প্রত্যয়ী স্মৃতির সঞ্চয়

প্রবন্ধপাঠ যে একইসঙ্গে অনুভূতি ও মননকে যুগপৎ স্পর্শ করতে পারে ভাবনায়, লাবণ্যে ভরিয়ে দিতে পারে প্রাণ, তার দৃষ্টান্ত অন্তর্নিহিত রয়েছে আবুল হাসনাতের গদ্যে। জানার, বোঝার নানা স্তরিক সমাবেশে-স্বকীয় বিন্যাসরীতিতে বিনির্মিত এই গদ্যশৈলীতে মিশে রয়েছে কবিপ্রাণের আত্মিক ছোঁয়া। মাহমুদ আল জামান নামে যে তিনি কবিতাও রচনা করেন সেটি তখন বিশেষ তাৎপর্য পায়। চিন্তার ব্যাপ্তি আছে, গভীরতা আছে, অথচ ভার নেই, আবার তা হালকা চপলতাও নয়। একে বলি, দেখা ও উপলব্ধির অভিজ্ঞতার নান্দনিক রসায়নে জুড়ে থাকা অন্তঃশীল অন্তর্ময়তা। আবুল হাসনাতের প্রত্যয়ী স্মৃতি ও অন্যান্য (২০১৯) প্রবন্ধ গ্রন্থটি আমাকে বিস্মিত করেছে উক্ত নান্দনিক বোধে ও অন্তর্মননের বিশ্লেষণ ক্ষমতায়। সৃজনশীল ব্যক্তিদের সম্মাননা জ্ঞাপনের জন্যই লিখিত হয়েছে গ্রন্থটি, যাতে আছে ব্যক্তিগত স্মৃতির সংবেদন, তদ্গত চিত্তের সুমিত সুবেদী অন্তর্বয়ন-কলা। বিশজন সাংস্কৃতিক-সাহিত্যিক ব্যক্তিত্বের সমাবেশে সংকলিত প্রবন্ধগুলি যেমন বৈচিত্র্যবহুল, তেমনি নানা চেতনার রূপান্বয়ে, ব্যক্তির কৃতি ও ব্যক্তিত্বের স্বকীয়তায় অনন্য রূপমূর্তি ধারণ করেছে। এঁরা সবাই আমাদের বৌদ্ধিক-সাংস্কৃতিক ভূমণ্ডলের ঐতিহাসিক মানুষ – সময়পটে সমাজদীক্ষায়, বহুস্তরিক সংগ্রাম ও জীবনকে আত্মস্থ-বিকিরিত করায় স্বনামধন্য। আবুল হাসনাতের রাজনীতি-মতাদর্শ ও শিল্পপ্রাণতার প্রকাশ ঘটেছে তাঁদের ঘিরে, বলা চলে নিজেকে খুঁড়ে খুঁড়ে জুড়ে দিয়েছেন তাঁদের সঙ্গে, মরণের ওপারে চলে গিয়ে তিনি নিজেও আজ আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন নিজের কৃতিকর্ম দিয়ে, লেখালেখির – স্বল্প হলেও – দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন।

বহুরূপী নাট্যান্দোলনের প্রাণপুরুষ শম্ভু মিত্র এবং রক্তকরবী প্রযোজনার খালেদ চৌধুরী – এই দুই ব্যক্তিত্বের সাযুজ্য খুঁজে পাই উভয়ের নাট্যপ্রাণতার সঙ্গে। আবুল হাসনাতের শম্ভু মিত্রকে নিয়ে যে-ভাবনা তা একদিকে তথ্যনির্ভর, আরেকদিকে মর্মার্থ তুলে ধরায় আলোকসঞ্চারী। বাংলা নাটকের বিশ শতকীয় ঐতিহ্যের হাত ধরে শম্ভু মিত্র দীর্ঘ নাট্যপথ হেঁটেছেন, নতুন ও আধুনিক ধারা তৈরির ব্রত নিয়ে, প্রত্যয়বোধে আর সংগ্রামে এই ব্রতটি সফলভাবেই পালিত হয়েছে। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাট্যের প্রযোজনা ও নির্দেশনায় আর অভিনয় পারদর্শিতায় শম্ভু মিত্র বাংলা নাট্যজগতে রবীন্দ্রনাথের প্রতীকধর্মী নাট্যরূপকে নিয়ে এসেছেন বাস্তব রক্তমাংসের জগতে। তাৎপর্য, মর্মার্থ আর রূপকল্পে তাঁর রক্তকরবী, চার অধ্যায়ের অভিনয় ছিল সমকালের পটে প্রাসঙ্গিক ও অপরিহার্য, আবেদনের সূক্ষ্মতায়, শৈল্পিক রূপাদর্শে রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেন বাংলা নাটকের নতুন অধ্যায়।

দ্বিতীয় কৃতি হচ্ছে, অভিনয়ে যাত্রাধর্মী আবেগপ্রবণতা থেকে মুক্ত করা, তাঁর থিয়েটার ছিল বুদ্ধিদীপ্ত, সমাজ-সচেতন আর শিল্পগুণে আঁভাগার্দতুল্য সৃষ্টি, থিয়েটারকে ওয়ে অব লাইফ করে তোলা। তৎকালীন কম্যুনিস্টদের নির্দেশের বাইরে গিয়ে তিনি থিয়েটারকে গড়ে তোলেন নাট্যগোষ্ঠীধর্মের অনুগত যেখানে বহুস্তরিক জীবন সংগ্রামই ছিল আদর্শ, গণনাট্য সংঘ বা নবনাট্য কিংবা বহুরূপী – সবেতে তাঁর সহযোগ ও বিজড়ন সর্বদাই সৃজন-উদ্যোগ ও বৃহত্তর জনমানুষের হৃদয়উদ্বোধকের দায়িত্ব পালন করে গেছে। আর ছিল অভিনয়ের দুর্লভ ক্ষমতা দিয়ে মঞ্চসজ্জা ও চরিত্রকে-কাহিনিকে নববিন্যাস দেওয়ার রূপদক্ষতা। এক্ষেত্রে শম্ভু মিত্র সহায়তা পেয়েছেন খালেদ চৌধুরীর কাছ থেকে, নাট্যজগতের আরেক প্রতিভাধর রূপকার। আর সঙ্গিনী হিসেবে পেয়েছেন গুণবতী অভিনেত্রী-স্ত্রী তৃপ্তি মিত্রকে – আরেক অতুলনীয় প্রতিভাময়ী নাট্যজন।

শম্ভু মিত্রের সকল স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। আবুল হাসনাত সেদিকটিতেও আলো ফেলেন। কলকাতায় একটি স্থায়ী মঞ্চ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা-উদ্যোগ গ্রহণ করা সত্ত্বেও ব্যর্থ হয়, তাছাড়া ইতোমধ্যে পরের প্রজন্মের আচরণ, দলের অভ্যন্তরীণ সংকট তাঁকে বেদনাহত করেছিল। তাঁর জীবনদর্শন ও কর্মক্রিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ভণ্ডামি ও ক্ষুদ্রতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ। সমাজ, রাষ্ট্র, সহযাত্রী ও আত্মজন তাঁকে যতটা কষ্ট দিয়েছিল, তার নিদর্শন পাওয়া যায় মৃত্যুর কিছুদিন আগে লিখিত এক ইচ্ছাপত্রে। এই প্রবন্ধে শম্ভু মিত্রের নাট্যরচনা, বিশেষ করে চাঁদ বণিকের পালা সম্পর্কে আলাপ করা হয়নি। প্রতিভাধর এই মানুষটিকে প্রবন্ধকার বিস্ময়-নম্র প্রত্যয়েই শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।

একই সূত্রে আমরা পাঠ করতে পারি ‘খালেদ চৌধুরী ও রক্তকবরী’ প্রবন্ধটি। এটিও স্মৃতিতর্পণ ও কৃতির বয়ান। খালেদ চৌধুরী বাংলা নাট্যমঞ্চকে করে তুলেছিলেন আধুনিক ও দেশীয় নাটকের সংশ্রিমণজাত শিল্প। অসাধারণ ভারসমতা রক্ষা করে প্রতীকায়নের মধ্য দিয়ে, বিশেষ করে রক্তকরবীর মঞ্চায়নকে দিয়েছিলেন অনন্য উচ্চতা, যতে ছিল পরিশীলিত বোধ ও অভিনবত্ব। তাঁর বোধ ও মনন গড়ে উঠেছিল আইপিটি-র কর্মী ও সদস্য হিসেবে সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞের অভিজ্ঞতা থেকে। মঞ্চ পরিকল্পনায় শুধু আবেগ নয়, ছিল প্রখর বুদ্ধিমত্তা – কী উদ্ভাবনী কৌশলে, কী পরিমিতিতে। আরো অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছিল চিত্রকলা, রেখচিত্র ও লোকসংগীতের সঙ্গে তাঁর গভীর সম্পৃক্তিতে। সংগীত, পোশাক, বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারে, আবহ সৃষ্টিতে তিনি ছিলেন বিজ্ঞ ও পরিশ্রমী। অনেক নাটকের মঞ্চ পরিকল্পনা করেছিলেন কৃতিত্বের সঙ্গে। তাঁর আরো পরিচয় হচ্ছে, তিনি ছিলেন মঞ্চ-পরিকল্পকের পাশাপাশি প্রচ্ছদশিল্পী, সংগীতজ্ঞ, লোকশিল্প সংগ্রাহক ও লেখক। তৎকালীন সাংস্কৃতিক জগতে বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা এবং ভাবনা-বিনিময়ের সূত্রেও খালেদ চৌধুরীর প্রতিভার বিকাশ ঘটেছিল। তাঁর স্মৃতিকথা বিষয়ক বইয়ে এ-বিষয়ে বিস্তৃত বক্তব্য আছে – যা একইসঙ্গে তুলে ধরে খালেদ চৌধুরীর সৃজনশীলতার পরিচয় এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক-সৃজনশীল চিন্তানায়কদের অনেক অজানা তথ্য। আবুল হাসনাত যত্ন ও কুশলতার সঙ্গে তাঁর প্রবন্ধে এই সৃজনতৎপর সময়টিকে বয়ান করেন আকর্ষণীয় গদ্যে। একটি বিশেষ তথ্য হলো, খালেদ চৌধুরীর নাম ছিল প্রথমে চিরকুমার দত্ত, পরে চিত্তরঞ্জন চৌধুরী এবং হিন্দু ধর্মের গোঁড়ামিতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে গৃহত্যাগী হয়ে নাম গ্রহণ করেন খালেদ চৌধুরী। হাসনাত প্রবন্ধটিতে আরো বিশ্লেষণ করেন কমিউনিস্টদের মতাদর্শভিত্তিক সাংস্কৃতিক ক্রমতৎপরতা, আইপিটির অগ্রণী ভূমিকা ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-জটিলতার দিকগুলো; তবু তিনি ছিলেন বহুরূপী ও শম্ভু মিত্র-তৃপ্তি মিত্রের একান্ত আপনজন ও আত্মজন। প্রবন্ধে তাঁর থিয়েটারে শিল্পভাবনা নামের বইটির ওপর আলোকপাত করে হাসনাত প্রতিফলিত করেছেন খালেদ চৌধুরীর ব্যক্তিপ্রতিভার ঐতিহাসিকত্ব, মন ও মননের শিল্পান্বিত রূপটিকে।

বাংলাদেশের অগ্রণী সাংস্কৃতিক-ব্যক্তিত্ব ও লড়াকু মানুষটি হচ্ছেন সন্জীদা খাতুন। তাঁকে নিয়ে হাসনাতের স্মৃতির প্রত্যয় বিশেষভাবে গভীরতাসন্নত। প্রবন্ধটি সংহত, মিত পরিসরের এবং সন্জীদা খাতুনের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের। এখানে হাসনাতের স্বদেশ-অন্বেষা ও সাংস্কৃতিক চেতনার যুগপৎ প্রকাশ ঘটেছে। আমরা ছুঁতে পারি সন্জীদা খাতুনের প্রতিভা ও কৃতির সঙ্গে সঙ্গে হাসনাতেরও প্রত্যয়, প্রজ্ঞা ও লেখনীসত্তার স্বকীয়তাকে। একজন লেখকের এটাই ধর্ম যে, তিনি নিজের মননাবেগের স্রোতকেও বইয়ে দেবেন অপরের ব্যক্তিসত্তা নিয়ে স্মৃতিতর্পণের ধারায়। এর ফলে পাঠক দুই স্রোতের মিথস্ক্রিয়ায় তৃতীয় একটা

বোধ-মননে সংবেদ্য ও বিজ্ঞ হয়ে ওঠে।

এদেশে ষাট দশকের গণআন্দোলনের যে-ধারা সৃষ্টি হয়েছিল তাতে সাংস্কৃতিক দিকটিও ছিল অগ্রসৈনিকের ভূমিকায়। হাসনাত তাঁর প্রবন্ধে এসব আন্দোলন-সংগ্রামের পটভূমি ও কার্যক্রম বর্ণনা করেন – নিজেও ছিলেন এর অংশীদার। এই প্রেক্ষাপটেই জন্মায় রবীন্দ্রচর্চাভিত্তিক ‘ছায়ানট’ – বাঙালি সংস্কৃতির সামগ্রিক বিকাশ ও  উন্নয়নের লক্ষ্যে। ‘নবীন মধ্যবিত্ত ও উঠতি যুবকেরা এই সময়ের ছায়ানটের কর্মপ্রয়াসে সঞ্জীবিত হয়েছিল। মঞ্চ পরিকল্পনা, শিল্পীদের পোশাক ও সংগীত পরিবেশনার নতুন এক বিন্যাস নিয়ে এসেছিল ছায়ানট।’ সন্জীদা খাতুন ছিলেন এর অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা। রুচি নির্মাণে ও সংস্কৃতিচর্চায় তাঁর কর্মকাণ্ড ছিল ঐতিহাসিক। কেবল সংগীত নয়, শিল্প ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের বহুমাত্রিক ঘটনায় সমৃদ্ধ হয়ে উঠছিল তাঁর জীবনধারা। সন্জীদা খাতুনের ব্যক্তিস্বরূপকে চিহ্নিত করে হাসনাত ইঙ্গিত দেন তাঁর সৃষ্টিশীলতা ও অঙ্গীকারের অভিযাত্রার দিকে। যার সঙ্গে যুক্ত ছিল সাহিত্য-সাধনাও। জীবনদৃষ্টির নানা পালাবদলও তাঁকে করেছিল অভিজ্ঞতাঋদ্ধ এক ব্যক্তিমানুষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর শান্তিনিকেতন গড়ে দিয়েছিল তাঁর সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার জগৎকে, বিশেষ করে তৎকালীন নিষিদ্ধ রবীন্দ্রসংগীতকে তিনি মুক্ত করেছিলেন। মনন, সাধনা ও বিদ্যাচর্চার সঙ্গে সঙ্গে সংগীতচর্চার ফলে সন্জীদা খাতুনের জীবনচর্যা হয়ে উঠেছিল বৈচিত্র্যময়। তাঁর সামাজিক-সাংস্কৃতিক লড়াই তাই বাঙালির জাগরণ ও মুক্তিরই যুদ্ধ। একাত্তরের দিনগুলোতেও অব্যাহত ছিল তাঁর ধৈর্যময় দৃঢ়তা ও সক্রিয়তা। শরণার্থী শিবিরে তাঁর সংগীত ও সুরতরঙ্গ হয়ে উঠেছিল প্রত্যয়ী-প্রত্যাশার বাণী। হাসনাত বারবার স্মরণ করেছেন তাঁর শেকড়সন্ধানী, বিজ্ঞানভিত্তিক ও মানবিক-সাংস্কৃতিক জনশিক্ষার চিন্তাচেতনাকে। সন্জীদা খাতুনের কৃতি-কৃতিত্ব তাই প্রাণদায়ী এক মহতী সাধনা। তাঁর সঙ্গে হাসনাতের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল বলেই লিখতে পেরেছেন এই প্রবন্ধটি, যা নিছক গুণকীর্তন নয়, গভীর উপলব্ধি ও স্বচক্ষে আপন অভিজ্ঞতার আলোয় পরিস্রুত। হাসনাত ছিলেন প্রথম দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সাহিত্য পাতার সম্পাদক; পরবর্তীকালে মাসিক কালি ও কলমের সম্পাদক, স্বভাবতই সাহিত্যধারার সঙ্গে তাঁর নিবিড় সখ্য ছিল বোধের ও বিবেচনার। আলোচ্য গ্রন্থে তাই কবি-লেখকদের বেশি স্মরণ করেছেন তিনি। তাঁদের নিয়ে স্মৃতির পশরা সাজিয়েছেন, কবিতার ক্ষেত্রে

দেখি সমর সেন, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শামসুর রাহমান প্রমুখের কাব্যসাধনার অন্তর্লোক আবিষ্কারে তিনি সচেষ্ট।

কবি সমর সেনের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত বাংলা একাডেমি ঢাকার একটি অনুষ্ঠানে আলোচনাসূত্রে কবি সম্পর্কে নিজের পঠন-পাঠন ও নান্দনিক বোধকে তুলে ধরেছেন। সামগ্রিকভাবে সমর সেনের বিশেষত্ব উল্লেখ করে দেখান যে, এই কবির ‘সৃজনধর্ম, ব্যক্তিস্বরূপ, মস্কোয় অনুবাদক হিসেবে যাপন, সোভিয়েত সমাজব্যবস্থার প্রতি আস্থা থাকা সত্ত্বেও বাক-স্বাধীনতা সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি এবং নাউ ফ্রন্টিয়ার পর্বের সাংবাদিক জীবন।’ এতো বিচিত্র অভিজ্ঞতাময় জীবনযাপনে সমর সেন ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ অর্থকষ্ট থাকা সত্ত্বেও ছিলেন সংগ্রামের অঙ্গীকারে দৃপ্ত। সাংবাদিক হিসেবেও ছিলেন বিবেকী কণ্ঠস্বর ও সমাজের অসংগতি চিহ্নিতকরণে সাহসী। হাসনাতের স্মৃতিচারণায় এই দিকটি বেশি মনোযোগ পেয়েছে। বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের তৎকালীন ভূমিকা নিয়েও তিনি কথা বলেছেন। তাঁর মতে, সমর সেনের কবিতা প্রাথমিক পর্যায়ে রোমান্টিক যা বেদনা ও বাসনা-

অতৃপ্তিতে ভরপুর। কলকাতা শহরের মধ্যবিত্ত যুবকদের প্রেম ও হতাশা, রুদ্ধ যৌবন, এইসবই সমর সেনের অবলম্বন। এবং তা তাঁর খ্যাতিরও কারণ। তবে তিনি হতাশার পরেই ব্যক্ত করেছিলেন জীবনমুক্তির পন্থারূপে মার্কসীয় বিশ্বদীক্ষার অনিবার্যতা। তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব গদ্য কবিতা সৃষ্টিতে, চিত্রকল্পধর্মী কবিতা রচনায়। পরে অবশ্য ভাবাদর্শের ধারাটি তাঁকে নিয়ে গেছে ইতিহাসের দীর্ঘ আঙ্গিকে। জীবনের অনুষঙ্গ ও পর্যবেক্ষণে তাঁর কাব্যদৃষ্টি হয়েছিল তীক্ষè, কখনো-বা কর্কশ-লালিত্যময়।

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কাব্যসত্তা সম্পর্কেও হাসনাতের দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্লেষণ তাৎপর্যপূর্ণ। এই কবি জীবনের দৈনন্দিন টুকরো টুকরো অংশকে কাব্যরূপ দিয়েছেন এবং হৃদয়-উন্মোচনের দায় নিয়েছেন। এতে তাঁর চারপাশের সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাবলিও গৃহীত। সরল ও নিরাভরণ তাঁর কবিতা। তাঁরও ছিল কবিতায় ছন্দময় গদ্যময়তা প্রসারণের কাব্যনির্মিতি। ভাবালুতা-আবেগ বা রোমান্টিক ধূসরিমার বদলে এক ধরনের জীবনায়নের প্রত্যক্ষ বাস্তবতাই ছিল নীরেন্দ্রনাথের আশ্রয়। তাঁর একটি নিজস্ব বাকভঙ্গির প্যাটার্ন ছিল, যা প্রবহমান জীবন ও সুখ-দুঃখের সংসার নিয়ে গড়ে উঠেছিল। ফলে নিজস্ব ভাষা ও বানানরীতির ব্যাকরণ তাঁর কবিতায় লক্ষ করা যায়। আনন্দের প্রতি সমর্থন আর শোকের সান্ত্বনাই ধারণ করে আছে কবিতাগুলি।

বাংলাদেশের কবিদের সঙ্গে তাঁর সহমর্মী-সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও ছিল আবেগ ও মনোযোগ। ছিল বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান মৌলবাদ, প্রগতিশীল লেখক-বুদ্ধিজীবীদের সংকটদীর্ণ অবস্থা নিয়ে গভীর উদ্বেগ। জীবনের গহন হাত দিয়ে ছুঁতে চাওয়া এই কবির লেখনী ছিল সকলের কুশলকামনায় প্রীতিঘন।

খ্যাতিমান কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিসত্তা দিয়ে হাসনাত বিশেষভাবে গভীর মনোযোগী। এটি তাঁর নিজেরই চারিত্র্য যে প্রগতি ও বামপন্থার প্রতি তাঁর আজীবন সমর্থন ও সক্রিয়তা তারই নিদর্শন। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও এই তত্ত্বাদর্শে বিশ্বাসী, নিজের লেখনীতে তিনি এর পদাতিক, সাহিত্যিক যোদ্ধা। তাঁর অঙ্গীকার ও শ্রেণিসংগ্রামভিত্তিক রাজনৈতিক চেতনা কীভাবে নান্দনিক বোধে ও লাবণ্যে বিনির্মিত হয় কবিতায়-গদ্যে, তা স্মরণ করেন হাসনাত। চল্লিশের দশকের উত্তাল সময়জাত এই কবি অমর হয়ে আছেন এই কাব্যবাক্যে, ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক/ আজ বসন্ত।’ তাঁর কবিতা ছিল সহজবোধ্য, সরল ও নিরাভরণ উপমায় গাঁথা ভিন্নধর্মী উপমা-উৎপ্রেক্ষার অন্তর্বয়নে খুবই জনপ্রিয়। কলকাতা কমিউনিস্ট পার্টির সংকট-জটিলতার সঙ্গে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সম্পর্ক নিয়েও হাসনাত বিস্তারিত আলাপ করেছেন। সব মিলিয়ে সুভাষের অন্তর্জীবন ও বহির্জীবনের একটি নকশা ফুটে উঠেছে এই আলাপে। সুভাষের সৃজন ও রাজনৈতিক সংকট মূলত বাংলা কবিতা ও কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিধাজটিলতার বহুরৈখিক ইতিহাসযুক্ত।

বাংলাদেশের প্রধান কবি অভিধাযুক্ত শামসুর রাহমানের কাব্যগ্রন্থ সম্পাদনাসূত্রে হাসনাত ‘শামসুর রাহমান ও তাঁর কবিতা’ – এই রচনাটি লেখেন। এখানে তাঁর আলাপ শুরু হয় পঞ্চাশের দশকের বাংলা কবি ও কবিতার বৈশিষ্ট্য এবং প্রেক্ষাপট নিয়ে। এই আলাপ নতুন কোনো তথ্য দেয় না, তবে এই তাৎপর্য তুলে ধরে যে, পঞ্চাশের ধারাটি তিরিশের ধারারই উৎসধারা থেকে উৎসারিত নতুন মানচিত্র ও বোধ নিয়ে। বিস্তৃত পরিসরে হাসনাত আধুনিক কবিতার ইতিহাস ও পশ্চিমের প্রভাব ইত্যাদিও ব্যাখ্যা করেছেন। শামসুর রাহমান প্রসঙ্গে তাঁর কথন ও দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক, এই কবির স্বরূপ নির্ণয়ে পরিশ্রমী। রাহমান যে balance of two opposites – দুই বৈপরীত্যকে কবিতায় মিলিয়ে দেন, সেটি হাসনাতের লেখায় পরিস্ফুটিত। সেইসঙ্গে কবির সহগামী বন্ধুদের প্রভাব ও সখ্যের দিকটিও ব্যক্ত করেন – যেমন হাসান হাফিজুর রহমান, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, শহীদ কাদরী প্রমুখ। রাহমানের কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পায় ষাটের দশকে, যদিও লেখা ছাপা হয়েছিল পঞ্চাশের দিকে। তিনি প্রথম থেকেই নিজের ধরনটি খুঁজে নিয়েছিলেন, যদিও শুরুর দিকে আত্মমগ্নতা, জীবনানন্দীয় অনুষঙ্গ ও ভঙ্গির প্রভাব লক্ষ করা যায়। শামসুর রাহমানের স্বকীয়তা হলো, একদিকে ব্যক্তিময়তার চর্চা, আরেকদিকে সময় ধারায় দেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনগুলোর বিবর্তিত রূপে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখার প্রয়াস। এটি রাহমানের কবিতার পরিসরকে বিস্তৃত করেছে, ঢাকার নাগরিক জীবনের ছন্দকে তিনি আবিষ্কার করতে পেরেছেন। হাসনাতও এই সময়েই বেড়ে ওঠা ব্যক্তিত্ব, তাই অনায়াসে রাহমানের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও কবিতার বৈশিষ্ট্যকে বুঝে নিতে পেরেছিলেন, তাঁর বিবর্তন ও বিকাশকে ধরতে পেরেছিলেন, এই প্রবন্ধটি তাই রাহমান, তাঁর কবিতা ও স্বদেশের ইতিহাসে তাঁর সংলগ্নতার পরিচয়বাহী। পুরো রচনাটি অনেক তথ্যের সমাহারধন্য, খুবই স্বচ্ছ-প্রাঞ্জল বক্তব্যসমৃদ্ধ লেখাটি, নান্দনিক চেষ্টা ও ইতিহাসজ্ঞানেও সমৃদ্ধ। দীর্ঘ এই আলোচনার প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায় বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত শামসুর রাহমান রচনাবলীর ভূমিকা থেকে গৃহীত।

আমাদের বাংলা ভাষা-আন্দোলনের সৈনিক আহমদ রফিক নিয়েও রয়েছে প্রত্যয়ী স্মৃতির তন্ময় প্রকাশ। এছাড়া আছে দার্শনিক বৌদ্ধিক ব্যক্তিত্ব অশোক মিত্র, অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান, নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মা, শিল্পকর্মী হাসান ইমাম, নৃত্যশিল্পী বুলবুল চৌধুরী এবং কতিপয় কথাশিল্পী, যেমন হাসান আজিজুল হক, কথাশিল্পী মাহমুদুল হক, মন্দিরা নন্দী প্রমুখ। কথাসাহিত্য সম্পর্কে হাসনাতের জিজ্ঞাসা ও চেতনা উন্মোচিত হয়েছে হাসান আজিজুল হক ও মাহমুদুল হককে নিয়ে লেখা রচনায়।

হাসান আজিজুল হকের কথাসাহিত্যের বিস্তৃত ভুবন তাঁর বহুমুখী সৃজন ও বহুভাবনায় আলোকিত। বর্ণনাগুণে ও প্রান্তিক ভূমিহীন মানুষের সংলাপায়নে তাঁর ছোটগল্পগুলো অনন্য। শিল্পমূল্যও অনস্বীকার্য। যথারীতি হাসনাত তাঁকে স্থাপন করেছেন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, সামাজিক-রাজনৈতিক চালচিত্রে। রচনাটি জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশন-আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থাপিত হয়েছিল। তিনি, বিশেষভাবে হাসান, দেশ বিভাগ, মুক্তিযুদ্ধ, উন্মূল উদ্বাস্তুদের যন্ত্রণা ও শ্রেণিদ্বন্দ্ব নিয়েই লেখালেখি করেছেন, এখনো করে যাচ্ছেন। কথাশিল্পী মাহমুদুল হককে নিয়ে লিখিত প্রবন্ধেও হাসনাত লেখকের মূল জীবনস্বরটি ধরতে চেয়েছেন। অন্তর্ভেদী লেখক মাহমুদুল হক নিপুণ ভাষায়, চিত্রকল্পাত্মক ও ধ্বনিলালিত্যে ভরপুর নান্দনিক সত্তার অধিকারী। আর আছে শৈশবস্মৃতির বেদনা, দেশত্যাগী হওয়ার দুঃখ। মনস্তাত্ত্বিক জটিলতারও রূপকার তিনি। তেমনি মন্দিরা নন্দী প্রায়-অপরিচিত গল্পলেখকের ওই দেখা যায় বাড়ি আমার বইটির মুগ্ধপাঠ লিপিবদ্ধ করেছেন হাসনাত। এই লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি নির্মোহ। ষাটের দশকে তাঁর পদচারণা – রুচিবোধে ও মেধায় অনন্য। তাঁর লেখায় সঞ্চারিত থাকে হৃদয়মথিত চাপা কান্না, দেশত্যাগের বেদনা। হাসনাত যে এই তিনজন কথাশিল্পীর স্মৃতি স্মরণ করেন তার একটি ঐক্যসূত্র আছে, তা হলো, দেশত্যাগের মর্মন্তুদ ঘটনাজাত অন্তর্বেদনা। এঁদের জন্মভিটা, বেড়ে ওঠা, শিক্ষার্জনের সময়কালটা ধরতে চেয়েছেন আবুল হাসনাত, তাতে ফুটেছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক পালাবদলও। মন্দিরা সম্পর্কে পাঠক অবগত হয়ে সমৃদ্ধ হবেন নিঃসন্দেহে। তিনি গল্পলেখা ছাড়াও নৃত্যশিল্পচর্চাও করতেন। মনোগ্রাহী সরল বর্ণনায় তাঁকে উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে হাসনাত নিজের শিল্পচেতনাকেও প্রতিবিম্বিত করেন। তা ব্যক্তিস্মৃতিতে সীমাবদ্ধ থাকে না, হয়ে ওঠে নৈর্ব্যক্তিক। মন্দিরার গল্পরচনার বিষয়টিও ঐতিহাসিক তাৎপর্যময় – বিশেষ করে এদেশের নারীদের লেখালেখির ক্ষেত্রে। সময়, সংকট ও জীবনবোধের শ্রদ্ধামিশ্র উন্মোচনে হাসনাত এইসব ব্যক্তিত্বকে আপন আলোয় ফুটিয়ে তুলেছেন। কথাশিল্পীত্রয়ের উপস্থাপনায় তাঁদের  লেখালেখির বয়ানের সঙ্গে সঙ্গে আসে তাঁদের জীবন প্রতিবেশও, অভিজ্ঞতাও। বস্তুত, আবুল হাসনাত ব্যক্তিপ্রতিভাকে স্থাপনই করেন বিস্তৃত পটে – ইতিহাসের ধারায়, চলমান সংকটদ্বন্দ্বের সংঘর্ষে।

গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিচারণায় আসেন বুলবুল চৌধুরী, সুবীর চৌধুরী – স্ব-স্ব শিল্পকৃতি নিয়ে, জীবনকথাও থাকে তাতে। আর তাতে ফুটে ওঠে কালচিহ্নিত পরিপ্রেক্ষিত। এইসব স্মৃতির তর্পণ তখনই প্রত্যয়ী হয়ে ওঠে যখন তাতে মিশে যায় হাসনাতের ব্যক্তি-নির্বাচন, ব্যক্তিদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের অভিজ্ঞতা ও জীবনবীক্ষা। এমনকি নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মার প্রকৃতিপ্রেম, লেখালেখির বিষয়েও একই কথা প্রযোজ্য। ধীমান, প্রাজ্ঞ, আপিলা চাপিলার লেখক, অর্থশাস্ত্রজ্ঞ অশোক মিত্র কিংবা বাংলাদেশের রেহমান সোবহানের আর্থসমাজ নিয়ে ভাবনাচিন্তাকেও প্রত্যক্ষ করেন স্বদেশপরিপ্রেক্ষিতেই, কল্যাণধর্মী রাষ্ট্রকল্পনায়। প্রথম আলো পত্রিকার সম্পাদক – হাসনাতের রাজনৈতিক জীবনের একসময়ের সঙ্গী – মতিউর রহমানের বিচক্ষণতা ও দক্ষতাকেও চেতনার পরিধিতে নিয়ে আসেন। হাসনাতের এই বইয়ের তাৎপর্যই হলো একজনের স্মৃতিচারণে বহু ব্যক্তির সাহচর্যের প্রসঙ্গ এসে যায়, কারণ ব্যক্তি একা থাকে না, সবাইকে জড়িয়েই তাঁর অবস্থান তৈরি হয়। তেমনি ভূমেন্দ্র গুহর জীবনানন্দচর্চার পরিশ্রম ও প্রজ্ঞার প্রসঙ্গও উপস্থাপিত হয়। আছেন হামদি বে – কলকাতার একজন বিখ্যাত সাংবাদিক, ইংরেজি ভাষায় যাঁর লেখালেখি। কলকাতার সাহিত্যাঙ্গনে তাঁর চলাচল জীবনরসে ও বোধে ছিল আলোকসঞ্চারী।

বস্তুত, হাসনাতের বইটি স্মৃতির রোমন্থন হলেও তা জীবন্ত বাস্তবতা হয়ে ওঠে তাঁর লেখার গুণে। বহুমুখী প্রতিভা সম্পর্কে চিন্তাশীল মনটির অন্তর্লীন শ্রদ্ধাবোধ ছিল একান্তই স্বচ্ছ; কিছু ক্ষেত্রে ক্রিটিকও হন তিনি। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজের আত্ম-আয়তনকে সম্পাদনার সীমায় বেঁধে রাখলেও চোখ-কান ও বিদ্বজ্জনের সংস্পর্শ ছিল খোলা ও বিস্তৃততর। হাসনাতের ডিসকোর্স প্রগতিশীল ভাবাদর্শের অন্তর্বয়ন হওয়ায় বইটি হয়ে উঠেছে নিছক স্মৃতিকথা নয়, সময় ও চেতনার দলিলও। পরিশীলিত ব্যক্তিত্বের অধিকারী তিনি, যদিও নিজ লেখনী-সত্তাকে বহুগুণে প্রসারিত করেননি। একথাও মনে রাখি, হাসনাত মাহমুদ আল জামান নামে কবিতাও লিখে গেছেন। আলোচ্য প্রত্যয়ী স্মৃতি ও অন্যান্য বইটির পরিসর ও বৈচিত্র্যের অন্তরালে সর্বজ্ঞ দৃষ্টিসম্পন্ন গদ্য লেখকের পদচ্ছাপ সুস্পষ্ট। আমাদের গদ্যসাহিত্যের বিশেষ সঞ্চয়। সম্পাদক হিসেবে, কবি হিসেবে তাঁর মনোচারিত্র্য যতই নিবিড়মগ্ন থাকুক না কেন মূলত তিনি একজন গদ্যকার। স্মৃতির ঝাঁপিতে নিজ স্মৃতির সঞ্চয় তাই আসলে পাঠকেরও স্মৃতি-অভিজ্ঞতার তারে কম্পন তোলে, তাদের জানায়, ভাবায়, দেশকালপাত্র সম্পর্কে নতুনভাবে আলোকিত করে। এবং সম্পাদনার দায়িত্বভারে তাঁর সীমাবদ্ধ হয়ে থাকার অন্তর্বেদনাকেও ইশারাস্পন্দিত করে রাখে। হতে পারতেন বাংলা সাহিত্যের একজন মননশীল গদ্যশিল্পী। সে-সম্ভাবনা অচরিতার্থ হয়ে রইল। লোকান্তরিত হাসনাতকে জানাই অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা।