে নবীন ও দীপ্তিতে উজ্জ্বল; বাংলা মঞ্চধারায় নতুন প্রতিশ্রুতির প্রবর্তক। শুধু রবীন্দ্র-নাটকের প্রয়োগরীতি ও মঞ্চকুশলতার জন্যই নয়, নাটককে উৎকর্ষের উচ্চতায় পৌঁছানোর সাধনায় তাঁর তুল্য ব্যক্তি নেই।’ যেসব মানুষ বাঙালি সংস্কৃতিকে ঋদ্ধ করেছেন, আবুল হাসনাত তাঁর প্রত্যয়ী স্মৃতিতে তাঁদের কথাই বেশি করে তুলে ধরেছেন।

আবুল হাসনাতের আত্মস্মৃতি হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে অসাধারণ এক রচনা। এমন নিরাসক্ত আত্মজীবনী বাংলা সাহিত্যে তেমন একটা দেখা যায় না। নিজের কথার অন্তরালে আবুল হাসনাত এখানে তুলে ধরেছেন তাঁর সময়ের কথা, উত্তাল ষাটের চালচিত্র, মুক্তিযুদ্ধের অনুপম উল্লাসের কথা। আবুল হাসনাত শিশু-কিশোরদের জন্য বই লিখেছেন, গীতিনাট্য লিখেছেন, অনুবাদ করেছেন একাধিক গ্রন্থ। সংখ্যা স্বল্প হলেও আবুল হাসনাতের কলম বিচিত্র রূপকল্পে শিল্পময় হয়ে উঠেছে।

আবুল হাসনাত আর নেই আমাদের মাঝে। কিন্তু আছে তাঁর দর্শন, আছে তাঁর গ্রন্থরাজি। এসব নিয়ে তিনি বহুদিন বেঁচে থাকবেন বাঙালির চিত্তলোকে। আবুল হাসনাত নামটাই আমাদের কাছে শুদ্ধতার প্রতীক। তাঁকে স্মরণ করা, তাঁর বই পাঠ

করা – সবকিছুই আমাদের কাছে মনে হয় শুদ্ধতাকে স্পর্শ করা।

জয়তু আবুল হাসনাত, জয়তু হাসনাতভাই।