আবুল হাসনাতের আত্মজ্ঞান ও তাঁর অগ্রসরমানতা

সর্বজন শ্রদ্ধেয় শঙ্খ ঘোষের ‘নিরহং শিল্পী’ নামে একটি প্রবন্ধ আছে। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘কত সময়েই আমাদের দেখতে হয় অযোগ্যের আস্ফালন! দেখতে হয়, শুনতে হয়, আর দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে ক্লিষ্ট হতে থাকে মন।’ আবার এই দেখা আর শোনার বিপরীত চিত্রের কথা উল্লেখ করতেও শঙ্খ ঘোষ ভোলেননি। সে-কারণেই বলেছিলেন, ‘সামনে-দেখা অনেক বিনয়ছবিও কি ভেসে আসে না কাছে? নিরহং আচরণের অনেক অনাবিল চিহ্নও কি ধরা থাকে না আমাদের অভিজ্ঞতায়? মনে

হয়, আস্ফালনের একেবারে বিপরীত সেই অভিজ্ঞতাগুলিই মুছে দিতে পারে সব ক্লেদ, নতুনভাবে সচল করে তুলতে

পারে মন।’

শঙ্খ ঘোষের এই কথাগুলো যখন পাঠ করি, প্রয়াত আবুল হাসনাতের কথা তখন স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মনে পড়ে যায় – যাঁরা এই মানুষটিকে খুব কাছ থেকে চিনতাম, জানতাম – তাঁদের কাছে সেই নিরহং শিল্পীর এক অনুপম দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি।  নিজের  সময়ের  নায়ক  হওয়ার  প্রায় সমস্ত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নিজেকে চিরদিন অন্তরালেই রেখেছিলেন। কখনো ভরা-মজলিশে সামনে আসার কসরত তাঁকে করতে হয়নি, করতে চানও-নি। আত্মজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ ছিলেন, সে-কারণেই আত্মমর্যাদার বোধটুকুও কখনো এক মুহূর্তের জন্যও হারিয়ে ফেলেননি। পবিত্র বাইবেলের ‘Isaiah’ (‘যিশাইয় ভাববাদীর পুস্তক’) অংশে সেখানে বলা হচ্ছে – ‘Arise, shine, for your light has come.’ (‘উঠো, দীপ্তমতী হও, কেননা তোমার দীপ্তি উপস্থিত’)। আবুল হাসনাতের ব্যক্তিত্বে আমরা দেখতে পেয়েছিলাম সেই দীপ্তির প্রোজ্জ্বল উপস্থিতি, যা তাঁকে সাধারণের মধ্যেই এক অসাধারণ ব্যক্তিত্বের পরিচিতি দিয়েছিল। আমরাই বরং আমাদের

আত্ম-অহমিকার আস্ফালন দেখিয়ে তাঁকে কখনো-কখনো

অগ্রাহ্য করেছি।

আবুল হাসনাতকে যে ‘নিরহং শিল্পী’ বলছি, তাতে অনেকেই হয়তো একটু অবাক হবেন, ভাবতে পারেন – সম্পাদক-কবি-প্রাবন্ধিক-চিত্রসমালোচক ছিলেন তিনি, কিন্তু তাই বলে ‘শিল্পী’ও কি ছিলেন? নাকি সেটা তাঁকে বলা যায়? শঙ্খ ঘোষ এ-প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন, “শিল্পী’ শব্দটির তাৎপর্য বহুদূর প্রসারিত হতে পারে। চলচ্চিত্রের সংগীতের নাট্যের চিত্রের ভাস্কর্যের সাহিত্যেরই শুধু নয়, ‘শিল্পী’ কেউ হতে পারেন জীবনেরও, যাপনেরও।’

আবুল হাসনাতকেও আমরা সেই অর্থেই শিল্পী বলেছি – একজন ‘নিরহং শিল্পী’।

আবুল হাসনাতের অসাধারণত্বের কথা বলতে গিয়ে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর একটি স্মৃতিচারণমূলক প্রবন্ধে কয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছিলেন। সেগুলোকে যদি একটু সূত্রাকারে সাজাই, তাহলে হাসনাতের কৃতিত্বের দিকটি স্পষ্টভাবে আমাদের সামনে ফুটে উঠবে –

ক. তিনি দীর্ঘদিন ‘সংবাদ’-এর সাহিত্য সাময়িকী সম্পাদনা করে ‘সংবাদ’-এর সাহিত্য সাময়িকীকে একটি বিশেষ উচ্চতায় দাঁড় করিয়েছেন। … অত্যন্ত দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে সম্পাদনা করতে পারতেন, যা ছিল আমাদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। … প্রবীণ লেখকদের যেমন সম্মান দেখাতে জানতেন এবং তাঁদের লেখা প্রকাশ করতেন, তেমনি তরুণদেরও তিনি উৎসাহিত করতেন এবং নিয়মিত লেখা প্রকাশ করতেন।

খ. সম্পাদনার ক্ষেত্রে যে গুণটা বেশি থাকা দরকার, সেটা হলো ভালো লেখা চেনার ক্ষমতা এবং লেখাটিকে সঠিকভাবে তুলে ধরা। আবুল হাসনাত ভালো লেখা সহজে চিনতে পারতেন। তাঁর সম্পাদনার মুনশিয়ানার কারণে ভালো লেখা পেতে সমস্যা হতো না।

গ. হাসনাত ছিলেন একজন প্রচণ্ড শিল্পসমঝদার মানুষ। ‘সংবাদ’ এবং ‘কালি ও কলম’-এর সম্পাদনায় এর স্পষ্ট স্বাক্ষর রয়েছে। তিনি নিজেও অনেক শিল্পসমালোচনা লিখেছেন। তাঁর শিল্পসমালোচনায়ও প্রতিভার স্বাক্ষর লক্ষণীয় ছিল। … সমসাময়িক অনেক শিল্পীই ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুজন।

ঘ. হাসনাত শুরু থেকেই রাজনীতির মানুষ ছিলেন। তিনি সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন।

ঙ. ব্যক্তিগত জীবনে হাসনাতের মতো এত বিনয়ী, রুচিস্নিগ্ধ ভদ্র মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। তাঁর চলাফেরা, অন্যের

সঙ্গে আচার-ব্যবহার ও জীবনযাপন ছিল অসাধারণ ব্যক্তিত্বপূর্ণ।

(দৈনিক সংবাদ : ৫ নভেম্বর, ২০২০)

এটা শুধু সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর একার অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ বা পর্যালোচনা নয়; আবুল হাসনাতের সঙ্গে যাঁদের ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল, তাঁদের প্রায় সবাই উপর্যুক্ত বিবরণের সঙ্গে আন্তরিকভাবে একমত পোষণ করবেন।

অধ্যাপক-প্রাবন্ধিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম লিখেছেন যে, ‘আমি দেখেছি হাসনাতভাইয়ের মধ্যে যে রাজনৈতিক সত্তাটা

ছিল – সেটি জনদরদি, গণমুখী এবং পরিবর্তনকামী। এই পরিবর্তনটা যখন সম্ভব হয়নি, তিনি খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। তিনি আশা করছিলেন স্বাধীনতার পর একটা নীরব বিপ্লব হবে। আমার মনে হয়েছে, তিনি সমাজকে নিয়ে যে স্বপ্নটা দেখতেন সেটির বাস্তবায়ন না হওয়ায় মনে মনে তিনি খুবই কষ্টে ছিলেন।’

                                (দৈনিক সমকাল : ৬ নভেম্বর, ২০২০) 

সেদিনকার সেই হতাশাজনক পরিস্থিতিতে আবুল হাসনাতের মতো সংবেদনশীল, রাজনীতি-সচেতন মানুষ বেশ খানিকটা বিমর্ষ হয়ে পড়বেন – এটাই তো স্বাভাবিক। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম আরো জানিয়েছেন, ‘মুখ ফুটে তিনি কখনও তাঁর কষ্টের কথাগুলো বলতেন না। তবে তিনি মানুষকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা কখনও ছেড়ে দেননি, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত হয়তো তিনি মানুষকে নিয়ে স্বপ্নটা দেখেছেন।’ আর সেই কারণেই – সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের মতে – আবুল হাসনাত ‘সত্তর দশকের শুরুতে এসে … ভেবেছিলেন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করলে তিনি বহু  মেধা ও প্রতিভাকে একটা জায়গায় নিয়ে আসতে পারবেন; এবং সেই মেধা ও মননের সমন্বয়ে তিনি বাংলাদেশে একটা সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারবেন। যে সংস্কৃতি মানুষকে জাগাবে।’ এখানে বলে রাখা ভালো যে, সেদিনকার সেই দুঃসময়ের মধ্যে আবুল হাসনাতের সেই সংবেদনশীল, রাজনীতি-সচেতন চিন্তারই ফসল গণসাহিত্য, যার সম্পাদনার দায়িত্ব তিনি নিয়েছিলেন।

অন্যদিকে তাঁর নিজের স্মৃতিকথায় আবুল হাসনাত লিখেছেন, ‘১৯৭২ সালের আগস্টে প্রকাশিত হলো মাসিক সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা ‘গণসাহিত্য’। আমি হলাম সম্পাদক। সেই সময়ে একটি সংখ্যা বের হওয়ার পর বছর দশেক বেঁচে ছিল।’     (হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে)

সেই বইতেই তিনি অকপটে স্বীকার করেছিলেন, ‘এই পত্রিকাটি সে-সময় বেঁচে থাকার এক অবলম্বন হয়ে উঠেছিল।’ এই পত্রিকার প্রকাশ শুধু তাঁর একার নয়, অনেক লেখক-পাঠকের কাছেও তা ছিল জীবনের স্পন্দনকে স্পর্শ করতে পারার মতো একটি ঘটনা।

গণসাহিত্যের প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ২২শে শ্রাবণ, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ৭ই আগস্ট, ১৯৭২ সালে। এদিনটি আবার রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ দিবস। পত্রিকাটির প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জার দায়িত্বে ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী।

কী ছিল প্রথম সেই সংখ্যায়? ছিল – প্রবন্ধ, কবিতা, থিয়েটার নিয়ে আলোচনা, গল্প, পুস্তক-সমালোচনা। প্রথম সংখ্যায় প্রবন্ধ লিখেছিলেন – আনিসুজ্জামান (‘পৃথিবীর কবি’), রণেশ দাশগুপ্ত (‘কবিতা যেন জীবন্ময়ী নদী’), রংগলাল সেন (‘মার্কুসের সমাজচিন্তা’), সন্তোষ গুপ্ত (‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ ও বিষ্ণু দে’) ও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (‘মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ’)।

আজকের দিনে এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা বলতে পারি, ওই পত্রিকার প্রতিটি প্রবন্ধই ছিল সুনির্বাচিত, প্রাঞ্জল; সেইসঙ্গে নানাভাবে তৎকালীন সময়ের বহুস্তরিক চিহ্নকে যেন ধারণ করার একটা ব্যাপার তাদের মধ্যে দেখা যায়। এখানেই আবুল হাসনাতের সম্পাদনার মুনশিয়ানা, যাকে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছিলেন, ‘ভালো লেখা চেনার ক্ষমতা এবং লেখাটিকে সঠিকভাবে তুলে ধরা।’ গণসাহিত্যের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল – নানা ধরনের পুস্তক-সমালোচনার উজ্জ্বল আর বৈচিত্র্যময় সমাহার। আমরা জানি, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের পরিচয় পত্রিকার প্রধান শক্তি নিহিত ছিল তার গ্রন্থ-সমালোচনার অংশে। গণসাহিত্যের বেলায়ও একথা সত্যি। সম্পাদকের নির্বাচন ও সম্পাদনার গুণে পুস্তক-সমালোচনাও যে কীভাবে একটি পত্রিকার উজ্জ্বল অংশে পরিণত হয়ে থাকে, তার নমুনা পেয়েছি এই গণসাহিত্য পত্রিকায়। একই দৃষ্টান্ত আবুল হাসনাত তাঁর সংবাদ সাময়িকী কিংবা কালি ও কলম সম্পাদনার সময়েও দেখাতে সমর্থ হয়েছিলেন।

পরিচয় পত্রিকা প্রসঙ্গে হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় যেমনটি বলেছিলেন, এই পত্রিকার ‘নায়ক যদি কেউ থাকেন তো তিনি অতি সঙ্গত ও স্বাভাবিকভাবেই হলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত।’

গণসাহিত্য-সম্পাদনায়, তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও, এমন কথা আবুল হাসনাতের বেলায় বলার এতটুকুও উপায় নেই। আবুল হাসনাত নিজেই সেই উপায়টি আর রাখেননি। সম্ভবত রাখতে চানও-নি। কেননা, তাঁর ব্যক্তিত্বের ধরনটিই ছিল এসবের বিপরীত। তিনি কখনোই ‘নায়ক’ ছিলেন না – না গণসাহিত্যে, না সংবাদে, কি কালি ও কলমে। প্রতিটি পত্রিকায় তিনি ছিলেন, যাকে বলা যায়, নেপথ্যের কারিগর। অন্তরালে থাকতেই তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। আমাদের কালের ‘সম্পাদক’ ছিলেন তিনি; কিন্তু কোনোভাবেই তাঁর কালের নায়ক নন। আবুল হাসনাতের শ্রদ্ধার একজন মানুষ ছিলেন নাট্যজন শম্ভু মিত্র। শম্ভু মিত্রের মতো তিনিও মনে করতেন যে, ‘নায়ক’ বা ‘জনপ্রিয়’ হওয়ার চেষ্টার মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধ নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। এদিক থেকে আবুল হাসনাত ছিলেন সতর্ক ও সচেতন, যা কি না তাঁর রুচিবোধ ও মাত্রাজ্ঞানের পরিচয় দেয়।

আবুল হাসনাতের জীবনের অন্যতম সেরা কীর্তি সংবাদ সাময়িকী সম্পাদনা। একটি দৈনিকের সাহিত্যের পাতাকে কতটা উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব, তার এক অসামান্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছেন তিনি। এ-প্রসঙ্গে দৈনিক বাংলার সাহিত্য সম্পাদক আহসান হাবীবের কথাও আমাদের স্মরণ করা উচিত। আবুল হাসনাত তাঁর স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন, ‘১৯৭৪ সালের জুলাই মাসে আমাকে যখন ‘সংবাদ’ সম্পাদক আহমেদুল কবির সংবাদ সাময়িকীর দায়িত্ব গ্রহণ করতে বললেন, আমি অনুভব করেছিলাম এ দায়িত্বের বিশালত্ব কত না বৃহৎ।’ তিনি আমাদের আরো জানিয়েছেন, ‘১৯৭৬-এ সংবাদ পুনঃপ্রকাশের পর সাময়িকী বিভাগটি নববিন্যাসে বিন্যস্ত করার চেষ্টা করেছিলাম। … সংবাদ কর্তৃপক্ষের সহায়তায় এই সময় চার পৃষ্ঠা সাময়িকী প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।’ সেখানে কী কী আয়োজন ছিল তার একটা সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়েছেন আবুল হাসনাত – ‘ইতিহাস, ঐতিহ্য, বিদেশি সাহিত্য, বই পরিচিতি, সংগীত, স্বাস্থ্য, এমনকি স্থাপত্যও গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে সাময়িকীর পাতায়। … পঁচিশে বৈশাখ ও বাইশে শ্রাবণে বের হতো রবীন্দ্রসংখ্যা।’ এরপরই গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য আমাদের জানান তিনি – ‘আমার বিশেষ দৃষ্টি ছিল নবীন লেখকদের পরিচর্যায়। আকস্মিক অনেক চমক জাগানো এবং সমীহ করবার মতো লেখকদের রচনা আসত মফস্বল থেকে, কখনো দূরের কোনো গ্রাম বা শহর থেকে। সেসব লেখা পত্রস্থ হয়েছে যত্নসহকারে।’ কথাগুলো কতটা সত্যি সেটা আজকের প্রজন্মের অনেকেই হয়তো ঠিকঠাক বুঝতে পারবেন না। কিন্তু আশি-নব্বইয়ের দশকে যাঁরা সাহিত্যচর্চা করেছেন, কিংবা সেই সময়ের হৃদয়বান পাঠক-পাঠিকা যাঁরা ছিলেন, তাঁরা এই কথার গুরুত্বটি অনুধাবন করতে পারবেন। সেই কারণেই আবুল হাসনাত লিখেছিলেন, ‘সেকালে অনেক পাঠক ও লেখকের কাছে সংবাদ সাময়িকী শ্রদ্ধার আসন অর্জন করতে সমর্থ হয়েছিল। বাংলাদেশের প্রায় সব প্রতিষ্ঠিত লেখকই লিখেছেন সংবাদ পত্রিকার সাময়িকী বিভাগে। তাঁরা আমাদের অনুরোধে সাড়া দিয়ে তাঁদের শ্রেষ্ঠ লেখাটিই লিখেছেন এই বিভাগে।’ কথাটির মধ্যে একটুও অতিশয়োক্তি নেই। আবেগের আতিশয্যের কোনো ব্যাপারই আবুল হাসনাতের মধ্যে ছিল না। এইটি তাঁর ব্যক্তিত্বেরই একটি সামগ্রিক ধরন।

এই তথ্যটিও অনেকেরই হয়তো জানা নেই যে, আবুল হাসনাত একজন তন্নিষ্ঠ, আগ্রহসঞ্চারী কবি ছিলেন। ‘মাহমুদ আল জামান’ নামে নিয়মিত কবিতা-চর্চা করে গিয়েছেন; কিন্তু নিজে থেকে কাউকে সে-কথা বলার মতো মানুষ তিনি ছিলেন না। প্রাবন্ধিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী খুবই চমৎকারভাবে আবুল হাসনাতের কাব্যকীর্তির মূল্যায়ন করেছেন অল্প কয়েকটি কথায়। তিনি বলেছেন, ‘তাঁর [মাহমুদ আল জামান] কবিতাও আমি অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে পাঠ করি। সম্পাদনায় হাসনাত ছিলেন নৈর্ব্যক্তিক, কিন্তু কবিতায় ছিলেন তার বিপরীত। এখানে তাঁর ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ, আবেগ, মান-অভিমান জায়গা করে নিত। অর্থাৎ তাঁকে আরও ব্যাপকভাবে খুঁজে পাওয়া যেত কবিতায়।’ আমরা এখানে তাঁর প্রকাশিত তিনটি কাব্য থেকে খানিকটা দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি –

ক.

সত্য বটে কোথায় লুকাবে? কুচকাওয়াজে জীবন অগ্নিগর্ভ

প্রজ্ঞার আগুনে অঙ্গীকারের শব্দাবলী দীপ্র,

                    শোকসভায় জ্বলে না কোন প্রেম;

হওয়া না হওয়ার দ্বিধায় দুলছে বুক

সত্য বটে আশার গন্তব্যে কোথায়ও কোন

                                       অনন্ত নেই।

(‘জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক’, ১৯৮৭)

খ.

একদিন জন্মান্ধ লোকটি শোকস্তব্ধ শহরে

নারীর জন্য

    দৈন্য দুঃখ শোক নিয়ে

    অপরাজিতার মতো নীল হয়ে

    বেঁচেছিল আকাশ গঙ্গায়, খাণ্ডবদাহনে

    তারপর

অপেক্ষা থেকে অঙ্গীকারে যেতে যেতে

 ফের সে দেখে নিল

প্রিয় জন্মভূমি, কিছু ফুল

চারিদিকে ছড়ানো ছবি

পিতার প্রতিকৃতি।

(‘কোনো একদিন ভুবনডাঙায়’, ২০১০)

গ.

মন্দিরে পুষ্পাঞ্জলি

সুরুলের বৃক্ষের সারির ভিতর পাখির ঘরগেরস্থালি

বিষাদ গাঢ় হওয়া এই স্মৃতি বিস্মৃতির কালো বারান্দায়

২৬ ডিসেম্বরের স্তব্ধ দুপুরে

মনে হলো

প্রেম বুকে বীজকম্প অন্ধকার নিয়ে সবিতা হালদার এখনও বেঁচে আছে।

(‘ভুবনডাঙার মেঘ ও নধর কালো বেড়াল’, ২০১৪)

কবি হপকিন্স (Gerard Manley Hopkins) গভীরভাবেই বিশ্বাস করতেন যে, ‘Every true poet, I thought, must be original and originality a condition of poetic genius.’। যে-‘কাব্যিক প্রতিভা’ কিংবা ‘অপূর্ব প্রজ্ঞা’র কথা হপকিন্স বলেছিলেন, সেটি মাহমুদ আল জামানের (আবুল হাসনাত) মধ্যে পূর্ণমাত্রায় ছিল। নিজের রচিত কবিতা নিয়ে তাঁর কতখানি প্রস্তুতি আর আয়োজনের বিশালতা ছিল, সেটি আমরা তাঁর এই ‘আত্মকথন’ থেকে বুঝে নিতে পারি, যেখানে তিনি বলেছেন : ‘হৃদয়, মন, মস্তিষ্ক কখনো-সখনো দিন যাপনের দুঃখ, বেদনা, কষ্ট, গ্লানি, আনন্দ কবিতা লিখতে প্রেরণা দেয়। কখনও অঙ্গীকারের তাগিদে, কখনও ভাবাবেগে তাড়িত হয়ে। কখনও সুদূর অতীতে দেখা কোনো এক হেমন্তে শীত সকালের কথা ভেবে।’ এ-রকম একটি প্রাঞ্জল আর অনবদ্য টুকরো গদ্য পাঠ করার পরে এই আক্ষেপ আমাদের কিছুতেই যায় না যে, এতটা আয়োজন শেষেও তিনি কতটা কম লিখে গেলেন! কবিতার গুণগত মান আর সংখ্যার বিচারটা মাথায় রেখেও কথাটা বলতে হলো।

আবুল হাসনাতের সঙ্গ-নৈকট্য পাওয়ার সৌভাগ্য যাঁদের হয়েছে, তাঁরা জানেন এই মানুষটির ব্যক্তিত্বের ধরন; তার চিন্তার কাঠামোর সঙ্গে যাঁদের নিবিড় পরিচয় ছিল, তাঁরা জানেন তাঁর পছন্দ-অপছন্দের স্বাতন্ত্র্যময়তা। দেশ-বিদেশে চিত্রকলায় তিনি অনুরক্ত ছিলেন, ছিলেন দর্শন-ইতিহাস-সাহিত্য-সংস্কৃতির আগ্রহী পাঠক, রবীন্দ্রনাথে মগ্ন, কিন্তু আধুনিক সাহিত্যভাবনায় সমাচ্ছন্ন একজন উজ্জীবিত ব্যক্তি। জীবনজিজ্ঞাসায় ছিলেন তিনি ক্লান্তিহীন, সেই সক্রিয় চেতনা বন্ধুবর্গের চেতনায় সঞ্চারিত করার পরিশীলিত ক্ষমতাও তাঁর মধ্যে ছিল। জীবনের কাছে কৃতজ্ঞ বোধ করি এই কারণে যে, তাঁর নিবিড় সঙ্গ পাওয়ার সুযোগ আমাদের কারো-কারো হয়েছিল। এই বিষয়ে আজ বিশদে না-গিয়ে শুধু বলি, রবীন্দ্রনাথের বিদেশি বন্ধুদের একজন ছিলেন লিওনার্দ এলমহর্স্ট (Leonard Knight Elmhirst)। চিত্রকর নন্দলাল বসু সম্পর্কে তিনি একবার বলেছিলেন যে, ‘নন্দলালের সঙ্গ একটা এডুকেশন।’ আবুল হাসনাতের সঙ্গে নন্দলাল বসুকে কোনোভাবেই হয়তো মিলিয়ে ফেলার উপায় নেই, কিন্তু এই কথাটি তাঁর সম্পর্কেও আমরা বলতে পারি যে, আবুল হাসনাতের সঙ্গ ছিল একটা সত্যিকারের ‘এডুকেশন’। নন্দলালের মতো তাঁর শিল্পদৃষ্টিও ছিল ‘অত্যন্ত খাঁটি’ আর তাঁর ‘বিচারশক্তি ছিল অন্তর্দর্শী’। এই মানুষটি নিজের অতীতকে স্বীকার করে নিয়ে, বর্তমানকে গ্রাহ্যতা দিয়ে, ভবিষ্যতের দিকে আশাবাদী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে পারতেন শুধু এই কারণেই যে, তিনি একান্তভাবেই মানবিক অভিযাত্রায় নতুন আলোর চেতনার প্রত্যাশী ছিলেন, কোনো সস্তা আবেগের কাছে কিংবা জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাবের সঙ্গে তাকে মিশিয়ে ফেলতে চাননি।

৮.১

অসুস্থ শরীরে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আবুল হাসনাত লিখেছিলেন –

আমার রোদ্দুর ঢেকে যাচ্ছে কালো মেঘে

হায় ছায়াবৃতা দাও, আমাকে দাও সজীব

সহজ উজ্জ্বলতা

ঘুম নেই চোখে, তাকিয়ে থাকি

অক্সিজেনের মিটারে।

আবুল হাসনাতের এই কবিতার সূত্রে আমাদের মনে পড়ে, রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘জানালার কাছে বসে বসে প্রায়ই ভাবি, দূর বলে একটা পদার্থ আছে, সে বড়ো সুন্দর। বস্তুত সুন্দরের মধ্যে একটা দূরত্ব আছে, নিকট তার ¯ূ’’ল হস্ত নিয়ে তাকে যেন নাগাল পায় না।’ সুন্দরের নাগাল পাওয়া-না-পাওয়া নিয়ে এই উপলব্ধি শেষ মুহূর্তেও আবুল হাসনাতের মধ্যে তীব্রভাবেই ছিল। রবীন্দ্রনাথের মতো তিনিও আমৃত্যু বিশ্বাস করতেন, ‘সুন্দর আমাদের সমস্ত দিগন্ত ছাড়িয়ে যায়, তাই সে প্রয়োজনের সঙ্গে সংলগ্ন থাকলেও আমাদের প্রয়োজনের অতীত।’ তাঁর এই বিশ্বাস নিয়েও কোনোদিনই একেবারেই রাজনীতিবিমুখ  ছিলেন  না  আবুল  হাসনাত।  মাও সে-তুঙের এই কথায় তাঁরও আস্থা ছিল যে, ‘আমাদের ঝড়ঝাপটার মোকাবিলা করা ও দুনিয়ার মুখোমুখি হওয়া উচিত … এ দুনিয়া হচ্ছে গণসংগ্রামের মহান দুনিয়া।’ আর তাই দেখতে পাই, তাঁর

স্মৃতিকথায় কী অকপটেই-না তিনি বলেছিলেন, ‘দারিদ্র্যের কশাঘাতে জীর্ণ ও শীর্ণ হতে পারত আমার জীবন। কিন্তু আমি সেটা হতে দিইনি।’ সেইসঙ্গে এ-ও বলেছেন দ্বিধাহীনভাবে : ‘মাঝে মাঝে বিষণ্ন বোধ করি, যখন দেখি কোনো বন্ধু ও আত্মজন অহংকার ও দম্ভে মানুষকে অশ্রদ্ধা করেন।’ জীবনানন্দ দাশ তাঁর অন্তিম পর্বের কবিতায় দীনতাকে অন্তিম গুণ হিসেবে উল্লেখ করে লিখেছিলেন – ‘মানুষের সব গুণ শান্ত নীলিমার মতো ভালো?/ দীনতা : অন্তিম গুণ, অন্তহীন নক্ষত্রের আলো।’

৮.২

‘স্থিতপ্রজ্ঞ’ এই মানুষটি তাঁর সেই মানবিকতার অন্তিম গুণ সঙ্গে নিয়েই আমাদের মধ্যে থেকে বিদায় নিয়েছেন। শম্ভু মিত্র যাকে বলেছিলেন ‘খেই-হারানো যুগ’, সেই যুগে বসবাস করেও, জীবনের কাছে এ-এক বিশাল প্রাপ্তি আবুল হাসনাতের, যার কাছে যে-কোনো বৈষয়িক প্রাপ্তিই তুচ্ছ হয়ে যেতে বাধ্য। শঙ্খ ঘোষের কথার জের ধরে বলতে হয় – ‘জীবন ভরে সবসময়েই কি এঁরা এমন ছিলেন? না-ও হতে পারে তা। ভিন্ন কোনো সময়ে ভিন্ন কারো চোখে অন্যরকম ছবিও ধরা দিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু কোনো কোনো লহমায় এভাবে নিজেকে সর্বতোভাবে সমর্পণ করে দিতে পারেন কোনো মানুষ, তাঁর শিল্পকাজের দায়ে, বিনতির সেই অপার সৌন্দর্যটা কখনো ভুলবার নয়।’ আর সেটি ভুলবার নয় বলেই আবুল হাসনাতের প্রসঙ্গেও কথাগুলো বারবার মনে পড়ে। তাঁর চলে যাওয়াটা আমাদের

শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্যের জগতের ক্ষতির দিকটি যেন চোখে আঙুল দিয়ে বারবার দেখিয়ে দিয়ে যায়। আমরা সেই মোহ্যমানতা আর কাটিয়ে উঠতে পারি না।

৮.৩

আর ঠিক এখানেই আবুল হাসনাতের বিজয়। বিজয় যাবতীয় ব্যর্থতা আর অপ্রাপ্তির বিরুদ্ধে। তাঁর মতো একজন মানুষের পক্ষেই সম্ভব মৃত্যুকে এইভাবে পেছনে ফেলে দৃঢ় পদক্ষেপে তাঁর অন্তহীনভাবে এগিয়ে যাওয়া, যা কেবল একজন ‘নিরহং শিল্পী’র পক্ষেই সম্ভব হয়ে ওঠে।

জার্মান লেখক মার্টিন কেম্পশেন বিশ্বাসের কথা বলতে গিয়ে জানিয়েছেন যে, ‘একজন কবির রচনা বেশি-বেশি পড়াই আমাদের পক্ষে কবিকে সম্মান জানানোর একমাত্র উপায়।’ ঠিক সে-কারণেই আবুল হাসনাতের গোটা জীবনের অর্জনগুলো নিয়ে আলোচনা, বৌদ্ধিক পরিক্রমা, পর্যালোচনার বিস্তার – এসবই আজ হতে পারে তাঁকে সত্যিকার অর্থেই সম্মান জানানোর একটি কর্তব্যনিষ্ঠ আয়োজন। সেই আয়োজন থেকে আমরা যেন নিজেদের কোনোভাবেই দূরে সরিয়ে না রাখি।

প্রয়াত আবুল হাসনাতের স্মৃতির প্রতি জানাই আমাদের আন্তরিক শ্রদ্ধা!