আবুল হাসনাত : কিছু ছিন্নভিন্ন অনুভব, তাঁর কবিতা ও স্মৃতিগ্রন্থ

ব্যক্তিগতভাবে লেখা ছাপানোর অনুমোদন আমি সম্পাদক আবুল হাসনাতের কাছ থেকে দীর্ঘদিন ও ধারাবাহিকভাবে পেয়েছি, তা ভাবলে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ থাকে না। তিনি দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী দীর্ঘ সময় ধরে সম্পাদনা করেন। তাঁর সম্পাদিত সংবাদ সাময়িকীতে আমার লেখা ছাপা হয়েছে ধারাবাহিকভাবে প্রায় ২০ বছর ধরে। ২০০৪ সাল থেকে আমৃত্যু তিনি সাহিত্যপত্রিকা কালি ও কলমের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সেই কালি ও কলম পত্রিকায়ও প্রথম থেকেই তিনি আমার কবিতা ও কিছু প্রবন্ধ ছেপেছেন। আমার সৌভাগ্য যে, তাঁর মৃত্যুর আগে, তাঁর সম্পাদিত কালি ও কলমের শেষ সংখ্যায়ও আমার একটি দীর্ঘ কবিতা ছেপেছেন। আমার সাহিত্যজীবনে আর কোনো সম্পাদকের কাছ থেকে এত দীর্ঘ সময় ও ধারাবাহিকভাবে এতটা অনুমোদন পাইনি! দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী ও কালি ও কলম পত্রিকায় উল্লিখিত ৪০ বছরের মধ্যে প্রায় ৩০-৩৫ বছর আমার লেখা ছাপিয়ে যে ভূমিকা তিনি পালন করেছেন, তা কখনো ভোলা যাবে না। তাঁর হাত দিয়ে লেখা ছাপা হলে মনে হতো, আমি ফুরিয়ে যায়নি, আমাকে আরো লিখতে হবে। শুধু কি তাই? তাঁর হাত দিয়ে লেখা ছাপা হওয়ায় আমি কবি ও লেখক হিসেবে সবসময়ে বিশেষ মর্যাদা অনুভব করতাম। সাহিত্য পরিমণ্ডলে একটা ব্র্যান্ডিং চালু হয়েছিল যে, আমাদের লেখা শ্রদ্ধেয় আবুল হাসনাত ছাপেন, আমরা সংবাদ ও কালি ও কলমের  লেখক।

আমাদের সাহিত্য পরিমণ্ডলের অভিভাবক, পৃষ্ঠপোষক ও আশ্রয়দাতা – যা-ই বলি না কেন, হঠাৎ তাঁর মৃত্যুসংবাদে আমরা যেন আগ্নেয়গিরির ছাইয়ের গহ্বরে পড়ে গেলাম। স্বার্থপরের মতো আমরা তো মনে মনে ভেবেছিলাম, তাঁর হাত ধরে আমাদের সৃজনশীল স্পর্ধা আরো বহুদিন ঊর্ধ্বে তুলে ধরে রাখতে পারব আমরা। সেটা আর হলো না, মনে হলো, আমরা খাদে পড়ে গেলাম।

শ্রদ্ধেয় আবুল হাসনাতকে নিয়ে আমারও কিছু স্মৃতি রয়েছে, যা অনুরণিত হবে বেঁচে থাকা পর্যন্ত। কতবার ভেবেছি তাঁকে আমি একটি বই উৎসর্গ করবো; কিন্তু পারিনি। পরমুহূর্তেই ভেবেছি – তিনি যদি ভাবেন তোষামোদ করছি। সে-কারণে তা করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। আরো ভেবেছিলাম, তাঁকে নিয়ে লিখবো বা তাঁর কোনো বই নিয়ে। এমন ভাবনা থেকে ২০১৭ সালে প্রকাশিত তাঁর নির্বাচিত কবিতা বইটি কিনে নোটও করেছিলাম; কিন্তু সে-ইচ্ছেও অবদমিত রেখেছিলাম। তবে তাঁর সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের কবিতা সংকলনটি নিয়ে একটি দীর্ঘ লেখা, তাঁর মৃত্যুর ক-মাস আগে লিখেছিলাম, তা জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত বই পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল; তা তিনি দেখেছিলেন কি না জানিনে!

সংকলনটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। বইটি  প্রকাশিত হয়েছে ২০০০ সালে, ঢাকার অবসর প্রকাশনা সংস্থা থেকে। প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী ধ্রুব এষ। ১২৬ জন কবির ২৭০টি কবিতা নিয়ে এ-বই আমাদের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক অলোকসামান্য

কাব্য-দলিল হিসেবে পাঠক, লেখক, গবেষক ও ছাত্রদের কাছে সমাদৃত। আমরা কজন তাঁর গুণগ্রাহী মাঝে মাঝে আলাপও করেছি, তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রদ্ধা জানানোর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি, সে-পথেও আমরা যেতে পারিনি!

আবুল হাসনাত এমন একজন সম্পাদক ছিলেন, যিনি লেখকদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতেন, যেন ব্যক্তিগত সম্পর্ক এমন পর্যায়ে না দাঁড়ায়, যাতে করে লেখা নির্বাচনে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা কঠিন হয় – এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখতেন বলে আমাদের কাছে মনে হয়েছে। সে-কারণে লেখা দিতে গিয়ে কেউ বসে আড্ডা বা অতিরিক্ত কথা বলবেন, সেরকম সুযোগ পাওয়া দুষ্কর ছিল। কিন্তু লেখা তাঁর নিজের পছন্দ হলে, তা ছাপিয়ে

দিতেন। ব্যক্তিগত পরিচয়ের বিষয়টি ছিল লেখার ক্ষেত্রে গৌণ। তিনি যখন দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী সম্পাদনা করতেন, তখন আমার কর্মস্থল পাশেই ছিল, তবুও গিয়ে সরাসরি হাতে লেখা দিতাম না, জিপিওতে গিয়ে লেখা পোস্ট করেছি। তাঁর সঙ্গে দেখা হলে সচরাচর বলতেন – ‘ভালো’, আর বলতেন ‘লেখা দিয়েন’। তাঁর সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের কবিতা সংকলনে কবিতা নিয়েছিলেন, আমি তিনটি কবিতা দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, আমার একটি কবিতা ছাপবেন; কিন্তু না, তিনটি কবিতাই ছেপে দিয়েছিলেন। সংবাদে ভ্রমণকাহিনি লিখতে চেয়েছিলাম, তিনি বলেছিলেন লিখতে; কিন্তু তা লিখতে পারিনি। ২০১০ সালে কালি ও কলম থেকে ‘কবিতা কথন’ নামে একটি নির্বাচিত কবিদের অনুষ্ঠান ধানমণ্ডিতে হয়েছিল। সেই জমজমাট অনুষ্ঠানে আমি কটি কবিতা পড়েছিলাম। অনুষ্ঠানশেষে নাস্তা খাওয়ার সময়, পাশে এসে কানের কাছে বলেছিলেন, ‘কবিতা পড়া ভালো হয়েছে।’ সেই কথাটি ভালোবাসার অতল থেকে তিনি বলেছিলেন বলে মনে হয়েছিল, তা এখনো অনুরণিত হয়।

২০১৯ সালে বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠানে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভায় আবুল হাসনাত মূল প্রবন্ধ পড়লেন। তিনজন আলোচকের মধ্যে আমিও ছিলাম। একই মঞ্চে তাঁর সঙ্গে সেদিন আলোচনা করতে পেরে গৌরববোধ হয়েছিল। আরো মনে পড়ছে, ৮ জুলাই ২০০৩ সালে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর, আমি কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলাম, তা সংবাদ সাময়িকীতে তিনি ছেপেছিলেন।

বাংলাদেশের সমান বয়সী তাঁর সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড   এদেশের মূল সংস্কৃতি-চেতনার কণ্ঠলগ্ন হয়ে শুধু আবর্তিতই হয়নি, সেই সংস্কৃতির ধারা শক্তিশালী করার লক্ষ্যে একনিষ্ঠভাবে কবি-লেখকদের তিনি পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। অনেক কবি-লেখকের বিকাশে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন, তা সংশ্লিষ্টজনেরা নিশ্চিত অনুভব করেন।

দুই

আবুল হাসনাত কবি মাহমুদ আল জামান নামে কবিতা ও অন্যান্য রচনা লিখেছেন। তাঁর কবিতার বইয়ের নাম জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক, কোনো একদিন ভুবনডাঙায় ও ভুবনডাঙার মেঘ ও নধর কালো বেড়াল। ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর নির্বাচিত কবিতা গ্রন্থটি। গ্রন্থটি প্রকাশ করে ‘জার্নিম্যান বুক্স’। নির্বাচিত কবিতার বইয়ে ১১৮টি কবিতা, তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ থেকে নিয়েছেন, এছাড়াও রয়েছে কিছু অগ্রন্থিত কবিতা। এই নির্বাচিত কাব্যগ্রন্থে রূপক হয়ে এসেছে ‘ভুবনডাঙ্গা’র কথা, যে-ভুবনডাঙ্গা তাঁরই স্বদেশের বিভিন্ন মূর্ত ব্যঞ্জনার প্রকাশ।  ‘ভুবনডাঙ্গার জ্যোৎস্না’ নামের কবিতায় কবি মাহমুদ আল জামান এমন অনুভব টেনে আনেন –

ভুবনডাঙ্গার মাঠ থেকে ফুলডাঙ্গা কত

                            দূর? মন বলে

জ্যোৎস্নাপ্লাবিত

রাত্রিতে থেকে যাও

আমি জানি তুমি নেই

তাই আর কড়া নাড়িনি

এই বাগানবিলাস, বুদ্ধ জুঁই, এই

                                সোনাঝুরি

                   সঙ্গীবিহীন এই রাত্রি

                     তোমাকে দিক পাখির

                   স্নিগ্ধ চোখ।

এসেছে ‘সবিতা হালদার’-এর কথা। ‘সবিতা হালদার’ – কখনো হয়ে উঠেছেন একজন নারীর মুখ, কখনো প্রিয়জনের মুখ, কখনো বা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া দূরবর্তী কারো প্রতিচ্ছবি। ‘সবিতা হালদার’ নিয়ে বেশকটি কবিতা আছে এই নির্বাচিত কবিতা গ্রন্থে, ‘সবিতা হালদারের চিঠি’ নামের কবিতায় কবি উচ্চারণ করেন –

তবুও

যাকে পাই ইমনকল্যাণে, আর

                           কোমলগান্ধারে

কিংবা কখনো বসন্ত বিলাসে

রক্তের ভেতর টের পাই, সে বলে

                                   চলেছে

কষ্ট নিয়ে কোথায় যাও,

মধ্যরাতে তোমার পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ;

তখন

এই শহর হয়ে ওঠে

অশান্ত বারুদগন্ধ নিয়ে ভয়ার্ত হরিণ

                           শাবকের বুক।

এই সময়ের মানুষ ঢেকে রাখে নিজেকে বিভিন্ন মুখোশে – সেই পর্যবেক্ষণ থেকে তাঁর কবিতায় বারবার টেনে এনেছেন ‘মুখোশ’ নামের প্রতীকী শব্দবন্ধ। আরো এসেছে কবিতায় ‘কালো বেড়াল’-এর কথা, যে-‘কালো বিড়াল’ দেশ ও জনগণের বিরুদ্ধ এক    কালজ্ঞ-শক্তি। এসেছে ‘বাদুড়’-এর কথাও। তাঁর কবিতার বিষয় ও শৈলী আলাদা, যা তাঁকে ভিন্নভাবে শুধু চিহ্নিত করে না, একজন শক্তিশালী কবি হিসেবেও আবিষ্কারের দাবি রাখে।

তিন

জার্নিম্যান বুক্স থেকে ২০১৯ ও ২০২০ সালে যথাক্রমে প্রকাশিত

 হয় প্রবন্ধগ্রন্থ প্রত্যয়ী স্মৃতি ও অন্যান্য এবং স্মৃতিগ্রন্থ হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে। প্রত্যয়ী স্মৃতি ও অন্যান্য গ্রন্থের ভূমিকায় আবুল হাসনাত লিখেছেন, ‘এ-গ্রন্থে ধরা রইল তেমনি নানা বিষয়ে আমার ভাবনা নিয়ে কয়েকটি প্রবন্ধ; ভালো লাগা কয়েকটি বই নিয়ে আমার কিছু কথা। কয়েকটি লেখা – সৃজনশীল ব্যক্তিদের সম্মাননা গ্রন্থের জন্য লেখা। এছাড়া স্মৃতি যে সতত সুখের – এ-কথাও উচ্চারিত হয়েছে বারংবার। আর শামসুর রাহমানের দীর্ঘ প্রবন্ধটি তাঁর রচনাবলি সম্পাদনার সূত্রে ভূমিকা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।’ গ্রন্থটিতে কবি শামসুর রাহমান ছাড়াও শম্ভু মিত্র, অশোক মিত্র, রেহমান সোবহান, খালেদ চৌধুরী, হাসান আজিজুল হক, আহমদ রফিক, সন্জীদা খাতুন, সমর সেন, হামদি বে, দ্বিজেন শর্মা, ভূমেন্দ্র গুহ, মাহমুদুল হক, সৈয়দ হাসান ইমাম, মতিউর রহমান, মন্দিরা নন্দী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুবীর চৌধুরী ও বুলবুল চৌধুরীকে  নিয়ে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে লিখেছেন আবুল হাসনাত, যা হয়ে উঠেছে আমাদের শিল্প-সাহিত্যের ইতিহাস, সন্ধিক্ষণ ও ক্যানভাস। ২৫১ পৃষ্ঠার বইটি ছাপা ও ভিন্নমাত্রার অলংকরণে বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রচ্ছদ ও গ্রন্থ নকশা করেছেন তারিক সুজাত।

হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে আবুল হাসনাত-রচিত একটি উল্লেখযোগ্য আত্মজৈবনিক গ্রন্থ। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, সাংবাদিকতা বিষয়ে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ, শিল্প-সংস্কৃতির বিশিষ্টজনদের জীবনের বিভিন্ন দিক, পুরনো ঢাকাসহ লেখকের বেড়ে ওঠা ও ব্যক্তিগত বিভিন্ন অনুষঙ্গ নিয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হিসেবে পাঠকের কাছে গ্রন্থটি ইতোমধ্যে গুরুত্ব পেয়েছে। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন রফিকুন নবী। ৩২৪ পৃষ্ঠার বইটি বের হওয়ার পরই বছরের শেষপ্রান্তে লেখক আবুল হাসনাত আমাদের ছেড়ে চলে যান। 

গত ১ নভেম্বর ২০২০-এ আবুল হাসনাত পরলোকগমন করেন। ১৯৪৫ সালের ১৭ জুলাই পুরনো ঢাকায় জন্ম নেন বলে এই গ্রন্থের ফ্ল্যাপে উল্লেখ রয়েছে; কিন্তু এই গ্রন্থের ৮৬ পৃষ্ঠায় তাঁর জন্ম সাল ও তারিখ নিয়ে ভিন্ন ভাষ্য পাওয়া যায়, তিনি লিখেছেন – ‘আমার জন্ম হয়েছে ১৯৪৩ সালে, মহাদুর্ভিক্ষের সময়ে ১২ আগা নবাব  দেউরিতে। আমি যে পরিবারে জন্মেছিলাম তা ছিল অতিশয় সাধারণ আটপৌরে পরিবার, দেশচেতনা বা সাম্যচেতনার আঁচ এই পরিবারকে কোনোদিন স্পর্শ করেনি। এমনকি পাকিস্তান আন্দোলন যখন প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, পরিবারের  অনেকেই তা থেকে দূরেই ছিলেন। রাজনীতি কোনোভাবে মানুষের মঙ্গলচেতনায় প্রভাব বিস্তার করে না – এরকম ধারণা সর্বদাই তাঁরা পোষণ করেছেন। ব্যবসা ব্যতিরেকে শহরের কোনো ঘটনা খুব একটা স্পর্শ করত না তাঁদের জীবনধারায়। রাজনীতি করা বা সরকার বিরোধিতা তাঁদের কাছে কোনো অর্থ বহন করেনি কোনোদিন। ম্যাট্রিক সার্টিফিকেট ও পাসপোর্টে আমার জন্মসাল ১৯৪৫ সালের ১৪ জুলাই। মা নির্দিষ্ট করে কত তারিখে ও কোন মাসে আমার জন্ম হয়েছিল বলতে পারেননি।’ এমন এক পরিবারে জন্ম নেওয়া আবুল হাসনাত পরবর্তীকালে কীভাবে ছাত্র ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের একজন বিশিষ্টজন হয়ে উঠলেন, তা বিস্ময়ের উদ্রেক করলেও বাস্তবে কিন্তু তিনি একজন উজ্জ্বল প্রতিকৃতিই হয়ে উঠেছেন শেষমেশ! আরো হয়ে উঠলেন সাহিত্য সাময়িকী ও পত্রিকার তুলনারহিত সম্পাদক। হয়ে উঠলেন কবি, প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক ও চিত্র-সমালোচক।

আবুল হাসনাতের হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে গ্রন্থটি শুধু তাঁর আত্মস্মৃতির কণ্ঠলগ্ন হয়ে থাকেনি, পুরনো ঢাকার কথা এসেছে, কীভাবে ভারত বিভাগের পর ভারতের বিভিন্ন অংশের মুসলিম জনগোষ্ঠী এসে এখানে বসবাস শুরু করে, কীভাবে এখানকার আদি হিন্দু বাসিন্দারা ঘরবাড়ি ছেড়ে পূর্ববাংলা থেকে চলে যায়, আছে আরো রক্তাক্ত দাঙ্গার কথা। লেখকের বেড়ে ওঠা থেকে শুরু করে  মায়ের কথা, পরিবারের কথা। কীভাবে তিনি তাঁর পিতার পুরনো বাড়ি নির্মাণের জন্য ৩০ হাজার টাকা সংবাদে চাকরি করা অবস্থায় সেখান থেকে ঋণ নেন, তার কথাও রয়েছে।

এই পর্যায়ে বইয়ের ৭৫ ও ৭৬ পৃষ্ঠার কিছুটা উল্লেখ করি – ‘১৯৫০ সালে যেদিন মর্মঘাতী ও ভয়ংকর দাঙ্গা হয় সেদিনটার কথা কোনোদিন ভুলব না। যদিও আমার বয়স তখন অল্প, তবু সেদিনটি আমার চোখে উজ্জ্বল হয়ে আছে। হাজী ওসমান গনি রোডে রাস্তার ওপরেই আমাদের বাড়ি ছিল। সেদিন আকস্মিক সকাল এগারোটার দিকে দেখেছি হই-হল্লা হচ্ছে রাস্তায়। অগণিত মানুষ ছুটছে নবাবপুরের দিকে; দেশবিভাগের পরও বহু হিন্দু পরিবার বাস করত নবাবপুরে। সামনের দিকে দোকান ও পেছনে বসতবাড়ি ছিল। অধিকাংশ বাড়ি ও ভবন ছিল পাকা। নানা

ধরনের নিপীড়নের পরও হিন্দু সম্প্রদায়ের একাংশ এদেশে থেকে গিয়েছিল। নবাবপুর থেকে পাটুয়াটুলি পর্যন্ত বহু হিন্দু ব্যবসায়ীর দোকান ছিল। রথখোলায় ছিল দুধের বড় আড়ত। নবাবপুরে স্বর্ণকার, ওষুধের দোকান, মনিহারি দোকান, লেপ-তোশক, মশারি-চাদর, শাড়ি ও মিষ্টির বহু দোকান ছিল। সিদ্দিকবাজার, সুরিটোলা ও সংলগ্ন অঞ্চল থেকে শত শত লোক তখন ছুটছে নবাবপুরের দিকে; খবর পেয়েছিল হিন্দুর দোকানপাট লুট হচ্ছে এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের বহু মানুষকে মেরে ফেলা হচ্ছে। এই যে শত শত লোক ছুটছিল, অধিকাংশ লোকই হিন্দুর দোকানপাট থেকে লুটপাটে কিছু পাওয়া যায় কি না সে-আকাক্সক্ষায় হন্যে হয়ে ছুটছিল। কেউ কৌতূহলী হয়েও ছুটছিল।’ আমরা জানি, এসব ঘটেছিল দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার কারণে। এমন দাঙ্গা, হত্যা, লুট ও করুণ অবস্থা ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকায় তখন ঘটেছিল, যা ছিল মানবিকতাকে হিমাঙ্কের নিচে নামিয়ে এনে রক্তাক্ত করা; সম্প্রদায় সম্প্রদায়ে এই যে বিভেদ ও অবিশ্বাস, তা আজো কাটেনি।

বইয়ের ৮০ পৃষ্ঠায় পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবারের বর্ণনাও দিয়েছেন – ‘ঢাকার বাহারি ও ঐতিহ্যবাহী খাবার পাওয়া যেত পুরান ঢাকার নানা অঞ্চলে। তেহারি, পায়া, সুতলি কাবাব, বাখরখানি, মোরগ পোলাওয়ের জন্য বিখ্যাত ছিল ইসলামপুর, লালবাগ ও চকবাজার। ইসলামপুরের সাইনু পালোয়ানের  মোরগ পোলাওয়ের স্বাদ এখনো জিবে লেগে আছে। অনেক রাত অবধি খোলা থাকত এই দোকান। আর ছিল লায়ন সিনেমার মুখে গ্যালাসি; এটি মাংসের এক সুস্বাদু পদ। শহরের দূর-দূরান্ত  থেকে অনেক ভোজনরসিক এই গ্যালাসি খাবারের জন্য যেতেন ইসলামপুরে। নারিন্দায় এসব খাবার পাওয়া যেত। পুরান ঢাকার নানা অঞ্চলে বাখরখানি রুটির দোকান গড়ে উঠেছিল। বাখরখানি রুটি অনেকেই গরুর মাংস দিয়ে খেতেন। শৌখিন বহু মানুষ বাদাম তেলের বদলে ঘি দিয়ে তৈরি করাতেন এই রুটি। কখনো ঢাকার অষ্টগ্রামের পনির দিয়ে এই বাখরখানি তৈরি হতো। আর ছিল ঢাকার সুস্বাদু মিষ্টি।’

মধ্য পঞ্চাশ থেকে পরবর্তী ষাট বছরে ঢাকার যে-পরিবর্তন হয়েছে, তার বিভিন্ন পর্যায়ের বর্ণনা এ-বইয়ের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে ছড়িয়ে আছে। পাঠক মাত্র তা পড়েই ঢাকার ভূগোল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থা ও মানুষের জীবনধারা সম্পর্কে বিভিন্ন দিক খুঁজে পাবেন।

এ-বইয়ে লেখক মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কীভাবে ঢাকা থেকে গাজীপুর-নরসিংদী হয়ে ত্রিপুরা পৌঁছেন, তারপর কলকাতায় কমিউনিস্ট পার্টির যুদ্ধকালীন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত হয়ে কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা রাখেন, সেই ভূমিকার বিভিন্ন পরিধির কথা যেমন এসেছে, তেমনি বহু মানুষের কথাও তিনি তুলে ধরেছেন, যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেরই বিশেষ অংশ হিসেবে আমরা বিবেচনা করতে পারি।

আবুল হাসনাত রাজনীতি, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক জগতের একজন ঘনিষ্ঠ ও বিশিষ্টজন ছিলেন। সেই সূত্রে এত বিশিষ্টজনের সঙ্গে তিনি মিশেছেন, কাছাকাছি থেকেছেন। তাঁদের কথা ঘুরেফিরে এ-বইয়ে তিনি বিস্তৃতভাবে বলেছেন, সে-কারণে এই স্মৃতিগ্রন্থটি শুধু আবুল হাসনাতের স্মৃতিগ্রন্থই হয়ে ওঠেনি, অন্য অনেকেরও ছোট ছোট স্মৃতির বয়ান হয়ে উঠেছে, যা পাঠ করলে বিভিন্ন মানুষ সম্পর্কেও জানা যায়।

আবুল হাসনাত দীর্ঘদিন দৈনিক সংবাদের সঙ্গে যুক্ত থেকে সাংবাদিকতা ও পত্রিকাটির সাহিত্য সাময়িকী সম্পাদনা করেছেন। এই গ্রন্থে সাংবাদিক জীবনের অনেক অপ্রিয় কথা তিনি বলেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পর সাংবাদিক শুভ রহমানের ঠাঁই সংবাদে আবারো কেন হলো না, কেন কায়েস আহমদের ট্র্যাজেডি হলো, কেন সংবাদে তাঁর নিজের পাওনা টাকা পেতে জটিলতা হলো – এসব নানা অজানা বিষয়ও তিনি তুলে ধরেছেন।

এই গ্রন্থের লেখক সিপিবি ও কমরেড ফরহাদের রাজনৈতিক ভূমিকার অজানা অনেক বিষয়ও টেনে এনে রাজনৈতিক ইতিহাসের উপাদান জুগিয়েছেন। আবুল হাসনাত, প্রেমিকার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার বিষয়টিও অকপটে তুলে ধরেছেন। এ-কারণে তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে চিকিৎসাও নিয়েছিলেন, তাও বলেছেন দ্বিধাহীনভাবে। সবমিলিয়ে আবুল হাসনাতের হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হবে, যদি আমরা ঢাকার সামাজিক ইতিহাস জানতে চাই, মুক্তিযুদ্ধ ও সাহিত্য-সাংস্কৃতিক বিভিন্ন অভিঘাতের সঙ্গে পরিচিত হতে চাই, রাজনৈতিক ও সাংবাদিকতা জগতের অন্দরমহলের অবস্থা অবলোকন করতে চাই কিংবা বিশিষ্টজনের কাজ ও চারিত্র্য সম্পর্কে জানতে চাই এবং আবুল হাসনাতকে নিবিড়ভাবে বুঝতে চাই, তাহলে এই গ্রন্থের কাছে আমাদের যেতে হবে।

চার

কবি মাহমুদ আল জামানের সৃজনশীলতার আরেক জগৎ তাঁর শিশুসাহিত্য। ইস্টিমার সিটি দিয়ে যায়, যুদ্ধদিনের ধূসর দুপুর, সমুদ্র ও টুকুর গল্প – এই বইগুলো শিশুসাহিত্যে উজ্জ্বল হয়ে আছে দীর্ঘদিন হলো। ২০১৮ সালে জার্নিম্যান বুক্স মাহমুদ আল জামানের কিশোর সমগ্র বের করে। এতে ইস্টিমার সিটি দিয়ে যায়, রানুর দুঃখ ভালোবাসা, যুদ্ধদিনের ধূসর দুপুর, সমুদ্র ও টুকুর গল্প এবং যুদ্ধদিনের পোড়োবাড়ি সংকলিত হয়। এই কিশোর সমগ্রটির ছাপা, বাঁধাই ও অলংকরণ দৃষ্টিনন্দন। তিনি শিশু-কিশোরদের জন্য আরো লিখেছেন জীবনীগ্রন্থ চার্লি চ্যাপলিন, জসীমউদ্দীন  ও সূর্যসেন।

চিত্রসমালোচনা বিষয়ে তাঁর লেখালেখির এলাকাটাও কম বিস্তৃত নয়। এ-বিষয়ে তার দুটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধের বই :  সতীনাথ, মানিক, রবিশঙ্কর ও অন্যান্য এবং  জয়নুল, কামরুল, সফিউদ্দীন ও অন্যান্য। মুক্তিযুদ্ধের কবিতা ও মুক্তিযুদ্ধের গল্প – তাঁর সম্পাদনাকাণ্ডের উল্লেখযোগ্য চিহ্ন। এই বই-দুটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সাহিত্যের অলোকসামান্য দলিল। অনুবাদও করেছেন তিনি – পশতু কবিতা ও পুশকিনের কবিতা।

দৈনিক সংবাদ ছাড়ার পর আবুল হাসনাত কালি ও কলমের সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি চিত্রকলা বিষয়ক পত্রিকা শিল্প ও শিল্পীরও সম্পাদক ছিলেন। এর আগে গণসাহিত্য নামে একটি সাহিত্য পত্রিকাও তিনি সম্পাদনা করেন। সম্পাদক হিসেবে পরিচিতি ব্যাপক হওয়ার কারণে লেখক আবুল হাসনাত বা কবি মাহমুদ আল জামানের সৃজনশীল কর্মকাণ্ড সবসময়ই অনেকটা আড়ালে থেকেছে।

১৯৮২ সালে টুকু ও সমুদ্রের গল্পের জন্য পেয়েছেন অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কার। ২০১৪ সালে তাঁকে বাংলা একাডেমি সম্মানসূচক ফেলোশিপ দেয়। ছায়ানটের কার্যকরী সংসদের সদস্য আবুল হাসনাত একসময়ে সংগঠনটির সহ-সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন দীর্ঘদিন।

আবুল হাসনাত শুধু একজন বিশিষ্ট ও তুলনারহিত সম্পাদকই ছিলেন না, তিনি আমাদের একজন বিশিষ্ট কবি, প্রাবন্ধিক ও শিশুসাহিত্যিক। তাঁর সৃজনশীল সাহিত্যকর্মের প্রতি যদি আমরা পাঠক ও সমালোচক হিসেবে আরো মনোযোগী হই, তাহলে শুধু আমরা তাঁকে গভীরভাবে আবিষ্কার ও অনুভবই করতে পারব না, তাঁর এবং তাঁর সাহিত্য সম্পর্কে আমাদের কৌতূহলও আরো বাড়বে।